গৌরগোপালেরা বড়ই গরিব
গৌরগোপালেরা বড়ই গরিব। গ্রামের মধ্যে তাদের বাড়িখানাই সবচেয়ে বেশি ভাঙাচোরা এবং শ্রীহীন। একবুক আগাছার মধ্যে ত্যাড়াবাঁকা হয়ে কোনওক্রমে বহুঁকালের পুরনো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
একসময়ে গৌরগোপালদের অবস্থা ভালই ছিল। জমিজমা ছিল, চাষবাস ছিল, একটু ব্যাবসাও ছিল। গৌরের ঠাকুরদার আমল থেকে অবস্থা পড়তে পড়তে এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। একবেলা নুনভাত জোটে তো আর একবেলা উপোস থাকতে হয়। চাষের জমি সব দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে।
গৌরগোপালেরা দুই ভাই। নিতাইগোপাল বড়, গৌরগোপাল ছোট। গৌরের বয়স এখন উনিশ কুড়ি। লেখাপড়ায় দুই ভাইয়ের কেউই ভাল নয়। তবে নিতাইগোপাল একটু সংস্কৃত জানে। পুজোআচ্চা করতে পারে। তাই করেই সে কোনওক্রমে সংসার চালায়। তাদের বাবা নেই, মা আছে। নিতাইগোপালের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একটু পয়সাওয়ালা, তাই তার বউয়ের ভারী দেমাক। সে শ্বশুরবাড়ির লোকদের মানুষ বলে জ্ঞানই করে না। নিতাইগোপাল বউকে ভয় খায়। তাই বেশি উচ্চবাচ্য করে না। বড়ভাইয়ের সংসারে আহাম্মক গৌরগোপাল আর তার বুড়ো মা বড় অনাদরে থাকে।
গৌরগোপালের লেখাপড়া হয়নি, তেমন কোনও বিশেষ গুণও তার নেই। তবে সে খুব সরল এবং ভালমানুষ গোছের। মিথ্যে কথা
বলে না, কাউকে আঘাত দেয় না, কখনও তার মুখে কেউ কোনও খারাপ কথা বা গালাগাল শোনেনি। অতি কষ্টে অধ্যবসায়ে সে ইস্কুলের শেষ পরীক্ষাটা পাস করেছে। এখন তার দজ্জাল বউদি তাকে দিয়ে বাসন মাজায়, কাপড় কাঁচায়, উঠোন ঝাঁট দেওয়ায়, আগাছা পরিষ্কার করায়, গোয়ালেরও হরেক কাজ তাকে করতে হয়। এমনকী দুপুরবেলা গোরু চরানোও আজকাল তার কাজ হয়েছে।
গৌরের এই কষ্ট তার মা আর চোখে দেখতে পারে না।
একদিন মা তাকে ডেকে বলল, “শোন বাবা, আমি চোখ বুজলে এদের সংসারে তোর বড় অনাদর হবে। একটু রয়ে-বুঝে থাকিস। আর মরার আগে আমি তোকে একটা জিনিস দিয়ে যাব। সেটা সাবধানে রাখিস।”
গৌর অবাক হয়ে বলে, “কী জিনিস, মা?”
“সে আছে। সময়মতো দেখতে পাবি।”
এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই গৌরের মা মারা গেল। মরার আগে গৌরকে কাছে ডেকে চুপিচুপি যে জিনিসটা তার হাতে দিল, সেটা এমন কিছু আহামরি জিনিস নয়। একটা কবচ।
গৌর খুব কান্নাকাটি করল মায়ের জন্য।
শ্রাদ্ধের পর নিতাই আর তার বউ গৌরকে একদিন ডেকে বলল, “এভাবে আর কতদিন বসে বসে খাবে? রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে পড়ো।”
শুনে গৌরের ভারী ভয় হল। কারণ জীবনে সে কখনও গাঁয়ের বাইরে বেরোয়নি। বাইরের জগৎটা কেমন তাও সে জানে না। তবে মুখে কিছু বলল না সে। শুধু বলল, “আচ্ছা।”
নিজের ভাঙা ঘরখানায় বসে একদিন দুপুরে ভাগ্যের পাকচক্রের কথা ভাবতে ভাবতে মায়ের দেওয়া কবচটার কথা মনে পড়ল তার।
কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীর পটের পিছনে লুকিয়ে রাখা কবচটা বের করে ভালভাবে দেখল সে। সাধারণ তামায় তৈরি। সোনা হলেও না হয় বেচে দু’পয়সা আয় হত। কবচটার গুণই বা কী? যদি গুণই থাকত, তা হলে সংসারে এত অভাব আর অশান্তিই বা কেন!
গৌরগোপাল কবচটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। মরার সময় তার মা বিকারের ঘোরে ভুল বকছিল। গৌরগোপাল তখন সংসারে তার শেষ স্নেহের আশ্রয় মায়ের মৃত্যুনীল মুখোনার দিকে চেয়ে হাঁ করে বসে থাকত। কথাগুলো তার কানে সেঁধোলেও মগজে ভাল করে ঢুকত না। তার মনে পড়ল, মা বিকারের ঘোরে বলেছিল, “কবচটা কিন্তু খুব সাবধান…কখনও হারাসনি বাবা…ওর মধ্যে কিন্তু দানো আছে…দানো…খুব সাবধান…”
এই দানো কে বা কী তা গৌরগোপাল জানে না। তবে কবচটা সে আবার সাবধানে কুলুঙ্গিতে পটের আড়ালে রেখে দিল।
সংসারে তার যতই অনাদর হোক, মা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিন দু’বেলা ভরপেট খাওয়া জুটত। কিন্তু মা মরে ইস্তক সেটাই আর জুটছে না। বউদি খেতে দেয় বটে, তবে একবারের বেশি দুবার ভাত সাধে না। ভাল পদ যদি কোনওদিন কিছু রান্না হয়, তবে তা গৌরগোপালের চোখের আড়ালে রাখে। এ-সবই গৌর টের পায়, কিন্তু ভয়ে কিছু বলে না। বলে হবেই বা কী? বরং বেশি ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করতে গেলে দাদা ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এই বাড়ি থেকে বেরোতেই গৌরের যত ভয়। বাইরের দুনিয়াটাকে তো সে একেবারেই চেনে না। এমন বিদ্যেও নেই যে, নিজে কিছু রোজগার করে খাবে।
গৌর তাই আধপেট খেয়েও আজকাল দাদার সংসারে দ্বিগুণ খাটুনি দেয়। গোরু চরানো, বাগান পরিষ্কার, মাটি কোপানো, জল তোলা তো ছিলই, সেইসঙ্গে আরও অনেক কাজ করে দেয় সে। কাঠ
কাটে, পুকুরের পানা তোলে, দাদার ছেলে-মেয়েকে পড়ায়। সারাদিন এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেয় না। হাসি-হাসি মুখ করে সারাক্ষণ দাদা-বউদিকে খুশি করতে চেষ্টা করে, যাতে বাড়ি থেকে এরা তাকে তাড়িয়ে না দেয়।
কিন্তু বিপদ হল, হঠাৎ একদিন বউদি তার দুই ষণ্ডামতে বজ্জাত ভাইকে এ বাড়িতে থাকার জন্য আনাল। তাদের নাম মাউ আর খাউ। তারা নাকি বখে যাচ্ছিল, সুতরাং ঠাঁইনাড়া করে তাদের শোধরানো দরকার। দুই ভাইয়েরই বেশ পালোয়ানের মতো চেহারা। খুব ডাকাবুকো ধরনের। বাড়িতে পা দিয়েই তারা নিরীহ গৌরগোপালকে নিয়ে পড়ল।
গৌর সাতে-পাঁচে থাকে না, সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তাকে দেখলেই কেন যেন দাদার শালাদের মজা করার ইচ্ছে উসকে ওঠে। গৌর হয়তো বাগানের কাজ করছে, পিছন থেকে এসে তারা হয়তো তার কাছাটা টেনে খুলে দেয়। নয়তো তার ন্যাড়া মাথায় হঠাৎ একটু তেরে কেটে তাক বাজিয়ে চলে যায়। গৌর কিছু বলে না। একে কুটুম মানুষ, তার ওপর আবার বউদি বা দাদার কাছে সুবিচার পাওয়ার বদলে বকুনি খাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। তাই গৌরকে সয়ে যেতে হয়। শুধু তা-ই নয়, এই দুই বজ্জাতকে খুশি করার জন্য সে সেধে সেধে হেসে হেসে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও যায়। তাতে যে সবসময়ে লাভ হয় এমন নয়। মাউ আর খাউ বুঝে গেছে, গৌরগোপাল একটি আহাম্মক এবং বোকা। তার ওপর এ বাড়িতে সে আছে আগাছার মতোই। সুতরাং গৌরকে তারা একদম পাত্তা দেয় না। তবে দরকারমতো তাকে দিয়ে পা দাবিয়ে বা পিঠ চুলকিয়ে নেয়। গৌর তাদের স্নানের আগে গায়ে তেল মাখায়, খাওয়ার সময় পাখা দিয়ে মাছি তাড়ায়। মাউ আর খাউ তাকে বাড়ির চাকরের মতোই ভাবে আর সেইরকমই ব্যবহার করে।
তবে কিনা গৌরগোপালের তাতে অপমানবোধ হয় না। এবাড়িতে সে যে থাকতে পারছে, তাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, এইটেই তার কাছে ঢের বলে মনে হয়। জন্মাবধি এ বাড়ির সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক।
মাঝে মাঝে নিঝুম রাতে গৌরগোপাল মায়ের দেওয়া কবচটা বের করে হাতের মুঠোয় করে চুপ করে বসে থাকে। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, মা তাকে এই কবচটা দিয়ে গেল কেন। তামার কবচটার মুখ ধূপের আঠা দিয়ে আটকানো। মাঝে মাঝে সে কবচটা নেড়ে বোঝবার চেষ্টা করে, ভিতরে কী আছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না।
এর মধ্যে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। গৌরগোপাল খাউ আর মাইয়ের সঙ্গে পুকুরে স্নান করতে গেছে। তিনজনেই জলে দাপিয়ে স্নান করছে। হঠাৎ খাউ-মাউ দুই ভাইয়ের মজা উসকে উঠল। হঠাৎ দুজনে মিলে গৌরকে ধরে জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখল। দুষ্টু বাচ্চারা এরকম একটু-আধটু করে, কিন্তু এ-খেলায় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে জীবন সংশয়। মাউ আর খাউয়ের সেই কাণ্ডজ্ঞান নেই। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে যে তিন মিনিটের বেশি কিছুতেই শ্বাস বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়, এটা বোধহয় তাদের জানাও ছিল না। দুই ভাই গৌরকে জলের তলায় চেপে রেখে হিহি করে হাসছিল।
ওদিকে জলের মধ্যে গৌর তখন আস্তে-আস্তে এলিয়ে পড়ছে। শ্বাস নিতে গিয়ে ঘাঁতঘাত করে জল গিলে ফেলছে। চেতনা আস্তে-আস্তে মুছে যাচ্ছে।
কাঠ কেটে, মাটি কুপিয়ে গৌরের গায়ে জোর কিছু কম হয়নি। তা ছাড়া জলে সাঁতার কেটে কেটে তার দমও হয়েছে অফুরন্ত। ইচ্ছে করলে সে খাউ আর মাউয়ের থাবা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে
পারত। কিন্তু ভালমানুষ গৌর মরতে মরতেও ভাবছে, যদি গায়ের জোর খাটাই তা হলে কুটুম-মানুষদের অপমান করা হবে। ওরা তো আমাকে নিয়ে একটু মজাই করছে। তার বেশি তো কিছু নয়। মজাটা যদি করতে না দিই তা হলে দাদা-বউদি বোধহয় রেগে গিয়ে তাড়িয়েই দেবে বাড়ি থেকে। এই সব ভেবে গৌর আর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না। খুব বিনয়ের সঙ্গে মরার জন্য চোখ বুজে ফেলল।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন পুকুরপাড়ে মেলা লোক জমেছে। তাকে উপুড় করে শুইয়ে গাঁয়ের চৌকিদার কুস্তিগির বাঁটুল তার পেটের জল বের করার জন্য পিঠের ওপর বসে দুমদাম কিল মারছে। বুড়ো কবিরাজমশাই তার নাড়ি ধরে বসে চোখ বুজে বিড়বিড় করে বলছেন, “এখনও ক্ষীণ..অতিক্ষীণ…নিমজ্জমান…।” তাঁর পাশেই ফকিরসাহেব তাঁর আরশিখানা নিয়ে বসে আছেন।
গৌরের জ্ঞান ফিরে এল বটে, কিন্তু বাঁটুলের কিলের চোটে আবার তার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। সে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি বেঁচে আছি-ই! ওরে বাবা, মরলাম রে।”
সবাই হইহই করে উঠল: “বেঁচে আছে..বেঁচে আছে…!”
তা বেঁচে গেল বটে গৌর, কিন্তু তার বড় ভয় হতে লাগল। ওই দুই বজ্জাত কুটুমের পাল্লায় পড়ে একদিন বেঘোরে প্রাণটা না যায়।
ভেবেচিন্তে গৌর একদিন দুপুরে গোরু চরানোর সময় গাঙপারে ফকিরসাহেবের থানে হানা দিল। আড়াইশো বছর বয়সি ফকিরসাহেব তখন একখানা আরশি মুখের সামনে ধরে কাঠের চিরুনিতে দাড়ি আঁচড়াচ্ছেন। ওই আরশি আসলে ভূতের কল। যেখানে যত লোক মরে, ফকিরসাহেব গিয়ে তার আত্মাটাকে আরশিতে ভরে ফেলেন। এইভাবে ওই আরশিতে এ-যাবৎ কয়েক হাজার ভূত জমা হয়েছে।
গৌর ফকিরসাহেবের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলে, “আজ্ঞে আমাকে একটা ভয়-তাড়ানোর তেল দেবেন?”
ফকিরসাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোর ভয়টা কীসের?”
“আজ্ঞে খাউ আর মাউ বড্ড অত্যাচার করে। কুটুম-মানুষ, কিছু বলতেও পারি না। দেখলেন তো সেদিন জলে চুবিয়ে মারার জোগাড় করেছিল।”
ফকিরসাহেব খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা সেদিন যদি মরতিস তো অমাবস্যার আগেই আমার পাঁচ হাজারটা ভূত পুরে যেত। যত নষ্টের গোড়া ওই কবরেজটা। তোর আত্মাটা শরীর ছেড়ে নাকের ফুটো দিয়ে বের হওয়ার জন্য সবে মাথাটা গলিয়েছে, আর ঠিক সেই সময়ে কবরেজ এমন একটা পাঁচন খাইয়ে দিলে যে, বাপ বাপ করে আত্মাটা আবার সেঁধিয়ে গেল ভিতরে।”
গৌর চোখ বড় বড় করে বলে, “আমার আবার ভয় করতে লেগেছে ফকিরবাবা।”
“খাউ আর মাউটা কে বল তো!” ফকিরসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
“বউদির ভাই।”
“তা ওদের ও-রকম নাম কেন?”
“সে জানি না। তবে তিন ভাইয়ের নাম হাউ, মাউ আর খাউ। বড়জন হাউ এখন জেলখানায় আছে। ডাকাতির আসামি। খালাস পেয়ে সেও নাকি এসে জুটবে। ফকিরবাবা, আমি বোধহয় বেশিদিন আর বাঁচব না।”
ফকিরসাহেব মোলায়েম গলায় বললেন, “বেঁচে থেকে হবেটা কী? বেঁচে থাকলেই খিদে পায়, খাটতে হয়, লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগে। তার চেয়ে মরে ভূত হয়ে আমার আরশিতে ঢুকে পড়, সুখে থাকবি।”
“তা না হয় থাকব ফকিরবাবা, কিন্তু বেঁচে থাকার দু-একটা সুখ করে আমি মরতে পারব না।”
ফকিরসাহেব দ্রু কুঁচকে বলেন, “বেঁচে থাকায় আবার সুখ কী রে! মরলেই সুখ।”
“কিন্তু আমি যে জীবনে কখনও পোলাউ খাইনি, চন্দ্রপুলি খাইনি, লুচি দিয়ে পায়েস খাইনি, মোটরগাড়িতে চাপিনি, ঢেউপুরের রথের মেলায় সার্কাসের খেলা দেখিনি। আগে এসব হোক, তারপর মরব।”
ফকিরসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ছেলেমানুষ। একেবারে ছেলেমানুষ। তা যা, ভয় তাড়ানোর তেল একটু দিয়ে দিচ্ছি।” বলে ফকিরসাহেব উঠে ঘর থেকে এক শিশি তেল এনে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, “যন্তর-মন্তর-তন্তর সার, ভয়ভাবনা পগার পার। রাক্ষস-খোক্ষস, দত্যিদানো, হাউ-মাউ-খাউ যতই আনন। ভূত-পেতনি, ডাকাত-তস্কর, তফাত হ রে যত ভয়ংকর। বৃশ্চিক, সর্প, সিংহ, ব্যাঘ্র, দূর হয়ে যা শীঘ্র শীঘ্র। নিশুত রাত্রি, অমাবস্যা, হয়ে যা রে একদম ফরসা।” তিনটে ফুঁ দিয়ে ফকিরসাহেব তেলটি তার হাতে দিয়ে বললেন, “কবরেজটার কাছে একদম যাবি না। আর রোজ এক ঘটি করে টাটকা দুধ দুয়ে দিয়ে যাবি সক্কালবেলায়।”
গৌর ঘাড় নেড়ে তেল নিয়ে ফকিরসাহেবের কাছ থেকে বিদেয় হল।
বিকেলে যখন গৌর খিদে-পেটে গোরু চরিয়ে ফিরছে, তখন মহাকাল-মন্দিরের সামনের রাস্তায় কবরেজমশাইয়ের মুখোমুখি পড়ে গেল।
কবরেজমশাই নাক উঁচু করে বাতাস শুকতে শুকতে বললেন, “উ! উ! মহামাস তেলের গন্ধ পাচ্ছি। এই ছোঁড়া, কার গা থেকে গন্ধটা আসছে রে?”
ভয়ে ভয়ে গৌরগোপাল বলে, “আজ্ঞে আমার গা থেকে।”
“তুই এ তেল পেলি কোথায়?”
“ফকিরসাহেব দিয়েছেন। তবে এ মহামাস তেল নয় কবরেজমশাই, এ হল ভয়তাড়ানো তেল। অনেক মন্তর লাগে।”
কবরেজমশাই হাঃ হাঃ করে হেসে বললেন, “ফকরেটা তাই বলে বুঝি! তাদড় তো কম নয়। এই তো বোধহয় গত মঙ্গলবার আমাকে অনেক তোতাই-পাতাই করে পুরনো মহামাস তেলটা ধরে নিয়ে গেল। সেটাই ভয়তাড়ানো তেল বলে বেচেছে বুঝি!”
গৌর ঘাড় চুলকোতে থাকে।
কবরেজমশাই হুংকার দিয়ে বলেন, “তোর আবার ওটার কাছে যাওয়ার দরকারই বা পড়ল কেন? ভয় পাচ্ছিস বুঝি? কীসের ভয়?”
“আমার অনেকরকম ভয় কবরেজমশাই।”
“দেখি তোর নাড়িটা।” বলে কবিরাজমশাই অনেকক্ষণ ধরে গৌরগোপালের নাড়ি ধরে চোখ বুজে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “প্রাণপাখিটা যে বড্ড ডানা ঝাঁপটাচ্ছে রে। ভয় হওয়ারই কথা কিনা।”
“তবে কী হবে কবরেজমশাই?”
“বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকগে। আজ আর কিছু খাসনে। কাল একটা পাঁচন তৈরি করে রাখব’খন, এসে নিয়ে যাস। আর ওই ফকরেটার কাছে কখনও যাবি না। জ্যান্ত মানুষ ওর ভালই লাগে না। মানুষ মরলে পরে ওর আনন্দ হয়।”
“যে আজ্ঞে।”
“তোদের পিছনের আমবাগানে একটা মস্ত মৌচাক দেখেছিলাম যেন।”
“ঠিকই দেখেছেন।”
“পিছনের পুকুরটায় খুব পদ্মফুল ফোটে, না?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তা হলে পদ্মমধুই হবে। খানিকটা দিস তো।” ঘাড় নেড়ে গৌরগোপাল বাড়ির পথ ধরল। কবিরাজমশাই কিন্তু খেতে বারণ করেছেন। কিন্তু খিদের চোটে গৌরের বত্রিশ নাড়ি পাক দিচ্ছে। সকালে যে তেঁতুল-পান্তা খেয়েছিল, সারাদিন রোদে রোদে মাঠে ঘুরে তা কখন তল হয়ে গেছে। উপোস করলে কি আর রক্ষে আছে!
তবু গৌর বাড়ি ফিরে গোয়ালে সাঁজাল দিয়ে পেটব্যথা বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে রইল।
গাঁ-গ্রামের লোকেরা সন্ধের পরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। বাতি জ্বালাবার খরচ অনেক। সন্ধের পর কাজটাই বা কী?
কিন্তু গৌরের ঘুম আসার নাম নেই। ঘড়ি ঘড়ি উঠে খিদের জ্বালায় জল খাচ্ছে। সাত ঘটি জল খেয়ে ফেলল, কিন্তু খিদে মেটবার নামটিও নেই। রাত যখন নিশুতি হয়ে এসেছে, তখন গৌর আর পারল না, উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
বেশ ফটফটে জ্যোৎস্না উঠেছে। সাদা উঠোনটা ধবধব করছে চাঁদের আলোয়।
গৌর চুপিচুপি গিয়ে রান্নাঘরের শিকল খুলে ঢুকল। সে জানে, রান্নাঘরে কিছুই থাকে না। চোরের ভয়ে বাসনকোসন রাখা হয় না এ-ঘরে। তবে মাটির গামলায় কিছু ভাতের ফ্যান হয়তো রাখা আছে, এই ভেবে গৌর মাটির গামলাটা তুলে দেখল। না, নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌর বেরিয়ে আসছিল। বাগানের গাছে ফলটল আছে। কিন্তু রাত্রিবেলা গাছের গায়ে হাত দিতে নেই। বউদির ঘরে যদিও বা মুড়ি-বাতাসা কিছু থেকে থাকে কিন্তু তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
রান্নাঘরের শিকলটা তুলে দিয়ে গৌর উঠোনে নামবার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। উঠোনের পশ্চিম দিকে দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। গৌর ছায়ায় সরে দাঁড়ায়।
দরজা খুলে খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে ঢ্যাঙামতো একটা লোক বেরিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে উঠোনটা পেরিয়ে চলে গেল। জ্যোৎস্নায় লোকটার মুখ ভাল দেখা গেল না বটে, কিন্তু গৌরের মনে হল, লোকটার মুখে দাড়ি আছে। আর চোখ দুটো মনে হল বেশ গর্তে ঢোকানো। লোকটা উঠোন পেরোবার সময় চারদিকে চোখ ঘঘারাতে ঘোরাতে যাচ্ছিল।
গৌর এ-রকম ঢ্যাঙা লোক এ অঞ্চলে আর দেখেনি। লোকটা চলে যেতেই খাউ আর মাউয়ের ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
এই নিশুতি রাতে এরকম একটা অদ্ভুত লোক ওদের ঘরে এসেছিলই বা কেন আর চুপিচুপি চলেই বা গেল কেন, তা ভেবে পেল না গৌর। ভাববার মতো শরীরের অবস্থাও নয় তার। খিদের চোটে পেট থেকে গলা অবধি তার আগুন জ্বলছে।
ঘরে এসে সে ঘুমোবার চেষ্টা করল। না, ঘুম আসছে না। উঠে একটু পায়চারি করল। তাতেও হল না। তখন সে খুব কষে কয়েকটা বুকডন আর বৈঠক দিয়ে নিল। তাতে হল হিতে বিপরীত। খিদেটা রাক্ষসের মতো হাঁউ-মাউ-খাউ করে তার পেটটাকে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল।
গৌর কুলুঙ্গিতে পটের পিছনে লুকোনো কবচটা বের করে হাতের মুঠোয় ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা, তুমি বেঁচে থাকতে কখনও খাওয়ার কষ্টটা হয়নি। এবার যে খিদেয় বাঁচি না। বাঁচিয়ে দাও মা।” খিদেটা তাতে মরল না বটে, কিন্তু কবচটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে থাকতে থাকতেই গৌর কাহিল হয়ে শুয়ে পড়ল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তা আর তার খেয়াল নেই।