Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পেটে ভাত নেই বলে

পেটে ভাত নেই বলে গৌরের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। শরীরটা বেশ কাহিল লাগছিল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বাইরে এসে গৌর অভ্যাসবশে গিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকল।

গোরুদের সঙ্গে গৌরের ভারী ভাবসাব। তাদের দুটো গোরু, দুটো বাছুর। গৌরকে দেখলেই তারা ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে। গা শুকে, চেটে, কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নানারকমভাবে তাদের আদর জানায়। পশুপাখিরাও মানুষ চেনে। গৌর গোরুদের গায়ে হাত বুলিয়ে, গলকম্বলে সুড়সুড়ি দিয়ে আদর করে বলল, “বড্ড খিদে পেয়ে গেছে তোদের, না রে? চল, আগে তোদের জাবনা দিই।” বড় গোরুটা এই কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

গোরুদের জাবনা দিতে দিতে গৌরের সেই লম্বা নোকটার কথা মনে পড়ল। মাউ আর খাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে লোকটা হনহন করে কোথায় যেন চলে গেল। চোর-ডাকাত নয় তো! কথাটা একবার তার দাদা নিতাইয়ের কানে তোলা দরকার। গাঁয়ের চোরদের সবাইকেই চেনে গৌর। তাদের সঙ্গে বেশ ভাবসাবও আছে। সুতরাং লোকটা গাঁয়ের আশপাশের গায়েরও নয়। তা হলে লোকটা কে?

নিতাই যখন পুকুরের ঘাটলায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিল, তখন গৌর গিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “দাদা, একটা কথা ছিল।”

নিতাই ভাইয়ের ওপর বিশেষ সন্তুষ্ট নয়। অন্য দিকে চেয়ে বলল, “পয়সা-টয়সা চেয়ো না। অন্য কথা থাকলে বলতে পারো।”

“না, পয়সা নয়। আমি পয়সা দিয়ে কী করব! বলছিলাম কী, কাল রাতে বাড়িতে চোর এসেছিল।”

নিতাই আঁতকে উঠে বলে, “চোর! কোন চোর দেখেছিস?”

“চেনা চোর নয়। লোকটা খুব লম্বা, খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দেখলাম।”

“তা হলে চেঁচাসনি কেন?”

“আমার প্রথমটায় মনে হয়েছিল, বোধহয় ওদের চেনা লোক। দরজা খুলে বেরোল, তারপর আবার ভিতর থেকে কে যেন দরজা বন্ধ করে দিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না কী করব। যদি কুটুমদের চেনা লোক হয়, তা হলে চোর বলে চেঁচালে তাদের অপমান হবে।”

নিতাই দাঁতন করা থামিয়ে গৌরের দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, “কীরকম চেহারাটা বললি?”

“খুব লম্বা আর সুভুঙ্গে।”

নিতাই গম্ভীর হয়ে বলল, “আজ রাত থেকে তোর ঘুমোনো বন্ধ। সারারাত জেগে লাঠি নিয়ে বাড়ি পাহারা দিবি। তোর বউদিকে বলে দিচ্ছি, আজ থেকে যেন তোকে রাতে ভাতটাত না দেয়। ভাতটাত খেলেই ঘুম আসে। পেটে একটু খিদে থাকলে জেগে থাকতে সুবিধে হয়।”

নিতাইয়ের কথা শুনে গৌরের মুখ শুকিয়ে গেল। একেই তো বউদি তাকে পেটভরে খেতে দেয় না বলে সারাদিন পেটের মধ্যে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। তার ওপর রাতের খাওয়া বন্ধ হলে যে কী অবস্থা হবে! কিন্তু কী আর করা। গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাট্টি পান্তাভাত খেয়ে গোরু নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

নদীর ধারের মাঠে গোরুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে গৌর গোবিন্দের বাড়ি গিয়ে হানা দিল। গোবিন্দ এই তল্লাটের সবচেয়ে পাকা চোর। মাঝবয়সি। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখ দুখানায় বুদ্ধির ঝিকিমিকি। চোর হলেও গোবিন্দ লোক খারাপ নয়। গৌরের মা বেঁচে থাকতে ভাগবত শুনতে যেত, মুড়ি-বাতাসা খেয়ে আসত।

গোবিন্দ উঠোনে বসে পাটের দড়ি পাকাচ্ছিল। গৌরকে দেখে খুশি হয়ে বলল, “আয়, বোস এসে। তা দাদাবউদির সংসারে কেমন আছিস?”

গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ভাল নয় গোবিন্দদা।”

“ভাল থাকবি কী করে? ওই যে দুটো গুন্ডাকে আনিয়ে রেখেছে তোর দাদা, ওরাই তোকে মেরে তাড়াবে। সাবধানে থাকিস।”

গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তাড়াবে সে আর বেশি কথা কী? বেঁচে যে আছি, এই ঢের। আজ থেকে আবার রাতের খাওয়াও বন্ধ হল।”

“কেন, কেন?”

“কাল রাতে বাড়িতে চোর এসেছিল, সেকথা দাদাকে বলায় দাদা রাতের খাওয়া বন্ধ করে সারারাত জেগে পাহারা দিতে হুকুম করেছে।”

“চোর!” বলে গোবিন্দ সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, “চোরকে দেখেছিস?”

“সেই কথাই তো বলতে এলাম। লম্বা, সুড়ঙ্গে চেহারার বিটকেল একটা লোক রাতে খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল। প্রথমটায় ভেবেছিলাম বুঝি ওদের কাছেই কেউ এসেছিল, চেনা লোকটোক হবে।”

“লোকটা যে চোর তা বুঝলি কী করে?”

“চোর কি না তা জানি না। তুমি এ-রকম চেহারার কোনও লোককে চেনো?”

গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “সেকথা পরে হবে। আগে ভাল করে লোকটার চেহারাটা মনে করে বল।”

“খুব ভাল করে দেখিনি। জ্যোৎস্নার আলোয় আবছা-আবছা যা মনে হল, লোকটা তালগাছের মতো ঢ্যাঙা, রোগাটে চেহারা, লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল। তারপর খাউ আর মাউয়ের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেলাম।”

গোবিন্দ দড়ি পাকানো বন্ধ করে গোল-গোল চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “ঢ্যাঙা লোক বললি? খুব রোগা?”

“সেরকমই মনে হল।”

গোবিন্দ দু-একটা শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, “এ অঞ্চলের লোক হলে ঠিক বুঝতে পারতাম লোকটা কে। না রে, এ তল্লাটের লোক নয়। চোর বলেও মনে হচ্ছে না। চোর হলে দরজায় শব্দ হত না। তোর দাদার ওই দুই গুন্ডা শালার স্যাঙাত নয় তো?”

“তাও হতে পারে।”

“একটু নজর রেখে চলিস। ওদের বড়ভাইটা তোক ভাল নয়। সেটা এখন জেলখানায় আছে বটে, কিন্তু চারদিকে তার অনেক চ্যালা-চামুণ্ডা।”

“হাউয়ের কথা বলছ? তাকে চেনো নাকি?”

“খুব চিনি, হাড়ে হাড়ে চিনি। বিশাল লম্বাচওড়া চেহারা, গায়ে অসুরের মতো জোর। সেই জোর নিয়ে কী করবে তা ভেবে পায়। তাই সবসময়ে একে মারছে, তাকে ধরছে, লোকের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে খুন অবধি কিছু বাকি নেই। হেন কাজ নেই যা ও করতে পারে না।”

গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “শুনছি জেল থেকে বেরিয়ে সেও এখানে আসছে।”

“আমিও শুনেছি। তোর দাদার মাথায় গোলমাল আছে বলেই শালাকে আদর করে এনে বসাতে চাইছে। কিন্তু এই আমি বলে দিচ্ছি, হাউ যদি আসে তবে তোদের কাউকে আর ওই ভিটেয় তিষ্ঠোতে হবে না। এমনকী, গায়ে লোক থাকতে পারবে কি না সন্দেহ।”

গৌর হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। গোবিন্দ তার দিকে চেয়ে বলল, “লম্বা লোকটা কে সেটা আমাকেও জানতে হচ্ছে। তুই ভাবিস না, আজ রাতে তোর সঙ্গে আমিও পাহারা দেব’খন।”

খানিকটা ভরসা পেয়ে গৌর উঠে গোরু চরাতে গেল। গোরু চরাতে গৌরকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়, তা নয়। গোরুগুলো আপনি ঘুরে ঘুরে মাঠের নধর ঘাস খেয়ে বেড়ায়। গৌর শুধু নজর রাখে যাতে ওরা হারিয়ে না যায় বা কারও বাগানে বা বাড়িতে না ঢোকে, কিংবা নালানর্দমায় না পড়ে-উড়ে যায়। গোর মাঠে ছেড়ে দিয়ে গৌর প্রথমে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। দুপুরবেলাটায় তার বড় খিদে পায়। কিন্তু এত ঘনঘন খিদে পেলে তো চলবে না। দুপুরের ভাত সেই বেলা গড়ালে গিয়ে জুটবে। ততক্ষণে গৌর জঙ্গলে ঢুকে ফলটল খোঁজে। পেয়েও যায় মাঝে মাঝে। এক-এক সময়ের এক-এক ফল। কখনও কামরাঙা, কখনও আতা, তেঁতুল, বেল, মাদার বা ফলসা। চুনোকুল আর বনকরমচাও মিলে যায় কখনও কখনও। তারপর একটা ঝুপসি গাছের তলায় শুয়ে সে কিছুক্ষণ ঘুমোয়।

আজ গৌর জঙ্গলে দুটো আতা পেয়ে গেল। ভারী মিষ্টি। খেয়ে গাছতলায় গামছা পেতে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গৌর স্বপ্ন দেখল, মা তার মাথার কাছটিতে এসে বসেছে। খুব মিষ্টি করে মা বলল, “কবচটা পরিসনি? ওরে বোকা! কবচটা সবসময়ে পরে থাকবি।”

ঘুম ভেঙে গৌর ধড়মড় করে উঠে বসল। তাই তো! কবচটার কথা যে তার খেয়ালই ছিল না। ঘরে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা আছে।

দুপুরবেলা বাড়ি ফিরেই গৌর গিয়ে কুলুঙ্গিতে কবচটা খুঁজল। নেই। গৌর অবাক। কাল রাতে নিজের হাতে কবচটা এইখানে রেখেছে সে। গেল কোথায়? সারা ঘর এবং ঘরের আশপাশে আঁতিপাঁতি করে খুঁজল সে। কোথাও কবচটা খুঁজে পেল না। বুকটা ভারী দমে গেল তার। চোখে জল এল। কবচটার মধ্যে যে বিশেষ কোনও গুণ আছে, তেমন তার মনে হয় না। তবে মায়ের দেওয়া জিনিসটার মধ্যে মায়ের একটু ভালবাসা আর আশীর্বাদও তো আছে।

ঢাকা ভাত রান্নাঘরে পড়ে ছিল। গৌর স্নান সেরে কড়কড়ে সেই ঠান্ডা ভাত একটু ডাল আর ডাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে কোনওক্রমে গিলেই ফকিরসাহেবের কাছে দৌড়োল, লোকে বলে ফকিরসাহেব তাঁর আরশিখানার ভিতর দিয়ে তামাম দুনিয়ার সব জিনিস দেখতে পান। হারানো জিনিসের সন্ধান তাঁর মতো আর কেউ দিতে পারে না।

ফকিরসাহেব এই দুপুরেও আরশিখানা হাতে নিয়ে দাওয়ায় বসে ছিলেন। চোখ দুটো টুলটুলু, মুখে পান।

“ফকিরসাহেব! ও ফকিরসাহেব!”

ফকিরসাহেব একটু চমকে উঠে বললেন, “কে রে! গৌর!”

“আমার একটা জিনিস হারিয়েছে ফকিরবাবা।”

ফকিরসাহেব একটা হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বললেন, “হারিয়েছে চুরি গেছে? ঘর থেকে না বার থেকে? ধাতুদ্ৰব্য না অধাতুদ্ৰব্য? ভারী না হালকা? চকচকে না ম্যাটমেটে?”

“একটা কবচ ফকিরবাবা। একটা তামার কবচ। আমার মা মরার আগে দিয়ে গিয়েছিল।”

কথাটা শুনে ফকিরসাহেব কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইলেন। সেই হাঁ দেখে গৌরের মনে হয়েছিল, ফকিরসাহেব বুঝি আবার হাই

তুলছেন। কিন্তু এতক্ষণ ধরে কেউ তো হাই তোলে না! আর হাই তোলার সময়ে কেউ ওভাবে গুলু-গুলু চোখ করে চেয়েও থাকে না। গৌরের বেশ ভয়-ভয় করতে লাগল। ফকিরসাহেব হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “হারিয়ে বসলি? মুখ গাধা কোথাকার!”

গৌর হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আমার দোষ নেই। কুলুঙ্গিতে যত্ন করে রেখেছিলুম।”

ফকিরসাহেব মুখ ভেঙিয়ে বললেন, “কুলুঙ্গিতে রেখেছিলুম! মাথাটা কিনে নিয়েছিলে আর কী! কেন রে হতভাগা, কবচটা হাতে পরে থাকতে কী হয়েছিল?”

“আজ্ঞে, গোরুটোরু চরাই, বাসন-টাসন মাজি, কাঠটাঠ কাটি, কখন কোথায় ছিটকে পড়ে যায়, সেই ভয়ে হাতে পরিনি।”

ফকিরসাহেব দু’খানা হাত গৌরের মুখের সামনে নাচিয়ে বললেন, “উদ্ধার করেছ। এখন কী সর্বনাশ হয় দেখো।”

এই বলে গম্ভীর মুখে ফকিরসাহেব উঠে গিয়ে বারান্দার এক কোণে তামাক সাজতে বসলেন।

গৌর ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারল না। তবে কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইল চুপচাপ।

ফকিরসাহেব অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেলেন। তারপর কলকে উপুড় করে রেখে নিমীলিত চোখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললেন, “ও কবচের কথা এ-গাঁয়ে মাত্র কয়েকজন জানে। এই ধর আমি, কবিরাজ, সুবল হোমিও, চোর গোবিন্দ, এমন ক’জন মাত্র। যারা জানে, তাদের বয়স এই আমারই মতো দেড়শো বা দুশো বছর।”

গৌর চোখ কপালে তুলে বলে, “গোবিন্দদার বয়স দেড়শো-দুশো?”

“এই সবে একশো একান্ন হয়েছে। আমার চেয়ে বাহান্ন বছরের ছোট। কবিরাজের বোধহয় একশো পঁচাত্তর চলছে, সেদিনের ছোঁকরা। সুবলের গত মাঘে দুশো হয়ে গেল।”

গৌর খুব ভক্তিভরে চেয়ে ছিল। বলল, “উরে বাবাঃ।”

“বয়সের কথাটা তুললাম কেন জানিস? তোদের ওই কবচটার ইতিহাস পুরনো লোক ছাড়া কেউ জানে না। আর ইতিহাসও সাংঘাতিক। তিনশো বছর আগে এই গাঁয়ে যোগেশ্বর নামে একজন লোক থাকতেন। সে কীরকম লোক তা এককথায় বলা মুশকিল। তবে আমরা তাঁকে আকাশে উড়তে, জলের ওপর হাঁটতে আর ডাঙায় ডিগবাজি খেয়ে খেয়ে চাকার মতো চলেফিরে বেড়াতে দেখেছি। তিনি আগুন দিয়ে বরফ জমাতে পারতেন, দিনদুপুরে অমাবস্যার অন্ধকার নামাতে পারতেন, একমুঠো ধুলো নিয়ে এক ফুঁ দিয়ে সোনার গুঁড়ো তৈরি করতেন। আমি, কবরেজ, গোবিন্দ, সুবল সব তার শাগরেদি করতুম। এই যে আরশিখানা দেখছিস, এ তাঁরই দেওয়া। কবরেজটা তেমন কিছু শিখতে পারল না বলে ওকে কবরেজির লাইনে ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি। একখানা শিশিও দিয়েছিলেন ওকে, তাতে কী আছে জানি না। গোবিন্দ, সুবল, ওরাও কিছু না-কিছু পেয়েছিল, তবে ও-সব গুহ্য কথা। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদাও ছিল তাঁর শাগরেদ। সে পেয়েছিল ওই কবচখানা। যাকে বলে জ্যান্ত কবচ। কবচের গুণাগুণ বলা বারণ, অত ভেঙে বলেনওনি যোগেশ্বরবাবা। তবে আমার ধারণা, ওই কবচ ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে মানুষের অসাধ্যি কিছু নেই। কিন্তু বংশের বাইরে কারও হাতে গেলেই সর্বনাশ।”

গল্প শুনে গৌর আর-একটু এগিয়ে বসল। বলল, “আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদাকে আপনি চিনতেন?”

“চিনব না মানে? এইটুকু দেখেছি।”

“তা যোগেশ্বরবাবার দয়ায় আপনারা সব এতকাল ধরে বেঁচে আছেন, তবে তিনি মরলেন কেন?”

“মরেছে! তোকে কে বলল যে, মরেছে! যোগেশ্বরবাবার যখন হাজার বছর বয়স পুরল তখন আমাদের ডেকে একদিন বললেন, “ওরে আমার তো মরণ নেই, কিন্তু এই শরীরটা বড় পুরনো হয়ে গেছে। হাড়গুলোয় ঘুণ ধরেছে, চামড়াটাও বড্ড কালচে মেরে গেছে, মাংস যেন ছিবড়ে। তা এটাতে বাস করতে আর আমার মন চায় না। আজই এটা ছেড়ে ফেলব। আমরা শুনে তাঁর হাতে-পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলুম। তখন তিনি বললেন, “মন যখন করেছি তখন ছাড়বই। ছেঁড়া, ময়লা, নোংরা জামা গায়ে পরে থাকতে যেমন ঘেন্না হয়, আমারও এই শরীরটা নিয়ে তাই হয়েছে। তবে তোরা দুঃখ করিস না, শরীর ছাড়লেও আমি কাছাকাছিই থাকব।’ এই বলে তিনি পটাং করে শরীরটা ফেলে দিলেন। বাস্তবিকই শরীরটায় আর কিছু ছিল না, একেবারে চামচিকের মতো দেখতে হয়েছিল। আমরা সবাই খুব কান্নাকাটি করলুম। কিন্তু তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদা ফটিক শোকে কেমন হয়ে গেল। যোগেশ্বরবাবার সেই শরীরখানা ঘাড়ে নিয়ে বিবাগি হয়ে গেল। সে মরেনি, দিব্যি আছে। আরশিখানার ভিতর দিয়ে তার সঙ্গে প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়, হিমালয়ে এক দুর্গম জায়গায় খুব জপতপ করছে ব্যাটা। এই আরশিখানা দিয়ে সব দেখা যায় কিনা।”

“তা হলে আমার কবচখানা কোথায় তা একটু দেখে দিন।”

ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “ওটি হওয়ার জো নেই। এই আরশি দিয়ে আর সব দেখা গেলেও যোগেশ্বরবাবার মন্ত্রপূত জিনিস কোনওটাই দেখার উপায় নেই। এই ধর যেমন কবরেজের শিশি, ফটিকের কবচ, সুবল বা গোবিন্দর কাছে যা আছে সে-সব এই আরশিতে ধরা পড়বে না। তাই বলছি, কবচটা হারিয়ে খুব গ্যাড়াকলে পড়ে গেছিস। এখন খুঁজেপেতে দেখগে কে নিল।”

ফকিরসাহেবের গল্প শুনে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল গৌর। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায় না, আবার না করেই বা উপায় কী। বাড়ি ফিরে গৌর একভাই বাসন মাজল, উঠোন ঝাঁট দিল, গাছে জল দিল, গোরুকে জাবনা দিল। তারপর মাটি কোপাতে গেল বাড়ির উত্তর দিককার বাগানে। কবচখানার জন্য মনটা বড় খারাপ। মন খারাপ থাকলে গৌরের গায়ে বেশ জোর আসে, কাজও করে ফেলে চটপট। যে মাটি কোপাতে অন্য দিন সন্ধে হয়ে যায়, তা আজ গৌর এক লহমায় কুপিয়ে ফেলল।

গৌর কুয়োর পাড়ে যখন মাটিমাখা হাত-পা ধুচ্ছে, তখন নেতাইগোপাল এসে বলল, “মনে আছে তো?”

গৌর ঘাড় নেড়ে বলে, “আছে।”

“আজ রাত থেকে তোর খাওয়া বন্ধ। সারারাত ঘরদোর পাহারা দিবি। বসে বসে আবার ঢুলিস না যেন। সবসময়ে পায়চারি করবি আর মাঝে মাঝে লাঠি ঠুকবি। মনে থাকবে যা বললুম?”

গৌড় ঘাড় নেড়ে বলল, “থাকবে।”

সন্ধের পর গৌর চুপিসারে বেরিয়ে পড়ল কবরেজমশাইয়ের বাড়ির দিকে। পথেই বাজারের গা ঘেঁষে হরিপদর ফুলুরির দোকান। দারুণ করে। দেখল, সেখানে দাঁড়িয়ে মাউ আর খাউ খুব মনের সুখে ফুলুরি ওড়াচ্ছে। গৌর আড়াল হয়ে সুট করে কেটে পড়ল।

কবরেজমশাই বৈঠকখানায় বসে কী একটা ঘষছিলেন। সবসময়েই তিনি কিছু না-কিছু বানিয়েই যাচ্ছেন। লতাপাতা, শেকড়বাকড়, ধাতু, পাথর, মধু, দুধ– এই সব সারাদিন একটার সঙ্গে আর-একটা মেশাচ্ছেন, জ্বাল দিচ্ছেন, পোড়াচ্ছেন। এরকম কাজপাগল লোক গৌর দুটো দেখেনি। ৩০

তাকে দেখে কবরেজমশাই হাতের কাজ থামিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এ, তোর গা থেকে যে বড্ড ভূত-ভূত গন্ধ আসছে রে। ওই বুজরুক ফকরেটার কাছে গিয়েছিলি নাকি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।”

“আবার সমস্যা কীসের?”

“আমার একটা জিনিস হারিয়েছে।”

“অ। তাই ফকরেটার কাছে গিয়েছিলি বুঝি? তা কী বলল বুজরুকটা?”

“আজ্ঞে সে মেলা কথা।”

“তা জিনিসটা পাওয়া গেল না তো!”

“আজ্ঞে না। যোগেশ্বরবাবার দেওয়া সেই কবচ নাকি ফকিরসাহেবের আরশিতে দেখা দেন না।”

কবিরাজমশাই এতক্ষণ দিব্যি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। কবচের কথা শুনে আচমকা একটা ‘আঁক করে শব্দ তুললেন গলায়। তারপর বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন গৌরের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে গৌরের মনে হল, কবিরাজমশাই বুঝি বসে বসেই মূৰ্ছা গেছেন। ভয় খেয়ে সে কবিরাজমশাইয়ের গায়ে একখানা ঠেলা দিয়ে ডাকল, “কবরেজমশাই! ও কবরেজমশাই!”

কবিরাজমশাই চোখ পিটপিট করে খুব নিচু স্বরে বললেন, “সর্বনাশ!”

“ফকিরসাহেবও সেই কথাই বলছিলেন। কবচটা হারানো নাকি ঠিক হয়নি। কুলুঙ্গিতে পটের পিছনে কবচটা লুকোনো ছিল। হারানোর কথা নয়। তবু যে কী করে হারাল!”

কবিরাজমশাই খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “কুলুঙ্গি! তোর কি মাথা খারাপ? ও জিনিস কেউ হেলাফেলা করে এখানে-সেখানে ফেলে রাখে?”

গৌর কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, “এখন তা হলে কী হবে কবরেজমশাই?”

কবিরাজমশাই মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠলেন, “কী হবে কবরেজমশাই! কী হবে তার আমি কী জানি রে লক্ষ্মীছাড়া? বেরো, বেরো, দুর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে! হাঁদারাম কোথাকার!”

গৌর ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এল বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই দেখল, বড় ঘরের বারান্দায় হ্যারিকেনের আলোয় তার দাদা নিতাই দুই শালাকে নিয়ে খেতে বসেছে। গরম ভাত আর ডালের গন্ধে ম ম করছে বাড়ি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress