Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অন্ধকারে যখন আংটি চোখ মেলল

অন্ধকারে যখন আংটি চোখ মেলল, তখন তার মাথাটা ঘুমে ভরা। কোথায় শুয়ে আছে সেই বোধটা পর্যন্ত নেই। কিছুক্ষণ ডোম্বলের মতো চেয়ে থাকার পর হঠাৎ সে তড়াক করে উঠে বসল। বিছানার পাশে একটা ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

ভূত যে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। মুখটা ভাল দেখা না গেলেও এরকম শীর্ণকায় এবং লম্বা চেহারা পোক বড় একটা নেই। এই সেই নকল রাজার সেক্রেটরি, যাকে সে এবং তার দাদা ঘড়ি বাসের মধ্যে খুন হতে দেখেছিল।

মারপিট আংটি বিস্তর করেছে, কিন্তু ভূতের সঙ্গে কীভাবে লড়তে হয় তা তার অজানা। তার ওপর তার ভূতের ভয়ও আছে।

সুতরাং আংটি একটা বিকট খ্যাখ্যা শব্দে গলাখাঁকারি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে, কে আপনি?”

লম্বা সিঁড়িঙ্গে ছায়ামূর্তিটা আংটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। পাথরের মতো স্থির। আংটি প্রশ্নের জবাবে একটু ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “তুমি এখানে কী করছ?”

আংটি তোতলাতে লাগল, আ…আমি…..আমি….কিন্তু আ-আপনি তো মরে গিয়েছিলেন!”

লম্বা লোকটা নিজের কোমরে হাত দিয়ে কোনও একটা বোতাম টিপল। আংটি দেখল লোকটার পায়ের দিকে, বোধহয় জুতোয় লাগানো একটা আলো জ্বলে উঠল এবং লোকটাকে বেশ স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। তবে তলার দিক থেকে আলো ফেললে যে-কোনও মানুষকে একটু ভৌতিক-ভৌতিক দেখায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা গায়ে আলো ফিট করা লোক জীবনে দ্যাখেনি আংটি।

সে ফের আমতা-আমতা করে বলল, “আ-আপনি কিন্তু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।”

লোকটা মৃদু ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “এখন দ্যাখো তো, আমি মরে গেছি বলে কি মনে হচ্ছে?”

আংটি দেখল, বাস্তবিকই লোকটার শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। একটু ভূতুড়ে দেখালেও লোকটাকে তার জ্যান্ত বলেই মনে হচ্ছিল। মাথাটা গুলিয়ে গেল আংটির। সে বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি জ্যান্ত মানুষ?”

লোকটা আলো নিবিয়ে দিয়ে বলল, “জ্যান্ত কি না জানি না, তবে ভূত-টুত নই।”

“তা-তার মা-মানে?”

“মানে বললেও তুমি বুঝতে পারবে না। সে কথা থাক। এখন বলো তো, তোমরা দুই ভাই আমাদের কাছে পালিয়ে এলে কেন?”

“আমরা ভেবেছিলাম, আপনারা আমাদের কিডন্যাপ করছেন।”

“কিডন্যাপ কি ওভাবে করে? তোমাদের খেলা দেখে মহারাজ খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি তোমাদের উপকার করতে চেয়েছিলেন। পালিয়ে এসে তোমরা ওঁকে অপমান করেছ।”

দাদা ঘড়ি থাকলে আংটি তেমন ভয় পায় না। কিন্তু একা বলেই তার বেশ ভয়-ভয় করছিল। সে কঁপা কাঁপা গলায় বলল, “উনি যে আমাদের উপকার করতে চেয়েছিলেন তা আমরা বুঝতে পারিনি।”

‘তা না হয় পারেনি, কিন্তু তোমরা ওঁকে মারারও চেষ্টা করেছ। আজ অবধি ওঁর গায়ে হাত তুলে কেউ রেহাই পায়নি।”

আংটি তাড়াতাড়ি বলল, “আমি সেজন্য মাপ চাইছি।”

“মাপ স্বয়ং মহারাজের কাছেই চাওয়া উচিত। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার সঙ্গে এসো।”

আংটি অবাক হয়ে বলল, “উনি কি এখানে আছেন?”

“আছেন বই কী।”

আংটি চারদিকে একবার চেয়ে নিল। দাদা ঘড়ি সঙ্গে নেই, সে একা। এই অবস্থায় আবার এদের খপ্পরে পড়লে রেহাই পাওয়া অসম্ভব হবে। সুতরাং পালাতে হলে এই বেলাই পালানো দরকার। সিঁড়িঙ্গে লোকটা বোধহয় দৌড়ে তার সঙ্গে পেরে উঠবে না। পারলে জঙ্গলের মধ্যেই তাদের তাড়া করত।

আংটি যখন এসব ভাবতে-ভাবতে গড়িমসি করছে, তখন লোকটা বলল, “পালানোর কথা ভাবছ?”

আংটি আমতা-আমতা করে বলল, “তা নয় ঠিক।”

“পালালে আমরা কিছুই করব না। যখন আগেরবার পালিয়েছিলে তখন আমরা অনায়াসেই তোমাদের ধরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু মহারাজের সেরকম ইচ্ছে নয়। তাই তোমাদের পালাতে দেখেও আমরা কিছুই করিনি এবারও করব না।

আংটি ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু সেবার আপনি আমাদের পিছু নিয়েছিলেন। বাসের মধ্যে আপনাকে কে যেন গুলি করেছিল।”

লোকটা নিরুত্তাপ গলায় বলল, “আমি মোটেই তোমাদের পিছু নিইনি। অন্য একটা জরুরি কাজে মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছিলেন। পথে কে বা কারা আমাকে খুন করার চেষ্টা করে।”

“হ্যাঁ, আপনার বুকে গুলি লেগেছিল।”

‘গুলি নয়। তার চেয়ে অনেক মারাত্মক কিছু। কিন্তু আসল কথা, আমি তোমাদের পিছু নিইনি। আজও নেব না। তোমরা বা তোমাদের কারও কোনও ক্ষতি করা মহারাজের উদ্দেশ্য নয়।”

আংটি এই বিপদের মধ্যে যেন একটু ভরসা পেল। লোকটার কথার মধ্যে একটু সত্যও থাকতে পারে।

সে জিজ্ঞেস করল, “উনি কোথাকার মহারাজ?”

“উনি মহারাজ নামে। ইচ্ছে করলে উনি গোটা দুনিয়াটাই সম্রাট হতে পারেন। কিন্তু তেমন ইচ্ছে তাঁর নেই।”

“আপনার বুকে গুলি লাগা সত্ত্বেও আপনি বেঁচে আছেন কী করে?”

“সে সব মহারাজ জানেন। এ পর্যন্ত আমাকে অনেকবারই খুন করবার চেষ্টা হয়েছে। কোনওবারই মরিনি। একটু আগেই কতগুলো বর্বর আমাকে আক্রমণ করেছিল। এতক্ষণ আমার বেঁচে থাকার কথা নয়। তবু দ্যাখো, দিব্যি বেঁচে আছি।”

কথাগুলো আংটি ভাল বুঝতে পারছিল না। খুব হেঁয়ালির মতো লাগছিল। একটু দুরদুরও করছিল বুক। কিন্তু সে প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। বলল, “মহারাজের কাছে যদি যেতে না চাই, তা হলে সত্যিই উনি কিছু করবেন না?”

‘না। তবে গেলে তোমারই লাভ হবে। অকারণে ভয় পেও না। তোমার। ক্ষতি করতে চাইলে অনায়াসেই করতে পারি। আমার কাছে এমন ওষুধ আছে চোখের পলকে তোমাকে অজ্ঞান করে দেওয়া যায়। এমন অস্ত্র আছে যা দিয়ে। তোমাকে ধুলো করে দেওয়া কিছুই নয়। তবে সেসব আমরা প্রয়োগ করার কথা চিন্তাও করি না।”

আংটি কঁপা গলায় বলল, “ঠিক আছে। মহারাজ কোথায়?”

“আমার সঙ্গে এসো।”

আংটি লোকটার পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

লোকটা কোমরের বোম টিপে জুতোর আলোটা জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেশ ফটফটে আলো। এরকম সুন্দর আলোওলা জুতো আংটি কখনও দ্যাখেনি। জুতোর ডগায় দুটি ছোট হেডলাইটের মতো জিনিস বসানো। আলোটা নীলচে এবং তীব্র।

সিঁড়িঙ্গে লোকটা একটা ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠল। স্কুপের ওপরে একটা ড্রাম এমনি পড়ে আছে।

লোকটা ড্রামটাকে দুহাতে ধরে একটা কঁকুনি দিয়ে তুলে ফেলল। তলায় একটা গর্ত।

লোকটা বলল, “নিশ্চিন্তে নামো। কোনও ভয় নেই।”

আংটি একটু ইতস্তত করল। ভয় করছে বটে, কিন্তু ভয় পেলে লাভ নেই। তাই সে দুর্গা’ বলে গর্তের মধ্যে পা বাড়াল।

না, পড়ে গেল না আংটি। গর্তের মধ্যে থাক-থাক-সিঁড়ি। কয়েক ধাপ নামতেই সড়িঙ্গে লোকটাও গর্তের মুখ বন্ধ করে তার পিছু পিছু নেমে এল।

আংটি দেখল, তলাটা অনেকটা সাবওয়ের মতো। একটু নোংরা আর সরু, এই যা, তবে দেখে মনে হয়, এই সাবওয়ে বহুঁকালের পুরনো। বোধহয় এই বাড়ি যখন তৈরি হয়েছিল তখনই চক-সাহেব এই সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন। আংটি, ঘড়ি এবং তাদের বন্ধুরা বহুবার এ-বাড়িতে এসে চোর-চোর খেলেছে, গুপ্তধনের সন্ধান করেছে। কিন্তু এই সুড়ঙ্গটা কখনও আবিষ্কার করতে পারেনি।

একটু এগোতেই ফের সিঁড়ি। এবার ওপরে ওঠার।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে আংটি যেখানে হাজির হল, সেটা এক বিশাল হলঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এরকম ঘর যে এবাড়িতে থাকতে পারে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না। ঘরে বিজলি বাতির মতো আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু খুব মৃদু। ঘরের একধারে কয়েকটা যন্ত্রপাতি রয়েছে। একটা যন্ত্র থেকে অবিরল নানারকম চি চি, কুঁই কুঁই, টরর টরর শব্দ হচ্ছে।

হলঘরের অন্যপ্রান্তে একটা টেবিলের সামনে বসে একজন লোক অখণ্ড মনোযোগে একটা গ্লোব দেখছে। গ্লোবটা নীল কাঁচের মতো জিনিসে তৈরি। তাতে নানারকম আলো।

লোকটাকে চিনতে মোটেই কষ্ট হল না। মহারাজ। মহারাজ আংটির দিকে তাকালেন।

আংটি ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মহারাজ তাকে দেখে হাসলেন। হাসিটা ভারি সুন্দর। রাগ থাকলে এরকম করে কেউ হাসতে পারে না।

মহারাজ ভরাট গলায় বললেন, “এসো আংটি, তোমার জন্যই বসে আছি।” আংটি এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গেল। মহারাজের ইঙ্গিতে সিঁড়িঙ্গে লোকটা একটা টুল এগিয়ে দিল।

আংটি মুখোমুখি বসতেই মহারাজ বললেন, “তুমি খুব ভয় পেয়েছ বলে মনে হচ্ছে।”

আংটি বলল, “না, এই একটু…..”

মহারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে দুঃখ এই যে, পৃথিবীকে কতগুলো বর্বরের হাত থেকে বাঁচানো বোধহয় সম্ভব হবে না। অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু…….”

বলেই মহারাজ তার গোলকের ওপর ঝুঁকে কী একটা দেখতে লাগলেন।

আংটি কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে রইল। মহারাজ ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি আমার আর্থ মনিটরটা নিয়ে এসো তো।”

সিঁড়িঙ্গে লোকটা দৌড়ে গিয়ে একটা ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্র নিয়ে এল।

২৭.

আর্থ-মনিটর কাকে বলে, তা আংটি জানে না। কিন্তু সে এটা বেশ বুঝতে পারছিল যে, সাধারণ ক্যালকুলেটরের মতো দেখতে হলেও যন্ত্রটা সামান্য নয়। মহারাজ যন্ত্রটা হাতে নিয়েই কী একটু কলকাঠি নাড়লেন, আর সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটার চার কোণ দিয়ে চারটে লিকলিকে অ্যান্টেনা বেরিয়ে এল। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, চারটে অ্যান্টেনাই নড়ন্ত। নিজে থেকেই অ্যান্টেনাগুলো কখনও ওপরে কখনও নীচে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে, আবার সটান সোজা হয়ে যাচ্ছে, ছোট হয়ে যাচ্ছে, আবার গলা বাড়িয়ে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। চারটে ধাতব যষ্টির ওরকম যথেচ্ছ নড়াচড়া দেখে আংটির গা শিরশির করতে থাকে।

মহারাজ যন্ত্রটির দিকে চেয়ে কী দেখছিলেন তিনিই জানেন। শরীরটা পাথরের মতো স্থির, চোখের পলক পড়ছে না। মহারাজকে খুব তীক্ষ্ণ চোখেই লক্ষ্য করছিল আংটি। পরে তার মনে হল, এরকম মানুষ সে কখনও দ্যাখেনি। লোকটা লম্বা চওড়া সন্দেহ নেই, গায়েও বোধহয় অসীম ক্ষমতা। তার চেয়েও বড় কথা, লোকটা যে-সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে তা একমাত্র খুব উঁচুদরের বিজ্ঞানীরাই বোধহয় করে থাকে। টেবিলের ওপর রাখা গোলকটাও লক্ষ্য করল আংটি। গ্লোবের মতো দেখতে হলেও মোটেই গ্লোব নয়। ঠিক যেন আকাশের জ্যান্ত মডেল। তাতে গ্রহ তারা নক্ষত্রপুঞ্জের চলমান ছবি দেখা যাচ্ছে।

মহারাজ ক্যালকুলেটর থেকে মুখ তুলে বললেন, “আংটি, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, জবাব দেবে?”

আংটি ভয়ে সিঁটিয়েই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“যদি তোমাদের এই পৃথিবীকে সৌরজগতের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হলে কী ঘটতে পারে জানো?”

আংটি অবাক হয়ে বলল, “তা হলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।”

মহারাজ মাথাটা ওপরে-নীচে মৃদুভাবে নাড়িয়ে বললেন, “ঠিক তাই। সৌরজগতের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ামাত্রই পৃথিবীর উপরিভাগ যা কিছু আছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। একটা জীবাণু অবধি বেঁচে থাকবে না, তা বলে পৃথিবী নামক ম্যাসটি নষ্ট হবে না। এটাকে যদি অন্য কোনও নক্ষত্রের কক্ষপথে স্থাপন করা হয়, তা হলে আবার এই গ্রহটিকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। আবহমণ্ডল তৈরি করে নতুন বসত গড়ে তোলা কঠিন হবে না।”

আংটি কিছুই না বুঝে চেয়ে রইল। মহারাজ একটু হাসলেন। খুবই বিষণ্ণ আর স্নান দেখাল তাঁর মুখ। মাথাটা। নেড়ে বললেন, “আমি পাকেচক্রে পৃথিবীতে এসে পড়েছি বটে, কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গ্রহটাকে ভালও বেসে ফেলেছি। মনে-মনে ভেবেছি, এই গ্রহটাকে ইচ্ছে করলে কত না সুন্দর করে তোলা যায়।”

মহারাজ যেন আবেগভরে একটু চুপ করে রইলেন।

আংটির গলার স্বর আসছিল না। বেশ একটু কসরত করেই গলায় স্বর ফুটিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথা থেকে এসেছিলেন?’,

মহারাজ মৃদু স্বরে বললেন, “সে আর-এক কাহিনী। পরে কখনও শোনাব। শুধু জেনে রাখো, আমি বিদেশী। বহু কোটি মাইল দূরের আর এক জায়গা থেকে আমি এসেছি।”

আংটি এত অবাক হল যে, হাঁ করে চেয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। মহারাজকে গুলবাজ বলে মনে হলে সে এত অবাক হত না। কিন্তু এ-লোকটার গ্র্যানাইট পাথরের মতে কঠিন মুখ, তীক্ষ্ণ গভীর চোখ এবং হাবভাবে এমন একটা ব্যক্তিত্বের পরিচয় সে পাচ্ছিল যে, অবিশ্বাস্য হলেও তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল। আর বিশ্বাস করছিল বলেই মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল তার।

মহারাজ তার যন্ত্রের দিকে ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আংটির দিকে চেয়ে বললেন, “এসো।”

মহারাজ হলঘরটার আর এক প্রান্তে গিয়ে একটা পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। পিছনে যন্ত্রচালিতের মতো হেঁটে এসে আংটিও দাঁড়াল। মহারাজ পর্দাটা হাত দিয়ে সরাতেই একটা টেলিভিশনের মতো বস্তু দেখা গেল। মহারাজ সুইচ টিপতেই পর্দায় নানারকম আঁকিবুকি হতে লাগল।

আংটি বলল, “এটা কী?”

মহারাজ মৃদুস্বরে বললেন, “কয়েকজন বর্বর কী কাণ্ড ঘটাতে চলেছে তা তোমাকে দেখাচ্ছি।”

মহারাজ একটা নব ঘোরলেন। পর্দায় একটা আবছা দৃশ্য ফুটে উঠল। ঘন কুয়াশার মধ্যে কী যেন একটা লম্বাটে জিনিস। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

মহারাজ বললেন, “এই যে আবছা জিনিসটা দেখছ, এটাও পৃথিবী নয়। বহুদূর থেকে এসেছে।”

“এটা কি মহাকাশযান?”

“হ্যাঁ। খুবই উন্নত ধরনের যন্ত্র। শুধু মহাকাশই পাড়ি দেয় না, আরও অনেক কিছু করে।”

পর্দার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে ছিল আংটি। গল্পে উপন্যাসে সে অন্য গ্রহের উন্নত জীবদের নানা কাণ্ডকারখানার কথা পড়েছে। নিজের চোখে দেখবে তা ভাবেনি। সে স্বপ্ন দেখছে না তো!

পর্দার ছবিটা একটু পরিষ্কার হল। দেখা গেল, বিশাল দৈত্যের আকারের কয়েকটা জীব মহাকাশযানের মস্ত দরজা দিয়ে ওঠানামা করছে। মনে হল তারা কিছু খুচরো জিনিস নামাচ্ছে।

আংটি ভিতু গলায় জিজ্ঞেস করে, “ওরা কারা?”

মহারাজ মৃদু স্বরে বললেন, “ওরা কারা তা আমিও সঠিক জানি না। তবে খুবই উন্নত-বুদ্ধিবিশিষ্ট কিছু বর্বর। বেশ কিছুদিন যাবৎ এরা পৃথিবীতে নানা জায়গায় থানা গেড়ে আছে। সমুদ্রের নীচে, পাহাড়ে, মেরু অঞ্চলে। নানাভাবে এরা পৃথিবীকে পরীক্ষা করে দেখছে।”

“কেন? ওরা কি পৃথিবীর কিছু করবে?”

মহারাজ হেসে বললেন, “শুনলে হয়তো তোমার অবিশ্বাস হবে। আসলে ওরা বোধহয় পৃথিবীকে চুরি করতে চায়।”

“চুরি?”

“ওরা অন্য একটা জগতে থাকে। ওদের বাসও এই তোমাদের সৌরমণ্ডলের মতোই একটি কোনও নক্ষত্রের মণ্ডলে। আমার বিশ্বাস, ওদের মণ্ডলে অনেকগুলো গ্রহ জুড়ে ওরা বসবাস করে। সম্ভবত বাসযোগ্য আরও গ্রহ ওদের দরকার।”

আংটি শিউরে উঠে বলে, “ও বাবা! আমার মাথা ঘুরছে।”

মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, “ তোমাদের বিজ্ঞান যেখানে আছে, সেখান থেকে ভাবলে এসব প্রায় অবিশ্বাস্যই মনে হয় বটে। তবে আমি যা বলছি, তা তুমি অন্তত অবিশ্বাস কোরো না।”

আংটি নিজের মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে।”

মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, “আমার মনে হয় পছন্দমতো একটা গ্রহ খুঁজে বের করতে ওরা মহাকাশে পাড়ি দিয়ে তোমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। নানাভাবে পরীক্ষা করে ওরা বুঝেছে যে, এরকম একটা গ্রহ হলে ওদের ভালই হয়। এখন কাজ হল পৃথিবীকে ঠেলে নিজেদের নক্ষত্রের মণ্ডলে নিয়ে যাওয়া। ওদের পক্ষে তেমন কিছু শক্ত কাজ নয়।”

আংটি আতঙ্কিত হয়ে বলল, “তা হলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা?”

“সৌরমণ্ডল থেকে ছিটকে গেলে পৃথিবীর উপরিভাগের সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। নষ্ট হয়ে যাবে আবহমণ্ডল! দারুণ ঠাণ্ডায় সব জমে পাথর হয়ে যাবে। ওরা ওদের নক্ষত্রমণ্ডলে নিয়ে গিয়ে পৃথিবীতে আবার আবহমণ্ডল তৈরি করবে। আমার বিশ্বাস, ওরা পৃথিবীকে ওদের কৃষি-গ্রহ হিসেবে ব্যবহার করবে। আমাদের নিজেদের মণ্ডলে আমরাও এক-একটা গ্রহকে এক-এক কাজে ব্যবহার করি।”

আংটি সবিস্ময়ে বলে, “তোমাদের ক’টা গ্রহ আছে?”

“একান্নটা। তাতে আমাদের কুলোয় না। কিন্তু তা বলে আমরা মানুষজন গাছপালা-সহ কোনও গ্রহ চুরির কথা ভাবতেও পারি না। ওরা বর্বর বলেই এরকম নৃশংস কাজ করতে পারে।”

“এখন তা হলে কী হবে?”

মহারাজ চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাই ভাবছি। বেশ কিছু দিন আগে আমি একটি দুর্ঘটনায় পড়ে তোমাদের পৃথিবীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই! আমার মহাকাশযান অকেজো হয়ে গেছে, মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে। আমার কাছে এখন তেমন কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই, যা দিয়ে বর্বরদের মোকাবিলা করা যায়।”

আংটি আশান্বিত হয়ে বলল, “কিন্তু আমাদের অ্যাটম বোমা আছে, হাইড্রোজেন বোমা আছে, নাইট্রোজেন বোমা আছে।”

মহারাজ মাথা নেড়ে বললেন, “সেসব আমি জানি। বর্বররাও সব খবর রাখে। তোমাদের কোনও অস্ত্রই কাজে লাগবে না। ওরা সবই সময়মতো অকেজো করে দেবে। পৃথিবীর কোথায় কী আছে, তার সব খবরই ওদের নখদর্পণে। ওরা তোমাদের কোনও সুযোগই দেবে না। আজ ওদের যে মহাকাশযান এসেছে, তাতে কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি আছে। এগুলো ওরা ভূগর্ভে পাঠিয়ে দেবে। ওরা নিজেরা মহাকাশযানে উঠে বেশ কিছু দূরে গিয়ে ভূগর্ভের যন্ত্রকে নির্দেশ পাঠাবে। তারপর কী হবে জানো?”

আংটি সভয়ে বলল, “কী হবে?”

“ওই যন্ত্রগুলোর প্রভাবে পৃথিবী নিজেই কক্ষচ্যুত হয়ে ওদের মহাকাশযানের নির্দেশমতো চলতে শুরু করবে এক নির্বাসযাত্রায়।”

“উরেব্বাস!”

“ভয় পেও না। আমি এখনও আছি। এ-ঘটনা এত সহজে ঘটতে দেব না। তবে তোমাদের সাহায্য চাই।”

২৮.

নাড়ি দেখে পঞ্চানন্দ বুঝল, গজ-পালোয়ানের শরীরটা যতই ফুলে উঠুক তার প্রাণের ভয় নেই। তবে জ্ঞান কখন ফিরবে তা বলা যায় না। গজ’র গা থেকে একটা ভারি মিষ্টি গন্ধ আসছে। লোকটাকে এই জলকাদায় এরকম অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে একটু মায়া হল তার। তাই নিচু হয়ে দু বগলের নীচে হাত দিয়ে প্রাণপণে সে শরীরটা টেনে একটু ওপরে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অত বড় লাশকে নড়ায় কার সাধ্যি? পঞ্চানন্দর গা দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগল, ঘনঘন শ্বাস পড়তে লাগল, কোমর টনটন করতে লাগল বৃথা পরিশ্রমে। আচমকাই পিছন থেকে কে যেন তার কাঁধে দুটো টোকা দিল।

পঞ্চানন্দ চমকে একটা লাফ দিয়ে বলে উঠল, “আমি না, আমি কিছু করিনি।”

অন্ধকারে মৃদু একটু হাসি শোনা গেল! কে যেন বলে উঠল, “তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ওই গোরিলাটা তোমার কে হয়?”

পঞ্চানন্দ ঘড়িকে দেখে একগাল হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ভাল ফুটল না। মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, বললে পেত্যয় যাবে না, ইটি হল গে আমাদের গজ-পালোয়ান। কিন্তু আঙুল ফুলে কী করে যে কলাগাছ হল সেটিই মাথায় আসছে না।”

বলে পঞ্চানন্দ টর্চটা জ্বেলে গজ-পালোয়ানের মুখে আলো ফেলল।

ঘড়ি একটু ঝুঁকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “অবাক কাণ্ড! এ তো গজদাই। দেখছি। বেঁচে আছে নাকি?”

“আছে আজ্ঞে। নাড়ি চলছে, শ্বাস বইছে, কিন্তু একে কি বেঁচে থাকা বলে? তবে সে চিন্তা পরে। আপাতত গজকে জল থেকে তোলা দরকার।”

ঘড়ি ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। ঘটনাটা খুবই বিস্ময়কর। গজ-পালোয়ান এত অল্প সময়ের মধ্যে এরকম পেল্লায় হয়ে উঠল নিশ্চয়ই কোনও কঠিন অসুখে। কিংবা অন্য কোনও রহস্যময় কারণে। ঘড়ি তার হাতে রুমালের পোঁটলাটার দিকে একবার তাকাল। কলের কাঁকড়াবিছেটাকে সে রুমালের ফঁসে আটকে রেখেছে। বিছেটা নড়াচড়া বন্ধ করেছে। তবে মিষ্টি গন্ধটায় এখনও ম ম করছে রুমালটা। ভারি নেশাড়ু গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করে। রুমালটা মাটিতে রেখে সে গজকে তোলার জন্য পঞ্চানন্দর সঙ্গে হাত লাগাল।

কাজটা বড় সহজ হল না। জলকাদায় পা রাখাই দায়। তারপর ওই বিরাট লাশটা টেনে ঢালু বেয়ে তোলা। দুজনেই গলদঘর্ম হয়ে গেল এই শীতের রাতেও।

ডাঙায় তুলে পঞ্চানন্দ আর ঘড়ি ভাল করে গজ-পালোয়ানকে পরীক্ষা করে দেখল। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবে গজ’র গা থেকে সেই ম ম করা মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছিল ঘড়ি। সে গিয়ে তার ফাঁস-দেওয়া রুমালটা ফের শুঁকল। একই গন্ধ।

পঞ্চানন্দ তার দিকেই চেয়ে ছিল। বলল, “কিছু বুঝতে পারলেন?” ঘড়ি মাথা নেড়ে বলল, “বড্ড ধাঁধা ঠেকছে।”

“রুমালটার মধ্যে কী বেঁধে রেখেছেন?”

“একটা সবুজে কাঁকড়াবিছে। আসল নয়। নকলের।”

পঞ্চানন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁ।”

“কিছু বুঝলেন?”

পঞ্চানন্দ দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”

“তা হলে বিজ্ঞের মতো হুঁ বললেন যে?”

পঞ্চানন্দ মৃদু হেসে বলল, “আজ্ঞে আপনি আমাকে খামোখা ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করতে লেগেছেন কেন?”

“আগে কথাটার জবাব দিন।”

পঞ্চানন্দ উদাস গলায় বলল, “হুঁ হাঁ লোকে অমন কত বলে, সবসময়ে কারণ থাকে না।”

“আমার কী মনে হয় জানেন? বাইরে থেকে আপনাকে যাই মনে হোক না কেন আপনি আসলে একটি ঘুঘু লোক।”

পঞ্চানন্দ তেমনি উদাসভাবে বলল, “আজ্ঞে আমার তেমন সুনাম নেইও। সবাই ওরকম সব বলে আমার সম্পর্কে। তা ঘুঘুই বোধহয় আমি। কিন্তু এসব কথা পরেও হতে পারবে। ওদিকে কী একটা যেন কাণ্ড হচ্ছে। ওটাও একটু দেখা দরকার।”

“ফ্লাইং সসার তো! আমরাও ওটাই দেখতে বেরিয়েছিলাম। কোন্‌খানে নামল বলুন তো?”

“বেশি দূর বোধহয় নয়। গজ আপাতত এখানেই থাক। এলাশ তো এখন নড়ানো যাবে না। আমার সঙ্গে আসুন।”

পঞ্চানন্দ চলতে শুরু করল। পিছনে ঘড়ি।

বেশি দূর যেতে হল না। জলার ধারে ঘন ঝোঁপঝাড় ভেদ করে কিছু দূর এগোবার পরই পঞ্চানন্দ দাঁড়িয়ে মাথাটা নামিয়ে ফেলে বলল, “ওই যে। উরে বাবা, এ তো দেখছি রাক্ষস-খোক্কশের বৃত্তান্ত!”

ঘড়িও দেখল। তার মুখে কথা সরল না।

জলার মাঝ বরাবর জলের মধ্যেই একখানা বিশাল চেহারার পটলের মতো বস্তু। দেখতে অনেকটা আদ্যিকালের উড়োজাহাজ জেপলিনের মতো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে বলে এবং শেষ রাতের দিকে কুয়াশা ভেদ করে স্নান একটু জোৎস্নাও দেখা দিয়েছে বলে বস্তুটা দেখা গেল। কিন্তু উড়ন্ত চাকির চেয়েও বিস্ময়কর হল কয়েকজন দানবাকৃতি জীব সেই মহাকাশযান থেকে কী যেন সব বড়-বড় যন্ত্রপাতি নামাচ্ছে।

পঞ্চানন্দ, চাপা গলায় বলল, “কিছু বুঝলেন?”

“না। এরা কারা?”

পঞ্চানন্দ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “এদের আমি আগেও দেখেছি। শিবুবাবুর ল্যাবরেটরি থেকে এরাই গজকে ধরে নিয়ে যায়। খুব সুবিধের লোক বোধহয় এরা নয়। গজও ছিল না।”

“তার মানে? গজদা আবার কী করেছে?”

“সে লম্বা গল্প। শুধু বলে রাখি, গজ এখানে এসে থানা গেড়েছিল একটা মতলবে’ সে মতলব হাসিল হয়েছে কি না জানি না। যদি হয়েও থাকে বেচারা কর্মফলে ফেঁসে গেছে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না।”

“এরা গজদাকে দাদুর ল্যাবরেটরি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা আপনি জানলেন কী করে? গজদাই বা ওখানে কী করছিল?”

“ফের এক লম্বা গল্পের ফেরে ফেললেন। এখন অত কথার সময় নেই। তবে ঘটনাটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আপনার দাদুর ল্যাবরেটরিতে সে প্রায়ই ঢুকত। তবে লুকিয়েচুরিয়ে। এবার ঢুকেছিল ন্যাড়াবাবুকে বলে। কিন্তু বেচারার কপালটাই খারাপ।”

“দাদুর ল্যাবরেটরিতে কী আছে?”

“তার আমি কি জানি! আমি মুখ লোক, তিনি পণ্ডিত।” আপনি অনেক কিছুই জানেন। ঘুঘু লোক।”

মাথা চুলকে পঞ্চানন্দ বলল, “আমি একরকম তার হাতেই মানুষ তো। তাই একটু-আধটু জানি বইকী! তবে বেশি নয়।”

ঘড়ি একটু হেসে বলল, “আপনি মোটেই আমার দাদুর হাতে মানুষ নন। আমার সন্দেহ হয় আপনি তাঁকে চিনতেনই না।”

“শিবু হালদার মশাইকে কে না চেনে! প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি।”

“নামে কেউ কেউ চিনতে পারে। কিন্তু আপনি সেরকম লোক নন।”

“আচ্ছা সে-তর্ক পরে হবে’খন। এখন সামনে যা হচ্ছে তার কী করবেন?”

ঘড়ি মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“কিছু কিন্তু করা উচিত। এই দানবগুলোর মতলব ভাল নয়।” কার্যত অবশ্য কে কী করবে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল।

.

পঞ্চানন্দ লোকটার ওপর হরিবাবুর বেশ আস্থা এসে গেছে। কাজের লোক। হাতে রাখলে মেলা উপকার হবে।

হরিবাবু আজ প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কবিতা লিখে বায়ু এমন চড়িয়ে ফেলেছেন। যে ঘুম আর আসছে না। ঘরময় পায়চারি করে করে পায়ে ব্যথা হয়ে গেল।

হঠাৎ তার মনে হল, ঘরে হাঁটাহাঁটি না করে প্রাতঃভ্রমণ করে এলে কেমন হয়? প্রাতঃকাল অবশ্য এখনও হয়নি। কিন্তু ভ্রমণ করতে করতে একসময়ে প্রাতঃকাল হবেই। না হয়ে যাবে কোথায়? তা ছাড়া বাইরে এখন বেশ পরিষ্কার বাতাস বইছে, ভাবটাব এসে যেতে পারে। চাই কী নিশুত রাতের ওপর এক খানা কবিতা নামিয়ে ফেলতে পারবেন।

হরিবাবু আর দেরি করলেন না। গা ঢেকে বাঁদুরে টুপি পরে, মোজা জুতো পায়ে দিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। তাঁর মনের মধ্যে কয়েকটা শব্দ ভ্রমরের মতো গুনগুন করছিল। “ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ, ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ।” প্রথমটায় কথাগুলোকে তার একটা না-লেখা কবিতার লাইন বলে মনে হচ্ছিল। ক্রোশের সঙ্গে কোন্ শব্দটা মেলানো যায় তাও ভাবছিলেন। বোস, তোষ, মোষ, ঘোষ, ফোঁস অনেক শব্দ আসছিল মাথায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এটা একটা সংকেত-বাক্য। পঞ্চানন্দ বলেছিল। একটি চাবিও দিয়েছিল বটে।

চাবিটা টেবিলের দেরাজে পেয়ে গেলেন হরিবাবু। ঈশান কোণও তাঁর জানা। তিন ক্রোশ পথটা একটু বেশি বটে, কিন্তু ক্রোশ মানে কি আর সত্যিই ক্রোশ?

আসলে এক ক্রোশ ঠিক কতটা তা হরিবাবুর মনে পড়ল না। কিন্তু এই সামান্য সমস্যা নিয়ে কালহরণ করাও তার উচিত বলে বিবেচনা হল না। তিনি চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

ঈশান কোণ ঠিক করে নিতে তাঁর মোটেই দেরি হল না। পঞ্চানন্দ লোকটাকে তাঁর মোটেই অবিশ্বাস হয় না। মিথ্যেকথা বলে হয়তো, গুলগপ্পোও ঝাড়তে পারে, চুরি-টুরির বদ অভ্যাস যে নেই তা বলা যায় না, পেটুকও বটে, কিন্তু তবু মন্দ নয়। কবিতা জিনিসটাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে।

হরিবাবু হনহন করে হাঁটা ধরলেন। মনটায় বেশ ঘূর্তি লাগছে। চাঁদও উঠে পড়েছে একটু। কুয়াশায় চারদিকটা বেশ স্বপ্নময়। এরকমই ভাল লাগে হরিবাবুর। চাঁদ থাকবে, কুয়াশা থাকবে, কবিতা থাকবে, তবে না।

হাঁটতে হাঁটতে হরিবাবু আত্মহারা হয়ে গেলেন। কোন্‌দিকে যাচ্ছেন তার খেয়াল রইল না।

২৯.

একটা হোঁচট খাওয়ার পর হরিবাবুকে থেমে পড়তে হল। পড়েই যাচ্ছিলেন। কোনও রকমে সামলে নিয়ে চারিদিকটা খেয়াল করে যা দেখলেন, তাতে বেশ অবাক হওয়ার কথা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি ঈশান কোণ লক্ষ্য করে হাঁটা ধরেছিলেন। এতক্ষণে মাইলটাক দূরে গিয়ে পৌঁছনোর কথা। কিন্তু মাথায় কবিতার পোকা ওড়াউড়ি করছিল বলে দিক ভুল করে তিনি ফের নিজের বাড়ির মধ্যেই ফিরে এসেছেন যেন!

হ্যাঁ, এটা তাঁদেরই বাড়ি বটে। ওই তো সামনে ঝুপসি কেয়াঝোঁপ। তার ওপাশে তার বাবার ল্যাবরেটরি। তারপর বাগান, তার ওপাশে তাঁদের বাড়িটা। ফটফটে জ্যোৎস্নায় সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

হরিবাবু একটু অপ্রতিভ বোধ করলেন। লজ্জা পেয়ে একা একাই জিভ কাটলেন তিনি।

ভোর হতে এখনও ঢের দেরি। হরিবাবু বাগানের মধ্যেই কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন। গুনগুন করে গান গাইলেন একটু। কবিতার লাইনও ভাববার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মাথায় তেমন কোনও লাইন এল না।

তিনি কবিতার মানুষ। সেইজন্যই বোধহয় নিজের বাবার ল্যাবরেটরিতে তিনি বিশেষ ঢোকেননি। বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকাণ্ডে তার তেমন আগ্রহ নেই। তবে পঞ্চানন্দ শিবু হালদারের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের যে-সব গল্প তাঁকে শুনিয়েছে, তা যদি সত্য হয় তবে বিজ্ঞান জিনিসটা বিশেষ খারাপ নয় বোধহয়। বিজ্ঞান বিষয়ে দু’একটা কবিতাও লিখে ফেলা বোধহয় সম্ভব।

ভাবতে ভাবতে তিনি ল্যাবরেটরিটার দিকে এগোলেন। দেখলেন দরজাটা ভেজানো থাকলেও তালা লাগানো নেই। বস্তুত ভাঙা তালাটা মেঝের ওপর পড়ে ছিল। কিন্তু হরিবাবু সেটা লক্ষ্য না করে ঢুকলেন। তারপর বাতি জ্বালালেন। চারিদিকটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে। দেরাজ খোলা, আলমারি হাঁটকানো, যন্ত্রপাতিও অনেকগুলো চিত বা কাত হয়ে পড়ে আছে।

হরিবাবু তাঁর বাবার গবেষণাগারটি হ হয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর এটা ওটা একটু করে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলেন। অবশ্য কিছুই তেমন বুঝতে পারলেন না।

এই ল্যাবরেটরিতে তিনি ছেলেবেলায় মাঝে-মাঝে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঢুকে পড়তেন। কাজের সময় ছেলেপুলেদের উৎপাতে বিরক্ত হলেও শিবুবাবু তেমন কিছু বলতেন না ছেলেকে। বহুঁকাল বাদে বাবার কথা মনে পড়ায় হরিবাবুর চোখ দুটো সজল হয়ে উঠল।

হরিবাবুর মনে পড়ল, একবার দেয়াল-আলমারির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন লুকোতে গিয়ে। নীচের তাকটা বেশ বড়ই ছিল। তার মধ্যে থাকত পুরনো সব কাগজপত্র। তার মধ্যে লুকোতে খুব সুবিধে। তা সেই রকম লুকিয়ে আলমারির দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ বাঁ ধারে একটা বোতামের মতো দেখতে পেয়ে সেটা খুঁটতে শুরু করেছিলেন। তখন হঠাৎ পিছনের দেয়ালটা হড়াস করে খুলে গেল। আর হরিবাবু উলটে একটা চৌকো-মতো গর্তে পড়ে গেলেন। তেমন যে চোট পেয়েছিলেন, তা নয়। শিবুবাবুই তাঁকে টেনে তুলেছিলেন গর্ত থেকে।

অনেক দিন কেটে গেছে। সেই লুকোচুরি খেলা, সেই গর্তে পড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আজ হরিবাবুর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে লাগল।

কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জনের পর হরিবাবু চোখ মুছলেন। দেয়াল-আলমারিটা। এখনও তেমনি আছে। হরিবাবু সেটা খুলে ভঁই করা পুরনো কাগজপত্র সরিয়ে বোতামটা বের করলেন। আজ আবার তাঁর সেইরকম লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

ইচ্ছেটা এমনই প্রবল হয়ে উঠল যে, হরিবাবু নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। হামাগুড়ি দিয়ে পুরনো কাগজপত্র ঠেলে অন্যধারে সরিয়ে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে তার নিজেকে ফের শিশু বলে মনে হতে লাগল। বয়স যেন অনেক বছর কমে গেছে।

বেখেয়ালে তিনি দেয়ালের গায়ে বোতামটাকে খুঁটতে লাগলেন।

ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটল যে, হরিবাবু সাবধান হওয়ার কোনও রকম সুযোগই পেলেন না। সেই বহুঁকাল আগের মতোই পিছনে একটা ফোকর হঠাৎ দিখা দিল এবং হরিবাবু হড়াস করে একটা চৌকো গর্তের মধ্যে পড়ে গেলেন।

তবে বয়সটা আর তো সত্যিই অত কম নয়। সেবার পড়ে গিয়ে তেমন ব্যথা পাননি। এবারে পেলেন। মাথাটায় ঝং করে কী যেন লাগল। ঝিমঝিম করে উঠল মাথা। চোখে কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখলেন হরিবাবু।

গর্তটা মাঝারি মাপের। অনেকটা জলের চৌবাচ্চার মতো। অন্ধকারে খুব ভাল করে কিছু বোঝা যায় না।

পতনজনিত ভ্যাবাচ্যাকা ভাব আর ব্যথার প্রথম তীব্রতাটা কাটিয়ে উঠে হরিবাবু হাতড়ে-হাতড়ে চারদিকটা দেখলেন। একটা গোল ছোট বলের মতো জিনিস তার হাতে ঠেকল। তিনি বস্তুটা কুড়িয়ে নিলেন। খুবই ভারী জিনিসটা। আর বলের মতো মসৃণ নয়। বস্তুটার গায়ে নানারকম খাঁজ আর ছোট-ছোট টিপ-বোতামের মতো কী সব যেন লাগানো আছে।

হরিবাবু জিনিসটা পকেটে পুরে ধীরেসুস্থে উঠে পড়লেন। হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এসে গর্তটার কপাট আঁটলেন। তারপর আলমারি বন্ধ করে ল্যাবরেটরির আলো নিবিয়ে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

ব্রাহ্মমুহূর্তটা পড়াশুনোর পক্ষে খুবই ভাল সময়। হরিবাবু ভাবলেন, এখন ঘড়ি আর আংটিকে ঘুম থেকে তুলে দেবেন। তারপর পঞ্চানন্দকে ডেকে নিয়ে ফের একবার বেড়াতে বেরোবেন। অবশ্য হাতে ঘড়ি না থাকায় হরিবাবু বুঝতে পারছিলেন না, এখন ঠিক ক’টা বাজে। তাই বাজুক, ব্রাহ্মমুহূর্তটা আজ তিনি পেরোতে দেবেন না কিছুতেই।

দোতলায় উঠে তিনি ছেলেদের ঘরে গিয়ে হানা দিলেন। “এই ওঠ, ওঠ, পড়তে বসে পড়। আর দেরি করা ঠিক নয়।”

ডাকতে গিয়ে হরিবাবু দেখে খুশিই হলেন যে, ছেলেরা কেউ বিছানায় নেই। তার মানে দুজনেই উঠে পড়েছে। এই তো চাই।

একতলায় নেমে এসে হরিবাবু পঞ্চানন্দের খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন, সেও বিছানায় নেই।

বাঃ। সকলেই ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পড়ছে আজকাল। এ তো খুবই ভাল লক্ষণ! হরিবাবু আর দেরি করলেন না। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তাঘাট তিনি ভালই চেনেন। কিন্তু অন্যমনস্কতার দরুন এক রাস্তায় যেতে আর-এক রাস্তায় চলে যান। এ ছাড়া তার আর কোনও অসুবিধে নেই।

আজও হাঁটতে হাঁটতে ব্রাহ্মমুহূর্ত নিয়ে একটা কবিতা লেখার কথা ভাবতে লাগলেন। ভাবতে-ভাবতে রাস্তাঘাট ভুল হয়ে গেল। তিনি সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় চলে এলেন।

.

মহারাজ টিভির মতো যন্ত্রটা বন্ধ করে দিয়ে আংটির দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি খুব ঘাবড়ে গেছ, না?”

আংটি সত্যিই ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। রূপকথার গল্পেও এরকম ঘটনার কথা। নেই। গোটা পৃথিবীটাকে চুরি করে নিয়ে যেতে চায় কিছু লোক, এ কি সম্ভব?

শিহরিত হয়ে আংটি বলল, “আপনি আসলে কে, আমাকে বলবেন?”

মহারাজ হাসলেন, বললেন, “আর যাই হই আমি গুলবাজ নই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।”

আংটি কঁপতে কাঁপতে বললেন, “আপনি আমাদের বাঁচানোর জন্য কিছু করতে পারেন না?”

মহারাজ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “চেষ্টা নিশ্চয়ই করব। কিন্তু বিপদ কী জানো? এদের ধ্বংস করার মতো যে অস্ত্র আমার কাছে আছে, তা প্রয়োগ করলে পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যাবে।”

আংটি হঠাৎ এই প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ আলাদা একটা প্রশ্ন করল, “আপনি অন্য গ্রহের মানুষ হয়েও এমন চমৎকার বাংলা শিখলেন কী করে?”

মহারাজ একটু হেসে বললেন, “শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীর অনেক ভাষাই আমাকে শিখতে হয়েছে। তোমরা ভাষা শেখো, আমরা শিখি ধ্বনি। আমাদের মাথাও অবশ্য একটু বেশি উর্বর। শিখতে সময় লাগে না। তা ছাড়া আছে অনুবাদযন্ত্র। যে-কোনও ভাষাই তুমি বলো না কেন, তা আমার ভাষায় অনুবাদ হয়ে আমার কানে পৌঁছবে আমার ভাষা তোমার ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাবে।”

আংটির মাথার একটা স্মৃতি খেলা করে গেল। সে রামরাহা নামে একজন লোকের কথা কোনও বইতে পড়েছিল। এই সেই রামরাহা নয় তো!

আংটিকে কিছু বলতে হল না। মহারাজ নিজেই একটু মুচকি হেসে বললেন, “ঠিকই ধরছ। আমিই সেই রামরাহা।”

“আপনি একশো মাইল স্পিডে দৌড়োতে পারেন! দশ ফুট হাইজাম্প দিতে পারেন!”

মহারাজ হাত তুলে বললেন, “ব্যস, থামো। তোমার কাছে যেটা বিস্ময়কর ক্ষমতা বলে মনে হচ্ছে, আমাদের কাছে তা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।”

“আপনি তো ইচ্ছে করলেই ওই বর্বরদের ঠাণ্ডা করে দিতে পারেন।” রামরাহা দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না, আংটি, এই বর্বররা আমার চেয়ে কম ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু সে-কথা যাক। আমার কাছে একটা অত্যন্ত সেনসিটিভ ট্রেসার আছে। তা দিয়ে পৃথিবীর কোথায় কোন্ শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে বা ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেগুলো ধরা যায়। কয়েকদিন আগে ট্রেসারে আমি একটা কাঁপন লক্ষ্য করি। মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে এমন একটা যন্ত্র বা শক্তির উৎস আছে যা অকল্পনীয়। আমি সেই উৎসের সন্ধানে খুঁজেখুঁজে যন্ত্রের নির্দেশে এখানে এসে হাজির হই। এখানেই আস্তানা গেড়ে কয়েকদিন হল বসে আছি। বুঝতে পারছি উৎসটা এখানেই কোথাও আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় তা বুঝতে পারছি না। আশ্চর্যের বিষয় যখন ক্রিকেট খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ট্রেসারে সেই কম্পন ধরা পড়ে। তোমাদের গা থেকে সেই শক্তির একটা আভাস আসছিল। সেজন্যই তোমাদের দু ভাইকে তুলে এনেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তোমাদের কাছে জিনিসটা নেই।”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“তোমাদের মগজ এক্স-রে করে।”

৩০.

আংটি আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু আমাদের কাছে তো ওরকম কিছু নেই।”

মহারাজ অর্থাৎ রামরাহা একটু হেসে বললেন, “হয়তো আছে, কিন্তু তোমরা জানো না। হয়তো নয়, অবশ্যই আছে। কিন্তু জিনিসটা ঘুমন্ত। ওর ভিতর থেকে সূক্ষ্ম একটা বিকিরণ সব সময়েই ঘটছে। কিন্তু বিকিরণটা এতই সামান্য যে, ধরা মুশকিল। তোমরা যে বাড়িতে থাকো তারই কোথাও লুকানো আছে। কিন্তু সেটা খুঁজে দেখার সময় আমি পাইনি। সময় বোধহয় আর পাব না। এখন আমার হাতে যেটুকু ক্ষমতা আছে সেটুকুই কাজে লাগাতে হবে। চলো, আর সময় নেই।

এই বলে মহারাজ উঠে পড়লেন।

.

হরিবাবু যেখানটায় এসে পড়েছেন, সেটা যে একটা জলা তা তার খেয়াল হল পায়ে ঠাণ্ডা লাগায়। এতক্ষণ বেশ ব্রাহ্মমুহূর্তে পবিত্রতার কথা ভাবতে ভাবতে মনটা উড়ু উড়ু করছিল। কিছু কবিতার লাইনও চলে আসছিল মাথায়।

ত্যাগ করো লোকলজ্জা,
ভোরবেলা ছাড়ো শয্যা,
করো কজা, ব্রাহ্মমুহূর্তেরে,
ঝরাও ঘর্ম, ধরো কর্ম,
সঙ্গী হবেন, পরব্রহ্মা,
এলেন বলে লক্ষ্মী তেড়েফুঁড়ে।

এর পরেও কবিতাটা চলত। কিন্তু ঝপাং করে হাঁটুভর যমঠাণ্ডা জলে আচমকা নেমে পড়লে কোনও কবিতারই ভাবটাব থাকে না। হরিবাবুরও তাল কেটে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কবির পথে যে কত বাধা তা আর বলে শেষ করা যায় না।

অন্য কেউ হলে জল থেকে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ত। কিন্তু হরিবাবু সেরকম লোক নন। জলে নেমে ব্রহ্মার পর্যন্ত ঠাণ্ডায় ঝনঝন করে উঠলেও তিনি পিছু হটলেন না। ছেলেবেলায় এই জলায় তিনি কতবার মাছ ধরতে এসেছেন। জলার মাঝখানটা তখন বেশ গভীর ছিল। নিতাই নামে একটা লোকের একখানা ডিঙি নৌকো বাঁধা থাকত ধারে। বহুবার সেই নৌকো বেয়ে জলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আজ নৌকো নেই, কিন্তু…….

কিন্তু জাহাজ আছে!

হরিবাবু খুবই অবাক হয়ে গেলেন। জলার মধ্যে বেশ খানিকটা জলকাদা। ভেঙে তিনি আপনমনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। নিতাইয়ের ডিঙি নৌকোর কথাটা বারবার মনে আসছে। এমন সময় দেখলেন, জলার মধ্যে বাস্তবিকই মস্ত এক জাহাজ। না, একেবারে হুবহু জাহাজের মতো চেহারা নয়। মাস্তুল-টাস্তুল নেই। কেমন একটু লেপাপোছা চেহারা। তা হোক, তবু এ যে জাহাজ তাতে সন্দেহ নেই।

বিস্ময়টা বেশিক্ষণ রইল না হরিবাবু। ব্রাহ্মমুহর্তে উঠলে কত কী হয়, কত অসম্ভবই সম্ভব হয়ে ওঠে তার কি কিছু ঠিক আছে। তবে স্বয়ং ব্রহ্মই যে হরিবাবুর মনের ইচ্ছে টের পেয়ে নৌকোর বদলে আস্ত একখানা জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছেন, এ-বিষয়ে তার আর কোনও সন্দেহ রইল না।

হরিবাবু জল ভেঙে যতদূর সম্ভব দ্রুত জাহাজটার দিকে এগোতে লাগলেন।

জাহাজের লোকজন যেন হরিবাবুর জন্যই অপেক্ষা করছিল। করারই তো কথা কিনা। তবে তোকগুলোর চেহারা-ছবি হরিবাবুর বিশেষ পছন্দ হল না। বড্ড বড়সড় আর বেজায় হোঁতকা। সংখ্যায় তারা জনা চার-পাঁচ হবে। হরিবাবু জাহাজটার কাছে হাজির হতেই লোকগুলো হাতের কাজ ফেলে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। হরিবাবু তাদের দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, “বাঃ, বেশ জাহাজখানা তোমাদের!”

ঠিক এই সময় অনেকটা দূর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা, পালিয়ে এসো! ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।”

হরিবাবু একটু থমকে চারদিকে চাইলেন। গলাটা তার বড় ছেলে ঘড়ির বলে মনে হল। কিন্তু ঘড়ি কেন চেঁচাচ্ছে তা তার মাথায় ঢুকল না।

হরিবাবুও চেঁচিয়ে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই দুমন ওজনের একখানা থাবা এসে কাক করে ঘাড়খানা ধরে এক ঝটকায় শূন্যে তুলে নিল। হরিবাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন।

ভাল করে কিছু বুঝবার আগেই সেই বিশাল হাতখানা একখানা ক্রেনের মতো তাঁকে শূন্যে ভাসিয়ে সেই জাহাজখানার ভিতরে একটা চৌকো বাক্সের মতো ঘরে নিক্ষেপ করল।

হরিবাবুর কিছুক্ষণের জন্য মূৰ্হার মতো হয়েছিল। তারপর চোখ মেলে চাইতে তিনি দেখলেন, তার আশেপাশে আরও বেশ জনাকয় লোক রয়েছে। দু’চারজনকে তিনি চেনেনও। যেমন লোহার কারিগর, হরিদাস, পটুয়া বক্রেশ্বর, আতরওয়ালা এক্রাম, হালুইকর গণেশ, রামজাদু স্কুলের বিজ্ঞানের মাস্টার যতীন ঘোষ। আরও অনেকে।

যতীনবাবুই হরিবাবুকে দেখে এগিয়ে এলেন। মুখোনা শুকনো, চোখে আতঙ্ক। বললেন, “এসব কী হচ্ছে মশাই?”

হরিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “কিছুই বুঝতে পারছি না। মনের ভুলে জলায় নেমে জাহাজ দেখে এগিয়ে এসেছি, অমনি ধরে আনল।”

যতীনবাবু ধরা গলায় বললেন, “আমিও রাতে একটু বাথরুমে গিয়েছিলুম। বাইরে একটা অদ্ভুত আলো দেখে বেরিয়ে আসি। জলায় আলো জ্বলছে দেখে ব্যাপারটা তদন্ত করতে এসে পড়েছিলুম। তারপর এই তো দেখছেন।”

“এরা সব কারা?”

“মানুষ নয়। ভূত যদি বা হয় বেশ শক্ত ভূত। সেই কখন থেকে এক নাগাড়ে রাম-রাম করে যাচ্ছি, কোনও কাজই হচ্ছে না।”

হরিবাবু চারদিকে চেয়ে দেখলেন। ঘরখানায় দেখার অবশ্য কিছু নেই। লোহার মতোই শক্ত কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি মসৃণ দেয়াল। ছাদখানা বেশ নিচু। তাতে কয়েকটা অদ্ভুত রকমের আলো জ্বলছে। ঘরের মেঝেখানাও ধাতুর তৈরি। তবে ঘরখানা বেশ গরম। বাইরের ঠাণ্ডা মোটেই টের পাওয়া যাচ্ছে না।

হরিবাবু হঠাৎ যতীনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, জাহাজের সঙ্গে মেলানো যায় এমন কোনও শব্দ মনে পড়ছে?”

“জাহাজ!” বলে যতীনবাবু অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আজ্ঞে না। রামনাম ছাড়া আর কোনও শব্দই আমার মাথায় নেই কিনা। কিন্তু, আপনি কি এখনও কবিতার কথা ভাবছেন? এই দুঃসময়ে, এত বিপদের মধ্যেও?”

হরিবাবু একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, “কী জানেন, একবার কবি হয়ে জন্মালে আর কবিতা কিছুতেই ছাড়তে চায় না। শত বিপদ, শত ঝড়ঝঞ্ঝা, এমনকী মৃত্যুর মুখেও কবিতার লাইন গুনগুন করবেই মাথায়। ওয়ানস এ পোয়েট অলওয়েজ এ পোয়েট।”

যতীনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তাই তো দেখছি। কিন্তু কবিতা দিয়ে আর কী-ই-বা করবেন হরিবাবু? পরিস্থিতি যা বুঝছি, এরা সব মহাকাশের জীব। আর এই যেখানে আমরা আটক রয়েছি, এটা একটা মহাকাশযান। আমার মনে হচ্ছে এরা আমাদের ধরে অন্য কোনও গ্রহে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কবিতার চল আছে কি না কে জানে।”

হরিবাবু একটু ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন। তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কবিতা নেই এমন গ্রহ কোথাও থাকতে পারে না। দুনিয়াটাই তো কবিতায় ভরা, আমি তো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাই, নক্ষত্র থেকে টপটপ করে কবিতা ঝরে পড়ছে জলের ফেঁটার মতো।”

“বটে!” বলে যতীনবাবু আর একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মাথা নেড়ে বললেন, “বাস্তবিক আপনি ক্ষণজন্মা পুরুষ।”

হরিবাবু একটু হাসলেন। লোকগুলো ভয়ে সব বোবা মেরে আছে। দু’চারটে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে মাত্র। হরিবাবু ওসব গ্রাহ্য করলেন না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে জাহাজের সঙ্গে কী মেলানো যায় তা গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন।

আংটি যখন রামরাহার পিছু পিছু জলার ধারে এসে দাঁড়াল তখন জলার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। কী ঘটছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু খুব শক্তিশালী একটা যন্ত্রের চাপা শব্দ আসছিল। পায়ের তলায় মাটি সেই যন্ত্রের বেগে থিরথির করে কাঁপছে।

রামরাহা বললেন, “ওরা মাটি ফুটো করে ভিতরে চার্জ নামিয়ে দিচ্ছে।”

“চার্জ মানে?”

“এক ধরনের মৃদু বিস্ফোরক। শুধু এখানেই নয়, পৃথিবীর আরও কয়েকটা জায়গায় এরকম কাজ চলছে। চার্জগুলো কার্যকর হলেই পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ধীরে ধীরে সরে সৌরমণ্ডলের বাইরের দিকে ছুটতে শুরু করবে।”

“কী ভয়ংকর!” রামরাহা দাঁতে ঠোঁট কামড়ালেন। তাঁর পিঠে একটা রুকস্যাকের মতো ব্যাগ। সেটা ঘাসের ওপর নামিয়ে প্রথমে একটা ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্র বের করে কী যেন দেখতে লাগলেন।

হঠাৎ চমকে উঠে বললেন, “এ কী!”

“কী হয়েছে?”

“সর্বনাশ! আমি যে শক্তির উৎসটার কথা তোমাকে বলছিলাম, এখন দেখছি সেটার সন্ধান বর্বররাই পেয়ে গেছে। এই দ্যাখো।”

মহারাজ ওরফে রামরাহা ক্যালকুলেটরটা আংটির সামনে ধরলেন। আংটি দেখল একটা ছোট্ট ঘষা কাঁচের পর্দায় একটা মৃদু আলোর রেখায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

রামরাহা বললেন, “তোমার দাদু একজন আবিষ্কারক ছিলেন। সম্ভবত কোনও সময়ে তিনি এই অদ্ভুত জিনিসটি আবিষ্কার করেছিলেন। এই জিনিসটির সন্ধানেই বোধহয় বর্বররা এখানে হানা দিয়েছিল। এখন দেখছি, ওরা ওটা পেয়ে গেছে।”

“তা হলে কী হবে?”

রামরাহা কব্জির ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “আংটি, আমার আর বিশেষ কিছু করার নেই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবী কক্ষচ্যুত হবে। সেই সময়ে আমার পক্ষে এই গ্রহে থাকা ঠিক হবে না। আমি সমুদ্রের তলায় আমার মহাকাশযানে ফিরে যাচ্ছি। পৃথিবীকে ওরা টেনে নেওয়ার আগেই আমাকে চলে যেতে হবে। তবে আমি তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress