Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোলমেলে লোক || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

গোলমেলে লোক || Shirshendu Mukhopadhyay

বিজয়বাবু হাঁ হয়ে গেলেন

“বাজার!” বলে একটা আর্তনাদ করে বিজয়বাবু হাঁ হয়ে গেলেন।

গুরুপদ দুখানা ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ বিজয়বাবুর শিথিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ মেজদা, বাজার।”

বিজয়বাবু হঠাৎ সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন, “আমি করব বাজার? আমাকে বাজারে যেতে বলিস, তোর এত সাহস?”

গুরুপদ সভয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “আহা, আমি তোমাকে বাজার করতে বলব কেন?”

“এই যে বললি? জীবনে কখনও বাজারে গেলুম না, আর এখন তুই আমাকে বাজারে যাওয়ার হুকুম করিস?”

“আমি বলছি না তো! আমি বলতে যাব কোন দুঃখে? এ আমার বলা নয়, আমাকে দিয়ে বলানো হয়েছে মাত্র।”

“কে? কার এত সাহস?”

“বড়বউদি আর মেজোবউদি।”

বিজয়পদ চোপসানো বেলুনের মতো হয়ে গিয়ে ফাসফেসে গলায় বললেন, “তা সেটা আগে বলতে হয়। কিন্তু আমাকে তারা বাজারে পাঠাতে চায় কেন জানিস?”

“কাল রাতে বাড়িতে বউদিরা মিলে মিটিং করেছে। তাদের মত হল, তোমার কোনও এক্সারসাইজ হচ্ছে না, তুমি দিনদিন অলস আর ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছ। গ্রন্থকীট হওয়ার ফলে তোমার বস্তুজ্ঞান লোপ পাচ্ছে এবং তুমি আজকাল প্রায়ই ভূত দেখছ। ফলে আজ থেকে তোমার রুটিন পালটে ফেলতে হবে। বাইরের খোলা হাওয়া বাতাসে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাজার-হাট করতে হবে, লোকের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়ে দিতে হবে।”

বিজয়বাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “লিস্টিতে আর কিছু নেই? এভারেস্টে ওঠা বা ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া!”

“পরে হয়তো সেসব নিদানও দেওয়া হবে। আজ বাজার দিয়ে শুরু।”

বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ গলায় বললেন, “বাজারটা কোন দিকে যেন?”

“পুব দিকে।”

“অ। তা সে না হয় হল! কিন্তু হা রে, বাজার কীভাবে করতে হয় জানিস?”

“তা জানব না কেন?”

“তা হলে তুইও না হয় সঙ্গে চল।”

“আমার ঘাড়ে একটা বই দুটো মাথা তো নেই মেজদা।”

“তা বটে।”

গুরুপদ অভয় দিয়ে বলল, “ভয়ের কিছু নেই, ফর্দ ধরে বাজার করলেই হবে। লাউ, কুমড়ড়া, পালংশাক, ধনেপাতা, বেগুন, উচ্ছে, নিমপাতা, আলু, টম্যাটো, পোনামাছ আর হাঁসের ডিম।”

“ওরে বাবা! এত খাওয়া কি ভাল?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজয়বাবুকে উঠতে হল। তিনি কখনও যুদ্ধে যাননি বটে, কিন্তু আজ মনে হয়, সেটাও এমন কিছু নয়। বাজারে চোর, জোচ্চোর, পকেটমার ঘুরে বেড়ায়, দর বেশি হাঁকে, ওজনে ফাঁকি দেয়, পচা জিনিস গছিয়ে দেয়। কী করে সব দিক সামলাবেন সেই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে তিনি বাজারে রওনা হয়ে পড়লেন।

বাড়ির কাছেই মোড়ের মাথায় ভবেন রক্ষিতের সঙ্গে দেখা। “কে রে, বিজয় নাকি? বাজারে যাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ ভবেনা।”

“ভাল-ভাল। আমিও একটু আগেই বাজার ঘুরে এলুম কিনা! তা আজ নন্দগোপালের কাছে ভাল বেগুন পাবি। একেবারে কাশীর বেগুনের মতো স্বাদ। ধনঞ্জয় টাটকা লাউ পেড়ে এনেছে। সুকুমারের দোকানে আলতাপাটি শিম এসেছে দেখেছি।”

আনমনে একটা হুঁ দিয়ে বিজয়বাবু দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। একটা ধন্দ-ধন্দ ভাব। প্রথম বাজারে গেলে বোধ হয় এরকমই হয়।

আলুর দোকানে শিবেন ধর উবু হয়ে বসে আলু বাছছেন দেখে বিজয়বাবুর ধড়ে প্রাণ এল। শিবেন ধর বিষয়ী লোক। ঝুপ করে তার পাশে বসে পড়ে বিজয়বাবু বললেন, “আলু নিচ্ছেন বুঝি শিবেনবাবু?”

“হ্যাঁ। তা আপনিও নেবেন বুঝি? ওই লালচে লম্বা ছাদের আলুগুলো বেছে তুলুন। ওগুলো খাঁটি নৈনিতাল। খবরদার, চার টাকার বেশি দর দেবেন না।”

বিজয়বাবুর ভারী সুবিধে হয়ে গেল। ফুলকপি কিনতে গিয়ে একটু বিভ্রাটে পড়েছিলেন। কালু মোক এগিয়ে এসে বলল, “আহা, ওগুলো নয়! গোড়ার দিকটা একটু সরু মতো দেখে নিন। ওগুলোর সোয়াদ খুব। দিশি জিনিস তো, সঙ্গে কড়াইশুটি নিতে ভুলবেন না। ওই অমর আজ টাটকা কড়াইশুটি এনেছে।”

বেশ ভালই লাগছে বাজার করতে তাঁর। বাজার-ভর্তি এত চেনা লোককে পেয়ে যাবেন তা তো আর জানতেন না!

মাছের বাজারে গিয়ে মাছের একটা টুকরো প্রায় পছন্দই করে ফেলেছিলেন। ঠিক এই সময় গোপেন বিশ্বাস কোত্থেকে উদয় হয়ে বলল, “আহা, করো কী হে বিজয়? ওটা যে শতবাসি মাছ। ওই ফুলেশ্বর টাটকা পোনা মাছটা সবে কেটেছে। যাও-যাও, সের দুই কিনে ফ্যালো গে।”

অতি সুষ্ঠুভাবেই বাজার করছেন বিজয়বাবু, কিন্তু সেই অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। বারবারই মনে হচ্ছে, একটা কীসের যেন হিসেব মিলছে না। একটা বেশ গোলমাল হচ্ছে! কিন্তু কীসের গোলমাল তা ধরতে পারছেন না।

একজন মুটের হাতে বাজারপত্র চাপিয়ে বাজার থেকে বেরোতে যাবেন, সর্বেশ্বর পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা।

“বাজার হল বুঝি?”

“যে আজ্ঞে, পণ্ডিতমশাই।”

“তোকে একটা কথা অনেকদিন ধরে বলব-বলব করছি, বলা হয়ে উঠছে না।”

“কী কথা পণ্ডিতমশাই?”

“আহা, ওই বাইবেলটার কথা। জনসাহেবের সেই হিব্রু ভাষার বাইবেল। যদিও ম্লেচ্ছ জিনিস, তবু ওটা আগলে রাখিস। ওটার এখন অনেক দাম।”

বিজয়বাবুর মোটে খেয়ালই ছিল না। ঠিক বটে! তাঁদের বাড়িতে অনেক বইয়ের মধ্যে একটা হিব্রু ভাষার পুরনো বাইবেলও আছে বটে। শোনা যায়, জনসাহেবের নাতি বইখানা তাঁর দাদুকে দিয়েছিল।

বিজয়বাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, “অনেক দাম?” সর্বেশ্বর বললেন, “তাই তো শুনি। ওই বাইবেলের মধ্যে নাকি গুপ্তধনের সন্ধান আছে।”

বিজয়বাবু বিস্মিত। হাঁ করে চেয়ে রইলেন।

“কিছু লোক বাইবেলটা হাত করার জন্য ঘুরঘুর করছে বাপু। একটু হুঁশিয়ার থাকি।”

“যে আজ্ঞে।” বলে চিন্তিত বিজয়বাবু বাড়িমুখো হাঁটতে-হাঁটতে ফের অস্বস্তিটা বোধ করছিলেন। কী যেন একটা গরমিল হচ্ছে। কেমন যেন একটু ধাঁধামতো ভাব হচ্ছে! অথচ পকেটমার হয়নি! বিশেষ ঠকেও যাননি। কারও সঙ্গে কথা-কাটাকাটি বা অশান্তি হয়নি। অথচ এরকম হচ্ছে কেন?

মুটে ছেলেটা তাঁর পিছু পিছু আসছিল। হঠাৎ বলল, “আচ্ছা বাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“কী কথা রে?”

“আপনি একা-একা কথা বলেন কেন?”

“একা-একা কথা বলি? দূর পাগল, কখন আমাকে একা-একা কথা বলতে দেখলি?”

“আজ্ঞে, সারাক্ষণই তো আপনি বাজার করতে-করতে বেশ জোরে জোরে কথা বলছিলেন। এই যে একটু আগে বললেন, “যে আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই। তারপর বললেন, “তাই নাকি পণ্ডিতমশাই। সবাই বলছিল বাবুটা পাগলা আছে।”

বিজয়বাবু রেগে একটা ধমক দিতে গিয়েও হঠাৎ বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাই তো! সর্বেশ্বর পণ্ডিত আসবেন কোত্থেকে? তিনি তো অন্তত পাঁচ বছর আগে…। মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল বিজয়বাবুর। তাই তো! ভবেন রক্ষিত, শিবেন ধর, কালু মোক বা গোপেন বিশ্বাস কারওরই তো বেঁচে থাকার কথা নয়। এঁদের প্রত্যেকের শ্রাদ্ধে তাঁর নেমন্তন্ন ছিল।

“ভূ-ভূত! ভূ-ভূত! ভূ-ভূত!” বলে আবার হাত-পা ছড়িয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন বিজয়বাবু। লোকজন ছুটে এল। ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। এল জল, এল পাখা। ৬৮

খবর পেয়ে যতীনডাক্তারও এসে হাজির। বিজয়বাবুর প্রেশার দেখা হল, জিভ দেখা হল, চোখ দেখা হল, নাড়ি দেখা হল, বুক পরীক্ষা হল, পেট টিপে দেখা হল।

শশীমুখী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, “ভূত দেখারও তো একটা নিয়মকানুন রীতিনীতি থাকবে রে বাপু! যখন-তখন দেখলেই তো হবে না! অন্ধকার চাই, একা হওয়া চাই, নিরিবিলি জায়গা চাই! বাজার-ভর্তি একহাট লোকের মধ্যে দিনের ফটফটে আলোয়, তাও একটি-দুটি নয়, গন্ডায়-গন্ডায় ভূত দেখে নাকি কেউ? ছ্যা-হ্যাঁ, এ যে ভূতের উপর ঘেন্না ধরে গেল বাবা! ভূত যদি এমন নির্লজ্জ, আদেখলে বেহায়া হয়, তা হলে ভূতকে আর কেউ কখনও ভয় পাবে?”

মূৰ্ছনাদেবীও রাগ করে বললেন, “চারদিকে মনিষ্যিগুলোকে কখনও ওঁর নজরে পড়ে না, নজরে পড়ে কেবল ভূতেদের!”

এই কদিন আগেও বিজয়বাবু ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। ভূত বলে যে কিছু থাকতে পারে এটা কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কি বিশ্বাস করতে পারে? তা হলে এখন এসব কী হচ্ছে? এ কি ভূত না ভুল? তাঁর কি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? লজিক কাজ করছে না? ঘরভর্তি পাড়া-প্রতিবেশী আর বাইরের মানুষজন তাঁকে হাঁ করে দেখছে, আর নানা কথা কইছে। লজ্জায় মুখ দেখানোর জো রইল না তাঁর! চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে থাকা ছাড়া তাঁর আর কী-ই বা করার আছে? এইভাবে দশজনের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে বেঁচে থাকাও যে কঠিন হয়ে উঠছে তাঁর কাছে!

যতীনডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, “শশীমুখী বউমা ঠিকই বলেছেন। ভূত-টুত দেখার একটা আলাদা অ্যাটমস্ফিয়ার আছে। দিনেদুপুরে বাজারে ভিড়ের মধ্যে ভূত দেখাটা তো ঠিক হচ্ছে না!”

নীলমণি ঘোষ বললেন, “ঘোর কলিকাল বলেই হচ্ছে। এর

পর বেলা বারোটায় আকাশে তারা দেখা গেলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।”

অভয়পদ বলল, “এসবের মূলে কি গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর এল নিনো আছে বলে আপনার মনে হয় ডাক্তারবাবু?”

শশীমুখী রোষ-কষায়িত লোচনে তার দিকে তাকাতেই অভয়পদ তাড়াতাড়ি পিছিয়ে ভিড়ের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।

যতীনডাক্তার বিদায় হলেন। ঘরের ভিড়টাও ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল। একা হওয়ার পর বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললেন। আর চোখ খুলেই শুনতে পেলেন, ভিতর দিককার বারান্দায় নয়নতারা শশীমুখীকে বলছে, “ও বড়দি, ভূতই দেখুন আর যা-ই দেখুন, মেজদা কিন্তু বাজারটা করেছেন ভারী ভাল! কী সুন্দর কচি লাউ এনেছেন দেখুন! আর বাজারের সেরা ফুলকপি, সরু ডাঁটিওয়ালা। কী ভাল বড়-বড় টম্যাটো, কচি পালং, নারকুলে বাঁধাকপি আর কড়াইশুটি!”

বাসবীও বেশ উঁচু গলায় বলল, “আর মাছটাও একদম এক নম্বর। এমন পাকা তেলালো রুই অনেকদিন আসেনি। নাঃ, মেজদার মতো এত সুন্দর বাজার কাউকে করতে দেখিনি!”

প্রশংসা শুনে বিজয়বাবুর মুখ শুকোল! সর্বনাশ! তাঁর বাজারের সুখ্যাতি বেশি ছড়ালে যে এবার থেকে তাঁকেই ঠেলেঠুলে রোজ বাজারে পাঠানো হবে। সেই ধকল কি তিনি সইতে পারবেন? হার্টফেল হয়ে যাবে যে!

খুব সরু গলায় পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “বাবু!”

বিজয়বাবুর বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে পাঁজরে জোর একটা ধাক্কা দিল। তিনি টক করে চোখ বুজে ফেলে ককিয়ে উঠলেন, “ভূ-ভূত! না না, আমি আর ভূত দেখতে পারব না বাবা। আর নয়। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে। তুমি বরং আর একদিন…!” ৭০

“বাবু, আমি লখাই!” বিজয়বাবু মিটমিট করে তাকিয়ে দেখলেন, লখাই-ই বটে। তাঁর বিছানার পাশে মেঝেয় বসে দাঁত বের করে হাসছে।

“হাসছিস যে বড়?”

“ভয় খেলেন তো, তাই দেখেই হাসছি।”

“মানুষ ভয় খেয়ে মরতে বসলে কি তোর মজা হয়?”

“না বাবু, বলছি, তেনারা তো আপনার ভালই করতে চেয়েছিলেন?”

বিজয়বাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তা ভালটা একটু আড়াল আবডাল থেকে করা যেত না? অমন বুক ফুলিয়ে চোখের সামনে এসে ভাল করতে হয়? তাতে যে হার্টফেল হতে পারে, সেটাও তো ভাল করার আগে ভাবা উচিত ছিল।”

লখাই মাথা-টাথা চুলকে বলল, “তা বটে! তবে কিনা তেনাদের মতিগতি বোঝা ভারী শক্ত। কিন্তু আপনার সঙ্গে তেনাদের যে একটা ভারী কাজের কথা আছে! না বললেই নয়।”

বিজয়পদ অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “ওরে না না! আমি কোনও কথাটথা শুনতে পারব না! আর দেখা-সাক্ষাতেরও দরকার নেই।”

“কিন্তু বাবু, কথাটা যে বড্ড কাজের ছিল।”

“কী কথা? অ্যাঁ? আমার সঙ্গে তাদের এত কথা কীসের?”

লখাই ফের মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কী আর বলব? তবে যতদূর জানি, একটা বই নিয়ে কথা। বইখানা নাকি খুব কাজের বই।”

“বই!” বলে হঠাৎ বিজয়পদ শোওয়া অবস্থা থেকে সটান হয়ে বসে বললেন, “তাই তো! সর্বেশ্বর পণ্ডিত তো একটা বইয়ের কথাই বলেছিলেন! হিব্রু ভাষায় ছাপা বাইবেল!”

লখাই একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেইখানাই!”

“তার মধ্যে নাকি গুপ্তধনের হদিশ আছে?”

বিজয়পদ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “চল তো দেখি।”

লাইব্রেরি ঘরে এসে বিজয়পদ কাঠের মইখানা উত্তর দিকের দেওয়ালে একেবারে কোণ ঘেঁষে দাঁড় করালেন। কোথায় কোন বই রাখা আছে এটা তাঁর একেবারে মুখস্থ। চোখ বেঁধে দিলেও বের করতে পারবেন।

লখাই মইখানা চেপে ধরে রইল। বিজয়পদ খুব সাবধানে মই বেয়ে উপরে উঠলেন। বাঁ ধারে পরপর দশ-বারোখানা নানা সংস্করণের বাইবেল সাজানো। বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়খানাই হিব্রু ভাষার বাইবেল। কিন্তু জায়গাটা ফাঁকা!

বিজয়পদ একটা আর্তনাদ করলেন, “সর্বনাশ!”

“কী হল বাবু?”

“বইটা তো নেই!”

“বলেন কী বাবু? এঃ হেঃ, তেনারা যে ভারী নেতিয়ে পড়বেন?”

স্তম্ভিত বিজয়পদ মই থেকে নামার কথা অবধি ভুলে গিয়ে দু’ হাত মাথায় দিয়ে ডুকরে উঠতে যাচ্ছিলেন। সাধারণত মইয়ের উপর উঠলে দু হাত ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম নেই, তা যুক্তিযুক্তও নয়, বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও নয়। সুতরাং বিজয়বাবু মইয়ের ডগা থেকে চিতপটাং হয়ে সোজা মেঝের উপর পড়তে লাগলেন। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে দুটো জোরালো হাত তাঁকে ধরে পাঁজাকোলে তুলে না নিলে বিপদ ছিল।

পড়ার ধকলে বিজয়পদর মাথাটা ডোম্বল হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তারপর আবছা চোখে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখটা দেখে ককিয়ে উঠলেন, “ভূ-ভূত! ভূ-ভূত!”

লোকটা তাঁকে যত্ন করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আজ্ঞে, ভূতও বলতে পারেন। আমি কি আর মনিষ্যির মধ্যে পড়ি? তবে কিনা এখনও চৌকাঠটা ডিঙনো হয়নি, এই যা!”

“ও, আপনি সেই বটু সর্দার, তাই না?”

“যে আজ্ঞে। তা বাবু, অমন হন্তদন্ত হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে কোন বইটা খুঁজছিলেন বলুন তো?”

বিজয়পদ একটু ধাতস্থ হয়েছেন। সুতরাং সতর্কতা অবলম্বন করে বললেন, “ও একটা ইংরেজি বই।”

লোকটা ঘরের কোণ থেকে চামড়ায় বাঁধানো একটা মোটা বই কুড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, “আজ্ঞে, আমি মুখ মানুষ। ইংরেজিও জানি না, হিব্রুও জানি না। তা দেখুন তো, এই বইটা নাকি?”

বিজয়পদ বইটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে উলটে-পালটে দেখে বললেন, “আরে, এই তো সেই বই! হিব্রু ভাষার বাইবেল! এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

“আজ্ঞে, যেখানে রাখা ছিল সেখান থেকেই পেয়েছি।”

“বলেন কী? তা বইটা নামিয়েছিলেন কেন?”

“সে আর কবেন না। শুনেছিলুম, বইটার মধ্যে নাকি গুপ্তধনের একখানা নকশা আছে। তা ভাবলুম, নকশাখানা বেহাত হলে বাবুর তো বেজায় লোকসান হয়ে যাবে। তাই নকশাখানা বের করে নিয়ে গিয়ে এই একটু আগে বাজার থেকে ছাপাই করে নিয়ে এলাম।”

বিজয়পদ আঁতকে উঠে বললেন, “জেরক্স করিয়েছেন? সর্বনাশ! তা হলে তো খবরটা চাউর হয়ে যাবে?”

বটু সর্দার চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তা খুব একটা ভুল বলেননি। দোকানি আর তার শাগরেদ বলাবলি করছিল বটে, এটা নাকি গুপ্তধনের নকশা। তা তারাও কয়েকখানা ছাপিয়ে নিল দেখলাম।”

বিজয়বাবু দু হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন, “হায়-হায়। সারা গাঁয়ে যে এতক্ষণে ঢিঢ়ি পড়ে যাওয়ার কথা! এমন একটা গোপন জিনিস কি বাজারের দোকানে জেরক্স করতে হয়?”

“ঘাবড়াবেন না বাবু, আসল নকশাটা বইয়ের মধ্যেই যত্ন করে রাখা আছে। হেঁ হেঁ, ওখানা তো আর হাতছাড়া করিনি!”

লখাই এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, “হ্যাঁ বটে, বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় আমি ফটিককে এই নকশার ছাপাই ফিরি করতে দেখেছি। হেঁকে বলছিল বটে, “গুপ্তধনের নকশা, দু’ টাকা! গুপ্তধনের নকশা, দু’ টাকা!”

“কী সর্বনাশ করলেন বলুন তো?”

বটু সর্দার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “তা বাবু, বুড়ো হয়েছি, ভীমরতিই হল বোধ হয়।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress