ঘটি-বাঙাল
অর্ধশতাব্দী আগে ধানসিঁড়ি নদীর তীরের আশ্চর্যতম বাঙাল কবি লিখেছিলেন, ‘আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?’ সে প্রশ্নের ছিল রোমান্টিক অনুপ্রাস। অন্য অনুষঙ্গে, ভিন্ন প্রসঙ্গের সে এক বেদনার গাথা।
ঘটি-বাঙালের প্রসঙ্গও, দেশ ভাগের চার দশক পরে এখন প্রায় ওই ‘আবার তাহারে কেন ডেকে আনো’র পর্যায়ে চলে গেছে।
আজ আর কে খেয়াল রাখে, কে ঘটি, কে বাঙাল। আগে তো ছিলই। বিশেষ করে পার্টিশনের পরে পরে যখন একের পর এক জনস্রোতের ধাক্কা, উদ্বাস্তু প্রবাহ এসে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় আছড়ে পড়ল তখনই তুঙ্গে উঠেছিল ঘটি-বাঙালের বাদবিসম্বাদ। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রাচীন জনপদে বহুদিন আগে থেকেই একটা করে বাঙালপাড়া ছিল। যেখানে সাধারণত পূর্ববঙ্গের লোকেরাই বসবাস করত। কিন্তু উনিশশো সাতচল্লিশে সেই অসম্ভব দেশভাগের পর আর সামান্য বাঙাল পাড়ায় কুলোল না। তরাই থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত যেখানেই কোনওক্রমে বাসযোগ্য জমি পাওয়া বা দখল করা সম্ভব হল সেখানেই গড়ে উঠল উদ্বাস্তু উপনিবেশ, কোথাও তার নাম কলোনি, কোথাও গড় বা নগর, যথা আজাদ কলোনি, আজাদগড় বা আজাদ নগর।
বাঙাল-ঘটির সংঘাতের দিন বহুকাল হল বিদায় নিয়েছে। ভঙ্গবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে গা ঘেঁষা-ঘেঁষি করে চল্লিশ বছর বসবাস করে যে যার স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। সব বাড়িতেই এখন পোস্ত রান্না হয়। সেটা আর পশ্চিমবঙ্গীয় বা রাঢ় দেশীয়দের একচেটিয়া নয়, রান্নায় ঝাল বেশি হলে এখন আর কেউ কাউকে বাঙাল বলে সন্দেহ করে না। খবরের কাগজে ‘পূর্ববঙ্গীয় পাত্রী চাই’ কিংবা ‘পশ্চিমবঙ্গীয় ভাড়াটিয়া বাঞ্ছনীয়’ এ ধরনের বিজ্ঞাপন ক্রমশই বিরল হয়ে আসছে।
পার্টিশনের পরে বাঙাল-ঘটির বিবাদ যতটা প্রখর হয়েছিল, ঠিক ততটা স্তিমিত হয়ে গেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। এখন আর সীমান্ত পেরিয়ে বাঙালেরা কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে আসে না, যারা আসে তারা বাঙাল নয়, তারা বাংলাদেশি। সেসব বাঙাল কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে যাদের নিয়ে হাসির গান গাওয়া হত।
‘বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা
আমি ঢাকার বাঙাল নই।’
বলা বাহুল্য, ঢাকার বাঙালই ছিল, কুলীন শ্রেষ্ঠ বাঙাল কুলতিলক যাকে বলে কাঠ বাঙাল। তার হাবভাব, উচ্চারণ-আচরণ, অশন-ব্যসন সবই ছিল উঁচু তারে বাঁধা। গঙ্গার এই তীরের বহু শতাব্দীর মার্জিত নাগরিকতার সঙ্গে তার ছিল বিস্তর ফারাক।
বাঙাল-ঘটির আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আমার তেমন কৌতুক বোধ হচ্ছে না।
এই আলোচনা করার অধিকার আমার জন্মগত। আমিও এক সাবেকি বাঙাল। পনেরো বছর বয়েসে দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি। তারপর ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে কবে এই নগর সভ্যতায় বিলীন হয়ে গেছি।
আমরা পূর্ববঙ্গীয় হলেও, সে মাত্র তিনশো বছরের ব্যাপার। মোঘল রাজত্বের মধ্যকালে বারো ভুঁইঞাদের সঙ্গে দিল্লিশ্বরের মারামারির যুগে নিতান্ত আত্মরক্ষার তাগিদে আমরা পদ্মা-যমুনা-ধলেশ্বরী পেরিয়ে পালিয়ে যাই, যশোহরের কালিয়া পরগনা থেকে উত্তর মধ্যবঙ্গের আটিয়া পরগনায়।
এখনকার যশোহর বাংলাদেশের মধ্যে হলেও সেটা কখনও বাঙালের এলাকা ছিল না। তখন তো নয়ই। কাপুরুষের মতো আমরা বাঙাল দেশে প্রবেশ করেছিলাম এবং আবার তিনশো বছর পরে কাপুরুষের মতো সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি।
আমি নিজে বিয়ে করেছি খাঁটি পশ্চিমবঙ্গে। বারেন্দ্র বংশীয় বলে আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বহুকাল ধরে বাঙাল ও ঘটি দুইই আছে। দুই সমাজের সমস্ত দোষগুণ আমাদের পারিবারিক রক্তে ও চরিত্রে মিলে আছে। এখনও যখন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানে খেলা হয় আমরা কোনটা আমাদের দল ধরতে পারি না, ফলে যখন যে জেতে তারই পক্ষে চলে যাই। খেলা ড্র হলে দু’পক্ষকেই সমান গাল দিই।
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের কথায় অন্য একটা কথা মনে পড়ছে, নিতান্ত দুঃখের কথা। এই দুই ফুটবল টিম যেমন বাঙাল-ঘটির প্রতীক, তেমনিই ইলিশ আর চিংড়ি এই দুই মাছ। দুটি মাছই আরও অনেকের মতো আমার ঠিক সমান প্রিয়। আজকের এই অগ্নিমূল্যের দিনে যখন বাজারে গিয়ে এই দুটি মাছের স্টল থেকে সমদূরত্বে থাকি, বারবার মনে পড়ে যায়, চল্লিশে-পঞ্চাশের কলকাতার কথা।
বাঙাল-ঘটির সেই মান অভিমান, চুলোচুলি, বাদবিসম্বাদের স্মরণীয় যুগে পুরো ব্যাপারটা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল-ইলিশ মাছ বনাম মোহনবাগান-চিংড়ি মাছ সংগ্রামে। সেই রেষারেষির মধ্যে কোথায় ছিল একটা কৌতুকের আভাস, পুরোটা দমবন্ধ ব্যাপার ছিল না।
সেদিনের বাংলা সাহিত্যের রথী মহারথীরা মায় তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি তো বটেই বাঙাল-ঘটি নিয়ে লিখেছেন। আর সেই উদ্বাস্তু শিবিরে লোভী ভূতের মাছভাজা খাওয়ার চেষ্টা, বাঙালদের হাতে ভূতের নির্যাতন ও পলায়ন— শিবরাম চক্রবর্তীর সেই মর্মান্তিক গল্প পাঠ করে অনেক বাঙালই সেদিন হাসেননি।
এরও বহু আগে লেখা হয়েছিল,
‘বাঙাল মনুষ্য নয়,
উড়ে এক জন্তু।
লাফ দিয়া গাছে ওঠে
হাত নেই কিন্তু ॥’
কিন্তু সর্বাধিক মর্মান্তিক গল্পটি লিখেছিলেন, বাঙাল-ঘটির চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের বহুকাল আগে বাংলা সরস রচনার পিতামহ প্রতিম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের পুরনো গ্রন্থাবলি সিরিজের ত্রৈলোক্যনাথ গ্রন্থাবলির দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম কাহিনীটির নামই হল ‘বাঙাল নিধিরাম।’
বিসূচিকা রোগগ্রস্ত বাঙাল নিধিরাম মুমূর্ষূ-অবস্থায় গঙ্গাতীরে শুয়ে ছটফট করছেন। বেলা দশটা, প্রচণ্ড সূর্য কিরণে জগৎ অগ্নিময়, নিধিরামের প্রাণ তবুও বাহির হয় না।
দু’জন বৃদ্ধ-ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফেরার পথে কণ্ঠাগত প্রাণ নিধিরামকে দেখতে পেলেন। নিধিরাম তাঁদের বললেন, ‘তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, যদি মুখে একটু জল দেন।’
বৃদ্ধরা জল দেওয়ার পরিবর্তে নিধিরামকে প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘মহাশয়ের নিবাস’, ‘মহাশয়ের নাম’ ইত্যাদি মামুলি কথা, সেসব প্রশ্ন কোনও মৃত্যু পথযাত্রীকে করা যায় না। সে যা হোক অবশেষে তাঁরা নিধিরামের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনার ব্যাতোন (বেতন)?’
নিধিরাম তখন বললেন, ‘আমি চাকরি করি না আমার বেতন নাই, যান আপনারা বাড়ি যান। আমার জলে কাজ নাই।’
গাঙ্গেয় পশ্চিমবাংলায় সেদিন বাঙাল নিধিরামের যে বিপর্যয় হয়েছিল, সেই দুর্ভোগের যুগ অবশ্য এখন আর নেই, বাঙাল-ঘটি মিলে মিশে প্রায় একাকার হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী নতুন প্রজন্মের বাঙালেরা প্রথম ধাক্কায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের সন্তানেরা এখন অন্য প্রজন্মমুখী। তাদের কাছে এ দুয়ের পার্থক্য হাস্যকর।
হাস্যকর হোক যাই হোক, বাঙাল-ঘটি বাদবিসম্বাদের পালায় শেষ যবনিকা নেমে আসার আগে এটুকু স্মরণে রাখা ভাল যে, এই কলহে যতটা মান অভিমান ছিল ততটা তিক্ততা ছিল না, যতটা রেষারেষি ছিল ততটাই হাসাহাসি ছিল; অনেকটা শুকসারী গানের মতো এ বলে আমার এই ভাল তোমার ওই খারাপ, সেও বলে আমার এই ভাল তোমার ওই খারাপ।