Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোলমেলে লোক || Shirshendu Mukhopadhyay

গোলমেলে লোক || Shirshendu Mukhopadhyay

মদনপুরের হাটে

মদনপুরের হাটে মোট বত্রিশ টাকা পকেটমার হয়ে গেল গুরুপদর। গুরুপদ যখন নিশিকান্তর দোকানে গামছা দুর করছিল, তখনই ঘটনা। একটা পাতলা চেহারার কমবয়সি লোক কিছুক্ষণ ধরেই তার আশপাশে ঘুরঘুর করছিল যেন। বোধ হয় তক্কেতক্কেই ছিল। নিশিকান্তর দোকানে গামছা বাছাবাছি করার সময় সট করে পকেট ফাঁক করে দিয়ে সটকেছে। স্বীকার করতেই হবে যে, ছোঁকরার হাত খুব পরিষ্কার, গুরুপদর একটু সুড়সুড়ি অবধি লাগেনি। একটা মাছি ভনভন করে মুখে-চোখে বারবার বসছিল বলে সেই সময়টায় গুরুপদ একটু ব্যতিব্যস্ত ছিল বটে, সেই ফাঁকেই কাজ হাসিল করেছে। রাগ যে একটু হল না তা নয়। তবে কিনা গুরুপদ গুণীর কদর দিতেও জানে। পকেটমার লোকটার হাতটি চৌখস। গুরুপদ একসময় জাদুকর সাতকড়ি সরখেলের শাগরেদি করেছিল। হাতসাফাই মকশো করার জন্য কী খাটুনিটাই খাটতে হত! সাতকড়িবাবু বুড়ো বয়স অবধি সকালে উঠে দু’ঘণ্টা প্র্যাকটিস করতেন। যেমন বড় বড় গানাদাররা রেওয়াজ করে, তেমনি। তা পকেটমারিও সেইরকমই এক বিদ্যে। নিপুণ আঙুলের আলতো এবং সূক্ষ্ম কাজ! জাদুকর বা গানাদার বা বাজনদারের ভুলচুক হলে, আর যাই হোক, প্রাণের ভয় নেই। কিন্তু পকেটমারের ভুলচুক হলে হাটুরে ঠ্যাঙানি খেয়ে গঙ্গাযাত্রার দশা হতে পারে। তা যদি না-ও হয়, থানা-পুলিশ থেকে হাজতবাস, কী-ই না হতে পারে?

গামছা আর কেনা হল না গুরুপদর।

কথাটা হল, বিদ্যের কোনও শেষ নেই। যতই শেখো না কেন, আরও কত কী বাকি থেকে যায়! গুরুপদ বিদ্যে শিখতে বড় ভালবাসে। স্কুল-কলেজে তেমন সুবিধে করতে পারেনি বটে, কিন্তু বিদ্যে তার কিছু কম নেই। বিদ্যাধরমাঝির কাছে নৌকো বাইতে শিখেছিল, গদাইধীবরের কাছে খ্যাপলা জাল ফেলতে। সাপ ধরতে শিখিয়েছিল হবিবগঞ্জের বুড়ো সাপুড়ে নজর আলি। সাতকড়িবাবুর কাছে কিছুদিন নাড়া বেঁধে ম্যাজিক মকশো করল। শিবু মিশ্রের কাছে শিখল তবলা। মারণ-উচাটন শিখবে বলে বীরপুরের শ্মশানে তারাতান্ত্রিকের কাছেও কিছুদিন ধরনা দিতে হয়েছিল। পাশের বাড়ির সেলাইদিদিমণি শোভনাদির কাছে উলবোনা শিখতেও বাকি রেখেছে নাকি? হরেরাম ভট্টাচার্যের কাছে খালি জ্যোতিষী আর নবছা মণ্ডলের কাছে এক হোমিয়োপ্যাথিও শেখা আছে তার। এত সব শিখেও তার মনে হয়, আহা, আরও কিছু শিখলে হত! এই যেমন এখন হচ্ছে! পকেটমারি হওয়ার পর তার মন বলছে, এ বিদ্যেটাও কিছু ফ্যালনা নয়। কারও পকেট মেরে আখের গোছানোর মতলব নেই তার। কিন্তু বিদ্যেটা শিখে রাখা তো আর দোষের নয়!

মদনপুরের হাটের নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে নটবর হাজরা। তার চা-মিষ্টির দোকান। ভারী তিরিক্ষি মেজাজের মানুষ। তবে কণ্ঠী তিলকধারী পরম বৈষ্ণব। তার দোকানে যাতায়াত নেই মদনপুরের তেমন হাটুরে খুঁজে পাওয়া শক্ত। চোর-ছ্যাচোড় থেকে দারোগা পুলিশ সকলেরই পায়ের ধুলো নটবরের দোকানে পড়ে থাকে।

শীতে-গ্রীষ্মে নটবরের একটাই পোশাক। গায়ে হাতাওয়ালা একটা গেঞ্জি আর পরনে হেঁটো ধুতি। দোকানে গিজগিজ করছে খদ্দেরের ভিড়। নটবর ঝাঁঝরি হাতায় রস ঝেড়ে বোঁদে তুলে বারকোশে রাখছিল। তারই ফাঁকে পকেটমারির বৃত্তান্তটা শুনে একটা ফঁৎ করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ, মাত্র বত্রিশ টাকা পকেটমারি হয়েছে বলে সাতকাহন করে বলতে এয়েছ! এ যে বড় ঘেন্নার কথা হল বাপু! পকেটমারের তো মেহনতেও পোষায়নি। বরং তাকে খুঁজে বের করে তার হাতে আরও শতখানেক টাকা গুঁজে দিয়ে মাপ চেয়ে নাও গে যাও!”

“সেরকমই ইচ্ছে নটবরদাদা! আর সেই জন্যই তার তল্লাশে তোমার কাছে আসা।”

নটবর বিরস মুখে বিরক্ত হয়ে বলল, “শোনো কথা! পকেটমারের তল্লাশে বাবু এয়েছে আমার কাছে? কেন রে বাপু। আমি কি চোর-চোট্টাদের ইজারা নিয়ে বসে আছি? কথাটা পাঁচকান হলে ভদ্রলোকেরা আর এ দোকানে পা দেবে ভেবেছ?”

তটস্থ হয়ে গুরুপদ বলল, “কথাটা ওভাবে বলা নয় নটবরদাদা। বলছিলাম কী, মদনপুরের হাটে এমন মানুষ নেই, যে তোমাকে খাতির করে না। কে কোন মতলবে ঘুরে বেড়ায় তা তোমার চেয়ে ভাল আর কে জানে?”

নটবর আড়চোখে চেয়ে বলল, “তা তাকে ধরতে পারলে কি থানা-পুলিশ করবে নাকি? তা হলে বাপু, আমি ওর মধ্যে নেই।”

জিভ কেটে গুরুপদ বলল, “আরে না না। থানা-পুলিশের কথাই উঠছে না। ছোঁকরার হাত বড় সাফ। তাই ভাবছিলাম, তাকে পেলে একটু পায়ের ধুলো নিতুম।”

নটবর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “ওসব গাঁটকাটা পকেটমারদের খবর বটু সর্দারের কাছে পাবে, আমার কাছে নয়। এখন বিদেয় হও।”

“কিন্তু দাদা, বটু সর্দারকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

“তার আমি কী জানি! নামটা হাটের মধ্যে ছড়াতে ছড়াতে যাও, দ্যাখো যদি লেগে যায়।”

গুরুপদ বুঝল, নটবরের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি খবর আদায় হবে না। তা এই খবরটুকুও বড় কম নয়। বটু সর্দার তার লাইনের কেউকেটাই হবে। আর কেউকেটাকে খুঁজে বের করা খুব শক্ত নয়।

তবে মদনপুরের হাটে আহাম্মকেরও অভাব নেই। প্রথম যে লোকটাকে গুরুপদ পাকড়াও করল, তার বেশ রাঙামুলো চেহারা, নাদুসনুদুস, ঘাড়ে একটা বস্তা। বটু সর্দারের নাম শুনে একগাল হেসে বলল, “বটুক মুন্সিকে খুঁজছ তো? ওই তো বটতলায় বসে তোলার পয়সা গুনছেন। পরনে সবুজ চেক লুঙি, গায়ে হলুদরঙা ভাগলপুরি চাঁদর।”

দ্বিতীয় লোকটা সিঁড়িঙ্গে চেহারা। একটু বাবুগোছের। পরনে শান্তিপুরি ধুতি, গায়ে গরদের পাঞ্জাবি। নাক সিঁটকে বলল, “বটু সর্দার, দূর মশাই, এ তো কোনও ভদ্রলোকের নামই নয়।”

গুরুপদ ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, ভ ভদ্রলোক ননও। তবে গুণী লোক।”

লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “গুণী লোক! মদনপুরের হাটে গুণী লোক ঘাপটি মেরে আছে আর আমি তার খবর জানি না? তা তোমার বটু সর্দারের গুণটা কীসের? ব্যায়ামবীর না মাদারি, হালুইকর না তবলচি, কবিয়াল না দাঁতের ডাক্তার?”

গুরুপদ থতমত খেয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটা ঠিক জানা নেই। তবে গুণী বলেই শোনা ছিল।”

“দূর দূর! শোনা কথায় কান দিয়ো না হে! মদনপুরের হাটে গুণী মানুষ সাকুল্যে তিনজন। হেয়ার কাটিং-এর ফটিক শীল, রসবড়ার কারিগর বিরিঞ্চিপদ পান্ডা আর গনতকার গণেশ গায়েন। বুঝলে?”

গুরুপদ ফাঁপড়ে পড়ল। বলতে নেই, মদনপুরের হাট আড়ে দিঘে বিরাট চত্বর। হাজারও মানুষ গিজগিজ করছে। তল্লাটে এত জমজমাট হাট আর নেই। এখানে বটু সর্দারকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

“ছেলে হারিয়েছে বুঝি?” বলে ভুইফোড় একটা লোক ভারী হাসি-হাসি মুখ করে পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। ছোঁকরা বয়স, পরনে কালো পাতলুন আর চকরাবকরা জামা, বাবরি চুল আর সরু গোঁফ।

গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে বুঝলেন?”

“ও আমরা মুখ দেখেই বুঝি। ফি হাটবারে এই মদনপুরে না হোক দশ-বিশটা ছেলে-মেয়ে হারায়। মেহনত করে আমরাই তাদের খুঁজে দিই কিনা! ওই তো আমাদের অফিসের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, ‘সন্ধানী’। রেটও খুব সস্তা, ছেলেপ্রতি দু’শো টাকা। ছেলের নামধাম, বিবরণ লিখিয়ে একশো টাকা আগাম ফেলে রসিদ পকেটে পুরে নিশ্চিন্তে হাটবাজার করতে থাকুন। দু’ঘণ্টা বাদে আমাদের অফিসে এলেই ছেলে পেয়ে যাবেন।”

“বটে! বাঃ বাঃ, এ তো খুব ভাল ব্যবস্থা!”

“তা আপনার ছেলের নাম কী? বয়স কত? গায়ের রং? হাইট? কোথাও কাটা দাগ বা জডুল আছে কি?”

“ইয়ে, একটা মুশকিল হয়েছে।”

“কী মুশকিল মশাই?”

“আমিও একজনকে খুঁজছি বটে, তবে তার হাইট, বয়স বা জডুলের কথা জানা নেই কিনা!”

“সে কী মশাই? বাপ হয়ে নিজের ছেলের নাম জানেন না?”

“আহা, তা জানব না কেন? ছেলে হলে তবে তো নাম! আর ছেলে হওয়ার আগেও তো কিছু বখেরা থাকে, তাই না? তা আমার যে সেটাও হয়নি?”

“তার মানে?”

“এই বিয়ের কথাই বলছিলাম আর কী! আমার সেটাও হয়ে ওঠেনি কিনা!”

“আহা, সেটা আগে বলবেন তো! তা হলে আপনার হারিয়েছে। কে?”

“তার নাম বটু সর্দার।”

“এই তো মুশকিলে ফেললেন। শুধু নাম দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা ডবল খাটুনির কাজ। ঠিক আছে, আগামটা দিয়ে যান, দেখছি।”

“ওটাও পেরে উঠছি না। একটু আগেই আমার পকেটমার হয়েছে।”

লোকটা কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “যত্ত সব!” তারপর হনহন করে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। কয়েক পা হেঁটেই দাঁড়াতে হল গুরুপদকে। একটা প্রাণকাড়া গন্ধে ভারী উচাটন হয়ে উঠল সে। কাছেপিঠেই কোথায় যেন ফুলুরি-বেগুনি ভাজা হচ্ছে। তটস্থ হয়ে চারদিকে চেয়েই সে ভিড়টা দেখতে পেল। গন্ধটা যেন বাতাসকে একেবারে রসস্থ করে ফেলেছে। সম্মোহিতের মতো গিয়ে ভিড়ের পিছন দিকটায় দাঁড়িয়ে প্রাণভরে গন্ধটা নিল সে। পকেটে পয়সা না থাকলে দুঃখের জল যে কোথা থেকে কোথায় গড়াতে পারে, তা আজ হাড়ে-হাড়ে বুঝল সে। পণ্ডিতরা বলেছেন বটে যে, ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যায়। কিন্তু গুরুপদর মনে হল, কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়। এই তো সে গন্ধে গন্ধে বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলল, কিন্তু কই, পেটটা অর্ধেক ভরেছে বলে তো মনে হচ্ছে না! বরং খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়েই উঠতে চাইছে।

“শিবপদ যে!” বলে গোলগাল, বেঁটে আহ্লাদি চেহারার একটা প্যান্ট আর ডোরাকাটা জামাপরা লোক ভারী হাসি হাসি মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

গুরুপদ বলল, “আমি শিবপদ নই।”

“নও? শিবপদর মতোই যেন লাগল!”

“আপনার চোখের ভুল।”

“তা হবে।” বলে লোকটা বিদেয় হল।

কিন্তু একটু বাদেই চোখে ঘষাকাঁচের চশমা, পায়জামা আর হলুদ পাঞ্জাবি পরা খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা পাকানো চেহারার একটা লোক তার মুখে একটা জর্দা পানের শ্বাস ফেলে বলল, “নব নাকি রে?”

বিরক্ত গুরুপদ একটু রাগের গলায় বলল, “দিলেন তো অমন তেলেভাজার গন্ধটাকে জর্দার গন্ধ দিয়ে গুলিয়ে! আমি নব নই।”

“নও? তা আগে বলতে হয়!” বলে লোকটা ল্যাকপ্যাক করে চলে গেল।

তেলেভাজার খদ্দেরের ভিড় থেকে একটা ছিপছিপে ফরসামতো ছোঁকরা একটা শালপাতার ঠোঙা হাতে বেরিয়ে এসে তার দিকে চেয়ে বলল, “আরে মশাই, যান যান, তাড়াতাড়ি লাইনে ঢুকে পড়ুন। জিনিস শেষ হয়ে আসছে যে!”

গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না হে ভায়া, পকেটে পয়সা নেই।”

ছোঁকরা চটপটে পায়ে চলে যেতে যেতে বলল, “আহা, খুঁজে পেতে দেখুন না, কত সময়ে পাওয়াও তো যায়!”

গুরুপদ বিমর্ষ হয়ে ছোঁকরার গমনপথের দিকে চেয়ে ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য পকেটে একটু হাত বোলাতে গেল। আর তখনই ভারী অবাক হয়ে টের পেল, তার বুকপকেটে ভাঁজ করা কাগজের মতো কী যেন। সঙ্গে দুটো চাকতিও যেন আঙুলে লাগল। পকেট থেকে জিনিসগুলো বের করে তার মুখ একগাল মাছি। তিনটে দশ টাকার নোট আর দুটো এক টাকার কয়েন! মোট বত্রিশ টাকা। এই টাকাই তো ছিল তার পকেটে? কখন, কীভাবে ফেরত এল রে বাবা? এরকমও কি হয় নাকি? গুরুপদ হাঁ করে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। তা হলে কি তার আদৌ পকেটমার হয়নি?

কিন্তু তাই বা কী করে হয়? টাকাটা তার বুকপকেটেই ছিল বটে, কিন্তু গত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সে অন্তত বাইশবার তার জামার তিনটে পকেটই তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। এমন তো নয় যে, টাকাগুলো একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে!

হঠাৎ বাঘ-ডাকা একখানা কণ্ঠস্বর তার কান ঘেঁষেই গর্জন করে উঠল, “পথ হারিয়ে ফেলেছিস রে দুরাত্মা? সংসারের পেঁজরাপোলে ঘুরে ঘুরে মরছিস রে মায়াবদ্ধ জীব? এখনও পথের সন্ধান পেলি না রে পাপী? এখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে শুধু ভেবে যাচ্ছিস? ওরে, চলতে শুরু কর, চলতে শুরু কর! আর দেরি করিসনি। সময় যে কচুপাতায় বৃষ্টির ফোঁটা রে! কেতরে পড়েছিস কি গড়িয়ে গেলি!”

গুরুপদ সবিস্ময়ে দেখল, সামনে দাড়ি-গোঁফওয়ালা, জটাজুটধারী, রক্তাম্বর পরা পেল্লায় চেহারার এক সাধু দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একখানা বিভীষণ চেহারার সিঁদুর লেপটানো শূল আর কমণ্ডলু। দেখলে ভয়-ভক্তি দুটোই হওয়ার কথা। কিন্তু গুরুপদর মাথায় অবাক ভাবটা এখনও রয়েছে বলে কোনওটাই তেমন হল না। তবে একটু সচকিত হয়ে বলল, “পথ হারিয়ে ফেলিনি তো বাবাজি, তবে পথ একটা খুঁজছি বটে!”

সাধু হুংকার দিয়ে বলল, “পথ খুঁজবি কী রে? তোর সামনেই তো সোজাপথ! এগিয়ে যা, এগিয়ে যা! পঞ্চাশ কদম এগোলেই দেখবি, তোর অভীষ্ট ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভাল চাস তো আর গোলকধাঁধায় ঘুরিস না। সাধুসেবায় দশটা টাকা ফেলে দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে চল দেখি!”

ভারী ধন্ধে পড়ে গেল গুরুপদ। সাধুটা ভণ্ড কি না কে জানে? তবে কথার মধ্যে একটা সংকেত নেই তো? সোজা পঞ্চাশ পা এগোলেই কি বটু সর্দারের ঠেক? কে জানে, হতেও তো পারে।

সে পকেট থেকে দোনোমোনো করে একটা দশ টাকার নোট বের করেছে কি করেনি, সাধুবাবা সট করে এমন কায়দায় সেটা তুলে নিল যে, গুরুপদ প্রায় টেরই পেল না! মনে হল, নোটটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

সাধু তেমনি সপ্তমে গলা তুলে বলল, “যা ব্যাটা যা! তোর মুক্তিই হয়ে গেল ধরে নে।”

সাধু বিদেয় হলে গুরুপদ ভিড় ঠেলে গুনে গুনে পঞ্চাশ পা এগিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যার কোনও সুরাহা হল না। বাঁ ধারে একটা কাঁচের চুড়ির দোকানে রাজ্যের মেয়ের ভিড়। ডান ধারে পাইকারি সবজিবাজারের চেঁচামেচি। এই হট্টমেলায় কোথায় বটু সর্দারকে পাওয়া যাবে?

তবে পঞ্চাশ পা কথাটাও একটু গোলমেলে। সকলের পা তো সমান মাপের নয়। কেউ লম্বা পায়ে হাঁটে, কেউ গুটিগুটি। আর পঞ্চাশ বললেই কি আর টায়েটিকে পঞ্চাশ! দু-চার পা এদিক-ওদিক হতেই পারে। তাই সে একটু এগিয়ে এবং একটু পিছিয়ে বারকয়েক চারদিকটা জরিপ করল। তেমন সুবিধে হল না। সামনে হাওয়া বন্দুকের দোকানে বেলুন ফাটানোর হুড়োহুড়ি, কাঠিবরফওলার হাঁকডাক, আর পিছনে খোলভুসির আড়ত আর ছাপাশাড়ির স্টল। রহস্যময় কিছুই নেই।

কোনও কাজ আটকে গেলে গুরুপদর বড় অসোয়াস্তি হয়। তাই সে একটু হতাশ আর একটু ভাবিত হয়ে চারদিকে টালুমালু করে চাইছিল। হঠাৎ লুঙি আর ফতুয়াপরা রোগামতো ধূর্ত চেহারার একটা লোক তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, “তোমার মতলবখানা কী বলো তো বাপু? অ্যাঁ! মতলখানা কী?”

গুরুপদ তটস্থ হয়ে বলল, “আজ্ঞে, মতলব কিছু নেই। চারদিকটা দেখছি আর কী!”

“উঁহু। অত সোজা মানুষ বলে তো তোমাকে মনে হচ্ছে না! গতিবিধি অত্যন্ত সন্দেহজনক! একবার এগোেচ্ছ, একবার পিছোচ্ছ। চোখ চরকির মতো চারদিকে ঘুরছে। শিয়ালের মতো হাবভাব। তুমি তো মোটেই সুবিধের লোক নও বাপু! অনেকক্ষণ ধরে আড়ে আড়ে তোমাকে চোখে চোখে রেখেছি। আসল কথাটা খুলে বলল তো বাপু! তুমি নির্ঘাত বেজা মল্লিকের চর!”

গুরুপদর মুখ একগাল মাছি। কস্মিনকালে বেজা মল্লিকের নাম শোনেনি। অবাক হয়ে বলল, “বেজা মল্লিক কে মশাই?”

লোকটা একটু মিচকে শয়তানি হাসি হেসে বলল, “আর ভালমানুষ সাজতে হবে না হে! তোমাকে দেখেই চিনেছি। এই মনোময় মান্নার চোখে ধুলো দেবে তেমন শর্মা এখনও জন্মায়নি, বুঝলে?”

গুরুপদ ভয় খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “এ তো বড় মুশকিলেই পড়া গেল মশাই! আমি হলুম গে গোপালহাটির গুরুপদ রায়। কস্মিনকালেও বেজা মল্লিক নামে কাউকে চিনি না। কেন ঝুটমুট ঝামেলা করছেন বলুন তো?”

“ঝামেলার এখনই কী দেখলে? সোজা কথায় যে কাজ হবে না তা আমি আগেই জানতুম। তাই আমার শাগরেদরাও তৈরি হয়ে আছে। একডাকে লহমায় এসে ঘিরে ফেলবে। ঝামেলা তো শুরু হবে তখন।”

গুরুপদ একেবারে অকূলপাথারে পড়ে গেল। জল যে এতদূর গড়াবে কে জানত? শুকনো গলায় সে বিড়বিড় করে বলল, “বটু সর্দারের খোঁজ করতে এসে তো আচ্ছা বিপদেই পড়া গেল দেখছি?”

মনোময় মান্না যেন হঠাৎ ছ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখ গোল গোল করে তার দিকে চেয়ে বলল, “কে? কার নাম বললে হে?”

“সে আপনি চিনবেন না। নমস্য লোক। তার নাম বটু সর্দার।”

সটান দাঁড়িয়ে ছিল মনোময়। এবার হঠাৎ যেন হাঁটু ভেঙে, কোমর ভাঁজ হয়ে একেবারে দ’ হয়ে গেল। গ্যালগ্যালে হেসে গদগদ গলায় বলে উঠল, “বটু সর্দার! ওরে বাবা, আগে বলবে তো! ছিঃ ছিঃ, দ্যাখোদিকি কাণ্ড! কিছু মনে কোরো না বাপু, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছিল!”

গুরুপদ ভদ্রতা করে বলল, “না না, তাতে কী হয়েছে? ভুল তো মানুষের হতেই পারে।”

মনোময় ভারী আপ্যায়িত হয়ে দু’হাত কচলে নরম গলায় বলল, “তা বাপু, তুমি যখন বটু সর্দারের লোক, তখন আমার একটা উপকার করে দিতেই হবে।”

“কীসের উপকার?”

মনোময় একটু হেঃ হেঃ করে নিয়ে বলল, “আমার ভাইপোটা পাশটাস করে বসে আছে, কিন্তু কাজকর্মে তেমন সুবিধে করে উঠতে পারছে না। তার খুব ইচ্ছে, বটু সর্দারের আখড়ায় গিয়ে একটু হাতের কাজ শিখে রোজগারে নেমে পড়ে। তা বটুর আখড়ায় তো শুনি বিদ্যের সমুদুর। পকেটমারি, ছিনতাই, কেপমারি, চুরি, ডাকাতি, ভোলাবাজি, ভাড়াটে খুন, কিডন্যাপিং, সবই শেখানো হয়। ওখান থেকে যারা পাশটাস করে বেরোয় তারা কেউ বসে নেই। কিন্তু বটুর আখড়ায় ঢোকা বড় শক্ত। অ্যাডমিশন টেস্ট আছে, ফিজিক্যাল ফিটনেস আছে, আই কিউ পরীক্ষা আছে। তা দেবে বাপু একটা ব্যবস্থা করে? বড় উপকার হয় তা হলে। এই তো কাছেই মগরাহাটিতে তার ঠেক, বড়জোর মাইলটাক হবে। বলো তো তোমার সঙ্গে গিয়ে আজই পাকা কথা সেরে আগাম দিয়ে যাই?”

গুরুপদ একটু থতমত খেয়ে গেল। এত ব্যাপার তো তার জানা ছিল না। তবে চট করে সামলে নিয়ে বলল, “সেই উপায় নেই মশাই। আমি এখন ডিউটিতে আছি।”

খপ করে তার হাত দুখানা ধরে মনোময় বলল, “আমার ভাইপোটার একটা ব্যবস্থা তোমাকে করে দিতেই হবে বাপু। তার ঝোঁকটা তোলাবাজির দিকেই। দিব্যি ভাল ব্যাবসা। এক পয়সা লগ্নি নেই, টহল দিয়ে বেড়াও আর টাকা তোলো।”

শুনে গুরুপদর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! সে আমতা-আমতা করে বলল, “হ্যাঁ, তাই বা মন্দ কী? তবে আপনার নিজের ভাইপো বলেই বলছি, ওসব লাইনে ভাইপোকে নামানো কি ভাল?”

মনোময় চোখ কপালে তুলে বলল, “ভাল নয় মানে? বটু সর্দারের নাম তো লোকের মুখে-মুখে। এই তো নিশিগঞ্জের গোপাল দাস মাত্র দু’বছর আগে পাশ করে বেরিয়ে কুঁড়েঘর ভেঙে রাতারাতি তিনতলা বাড়ি তুলে ফেলল। ছিনতাইয়ের হাত এত ভাল, গলার হার বা কানের দুল এমন কায়দায় তুলে নেবে যে, কেউ টেরটিও পাবে না। নসিপুরে হাবু গুন্ডার কথাই ধরো না কেন। শুধু মস্তানি করে কোন মন্ত্রীর শাগরেদ হয়ে এখন লাখ টাকা কামাচ্ছে। বিদ্যাপুরের ফেন্টুকে চেনো? গাঁট আর পকেট কেটে তার এখন মারুতি গাড়ি। পিরতলার ভৈরব মণ্ডলের নাম তো খুব শুনে থাকবে। চারটে ব্যাংক লুট করে এত টাকা হাতে এল যে, রাখার জায়গা নেই। শেষে দুধেল গোরুটা বেচে দিয়ে গোয়ালঘরে গাদা করে টাকা রাখতে হয়েছে।”

গুরুপদর চোখ গোল থেকে আরও গোল হচ্ছিল। বটু সর্দারের তালিমের যে এত গুণ তা কে জানত? সে এক পা দু পা করে পিছু হটছিল। আমতা-আমতা করে বলল, “তা বটে। তবে কিনা…!”

মনোময় খুব আপ্যায়নের হাসি হেসে বলল, “অবিশ্যি তোমাকে এসব বলার মানেই হয় না। এ যেন মায়ের কাছে মাসির গপ্পো। তুমি নিজেই তো বটু সর্দারের নিজের হাতে তৈরি জিনিস! তা বাপু, তোমার হাতযশটা কীসে বলো তো?”

গুরুপদ ঘাবড়ে গেলেও কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, “সে বলার মতো কিছু নয়। ওই একটু-আধটু হাতের কাজ শিখেছি আর কী।”

“আহা, তোমার বিনয়ের ভাবখানা দেখে বড় ভাল লাগল বাপু! নিজের গুণের কথা কি আর নিজের মুখে ফেঁদে বলা যায়? তবে তোমাকে দেখেই কিন্তু ঠিক চিনে নিয়েছি। একটু হাবাগোবা ভালমানুষের মতো চেহারাখানা বটে, কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারোনি। ভাব দেখেই মনে হয়েছিল, এ একেবারে তৈরি জিনিস। হেঃ হেঃ, ঠিক কি না?”

গুরুপদ একটু আঁতকে উঠে আর্তনাদের গলায় বলল, “আজ্ঞে, না, অতটা নয়।” মনোময় ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “না বললে শুনছে কে হে? দাঁড়াও, অত বড় মানুষের চেলা তুমি, পাঁচজনকে ডেকে একটু দেখাই। সবাই চিনে রাখুক তোমাকে।”

বলেই মনোময় পিছু ফিরে টারজানের মতো মুখের দু’পাশে দু’ হাত চোঙার মতো করে, “ওরে শিবু, ও ষষ্ঠীপদ, ওরে মান্তু, ট্যাপা, গিরিজা, ধেয়ে আয় রে, ছুট্টে আয়। দেখে যা কাকে পাকড়াও করেছি…!”

ষন্ডা চেহারার ছ’-সাতজন ছেলে-ছোঁকরা ধেয়ে-পেয়ে আসছিল।

গুরুপদ ঠিক বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা কী হচ্ছে? ঠিক এই সময় তার ডান হাতে একটা হ্যাঁচকা টান পড়ল। কে যেন তাকে প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, “পালাও! পালাও?”

হাটের গিজগিজে ভিড়ের ভিতর দিয়ে দিব্যি ফঁক-ফোকর গলে একটা মাঝবয়সি লোক তার নড়া ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গুরুপদ একবার “করেন কী! করেন কী!” বলে আপত্তি জানিয়েছিল বটে! কিন্তু লোকটা একটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপচাপ ছুটতে থাকো। কোনও কথা নয়।” পিছনে কারা যেন রে রে করে তেড়ে আসছে বলেও টের পেল সে। গুরুপদর আর আপত্তি হল না।

লোকটা লহমায় তাকে দু’ সার দোকানঘর পেরিয়ে একটা খড়ের গাদার পিছনে এনে দাঁড় করাল। গুরুপদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এটা কী হল?”

লোকটার পরনে একটা মালকোঁচা মারা আট করে পরা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা মেটে রঙের ফতুয়া। মাথায় ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল, খুঁড়ো গোঁফ আর গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বেশ হাড়ে-মাসে পোক্ত চেহারা। জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে ছিল। ভারী অবাক গলায় বলল, “কিছু খারাপ করলুম নাকি?”

গুরুপদ বলল, “খারাপ করলেন না? একটা লোকের সঙ্গে দুটো কাজের কথা হচ্ছিল, কোথা থেকে চেনা নেই, জানা নেই, বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ এসে নড়া ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে হিড়হিড় করে টেনে আনলেন যে বড়? কাজটা কি ভাল হল মশাই?”

লোকটা মিনমিন করে বলল, “আহা, অত ভেবেচিন্তে কি কাজ করা যায়? আমার বাপু মাথাটা আজকাল তেমন খেলে না। হঠাৎ তোমাকে ওই লোকটার সঙ্গে দেখে মনে হল, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। তাই একটু টানা-হাচড়া করতে হল বাপু। কিছু মনে কোরো না।”

“তা হঠাৎ ওরকম কাণ্ড করার ইচ্ছে হল কেন আপনার? পাগল নাকি আপনি?”

লোকটা মাথা চুলকে ভারী ভাবিত হয়ে বলল, “তা আছি বোধ হয় একটু।”

“ওই লোকটাকে কি আপনি চেনেন?”

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না হে বাপু, আজকাল চোখেই কি তেমন দেখি? তিন কুড়ি বয়স পুরতে চলল যে! এখন সব কিছু তেমন ঠিকঠাক ঠাহর হয় না, বুঝলে! তবে আবছা যেন মননা মান্না বলে মনে হচ্ছিল। না-ও হতে পারে। একরকম দেখতে দুটো লোকও তো হয়! আকছারই হচ্ছে।”

“আপনি ঠিকই দেখেছেন। লোকটা মনোময় মান্নাই বটে! তা লোকটা কেমন? পাজি লোক নাকি?”

“ওই দ্যাখো! তাই কি বললুম?”

“মানেটা তো সেরকমই দাঁড়াচ্ছে।”

“ওরে না না, পাজি লোক হতে যারে কোন দুঃখে? সত্যি কথা বলতে কী বাপু, আজকাল আর আমি একটাও পাজি লোক দেখতে পাই না। আগে দু-চারটে চোখে পড়ত বটে। কিন্তু এখন আর তাদের তেমন দেখছি না তো! আচ্ছা, পাজি লোকগুলো সব গেল কোথায় বলতে পারো?”

“পাজি লোকের অভাব কী? চারদিকে তারাই তো গিজগিজ করছে! এই যে আপনি, তা আপনিই কী আর ভাল লোক? নড়া ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মেরেছিলেন যে, বগল অবধি টাটাচ্ছে।”

লোকটা তেমনি জুলজুলে ভিতু চোখে চেয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক। আমি তেমন সুবিধের লোক নইও।”

“পাজি লোকের কথা আরও শুনবেন? এই একটু আগেই এই হাটে গামছা দর করার সময় আমার বত্রিশটা টাকা দিনে-দুপুরে

পকেটমার হয়েছে। তবু বলবেন দুনিয়ায় পাজি লোক নেই?”

লোকটা চোখ কপালে তুলে বলল, “পকেটমার হয়েছে? বলো কী? এ তো সব্বোনেশে কথা!”

“আর সেই পকেটমার নাকি বটু সর্দারের লোক। আর বটু সর্দারের আখড়ায় নাকি ডজন-ডজন চোর, ডাকাত, পকেটমার, ছিনতাই আর তোলাবাজ তৈরি হচ্ছে। তবু পাজি লোক চোখে পড়ছে না আপনার?”

লোকটা ভারী আতান্তরে পড়ে চোখ মিটমিট করে বলল, “ওই তো বললাম, আমার চোখ দুটোই গিয়েছে। আজকাল আর ভালমন্দ তেমন ঠাহর পাই না। তবে বাপু, সত্যিকথা বলতে কী, মন্দ যেমন আছে তেমনি ভালও কি আর নেই? যেমন ধরো, পকেটমার হয়তো কারও টাকা পকেট মারল, আবার তারপর হয়তো সেই টাকা ফেরতও দিয়ে দিল। এমন কি আর হয় না? হতেই পারে। ঠিক কিনা বলো?”

“খুব ঠিক! কিন্তু সেকথা আপনি জানলেন কী করে? পকেটমার যে আমার টাকা ফেরত দিয়েছে, সেকথা তো পকেটমার ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়!”

লোকটা বড় বড় চোখে চেয়ে ভারী অবাক হয়ে বলল, “ফেরত দিয়েছে? বলো কী হে? তা হলে কি সত্যযুগ এসে পড়ল নাকি?”

“আপনি কিন্তু কথা ঘোরাচ্ছেন।”

লোকটা সবেগে মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “ওরে না রে বাবা, না। মেরেকেটে দশ-বারোটা বাকি সম্বল করে এই তিনকুড়ি বয়স পার করলুম। কথাই জানি না মোটে, তা তার আবার ঘোরপ্যাঁচ। পেটে বিদ্যে থাকলে তো কথার মারপ্যাঁচ শিখব রে বাপু! ওই লেখাপড়া জানা বাবুরা কথা দিয়ে বাঘ-সিংগি মারে, আমাদের কি সে জোর আছে?”

“বুঝলুম! আপনি আর ভেঙে বলবেন না তো? তা হলে আমাকেই বলতে হচ্ছে। আমার পকেট কে মেরেছিল জানেন? সে হল…!”

“ওরে চুপ! চুপ! অমন হেঁকে কি ওসব কথা কইতে আছে? মনো মান্না দলবল নিয়ে ঘুরছে যে! কথাটা কানে গেলেই ফস করে

এসে হাতে হাতকড়া পরিয়ে থানায় টেনে নিয়ে যাবে।”

গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “মনোময় মান্না কি পুলিশের লোক নাকি মশাই?”

লোকটা মাথা চুলকে বলল, “সেরকমই তো শুনি। শোনার ভুলও হতে পারে।”

“বুঝেছি।” লোকটা ফের জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে বলল, “তাই বলছিলুম বাপু, টাকাটা যখন ফেরত পেয়েই গিয়েছ, তখন আর দেরি না করে বাড়িমুখো রওনা হয়ে পড়ো। বেলাও পড়ে এল। সন্ধের পর আমি আবার পথঘাট মোটেই ঠাহর করতে পারি না। মগরাহাটি তো আর চাট্টিখানি পথ নয়!”

“মগরাহাটি? আপনি কি মগরাহাটির লোক?”

“তিনকুড়ি বছর ধরে তাই তো জেনে আসছি!”

“তা হলে তো বটু সর্দারকে নিশ্চয়ই চেনেন? তার আখড়া যে ওখানেই?”

“হতে পারে! মগরাহাটি বিরাট জায়গা, মেলা লোকের বাস। আমি কি আর সবাইকে চিনে বসে আছি নাকি?”

“শুনেছি, সেখানে তার বিরাট আখড়া! গন্ডায়-গন্ডায় চোর ডাকাত, পকেটমার, তোলাবাজ তৈরি হচ্ছে।”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, “সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।”

“কিছু বললেন?”

“না, এই বলছিলুম যে, বটু সর্দারের সঙ্গে তোমার দরকারটা কীসের?”

“দরকার তেমন কিছু নয়। শুনেছি গুণী মানুষ, একটু পায়ের ধুলো নিয়ে যেতুম।”

“আহা, তার জন্য অত দূরে যাওয়ার দরকার কী? এখানেই সেরে ফেললে হয়!”

গুরুপদ হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভারী অবাক গলায় বলল, “আপনিই বটু সর্দার নাকি? তা আপনাকে তো তেমন সাংঘাতিক লোক বলে মনে হচ্ছে না? দেখে তো ভয়ই লাগছে না মশাই!”

লোকটা একটু জড়সড় হয়ে বলল, “তা কেমন বটু সর্দার তোমার চাই বলো তো?”

গুরুপদ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আহা, শত হলেও বটু সর্দার একজন ডাকসাইটে লোক তো, হাঁকে-ডাকে-প্রতাপে লহমায় চেনা যাবে, তবে না!”

লোকটা মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বলল, “না বাপু, আমার কাছে তেমন বটু সর্দার নেই।”

একটু নাক সিটকে গুরুপদ বলল, “তা আপনাকে তেমন ভক্তিছেদ্দা হচ্ছে না বটে, তবে মানতে হবে যে, আপনার এলেম আছে। টাকাটা এমন মোলায়েম হাতে তুলে নিয়েছিলেন যে, টেরটাও পাইনি। কিন্তু কথাটা হল, টাকাটা ফের ফেরত দিলেন কেন?”

বটু সর্দার উদাস মুখ করে বলল, “টাকা দিয়ে আমার হবেটা কী? আমারটা খাবে কে? তিনকুলে কেউ নেই, চেলাচামুণ্ডা যারা ছিল তারাও লায়েক হয়ে যে যার ধান্দায় নেমে পড়েছে।”

গুরুপদ তাজ্জব হয়ে বলল, “তবে পকেট মারলেন কেন?”

“অভ্যেস রাখতে হয়, অভ্যেস রাখতে হয়। নইলে যে আঙুলে মরচে পড়ে যাবে।”

গুরুপদ একটু দোনোমোনো করে বলল, “পকেটমারিটা আমারও একটু শেখার ইচ্ছে ছিল মশাই! না হয় আপনার কাছেই শিখতাম!”

বটু সর্দার বিরস মুখে ঘনঘন মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “সে উপায় নেই হে। আমার ডঙ্কা বেজে গিয়েছে।”

“তার মানে?”

“আজ, কাল বা পরশুর মধ্যেই আমার খুন হয়ে যাওয়ার কথা। দু’-একদিন এদিক-ওদিক হতে পারে।”

“সে কী! কে খুন করবে আপনাকে?”

“সেইটেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না। দু’-দু’বার তাদের তাক ফসকেছে। তিনবারের বার বড় একটা ফসকায় না।”

উৎকণ্ঠিত গুরুপদ বলল, “তা আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন না কেন?”

“পালানোও কি চাট্টিখানি কথা? মাথা গোঁজার জায়গা দেবে কে? আর দিলেও কি রেহাই আছে বাপু? তারা ঠিক খুঁজে বের করবে।”

“তা হলে পুলিশের কাছে যান।”

বটু সর্দার করুণ একটু হেসে বলল, “তারাও ফঁসিতে ঝোলাবে বলে ওত পেতে আছে যে! জেলখানায় মরা আমার তেমন পছন্দ নয় বাপু। তার চেয়ে মাঠেঘাটে মরা অনেক ভাল। মরতে মরতেও হয়তো আকাশ-টাকাশ দেখা যাবে, একটু পাখির ডাকও কানে আসবে। চাই কি একটু ফুরফুরে বাতাসও এসে লাগবে গায়ে। কী বলো?”

“না না, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। আপনি লোকটা হয়তো তেমন ভাল নন। কিন্তু গুণী লোক তো! এরকম বেঘোরে মরতে দেওয়া যায় না। চলুন, আমাদের বাড়িতে চলুন। আমাদের বাড়িতে মেলা লোক। সেখানে ভয় নেই।”

“পাগল নাকি! আমাকে নিয়ে শেষে বিপদে পড়বে বাপু।”

“হোক বিপদ। আমি ছাড়ছি না আপনাকে।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress