গোলাপ সুন্দরী (Golap Sundari) : 06
কখন মনে হয় সে সঙ্গীত অ্যাসিতেছে কখন বা মনে হয় আশ্চৰ্য্য মিথ্যা ! সে, বিলাস, দেখিল পা ঠাণ্ড ঠাণ্ডা লাগিতেছে, এইটুকু বোধকে সুচতুর বিলাস আশ্রয় করিল ; দ্রুত আপনকার শরীরের যত্ন লইতে সে ব্যগ্র হয় । সে বুঝিল সে ক্ষুধাৰ্ত্ত ! এই সূত্রেই সে মনস্থ করে কডলিভার আর এক চামচ বেশী করিয়া সেবন করিবে ।
এখন সে এই হলে আসিয়া একটু পোর্ট ঢালিয়া অল্প চুমুক দিতে কেমন যেন সাহস ফিরিয়া পাইল, চকিতে চেট্টির লিখিত এপিটাপের কথা স্মরণে আসে, যে স্মরণ এতকাল রৌদ্র আর আশা লইয়া দিনক্ষয় করিয়াছে—এবং এমত সে ভাব করিল যেন এখনি সে সেই এপিটুপি খুঁজিয়া বাহির করিবে, এবং এই মুহূৰ্ত্তে মেঘগর্জন শোনা যায়, আর তাহারই শেষে আবার সেই ধীর মন্থর মৰ্ম্মান্তিক ক্ৰন্দন ধ্বনি যাহা গোলাপের অন্তর হইতে—গোলাপ ত স্বল্পায়ু মানুষের অনন্ত সুপ্তি—এই সুপ্তি হইতে, স্থানসমূহকে আচ্ছন্ন করে । বিলাস কোথায় যেন অন্তৰ্দ্ধান করিয়াছিল ।
এখন দরজায় করাঘাত পড়িল, বিলাস যেমন চোখে প্রথম ক্ৰন্দন ধ্বনি শুনে, তেমনই আশ্চর্য্য হইয়া হয়ত বিরক্ত হইয়া দ্বারে করাঘাত শুনিল, চাপার বাবা ত চলিয়া গিয়াছে তবে শ্মশানযাত্রী ? পুনরায় করাঘাত। বিলাস অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে দরজা খুলিতেই, দূরস্থিত আলো, ছবির কাচে লাগিয়া আলোকিত করিয়াছে দেখিল, আশচর্য্য একটি চক্ষু তাহারই আশে, শিকড়াকৃতি কেশরাশি, ক্রমাগত সম্ভবত বৃষ্টিজল গড়াইয়া পড়িতেছে, যন্ত্রচালিতের মতই দরজা মেলিয়া ধরিল, এবং স্পষ্ট দেখিল, সুন্দর একটি মুখমণ্ডল, সুদীর্ঘ পক্ষ্মযুক্ত পদ্ম-পলাশ লোচন, চুলগুলি ঝুরি ঝুরি হইয়া নামিয়াছে এবং ক্রমাগত জলধারা, আর যে মেজেতে পড়িয়া জলবিন্দুর শব্দ হইতেছে। সম্মুখের রমণীর মুখখানি অল্প অল্প আন্দোলিত।
বিলাস, নিশ্চিত ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না ।
“আমি এলা”
বিলাস এখনও তাহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইতে পারে নাই, এ কারণ যে দূর কোন ঐতিহাসিক প্রাসাদের মধ্যে সে আশ্রয় লাভ করে নাই ।
রমণী কহিলেন “চিনতে পারছেন না”
বিলাস এমত জড় অবস্থাতেও আপনার মস্তক হেলাইয়া সায় দিল । পরক্ষণে সে সংজ্ঞা ফিরিয়া পাইয়া অসম্ভব আপনার করা কণ্ঠে কহিল “আরে আসুন আসুন…বেচারী আপনি ঠিক আছে… চলে আসুন কার্পেট আঃ…আর দেরী নয়…” মনে হইল সে যেন বা ওমির সঙ্গে কথা কহিতেছে ।
“সত্যি আমায় চিনতে পেরেছেন…” ঘরের চারিদিক রমণী শিশুর ন্যায় মাথা তুলাইয়া দেখিতে লাগিলেন ।
“নিশ্চয়…কথা পরে হবে…এখন…কাপড় না বদলালে আপনি ত…”
“কিছু নয় কাপড়টা নিঙড়ে নিয়ে বসে থাকব, বৃষ্টি…”
“তা হয় না…আমার কাপড় ত নেই…সবই…” এইটুকু মাত্র বলিয়া বিলাস সহসা গম্ভীর হইয়া উঠিল, এসব কথাবাৰ্ত্তা বলিতে তাহার কেমন লজ্জা হইল, প্রথমত ভদ্রমহিলা, অথবা প্রথমত সে ভদ্রলোক… । তথাপি অত্যন্ত কৰ্ত্তব্যপরায়ণ কণ্ঠে কহিল “এক কাজ করুন”, বলিয়া তৎক্ষণাৎ বাতিদানটি লইয়া পূৰ্ব্ব দিককার ঘরের দেরাজের উপর রাখিয়া যোগ করিল “পাশে বাথরুম আছে, আপনি অনায়াসে এখানে আপনার মত করে এ ঘর ব্যবহার করতে পারবেন” এবং কক্ষ পরিত্যাগ কালে মুখ না ফিরাইয়া কহিল “সত্যিই আমি বড় লজ্জিত তবু যা যা আছে আমি দিয়ে যাচ্ছি—”
বিলাস অন্ধকার হলে এক বসিয়াছিল, আপনার অজ্ঞাতসারে একবার দেখিল তাহার সুন্দর হাত ফুটিকে আরাম দিবার মানসে বাতিদানের কাচের আশেপাশে নাম উঠা করিতেছে ; বিলাস ভাবিল ভদ্রমহিলাকে একটু পোর্ট…না কোন প্রয়োজন নাই, হয়ত গর্হিত হবে ।
সে জানালায় দাঁড়াইয়া ঘোর মেঘলিপ্ত আকাশের প্রতি লক্ষ্য করে, জানালার গরাদে তাহার হস্তদ্বয় এবং সেখানেই আপনার মুখমণ্ডল স্পর্শ করত লৌহের শৈত হইতে ঈষৎ আরাম পায়, আজিকার সারাদিনটা তাহার এক ভাবে কাটিয়াছে, যেখানে সে কারণ মাত্র ; যে অহঙ্কার যে মনোভাব লইয়া ওমিকে সে চিঠি লিখিতে পারে তাহার এক কণা মাত্র অদ্য মাথাও তুলিতে পারে নাই, পিণ্ডদানের কথা মনে এতাবৎ আসে নাই, শ্লোক পাঠ কালে একদা সে ঊর্দ্ধের আকাশকে, নিঃসঙ্গতাকে শায়িত স্ত্রীলোকের মধ্যে দেখিয়াছে— সে কথা আরও স্পষ্ট করিয়া মনে হইতেছিল ।
বিলাসের এই দুর্য্যোগময়ী রাত্রের অতিথির কথা একবারও মনে হয় নাই, এ কারণে যে সে যে-সমাজে মানুষ সেখানে নারী জাতি সম্পর্কে সাধারণ লজ্জা তথা বিমূঢ়ভাব নাই যদিচ পূর্ণ ধৰ্মজ্ঞান আছে। বিলাস এখান হইতে কাহার যেন কণ্ঠস্বর শুনিল “আমার আর আলোর প্রয়োজন নেই”
বিলাস অনন্যসাধারণ লীলাময়ী প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তাহার ধারণা এ কণ্ঠস্বর ইদানীং মন্থিত ধরিত্রী হইতে আসে, অন্য কোথাও হইতে বিলাস মহাউৎকণ্ঠায় কিছুকাল কাটাইবার পর একদা তাহার খেয়াল হইল, উহা রমণীর কণ্ঠস্বর। সে তৎক্ষণাৎ ভদ্রভাবে দাঁড়াইয়া অত্যধিক সহবত সহ কহিল “না থাক আমি” তাহার শেষ কথাটা কক্ষস্থিত অন্ধকারে মিলাইয়া গেল, ইহাতে প্রতীয়মান সে স্বল্পভাষী, কিন্তু সত্যই সে সমস্যায় পড়িয়াছিল, কেন না গৃহে অন্য আলোর ব্যবস্থা আর নাই, ইহা ব্যতীত ভূষণ যে মোমবাতি কোথায় রাখে তাহা জানা ছিল না !
“আপনাকে খুব মুস্কিলে ফেলেছি”
এ কণ্ঠস্বর পুনরায় সাধারণ ভাবে আসিল না, সমুদয় দিক প্রদক্ষিণ করিয়া দূর পাহাড়ের পাশ দিয়া আসিয়া তাহার তন্দ্রায় লাগিল যেখানে দর্শক তথা শ্রোতা ব্যতীত অন্য অস্তিত্ব তাহার ছিল না, এমন কি সে ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণে আপনকার সূক্ষ্ম দেহ দিব্য কম্পন অনুভব করিত যে সে একনিষ্ঠ এরূপ নিশ্চয়তার কোন চিহ্ন সেখানে নাই । এ তন্দ্রা হইতে সে, বিলাস, পুনরায় ঘোর যামিনী আবৃত বসুন্ধরা দর্শন করিল, এবং চকিতে সোজা হইয়া পূৰ্ব্বদিককার কক্ষ অভিমুখে চাহিল।
আর কোন শব্দ নাই, মুখচোরা লজ্জা সে ঘরে যেমত বা ছাইয়া আছে । ইহার পর কুষ্ঠাবিজড়িত কণ্ঠের স্বর আসিল “কি কুক্ষণে যে শহরে গিয়েছিলুম…গরুর গাড়ীও এগোতে পারলে না…মাইল খানেক পথ হেঁটে” তাহার স্বর মসৃণ আলোর মত হলঘরে ভ্রমণ করিতে লাগিল ।
“বৃষ্টি কখন যে থামবে…”
“ব্যস্ত হবেন না”