Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

লোকটা যে মরেছেই

লোকটা যে মরেছেই, এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অনেকেই দেখেছে ব্যাপারটা, পাড়ায় একটু খোঁজ-খবর করলেই সঠিক খবরটা জানা যেতে পারে। তবু সামান্য দ্বিধায় পড়ল শ্যাম, কেননা, সে যে জানালায় দাঁড়িয়ে আয়নার আলো ফেলছিল এটাও অনেকের পক্ষে দেখে থাকা সম্ভব।

সকালে উঠে তাই শ্যাম প্রথমে খবরের কাগজটা দেখল। না, তাতে কোনও মোটর-সাইক্লিস্টের মৃত্যুর খবর নেই। একজন সাইক্লিস্টের সঙ্গে একটি টেম্পো ভ্যানের ধাক্কা লেগেছিল চিৎপুরে, একটি বাচ্চা ছেলে মারা গেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে রাস্তা পার হতে গিয়ে লরির চাপায়, একজন অজ্ঞাতনামা (৪০)। লোক বাস থেকে পড়ে গিয়ে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে, আর-একজন…না, কোনও মোটরসাইক্লিস্ট নয়। কাল কলকাতায় কোনও মোটর সাইক্লিস্টেরই মৃত্যু হয়নি।

বড় হতাশ হল শ্যাম। এখন এই লোকটা, এই মোটর-সাইক্লিস্ট লোকটা যদি মরে না গিয়ে থাকে, তবে হয়তো তার হাত-পা একটু কেটেকুটে গেছে, কিংবা ভেঙেছে কয়েকটা হাড়গোড়। সে ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসবার পর লোকটা অনায়াসে তার জানালাটা খুঁজে বার করতে পারে, এবং তারপর তাকেও। তখন একদিন না একদিন অকারণে আয়নার আলো ফেলার জন্য তাকে একটা অচেনা লোকের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। শ্যাম জানে লোকটা আইনগতভাবে কিছুই করতে পারে না। তবে লোকটা খুব লম্বা চওড়া এবং নিষ্ঠুর হতে পারে। না, তাকে ভাল করে দেখেনি শ্যাম শুধু আয়নার আলো তার মুখে ফেলে জানালার নীচে বসে পড়েছিল। কেন আলো ফেলেছিল তা শ্যামের জানা নেই, তবু শ্যাম মাত্র এইটুকুই বলতে পারে।

না মশাই, আপনার ওপর আমার কোনও রাগ ছিল না। আপনাকে আমি চিনতুমই না। অনেক দিন ধরে আমার হাতে কোনও কাজ নেই, জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে, আর ক্রমে ক্রমে আমি কেমন ঠান্ডা মেরে আসছি। কাজেই শরীর-মন গরম রাখার জন্য, ঝিমিয়ে পড়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সারাদিন আমাকে নানা খেলা তৈরি করে নিতে হয়। এই সবকিছুই মশাই একটি কার্যকারণসূত্রে বাঁধা। যদি একটা মা-বাপ তোলা গালাগাল আমি সহ্য করতে পারতুম তা হলে আমি আজও থাকতুম সেই শ্যাম— যে টেলিফোন তুলে নেওয়া থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা, এই সব কাজই খুব সুন্দর এবং ভদ্রভাবে করত, যে সারাদিন কেবল নিজের কথাই ভেবে যেত এবং তা হলে এই আলো-ফেলার খেলা তাকে খেলতে হত না এবং আপনিও নিরাপদে তেমাথায় মোড় ঘুরতে পারতেন–

শ্যামের এইসব যুক্তি যে লোকটা শ্যামের মতো করেই বুঝবে তার কোনও মানে নেই। সে-ক্ষেত্রে লোকটা শ্যামের দিকে দু’-এক পা এগিয়ে আসতে পারে। তখন কী করা উচিত তাও শ্যাম ভেবে দেখল। সেক্ষেত্রে হাতের কাছে কিছু অস্ত্রশস্ত্র থাকা দরকার, দেয়ালে থাকা দরকার একটা পালিয়ে যাওয়ার গুপ্ত দরজা, আর জানালা দিয়ে নেমে যাওয়ার জন্য একটা দড়ির সিঁড়ি। কিংবা, ইতুর সঙ্গে যে ছোঁয়াছুঁয়ির খেলাটা খেলেছিল শ্যাম, সেই খেলাটাও তখন খেলা যেতে পারে। কিংবা সুবোধ মিত্রকে গিয়ে বলা যেতে পারে এক জায়গায় বেশি দিন থাকা ঠিক নয় মশাই, আসুন আমরা ঘর বদল করে ফেলি।

শ্যাম সামান্য উত্তেজনা বোধ করতে থাকে। সে দ্রুত তার ঘরের চার দিক ঘুরে ঘুরে দেখে নেয়। একটা মাত্র দরজা, তারপর অপরিসর প্যাসেজ, সিঁড়ি। জানালার কাছে এসে দেখে, প্রায় বারো-চোদ্দো ফুট নীচে শান বাঁধানো ফুটপাথ। ফিরে আবার ঘরের দিকে চেয়ে দেখে শ্যাম। চিন্তায় তার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। ডান দিকের দেয়ালে বাথরুমের পলকা দরজা। নিজেকে খুব নিরাপদ মনে হয় না শ্যামের। কোনওখানেই নেই লুকিয়ে থাকবার নিরাপদ জায়গা, বা পালিয়ে যাওয়ার সহজ পথ। লোকটা যদি খুব গায়ের জোরওয়ালা নোক হয়, যদি খুব লম্বা-চওড়া, নিষ্ঠুর হয়, তা হলে আত্মরক্ষার জন্য শ্যামকে একটু প্রস্তুত থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় শ্যাম ঘরের ভিতরে অদৃশ্য এবং অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের তাড়া খেয়ে এদিক-ওদিক দ্রুত সরে গেল। লাফ মেরে উঠল চৌকিতে, কয়েক পাক ঘুরল, বাতাসে ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে গেল, ঘুষি মারল দেয়ালে যেমন ঘুষি খেয়ে একবার রূপশ্রী ফার্নিচার্সের ওয়ার্ডরোবের পাল্লাটা চোট খেয়েছিল, আর দেয়ালের একটা দুর্বল অংশের চুনবালি পড়েছিল খসে।

তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে শ্যাম আপনমনে বলল, না মশাই, আপনার ওপর আমার কোনও রাগ নেই। ছিলও না। বলতে বলতে বাতাসে হাত এগিয়ে দিল শ্যাম খুব বিনীতভাবে, অদৃশ্য এবং অনুপস্থিত লোকটার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল, তারপর বলল, চা খাবেন?…হা হা বসুন, বিছানাতেই বসুন, কিংবা বলতে বলতে শ্যাম ঘরের একমাত্র চেয়ারটাকে জানালার কাছে টেনে আনল, কিংবা এই চেয়ারটায় বসুন, রোদে পিঠ দিয়ে। চমৎকার আরাম লাগবে, তারপর আমি আপনাকে দেব। গরম-গরম এক কাপ চা–

বলতে বলতে শ্যাম সারা ঘরে পায়চারি করে বেড়ায়, না, আপনাকে খুব একটা খারাপ দেখাচ্ছে না। যদিও আপনার মুখটা একটু কেটেকুটে গেছে, একটা হাতে এখনও ব্যান্ডেজ, তবুও আপনাকে বেশ বীরের মতোই দেখাচ্ছে অনেকটা যুদ্ধফেরত সোলজারের মতোই। আপনি কি বিবাহিত? না? তা হলে আরও ভাল, এই অবস্থাতে আপনি মেয়েদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করতে পারবেন। আমাদের দেশের মেয়েরা বীরপুরুষ ছেলেদের দেখাই পায় না, যে পুরুষ তারা দেখে সে-সব ছোকরারা মিনমিন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েদের স্কুল কলেজের আশেপাশে, যাতায়াতের রাস্তায়, পিছু নিচ্ছে কিছুদূর পর্যন্ত, ভুল বানানে লিখছে প্রেমপত্র, পরিচয় হলে নিয়ে যাচ্ছে বড়জোর লেক বা ময়দানে, ভিক্টোরিয়ায় বা পার্কে, তারপর সেখানে বসে…থাকগে! আসল কথা, আহত পুরুষ মেয়েরা পছন্দ করে। তা ছাড়া, আপনাকে ষাঁড়ে গুঁতিয়ে দেয়নি, আপনি টেম্পো বা ঠেলাগাড়ির ধাক্কা খাননি, রাস্তার হামেশা হাঙ্গামায় বেমক্কা ইটের টুকরো এসে পড়েনি আপনার গায়ে আপনি খানাখন্দেও পড়ে যাননি। আপনি আহত হয়েছেন মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনায়। ব্যাপারটার মধ্যে একটু বীরত্বের গন্ধ আছে? বলতেই চোখে ছবি ভেসে ওঠে–একটু অহংকারী, সাহসী ছুটন্ত এক পুরুষ দুটো ছড়ানো হাতে বুনো ঘোড়ার ঝুঁটির মতো ধরে-থাকা মোটরসাইকেলের কঁপা হাতল, বুক চিতিয়ে, পা বাঁকিয়ে বসে থাকার সেই উগ্র ভঙ্গি, হাওয়ায় উড়ছে চুল, শার্টের কলার এলোমেলো, দাঁতে টিপে রাখা একরোখা একটু হাসি…চমৎকার নয়! ছেলেবেলা থেকেই মোটর-সাইক্লিস্টদের আমি ওই চোখে দেখে আসছি। বলতে কী, আমার জীবনের একসময়ে একমাত্র লক্ষ্য ছিল বেপরোয়া একজন মোটর-সাইক্লিস্ট হয়ে যাওয়া–আর কিছু নয়–কেবল খুব ছুটন্তু একটা মোটর-সাইকেলে ওইভাবে বসে থাকা। সেই কারণেই আমার সতেরো-আঠারো বছর বয়সে প্রথম কলকাতায় এসে আমি সার্জেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছিলুম। কোমরে ধূসর রঙের পিস্তল, মাথায় কালো টুপি আর ওই লাল মোটর-সাইকেল! সার্জেন্ট দেখলে আমি রাস্তার সুন্দরী মেয়েদেব লক্ষই করতুম না…

চেয়ারে অদৃশ্য লোকটা নড়ে ওঠে যেন।

শ্যাম সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে বলে, না মশাই, আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কিছু বলছি না, একথা সত্যিই যে খেলার জন্যও আপনার মুখে আয়নার আলো ফেলা ঠিক হয়নি…কিন্তু দেখুন, আমারও কিছু করার নেই। বড় অসময় চলছে…সকাল থেকেই দিন লম্বা হতে শুরু করে, সন্ধে থেকেই রাত অফুরান মনে হয়। কিছুই ঘটে না, বস্তুত কিছুই ঘটে না। দিনে দু’বার চিঠির বাক্স খুলি; আমি…পাখির বাসার মতো ছোট্ট চিঠির বাক্স খুলতে গিয়ে প্রতিবার মনে হয় দরজা খুললেই লাফিয়ে পড়বে একটা খরগোশের বাচ্চা, কিংবা হাত দিলেই পাওয়া যাবে গোলাপি কাগজে মোড়া কোনও উপহার, কিংবা অচেনা মেয়ের লেখা ভালবাসার চিঠি। কিছুই ঘটে না, বস্তুত কিছু ঘটে না।…সকালে উঠে মনে হয় আজ কেউ আসবে খুব অচেনা রহস্যময় কেউ—যাকে দেখে মনে হবে চেনা, অথচ চেনা যাবে না, এবং যে যাওয়ার সময় কিছু রহস্য রেখে যাবে; ঘুমোবার সময়ে মনে হয় আজ স্বপ্নের ভিতরে আমি পেয়ে যাব কোনও দৈব শিকড়বাকড়, ক্যানসারের ওষুধ কিংবা গুপ্তধনের সন্ধান; কুয়াশার রাস্তায় হাটবার সময়ে, মনে হয়, কুয়াশা কেটে গেলেই দেখতে পাব আমি হঠাৎ অচেনা বিদেশে পৌঁছে গেছি, যেখানে খাওয়ার লোক নেই বলে ইলিশের ঝক চলে যাচ্ছে সমুদ্রে, গোরুর বাঁট থেকে খসে পড়ছে দুধ, চাক থেকে মধু চুইয়ে মাটি যাচ্ছে ভিজে, যেখানে সৎ ব্যবসায়িরা দোকান সাজিয়ে বসে আছে যেখানে সারা দেশে এক দাম, যেখানে শান্ত ধার্মিক মানুষেরা ধীর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সারা বছর যেখানে চলেছে উৎসব…

শ্যাম চেয়ারটার সামনে এসে দাঁড়ায়, মাথা নাড়ে–কিছুই ঘটে না! বস্তুত কিছুই ঘটে না।

তারপর শ্যাম বিনীতভাবে অদৃশ্য অনুপস্থিত লোকটাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, আচ্ছা, আবার দেখা হবে…

ঘরের মাঝখানে আবার ফিরে আসে শ্যাম, বিষণ্ণভাবে চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ‘ইয়াঃ’ বলে চমকে হেসে ওঠে। সিগারেট ধরিয়ে আবার খবরের কাগজটা তুলে নেয়, গুনগুন করে বলে, মাই গু-উ-উ-নেস, আই কুডনট কিল দ্যা ম্যান।

ঘরের চারি দিকে অন্যমনে চেয়ে দেখে শ্যাম–নাঃ, বস্তুত কোথাও নেই লুকিয়ে থাকবার জায়গা, কিংবা পালিয়ে যাওয়ার সহজ পথ।

.

দুপুরে বেরোনোর সময় শ্যাম তিনটে চিঠি পেল।

জীবনবিমার প্রিমিয়ামের চিঠি, খামের উপর দুহাতে আড়াল করা প্রদীপের ছবি। আপনার জীবন মূল্যবান। ইলেকট্রিকের বিল, আর পাকিস্তানের কালচে খামে বাবার চিঠি। কোনওটাই ভাল করে পড়ে দেখে না শ্যাম। বাবার চিঠির দিকে চেয়ে থাকে, মাঝে মাঝে হঠাৎ এক-আধটা লাইন চোখে পড়ে–সঞ্চয়ি না হইলে ভবিষ্যতে নিরুপায় হইবা…এতদূর হইতে আমরা তোমার জন্য আর কী করিতে পারি, ভরসা একমাত্র দয়াল ঠাকুর…চাকুরীর বন্দোবস্ত হইল কিনা সত্বর জানাইবা…সোনাকাকা ও রাঙাপিসির খোঁজখবর লইও, অভাবের সময়ে আত্মীয়স্বজন…আশু গাঙ্গুলীর সহিত দেখা করিও। সে আমার বাল্যবন্ধু, হাওড়ায় তিনটা লোহার কারখানা, ডোভার লেনে চারিতলা বাড়ি, গাড়ি…জমিজমা আর কিনিতে ভরসা হয় না, অসময় পড়িয়াছে…সময় থাকিতে হিন্দুস্থানে না যাওয়া অবিবেচকের কাজ হইয়াছে…এখানে গঙ্গা নাই, বড় দুঃখ…ধনভাইয়ের শ্রাদ্ধ হইয়া গেল, সমারোহ হয় নাই, হিন্দুস্থান হইতে তাহার ছেলেরা আসিতে পারে নাই, জ্ঞাতিরা মুখাগ্নি করিয়াছে…বড় ভয় হয়…তোমার মায়ের অবস্থা পূর্ববৎ শয্যাশায়ি, পুলিনের বউ আসিয়া রান্নাবান্নার কাজ করিয়া দিয়া যায়…তোমার মা ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে তোমার নাম ধরিয়া ডাকেন…ওখানে জিনিসপত্রের দাম…চালের দাম যাহা শুনি, তাহাতে আশ্চর্য হইতে হয়…বাঙালির ছেলে, দু’বেলা ভাত না খাইলে শরীর থাকে না…সাবধানে থাকিও…এখন ঠাকুর ভরসা…তোমাকে সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে নিশ্চিন্তে চোখ বুজিতাম।

দশ বছর আগে বাবা শেষবার এসেছিল কলকাতায়, শেয়ালদায় আনতে গিয়েছিল শ্যাম। দেখল, যেন একটা অচেনা লোক, একটু কুঁজো, কালো রোগা চেহারা। প্রণাম করতেই পিঠে হাত রেখেছিল বাবা, কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপেছিল, মনু কেমন আছ? যে কয়দিন ছিল, বাবা একটুও স্থির থাকেনি। কাঁচড়াপাড়া, হালিশহর, বৈঁচীগ্রাম, সোদপুর কিংবা ডায়মন্ড হারবার ঘুরে বেড়িয়েছিল আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি। তাকে ডেকে বলত, মনু চিন্যা রাখ। আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্ঠি চিন্যা রাখতে হয়, বিপদে আপদে আপনা রক্তের মানুষ কামে লাগে। এদিকে জমিজমার খোঁজ করেছিল, সম্পত্তি বিনিময়ের চেষ্টাও হয়েছিল একটু, তারপর বলেছিল, আমাগো আর আহন হইব না। ভাল লাগে না রে মনু, এই দ্যাশ বড় রুঠা! পাকিস্তান উঠে যাবে কি না সে খোঁজখবরও একটু নিয়েছিল বাবা। মা পাঠিয়েছিল আমসত্ত্ব, গোকুল পিঠে আর নতুন কাপড়। মাসখানেক পরে বনগাঁয়ের সীমানা পর্যন্ত বাবাকে এগিয়ে দিয়ে এসেছিল শ্যাম। মনু, ভাল থাইকো—এই কথা বলে বাবা এদেশের সীমা ডিঙিয়ে গেল।

এখন, এই যে লোকটা তাকে চিঠি লেখে, তার ভালমন্দের খবর নেয়–এ লোকটা কে! বাবা? কীরকম বাবা। তার মুখ মনে পড়ে না, ভিনদেশি এক অচেনা লোক, ভিটের মায়া ছেড়ে আসতে পারেনি— এ লোকটার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? শ্যামের বাক্সে বাবা-মার একটা জোড়ের ফটো আছে। পিছনে রাজবাড়ির সিন্ ফেলা, পাশে টব, সুতির ডোরাকাটা একটা কোট গায়ে, ধুতি আর পাম্প-৩ পরা গ্রাম্য লোকটা বুক চিতিয়ে বসে আছে, পাশে ধোয়া পাট-ভাঙা জংলা-পেড়ে শাড়ি-পরা মা–জবুথবু, ছোট্ট একটুখানি মানুষ, ক্যামেরার লেনসের দিকে কৌতুহলী চোখ। বিশ্বাস হতে চায় না যে এঁরা শ্যামের মা বাবা, এঁরাই তার জন্মের কারণ। এঁরাও তো জানেন না শ্যাম কে, কিংবা কোথা থেকে এল!

না, বহুকাল আর সেই ছবি বের করে দেখে না শ্যাম, আগে মায়ের জন্য কাঁদত, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কিংবা নতুন চাকরিতে যাওয়ার সময়ে প্রণাম করে যেত ওই ছবি। তারপর আস্তে আস্তে কপূরের গন্ধের মতো মন থেকে মুছে গেছে ওই দুটি মুখ। মনে পড়ে না, আর তেমন করে মনে পড়ে না। কেবল মাঝে মাঝে হরিধ্বনি দিয়ে যখন মড়া নিয়ে যায়, তখন চমকে উঠে মনে পড়ে কুয়োতলা, ঘাটে যাওয়ার মেঠো পথ, করমচার গাছ, পরে লাফিয়ে পড়ছে ব্যাঙ; মনে পড়ে, প্রকাণ্ড এক অন্ধকারের মধ্যে উত্তরের ঘরের দাওয়ায় ছোট্ট একটু হ্যারিকেনের আলো কোলে করে মা বসে আছে মুখের চামড়ায় নেমেছে শিকড়বাকড়, কথা বলতে গেলে মাথা কাপে—সামনের অন্ধকার, এক-আকাশ অস্পষ্ট নক্ষত্র, আর রক্তের মধ্যে অতি দুর্বোধ্য মৃত্যুর হিম অনুভব করতে করতে অসহায় মা বীজমন্ত্র ভুলে গিয়ে বিড়বিড় করে বলে চলেছে—”মনু, মনু রে, অ মনু মনু…মনু, মনু রে, অ মনু…’।

মনে মনে শ্যাম প্রশ্ন করে, তুমি আমার কে? তোমরা কারা? না, আমি তোমাদের চিনি না। তারপর চমকে ওঠে সে, অস্থির হয়ে আবার বিড়বিড় করে বলে, তোমরা ভাল থেকো। বেঁচে থেকো। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ভাল আছি। আমি খুব ভাল আছি। দেখো, একদিন খুব সুসময় এসে যাবে। ভাল জমিতে আমরা তুলব ঘড়বাড়ি, তৈরি করব বাগান, মাছ ছেড়ে দেব পুকুরে, ছাড়া জমিতে বসিয়ে দেব জ্ঞাতিদের ঘর, এক-আধজন বোষ্টম, আর ধোপানাপিত। দূর বিদেশ থেকে আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব, আমি নৌকো বোঝাই করে নিয়ে আসব সুদিন…। সেই কবে ছেলেবেলায় শোনা ঘুমপাড়ানি গান গুনগুন করে শ্যাম, মায়রে দিলাম ডবল শাঁখা, ভাই করাইলাম বিয়া, বাপরে দিলাম সোনার মটুক, তীর্থ কর গিয়া…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *