বিমলার আত্মকথা
আজ সকালে অমূল্যর কলকাতা থেকে ফেরবার কথা। বেহারাকে বলে রেখেছি, সে এলেই যেন খবর দেয়। কিন্তু স্থির থাকতে পারছি নে। বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে বসে রইলুম।
অমূল্যকে যখন আমার গয়না বেচবার জন্যে কলকাতায় পাঠালুম তখন নিজের কথা ছাড়া আর কোনাে কথা বুঝি মনেই ছিল না। এ কথা একবারও আমার বুদ্ধিতে এলই না যে, সে ছেলেমানুষ, অত টাকার গয়না কোথাও বেচতে গেলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে। মেয়েমানুষ, আমরা এত অসহায় যে আমাদের নিজের বিপদ অন্যের ঘাড়ে না চাপিয়ে আমাদের যেন উপায় নেই। আমরা মরবার সময় পাঁচজনকে ডুবিয়ে মারি।
বড়াে অহংকার করে বলেছিলুম, অমূল্যকে বাঁচাব। যে নিজে তলিয়ে যাচ্ছে সে নাকি অন্যকে বাঁচাতে পারে! হায় হায়, আমিই বুঝি ওকে মারলুম! ভাই আমার, আমি তাের এমনি দিদি, যেদিন মনে মনে তাের কপালে ভাইফেঁটা দিলুম সেইদিনই বুঝি যম মনে মনে হাসলে। আমি যে অকল্যাণেরই বােঝা নিয়ে ফিরছি আজ।
আমার আজ মনে হচ্ছে, মানুষকে এক-এক সময় যেন অমঙ্গলের প্লেগে ধরে। হঠাৎ কোথা হতে তার বীজ এসে পড়ে, আর এক রাত্রেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। সেই সময়ে সকল সংসার থেকে খুব দূরে কোথাও তাকে সরিয়ে রাখা যায় না কি? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তার ছোঁয়াচ বড়াে ভয়ানক। সে যে বিপদের মশালের মতো, নিজে পুড়তে থাকে সংসারে আগুন লাগাবার জন্যেই।
নটা বাজল। আমার কেমন বােধ হচ্ছে, অমূল্য বিপদে পড়েছে, ওকে পুলিসে ধরেছে। আমার গহনার বাক্স নিয়ে থানায় গােলমাল পড়ে গেছে। কার বাক্স ও কোথা থেকে পেলে, তার জবাব তাে শেষকালে আমাকেই দিতে হবে— সমস্ত পৃথিবীর লােকের সামনে কী জবাবটা দেব? মেজোরানী, এতকাল তােমাকে বড়াে অবজ্ঞাই করেছি। তােমার দিন এল। তুমি আজ সমস্ত পৃথিবীর রূপ ধরে শােধ তুলবে। হে ভগবান, এইবার আমাকে বাঁচাও—আমার সমস্ত অহংকার ভাসিয়ে দিয়ে মেজোরানীর পায়ের তলায় পড়ে থাকব।
আর থাকতে পারলুম না, তখনই বাড়ি-ভিতরে মেজোরানীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তিনি তখন বারান্দায় রােদ্দুরে বসে পান সাজছেন, পাশে থাকো বসে। থাকোকে দেখে মুহূর্তের জন্যে মনটা সংকুচিত হল, তখনই সেটা কাটিয়ে নিয়ে মেজোরানীর পায়ের কাছে পড়ে তাঁর পায়ের ধুলাে নিলুম।
তিনি বলে উঠলেন, ও কী লাে ছােটোরানী, তাের হল কী? হঠাৎ এত ভক্তি কেন!
আমি বললুম, দিদি, আজ আমার জন্মতিথি। অনেক অপরাধ করেছি। করাে দিদি, আশীর্বাদ করাে, আর যেন কোনােদিন তােমাদের কোনাে দুঃখ না দিই। আমার ভারি ছােটো মন।
বলেই তাঁকে আবার প্রণাম করে তাড়াতাড়ি উঠে এলুম। তিনি পিছন থেকে বলতে লাগলেন, বলি ও ছুটু, তাের জন্মতিথি, এ কথা আগে বলিস নি কেন? আমার এখানে দুপুরবেলা তাের নেমন্তন্ন রইল। লক্ষ্মী বােন, ভুলিস নে।
ভগবান, এমন কিছু করাে যাতে আজ আমার জন্মতিথি হয়। একেবারে নতুন হতে পারি নে কি? সব ধুয়ে মুছে আর-একবার গােড়া থেকে পরীক্ষা করাে প্রভু।
বাইরের বৈঠকখানা-ঘরে যখন ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় সেখানে সন্দীপ এসে উপস্থিত হল। বিতৃষ্ণায় সমস্ত মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। আজ সকালের আলােয় তার যে মুখ দেখলুম তাতে প্রতিভার জাদু একটুও ছিল না। আমি বলে উঠলুম, আপনি যান এখান থেকে।
সন্দীপ হেসে বললে, অমূল্য তাে নেই, এবার বিশেষ কথার পালা যে আমার।
পােড়া কপাল! যে অধিকার আমিই দিয়েছি সে অধিকার আজ ঠেকাই কী করে? বললুম, আমার একলা থাকবার দরকার আছে।
রানী, আর-একজন লােক ঘরে থাকলেও একলা থাকার ব্যাঘাত হয় না। আমাকে তুমি মনে কোরাে না ভিড়ের লােক— আমি সন্দীপ, লক্ষ লােকের মাঝেও আমি একলা।
আপনি আর-এক সময় আসবেন, আজ সকালে আমি—
অমূল্যর জন্যে অপেক্ষা করছেন?
আমি বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উদ্যােগ করছি, এমন সময় সন্দীপ তার শালের ভিতর থেকে আমার গয়নার বাক্স বের করে ঠক্ করে পাথরের টেবিলের উপর রাখলে।
আমি চমকে উঠলুম। বললুম, তা হলে অমূল্য যায় নি?
কোথায় যায় নি?
কলকাতায়?
সন্দীপ একটু হেসে বলল, না।
বাঁচলুম। আমার ভাইফোঁটা বাঁচল। আমি চোর, বিধাতার দণ্ড ঐ পর্যন্তই পৌঁছােক— অমূল্য রক্ষা পাক্।
সন্দীপ আমার মুখের ভাব দেখে বিদ্রূপ করে বললে, এত খুশি রানী? গয়নার বাক্সের এত দাম? তবে কোন্ প্রাণে গয়না দেবীর পূজায় দিতে চেয়েছিলে? দিয়ে তাে ফেলেছ, দেবতার হাত থেকে আবার কি ফিরিয়ে নিতে চাও?
অহংকার মরতে মরতেও ছাড়ে না। ইচ্ছে হল দেখিয়ে দিই, এ গয়নার ’পরে আমার সিকি পয়সার মমতা নেই। আমি বললুম, এ গয়নায় আপনার যদি লােভ থাকে নিয়ে যান-না।
সন্দীপ বললে, আজ বাংলাদেশে যেখানে যত ধন আছে সমস্তর ’পরেই আমার লােভ। লােভের মতাে এত বড়াে মহৎ বৃত্তি কি আর কিছু আছে? পৃথিবীর যারা ইন্দ্র লােভ তাদের ঐরাবত। তা হলে এ-সমস্ত গয়না আমার?
এই বলে সন্দীপ বাক্সটি তুলে নিয়ে শালের মধ্যে ঢাকা দিতেই অমূল্য ঘরের মধ্যে ঢুকল। তার চোখের গােড়ায় কালি পড়েছে, মুখ শুকনাে, উষ্কখুষ্ক চুল। একদিনেই তার তরুণ-বয়সের লাবণ্য যেন ঝরে গিয়েছে। তাকে দেখবামাত্রই আমার বুকের ভিতরটায় কামড়ে উঠল।
অমূল্য আমার দিকে না তাকিয়েই একেবারে সন্দীপকে গিয়ে বললে, আপনি গয়নার বাক্স আমার তােরঙ্গ থেকে বের করে এনেছেন?
গয়নার বাক্সটা তােমারই নাকি?
না, কিন্তু তােরঙ্গ আমার।
সন্দীপ হা হা করে হেসে উঠল। বললে, তােরঙ্গ সম্বন্ধে আমি-তুমির ভেদবিচার তাে তােমার বড়াে সূক্ষ্ম হে অমূল্য! তুমিও মরবার আগে ধর্মপ্রচারক হয়ে মরবে দেখছি।
অমূল্য চৌকির উপর বসে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মাথা রাখলে। আমি তার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললুম, অমূল্য, কী হয়েছে?
তখনই সে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দিদি, এ গয়নার বাক্স আমিই নিজের হাতে তােমাকে এনে দেব এই আমার সাধ ছিল। সন্দীপবাবু তা জানতেন, তাই উনি তাড়াতাড়ি—
আমি বললুম, কী হবে আমার ঐ গয়নার বাক্স নিয়ে! ও যাক-না, তাতে ক্ষতি কী?
অমূল্য বিস্মিত হয়ে বললে, যাবে কোথায়?
সন্দীপ বললে, এ গয়না আমার। এ আমার রানীর দেওয়া অর্ঘ্য।
অমূল্য পাগলের মতাে বলে উঠল, না না না— কখনােই না। দিদি, এ আমি তােমাকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছি, এ তুমি আর কাউকে দিতে পারবে না।
আমি বললুম, ভাই, তােমার দান চিরদিন আমার মনে রইল, কিন্তু গয়নায় যার লােভ সে নিয়ে যাক-না।
অমূল্য তখন হিংস্র জন্তুর মতাে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে গুম্রে গুম্রে বললে, দেখুন সন্দীপবাবু, আপনি জানেন আমি ফাঁসিকে ভয় করি নে। এ গয়নার বাক্স যদি আপনি নেন—
সন্দীপ বিদ্রূপের হাসি হাসবার চেষ্টা করে বললে, অমূল্য, তােমারও এতদিনে জানা উচিত তােমার শাসনকে আমি ভয় করি নে। মক্ষীরানী, এ গয়না আজ আমি নেব বলে আসি নি, তােমাকে দেব বলেই এসেছিলুম। কিন্তু আমার জিনিস তুমি যে অমূল্যর হাত থেকে নেবে সেই অন্যায় নিবারণ করবার জন্যেই প্রথমে এ বাক্সে আমার দাবি স্পষ্ট করে তােমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলুম। এখন আমার এই জিনিস তােমাকে আমি দান করছি, এই রইল। এবারে ঐ বালকের সঙ্গে তুমি বােঝাপড়া করাে, আমি চললুম। কিছুদিন থেকে তােমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা চলছে, আমি তার মধ্যে নেই। যদি কোনাে বিশেষ ঘটনা ঘটে ওঠে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। অমূল্য, তােমার তােরঙ্গ বই প্রভৃতি যা-কিছু আমার ঘরে ছিল সমস্তই বাজারে তােমার বাসাঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ঘরে তােমার কোনাে জিনিস রাখা চলবে না।
এই বলে সন্দীপ তাড়াতাড়ি ঘরে থেকে চলে গেল।
আমি বললুম, অমূল্য, তােমাকে আমার গয়না বিক্রি করতে দিয়ে অবধি আমার মনে শান্তি ছিল না।
কেন দিদি?
আমার ভয় হচ্ছিল, এ গয়নার বাক্স নিয়ে পাছে তুমি বিপদে পড়, পাছে তােমাকে কেউ চোর বলে সন্দেহ করে ধরে। আমার সে ছ হাজার টাকায় কাজ নেই। এখন আমার একটি কথা তােমাকে শুনতে হবে। এখনই তুমি বাড়ি যাও। যাও তােমার মায়ের কাছে।
অমূল্য চাদরের ভিতর থেকে একটা পুঁটুলি বের করে বললে, দিদি, ছ হাজার টাকা এনেছি।
জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় পেলে?
তার কোনাে উত্তর না দিয়ে বললে, গিনির জন্যে অনেক চেষ্টা করলুম, সে হল না, তাই নােট এনেছি।
অমূল্য, মাথা খাও, সত্যি করে বলাে এ টাকা কোথায় পেলে?
সে আপনাকে বলব না।
আমি চোখে যেন অন্ধকার দেখতে লাগলুম। বললুম, কী কাণ্ড করেছ অমূল্য? এ টাকা কি—
অমূল্য বলে উঠল, আমি জানি, তুমি বলবে এ টাকা আমি অন্যায় করে এনেছি। আচ্ছা, তাই স্বীকার। কিন্তু, যত বড়াে অন্যায় তত বড়ােই দাম, সে দাম আমি দিয়েছি। এখন এ টাকা আমার।
এ টাকার সমস্ত বিবরণ আমার আর শুনতে ইচ্ছে হল না। শিরগুলাে সংকুচিত হয়ে আমার সমস্ত শরীরকে যেন গুটিয়ে আনতে লাগল। আমি বললুম, নিয়ে যাও অমূল্য, এ টাকা যেখান থেকে নিয়ে এসেছ এখনই সেখানে দিয়ে এসাে।
সে যে বড়াে শক্ত কথা।
না, শক্ত নয় ভাই! কী কুক্ষণে তুমি আমার কাছে এসেছিলে! সন্দীপও তােমার যত বড়ো অনিষ্ট করতে পারে নি আমি তাই করলুম।
সন্দীপের নামটা যেন তাকে খোঁচা মারলে। সে বললে, সন্দীপ! তােমার কাছে এলুম বলেই তাে ওকে চিনতে পেরেছি। জান দিদি? তােমার কাছ থেকে সেদিন ও যে ছ হাজার টাকার গিনি নিয়ে গেছে তার থেকে এক পয়সাও খরচ করে নি। এখান থেকে গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রুমাল থেকে সমস্ত গিনি মেজের উপর ঢেলে রাশ করে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বললে, এ টাকা নয়, এ ঐশ্বর্য-পারিজাতের পাপড়ি। এ অলকাপুরীর বাঁশি থেকে সুরের মতাে ঝরে পড়তে পড়তে শক্ত হয়ে উঠেছে। একে তাে ব্যাঙ্কনােটে ভাঙানাে চলে না, এ যে সুন্দরীর কণ্ঠহার হয়ে থাকবার কামনা করছে। ওরে অমূল্য, তােরা একে স্থূল দৃষ্টিতে দেখিস নে। এ হচ্ছে লক্ষ্মীর হাসি, ইন্দ্রাণীর লাবণ্য। না না, ঐ অরসিক নায়েবটার হাতে পড়বার জন্যে এর সৃষ্টি হয় নি। দেখাে অমূল্য, নায়েবটা নিছক মিথ্যা কথা বলেছে, পুলিস সেই নৌকোচুরির কোনাে খবর পায় নি। ও এই সুযােগে কিছু করে নিতে চায়। দেখাে অমূল্য, নায়েবের কাছ থেকে সেই চিঠি তিনটে আদায় করতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেমন করে? সন্দীপ বললে, জোর করে, ভয় দেখিয়ে। আমি বললুম, রাজি আছি, কিন্তু এই গিনিগুলি ফিরিয়ে দিতে হবে।— সন্দীপ বললে, আচ্ছা, সে হবে— কেমন করে ভয় দেখিয়ে নায়েবের কাছ থেকে সেই চিঠিগুলি আদায় করে পুড়িয়ে ফেলেছি সে অনেক কথা। সেই রাত্রেই আমি সন্দীপের কাছে এসে বলেছি, আর ভয় নেই, গিনিগুলি আমাকে দিন, কাল সকালেই আমি দিদিকে ফিরিয়ে দেব।— সন্দীপ বললে, এ কোন মােহ তােমাকে পেয়ে বসল! এবার দিদির আঁচলে দেশ ঢাকা পড়ল বুঝি! বলাে বন্দে মাতরং। ঘাের কেটে যাক।— তুমি তাে জান দিদি, সন্দীপ কী মন্ত্র জানে। গিনি তারই কাছে রইল। আমি অন্ধকার রাত্রে পুকুরের ঘাটের চাতালের উপরে বসে বন্দে মাতরং জপতে লাগলুম। কাল যখন তুমি গয়না বেচতে দিলে তখন সন্ধ্যার সময় আবার ওর কাছে গেলুম। বেশ বুঝলুম, তখন ও আমার উপরে রাগে জ্বলছে। সে রাগ প্রকাশ করলে না। বললে, দেখাে, যদি আমার কোনাে বাক্সয় যদি সে গিনি থাকে তাে নিয়ে যাও।— বলে আমার গায়ের উপর চাবির গােছাটা ফেলে দিলে। কোথাও নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় রেখেছেন বলুন। সন্দীপ বললে, আগে তােমার মােহ ভাঙবে তার পরে আমি বলব। এখন নয়।— আমি দেখলুম, কিছুতেই তাকে নড়াতে পারব না, তখন আমাকে অন্য উপায় নিতে হয়েছিল। এর পরেও ওকে ছ হাজার টাকার নােট দেখিয়ে সেই গিনি-ক’টা নেবার অনেক চেষ্টা করেছি। গিনি এনে দিচ্ছি বলে আমাকে ভুলিয়ে রেখে ওর শােবার ঘর থেকে আমার তােরঙ্গ ভেঙে গয়নার বাক্স নিয়ে তােমার কাছে এসেছে। এ বাক্স তােমার কাছে আমাকে নিয়ে আসতে দিলে না। আবার বলে কিনা, এ গয়না ওরই দান! আমাকে সে কতখানি বঞ্চিত করেছে সে আমি কাকে বলব? এ আমি কখনাে মাপ করতে পারব না। দিদি, ওর মন্ত্র একেবারে ছুটে গেছে। তুমিই ছুটিয়ে দিয়েছ।
আমি বললুম, ভাই আমার, আমার জীবন সার্থক হয়েছে। কিন্তু অমূল্য, এখনাে বাকি আছে। শুধু মায়া কাটালে হবে না, যে কালি মেখেছি সে ধুয়ে ফেলতে হবে। দেরি কোরাে না অমূল্য, এখনি যাও, এ টাকা যেখান থেকে এনেছ সেইখানেই রেখে এসাে। পারবে না, লক্ষ্মী ভাই?
তােমার আশীর্বাদে পারব দিদি।
এ শুধু তােমার একলার পারা নয়, এর মধ্যে যে আমারও পারা আছে। আমি মেয়েমানুষ, বাইরের রাস্তা আমার বন্ধ। নইলে তােমাকে আমি যেতে দিতুম না, আমিই যেতুম। আমার পক্ষে এইটেই সব চেয়ে কঠিন শাস্তি যে, আমার পাপ তােমাকে সামলাতে হচ্ছে।
ও কথা বােলাে না দিদি! যে রাস্তায় চলেছিলুম সে তােমার রাস্তা নয়। সে রাস্তা দুর্গম বলেই আমার মনকে টেনেছিল। দিদি, এবার তােমার রাস্তায় ডেকেছ— এ রাস্তা আমার আরাে হাজার গুণে দুর্গম হােক, কিন্তু তােমার পায়ের ধুলাে নিয়ে জিতে আসব। কোনাে ভয় নেই। তা হলে এ টাকা যেখান থেকে এনেছি সেইখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে, এই তােমার হুকুম?
আমার হুকুম নয় ভাই, উপরের হুকুম।
সে আমি জানি নে। সেই উপরের হুকুম তােমার মুখ দিয়ে এসেছে এই আমার যথেষ্ট। কিন্তু দিদি, তােমার কাছে আমার নেমন্তন্ন আছে। সেইটে আজ আদায় করে তবে যাব। প্রসাদ দিতে হবে। তার পরে সন্ধের মধ্যেই যদি পারি কাজ সেরে আসব।
হাসতে গিয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল। বললুম, আচ্ছা।
অমূল্য চলে যেতেই আমার বুক দমে গেল। কোন মায়ের বাছাকে বিপদে ভাসালুম! ভগবান, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত এমন সর্বনেশে ঘটা করে কেন? এত লােককে নিমন্ত্রণ? আমার একলায় কুলােল না? এত মানুষকে দিয়ে তার ভার বহন করাবে? আহা, ঐ ছেলেমানুষকে কেন মারবে?
তাকে ফিরে ডাকলুম, অমূল্য! আমার গলা এমন ক্ষীণ হয়ে বাজল, সে শুনতে পেলে না। দরজার কাছে গিয়ে আবার ডাকলুম, অমূল্য! তখন সে চলে গেছে। বেহারা! বেহারা!
কী, রানীমা?
অমূল্যবাবুকে ডেকে দে।
কী জানি, বেহারা অমূল্যর নাম বােধ হয় জানে না; তাই সে একটু পরেই সন্দীপকে ডেকে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই সন্দীপ বললে, যখন তাড়িয়ে দিলে তখনই জানতুম ফিরে ডাকবে। যে চাঁদের টানে ভাঁটা সেই চাঁদের টানেই জোয়ার। এমনি নিশ্চয় জানতুম তুমি ডাকবে যে, আমি দরজার কাছে অপেক্ষা করে বসে ছিলুম। যেমনি তােমার বেহারাকে দেখেছি অমনি সে কিছু বলবার পূর্বেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, আচ্ছা আচ্ছা, আমি যাচ্ছি— এখনই যাচ্ছি। ভােজপুরীটা আশ্চর্য হয়ে হাঁ করে রইল। ভাবলে, লােকটা মন্ত্রসিদ্ধ। মক্ষীরানী, সংসারে সব চেয়ে বড়াে লড়াই এই মন্ত্রের লড়াই। সম্মােহনে সম্মােহনে কাটাকাটি। এক বাণ শব্দভেদী বাণ। আবার নিঃশব্দভেদী বাণও আছে। এতদিন পরে এ লড়াইয়ে সন্দীপের সমকক্ষ মিলেছে। তােমার তূণে অনেক বাণ আছে রণরঙ্গিণী! পৃথিবীর মধ্যে দেখলুম, কেবল তুমিই সন্দীপকে আপন ইচ্ছামতে ফেরাতে পারলে, আবার আপন ইচ্ছামতে টেনে আনলে। শিকার তাে এসে পড়ল। এখন একে নিয়ে কী করবে বলাে? একেবারে নিঃশেষে মারবে, না তােমার খাঁচায় পুরে রাখবে? কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি রানী, এই জীবটিকে বধ করাও যেমন শক্ত, বন্ধ করাও তেমনি। অতএব দিব্য অস্ত্র তােমার হাতে যা আছে তার পরীক্ষা করতে বিলম্ব কোরাে না।
সন্দীপের মনের ভিতর একটা পরাভবের সংশয় এসেছে বলেই সে আজ এমন অনর্গল বকে গেল। আমার বিশ্বাস, ও জানত আমি অমূল্যকেই ডেকেছি, বেহারা খুব সম্ভব তারই নাম বলেছিল, ও তাকে ফাঁকি দিয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমাকে বলতে দেবার সময় দিলে না যে ওকে ডাকি নি, অমূল্যকে ডেকেছি। কিন্তু আস্ফালন মিথ্যে। এবার দুর্বলকে দেখতে পেয়েছি। এখন আমার জয়লব্ধ জায়গাটির সূচ্যগ্রভূমিও ছাড়তে পারব না।
আমি বললুম, সন্দীপবাবু আপনি গল্ গল্ করে এত কথা বলে যান কেমন করে? আগে থাকতে বুঝি তৈরি হয়ে আসেন?
এক মুহূর্তে সন্দীপের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। আমি বললুম, শুনেছি কথকদের খাতায় নানা রকমের লম্বা লম্বা বর্ণনা লেখা থাকে, যখন যেটা যেখানে দরকার খাটিয়ে দেয়। আপনার সেরকম খাতা আছে নাকি?
সন্দীপ চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, বিধাতার প্রসাদে তােমাদের তাে হাবভাব-ছলাকলার অন্ত নেই; তার উপরেও দর্জির দোকান, স্যাকরার দোকান তােমাদের সহায়; আর বিধাতা কি আমাদেরই এমনি নিরস্ত্র করে রেখেছেন যে—
আমি বললুম, সন্দীপবাবু, খাতা দেখে আসুন; এ কথাগুলাে ঠিক হচ্ছে না। দেখছি, এক-একবার আপনি উলটোপালটা বলে বসেন। খাতা-মুখস্থর ঐ একটা মস্ত দোষ।
সন্দীপ আর থাকতে পারলে না। একেবারে গর্জে উঠল, তুমি! তুমি আমাকে অপমান করবে! তােমার কী না আমার ধরা পড়েছে বলাে তাে। তােমার যে—
ওর মুখ দিয়ে আর কথা বেরােল না। সন্দীপ যে মন্ত্রব্যবসায়ী। মন্ত্র যে মুহূর্তে খাটে না সে মুহূর্তেই ওর আর জোর নেই। রাজা থেকে একেবারে রাখাল হয়ে যায়। দুর্বল! দুর্বল! ও যতই রূঢ় হয়ে উঠে কর্কশ কথা বলতে লাগল ততই আনন্দে আমার বুক ভরে উঠল। আমাকে বাঁধবার নাগপাশ ওর ফুরিয়ে গেছে, আমি মুক্তি পেয়েছি, বাঁচা গেছে, বাঁচা গেছে। অপমান করাে, আমাকে অপমান করাে, এইটেই তােমার সত্য। আমাকে স্তব কোরাে না, সেইটেই মিথ্যা।
এমন সময় আমার স্বামী ঘরের মধ্যে এলেন। অন্য দিন সন্দীপ মুহূর্তেই আপনাকে যেরকম সামলে নেয় আজ তার সে শক্তি ছিল না। আমার স্বামী তার মুখের দিকে চেয়ে একটু আশ্চর্য হলেন। আগে হলে আমি এতে লজ্জা পেতুম। কিন্তু স্বামী যাই মনে করুন-না, আমি আজ খুশি হলুম। আমি ঐ দুর্বলকে দেখে নিতে চাই।
আমরা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে রইলুম দেখে আমার স্বামী একটু ইতস্তত করে চৌকিতে বসলেন। বললেন, সন্দীপ আমি তােমাকেই খুঁজছিলুম। শুনলুম এই ঘরেই আছ।
সন্দীপ কথাটার উপর একটু বিশেষ ঝোঁক দিয়ে বললে, হাঁ, মক্ষীরানী সকালেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি যে মউচাকের দাসমক্ষিকা, কাজেই হুকুম শুনেই সব কাজ ফেলে চলে আসতে হল।
স্বামী বললেন, কাল কলকাতায় যাচ্ছি, তােমাকে যেতে হবে।
সন্দীপ বললে, কেন, বলাে দেখি? আমি কি তােমার অনুচর নাকি?
আচ্ছা, তুমিই কলকাতায় চলাে, আমি তােমার অনুচর হব।
কলকাতায় আমার কাজ নেই।
সেইজন্যেই তাে কলকাতায় যাওয়া তােমার দরকার। এখানে তােমার বড্ড বেশি কাজ।
আমি তাে নড়ছি নে।
তা হলে তােমাকে নড়াতে হবে।
জোর?
হাঁ, জোর।
আচ্ছা বেশ, নড়ব। কিন্তু, জগৎটা তাে কলকাতা আর তােমার এলেকা এই দুই ভাগে বিভক্ত নয়। ম্যাপে আরাে জায়গা আছে।
তােমার গতিক দেখে মনে হয়েছিল, জগতে আমার এলেকা ছাড়া আর-কোনাে জায়গাই নেই।
সন্দীপ তখন দাঁড়িয়ে উঠে বললে, মানুষের এমন অবস্থা আসে যখন সমস্ত জগৎ এতটুকু জায়গায় এসে ঠেকে। তোমার এই বৈঠকখানাটির মধ্যে আমার বিশ্বকে আমি প্রত্যক্ষ করে দেখেছি, সেইজন্যেই এখান থেকে নড়ি নে। মক্ষীরানী, আমার কথা কেউ বুঝতে পারবে না, হয়তো তুমিও বুঝবে না। আমি তোমাকে বন্দনা করি। আমি তোমারই বন্দনা করতে চললুম। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মন্ত্র বদল হয়ে গেছে। বন্দে মাতরম নয়— বন্দে প্রিয়াং, বন্দে মোহিনীং! মা আমাদের রক্ষা করেন, প্রিয়া আমাদের বিনাশ করেন। বড়ো সুন্দর সেই বিনাশ। সেই মরণনৃত্যের নূপুরঝংকার বাজিয়ে তুলেছ আমার হৃৎপিণ্ডে। এই কোমলা সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বাংলাদেশের রূপ তুমি তোমার এই ভক্তের চক্ষে এক মুহূর্তে বদলে দিয়েছ। দয়ামায়া তোমার নেই গো। এসেছ মোহিনী, তুমি তোমার বিষপাত্র নিয়ে। সেই বিষ পান করে, সেই বিষে জর্জর হয়ে, হয় মরব নয় মৃত্যুঞ্জয় হব। মাতার দিন আজ নেই— প্রিয়া, প্রিয়া, প্রিয়া! দেবতা স্বর্গ ধর্ম সত্য সব তুমি তুচ্ছ করে দিয়েছ। পৃথিবীর আর সমস্ত সম্বন্ধ আজ ছায়া। নিয়মসংযমের সমস্ত বন্ধন আজ ছিন্ন। প্রিয়া, প্রিয়া, প্রিয়া তুমি যে দেশে দুটি পা দিয়ে দাঁড়িয়েছ তার বাইরের সমস্ত পৃথিবীতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারই ছাইয়ের উপর আনন্দে তাণ্ডবনৃত্য করতে পারি। এরা ভালোমানুষ, এরা অত্যন্ত ভালো। এরা সবার ভালো করতে চায়। যেন সবই সত্য! কখনোই না। এমন সত্য বিশ্বে আর-কোথাও নেই, এই আমার একমাত্র সত্য। বন্দনা করি তোমাকে। তোমার প্রতি নিষ্ঠা আমাকে নিষ্ঠুর করেছে, তোমার ’পরে ভক্তি আমার মধ্যে প্রলয়ের আগুন জ্বালিয়েছে। আমি ভালো নই। আমি ধার্মিক নই। আমি পৃথিবীতে কিছুই মানি নে। আমি যাকে সকলের চেয়ে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি কেবলমাত্র তাকেই মানি।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! এই কিছু আগেই আমি একে সমস্ত মন নিয়ে ঘৃণা করেছিলুম। যাকে ছাই বলে দেখেছিলুম তার মধ্যে থেকে আগুন জ্বলে উঠেছে। এ একেবারে খাঁটি আগুন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিধাতা এমন করে মিশিয়ে কেন মানুষকে তৈরি করেন? সে কি কেবল তার অলৌকিক ইন্দ্রজাল দেখাবার জন্যে? আধ ঘণ্টা আগেই আমি মনে মনে ভাবছিলুম, এই মানুষটাকে একদিন রাজা বলে ভ্রম হয়েছিল বটে, কিন্তু এ যাত্রার দলের রাজা। তা নয়, তা নয়— যাত্রার দলের পোশাকের মধ্যেও এক-এক সময় রাজা লুকিয়ে থেকে যায়। এর মধ্যে অনেক লোভ, অনেক স্থূল, অনেক ফাঁকি আছে; স্তরে স্তরে মাংসের মধ্যে এ ঢাকা, কিন্তু, তবুও— আমরা জানি নে, আমরা শেষ কথাটাকে জানি নে, এইটেই স্বীকার করা ভালাে—আপনাকেও জানি নে। মানুষ বড়াে আশ্চর্য। তাকে নিয়ে কী প্রকাণ্ড রহস্যই তৈরি হচ্ছে তা সেই রুদ্র দেবতাই জানেন— মাঝের থেকে দগ্ধ হয়ে গেলুম। প্রলয়! প্রলয়ের দেবতাই শিব, তিনিই আনন্দময়, তিনি বন্ধন মােচন করবেন।
কিছুদিন থেকে বারে বারে মনে হচ্ছে, আমার দুটো বুদ্ধি আছে। আমার একটা বুদ্ধি বুঝতে পারছে, সন্দীপের এই প্রলয়রূপ ভয়ংকর; আর-এক বুদ্ধি বলছে, এই তাে মধুর। জাহাজ যখন ডােবে তখন চার দিকে যারা সাঁতার দেয় তাদের টেনে নেয়— সন্দীপ যেন সেই মরণের মূর্তি— ভয় ধরবার আগেই ওর প্রচণ্ড টান এসে ধরে— সমস্ত আলাে, সমস্ত কল্যাণ থেকে, আকাশের মুক্তি থেকে, নিশ্বাসের বাতাস থেকে, চিরদিনের সঞ্চয় থেকে, প্রতিদিনের ভাবনা থেকে চোখের পলকে একটা নিবিড় সর্বনাশের মধ্যে একেবারে লােপ করে দিতে চায়। কোন্ মহামারীর দূত হয়ে ও এসেছে, অশিবমন্ত্র পড়তে পড়তে রাস্তা দিয়ে চলেছে, আর ছুটে আসছে দেশের সব বালকরা, সব যুবকরা। বাংলাদেশের হৃদয়পদ্মে যিনি মা বসে আছেন তিনি কেঁদে উঠেছেন— তাঁর অমৃতভাণ্ডারের দরজা ভেঙে ফেলে এরা সেখানে মদের ভাণ্ড নিয়ে পানসভা বসিয়েছে; ধুলার উপর ঢেলে ফেলতে চায় সব সুধা, চুরমার করতে চায় চিরদিনের সুধাপাত্র। সবই বুঝলুম, কিন্তু মােহকে তাে ঠেকিয়ে রাখতে পারি নে। সত্যের কঠোর তপস্যার পরীক্ষা করবার জন্যে সত্যদেবেরই এই কাজ। মাতলামি স্বর্গের সাজ প’রে এসে তাপসদের সামনে নৃত্য করতে থাকে। বলে, তােমরা মূঢ়— তপস্যায় সিদ্ধি হয় না, তার পথ দীর্ঘ, তার কাল মন্থর; তাই বজ্রধারী আমাকে পাঠিয়েছেন; আমি তােমাদের বরণ করব; আমি সুন্দরী, আমি মত্ততা, আমার আলিঙ্গনেই নিমেষের মধ্যে সমস্ত সিদ্ধি।
একটুখানি চুপ করে থেকে সন্দীপ আবার আমাকে বললে, এবার দূরে যাবার সময় এসেছে দেবী! ভালােই হয়েছে। তােমার কাছে আসার কাজ আমার হয়ে গেছে। তার পরেও যদি থাকি তা হলে একে একে আবার সব নষ্ট হয়ে যাবে। পৃথিবীতে যা সকলের চেয়ে বড়াে তাকে লােভে পড়ে সস্তা করতে গেলেই সর্বনাশ ঘটে। মুহূর্তের অন্তরে যা অনন্ত তাকে কালের মধ্যে ব্যাপ্ত করতে গেলেই সীমাবদ্ধ করা হয়। আমরা সেই অনন্তকে নষ্ট করতে বসেছিলুম। ঠিক এমন সময়ে তােমারই বজ্র উদ্যত হল; তােমার পূজাকে তুমি রক্ষা করলে, আর, তােমার এই পূজারীকেও। আজ আমার বিদায়ের মধ্যেই তােমার বন্দনা সকলের চেয়ে বড়াে হয়ে উঠল। দেবী, আমিও আজ তােমাকে মুক্তি দিলুম। আমার মাটির মন্দিরে তােমাকে ধরছিল না, এ মন্দির প্রত্যেক পলকে ভাঙবে-ভাঙবে করছিল, আজ তােমার বড়াে মূর্তিকে বড়াে মন্দিরে পূজা করতে চললুম। তােমার কাছ থেকে দূরেই তােমাকে সত্য করে পাব। এখানে তােমার কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়েছিলুম, সেখানে তােমার কাছ থেকে বর পাব।
টেবিলের উপর আমার গয়নার বাক্স ছিল। আমি সেটা তুলে ধরে বললুম, আমার এই গয়না আমি তােমার হাত দিয়ে যাঁকে দিলুম তাঁর চরণে তুমি পৌছে দিয়ো।
আমার স্বামী চুপ করে রইলেন। সন্দীপ বেরিয়ে চলে গেল।
অমূল্যের জন্যে নিজের হাতে খাবার তৈরি করতে বসেছিলুম, এমন সময় মেজোরানী এসে বললেন, কী লাে ছুটু, নিজের জন্মতিথিতে নিজেকেই খাওয়াবার উজ্জুগ হচ্ছে বুঝি?
আমি বললুম, নিজেকে ছাড়া আর-কাউকে খাওয়াবার নেই নাকি?
মেজোরানী বললেন, আজ তাে তাের খাওয়াবার কথা নয়, আমরা খাওয়াব। সেই জোগাড়ও তাে করছিলুম, এমন সময় খবর শুনে পিলে চমকে গেছে আমাদের কোন্ কাছারিতে নাকি পাঁচ-ছ শাে ডাকাত পড়ে ছ হাজার টাকা লুটে নিয়েছে। লােকে বলছে, এইবার তারা আমাদের বাড়ি লুট করতে আসবে।
এই খবর শুনে আমার মনটা হালকা হল। এ তবে আমাদেরই টাকা! এখনই অমূল্যকে ডাকিয়ে বলি, এই ছ হাজার টাকা এইখানেই আমার সামনে আমার স্বামীর হাতে সে ফিরিয়ে দিক, তার পরে আমার যা বলবার সে আমি তাঁকে বলব।
মেজোরানী আমার মুখের ভাব লক্ষ্য করে বললেন, অবাক করলে! তাের মনে একটুও ভয়-ডর নেই?
আমি বললুম, আমাদের বাড়ি লুট করতে আসবে এ আমি বিশ্বাস করতে পারি নে।
বিশ্বাস করতে পার না? কাছারি লুট করবে এইটেই বা বিশ্বাস করতে কে পারত?
কোনাে জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে পুলিপিঠের মধ্যে নারকেলের পুর দিতে লাগলুম। আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে তিনি বললেন, যাই, ঠাকুরপােকে ডেকে পাঠাই, আমাদের সেই ছ হাজার টাকা এখনই বের করে নিয়ে কলকাতায় পাঠাতে হবে, আর দেরি করা নয়।
এই বলে তিনি চলে যেতেই আমি পিঠের বারকোশ সেইখানে আলগা ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি সেই লােহার সিন্দুকের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম। আমার স্বামীর এমনি ভােলা মন যে দেখি তাঁর যে কাপড়ের পকেটে চাবি থাকে সে কাপড়টা তখনাে আলনায় ঝুলছে। চাবির রিঙ থেকে লােহার সিন্দুকের চাবিটা খুলে আমার জ্যাকেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেললুম।
এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ল। বললুম, কাপড় ছাড়ছি।
শুনতে পেলুম মেজোরানী বললেন, এই কিছু আগে দেখি পিঠে তৈরি করছে, আবার এখনই সাজ করবার ধুম পড়ে গেল! কত লীলাই যে দেখব! আজ বুঝি ওদের বন্দে মাতরমের বৈঠক বসবে। ওলাে, ও দেবীচৌধুরানী, লুটের মাল বােঝাই হচ্ছে নাকি?
কী মনে করে একবার আস্তে আস্তে লােহার সিন্দুকটা খুললুম। বােধ হয় মনে ভাবছিলুম, যদি সমস্তটা স্বপ্ন হয়, যদি হঠাৎ সেই ছােটো দেরাজটা টেনে খুলতেই দেখি সেই কাগজের মােড়কগুলি ঠিক তেমনিই সাজানাে রয়েছে। হায় রে, বিশ্বাসঘাতকের নষ্ট বিশ্বাসের মতােই সব শূন্য।
মিছামিছি কাপড় ছাড়তেই হল। কোনাে দরকার নেই, তবু নতুন করে চুল বাঁধলুম। মেজোরানীর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন ‘বলি, এত সাজ কিসের’ আমি বললুম, জন্মতিথির।
মেজোরানী হেসে বললেন, একটা কিছু ছুতাে পেলেই অমনি সাজ। ঢের দেখেছি, তাের মতাে এমন ভাবুনে দেখি নি।
অমূল্যকে ডাকবার জন্যে বেহারার খোঁজ করছি এমন সময় সে এসে পেনসিলে লেখা একটি ছােটো চিঠি আমার হাতে দিলে। তাতে অমূল্য লিখেছে: দিদি, খেতে ডেকেছিলে কিন্তু সবুর করতে পারলুম না। আগে তােমার আদেশ পালন করে আসি, তার পরে তােমার প্রসাদ গ্রহণ করব। হয়তাে ফিরে আসতে সন্ধ্যা হবে।
অমূল্য কার হাতে টাকা ফেরাতে চলল, আবার কোন জালের মধ্যে নিজেকে জড়াতে গেল। আমি তাকে তীরের মতাে কেবল ছুঁড়তেই পারি, কিন্তু লক্ষ্য ভুল হলে তাকে আর কোনােমতে ফেরাতে পারি নে।
এই অপরাধের মূলে যে আমি আছি এই কথাটা এখনই স্বীকার করা আমার উচিত ছিল। কিন্তু, মেয়েরা সংসারে বিশ্বাসের উপরেই বাস করে, সেই-যে তাদের জগৎ। সেই বিশ্বাসকে লুকিয়ে ফাঁকি দিয়েছি, এই কথাটা জানিয়ে তার পরে সংসারে টিঁকে থাকা আমাদের পক্ষে বড়াে কঠিন। যা আমরা ভাঙব ঠিক তার উপরেই যে আমাদের দাঁড়াতে হবে— সেই ভাঙা জিনিসের খোঁচা নড়তে-চড়তে আমাদের প্রতি মুহূর্তেই বাজতে থাকবে। অপরাধ করা শক্ত নয়, কিন্তু সেই অপরাধের সংশােধন করা মেয়েদের পক্ষে যত কঠিন এমন আর কারাে নয়।
কিছুদিন থেকে আমার স্বামীর সঙ্গে বেশ সহজে কথাবার্তা কওয়ার প্রণালীটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই হঠাৎ এত বড়াে একটা কথা কেমন করে এবং কখন যে তাঁকে বলব তা কিছুতেই ভেবে পেলুম না। আজ তিনি অনেক দেরিতে খেতে এসেছেন, তখন বেলা দুটো। অন্যমনস্ক হয়ে কিছুই প্রায় খেতে পারলেন না। আমি যে তাঁকে একটু অনুরােধ করে খেতে বলব, সে অধিকারটুকু খুইয়েছি। মুখ ফিরিয়ে আঁচলে চোখের জল মুছলুম।
একবার ভাবলুম সংকোচ কাটিয়ে বলি, ঘরের মধ্যে একটু বিশ্রাম করাে’সে, তােমাকে বড়াে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।— একটু কেশে কথাটা যেই তুলতে যাচ্ছি এমন সময় বেহারা এসে খবর দিলে, দারােগাবাবু কাসেম সর্দারকে নিয়ে এসেছে। আমার স্বামী উদ্বিগ্নমুখে তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন।
তিনি বাইরে যাওয়ার একটু পরেই মেজোরানী এসে বললেন, ঠাকুরপাে কখন খেতে এলেন আমাকে খবর দিলি নে কেন? আজ তাঁর খাবার দেরি দেখে নাইতে গেলুম— এরই মধ্যে কখন—
কেন, কী চাই?
শুনছি, তােরা কাল কলকাতায় যাচ্ছিস। তা হলে আমি এখানে থাকতে পারব না। বড়োরানী তাঁর রাধাবল্লভ ঠাকুরকে ছেড়ে কোথাও নড়বেন না। কিন্তু আমি এই ডাকাতির দিনে যে তােমাদের এই শূন্য ঘর আগলে বসে কথায় কথায় চম্কে চম্কে মরব সে আমি পারব না। কাল যাওয়াই তাে ঠিক?
আমি বললুম, হাঁ, ঠিক।
মনে মনে ভাবলুম, সেই যাওয়ার আগে এইটুকু সময়ের মধ্যে কত ইতিহাসই যে তৈরি হয়ে উঠবে তার ঠিকানা নেই। তার পরে কলকাতাতেই যাই কি এখানেই থাকি, সব সমান। তার পর থেকে সংসারটা যে কেমন, জীবনটা যে কী, কে জানে! সব ধোঁওয়া, স্বপ্ন! এই-যে আমার অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে উঠল বলে, আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র আছে— এই সময়টাকে কেউ একদিন থেকে আর-একদিন পর্যন্ত সরিয়ে সরিয়ে টেনে টেনে খুব দীর্ঘ করে দিতে পারে না? তা হলে এরই মধ্যে আমি ধীরে ধীরে একবার সমস্তটা যথাসাধ্য সেরে-সুরে নিই; অন্তত এই আঘাতটার জন্যে নিজেকে এবং সংসারকে প্রস্তুত করে তুলি। প্রলয়ের বীজ যতক্ষণ মাটির নীচে থাকে ততক্ষণ অনেক সময় নেয়; সে এত সময় যে মনে হয়, ভয়ের বুঝি কোনাে কারণ নেই। কিন্তু মাটির উপর একবার যেই এতটুকু অঙ্কুর দেখা দেয় অমনি দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠে; তখন তাকে কোনােমতে আঁচল দিয়ে, বুক দিয়ে, প্রাণ দিয়ে চাপা দেবার আর সময় পাওয়া যায় না।
মনে করছি, কিছুই ভাবব না, অসাড় হয়ে চুপ করে পড়ে থাকব, তার পরে মাথার উপরে যা এসে পড়ে পড়ুক গে। পরশুদিনের মধ্যেই তাে যা হবার তা হয়ে যাবে— জানাশােনা, হাসাহাসি, কাঁদাকাটি, প্রশ্ন, প্রশ্নের জবাব, সবই।
কিন্তু অমূল্যর সেই আত্মােৎসর্গের-দীপ্তিতে-সুন্দর বালকের মুখখানি যে কিছুতে ভুলতে পারছি নে। সে তাে চুপ করে বসে ভাগ্যের প্রতীক্ষা করে নি, সে যে ছুটে গেল বিপদের মাঝখানে। আমি নারীর অধম তাকে প্রণাম করি— সে আমার বালক-দেবতা, সে আমার কলঙ্কের বােঝা একেবারে খেলাচ্ছলে কেড়ে নিতে এসেছে। সে আমার মার নিজের মাথায় নিয়ে আমাকে বাঁচাবে, ভগবানের এমন ভয়ানক দয়া আমি সইব কেমন করে! বাছা আমার, তােমাকে প্রণাম। ভাই আমার, তােমাকে প্রণাম। নির্মল তুমি, সুন্দর তুমি, বীর তুমি, নির্ভীক তুমি, তােমাকে প্রণাম। জন্মান্তরে তুমি আমার ছেলে হয়ে আমার কোলে এসাে, এই বর আমি কামনা করি।
এর মধ্যে চার দিকে নানা গুজব জেগে উঠেছে, পুলিস আনাগােনা করছে, বাড়ির দাসী-চাকররা সবাই উদ্বিগ্ন। ক্ষেমা দাসী আমাকে এসে বললে, ছােটোরানীমা, আমার এই সােনার পৈঁচে আর বাজুবন্ধ তােমার লােহার সিন্দুকে তুলে রেখে দাও। ঘরের ছােটোরানীই দেশ জুড়ে এই দুর্ভাবনার জাল তৈরি করে নিজে তার মধ্যে আটকা পড়ে গেছে, এ কথা বলি কার কাছে? ক্ষেমার গয়না, থাকোর জমানাে টাকা আমাকে ভালােমানুষের মতাে নিতে হল। আমাদের গয়লানী একটা টিনের বাক্স করে একটি বেনারসি কাপড় এবং তার আর-আর দামি সম্পত্তি আমার কাছে রেখে গেল; বললে, রানীমা, এই বেনারসি কাপড় তােমারই বিয়েতে আমি পেয়েছিলুম।
কাল যখন আমারই ঘরের লােহার সিন্দুক খােলা হবে তখন এই ক্ষেমা, থাকো, গয়লানী— থাক্, সে কথা কল্পনা করে হবে কী! বরঞ্চ ভাবি, কালকের দিনের পর আর-এক বৎসর কেটে গেছে, আবার একটা তেসরা মাঘের দিন এসেছে। সেদিনও কি আমার সংসারের সব কাটা ঘা এমনি কাটাই থেকে যাবে?
অমূল্য লিখেছে, সে আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবে। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে একা বসে চুপ করে থাকতে পারি নে। আবার পিঠে তৈরি করতে গেলুম। যা তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট, কিন্তু আরাে করতে হবে। এত কে খাবে? বাড়ির সমস্ত দাসী-চাকরদের খাইয়ে দেব। আজ রাত্রেই খাওয়াতে হবে। আজ রাত পর্যন্ত আমার দিনের সীমা। কালকের দিন আর আমার হাতে নেই।
পিঠের পর পিঠে ভাজছি, বিশ্রাম নেই। এক-একবার মনে হচ্ছে, যেন উপরে আমার মহলের দিকে কী-একটা গােলমাল চলছে। হয়তাে আমার স্বামী লােহার সিন্দুক খুলতে এসে চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই নিয়ে মেজোরানী দাসী-চাকরকে ডেকে একটা তােলপাড় কাণ্ড বাধিয়েছেন। না, আমি শুনব না, কিচ্ছু শুনব না, দরজা বন্ধ করে থাকব।
দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি, থাকো তাড়াতাড়ি আসছে; সে হাঁপিয়ে বললে, ছােটোরানীমা!— আমি বলে উঠলুম, যা যা, বিরক্ত করিস নে, আমার এখন সময় নেই।— থাকো বললে, মেজোরানীমার বােনপাে নন্দবাবু কলকাতা থেকে এক কল এনেচেন, সে মানুষের মতাে গান করে, তাই মেজোরানীমা তােমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।— হাসব কি কাঁদব তাই ভাবি। এর মাঝখানেও গ্রামােফোন! তাতে যতবার দম দিচ্ছে সেই থিয়েটারের নাকি সুর বেরােচ্ছে— ওর কোনাে ভাবনা নেই। যন্ত্র যখন জীবনের নকল করে তখন তা এমনি বিষম বিদ্রূপ হয়েই ওঠে।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। জানি, অমূল্য এলেই আমাকে খবর পাঠাতে দেরি করবে না, তবু থাকতে পারলুম না; বেহারাকে ডেকে বললুম, অমূল্যবাবুকে খবর দাও। বেহারা খানিকটা ঘুরে এসে বললে, অমূল্যবাবু নেই।
কথাটা কিছুই নয়, কিন্তু হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে যেন তােলপাড় করে উঠল। ‘অমূল্যবাবু নেই’ সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে এ কথাটা যেন কান্নার মতাে বাজল। নেই, সে নেই! সে সূর্যাস্তের সােনার রেখাটির মতাে দেখা দিলে, তার পরে আর সে নেই! সম্ভব-অসম্ভব কত দুর্ঘটনার কল্পনাই আমার মাথার মধ্যে জমে উঠতে লাগল। আমিই তাকে মৃত্যুর মধ্যে পাঠিয়েছি। সে যে কোনাে ভয় করে নি সে তারই মহত্ত্ব, কিন্তু এর পরে আমি বেঁচে থাকব কেমন করে!
অমূল্যর কোনাে চিহ্নই আমার কাছে ছিল না, কেবল ছিল তার সেই ভাইফোঁটার প্রণামী, সেই পিস্তলটি। মনে হল, এর মধ্যে দৈবের ইঙ্গিত রয়েছে। আমার জীবনের মূলে যে কলঙ্ক লেগেছে বালকবেশে আমার নারায়ণ সেটি ঘুচিয়ে দেবার উপায় আমার হাতে রেখে দিয়েই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন। কী ভালােবাসার দান! কী পাবনমন্ত্র তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন!
বাক্স খুলে পিস্তলটি বের করে দুই হাতে তুলে আমার মাথায় ঠেকালুম। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে আরতির কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠল। আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলুম।
রাত্রে লােকজনদের পিঠে খাওয়ানাে গেল। মেজোরানী এসে বললেন, নিজে নিজেই খুব ধুম করে জন্মতিথি করে নিলি যা হােক! আমাদের বুঝি কিছু করতে দিবি নে? এই বলে তিনি তাঁর সেই গ্রামােফোনটাকে যত রাজ্যের নটীদের মিহি চড়া সুরের দ্রুত তানের কসরত শােনাতে লাগলেন; মনে হতে লাগল, যেন গন্ধর্বলােকের সুরওয়ালা ঘােড়ার আস্তাবল থেকে চিঁহি চিঁহি শব্দে হ্রেষাধ্বনি উঠছে।
খাওয়ানাে শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল, আজ রাতে আমার স্বামীর পায়ের ধুলাে নেব। শােবার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি অকাতরে ঘুমােচ্ছেন। আজ সমস্ত দিন তাঁর অনেক ঘােরাঘুরি অনেক ভাবনা গিয়েছে। খুব সাবধানে মশারি একটুখানি খুলে তাঁর পায়ের কাছে আস্তে আস্তে মাথা রাখলুম। চুলের স্পর্শ লাগতেই ঘুমের ঘােরে তিনি তাঁর পা দিয়ে আমার মাথাটা একটু ঠেলে দিলেন।
পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে বসলুম। দূরে একটা শিমুল গাছ অন্ধকারে কঙ্কালের মতাে দাঁড়িয়ে আছে; তার সমস্ত পাতা ঝরে গিয়েছে; তারই পিছনে সপ্তমীর চাঁদ ধীরে ধীরে অস্ত গেল।
আমার হঠাৎ মনে হল, আকাশের সমস্ত তারা যেন আমাকে ভয় করছে, রাত্রিবেলাকার এই প্রকাণ্ড জগৎ আমার দিকে যেন আড় চোখে চাইছে। কেননা, আমি যে একলা। একলা মানুষের মতাে এমন সৃষ্টিছাড়া আর কিছুই নেই। যার সমস্ত আত্মীয়স্বজন একে একে মরে গিয়েছে সেও একলা নয়, মৃত্যুর আড়াল থেকে সে সঙ্গ পায়। কিন্তু যার সমস্ত আপন মানুষ পাশেই রয়েছে তবু কাছে নেই, সে মানুষ পরিপূর্ণ সংসারের সকল সঙ্গ থেকেই একেবারে খসে পড়ে গিয়েছে, মনে হয়, যেন অন্ধকারে তার মুখের দিকে চাইলে সমস্ত নক্ষত্রলােকের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি যেখানে রয়েছি সেইখানেই নেই। যারা আমাকে ঘিরে রয়েছে আমি তাদের কাছ থেকেই দূরে। আমি চলছি, ফিরছি, বেঁচে আছি এবং একটা বিশ্বব্যাপী বিচ্ছেদের উপরে, যেন পদ্মপাতার উপরকার শিশিরবিন্দুর মতাে।
কিন্তু মানুষ যখন বদলে যায় তখন তার আগাগোড়া সমস্ত বদল হয় কেন? হৃদয়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই যা ছিল তা সবই আছে, কেবল নড়ে-চড়ে গিয়েছে। যা সাজানো ছিল আজ তা এলোমেলো, যা কণ্ঠের হারে বাঁধা ছিল আজ তা ধুলোয়। সেইজন্যেই তো বুক ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছা করে মরি, কিন্তু সবই যে হৃদয়ের মধ্যে বেঁচে আছে; মরার ভিতরে তো শেষ দেখতে পাচ্ছি নে। আমার মনে হচ্ছে, যেন মরার মধ্যে আরো ভয়ানক কান্না। যা-কিছু চুকিয়ে দেবার তা বাঁচার ভিতর দিয়েই চুকোতে পারি, অন্য উপায় নেই।
এবারকার মতো একবার আমাকে মাপ করো, হে আমার প্রভু! যা-কিছুকে তুমি আমার জীবনের ধন বলে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে সে-সমস্তকেই আমি আমার জীবনের বোঝা করে তুলেছি। আজ তা আর বহনও করতে পারছি নে, ত্যাগ করতেও পারছি নে। আর-এক দিন তুমি আমার ভোরবেলাকার রাঙা আকাশের ধারে দাঁড়িয়ে যে বাঁশি বাজিয়েছিলে সেই বাঁশিটি বাজাও; সব সমস্যা সহজ হয়ে যাক। তোমার সেই বাঁশির সুরটি ছাড়া ভাঙাকে কেউ জুড়তে পারে না, অপবিত্রকে কেউ শুভ্র করতে পারে না। সেই বাঁশির সুরে আমার সংসারকে তুমি নতুন করে সৃষ্টি করো। নইলে আমি আর কোনো উপায় দেখি নে।
মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলুম। একটা কোনো দয়া কোথাও থেকে চাই— একটা কোনো আশ্রয়, একটু ক্ষমার আভাস, একটা এমন আশ্বাস যে সব চুকে যেতেও পারে। মনে মনে বললুম, আমি দিন-রাত ধরনা দিয়ে পড়ে থাকব প্রভু! আমি খাব না, আমি জলস্পর্শ করব না, যতক্ষণ না তোমার আশীর্বাদ এসে পৌঁছয়।
এমন সময় পায়ের শব্দ শুনলুম। আমার বুকের ভিতরটা দুলে উঠল। কে বলে, দেবতা দেখা দেন না? আমি মুখ তুলে চাইলুম না, পাছে আমার দৃষ্টি তিনি সইতে না পারেন। এসো, এসো, এসো! তোমার পা আমার মাথায় এসে ঠেকুক, আমার এই বুকের কাঁপনের উপরে এসে দাঁড়াও প্রভু, আমি এই মুহূর্তেই মরি।
আমার শিয়রের কাছে এসে বসলেন। কে? আমার স্বামী! আমার স্বামীর হৃদয়ের মধ্যে আমার সেই দেবতারই সিংহাসন নড়ে উঠেছে যিনি আমার কান্না আর সইতে পারলেন না। মনে হল, মূর্ছা যাব। তার পরে আমার শিরার বাঁধন যেন ছিঁড়ে ফেলে আমার বুকের বেদনা কান্নার জোয়ারে ভেসে বেরিয়ে পড়ল। বুকের মধ্যে তার পা চেপে ধরলুম— ঐ পায়ের চিহ্ন চিরজীবনের মতো ঐখানে আঁকা হয়ে যায় না কি?
এইবার তো সব কথা খুলে বললেই হত। কিন্তু এর পরে কি আর কথা আছে? থাক্ গে আমার কথা। তিনি আস্তে আস্তে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আশীর্বাদ পেয়েছি। কাল যে অপমান আমার জন্যে আসছে সেই অপমানের ডালি সকলের সামনে মাথায় তুলে নিয়ে আমার দেবতার পায়ে সরল হয়ে প্রণাম করতে পারব।
কিন্তু এই মনে করে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে, আজ ন বছর আগে যে নহবৎ বেজেছিল সে আর ইহজন্মে কোনোদিন বাজবে না। এ ঘরে আমাকে বরণ করে এনেছিল যে! ওগো, এই জগতে কোন্ দেবতার পায়ে মাথা কুটে মরলে সেই বউ চন্দন-চেলি পরে সেই বরণের পিঁড়িতে এসে দাঁড়াতে পারে! কতদিন লাগবে আর— কত যুগ— কত যুগান্তর— সেই ন বছর আগেকার দিনটিতে আর-একটিবার ফিরে যেতে! দেবতা নতুন সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু ভাঙা সৃষ্টিকে ফিরে গড়তে পারেন এমন সাধ্য কি তাঁর আছে?