Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঘনাদা ও মৌ-কা-সা-বি-স || Premendra Mitra » Page 5

ঘনাদা ও মৌ-কা-সা-বি-স || Premendra Mitra

পরাশর বনাম ঘনাদাও বলা যায়।

বলা যায় ঠিকই, কিন্তু মেলানো যায় কি?

না। গাছে মাছে যদি বা মেলানো যায়, পরাশর আর ঘনাদাকে মিলিয়ে দেওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। এ যেন গাওয়া ঘির সঙ্গে তক্তপোশ কিংবা তবলার সঙ্গে তেলাপোকা। মিল ওই শুধু ত আর ল-এ। কিন্তু সে তত মাথার গোলের মিল যেন লঙ্কা-ফোড়নের—হাঁচি শুনে হেঁশেলের চালে চামচিকের বাসা খোঁজা।

যে দুজনকে মেলাতে চাচ্ছি তাদের ঠিকানা নিয়েই তো গণ্ডগোল। আমাদের ইনি তো থাকেন বনমালি নস্করের বাহাত্তর নম্বরে, আর অন্যজন শুনেছি কোথায় সেই খিদিরপুরে।

খিদিরপুরের কোথায় কোন পাড়ার কোন গলি বা মহল্লায় তার কিছুই জানা নেই। জানবার উপায়ই বা কী?

না, না হঠাৎ খেয়াল হয়েছে যে উপায় একটা আছে। এ ভরসাটা আর কেউ নয়, শিবুই দিয়েছে।

উপায়টা কী? জিজ্ঞাসা করেছি আমরা।

খুব সোজা উপায়। শিবু ভনিতা করেছে, পরাশরের সব বৃত্তান্ত যাঁর মারফত জেনেছি সেই তাঁকেই গিয়ে ধরা।

তাঁকেই গিয়ে ধরা! শিশির আর গৌর সন্দেহ প্রকাশ করেছে, পরাশর বৃত্তান্তের বর্ণনাকার কৃত্তিবাস ভদ্র না কে, তাঁর কথা বলছ তো?

হ্যাঁ, তাঁর ছাড়া আর কার কথা বলব? শিবু একটু ঝাঁঝিয়ে বলেছে, মহাভারত রচনাকারের কথা বলতে বেদব্যাস ছাড়া নাম করব আর কার?

বেদব্যাস, আমি ঘনাদার ধরনে ধ্বনি করবার চেষ্টা করে অবজ্ঞাভরে অন্য তর্ক, তুলে বলেছি, একটু বুঝেসুঝে কথা বলো। কাকে বেদব্যাস বলছ? তেলাপোকাকে বলছ পাখি। তোমাদের ভদ্র না অভদ্র ওই কৃত্তিবাস পরাশর বৃত্তান্তের সঞ্জয়ও নয়।

সঞ্জয়ও নয়!—শিবু যেন একটু বেশি তেতে উঠল——অত হেনস্থা যাকে করছিস তার কেরামতি যে কতখানি তা বুঝিস! পরাশর বর্মার কি শার্লক হোমস-এর ওই কৃত্তিবাস-ওয়াটসনরা না থাকলে তাদের সব বাহাদুরির অর্ধেক জেল্লাই যে মাটি হয়ে যেত তা জানিস! এই কৃত্তিবাস আর ওয়াটসন নিজেরা বোকা বোকা আহম্মুকে সেজে এমন কায়দা করে তাদের বন্ধুদের বৃত্তান্ত লেখেন যে সেখানে উইটিবিকে মনে হয় যেন পাহাড় আর খিড়কি পুকুরকে যেন অকূল দরিয়া। সঞ্জয়ও নয় বলে নিজের বুদ্ধির বহরটা তাই জানিয়ে ফেলিস না!

শিবুর কথাগুলো নেহাত ফাঁকা গলাবাজি নয়। তার যুক্তিগুলোর ঠোক্করে একটু কাবু হলেও জবাব যাহোক একটা দিতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু শিশির গৌরের বকুনিতে নিজেকে রুখতে হল।

কী সব বেতালা বাজাচ্ছিস? ধমক দিয়েছে গৌর আর শিশির-শিবুর কথায় সায় দিয়ে বলেছে, সঞ্জয় হোক বা বেদব্যাসই হোক, আমরা যা চাইছি সেটুকু তাঁকে দিয়ে হলেই হল। আমরা তো তাঁর কাছে অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত চাইছি না, চাইছি শুধু ওই যাকে বলা যায় কুরুক্ষেত্রের ঠিকানাটুকু। সেইটুকু তাঁর কাছে পেলেই হল।

গৌর শিশিরের মীমাংসাই মেনে নিয়ে তারপর পরাশর কথাকার কৃত্তিবাস ভদ্রের পত্রিকার অফিসে খোঁজ করতে গিয়েছি।

কিন্তু কোথায় পত্রিকা?

পত্রিকার অফিসের পাশেই কৃত্তিবাস ভদ্র নিজেও থাকেন বলে শুনেছিলাম।

কিন্তু সেখানে গিয়ে জানলাম, সে খবর নাকি এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। জায়গাটা মৌলালি অঞ্চল। ঠিকানাটা খুঁজে বার করতে আমাদের ভুল হয়নি। কৃত্তিবাস ভদ্রের সম্পাদনায় যে পত্রিকা সেখান থেকে বার হত সেটা বেশ কয়েক বছর অন্য কোনও ঠিকানায় উঠে গেছে।

বাড়িটার এখন যা অবস্থা তাতে তার সঙ্গে সাহিত্যের কি সাংবাদিকতার জগতের কোনও সম্পর্কের কথা ভাবাই শক্ত।

বাড়ির নীচের তলাটা একটা গো-ডাউন গোছের। সেখানে গেলেই একটা অদ্ভুত গন্ধে বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করতে হয়। গন্ধটা উৎকট বিশ্রী কিছু নয়, শুধু কেমন একটু চেনাচেনা কিছুরই যেন কড়া ছোঁয়া লাগানো।

ভনিতাটা না বাড়িয়ে সোজা কথাতেই বলি, গন্ধটা বিড়ির পাতার আর তামাকের। গো-ডাউনট্রা ওই দুটো জিনিসেরই।

গো-ডাউনের দেওয়ালের গায়ে লাগানো দু-চারটে কাঠের খুপরি থেকেই অবশ্য ব্যাপারটা আঁচ করা উচিত ছিল। সেসব খুপরির নীচে ও ওপরের কাঠের তক্তায় বসে সবসুদ্ধ মিলে প্রায় জন কুড়িক কারিগর নিপুণ হাতে বিড়ি বাঁধছে।

প্রথমেই জায়গাটার অপ্রত্যাশিত গন্ধে একটু ভড়কে গেলেও ওই বিড়ি তৈরির একটি খুপরিতেই গিয়ে ওপরের কাগজের অফিসের খোঁজ করি। কাগজ! বড় কুলোর ওপর থেকে মশলা আর পাতা নিয়ে কলের মতো হাত চালিয়ে দেখতে না দেখতে একটার পর একটা নিখুঁত বিড়ি বাঁধার কাজ একটুও না থামিয়ে কারিগর আমাদের দিকে তাচ্ছিল্যভাবে চেয়ে বলে, কাগজ কাঁহা! হিয়া পত্তি মিলবে! বিড়ি বনানে কা পত্তি!

না, না!—আমাদের যতদূর হিন্দির দৌড় তাই দিয়েই বোঝাবার চেষ্টা করতে হয়েছে—কাগজ, মানে ওই কী বলে—পত্রিকা।

পরিকা! আরে পরিকা কাঁহা, কারিগর এক রাশ বিড়ি গুছিয়ে নিয়ে একটি বান্ডিলে বেঁধে ফেলতে ফেলতে ধৈর্য ধরেই বলে, পংরি নেহি, পত্তি, পতি! আভি সমঝমে আয়া?

হাঁ হাঁ, আয়া আয়া—তাড়াতাড়ি নিজেদের সংশোধন করে বলতে হয়—উও কাগজ না। ওই যিসকো বোলতা জাহাঙ্গির না হুমায়ুন!

হুমায়ুন! বলে কারিগর আমাদের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহসূচক উচ্চারণটা করতেই আসল শব্দটা আমাদের মনে পড়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিয়ে নিজেদের শুধরে বলেছি, নেহি, নেহি– হুমায়ুন-জাহাঙ্গির নেই—আকবর! আকবর!

আকবর? আমাদের উচ্চারণের গুণেই বোধহয় কারিগরকে ভুরু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকাতে হয়েছে।

আমরা ব্যস্ত হয়েছে উঠেছি এবার আমাদের বক্তব্যটা আরও ভাল করে বোঝাতে, হাঁ, হাঁ—আকবর! তবে ওই দিন দিন যে আকবর নিকলতা–ও নেহি, হপ্তা হপ্তা মানে সাত-সাত দিনমে যো আকবর পয়দা হোতা ওইসা কুছ-

ঠিক হ্যায়! ঠিক হ্যায়! এবার একটু কৌতুকের হাসি ফুটে উঠেছে কারিগরের মুখে। সেই হাসি নিয়েই, আমাদের আজব হিন্দির বোধ দিয়ে, সে তার নিজস্ব বাংলায় বুঝিয়ে দিয়েছে যে হপ্তায় হপ্তায় যে কাগজটা এখান থেকে বার হত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন। তবে ওপরে কাগজের অফিস যেখানে ছিল সেখানে মাঝে মাঝে দু-একজনকে সে যেতে-আসতে দেখেছে। সুতরাং সেখানে আমরা খোঁজ করে দেখতে পারি।

কাগজ বন্ধ শুনে হতাশ হবার কথা। তবু অফিসটা একেবারে বন্ধ না হওয়ার যে খবরটুকু কারিগরের কাছে পাওয়া গেল তারই ওপর ভরসা করে ওপরের তলায় একবার টু না মেরে পারলাম না।

ওপরে ওঠবার সিঁড়ি, তারপর কোল্যাপসিবল লোহার দরজা ও তারপরে বেশ লম্বা-চওড়া অফিস ঘরটা। নতুন করে বর্ণনা দেবার কিছু নেই। পরাশর বৃত্তান্তে তাঁর বন্ধু ও কীর্তিগাথাকার প্রতি কাহিনীতে যেরকম বর্ণনা দেন, জায়গাটা ঠিক তাই। সেই চওড়া সব বেমানান সিঁড়ি দিয়ে উঠে কোল্যাপসিবল গেট আর তা পেরিয়ে বেশ প্রশস্ত হলেও বেঢপ অফিস ঘরটা পর্যন্ত ঠিক ঠিক কেতাবি বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেল। মিলে গেল সেকেলে বিরাট একটু-আধটু পালিশ-ওঠা রং-চটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা পর্যন্ত।

কিন্তু টেবিলের ওধারে বসে একটা বই হাতে নিয়ে যিনি তাঁর ঘূর্ণি চেয়ার একটু ঘুরিয়ে তাতে হেলান দিয়ে পড়ছেন, তাঁর সঙ্গে বই থেকে পাওয়া বর্ণনা মিলছে না একেবারেই।

কোল্যাপসিবল দরজাটা বেশ ফাঁক করে খোলা থাকায় দ্বিধাভরে হলেও আমরা চারজনেই তখন অফিস ঘরটায় ঢুকে পড়েছি। পরস্পরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কে প্রথম দরকারি প্রশ্নটা করবে তা ঠিক করবার চেষ্টা করছি তার মধ্যেই মুখ থেকে। হাতের বইটা না নামিয়েই সেক্রেটারিয়েটের ওধারে আসীন মানুষটি বললেন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আসুন, বসুন।

একটু চমকে উঠে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম—মানুষটার কি এক্স-রে দৃষ্টি নাকি যে চোখের সামনে বই ঢাকা থাকলেও তার ভেতর দিয়ে দেখতে পায়!

আমরা তাঁর টেবিলের কাছে পৌঁছবার পর তিনি অবশ্য বইটা নামিয়ে বললেন, বসুন।

আমরা কিন্তু বসতে পারলাম না। একটু ইতস্তত করে কোনওরকমে আসার উদ্দেশ্যটা জানালাম, দেখুন আমরা কী বলে একজনের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাঁর খোঁজেই এখানে এসেছি।

বলুন, কার সঙ্গে দেখা করতে চান? সেক্রেটারিয়েট টেবিলে বসা মানুষটির গলায় আপ্যায়ন না থাকলেও বিরূপতা নেই। ভাবটা এই যে আমাদের কথা শুনতে ব্যগ্র না হলেও তাতে তাঁর আপত্তি নেই।

আমরা মানে— ওইটুকু অনুমতি পেয়েই আমরা এবার এক নিঃশ্বাসে জানালাম—কৃত্তিবাসবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাঁর একটা পত্রিকা এখান থেকে বার হত। সেই ঠিকানা থেকেই এখানে খোঁজ করতে এসেছি।

মানুষটির মুখে একটু যেন হাসির রেখা ফুটে উঠেছে কি না ঠিক বুঝতে পারলাম না। গলাটা কিন্তু বেশ একটু গম্ভীর রেখেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি কাগজে কিছু লেখা দেবার জন্য এসেছেন?

না, না,—আমরা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালাম-লেখা-টেখা নয়, পত্রিকার ব্যাপারও কিছু নয়, আমরা তাঁর সঙ্গে একটু অন্য ব্যাপারে দেখা করতে চাই।

বেশ, এবারে মুখের ভাবে আর সেই সঙ্গে গলার স্বরে প্রসন্ন আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বললেন, যা বলবার আমার কাছেই তা হলে বলতে পারেন। আমি-ই কৃত্তিবাস ভদ্র।

আপনিই কৃত্তিবাস ভদ্র! কথাটা আমাদের চারজনের মুখ দিয়েই আপনা থেকে বেরিয়ে এল।

নিজেকে কৃত্তিবাস ভদ্র বলে যিনি ঘোষণা করেছেন আমাদের অবাক হবার কারণটা তিনি অনুমান করে নিয়ে নিজেই ব্যাখ্যাটা দিলেন এবার—হাঁ, আমিই কৃত্তিবাস ভদ্র। কথাটা ঠিক বিশ্বাস যে হচ্ছে না, তাতে বোঝা যাচ্ছে পরাশরকে নিয়ে লেখা আমার বইগুলো কিছু কিছু আপনারা পড়েছেন আর তাতে আমাদের চেহারার যে বর্ণনা পেয়েছেন তাই থেকেই আমাকে কৃত্তিবাস ভাবতে বাধছে, কেমন?

হ্যাঁ-না কিছুই বলতে না পেরে আমরা তখন একটু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে।

স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাস নিজের বক্তব্যটা আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, বইগুলোতে দুজনের চেহারা বদলাবদলি করে বর্ণনা দিয়েছি।

কেন? চারজনের মুখে একই প্রশ্ন শোনা গেছে। কেন? আমাদের বিশেষ করে পরস্পরকে চেনা কঠিন করবার জন্য, বলে। স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাস একটু হেসে আবার জিজ্ঞাসা করেছেন, আমাকে কেন খুঁজছেন তা এখনও বললেন না!

আমরা মানে, দুবার ঢোঁক গিলে আমাদের সকলের হয়ে গৌরই কথাটা এবার বলেই ফেলেছে, আমরা আপনার পরাশর বর্মার ঠিকানাটা জানবার জন্যই আপনার খোঁজে এখানে এসেছি।

পরাশরের ঠিকানা জানবার জন্য খোঁজ করে আমার কাছে এসেছেন—

স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাসের মুখ যেন একটু গম্ভীর দেখিয়েছে।

তাঁর জন্য নয়, পরাশরের খোঁজে তাঁর কাছে এসেছি শুনে এরকম একটু ক্ষোভ অবশ্য হতেই পারে। তিনি অবশ্য চটপট সেটা কাটিয়ে উঠে আবার বলেছেন, পরাশরের ঠিকানা চাইতে এসেছেন। কিন্তু তার ঠিকানা কাউকে দেবার অনুমতি যে আমার নেই।

অনুমতি নেই!—আমরা বেশ হতাশ।

হ্যাঁ, অনুমতি নেই—স্বঘোষিত কৃত্তিবাস আমাদের প্রতি সহানুভূতিই দেখিয়ে জানিয়েছেন—তা তবে আপনারা কী জন্য তাঁকে খুঁজছেন যদি বলেন তা হলে তাঁকে একটা খবর আমি দিতে পারি।

খবর দিতে পারেন!-আমরা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছি আশায়—একটা কথা তা হলে তাঁকে যদি জানান।

কী কথা? গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাস।

এই মানে—আমি কথাটা শুরু করতে গিয়ে জিভে যেন জট পাকিয়ে ফেলেছি——ওই কী বলে বাহাত্তর নম্বর—মানে–

স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাসের মুখের চাপা একটু কৌতুকের ভাবটা আরও ভড়কে দিয়েছে আমাকে।

সবকিছু গুলিয়ে গোলমাল করে ফেলে আমার মুখ দিয়ে যা বেরিয়েছে তা হল— হ্যাঁ, মানে ওই বাহাত্তর নম্বর মানে গলির ওই বাড়িটা বুঝেছেন কিনা—

কী বুঝবেন উনি তোমার ওই পাগলের প্রলাপে? শিবু আর গৌর দুজনেই ঝংকার দিয়ে উঠে এবার আমায় একেবারে অপ্রস্তুত করে থামাল।

কিন্তু আমার লজ্জা নিবারণ করলেন স্বয়ং স্ব-ঘোষিত কৃত্তিবাস ভদ্র। একটু হেসে শিবু আর গৌরকে থামিয়ে তিনি বললেন, না, না—আপনারা মিছিমিছি উত্তেজিত হবেন না। যা বলবার উনি ঠিকই বলেছেন।

ঠিকই বলেছে! শিবু আর গৌরের সঙ্গে এবার শিশিরও যোগ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে—ও যা বলেছে তাতে তার এক বর্ণও আপনি কিছু বুঝেছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝেছি বইকী! ঠিকই বুঝেছি, আমাদের নতুন চেনা কৃত্তিবাস ভদ্র সকলকে একসঙ্গে আশ্বস্ত আর হতভম্ব করে বলেছেন, আপনাদের ওই ঠিকানায় পরাশর বর্মা একদিন যাতে যান তাই আপনারা চান তো? বেশ তো ব্যবস্থা করা যাবে।

সে ব্যবস্থা করা যাবে! নিজেদের কানগুলোকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে আমিই সবার আগে বলেছি, তা হলে বিকেলে চারটা নাগাদ আমরাই ট্যাকসি নিয়ে এখানে আসতে চাই। অবশ্য পরাশরবাবুর নিজের কোনও অসুবিধে যদি না থাকে।

না, না, কৃত্তিবাস আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, পরাশরের কোনও অসুবিধা হবে না। তবে ট্যাকসি নিয়ে আপনাদের আসবার কোনও দরকার নেই। পরাশর নিজেই ঠিক চারটের সময় আপনাদের বাহাত্তর নম্বরে গিয়ে পৌঁছবেন।

তিনি নিজেই গিয়ে পৌঁছবেন! আমরা এবার বেশ একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলেছি, কিন্তু তার চেয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে এলে কি ভাল হত না? মানে—আমাদের গলিটা ওই কী বলে—একটু গোলমেলে কিনা খুঁজে পেতে যদি—

দেখাই যাক না তা হলে পরাশরের দৌড়টা! আমাদের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কৃত্তিবাস ভদ্র বলেছেন, দারুণ দারুণ রহস্যভেদের বড়াই যে করে এই গলি খোঁজার ব্যাপারেই তার পরীক্ষা হয়ে যাক না। একটু থেমে আমাদের আবার আশ্বাস দিয়েছেন, আপনাদের কোনও ভাবনা নেই। কাল ঠিক চারটের সময় আপনাদের বাহাত্তর নম্বরের দরজায় পরাশর বর্মাকে হাজির দেখবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

এরপর আর কিছু বলা যায় না বলে মনের কথা মনেই চেপে রেখে বাধ্য হয়েই বিদায় নিয়ে এসেছি।

কে জানে পরাশর বর্মা সত্যিই বাহাত্তর নম্বরের দরজায় ঠিক চারটের সময় হাজির হতে পারবেন কিনা?

না পারলে আমাদের অনেকগুলো ভাল ভাল সাজানো চাল কিন্তু সত্যিই মাটি হয়ে। যাবে।

কত কায়দা করেই না সমস্ত দৃশ্যটা ছকে রেখেছি।

পরাশর বর্মাকে নীচে থেকে অভ্যর্থনা করে আমরা তাঁকে নিয়ে ওপরের আড্ডাঘরে গিয়ে ঢুকব। ঘনাদাকে তার আগেই রামভুজের হাঁড়িয়া কাবাবের নমুনা চাখাবার জন্য তাঁর মৌরসি কেদারায় বসিয়ে হাতে একটা প্লেট ভর্তি কাবাব আর চামচ ধরিয়ে দেওয়া থাকবে।

বারান্দা থেকে আড্ডাঘরে ঢুকে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলব, দেখুন, ঘনাদা, কাকে আজ ধরে এনেছি, দেখুন।

আমাদের উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়িতে ঘনাদার মেজাজটা খুব খোশ তখন নিশ্চয়ই নেই। তিনি ভুরু কুঁচকে অকিঞ্চিৎকর কিছু দেখার ভঙ্গিতে একবার একটু ঘাড় ফিরিয়েই আবার তা ঘুরিয়ে নিয়ে হাঁড়িয়া কাবাব চাখায় মনোনিবেশ করবেন।

আমরা ততক্ষণে পরাশর বর্মাকে ঘরের মধ্যে তাঁর কাছাকাছি এনে ফেলেছি। একসঙ্গে দু-তিনজনের গলায় তখন কলধ্বনি উঠবে—কাকে এনেছি জানেন? স্বয়ং পরাশর বর্মা আজ আমাদের এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।

এবার যা হবে সেইটেই দেখবার মতো।

ঘনাদা হাঁড়িয়া কাবাবের প্লেট থেকে যেন একটু করুণা করে চোখ তুলে পরাশর বর্মার দিকে তাকাবেন। তারপর আবার প্লেটের দিকেই চোখ ফেরাতে ফেরাতে বলবেন, বেশ! বেশ! পায়ের ধুলো যখন দিয়েছেন তখন ওঁকে বসতে বলো। তা উনি করেন কী?

উনি করেন কী? ওঁকে আপনি চেনেন না? উনি হলেন অদ্বিতীয় গোয়েন্দা পরাশর বর্মা।

ভাল! ভাল। এ সব লোকের সঙ্গে আলাপ থাকা ভাল। বসুন, গোয়েন্দা মশাই, আরাম করে বসুন।

যাঁকে এমন করে হেনস্থা করার চেষ্টা সেই পরাশর বর্মা কি নীরবে এই অপমান সয়ে যাবেন?

পালটা কোনও জুতসই মার কি তাঁর ভাঁড়ারে নেই। তা থাকবে বই কী?

ঘনাদার ব্যঙ্গ অনুরোধের আগেই আমরা অবশ্য এই দিনটির জন্যই আনানো ঘনাদার কেদারার দোসর একটিতে পরাশর বর্মাকে পরম সমাদরে বসিয়ে দিয়েছি।

তিনি কিন্তু ঘনাদার মতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সুরে নয়, বেশ সহজ স্বাভাবিক গলায় আমাদের শুধু জিজ্ঞাসা করবেন এবার আচ্ছা, আপনারা আমার পরিচয় দিচ্ছেন, কিন্তু উনি কে তা তো জানতে পারলাম না।

উনি! উনি!—আমাদের এবার আবার একবার গদগদ হবার পালা-উনি হলেন। ঘনাদা—

ভনাদা?—পরাশর বর্মার মুখের ভাবে আর গলার স্বরে যেন অকৃত্রিম সারল্য, কিন্তু মার হিসেবে ঘনাদাকে ভনাদা শোনা বুঝি একেবারে মোক্ষম!

এরপরে যা হবে তা বুঝি আমাদের বানিয়ে ভাববারও ক্ষমতা নেই। সেই দুই মহারথীর তিরন্দাজি বাহাদুরির জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্ষটুকু শুধু চাই।

সেই ধৈর্য ধরতে আমরা প্রস্তুত, কিন্তু আসর যাঁরা মাত করবেন সেই দুই। তালেবরের ঠিক মতো মোলাকাত তো চাই।

পরাশর বর্মাকে নিজেরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে আনবার জন্য তাই অত ব্যস্ত। হয়েছিলাম। কিন্তু সে ইচ্ছে যখন পূরণ হবার নয় তখন তাঁর প্রতিনিধি কৃত্তিবাস ভদ্রের কথায় বিশ্বাস করে তাঁর জন্য বাহাত্তর নম্বরের গেটেই অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কী?

অপেক্ষা করার দিক দিয়ে অবশ্য কোনও ত্রুটি রাখিনি। পরাশর বিকেল ঠিক চারটের সময় বাহাত্তর নম্বরের দরজায় হাজির হবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাঁর প্রতিনিধি কৃত্তিবাস। আমরা কোনও দিকে কোনও ভুলচুকের ফাঁক না রাখবার জন্য একেবারে বেলা তিনটে থেকেই দরজার বাইরের রাস্তায় খাড়া। খাড়া একলা কেউ নয়—চারজনই এক সঙ্গে। ঘড়ি আমাদের সকলেরই হাতে আর তা রেডিয়োর সঙ্গে দফায় দফায় মেলানো।

কিন্তু তিনটে থেকে সওয়া তিনটে, সাড়ে তিনটে, পৌনে চারটে প্রায় বাজতে চলল। পরাশর বর্মার এখনও দেখা নেই।

আমরা একবার নিজেদের ঘড়ির দিকে আর তারপর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি। রাস্তাটা—আমাদের গলিটা যাতে গিয়ে পড়েছে সেই সদর রাস্তা। সেদিকে ব্যাকুল হয়ে তাকাবার সঙ্গে কানটাও খাড়া রাখতে ভুলিনি। ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ি যাতেই পরাশর বর্মা আসুন আগে থাকতে তার আওয়াজটা পাবই।

কিন্তু তিনটে সাতান্ন আটান্ন উনষাট হয়ে কাঁটা দুটো চারটের দাগ ছুঁই ছুঁই করতে চলেছে। পরাশর বর্মার কি সময়জ্ঞান বা কথা রাখার কোনও বালাই নেই। তাঁর হয়ে কৃত্তিবাস ভদ্র কথা দিয়েছেন যে ঠিক চারটের সময় তিনি বাহাত্তর নম্বরের দরজায় হাজির হবেন। চারটের সময় বলে তিনি পাঁচটা-ছ-টা করবেন নাকি? না, একেবারেই আসবেন না?

তা হলে আমাদের সব আশায় ছাই।

কোনও লাভ নেই জেনেও সামনের বড় রাস্তার দিকে একটু এগিয়ে দেখব কি না ভাবছি, এমন সময়—এই যে! শুনে চমকে একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে একেবারে যেমন হতভম্ব তেমনই একটু অপ্রস্তুত।

সেখানে স্বয়ং পরাশর বর্মা না হলেও তাঁর প্রতিনিধি কৃত্তিবাস ভদ্র হাসি মুখে বলছেন, এইটেই তো আপনাদের বাহাত্তর নম্বর।

নিজেদের ঘড়িগুলোর দিকে চেয়ে দেখি সেখানে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় চারটে! হতভম্ব বেশ একটু হলেও যতটা অপ্রস্তুত হবার কথা ততটা যে হইনি তার যথেষ্ট কারণ অবশ্য আছে। সোজা সামনের রাস্তা ছেড়ে আমাদের বনমালি নস্কর লেনটা পেছনে যেসব সরু সরু জঘন্য গলির গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে—আর যেসব গলি ব্যবহার করা দূরে থাক, ভাল করে চিনি-ই না—সেই পথেই তিনি আসবেন তা ভাবব কী করে!

তা ছাড়া যিনি এসেছেন তিনি তো পরাশর বর্মা নন, তাঁর প্রতিনিধি কৃত্তিবাস ভদ্র। আসার কথা থাকলেও পরাশর নিজে এলেন না কেন?

আমাদের মনের প্রশ্নটা মুখে ফোটবার আগেই কৃত্তিবাস নিজে থেকেই জবাবটা দিয়ে জানালেন, বিশেষ একটা কাজেই আটকা পড়ার দরুন তাঁর হয়ে কৃত্তিবাসকেই আসতে হয়েছে। কৃত্তিবাসের কাছে ব্যাপারটা শুনে প্রয়োজন হলে পরাশর নিজে আসবেন।

দুধের সাধ ঘোলে মেটে না জেনেও এত কষ্টে সাজানো ব্যাপারটা পুরোপুরি পণ্ড হতে দেবার জন্য কৃত্তিবাসকে নিয়েই বাহাত্তর নম্বরে ঢুকতে হল।

সিঁড়ি দিয়ে কৃত্তিবাসকে নিয়ে ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সাজানো প্রোগ্রামের আর-এক চালের ভুলের নমুনা পেলাম।

ব্যবস্থা ছিল এই যে আমরা পরস্পরকে নিয়ে যখন ওপরে উঠে আসব তখন ঘনাদা আড্ডাঘরে তাঁর মৌরসি কেদারায় প্লেটে করে হাঁড়িয়া কাবাবের নমুনা চাখতে ব্যস্ত থাকবেন। ঠিক তখনই আমরা পরাশর বর্মাকে তাঁর কাছে হাজির করব এইটেই প্রোগ্রামের একটা ছকা চাল।

পরাশর না হয়ে কৃত্তিবাস হলেও আড্ডাঘরে ঢোকার পর ঘনাদার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলে যৎকিঞ্চিৎ একটা পালা হয়তো জমানো যেতে পারত।

কিন্তু কেমন করে যেন ঘনাদার সঙ্গে বেটপ্পা বারান্দার ওপরই দেখা হয়ে গেল। দেখা হয়ে যাবার পর আমাদের পাকা চালগুলো কেঁচে গিয়ে এত তোড়জোড় আর হয়রানির যৎসামান্য একটু উসুল করবার মতো কিছু পাওয়া যাবে কি?

তা অবশ্য গেল।

আর যা গেল তা আমাদের সব হিসেবের বাইরে।

ন্যাড়া সিঁড়ির নীচের ধাপ থেকে বারান্দার অন্য প্রান্তে কৃত্তিবাসের সঙ্গে আমাদের দেখে ঘনাদা অমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন কে ভাবতে পেরেছিল?

উচ্ছ্বসিত অবস্থাতেই বিদ্যাসাগরি চটি ফটফটিয়ে আমাদের দিকে আসতে আসতে তিনি বললেন, আরে পরাশর যে! এসো, এসো! তুমি হঠাৎ আসবে এ যে ভাবতেই পারিনি।

ঘনাদা আমাদের দেখে এমন উচ্ছ্বসিত হবেন তাও ভাবতে পারিনি আমরা। একটু হতভম্ব অবস্থাতেই ঘনাদার ভুলটা সংশোধনের জন্য তবু ব্যস্ত হতে হল।

ইনি পরাশর নন, ঘনাদা—মানে ইনি তাঁরই বন্ধু আর প্রতিনিধি কৃত্তিবাস ভদ্র, মানে–

ওইখানেই আমাদের এক ধমকে থামিয়ে ঘনাদা বললেন, বটে! উনি পরাশর নন, কৃত্তিবাস? জাত জেলেকে কই দেখিয়ে তেলাপিয়া বোঝাচ্ছ? পাকা মালিকে বাগানে লিচু দেখিয়ে বলছ আঁশফল? ও যদি পরাশর না হয় তা হলে আমি–

না, না ওঁদের কোনও দোষ নেই— আমাদের অবস্থা দেখেই বোধহয় কৃত্তিবাস এবার দয়া করে গোলমালের জটটা ছাড়ালেন।

কিন্তু তিনি যা বললেন তাতে আমরা আবার থ।

আমাদের কৃত্তিবাস নাকি সত্যিই কৃত্তিবাস নন, তিনিই আদি ও অকৃত্রিম পরাশর বর্মা। কৃত্তিবাস ভদ্র কিছুদিনের জন্য কোনও এক সাংবাদিক সম্মিলনীতে দূরে কোথাও গেছেন বলে পরাশর তাঁর বাড়িতেই ক-দিনের জন্য অজ্ঞাতবাসে আছেন। সেই অবস্থায় আমরা সেখানে তাঁকে দেখে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হই বলেই তার সুযোগ নিয়ে তিনি নিজেকে কৃত্তিবাস বলে চালিয়েছেন। ছদ্মনামে এখানে এলেও তাঁর সত্যকার উদ্দেশ্যটা এবার তিনি সরবে ঘনাদাকেই উদ্দেশ করে বললেন, মিথ্যে নাম দিয়ে এখানে আসার সত্যিকার উদ্দেশ্য হল আপনাকে দেখে আপনার পায়ের ধুলো নেবার সুযোগ নেওয়া।

কথাগুলো বলতে বলতে আমাদের কৃত্তিবাস থুড়ি পরাশর বর্মাকে সত্যিসত্যি নিচু হয়ে ঘনাদার পায়ের ধুলো নিতে দেখে আমরা তো থ।

আমাদের সাজানো নাটক আসল অভিনয়ে এ রকম দাঁড়াবে আমরা কি ভাবতে পেরেছি!

এরপর বিস্ফারিত চোখে যা যা দেখলাম সে সবই আমাদের হিসেবের বাইরে। বিবরণটা পরপর শুধু দিয়ে যাই।

কৃত্তিবাস থুড়ি আসলে পরাশর পায়ের ধুলো নিতে নিচু হতেই—আরে, করো কী করো কী বলে ঘনাদা যে আলতো বাধা দিলেন তাতে কৃত্তিবাস থুড়ি পরাশর বর্মার ধুলো না মিলুক, পা ছুঁতে কোনও অসুবিধা হয় না।

ঘনাদা এবার পরম সমাদরে কৃত্তিবাস থুড়ি পরাশরকে তুলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আড্ডাঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে গেলাম অবশ্য আমরাও।

এ দুই ক্ষণজন্মার মিলনের জন্য ঘনাদার মৌরসি কেদারার জুড়ি আর একটি কেদারা আগে থাকতে আমরাই পাতিয়ে রেখেছিলাম।

সে দুই কেদারাতেই বসে দুজনের আলাপ যেটা শুরু হল সেইটেই আমাদের চিত্রনাট্যের একেবারে উলটো।

দুজনের দেখা হবার পর কাছাকাছি বসার সঙ্গে সঙ্গে ঠোকাঠুকিতে আগুনের ফুলকি ছোটাবার কথা, তার বদলে মধু ঝরে পড়তে লাগল যেন দুজনের জিহ্বা দিয়ে।

নিজেদের কানে শুনতে হল ঘনাদা বলছেন, কতবার ভেবেছি এদের কাউকে দিয়ে তোমায় একবার বাহাত্তর নম্বরে ডাকিয়ে আনি। কিন্তু তুমি ব্যস্ত মানুষ, তার

ওপর তোমার এত নাম-ডাক। সত্যিই আসবে কি না বুঝতে না পেরে —

না, না, কী বলছেন, কী! ঘনাদাকে থামিয়ে পরাশর—হ্যাঁ, সত্যিই পরাশর আবার মধু বর্ষণ শুরু করেন, আমারই কতদিন ধরে আসবার ইচ্ছে। শুধু আপনি পাছে বিরক্ত হন এই ভয়ে—

না, না বিরক্ত হব কী— বলে ঘনাদা মহানুভবতার পরিচয় দিতে যাচ্ছিলেন। তার আর অবসর না দিয়ে পরাশর তৎক্ষণাৎ আবার সচ্ছাসে বলে ওঠেন, তবে চোখে না দেখলেও যেখানে গেছি সেখানেই আশ্চর্য সব কাণ্ডের মধ্যে আপনার হাতের ছাপ ঠিক ধরতে পেরে ধন্য ধন্য করেছি মনে মনে। এই তো সেদিন টেকসাসেনা, না অ্যারিজোনায় সেই ক্রুগার-এর আজব ভুট্টার খামারে। কোন ক্রুগার-এর কথা বলছি আপনি তো বুঝতেই পারছেন।

ঘনাদাকে একটু কি অপ্রস্তুত দেখিয়েছে। দেখালেও তা সেকেন্ড দু-একের জন্য। তাতেই সামলে তিনি বলেছেন, সেই ওটিস ক্রুগার-এর কথা বলছ তো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ওটিস কুগার! ঘনাদার স্মরণশক্তিতে যেন অবাক হয়ে বলেন। পরাশর, সে তো আসলে গুপ্ত এক নাৎসি শয়তান হিটলারের জার্মানিতে একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চালাত। তারপর যুদ্ধে জার্মানির হার হবার পর লুকিয়ে বারবার নাম ভাঁড়িয়ে অনেক ছলচাতুরি করে আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া, সেখান থেকে কানাডা হয়ে আমেরিকার দক্ষিণে পালিয়ে আসে। সে যে সেখানে এসেও কী সর্বনাশা শয়তানি চক্রান্ত আঁটছিল সেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা জার্মানির বিপক্ষে ছিল সেই সমস্ত দেশের মানুষের মধ্যে কে যে প্রথম ধরে ফেলেন আর তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করেন তা আমেরিকার অ্যারিজোনা থেকে এক মি. কেগান-এর জরুরি ডাক পেয়ে সেই কেগান-এর বিরাট র‍্যাঞ্চ-এ যাবার পর বুঝলাম।

কেগান-এর র‍্যাঞ্চ একটা দেখার মতো জায়গা। মাইলের পর মাইল কোথাও যেন সীমানেই ঢেউ-খেলানো আধা-বুনো ঘোড়ার পাল চরিয়ে বড় করবার প্রান্তর। কোথাও বা তেমনই বিশাল ভুট্টার খেত। সে এমন যে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

দেবতাদের কাছেও লোভনীয় এইসব তুলনাহীন র‍্যাঞ্চ-এর এক দারুণ দুশমনকে ধরে এনে কেগান-এর হাতে তুলে দেবার জন্য আমার সেখানে ডাক পড়েছিল।

কেগান-এর সঙ্গে আমার যেখানে দেখা হল সেটা ওই র‍্যাঞ্চ-এর মধ্যেই তার একটা ছোট ল্যাবরেটরি।

কিন্তু সে ল্যাবরেটরির চেহারা দেখে মনে হল দুটো খ্যাপা মোষ যেন তার মধ্যে তোতি করে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। অবস্থা তাতে যা দাঁড়িয়েছে তাতে ভাঙচুর জিনিসের আবর্জনার স্তুপে চালান করা ছাড়া কোনও গবেষণার কাজ আর তা দিয়ে যে চালাবার নয় তা বুঝতে দেরি হয় না।

ল্যাবরেটরির অবস্থা স্বচক্ষে আমি যাতে দেখি সেই জন্যই নিশ্চয় কোন সেখানে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। ল্যাবরেটরির মতো তার মালিকের অবস্থাও অবশ্য শোচনীয়। তাঁর মাথায় একটা চওড়া ব্যান্ডেজ বাঁধা, বাঁ হাতটাও কাঁধ থেকে একটা স্লিং-এ ঝোলানো।

কেগান কম কথার মানুষ। চুরমার হওয়া ল্যাবরেটরি আর নিজের জখমি চেহারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা না করে সোজাসুজি বললে, দেখুন, মিস্টার ভর্মা, এখানে যা দেখবার, দেখেছেন। এ ছাড়া আমার সমস্ত র‍্যাঞ্চটা আপনাকে ভাল করে দেখাবার ব্যবস্থা আমি করছি। এ সব দেখে এই ল্যাবরেটরি নিয়ে আমার এই র‍্যাঞ্চ-এর সব দিক দিয়ে চরম সর্বনাশ যে করেছে তাকে যে কোনও উপায়ে তোক ধরে আমার হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে। এ ব্যাপারে কাগজে কাগজে জানাজানি আর পুলিশের ঘাঁটাঘাঁটি আমি চাই না। তাই সম্পূর্ণ নিঃশব্দে গোপনে কাজটা হাসিল করার ভার আপনার ওপর দিতে চাই। ওই সঙ্গে এ কথাটাও জানিয়ে দিচ্ছি যে খরচার ব্যাপার আপনি যা দরকার মনে করেন, করতে পারবেন। এখন আমার এক কর্মচারীকে দিয়ে আপনাকে র‍্যাঞ্চটা দেখাবার ব্যবস্থা করি।

কেগান তার একজন কর্মচারীকে ডাকতে যাচ্ছিল। আমি যে এখানে আসার পরে—কেগান-এর সঙ্গে বিকেলে দেখা হওয়ার আগেই-র্যাঞ্চ-এর যা যা বিশেষ দেখবার তা দেখা সেরে ফেলেছি সে কথা জানিয়ে কেগানকে বাধা দিয়ে বললাম, শুনুন, দরকার হলে যা দেখবার সময়মত দেখা যাবে। তার আগে যে মানুষটিকে ধরে এনে আপনার হাতে তুলে দিতে বলছেন তার একটু বিবরণ আর পরিচয় আমার জানা দরকার নয় কি? মানুষটা কে, কোথা থেকে এল, কী কাজে তাকে লাগিয়েছিলেন, সবই আমি জানতে চাই।

দেখুন, তার দুশমনির কথা মনে করতে গিয়েই রাগে আক্রোশে মুখটা বিকৃত করে কেগান বললেন, সত্যি কথা বলতে গেলে লোকটা সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না।

কিছু না জেনে তাকে আপনার র‍্যাঞ্চ-এ কাজ দিয়েছিলেন? আমি একটু সন্দিগ্ধ মুখেই জিজ্ঞাসা করে বললাম, এরকম দস্তুর তো আপনাদের নয়।

না, তা নয়, কেগান অত্যন্ত আফশোসের সঙ্গে স্বীকার করলে, কিন্তু এরকম আহাম্মুকি করার তখন একটা কারণ ছিল। র‍্যাঞ্চ-এ কাজ নেবার জন্য ভবঘুরে হাঘরে গোছের উটকো লোকই আসে। দেখামাত্র তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেদিন একটা শুটকো কালা মর্কট গোছের চেহারার হাঘরে এসেছিল। অমনই কাজের খোঁজে। তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তার মাঝে সে হঠাৎ মেজাজ দেখিয়ে বলল—আমাকে দেখেই তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন? একটা যা হোক কাজ দিয়ে দেখুন না। না পারলে দূর করে দেবেন।

লোকটাকে দেখেই আমার কেমন অদ্ভুত লেগেছিল। ও ধরনের চেহারা আমাদের এ অঞ্চলে চোখেই পড়ে না। এখানকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান নয়, কাফ্রি-টাফ্রি তো নয়ই। শুটকো পাকানো, খেতে-না-পাওয়া কেলে চেহারা দক্ষিণের মেক্সিকোর কোনও পাহাড়ি আদিবাসী-টাসী হবে ভেবেছিলাম। আমার র‍্যাঞ্চ-এর বুনো ঘোড়ার পাল আপনার এখনও হয়তো চোখে পড়েনি। সে পাল দেখলে বুঝবেন আমেরিকার এই দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোনও র‍্যাঞ্চ-এ এমন দুর্দান্ত বুনো ঘোড়ার পাল নেই, এদের মধ্যেও আবার কালাদানো বলে এমন একটা দারুণ তেজি বুনো ঘোড়া আছে, কোনও রাখাল এখনও যার গলায় ল্যাসো-র ফাঁস লাগাতে পারেনি। আমার ঘোড়ার রাখালরা অন্য ঘোড়া-টোড়া যা দরকার মতো ধরাবাঁধা করুক, ও কালাদানোর কাছেও ঘেঁসে না। বুনো ঘোড়াদের ভেতরও দৈত্যের মতো তাদের রাজার মতো এই কালাদানো নিজের খুশিতে ঘুরে বেড়ায়। একজন অতি সাহসী তাকে বাগে আনবার আহাম্মকি করতে গিয়ে হাত-পা তো বটেই, প্রাণটা পর্যন্ত গুনাগার দিয়েছে।

শুঁটকো মর্কটটার জাঁক শুনে তাকে একটু উচিত শিক্ষা দেবার জন্য ঠাট্টা করে বলেছিলাম—হ্যাঁ, কাজ তুই পাবি কালা নেংটি! তার জন্য কী করতে হবে জানিস?

আজ্ঞে, বলন কী করতে হবে।—কালা নেংটিটা বিনয়ে যেন গলে যাচ্ছে।

বললাম—আমার র‍্যাঞ্চ-এ ঘোড়ার পালটা দেখেছিস?

পাল আর কী দেখব, হুজুর–নেংটিটা তার বিনয়ে গদগদ গলাতেই একটু তাচ্ছিল ফুটিয়ে বলেছিল—দেখেছি আপনার কালাদানোকে! হ্যাঁ, ঘোড়ার মতো ঘোড়া বটে একটা!

বটে!—লোকটার মুখে কালাদানোর এই প্রশংসাতেও জ্বলে উঠে বলেছিলাম—তা হলে কালাদানোকেই বাগ মানিয়ে ধরে নিয়ে আয়, তা হলেই এখানে চাকরি তোর পাকা।

কিন্তু বলে লোকটা এবার একটু সুর টানতেই তার জারিজুরি খতম হয়েছে বুঝে বলেছিলাম কিন্তু আবার কী? সে মুরোদ তোর নেই, এই তো?

আজ্ঞে না, হুজুর?—লোকটা বলেছিল—আমি শুধু বলছি যে কালাদানোকে ধরা ভাল হবে না। সেটা উচিত নয়।

কেন উচিত নয়?—খিঁচিয়ে উঠেছিলাম লোকটার ওপর—তোর মতো কালা নেংটির কালাদানোকে ধরবার ক্ষমতা নেই তাই বল।

ক্ষমতা আছে কি না তা তো দেখতেই পাবেন, হুজুরনেংটিটা তবু যেন ধাপ্পা দিয়ে মান বাঁচাবার চেষ্টা করে বলেছিল কিন্তু ওরকম তেজি স্বাধীন রাজা-ঘোড়া একবার হার মেনে ধরা পড়তে বাধ্য হলে সে অপমান হজম করে আর বাঁচবে কি তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে।

থাম! থাম!—এবার সত্যিই জ্বলে উঠে আমার হান্টারটা দেখিয়ে বলেছিলাম—তোর বাহাদুরি সব বোঝা গেছে, এক কালাদানোকে ধরে আনতে পারিস তো আন, নইলে হান্টার দিয়ে চাবকে এ মুল্লুক ছাড়া করব।

আপনার যা মর্জি বলে লোকটা চলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম নেংটিটা আর এ মুখো হবার সাহসই করবে না।

দুদিন তার দেখাও পাইনি সত্যিই। কিন্তু তার পরে তিন দিনের দিন সকালে ঘুমভাঙার পর আমার শোবার ঘরের বাইরে লোকজনের হইচই হাঁকডাক শুনে। বাইরে এসে একেবারে তাজ্জব।

সেই কালা নেংটিটা ফিরে এসেছে।

আর ফিরে এসেছে একা নয়, সেই আমার র‍্যাঞ্চ-এ জীবন্ত তুফানের মতো দুর্দান্ত বুনোঘোড়া কালাদানোর ওপর সওয়ার হয়ে।

কথার খেলাপ না করে নেংটিটাকে কাজ দিলাম। কী কাজ করবি তুই? প্রথমে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অবশ্য। সে বলেছিল—আজ্ঞে, যে কাজ দেন তাই করব। তবে র‍্যাঞ্চটা তদারকি করতে দিলেই ভাল হয়।

ভাল হয়?—নেংটিটাকে ক-দিন খাটিয়ে তার হাড় কালি করার ব্যবস্থা করে বিদায় করব ঠিক করে নিয়ে বলেছিলাম—বেশ, তাই কর।

সেই বলাই যে আমার কাল হবে তা তখন ভাবতে পারিনি। ক-দিন বাদে লোকটাকে আমার ভুট্টাখেতের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম—তোকে এ খেতের বেড়া মেরামত করতে বলেছিলাম। খেতের ভেতর তুই করছিস কী?

সে এতটুকু অপ্রস্তুত না হয়ে বলেছিল—খেতের ভেতর সর্বনাশা পোকা হয়েছে, তাই তাদের মারবার ব্যবস্থা করছিলাম।

পোকা হয়েছে? আমার খেতে? খেপে উঠে বলেছিলাম—আমার সঙ্গে চালাকি হচ্ছে? কী পোকা হয়েছে, তাই বল?

না, আজ্ঞে, সে পোকা আপনি চিনবেন না—নেংটিটা সোজা আমার মুখের ওপর বলেছিল—তবে সে পোকা আজ রাত্রে আপনাকে দেখিয়ে দেব।

রাত্রে আমার খেতের বাইরের সীমানার ওপর নানা জায়গায় আগুন জ্বেলে সে সত্যিই আলোর টানে উড়ে এসে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া রাশি রাশি পোকা আমায় দেখিয়ে বলেছিল—এর নাম মাজরা পোকা। এ আপনার দেশের পোকা নয়।

আমার দেশের পোকা নয়, এখানে এল কী করে?-রেগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাকে।

দরকারে কোথাকার পোকা কোথায় আসে কেউ জানে?—বলে নেংটিটা আমার হাতের একটা রাম-রদ্দা খাবার ভয়েই বোধহয় সরে পড়েছিল। কিন্তু পরের দিন সকালেই আমার ল্যাবরেটরিতে তাকে একটা টেবিলে বসে যন্ত্রপাতি টিউব ইত্যাদি মন দিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে একেবারে আগুন হয়ে উঠে বলেছিলাম-তুই এখানে? আমার ল্যাবরেটরিতে? কার হুকুমে এখানে ঢুকেছিস?

হুকুম আবার কার!—সে নেংটিটা বেপরোয়া গলায় জবাব দিয়েছিল—সমস্ত র‍্যাঞ্চ তদারকি করা আমার কাজ। তাই ল্যাবরেটরিতে কী হচ্ছে তাই দেখছি।

তাই দেখছিস! তোর ওই দেখার চোখ দুটোই উপড়ে ফেলে দেব!বলে তার ঘাড়টা মটকাবার জন্য ধরতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল। নেংটিটা কী এমন শয়তানি প্যাঁচ লাগাল যে ঘাড়মাথাটা দেয়ালে ঠুকে একেবারে সচাপ্টে ছিটকে গিয়ে পড়লাম। তখন আর ওঠবার ক্ষমতা নেই। সেই অবস্থাতেই দেখলাম ওই ঘরেরই একটা লোহার ডাণ্ডা নিয়ে সে সমস্ত ল্যাবরেটরি চুরমার করে দিয়ে আমার লক্ষ লক্ষ ডলারের সব গবেষণা নষ্ট করে দিচ্ছে। ল্যাবরেটরি ধ্বংস করার পর সে পালিয়েছে, কিন্তু আমেরিকা ছেড়ে এখনও যেতে পেরেছে বলে মনে হয়। আমার এমন বন্ধুবান্ধব কিছু আছে যারা তা হলে আমায় ঠিক খবর দিত। এখন আপনাকে যেমন করে হোক এই কালা নেংটিটাকে ধরে আমায় হাতে তুলে দিতে হবে। আমি একটা একটা করে তার প্রত্যেকটা অঙ্গ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার সামনে ঝোলাব–

খুব সাধু সংকল্প আপনার! কেগানকে তার হিংস্র উল্লাসের মাঝখানে থামিয়ে বললাম, কিন্তু তার আগে আপনাকে কয়েকটা তথ্য শোনাই। আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে দুনিয়ায় প্রায় দু-লক্ষ আগাছা আছে, তার মধ্যে অধিকাংশ আগাছাই মানুষের খেত-খামার থেকে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু কিছু এমন কড়া আগাছা আছে যারা কোনও মতে হার মানে না। তাদের কারও বীজ মাটির তলায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর অনায়াসে ঘুমিয়ে থেকে আবার সুযোগ পেলেই–

আমি এ সব কথা বলতে বলতে লক্ষ করছিলাম, কেগানের মুখ এ সব শুনতে শুনতে প্রথমে কেমন হতভম্ব, পরে একেবারে রাগে লাল হয়ে উঠছে। সে তারই মধ্যে গনগনে গলায় আমায় বললে, এ সব কী প্রলাপ বকছেন আপনি?

ও, প্রলাপ মনে হচ্ছে? আমি যেন দুঃখিত হয়ে বললাম, তা হলে প্রলাপ না মনে হয় এমন কথা বলছি শুনুন—ব্র্যসিকা নায়গরা নামটা শুনলে আপনি হয়তো খুশি হবেন। ওর একটা আটপৌরে নামও আছে—

–ব্ল্যাক মাস্টার।

কে? কে বললেন কথাটা! না, পরাশর বর্মা কি তাঁর মুখ দিয়ে শোনা কেগান-এর কথা নয়।

এ উচ্চারণটি স্বয়ং ঘনাদার।

পরাশর বর্মা হাত তুলে সেলামের ভঙ্গি করে বললেন, ঠিক বলেছেন। ব্ল্যাক মাস্টারনামটা শুনিয়ে তারপর আবার কেগানকে বললাম, অনেক এমন নামগান আপনাকে শোনাতে পারি। এদের মধ্যে কোনওকোনওটি যে জমিতে জন্মায় সেখানকার ফসল শুধু ধ্বংস করার নয়, তা বিষিয়ে দেবার ক্ষমতাও আছে। ধরুন—অ্যানেস্থেরা বিয়েন্নিশ-নামটা একটু বাঁকাচোরা করেই বললাম, তবে ওর আটপৌরে নাম ইভনিং প্রিমরোজ নামটায় কোনও গোলমাল নেই। ওইরকম নামের দু-চারটে আগাহাকে চেষ্টা করে সর্বনাশা করে তোলা যায় নাকি, যাতে মানুষের এত যুগের চাষবাসের নাভিশ্বাস উঠতে পারে—

এ সব কথা আমায় শোনাবার মানে?

অনেক আগেই লক্ষ করেছি কেগান-এর বাঁ হাতটা স্লিং-এ ঝোলানো থাকলেও সে ডান হাতে একটা পিস্তল ধরে আছে। এবার সেটা আমার দিকে তুলে সে আবার বলল, এ সব কথা আমায় শোনাবার মানে কী?

মানে তো আপনার হাতের ওই পিস্তলই বলে দিচ্ছে। একটু হেসে পিস্তলের মুখটা একটু সরিয়ে দিয়ে বললাম, শুনুন, আপনার র‍্যাঞ্চ-এর চাষ লোক দেখানো ভুট্টার হলেও আসলে তা আগাছার—আর এমন আগাছার যা মানুষের এতকালের চাষ, তার কৃষিবিদ্যাকে ধ্বংস করার সর্বনাশা আয়োজন করতে পারে। কিন্তু সমস্ত সভ্য মানুষের এমন শত্রুতা আপনি করছেন কেন? করছেন এই জন্য যে আপনার আসল নাম কেগান নয়, জুগার, হ্যাঁ, হের গার—এই নামটা বদলে আপনার আগেকার নাৎসি স্বরূপটা চাপা দিতে চেয়েছেন। সফলও হয়েছিলেন। জার্মানির তখনকার শত্রু সমস্ত দেশের সর্বনাশের জন্য এই আমেরিকায় লুকিয়ে আপনি এক ভয়ংকর শয়তানি চক্রান্ত করেন। সে চক্রান্ত হল এই র‍্যাঞ্চ চালিয়ে তার মধ্যে এমন একটি আগাছার সৃষ্টি করা যার গ্রাসে আমেরিকার—তার পরে তখনকার মিত্রশক্তির সব দেশের কৃষির সর্বনাশ করে দেবে।

আপনার সে চক্রান্ত কিন্তু সফল হল না। আপনার এ ভয়ংকর শয়তানি চক্রান্ত ধরে ফেলে যিনি আপনার কাছে কাজ নিয়েছিলেন সেই কালা নেংটিটা আপনার ল্যাবরেটরিই শুধু চুরমার করে যাননি, আপনার ভুট্টার খেতে যে সর্বনাশা আগাছা আপনি লালন করছিলেন, উপযুক্ত বীজাণুঘটিত রোগ ধরিয়ে, তা ধ্বংসের ব্যবস্থাও পাকা করে গেছেন। আজ আপনার সঙ্গে দেখা করার আগেই আমি নিজে আপনার চাষের খেত দেখে ও আপনার লোকজনের কাছে খেতের অবস্থা শুনে তা বুঝে নিয়েছি।

আমাকে পিস্তল ছুঁড়ে মেরেও আপনার কোনও লাভ হবে না, মি. গার। কারণ এতক্ষণ সকালে র‍্যাঞ্চ ঘুরে দেখে আপনার আসল পরিচয়টা জানার দরুন আমি বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আর একটা কথা মনে রাখবেন, যে নেংটিটা আপনার এই দশা করেছে আমি তাঁরই দেশের লোক। আমার বুকের বদলে মাথার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করতে গেলে আপনার পিস্তল সমেত গোটা ডান হাতটাই হয়তো ভেঙে আসতে পারে। সুতরাং সে চেষ্টা না করে কালা নেংটিটার কাছে এফবিআই সব খবর পেয়ে আপনার এখানে নিশ্চিত আসছে জেনে যেটুকু অবসর পেয়েছেন তাতে পালাতে পারেন কি দেখুন।

কোন মানে জুগার তা-ই করেছিল, আর আমি তার কালা নেংটিটাকে মনে মনে অজস্র প্রণাম জানিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।

পরাশর বর্মা থামলেন এবং তারপর যা হবার ঠিকই হল। রামভুজের হাঁড়িয়া কাবাবের সদ্ব্যবহার তো হয়েছেই, সেই সঙ্গে আরও অনেক কিছুর। আর এ সবের মধ্যে ঘনাদা পরাশর বর্মা সম্বন্ধে যা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন পরাশর বর্মা হয়েছেন তার দুগুণ।

অবশেষে যাবার সময় হলে ঘনাদা আমাদের ডেকে ট্যাক্সি আনিয়ে পরাশরকে সমাদরে পৌঁছে দিয়ে আসতে বলেছেন তাঁর ডেরায়।

তাই দিতে গিয়ে আমরা ভেবেছি ট্যাক্সিতে ওঠবার পরই শুনব—কী রকম বাঁশ দিয়ে তুললাম আপনাদের ন্যাড়া ছাদের গুলবাজকে, দেখলেন তো!

কিন্তু পরাশর বর্মা সে রকম একটি কথাও বলেননি। তার বদলে বলেছেন, যথার্থ মানীর মান রাখতে পেরেছি এই আমার আনন্দ।

আর ঘনাদা? ভেবেছিলাম, পরাশর বর্মাকে পৌঁছে দিয়ে আসবার পর তাঁর কাছে গিয়ে শুনব–মুখখু, মুখখু, একেবারে রাম মুখখু। শুধু বরাতে করে খাচ্ছে গোয়েন্দা হয়ে।

তার বদলে তিনি বলেছেন, দেখলে তো হে, সেই পুরনো কথার দাম! বিদ্যা। দদাতি বিনয়! পেটে সত্যিকার বিদ্যে আছে তাই ওই বিনয়।

আমরা বুঝেছি যে ঘনাদা ও পরাশর বর্মা দুজনের কাছে আমরাই কিছু শিক্ষা পেলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *