ভোর না হতেই ন্যাড়া উঠে পড়ল
ভোর না হতেই ন্যাড়া উঠে পড়ল। রাতে ভাল ঘুমও হয়নি তার। সে কুস্তিগির হলেও নানারকম ভয়ডর তার আছে। গায়ে জোর থাকলেও মনের জোর অন্য জিনিস। পঞ্চানন্দ নামে যে রহস্যময় লোকটি তাদের বাড়িতে থানা গেড়েছে, সে একদফা ভয় দেখিয়ে ভড়কে দিয়ে গেছে তাকে। তার ওপর মাঝরাতে গজ পালোয়ানের আবির্ভাব তাকে আরও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
দরজা খুলে ন্যাড়া সোজা গিয়ে ল্যাবরেটরির দরজায় ধাক্কা দিল, “ও গজদা, দরজা খুলুন।”
দরজা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই খুলে গেল এবং ন্যাড়া অবাক হয়ে দেখল, গজদার বদলে পঞ্চানন্দ। মুখে একগাল হাসি।
ন্যাড়া থতমত খেয়ে বলল, “আপনি এখানে?”
পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, সব দিকে নজর রাখাই আমার অভ্যাস কিনা। ভোর রাতে কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “দাদা উঠুন, শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে কুরুক্ষেত্র হচ্ছে। শুনেই চটকা ভেঙে গেল।”
ন্যাড়া বিবর্ণ মুখে বলল, “কে বলে গেল কথাটা?”
হেঁ হেঁ করে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে একটু হাসল পঞ্চানন্দ, “আজ্ঞে, সকল গুহ্য কথা কি ফাস করা যায়? তবে আমার চর-টর আছে। সাদা চোখে তাদের দেখা যায় না। তা সে যাকগে। খবর পেয়েই এসে হাজির হয়ে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া।”
“কী দেখলেন?”
“তিনটে সাহেবের সঙ্গে গজ-পালোয়ানের একেবারে গজগচ্ছপ হচ্ছে। চারদিক একেবারে লন্ডভন্ড কান্ড। তারপর তিনজনে মিলে গজ-পালোয়ানকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল।”
“বলেন কী!”
“তবে আর বলছি কী? এই এতক্ষণ ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ল্যাবরেটরিটা আবার যেমনকে তেমন গুছিয়ে রাখলাম আর কি। কিন্তু একটা ধন্ধ আমার কিছুতেই যাচ্ছে না। গজ-পালোয়ান লোকটা কেমন বলুন তো!”
ন্যাড়া মিনমিন করে বলল, “ভালই তো। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না।”
“তবে রাত্তিরে শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে এসে তার সেঁধোনোর মানে কী?” ন্যাড়া আমতা-আমতা করে বলল, গজদা একটু অসুবিধেয় পড়ে এসেছিলেন, তাই আমিই তাঁকে এখানে থাকতে বলেছিলাম মাঝরাতে।”
শুনে পঞ্চানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব স্থির দৃষ্টিতে গম্ভীর মুখে ন্যাড়ার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “কাজটা খুব ভাল করেননি ছোটবাবু। শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে অনেক দামি জিনিস আছে। এসব জিনিসের দাম টাকায় হয় না। তার ওপর গজ-পালোয়ানের আপনি কতটুকুই বা জানেন?”
দুষ্টু ছেলে যেমন দুষ্টুমি ধরা পড়ায় কঁচুমাচু হয়ে পড়ে, তেমনি মুখ করে ন্যাড়া বলল, “গজদা লোক তো বেশ ভালই।”
পঞ্চানন্দ মাথাটা দুপাশে নেড়ে মুখে চুকচুক একটা শব্দ করে বলল, “তাই যদি হবে তো তিনটে শহরের পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে কেন? কেনই বা তার মাথার দাম দশ হাজারা টাকা উঠেছিল?”
ন্যাড়ার মুখে কিছুক্ষণ কথা সরল না। তারপর অনেকক্ষণ বাদে সে শুধু বলল, “ফঁত।”
পঞ্চানন্দ জানে ফত’ কথাটার কোনও মানে হয় না, এটা বাংলা বা ইংরেজি বা হিন্দি কোনও ভাষায়ও নেই। এটা হল ভয় বিস্ময় ঘাবড়ে যাওয়া মেশানো একটা শব্দমাত্র। অর্থাৎ ন্যাড়া বাক্যহারা।
পঞ্চানন্দ একটু মোলায়েম হয়ে বলল, “অবিশ্যি সে-সব কথা আর না ভোলাই ভাল। গজ-পালোয়ান যদি ফিরেও আসে তবু তার কাছে সেসব কথা খবর্দার তুলবেন না! লোকটা একে রাগী, তার ওপর ভয়ংকার গুণ্ডা। চাই কি আপনাকেই দুটো রদ্দা বসিয়ে দিল।“
ন্যাড়া বাক্য ফিরে পেয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “না, বলব না।”
পঞ্চানন্দ ল্যাবরেটরির দরজায় একটা ভারি তালা লাগিয়ে চাবিটা নিজের টাকে খুঁজে বলল, “কথা আর পাঁচকান করবেন না। গজ-পালোয়ান যে এখানে রাতে থানা গেড়েছিল, তাও বেমালুম ভুলে যান। মনে করবেন স্বপ্ন দেখেছিলেন।”
ন্যাড়া বিষণ্ণ মুখে ঘাড় নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
ন্যাড়াকে বিদায় করে পঞ্চানন্দ চারদিকটা একটু ঘুরে দেখল। বেশ মোলায়েম রোদ উঠেছে। ঘাসে শিশির ঝলমল করছে। গাছে পাখি ডাকছে।
কুয়োতলায় একর্ডাই বাসন মাজতে মাজতে বসেছে ঠিকে-লোক। পঞ্চানন্দ গিয়ে তার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বুঝেসুঝে কাজ কোরো বাপু, বাসনে যেন ছাইয়ের দাগ না থাকে। আমি হলাম এ-বাড়ির নতুন ম্যানেজার। কাজে গাফিলতি সইতে পারি না, দু’দশ টাকা মাইনে বেশি চাও,তা সে দেখা যাবে।”
কাজের লোক বিগলিত হয়ে গেল।
হরিবাবু বাজার করতে পছন্দ করেন না। কিন্তু বাজার তবু তাকেই করতে হয়। কারণ, জরিবাবু বাজারে গেলে রেওয়াজে বাধা পড়ে, ন্যাড়া বাজারে গেলে কুস্তিতে ফাঁক পড়ে। ঘড়ি আর আংটির পড়াশুনো আছে। তাই কবি হরিবাবুকে রোজ সাতসকালে বাজার করার মতো অকাব্যিক কাজ করতে হয়।
আজও হরিবাবু বাজার করতে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। গিন্নি বাজারের ফর্দ করে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে রোজকার মতোই মনে করিয়ে দিলেন, “প্রত্যেকটা আইটেম কিনে তার কত দাম দিলে তা পাশে লিখে নেবে।”
হরিবাবু তা রোজই লেখেন, তবু ফিরে এলে দেখা যায় দু’চার টাকার গোলমাল ওর মধ্যেই করে ফেলেছেন। মুশকিল হল, অঙ্কে তিনি বরাবরই কাঁচা। সাড়ে তিন টাকা কিলোর জিনিস সাড়ে তিনশো গ্রাম কিনলে কত দাম হয় সেটা টক করে তার মাথায় খেলে না। রোজই তাই বাজার থেকে এসে তাকে নানা জবাবদিহি করতে হয়।
আজ বেরোবার মুখেই দেখেন পঞ্চানন্দ ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে জমাদারকে রীতিমত দাবড়াচ্ছে, “বলি ঝাড়ু দিস তা তোর ঝাটার শব্দ শোনা যায় না কেন রে? ওরকম কঁকির কাজ আর দেখলে একেবারে বিদেয় করে দেব। বাবু ভালমানুষ বলে খুব পেয়ে বসেছ দেখছি। দু’পাঁচ টাকা বাড়তি চাও পাবে, কিন্তু কাজ চাই একদম ফার্স্ট ক্লাস।”
হরিবাবু খুশিই হলেন। কাজের লোকগুলো বেজায় কঁকিবাজ তা তিনি জানেন, কিন্তু যথেষ্ট দাবড়াতে পারেন না। দাবড়ানোর জন্য যে-সব ভাষা এবং স্পষ্ট কথার প্রয়োজন তা তাঁর আসে না। তার মগজে যেসব ভাষা খেলা করে, তা কবিতার ভাষা। সে-ভাষায় জমাদার বা কাজের লোককে দাবড়ানো যায় না।
তিনি পঞ্চানন্দের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “বাঃ, এই তো চাই।”
পঞ্চানন্দ বিগলিতভাবে বলল, “কবি মানুষের কি বাজার করা সাজে। ছিঃ ছিঃ, দিন ও-সব ছোট কাজ আর আপনাকে করতে হবে না। ও আমিই বুঝেসুঝে করে আনব’খন।”
হরিবাবু খুশি হলেও ঘাড় চুলকে বললেন, “মুশকিল কী জানো, এটা শুধু বাজার করাই তো নয়, মর্নিং ওয়াক, অঙ্ক শিক্ষা, বাস্তব জ্ঞান অর্জন, সবই একসঙ্গে। তাই গিন্নি যদি শোনেন যে, আমার বদলে তুমি বাজারে গেছ, তা হলে কুরুক্ষেত্র করে ছাড়বেন।”
এ-কথাটায় পঞ্চানন্দও একটু ভাবিত হল। বস্তুত এ-বাড়ির গিন্নিমাকেই সে একটু ভয় খাচ্ছে। তাই চাপা গলায় বলল, “তা হলে আপনিও-না হয় চলুন। বাজারের কাছে মাঠের ধারে গাছতলায় বসে আকাশ-পাতাল যা হোক ভাবতে থাকুন, আমি ধাঁ করে বাজার এনে ফেলব। গিন্নিমাকে কথাটা না ভাঙলেই হল।”
হরিবাবু তবু সন্দিহান হয়ে বলেন, “হিসেব-টিসেব সব ঠিকমতো দিতে পারবে তো?”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “হিসেবে তেমন গোলমাল আমার হয় না। তবে কিনা আমি লোকটা তো তেমন সুবিধের নয়। দু’চার টাকা এধার-ওধার হয়েই যাবে, যেমন আপনারও হয়। তবে হিসেব এমন মিলিয়ে দেব যে, গিন্নিমা টু শব্দটিও করতে পারবেন না। শিবুবাবুও আমাকে দিয়ে মেলা বাজার করিয়েছেন।”
হরিবাবু সবিস্ময়ে বললেন, “তাই নাকি?”
“একেবারে আপনভোলা লোক ছিলেন তো, ডান বা জ্ঞান থাকত না, প্রায়ই। মাথায় নানারকম আগড়ম-বাগড়ম আজগুবি চিন্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে যা হয় আর কি। আমি তাকেও ওই মাঠের ধারে গাছতলায় বসিয়ে রেখে বাজার করে আসতাম। এসে দেখতাম বসে-বসে ছোট্ট একখানা খাতায় মেলা আঁক কষে ফেলেছেন।”
“বটে!”
“কাল থেকে আপনিও একখানা ও-রকম খাতা সঙ্গে করে আনবেন। গাছতলায় বসলে ভাব আসবে, পদ্যও লেখা হয়ে যাবে ঝুড়ি ঝুড়ি।”
হরিবাবু পঞ্চানন্দের সঙ্গে বাজারের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শুধু লিখলেই তো হল না হে। সেটা ছাপাও তো দরকার।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “খুব ন্যায্য কথা। ভাল জিনিসের আজকাল কদরই বা করে কে। আমাদের গায়ের শ্রীপতি কবিয়াল তো হন্যে হয়ে উঠেছিল। পদ্য লিখে পোস্টার সাঁটত দেয়ালে, পদ্য লেখা কাগজের ঠোঙা বিলি করত দোকানে দোকানে, তারপর এক ঘুড়িওলাকে ধরে পদ্য ছাপানো কাগজের ঘুড়ি তৈরি করে গাদাগাদা বিলোল। তাতে কাজও হল ভাল। লোকে পোস্টারে কবিতা পড়তে শুরু করল। মুড়ি খেয়ে ঠোঙাটা ফেলে দেওয়ার আগে অনেকেই ঠোঙার গায়ের লেখা একটু করে পড়ে দেখে। তেমনি শ্রীপতির কবিতাও পড়তে লাগল। তারপর ধরুন ঘুড়ির পদ্যও তো এক আজব জিনিস। যে ঘুড়ি কেনে সে পড়ে, তারপর ঘুড়ি কাটা গেলে আর একজন ধরে, তখন সে পড়ে। এমনি করে সাতটা গা আর তিনটে শহরে শ্রীপতি রীতিমত শোরগোল তুলে ফেলল।”
হরিবাবু যেন একটু উৎসাহী হয়ে উঠলেন। বললেন, “ব্যাপারটা একটু ছেলেমানুষি বটে, কিন্তু আইডিয়াটা বেশ নতুন তো।”
“তবে আর বলছি কী। দুনিয়ার নতুন কিছু করতে পারলেই কেল্লা ফতে। তবে একটু খরচ আছে।”
১৭.
পঞ্চানন্দ যখন বাজার করে ঘরে এল তখনও হরিবাবু মাঠের ধারে বাঁধানো গাছতলায় বসে খুব কষে ভাবছেন, কবিতা লেখা ঘুড়ি কডজন ছাপানো যায় এবং কবিতার ঠোঙা তিনি কীরকম কাগজ দিয়ে তৈরি করাবেন। ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছেন। একটা নেড়ি কুকুর এসে তার গা শুকে অনেকক্ষণ ল্যাজ নাড়ল, তারপর তার একপাটি চটি মুখে নিয়ে চলে গেল। তিনি টেরও পেলেন না।
পঞ্চানন্দ এসে এই অবস্থা দেখে প্রথমে গলাখাঁকারি দিল। তাতে কাজ না হওয়ায় দু’বার “হরিবাবু, ও হরিবাবু” বলে ডাকল। এবং অপারগ হয়ে শেষে ধাক্কা দিয়ে হরিবাবুকে সচেতন করে বলল, “বাজার হয়ে গেছে। একেবারে কড়ায়-গন্ডায় হিসেব মিলিয়ে এনেছি। গিন্নিমা’র ফর্দের মধ্যে দামটাও টুকে দিয়েছি।”
হরিবাবু এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে গা করলেন না। এমনই তাঁর অন্যমনস্কতা যে,উঠে একপাটি চটি পায়ে দিয়ে আর একপাটির জন্য পা বাড়িয়ে যখন সেটা পেলেন না, তখনও তাঁর তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হল না। মনে হল, একপাটি চটি পায়ে দেওয়াই তো রেওয়াজ। সুতরাং একটা খালি পা আর একটা চটি-পায়ে পঞ্চানন্দের পাশে-পাশে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, “দ্যাখো পঞ্চানন্দ, ঠোঙা ঘুড়ি এসব ভাল বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে আরও কয়েকটা ব্যাপারও আমার মাথায় এসেছে। ধরো, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের যদি বিনা পয়সায় খাতা বিলোনো যায়, আর সেই খাতার মলাটের চার পিঠে চারটে কবিতা ছাপিয়ে দিই তো কাজটা অনেকটা দূর এগোয়। বছরের শুরুতে আমরা কবিতা-ছাপানো ক্যালেন্ডার বের করতে পারি। তারপর হোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের ধরে পড়লে তারা যে পুরিয়া করে ওষুধ দেয় সেই পুরিয়ার কাগজে ছোট-ছোট কবিতা ছাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে।”
পঞ্চানন্দ বলল,”খাসা হবে। ওষুধের উপকার, কবিতার উপকার, দুই এক সঙ্গে। এরকম আরও ভাবতে থাকুন। আমাদের হরিদাস কবিয়াল তো দিনে পাঁচ সাতখানা করে খাম পোস্টকার্ড পাঠাত নানা লোককে।”
হরিবাবু হতচকিত হয়ে বললেন, “খাম পোস্টকার্ড?”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “বুঝলেন না, সে কি আর সত্যিকারের চিঠি নাকি? সব কবিতায় ঠাসা। চিঠি ভেবে লোকে খুলে দেখত কবিতা। ওইভাবেই তো হরিদাস একেবারে ঝড় তুলে দিয়েছিল।”
হরিবাবু উত্তেজিত গলায় বলল, “তুমি আজই কয়েকশো খাম আর পোস্টকার্ড নিয়ে এসো।”
পঞ্চানন্দ উদার গলায় বলল “হবে হবে, সব হবে। পঞ্চানন্দ যখন এসে পড়েছে তখন আর আপনার ভাবনা কী? কিন্তু হরিবাবু, আপনার ডান পায়ের চটিটা যেন দেখছি না!”
হরিবাবুও তাকিয়ে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তেমন অবাকও হলেন না। বললেন, “চটি জিনিসটাই বাজে। কখনও একটা পাই না, কখনও দুটোই পাই না।” বলে বাঁ পায়ের চটিটা ছুঁড়ে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে ডগমগ হয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, “আচ্ছা, ধরো, যদি কবিতা দিয়ে নামাবলী ছাপিয়ে বিলি করি, তা হলে কেমন হয়?”
“ভেবে দেখার মতো কথা বলেছেন। খুবই ভেবে দেখার মতো কথা। তবে কিনা গিন্নিমা দোতলা থেকে এদিকে নজর রেখেছেন। বাজারের থলিটা এইবেলা হাতে নিয়ে ফেলুন। আমি বরং পিছন দিক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছি।”
তা সত্যিই হরিবাবুর স্ত্রী দোতলা থেকে নজর রাখছিলেন। হরিবাবু বাড়ি ঢুকতেই তিনি ধেয়ে এসে তার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন।
হরিবাবু পকেট থেকে ফদটা পট করে বের করে এনে একগাল হেসে বললেন, “আজ দ্যাখো, হিসেব একেবারে টু দি পাই মিলিয়ে এনেছি।”
তাঁর গিন্নি কঠোর গলায় বললেন, “হিসেব পরে হবে, আগে বলল, পায়ের চটি-জোড়া কোথায় জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছ!”
হরিবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “চটি! চটি পরে আমি বাজারে যাইনি তো।”
“চটি পরে যাওনি মানে? তবে কি বুট পরে গিয়েছিলে?”
দু’দিন পঞ্চানন্দের সঙ্গে মিশে হরিবাবুর বুদ্ধি বেশ খুলে গেছে। একগাল হেসে বললেন, “আরে না। খালি পায়েই গিয়েছিলাম। আজকাল ডাক্তারদের মত হচ্ছে, যত আর্থ কন্টাক্ট হয় ততই ভাল। তাতে চোখের জ্যোতি বাড়ে, ব্লাডপ্রেশার হয় না, মাথায় নানারকম ভাব খেলে।”
তাঁর গিন্নি কথাটা বিশ্বাস করলেন না বটে, কিন্তু বেশি ঝামেলাও করলেন না। অফিসের সময় হয়ে আসছে। রান্নায় এ সময় কিছু তাড়া থাকে। শুধু বললেন, “আচ্ছা এ নিয়ে পরে বোঝাঁপড়া হবে।”
হরিবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন জামা ছেড়ে ছাদে উঠে রোদে বসে তেল মাখতে লাগলেন গায়ে। মাখতে-মাখতে তার ভাব এল। তেলমাখা গায়েই তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে টেবিলে বসে খাতা আর কলম টেনে নিলেন। লিখলেন :
পৃথিবীর গূঢ় অর্থ রয়েছে গোপন,
তেল যথা বুকে সরিষার।
ঘানির গোপন রন্ধ্রে তীব্র নিষ্পেষণে
শুরু হয় তার অভিসার।
কবির হৃদয় আজ ঘানিগাছ হয়ে
নিষ্পেষণ করে পৃথিবীরে,
সত্যের অমল মুখ আজি এ কবিরে
দেখা দিবি কি রে?
ওদিকে পঞ্চানন্দ বাড়ির পিছন দিকে একটু আড়ালে পড়েই হনহন করে হাঁটা দিল। বড় রাস্তা বা লোক-চলাচলের জায়গাগুলো সাবধানে এড়িয়ে সে একটু ঘুরপথেই শহরের বাইরে এসে পড়ল দেখতে- না দেখতেই। তারপর একটু পতিত জমি আর একটা মজা পুকুর পার হয়ে জঙ্গুলে রাস্তা ভেঙে এসে উঠল চকসাহেবের বাড়ির হাতায়।
বাইরে থেকে খুব ভাল করে বাড়িটা আর তার আশপাশ দেখে নিল সে। কোথাও কোনও নড়াচড়া নজরে পড়ল না। আগাছায় ভরা বাগানের মাঝখানে। ভাঙা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ধারেকাছে জনবসতি নেই।
পঞ্চানন্দ সাবধানে ভিতরে ঢুকল এবং ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে যতদূর সম্ভব। আত্মগোপন করে এগোতে লাগল।
দিনের বেলায় ভাঙা বাড়িটাকে যেমন করুণ দেখাচ্ছে, রাতের বেলায় তেমনি ভয়াবহ মনে হবে। এসব বাড়িতে সাপ আর ভূত গিজগিজ করে।
পঞ্চানন্দ চোর-পায়ে বারান্দাটা পেরিয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। না, গজ-পালোয়ানের ঘরে কেউ নেই। জিনিসপত্রগুলো সব লন্ডভন্ড হয়ে আছে বটে। কেউ কিছু একটা খুব খুঁজেছে। কী খুঁজেছে সেটাই জানা দরকার।
পঞ্চানন্দ ভিতরে ঢুকে চারপাশটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তার চোখে তেমন কিছু সূত্র নজরে পড়ল না।
দরজার কাছে মেঝের ওপরটা খুব ভাল করে দেখল পঞ্চানন্দ। মেঝেতে লালমতো দাগ রয়েছে খানিকটা। কিন্তু পঞ্চানন্দ চোখ বুজে বলে দিতে পারে ওটা কিছুতেই রক্তের দাগ নয়। রক্ত হলে এতক্ষণ মাছি ভ্যানভ্যান করত। জায়গাটা লাল না কালচে দেখাত।
পঞ্চানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরের দরজা দিয়ে সাবধানে ভাঙা বাড়ির ভিতরে ঢুকল। দেখার মতো তেমন কিছু নেই। রাশি-রাশি ইটের স্তূপ, কড়ি বরগা হেলে পড়ে আছে, থাম পড়ে আছে মেঝের ওপর, আগাছা জমেছে এখানে সেখানে।
পঞ্চানন্দ একটার পর একটা ঘর পার হতে লাগল।
পশ্চিম দিকে যে হলঘরটা রয়েছে সেটা ততটা ভাঙা নয়। তবে চারদিক থেকে ইট বালি এবং আরও সব ধ্বংসস্তূপ পড়ে ঘরটা একেবারে দুর্গম জায়গা হয়ে গেছে।
পঞ্চানন্দ খুঁজে খুঁজে একটা জায়গায় একটা রন্ধ্র বের করে ফেলল। উঁকি দিয়ে দেখল, ঘরটা ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। তবু অনেকক্ষণ চোখ রাখল সে ভিতরে।
একটা ইঁদুর বা ছুঁচো যেন ডাকল ভিতরে। চি-চিকচিক।
পঞ্চানন্দ হতাশ হয়ে সরে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ তার একটা খটকা লাগল। ইঁদুর বা ছুঁচোর ডাক সে জীবনে অনেক শুনেছে। এ-ডাকটা অনেকটা সেরকম হলেও হুবহু একরকম নয়। একটু যেন তফাত আছে।
পঞ্চানন্দ ফুটোটায় কান পাতল। এবার আর ছুঁচো বা ইঁদুরের ডাক বলে ভুল হল না। স্পষ্টই একটা যান্ত্রিক আওয়াজ। একটা কোনও সংকেত।
ফুটোর মধ্যে একটা দেশলাইকাঠির আগুন ধরলে ভিতরটা দেখা যেতে পারে মনে করে পঞ্চানন্দ ফুটোতে কান রেখেই দেশলাইয়ের জন্য জামার পকেট হাতড়াতে লাগল।
ঠিক এসময়ে খুব মোলায়েম হাতে কে যেন তার কানটা একটু মলে দিয়ে বলে উঠল, “এখানে কী হচ্ছে?”
আঁতকে উঠে পঞ্চানন্দ এমন একটা লাফ মেরেছিল যে, আর একটু হলেই হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ফেলত। লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে পঞ্চানন্দ মিটিমিটি চোখে চেয়ে দেখল, পাঁচ-সাতজন ছেলেছোঁকরা দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।
পঞ্চানন্দ বুদ্ধি হারাল না। একগাল হেসে গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই একটু দেখছিলাম আর কি!”
একটা কেঁদো চেহারার ছোঁকরা ধমক দিয়ে বলল, “এখানে দেখার আছেটা কী?”
পঞ্চানন্দ নির্বিকারভাবে বলল, “শুনেছিলাম বাড়িটা বিক্রি হবে। তাই অবস্থাটা একটু নিজের চোখে দেখে গেলাম আর কি। এ-অঞ্চলে একটা বাড়ি কেনার ইচ্ছে অনেক দিনের।”
কেঁদোটা এক পা এগিয়ে এসে গমগমে গলায় বলল, “আর এদিকে গজদার ঘরে জিনিসপত্র হাটকে আটকে রেখেছে কে?”
“আজ্ঞে, আমি না। গজ’র সঙ্গে দেখা করতেই আসা। সে আমার সম্পর্কে মাসতুতো ভাই হয়। গজ কোথায় গেছে তা আপনারা বলতে পারেন?”
ছেলেগুলো একটু মুখ-চাওয়াচায়ি করল। তারপর কেঁদোটা একটু হটে গিয়ে বলল, “আমরা গজদার কাছে কুস্তি শিখি। কিন্তু গজদাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আমরাও তাকে খুঁজছি।”
পঞ্চানন্দ খুব চিন্তিতভাবে বলল, “তা হলে তো বেশ মুশকিলই হল। গজ’র চিঠি পেয়েই আসা। সে-ই এ বাড়ির খবর দিয়েছিল কিনা।”
একটা ছেলে বলল, “আপনি কি সোজা স্টেশন থেকে আসছেন? তা হলে আপনার বাক্সটাক্স কোথায়?”
পঞ্চানন্দ খুব অমায়িক হেসে বলল, “গজ’র কাছে এসে উঠব, এমন আহাম্মক আমি নই। আমি উঠেছি ন্যাড়াদের বাড়িতে। ন্যাড়াকে বোধহয় আপনারা চেনেনও।”
‘ন্যাড়া!” বলে সকলে আবার মুখ-চাওয়াচায়ি করে।”
“আজ্ঞে। আমি হলুম গে হরিবাবুর ম্যানেজার। তাঁর বাবার আমল থেকেই যাতায়াত। মাঝখানে কয়েকটা বছর হিমালয়ে তপস্যা করতে যাওয়ায় সম্পর্কটা একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল।”
সকলে বেশ সম্ভ্রমের চোখে পঞ্চানন্দের দিকে তাকায়।
কেঁদো বলে, “তা দাদার নামটা কী?”
“পঞ্চানন্দ। ওটি সাধনমার্গের নাম। ওতেই ডাকবেন।”
“আমাদের মাপ করে দেবেন। খুব অন্যায় হয়ে গেছে।”
পঞ্চানন্দ উদার গলায় বলল, “করলাম।”
১৮.
ছেলেগুলো এসে পঞ্চানন্দকে একেবারে ঘিরে ধরল। ভারি লজ্জিত তারা। ষন্ডামতো একটা ছেলে বলল, “পঞ্চানন্দদা আমরা যে আপনার সঙ্গে বেয়াদপি। করে ফেলেছি সে কথা গজদাকে বলবেন না।”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “আরে না। তোমরা সবাই বুঝি গজ’র ছাত্র? বাঃ বাঃ। তা গজ একটু-আধটু-কুস্তি শিখেছিল বটে শেরপুরে থাকতে। আমিই শেখাতুম। অবশ্য আসল-আসল প্যাঁচগুলো শেখানোর সময়ই তো পেলাম না। হিমালয় থেকে আমার ডাক এসে গেল কিনা। তবে শুনেছি, গজ বেশ ভালই লড়েটড়ে।”
ছেলেগুলো একথায় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ষভাটা বলল, তা হলে আপনিই কেন আমাদের আজ একটু তালিম দেন না!”
পঞ্চানন্দ জিব কেটে বলল, “ও বাবা, গুরুর বারণ। ঠিক বটে, এক সময়ে যারা ধর্ম কর্ম করত, তারাই নানারকম শারীরিক প্রক্রিয়া আর কূট পাঁচ আবিষ্কার করেছিল। এই যেমন যুযুৎসু, কুংফু আসন। কিন্তু আমার গুরু আমাকে ও লাইনে একদম যেতে বারণ করেছেন। আসলে হল কী জানো?”
“কী পঞ্চানন্দদা?”
“যার সঙ্গেই লড়তে যাই তারই ঘাড় ভাঙে কি হাত ভাঙে কি ঠ্যাং ভাঙে। যত মোলায়েম করেই ধরি না কেন, একটা কিছু অঘটন ঘটেই যায়। সেবার তো গ্রেট এশিয়ান সার্কাসের হাতিটা খেপে বেরিয়ে পড়ল। বিস্তর লোক জখম হল তার পায়ের তলায় আর শুড়ের আছাড়ে। অগত্যা আমি গিয়ে হাতিটাকে সাপটে ধরলুম। ও বাবা, মড়াত করে দুটো পাঁজর ভেঙে হাতিটা নেতিয়ে পড়ল। তারপরই গুরু বারণ করলেন, ওরে তোর শরীরে যে স্বয়ং শক্তি ভর করে আছেন। আর কখনও কুস্তিটুস্তি করতে যাস না।”
ছেলেগুলো মুখ তাকাতাকি করতে লাগল। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে। না করলেও পঞ্চানন্দের ক্ষতি নেই। ছেলেগুলোকে অন্যমনস্ক রাখাটাই তার উদ্দেশ্য। হলঘরের ভিতর থেকে যে যান্ত্রিক শব্দটা আসছে সেটা ওদের কানে যাওয়াই ভাল। পঞ্চানন্দকে একাই ব্যাপারটা দেখতে হবে। ষটা বলল, “এক-আধটা প্যাঁচও কি শেখাবেন না দাদা?”
পঞ্চানন্দ গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “উপায় নেই রে ভাই। তবে এই বাড়িটা কিনে যদি সাধনপীঠ বানাতে পারি তখন দেখা যাবে।”
এ-কথায় ছেলেগুলো ফের মুখ-তাকাতাকি করল। কেঁদো চেহারার ছেলেটা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “দাদা, একটা কথা বলব? আপনি যদি ডাইরেক্টলি আমাদের না শেখান তা হলেও ক্ষতি নেই। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কুস্তি করব, আর আমাদের কোথায় ভুল হচ্ছে তা আপনি দেখেদেখে বলে দেবেন, তা হলে কেমন হয়?”
সব ছেলেই একথায় সায় দিয়ে উঠল। পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “সেটা মন্দ হবে না। তা তাই হোক।”
বাড়ির পিছন দিকটায় মাটি কুপিয়ে কুস্তির আখড়া হয়েছে। ছেলেরা সেখানে একটা গাছতলায় পঞ্চানন্দকে বেশ খাতির করে বসিয়ে নিজেরা দঙ্গলে নামল।
পঞ্চানন্দ খুব মাথা নাড়তে লাগল কুস্তি দেখে। এক-এক বার বলে ওঠে, “উহুঁহুঁ, হল না। পা-টা একটু কেতরে নিয়ে বল্টান মারতে হয়……আরে আরে, ওরকম পটকান দিতে হলে যে শিরদাঁড়া শক্ত রাখতে হয়……আহা হা, ওরকম ঠেলাঠেলি করলে চলে? পট করে কঁধ ছেড়ে কোমরটা ধরে নাও এইবেলা….ওটা কী হল হে? ছ্যা, ছ্যা, গজটা যে একেবারে কিছুই শেখায়নি তোমাদের!”
ঘন্টা দেড়েক এরকম চালিয়ে পঞ্চানন্দ ছুটি পেল। ঝিমঝিম করছে দুপুর। পঞ্চানন্দ পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকে আবার সেই হলঘরটার দিকে এগোল।
হঠাৎই সাক্ষাৎ এক ডাইনিবুড়ি কোত্থেকে যে বকবক করতে করতে এসে উদয় হল, তা বলা শক্ত। তবে পঞ্চানন্দ একটা থামের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে পরিষ্কার শুনতে পেল বুড়িটা আপনমনে গজগজ করছে, “রোজ আমি হিরুকে এইখানে ঘাস খেতে বেঁধে রেখে যাই, লক্ষী ছাগল আমার কোনওদিন পালায় না। আজ কোন অলপ্লেয়ে যে বাছাকে আমার গেরাস করতে এল গো!”
বলতে-বলতে বুড়ি হাঁটপাট করে চারদিকে ঘুরছিল। শনের মতো সাদা চুল, শরীরের চামড়ায় শতেক আঁকিবুকি, মুখোনা শুকনো, চোখ গর্তে, হাতে একখানা গাঁটওলা লাটি।
পঞ্চানন্দ একটু গলাখাঁকারি দিল।
“কে রে? কোন মুখপোড়া? হিরিকে কি তুই গেরাস করেছিস রে ড্যাকরা? আয়, সামনে আয় তো!”
পঞ্চানন্দ একবার বলবার চেষ্টা করল,”আমি নয় গো, আমি নয়।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! বুড়ি একেবারে লাঠি উঁচিয়ে ধেয়ে আসতে আসতে বলল, “তুই না তো কে রে মুখপোড়া? তোর মুখ দেখলেই তো বোঝা যায় গোরু-ছাগল চুরি করে করে হাত পাকিয়ে ফেলেছিস। চোখ দেখলেই তো
বোঝা যায় তুই এক নম্বরের পাজি। তোকে আজ ঝেটিয়ে বিষ নামাব……”
পঞ্চানন্দ পিছু ফিরে চো-চোঁ দৌড় দিল। এ-কাজটা সে খুব ভাল পারে। দৌড়ে একেবারে হরিবাবুদের বাড়ির কাঁঠালতলায় এসে পঞ্চানন্দ হাঁফ ছাড়ল, “খুব বাঁচা গেছে বাপ্। ওঃ, বুড়িটা কী তাড়াই না করেছিল!”
জামা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে পঞ্চানন্দ ধীরেসুস্থে বাড়িতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ কাঁক করে কে যেন তার গর্দানটা বাগিয়ে ধরল খিড়কির দরজার কপাটের আড়াল থেকে।
“দাদা, এই লোকটাই।”
পঞ্চানন্দ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “আমি না। কালীর দিব্যি, আমি কিছু করিনি।”
আংটি বলল, “তুমি নয় তো কে চাঁদু? কাল মাঝরাতে দাদুর ল্যাবরেটরির কাছে ঘুরঘুর করছিলে, দেখিনি বুঝি?”
কপাটের আড়াল থেকে আর-একজনও বেরিয়ে এল, ঘড়ি। খুব ঠান্ডা চোখে পঞ্চানন্দকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, “খুব গুলগপ্পো ঝেড়ে আমার বাবাকে বশ করে ফেলেছ কেমন?”
পঞ্চানন্দ অমায়িক হেসে বলল, “আজ্ঞে, অনেক কথার মধ্যে এক-আধটা বেফঁস মিথ্যে কথা বেরিয়ে যেতে পারে বটে, কিন্তু সে তেমন না ধরলেও চলে। হরিবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, আমি তাঁকে আগেভাগেই সাবধান করে দিয়েছিলুম কি না যে, লোক আমি তেমন সুবিধের নই।”
“বটে! তা হলে তো ধর্মপুর যুধিষ্ঠির। বাবাকে একটা চাবি দিয়েছ শুনলাম, আর নাকি গুপ্তধনের সংকেত!”
জিব কেটে পঞ্চানন্দ মাথা নাড়ল, “আজ্ঞে ওসব বুজরুকি কারবার আমার কাছে পাবেন না। গুপ্তধনের কথা শিবুবাবু আমাকে বলতে বলেননি, আমিও বলিনি।”
“তাহলে কথাটার মানে কী?”
পঞ্চানন্দ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “ সে কি আমিই জানি? যেমন শুনেছি তেমনি বলেছি। তা ঘাড়খানা এবার ছেড়ে দিলে হয় না? বড় টনটন করছে। আমার আবার একখানা বই দু’খানা ঘাড় নিই।”
আংটি একটু হেসে একখানা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘাড়টা ছেড়ে বলল, “একটা কথা শুনে রাখো। আমার বাবা বেজায় ভাল মানুষ। তাকে যদি বোকা বানানোর চেষ্টা করো, তা হলে মাটিতে পুঁতে ফেলব ওই কেয়াঝোঁপের তলায়।”
পঞ্চানন্দ উদাস মুখে বলল, “তিনটে লাশ ছিল, চারটে হবে।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে সে এক বৃত্তান্ত। কিন্তু আপনাদের যা ভাবগতিক দেখছি, বেশি বলতে ভরসা হয় না। হয়তো দিলেন কষিয়ে একখানা ঘুসো!”
ঘড়ি গম্ভীরভাবে বলল, “গুলগপ্পো যারা মারে তাদের মাঝে-মাঝে ঘুসো খেতেই হবে। এবার বলো তো চাঁদু, মাঝরাত্তিরে দাদুর ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ঢুকেছিলে কেন?”
“আজ্ঞে ওই গজটার জন্য। কতবার পইপই করে বলেছি, ওরে গজ, মানুষ হ। পরে বাড়িতে ঢুকে ওসব করা কি ঠিক? তা ভাল কথায় কবেই বা কান দিয়েছে?”
“গজ মানে কি গজ-পালোয়ান? সে কেন আমাদের বাড়িতে ঢুকবে?”
“সেইটেই তো কথা। পেত্যয় না হয় ন্যাড়াবাবুর কাছ থেকেই শুনে নেবেন’খন।”
ঘড়ি ঠাণ্ডা চোখে আবার একবার তাকে জরিপ করে নিয়ে বলল, “তোমার স্যাঙাতরা কারা ছিল?”
“স্যাঙাত! আজ্ঞে কোনওকালেই আমার স্যাঙাত-ট্যাঙাত নেই। বারবার একাবোকা ঘুরে বেড়াই।”
“তবে কেয়াঝোঁপের আড়াল থেকে তিনটে লোক যে বেরিয়ে এল, তারা কি ভূত?”
পঞ্চানন্দ তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “ও কথা বলবেন না। এখনও বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে। একেবারে জলজ্যান্ত তেনারা। আমার হাত দুয়েকের ভিতর দিয়েই হেঁটে গেলেন। গায়ে সেই বোঁটকা গন্ধ, উলটো দিকে পা, হাওয়ায় ভর দেওয়া শরীর….ওরে বাবা! ভাবতেও ভয় করে।”
ঘড়ি ভ্রূ কুঁচকে চিন্তিতভাবে পঞ্চানন্দের দিকে চেয়ে বলল, “আমরা ভূতটুত মানি না। ওসব বুজরুকি আমাদের দেখিও না। দাদুর ল্যাবরেটরির দিকে অনেকের নজর আছে, আমরা জানি। কিন্তু আমরাও বোকা নই, বুঝলে? ওই তিনটে লোক তোমারই দলের।”
পঞ্চানন্দ খুব গম্ভীর হয়ে বলল, “আজ্ঞে ভূত যদি নাও হয়, তা হলেও আমার সঙ্গে তাদের কোনও সাঁট নেই। তবে ওইখানে তিনটে লাশ বহুঁকাল আগে আমি আর শিবুবাবু মিলে পুঁতেছিলুম। তিনটেই সাহেব। গায়ে-গতরে পেল্লায়। বিশ্বাস না হলে জরিবাবু বা হরিবাবুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
ঘড়ি বলল, “লাশ এল কোথা থেকে?”
পঞ্চানন্দ দু’পা হটে বলল, “আজ্ঞে রদ্দা-ফদ্দা চালিয়ে বসবেন না যেন। এই সময়টায় আমার বড় খিদে পায়। আর খিদের মুখে মারধোর আমার সয় না।”
“ঠিক আছে, মারব না। বলল।”
“আজ্ঞে শিবুবাবু নিজের জান বাঁচাতে ওই তিন সাহেবকে খুন করেন। তারপর আমরা ধরাধরি করে……
“মিথ্যে কথা!”
“আজ্ঞে খুনটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তবে কিনা নিজের জান বাঁচাতে খুন করলে সেটা খুনের মধ্যে ধরা যায় না।”
‘জান বাঁচাতে কেন? ওরা কি দাদুকে মারতে চেয়েছিল?”
পঞ্চানন্দ বলল, “সে কে আর না চাইত বলুন। শিবুবাবু মরলে অনেকেরই সুবিধে ছিল।”
“খোলসা করে বলো।”
পঞ্চানন্দ বলল, “বলব’খন। আগে চানটান করে দুটো মুখে দিয়ে নিই, পিত্তি পড়লে আবার অনর্থ হবে’খন।”
কী ভেবে, যেন ঘড়ি আর আংটি এ-প্রস্তাবে আপত্তি করল না। বলল, ঠিক আছে।”
১৯.
হরিবাবুর খোকা দুটি যে বিশেষ সুবিধের নয়, তা পঞ্চানন্দ লহমায় বুঝে গেল। ওদের একজন হল গোমড়ামুখো গুণ্ডা, অন্যটা ছ্যাবলা গুণ্ডা। ছ্যাবলাদের তেমন আমল না দিলেও চলে, কিন্তু গোমড়াগুলোই ভয়জনক। কখন কী ভাবছে তা মুখ দেখে টের পাওয়া যায় না। তবে যতই গুণ্ডা হোক, পঞ্চানন্দ লক্ষ্য করেছে যে, ওরা ওদের বাপকে সাঙ্ঘাতিক ভয় পায়।
চানটান করে পঞ্চানন্দ যখন গিয়ে খেতে বসল, তখন দুপুর বেশ গড়িয়ে গেছে। এ-সময়ে গরম ভাতের আশা বৃথা। পঞ্চানন্দ ধরে নিয়েছিল, ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত আর তলানি কিছু ডাল তরকারি জুটতে পারে।
কিন্তু খেতে বসার পর বামুনঠাকুর যখন ধোঁয়া-ওঠা ভাত আর গরম-গরম ডাল-তরকারি আর মাছের ঝোলের বাটি সাজিয়ে-দিল, তখন রীতিমত অবাক। ভাত ভাঙতে ভাঙতে বলল, “জরুরি একটা কাজে গিয়েছিলাম কিনা, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।”
রাঁধুনি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তাতে কী বাবু? ওরকম হয়েই থাকে।”
পঞ্চানন্দ খেতে-খেতে বলল, “শেষপাতে একটু দই না হলে আবার আমার তেমন জুত হয় না।”
“আজ্ঞে, আছে। দই, কলা, চিনি সব সাজিয়ে রেখেছি।”
“বাঃ বাঃ, তুমি তো কাজের লোক হে। নাঃ, বাবুকে বলে তোমার মাইনেটা দু’পাঁচ টাকা বাড়িয়ে না দিলেই নয়।”
রাঁধুনি লাজুক মুখ করে একটু হাসল। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আপনি যে কী একটা পুঁটুলি আমার কাছে রাখবেন বলেছিলেন?”
পঞ্চানন্দ চট করে একটু ভেবে নিল। কখন কাকে কী বলে, তা তার হিসেবে থাকে না। হঠাৎ তার মনে পড়ল। রাত্রে এরকম একটা কথা বলেছিল বটে রাঁধুনিকে। মনে পড়তেই একটু হেসে বলল, “কথাটা বলে ভালই করেছ। পুঁটুলিটা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সোনাদানা কিছু তার মধ্যে আছে বটে, তবে বেশি নয়। বারো চোদ্দ ভরি হবে মেরেকেটে। শেরপুরের রাজা একখানা মুর্গির ডিমের সাইজের হিরে দিয়েছিল একবার আমার গান শুনে। সেটাও বোধহয় আছে। কিন্তু ওগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই রে ভাই। সন্ন্যাসী-বৈরাগী মানুষ আমি, ওসব দিয়ে কী-ই বা হবে। তবে হিমালয়ে থাকতে একবার খাড়াবাবার ডাক এল মানস-সরোবর থেকে। গিয়ে পড়তেই খাড়াবাবা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “ওরে পঞ্চা, আমি হলাম গিয়ে খাড়া-সন্ন্যাসী, বসা বা শোওয়ার জো নেই, দিনরাত একঠ্যাং বা দু’ঠ্যাঙে ভর করে খাড়া হয়ে সাধন-ভজন করতে হয়। কিন্তু একটা বেওকুফ ভূত এসে সারাক্ষণ আমার ঠ্যাং ধরে টানাটানি করে, পায়ে সুড়সুড়ি দেয়, হাঁটুতে গুঁতোয়। একটা ব্যবস্থা কর বাবা। তা তখন মন্ত্র পড়ে চারদিকে বন্ধন দিয়ে ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় একটা পলো দিয়ে তো ভূতটাকে পাকড়াও করলাম। ভারি নচ্ছার ভূত, ছাড়া পেলেই চারদিক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করে বেড়াবে। তাই একটা কৌটোয় ভরে পুঁটুলিতে রেখে দিয়েছি।”
রাঁধুনি আঁতকে উঠে বলল, “ও বাবা!”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “ভয়ের কিছু নেই, আমি তো আছিই। তবে পুঁটুলিটা হুট করে খুলেটুলে ফেলো না। নাড়াচাড়ায় কৌটোর ভূত যদি জেগে যায়, আর বোঝে যে আনাড়ির হাতে পড়েছে, তা হলেই কিন্তু কুরুক্ষেত্র করে ছাড়বে।“
রাঁধুনি মাথা চুলকে বলল, “পুঁটুলিটা বরং আপনার কাছেই থাক। আমি বরং দইটা নিয়ে আসছি।”
বলে রাঁধুনি পালাল।
খাওয়াটা মন্দ হল না পঞ্চানন্দের। ঢেকুর তুলে তৃপ্ত মুখে উঠে সে আঁচিয়ে নিল। তারপর গিয়ে জরিবাবুর ঘরে ঢুকল।
জরিবাবু কলেজে পড়ান। এসময়টায় ঘরে থাকেন না। পঞ্চানন্দ নিজেই একখানা পান সেজে মুখে দিল। তারপর শুয়ে একটু গড়াল।
যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন জরিবাবু ফিরেছেন এবং সন্তর্পণে জামাকাপড় পাল্টাচ্ছেন। তাকে দেখে একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “ইস্, আপনার ঘুমটা বোধহয় ভেঙে দিলাম।“
পঞ্চানন্দ অবাক হয়ে বলল, “ঘুম! ঘুমটা কোথায় দেখলেন? গত তেইশ বছর আমার ঘুম কেউ দ্যাখেনি। ঘুমের মতো যা দ্যাখেন তা হল যোগনিদ্রা। মনটাকে কৃটস্থে ফেলে ধ্যান করতে করতে সূক্ষ্ণদেহে বেরিয়ে পড়ি আর কি! কখনও বিলেত ঘুরে আসি, কখনও উত্তর-মেরু চলে যাই, যখন যেখানে প্রয়োজন মনে হয়। দে তো হামেশাই যেতে হয়। মঙ্গলগ্রহে, শুক্রে, বৃহস্পতিতে, কোথায় ডাক না পড়ে বলুন।”
জরিবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু আপনার যে নাক ডাকছিল।”
পঞ্চানন্দ খুব উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলল, “মুশকি কী জানেন? দেহ ছেড়ে আমি যখন বেরিয়ে পড়ি, তখন দেহটা একেবারে মড়ার মতো হয়ে যায়। শ্বাস চলে না নাড়ি থেমে যায়। লোকে ভাবে, সত্যিই বুঝি পঞ্চানন্দ পটল তুলেছে। একবার তো কাশীতেই ওই অবস্থায় আমাকে মড়া ভেবে দাহ করতে মণিকর্ণিকায় নিয়েও গিয়েছিল। ভ্যাগ্যিস সময়মতো নেবুলাটা চক্কর মেরে ফিরে এসেছিলাম। নইলে হয়ে যেত। শরীর গেলে ভারি অসুবিধে। সেই থেকে করি কী, সূক্ষ্মদেহে বেরিয়ে পড়ার আগে নাকটাকে চালু রেখে যাই। ওটা ডাকলে আর কেউ মরা মানুষ বলে ভাববে না।”
জরিবাবুর খুবই কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করতে। কয়েকবার ঢোঁক গিললেন, ঠোঁট কামড়ালেন, গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর বললেন, “তা ভাল, বেশ ভাল।”
পঞ্চানন্দ একটা হাই তুলে বলল, “তা আজও একটা চক্কর মেরে এলুম।”
জরিবাবু এত অবাক হয়েছেন যে, গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। খানিক বাদে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে?”
পঞ্চানন্দ আড়মোড়া ভেঙে বলল, “বেশি দূর যেতে হল না। ভেবেছিলুম, একবারে ব্রহ্মলোকের সাত নম্বর সিঁড়িতে গিয়ে শিবুবাবুকে ধরব।”
“সাত নম্বর সিঁড়ি?”
পঞ্চানন্দ খুবই উচ্চাঙ্গের একখানা হাসি হেসে বলল, “শিবুবাবু একেবারে ব্রহ্মলোকের দোরগোড়াতেই পৌঁছে গেছেন বলা যায়। আর সাত ধাপ উঠলেই সাক্ষাৎ-ব্ৰহ্মলোক। তবে কিনা যত কাছাকাছি হবেন ততই ওঠা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। শুনতে সাত ধাপ বটে, কিন্তু ওই সাত ধাপ পেরোতেই হয়তো লাখ লাখ বছরের তপস্যা লেগে যাবে। তবে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠেছেন অনেকটা। তা ভাবলাম সেখানেই চলে যাই। জায়গাটা বেশ সাফসুতরো, নির্জন, সিঁড়ির ধাপে বসে দুটো সুখ-দুঃখের কথাও কয়ে আসি আর বাড়ির সব খবরটবরও দিয়ে আসি। শুনে শিবুবাবু খুশি হবেন। তা অতদূর আর যেতে হল না। কৈলাশটা পেরোতে দেখি, শিবুবাবু নিজেই হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ওরে পঞ্চা, আমার বাড়িতে গিয়েছিস সে খবর পেয়েছি। বলি ওরা তোকে খাতিরযত্ন ঠিকমতো করছে তো! খাওয়া-শোওয়ার কোনও অসুবিধে নেই তো! এই শীতে গায়েই বা দিচ্ছিস কী?”
জরিবাবু চোখ গোল করে তাকিয়ে রইলেন।
পঞ্চানন্দ আড়চোখে ভাবখানা লক্ষ্য করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “আমি আর কী বলি! বললুম, ভালই আছি। কিছু কিছু অসুবিধে সে তো হতেই পারে। তখন শিবুবাবু ভারি দুঃখ করে বললেন, “ওরে পঞ্চা, আমার বড় ছেলেটাকে খরচের খাতায় লিখে রেখেছি, মেজোটাও বোধহয় মানুষ হল না, সেজোটা পুলিশে ঢুকে গোল্লায় গেছে, ছোটটা তো গবেট। তা তুই যখন গিয়ে পড়েছিস সেখানে, আমার ছেলেগুলোকে একটু দেখিস বাবা।”
জরিবাবু কী একটা বলবেন বলে হাঁ করেছিলেন, কিন্তু স্বর ফুটল না।
পঞ্চানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পরের বেগার খেটে-খেটে পঞ্চানন্দর আর নিজের জন্য কিছু করা হয়ে উঠল না। দুনিয়াটার নিয়মই এই। তা চায়ের ব্যবস্থাটা এ-বাড়িতে কীরকম বলুন তো জরিবাবু? পাঁচটা বাজতে চলল যে! এরপর চা খাওয়া যে শাস্ত্রে বারণ।”
জরিবাবু শশব্যস্তে বললেন, “দাঁড়ান দেখছি।”
পঞ্চানন্দ মোলায়েম স্বরে বলল, “খালি পেটে চা খাওয়াটা কিন্তু মোটেই কাজের কথা নয়। গোটাকতক ডিমভাজা আর মাখন-টোস্টেরও ব্যবস্থা করে আসবেন।“
জরিবাবুর ব্যবস্থায় চা এল, টোস্ট আর ডিমভাজা এল। পঞ্চানন্দ খেয়েদেয়ে উঠে ঢেকুর তুলে বলল, “এবার একখানা পান লাগান।”
পান চিবোতে চিবোতে পঞ্চানন্দ যখন জরিবাবুকে ছেড়ে হরিবাবুর সন্ধানে দোতলায় এল, তখন হরিবাবুর বাহ্যজ্ঞান নেই। টেবিলে স্থূপাকৃতি খাম, পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড। তিনি পোস্টকার্ডের পর পোস্টকার্ডে কবিতা লিখে চলেছেন।
পঞ্চানন্দ একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আজ্ঞে কাজ তো বেশ এগোচ্ছে দেখছি।”
হরিবাবু মুখ তুলে খুব পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “অফিসের পথেই ডাকঘর। নিজেই পঞ্চাশ টাকার কিনে আনলাম। আইডিয়াটা বেশ ভালই হে।”
পঞ্চানন্দ একটু চাপা গলায় বলল, “এসব কাজ করার সময় দরজাটা এঁটে নেবেন ভালমতন। গিন্নি-মা যদি দেখে ফেলেন তবে কিন্তু কুরুক্ষেত্তর হবে।”
“তা বটে, ওটা আমার খেয়াল হয়নি। আচ্ছা পঞ্চানন্দ, এই ধরো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রীকে যদি চিঠিতে কবিতা পাঠাই, তবে কেমন হয়?”
“সে তো খুবই ভাল প্রস্তাব। তাদের হাতেই তো সব কলকাঠি। কবিতা পড়ে যদি কাত হয়ে পড়েন তো আপনার কপাল খুলে গেল। সভাকবি-টবিও করে ফেলতে পারেন।”
‘দূর! সভাকবি আজকাল আর কেউ হয় না।”
“নিদেন দরবারে তো ডাক পড়তে পারে। চাই কি নোবেল প্রাইজের খাতায় আপনার নাম তুলবার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যাবেন তিনজনে।”
হরিবাবু একটু ব্যথিত হয়ে বললেন, “নোবেল প্রাইজের কথা থাক। এ-দেশের সম্পাদকরাই আমার কবিতা ছাপল না, তো নোবেল প্রাইজ। তবে আমি ঠিক করেছি নিজের খরচে একখানা কবিতার বই ছেপে বের করব।”
“সে তো হেসে-খেলে হবে। টাকাটা ফেলে নিশ্চিন্তে কবিতা লিখে যান, ছাপাখানা থেকে দফতরির বাড়ি দৌড়োদৌড়ি যা করার আমিই করব। তা আজ
এক-আধখানা কবিতা নামিয়েছেন। একখানা ছাড়ন শুনি।”
“শুনবে!” বলে একটু লজ্জার হাসি হাসলেন হরিবাবু। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন :
কবিতা কখনও ক্ষমা করে না কবিরে।
ক্ষমা পায় হত্যাকারী, ক্ষমা লভে চোর,
ডাকাত, মস্তান আর যত ঘুষখোর–
সিক্ত হয় ক্ষমারূপ বৃষ্টিবারিধারে।
কবির বাগানে নাচে প্রেত, ডাকে তারে
মরীচিকা। তা-ই কাব্য যমের দোসর।
কবিরে শোষণ করে, দিয়ে দেয় গোর।
কবিতা কখনও ক্ষমা করে না কবিরে।
২০.
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে-নেড়ে শুনছিল। বলল, “আবার একবার পড়ুন তো!”
পুলকিত হরিবাবু আবার পড়লেন।
পঞ্চানন্দ কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে বলল, “চোখের জল রাখা যায় না। আহা, কী জিনিসটা লিখেছেন! বুকটা যেন খাঁ-খাঁ করে ওঠে, জিব শুকিয়ে যায়, আর তেষ্টায় যেন ছাতি ফাটতে থাকে।”
হরিবাবু বিনয়ে মাথা চুলকোলেন।
পঞ্চানন্দ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বলল, “নাঃ তেষ্টাটা বড্ড চেপে বসেছে বুকে। তা হরিবাবু, বলে আসব নাকি চায়ের কথাটা? সঙ্গে একটু ঝাল চানাচুর!”
হরিবাবু প্রশংসায় এমনই বিগলিত হয়ে পড়েছিলেন যে ফশ করে বলে বসলেন, “আহা, শুধু ঝাল চানাচুর কেন, বেশ গরম গরম কড়াইশুটির কচুরি ভাজছে ভজুয়ার দোকানে। রেমোটাকে পাঠাও, এনে দেবে।”
এ-কথায় পঞ্চানন্দ আর একবার চোখ মুছে উঠে গেল। কচুরি আর চায়ের ব্যবস্থা করে ফিরে এসে বেশ গম্ভীর মুখে সে বলল, “এ দেশটার কিছু হল না কেন জানেন? ভাল জিনিসের সমঝদার নেই বলে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বা আকবরের আমল হলে আপনি নির্ঘাত সভাকবি হয়ে বসতেন!”
হরিবাবু খুব লাজুক মুখে হাসতে লাগলেন।
পঞ্চানন্দ নিমীলিত নয়নে খাটের তলায় একখানা তালা-দেওয়া তোরঙ্গকে লক্ষ্য করতে করতে বলল, “অবশ্য পঞ্চানন্দ তা বলে হাল ছাড়বে না। কাল সকালে শ-দুয়েক টাকা একটু গোপনে আমার হাতে দিয়ে দেবেন তো। কিছু খাম-পোস্টকার্ড কিনে ফেলব’খন, আর পোস্টারের ব্যবস্থা করতে হবে। খরচটা নিয়ে বেশি ভাববেন না। পেটের পুজো তো অনেকেই করে, কাব্যলক্ষ্মীর পুজো
অনেক উঁচুদরের ব্যাপার। খরচটা গায়ে মাখলে তো চলবে না।”
হরিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “বটেই তো। তা টাকাটা তুমি এখনই নিয়ে রাখতে পারো।”
জিব কেটে পঞ্চানন্দ বলল, “না, না, আমাকে অত বিশ্বেস করে বসবেন। লোক্টা আমি তেমন সুবিধের নই। টাকা হাতে এলেই লোভ চাগাড় দেয়। আর লোভ থেকে কত কী হয়। ও কাল সকালেই দেবেন’খন।”
হরিবাবু খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে খুব সংকুচিত গলায় বললেন, “তা ইয়ে, বলছিলাম কী, আরও গোটাকয় পড়ব নাকি?”
পঞ্চানন্দ একটু আঁতকে উঠে বলল, “আজ্ঞে, ভাল জিনিসের বেশি কিন্তু তল নয়। ধরুন পোলাও মাংস খাচ্ছেন, গুচ্ছের খেয়ে ফেললে কিন্তু পেট ভারী আইটাই হতে থাকে। আর তাতে সোয়াদটাও তো পাওয়া যায় না। এই যে একখানা শোনালেন, এইটে মাথায় অনেকক্ষণ ধরে রেখে, গোরুর মতো মাঝে মাঝে উগরে এনে জাবর কেটে যতটা আনন্দ হবে, এক গুচ্ছের শুনলে ততটা হওয়ার নয়।”
হরিবাবু ম্লানমুখে বললেন, “তা বটে। তা হলে আজ থাক।”
রেমো কচুরি আর চা দিয়ে গেল। পঞ্চানন্দ নিমীলিত চোখে কাঠের আলমারির মাথায় রাখা একখানা চামড়ার সুটকেসকে লক্ষ্য করতে করতে কচুরি আর চা শেষ করে উঠে পড়ল। বলল, “যাই আজ্ঞে, কবিতাটা নিয়ে শুয়ে শুয়ে একটু ভাবি গে।”
পঞ্চানন্দ বেরিয়ে পড়ল। সাবধানী লোক। সে আগেই দেখে নিল বাড়ির কে কোথায় রয়েছে এবং কী করছে। হরিবাবুর গিন্নি এই সময়ে পুজোর ঘরে থাকেন। কাজেই ওদিকটায় নিশ্চিন্ত। জরিবাবু তানপুরা চেপে ধরে রেওয়াজ করছেন, আরও ঘণ্টা-দুই চলবে। ন্যাড়া ঘরে নেই, আড্ডা মারতে বেরিয়েছে। ঘড়ি আর আংটি সন্ধেবেলা এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পড়তে যায়। চারদিকটা দেখে নিয়ে পঞ্চানন্দ জরিবাবুর ঘরে ঢুকে বিনা বাক্যব্যয়ে তার টর্চবাতিটা তুলে নিল। জরিবাবু চোখ বুজে রেওয়াজ করছেন, লক্ষ্য করলেন না। পঞ্চানন্দ বেরিয়ে এসে সাবধানে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর সদর খুলে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিল।
চকসাহেবের বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছল পঞ্চানন্দ, তখন চারদিকটা অন্ধকার আর কুয়াশায় একেবারে লেপৌঁছে গেছে। চার হাত দূরের বস্তু ঠাহর হয় না। পঞ্চানন্দও এরকম পরিস্থিতিই পছন্দ করে।
সামনের দিক দিয়ে কোনও বাড়িতে ঢোকা বিশেষ পছন্দ করে না পঞ্চানন্দ। ঘুরপথে, হাঁটুভর কাটা-জঙ্গল ভেদ করে একবারও টর্চ না জ্বেলে সে দিব্যি পিছনের বাগানে পৌঁছল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটু হিসেব-নিকেশ করে নিল সে। তারপর আন্দাজের ওপর ভরসায় ধীরে-ধীরে ভাঙা বাড়িটায় ঢুকে পড়ল।
একটু-আধটু হোঁচট, দু একটা দেয়ালের গুঁতো আর দু-একবার শেয়ালের। ডাক কি ছুঁচোর চাঁচানিতে চমকে ওঠা ছাড়া তেমন বিশেষ কোনও বাধা পেল না সে। হলঘরটার কাছ-বরাবর পৌঁছে কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে অপেক্ষা করল সে।
এদিকটায় একেই জনবসতি নেই, তার ওপর শীতের রাত বলে ভারি নিঝুম। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে একটানা যান্ত্রিক শব্দটা বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
পঞ্চানন্দের চোখে অন্ধকার সয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল। তারপর সাবধানে দেওয়ালের সেই ফোকরে চোখ রাখল।
প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না পঞ্চানন্দ। ঘরটা বেজায় বড়, ফোকরটা নিতান্তই ছোট। তবে অনেকক্ষণ চোখ পেতে রাখার পর ঘরের বাঁ ধারে একটা নীলচে আলোর আভা দেখতে পেল সে। আর কিছু নয়।
পঞ্চানন্দ বুঝল, এই ফোকরটা দিয়ে এর বেশি আর কিছু দেখা যাবে না। সুতরাং খুব সাবধানে সে ফোকরটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইটগুলো নেড়েচেড়ে দেখল যদি কোনওটা খুলে আসে। খানিকক্ষণ চেষ্টার পর বাস্তবিকই একটা ইট একটু নড়ল। পঞ্চানন্দের হাত মাখনের মতো কাজ করে। হঁটটা সামান্য চেষ্টাতেই সে নিঃশব্দে খুলে ফেলতে পারল। ফোকরটা এবার আর একটু বড় হয়েছে। পঞ্চানন্দ চারপাল্টা সতর্ক চোখে একবার দেখে নিয়ে ফোকরের মধ্যে উঁকি মারল।
হলঘরটা বাস্তবিকই বিশাল। বাঁ দিকের শেষ প্রান্তে নীলচে আলোটা জ্বলছে। ভারি নরম আর মোলায়েম আলো। এত মৃদু যে ভাল করে ঠাহর না করলে মালুমই হয় না।
পঞ্চানন্দ হাত দিয়ে ফোকরের আর একটা অংশ সাবধানে ভেঙে গর্তটা অল্প একটু বাড়াতে পারল।
এবার নজরে পড়ল, ঘরের বাঁ দিকের শেষ প্রান্তে একটা বড় টেবিল। তার ওপর ফুটবলের চেয়ে একটু বড় সাইজের একটা গ্লোবের মতো বস্তু। সেই গ্লোবের মতো গোলকটা থেকেই নীল আলো ছড়িয়ে পড়ছে। টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে একজন লোক গা ছেড়ে বসে আছে। বেশ মজবুত তার চেহারা। কাধখানা বিশাল। একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে গোলকটার দিকে চেয়ে আছে।
গোলকটা খুবই বিস্ময়কর। পঞ্চানন্দের অভিজ্ঞ চোখেও এরকম জিনিস এর আগে আর কখনও পড়েনি। কালচে নীল সেই গোলকটার মধ্যে বিন্দু বিন্দু সব আলো মিটমিট করে জ্বলছে। কোনওটা লাল, কোনওটা হলুদ, কোনটা বা সাদা। ছোট বড় মাঝারি নানা রকম আলোর বিন্দু। কিছুই না বুঝে পঞ্চানন্দ একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তবে সে আহাম্মক নয়। মাঝে-মাঝে সে চোখ ফিরিয়ে সে নিজের চারদিকটা সতর্ক চোখে দেখে নিচ্ছিল।
ঘরের ভিতর অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। গোলকের সামনে লোকটা চুপ করে বসে আছে। প্রায় আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ ঘরের ডান দিকের অন্ধকার থেকে চি-ই-চিক চি-ই-চিক শব্দটা পালটে গিয়ে একটা রাগী বেড়ালের ঘ্যাঁও-ঘ্যাঁও শব্দ হতে লাগল। পঞ্চানন্দ একটু চমকে গেলেও চট করে সামলে নিল নিজেকে। অবিকল রাগী বেড়ালের শব্দ হলেও পঞ্চানন্দের অভিজ্ঞ কান টের পেল, এটাও একটা যন্ত্রেরই শব্দ। বাইরে থেকে লোকে আলটপকা শুনলে বুঝতে পারবে না।
পঞ্চানন্দ নিবিষ্ট মনে ভিতরের আবছায়া ঘরখানার মধ্যে চোখ পেতে রইল। আচমকাই সে দেখতে পেল, ডান ধারের অন্ধকার থেকে লম্বা সিঁড়িঙ্গে চেহারার একজন লোক এগিয়ে এল। বাঁ ধারে যেখানে পাথরের মতো লোকটা বসে গোলকের দিকে চেয়ে আছে, সেদিকে এগিয়ে গেল লোকটা। হাতে একটা টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট। লোকটা নিঃশব্দে টেবিলের ওপর ক্যাসেটটা রেখে বশংবদ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
মজবুত চেহারার লোকটা ক্যাসেটটা তুলে নিয়ে টেবিলের তলায় কোনও একটা যন্ত্রে ফিট করল। তারপর খুট করে একটা শব্দ হল। পঞ্চানন্দ দেখল, টেবিলের ওপর নীলচে গোলকটার রং পালটে সাদা হয়ে যাচ্ছে। ফুটকিগুলোর বদলে কতগুলো কিম্ভুত রেখা ফুটে উঠছে তাতে। লম্বা এবং আড়াআড়ি রেখাগুলো দ্রুত ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য রকম সব রেখা আসছে। লাল, বেগুনি, হলুদ।
কিছুক্ষণ এরকম চলার পর জোয়ান লোকটা মুখ তুলে ঢ্যাঙা লোকটাকে অস্ফুট স্বরে কিছু বলল। ভাষাটা বাংলা কি না তা ধরতে পারল না পঞ্চানন্দ। তবে কান খাড়া করে রইল।
ঢ্যাঙা লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আজ রাতেই।”
জোয়ান লোকটা আবার একটা সুইচ টিপল টেবিলের তলায়। গোলকটা আগের মতো নীল হয়ে গেল।
নিরিখ-পরখ করে পঞ্চানন্দের মনে হল, গোলকটা খুব সাধারণ জিনিস নয়। খুবই আজব একটা কল। কল না বলে আয়না বলাই বোধহয় ঠিক হবে। কারণ গোলকটার মধ্যে যা ফুটে উঠছে তা আকাশের ছবি। ফুটকিগুলো হচ্ছে তারা। ছোট একটা গোলকের মধ্যে গোটা আকাশটাকে যেন ভরে রাখা হয়েছে।
জোয়ান লোকটাকেও খুব খর চোখে লক্ষ্য করল পঞ্চানন্দ। বেশ লম্বা-চওড়া শক্ত কাঠামোর চেহারা। ঠিক এইরকম চেহারার একটা লোকের বিবরণই সে পেয়েছে। যদি এই লোকটাই সে লোকটা হয়, তবে এর ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন। বিবরণে আছে : নোকটা ঘন্টায় একশো মাইল বা তার চেয়েও বেশি বেগে দৌড়োতে পারে। দশ ফুট বা তার চেয়েও উঁচুতে লাফাতে পারে। লোকটা যে কোনও পাহাড় ডিঙোতে পারে। যে-কোনও সমুদ্র পেরোতে পারে। শত্রু হিসেবে লোকটা অতি সাংঘাতিক। বন্ধু হিসেবে এ লোকটাকে পেলে যে-কেউ পৃথিবী জয় করতে পারে। এ লোকটা পৃথিবীর বন্ধু না শত্ৰু সেইটেই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
পঞ্চানন্দ খুবই চিন্তিত মুখে ফোকর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর খুব সাবধানে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল। মাথাটা এই শীতেও বেশ গরম লাগছে তার। গায়ে বেশ ঘাম হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে সে দেখল, খাওয়াদাওয়া প্রায় শেষ।
পঞ্চানন্দ আজ আর খাওয়া নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না। বস্তুত আজ সে রুই মাছের কালিয়া বা ছানার কোফতার তেমন স্বাদও পেল না। সবই এক রকম লাগল।
ঠাকুর বিনীতভাবে বলল, “আজ কি খিদেটা তেমন নেই বাবু?”
“না হে, রোজ কি আর খেতে ভাল লাগে?