সকালবেলাটি বড় মনোরম
সকালবেলাটি বড় মনোরম। বড় সুন্দর। দোতলার ঘর থেকে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে হরিবাবুর মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। বাগানে হাজার রকম গাছগাছালি। পাখিরা ডাকাডাকি করছে, শরৎকালের মোলায়েম সকালের ঠাণ্ডা রোদে চারদিক ভারি ফটফটে। উঠোনে রামরতন কাঠ কাটছে। বুড়ি ঝি বুধিয়া পশ্চিমের দেয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছে। টমি কুকুর একটা ফড়িঙের পিছনে ছোটাছুটি করছে। লকড়িঘরের চালে গম্ভীরভাবে বসে আছে বেড়াল ঝুমঝুমি। নীচের তলায় পড়ার ঘর থেকে হরিবাবুর ছেলে আর মেয়ের তারস্বরে পড়ার শব্দ আসছে। আর আসছে রান্নাঘর থেকে লুচি ভাজার গন্ধ। তিনি শুনেছেন, আজ সকালে জলখাবারে লুচির সঙ্গে ফুলকপির চচ্চড়িও থাকবে। হরিবাবু দাড়ি কামিয়েছেন, চা খেয়েছেন, লুচি খেয়ে বেড়াতে বেরোবেন। আজ ছুটির দিন।
কদিন ধরে হরিবাবুর মন ভাল নেই। তিনি ভাল রোজগার করেন। তার কোনো রোগ নেই। সকলের সঙ্গেই তার সদ্ভাব। কিন্তু তার একটি গোপন শখ আছে। বাইরে তিনি যাই হোন, ভিতরে ভিতরে তিনি একজন কবি। তবে তার কবিতা কোথাও ছাপা হয়নি তেমন। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে তিনি রোজ অনবরত লিখে চলেছেন কবিতার পর কবিতা। এযাবৎ গোটা কুড়ি মোটামোটা খাতা ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু গত প্রায় পাঁচ সাতদিন বিস্তর ধস্তাধস্তি করেও এক লাইন কবিতাও তিনি লিখতে পারেননি। তাই মনটা বড় খারাপ।
আজ সকালের মনোরম দৃশ্য দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে কবিতার খাতা খুলে বসলেন। মনটা বেশ ফুরফুর করছে। বুকের ভিতরে কবিতার ভুরভুর উঠছে। হাতটা নিশপিশ করছে। তিনি স্পষ্ট টের পাচ্ছেন, কবিতা আসছে। আসছে। তবে আর একটা কী যেন বাকি। আর একটা শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ বা দৃশ্য যোগ হলেই ভিতরে কবিতার ডিমটা ফেটে শিশু-কবিতা বেরিয়ে আসবে ডাক ছাড়তে ছাড়তে।
হরিবাবু উঠলেন। একটু অস্থিরভাবে অধীর পায়ে পায়চারি করতে লাগলেন দোতলার বারান্দায়। একটা টিয়া ডাক ছেড়ে আমগাছ থেকে উড়ে গেল। নিচের তলায় কোণের ঘর থেকে হরিবাবুর ভাই পরিবাবুর গলা সাধার তীব্র আওয়াজ আসছে। কিন্তু না, এসব নয়। আরও একটা যেন কিছুর দরকার। কী সেটা?
হরিবাবু হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। একটা ট্রেন যাচ্ছে। ঝিকির-ঝিকির ঝিকির ঝিকির মিষ্টি শব্দে মাটি কাঁপিয়ে, বাতাসে ঢেউ তুলে গাছপালার আড়াল দিয়ে আপনমনে আপ ট্রেন চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। বাঃ, চমৎকার। এই তো চাই। কবিতার ডিম ফেটে গেছে।
হরিবাবু দৌড়ে এসে টেবিলে বসে খাতা-কলম টেনে নিলেন। তারপর লিখলেন :
দ্যাখো ওই ভোরের প্রতিভা
ম্লান বিধবার মতো কুড়াতেছে শিউলির ফুল,
সূর্যের রক্তাক্ত বুকে দীর্ঘ ছুরিকার মতো ঢুকে যায় ট্রেন।
বান্টু নামে বাচ্চা চাকর এসে ডাকল, “বাবু লুচি খাবেন যে! আসুন।”
হরিবাবু খুনির চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে বললেন, “এখন ডিস্টার্ব করলে লাশ ফেলে দেব! যাঃ।”
ছেলেটা হরিবাবুকে ভালই চেনে। হরিবাবু যে ভাল লোক তাতে সন্দেহ নেই, তবে কবিতা লেখার সময় লোকটা সাক্ষাৎ খুনে।
সুতরাং বান্টু মিনমিন করে “লুচি যে ঠাণ্ডা মেরে গেল” বলেই পালাল। কিন্তু হরিবাবুর চিন্তার সূত্র সেই যে ছিন্ন হল, আর আধঘণ্টার মধ্যে জোড়া লাগল না। চতুর্থ পঙক্তিটা আর কিছুতেই মাথায় আসছে না। বহুবার উঠলেন, জল খেলেন, মাথা ঝাঁকালেন, একটু ব্যয়ামও করে নিলেন। কিন্তু নাঃ, এল না।
পরিবাবুর গান থামল। ছেলেমেয়ের পড়া থামল। পাখির ডাক থামল। কাঠ কাটার শব্দও আর হচ্ছে না। রোদ বেশ চড়ে গেল। হরিবাবুর পেট চুঁইছুঁই করতে লাগল। তবু এল না।
হরিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাতাটা বন্ধ করলেন। তারপর নীরবে খাওয়ার ঘরে এসে টেবিলে বসলেন।
তার স্ত্রী সুনয়নী দেবী ঝংকার দিয়ে উঠলেন, “এত বেলায় আর জলখাবার খেয়ে কী হবে? যাও, চান করে এসে একেবারে ভাত খেতে বোসো। বেলা বারোটা বাজে।”
“বারোটা?” খুব অবাক হলেন হরিবাবু। দেয়ালঘড়িতে দেখলেন সত্যিই বারোটা বাজে। এক গ্লাস জল খেয়ে হরিবাবু উঠে পড়লেন। তারপর পিছনের বাগানে এসে গাছপালার মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন।
কিন্তু কোথাও শান্তি বা নির্জনতা নেই। বাগানের কোণের দিকে মাটি কুপিয়ে তার সবচেয়ে ছোট ভাই ন্যাড়া একটা কুস্তির আখড়া বানিয়েছে। সেইখানে তিন চারজন এখন মহড়া নিচ্ছে। হুপহাপ গুপগাপ শব্দ। বিরক্ত হয়ে হরিবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
বেরোবার মুখেই দেখলেন বাড়ির সামনে একটা উটকো লোক দাঁড়িয়ে আছে। গালে কয়েকদিনের রুখু দাড়ি, পরনে একটা ময়লা পাজামা, গায়ে তাপ্পি দেওয়া একটা ঢোলা জামা, কাঁধে একটা বেশ বড় পোঁটলা। রোগভোগা কাহিল চেহারা। বয়স খুব বেশি নয়, ত্রিশের কাছাকাছি।
লোকটাকে দেখেই হরিবাবুর মনে পড়ল ইদানীং খুব চোর-ঘঁচোড়ের উৎপাত হয়েছে শহরে। এই লোকটার চেহারাটাও সন্দেহজনক। উঁকিঝুঁকিও মারছে। সুতরাং তিনি লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে ধমকের স্বরে বললেন, “এই, তুমি কে হে? কেয়া মাংতা? হুম ডু ইউ ওয়ান্ট?”
তিন-তিনটে ভাষায় ধমক খেয়ে লোকটা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গিয়ে মিনমিন করে বলল, “আমি অনেক দূর থেকে আসছি।”
হরিবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “তাহলে মাথা কিনে নিয়েছ আর কী। দূর থেকে আসছ তো কী? আসতে বলেছিল কে? না এলেই বা এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হত?”
লোকটা এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “তা বটে, না এলেও হত।”
“তাহলে এবার কেটে পড়ো। যত দূর থেকে এসেছ, আবার তো দূরেই ফিরে যাও। নইলে পুলিশ ডাকব।”
লোকটা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে বুঝেছে। কিছুক্ষণ ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থেকে লোকটা খুব ভয়েভয়ে বলল, “আজ্ঞে একটা কথা ছিল। সেটা জেনেই চলে যাব।”
“কী কথা? আঁ, তোমার মতো ভ্যাগাবরে আবার কথা কিসের? যত সব গাঁজাখুরি দুঃখের কথা বানিয়ে বানিয়ে বলবে, আর বাড়ির দিকে আড়ে-আড়ে চেয়ে কোথায় কি আছে নজর করবে তো? ওসব কায়দা আমি ঢের জানি।”
লোকটা সঙ্গেসঙ্গে বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে কথাটা ঠিকই বলেছেন। দিনকাল ভাল নয়। চারদিকে চোর-জোচ্চোর সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। উটকো লোককে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভাল। তবে আমার কথাটা খুবই ছোট। আমি শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম এটাই শিবু হালদার মশাইয়ের বাড়ি কি না।”
‘হলে কী করবে?”
“তার বড় ছেলেকে একটা কথা বলে যাব আর একটা জিনিস দিয়ে যাব।”
“কী কথা? কি জিনিস?”
“আজ্ঞে সে তো শিবু হালদার মশাইয়ের বড় ছেলে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না।”
হরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমিই শিবু হালদাবেরর বড় ছেলে, আর এটাই শিবু হালদারের বাড়ি।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আমিও এরকমই অনুমান করেছিলাম।”
হরিবাবু বললেন, “আর তোমার অনুমানের কাজ নেই। শিবু হালদারের বাড়ি এশহরের সবাই চেনে। বেশি বোকা সেজো না। যা বলবার বলে ফেলো।”
লোকটা ভারি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “আজ্ঞে আমি একরকম তাঁর কাছ থেকেই আসছি।”
“একরকম! একরকম মানেটা কী হল হে? তার কাছ থেকে আসছ মানেটাই বা কী? ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পেলে না?”
লোকটা সবেগে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “আপনি বড় ভড়কে দেন মানুষকে। অত ধমকালে কি বুদ্ধি ঠিক থাকে?”
“বুদ্ধি অনেক খেলিয়েছ, এবার পেটের কথাটি মুখে আনো তো বাছাধন।
শিবু হালদারকে তুমি পেলে কোথায়? তিনি তো বছর বিশেক আগেই গত হয়েছেন।”
“আজ্ঞে তা হবে। তিনি যে আর ইহধামে নেই সে-কথা খবরের কাগজেই পড়েছিলাম। স্বনামধন্য লোক ছিলেন। বাঙালির মধ্যে অমন প্রতিভা খুব কম দেখা যায়।”
“তা কথাটা কী তা বলবে?”
“বলছি। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা প্রায় ত্রিশ বছর আগে। আপনি তখন এইটুকু।”
“বটে! তা তুমি তখন কতটুকু?”
“আমাকে দেখে বয়সের অনুমান পাবেন না।”
“তাই নাকি ব্যাটা হনুমান? ডাকব ন্যাড়াকে?”
“থাক থাক, লোক ডাকতে হবে না। আপনি একাই একশো। শিবু হালদার মশাই বলতেন বটে, ওরে পীতাম্বর, তুই দেখে নিস,আমার বড় ছেলে এই হরি একদিন কবি হবে। ওর হাত পা চোখ সব কবির মতো, তা দেখছি, শিবু হালদারের মতো বিচক্ষণ লোকেরও ভুল হয়। কবি কোথায়, এ তো দেখছি দারোগা।”
এ-কথায় হরিবাবুর এবার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার পালা। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাবা বলতেন ও-কথা?”
“তবে কি বানিয়ে বলছি?”
হরিবাবু ঢোঁক গিলে বললেন, “তুমি বাপু বড্ড ঘড়েল দেখছি। শিবু হালদারকে চিনতে, তার মানে তোমার বয়স তখন……”
লোকটা শশব্যস্তে বলল, “বেশি নয়, চল্লিশের মধ্যেই। এখন এই সত্তর চলছে।”
‘‘সত্তর?”
“সামনে মাসে একাত্তর পূর্ণ হবে।”
“মিথ্যে কথা!” লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেউ বিশ্বাস করে না। তা সে যাকগে। গত ত্রিশ বছর তার একটা দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরছি। সেই দায় থেকে মুক্ত হতে আসা।”
বলে লোকটা পাজামার কোমর থেকে একটা গেঁজে বার করে আনল। তারপর সেটা হরিবাবুর হাতে দিয়ে বলল, “ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ”।
হরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, “তার মানে?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আর জানি না। শিবু হালদার মশাই এর বেশি আর বলেননি।”
০২.
উটকো লোকটার ওপর হরিবাবুর আর তেমন যেন রাগ হচ্ছিল না। তবু রাগের ভাবটা বজায় রেখে একটু চড়া গলায় বললেন, “আমাকে ধাঁধা দেখাচ্ছ? ভাবছ তোমার সব কথা বিশ্বাস করছি? ঈশান কোণ আর তিন ক্রোশ, এর কোনো মানে হয়?”
লোকটা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “আরে চুপ চুপ। এসব অতিশয় গোপন কথা। শিবুবাবু পইপই করে বারণ করেছিলেন, পাঁচকান যেন না হয়। আমার কর্তব্যটুকু করে গেলাম, ঘাড় থেকে দায় নেমে গেল, এবার তাহলে যাই।”
“গেলেই হল? তোমার নাম বলল, ঠিকানা বলো, কী কাজটাজ করো একে একে তাও বলো।”
লোকটা মাথা চুলকে খুব বিনীতভাবে বলল, “নাম তো মেলা। এক-এক জায়গায় এক-এক রকম। কোটা বলব?”
হরিবাবু ভড়কে গিয়ে বলেন, “অনেক রকম নাম কেন?”
“আজ্ঞে সে অনেক কথা, বললে আপনি রাগ করবেন।”
“আহা, যেন এখন আমি রেগে নেই! আমাকে আর রাগালে কিন্তু একদম রেগে যাব, তখন বুঝবে! আমার এক ভাই কুস্তিগির, এক ভাই পুলিশ, আমি—“
“আজ্ঞে আর বলতে হবে না। শিবুবাবু খুব গেরোতে ফেলেছেন বুঝতে পারছি। কথাটা কী জানেন, আমি তেমন ভাল লোক নই। যেখানেই যখনই থাকি, একটা না একটা অপকর্ম করে ফেলি। ঠিক আমিই যে করি তা বলা যায় না। তবে আমার হাত দুখানা করে ফেলে। তা সে একরকম আমারই করা হল।”
“বটে! বটে! তা অপকর্মগুলো কীরকম?”
কোথাও খুন, কোথাও ডাকাতি, কোথাও চুরি, এই নানারকম আর কী, পুলিশ পিছনে লাগে বলে নামধাম চেহারা সবই পাল্টাতে হয়। তা এই করতে করতে নিজের নামটা একেবারে বিস্মরণ হয়ে গেল। কখনও মনে হয় চারুদত্ত, কখনও মনে হয় মেঘদূত, কখনও মনে হয় দ্বৈপায়ন। কিছুতেই স্থির করতে পারি না কোনটা। তাই লোকে জিজ্ঞেস করলে যা হয় একটা বলে দিই। এই যেমন এখন আপনি জিজ্ঞেস করার পর হঠাৎ মনে হল আমার নাম বোধহয় পঞ্চানন্দ। কোত্থেকে যে নামটা মাথায় এল, তাই বুঝতে পারছি না। এরকম নাম জন্মে শুনিনি।”
হরিবাবু খুব কটমট করে পঞ্চানন্দের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটার ওপর সত্যি-সত্যি রাগ করা উচিত কি না তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে তার তেমন রাগ হচ্ছে না। রাগ কখনও তার তেমন হয় না। আর রাগ হয় না। বলেই সংসারে তার মতামতের দাম এত কম। সে যাকগে, হরিবাবু যথাসাধ্য রাগ-রাগ গলায় বললেন, “তুমি তাহলে একজন খুনি, গুণ্ডা এবং চোর! ঠিক তো?”
“আজ্ঞে খুব ঠিক। লোক আমি মোটেই সুবিধের নই।”
“কিন্তু তাহলে আমার বাবার সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি হল কী করে?”
পঞ্চানন্দ জামাটা তুলে মুখটা তাই দিয়ে মুছে নিয়ে বলল, “লোক ভাল হলে কী হবে, শিবু হালদার মশাই ছিলেন মাথা-পাগলা লোক। ওই সায়েন্স সায়েন্স করেই মাথাটা বিগডোল। আমার চালচুলো ছিল না, এখনও অবিশ্যি নেই, তা আমি সারাদিন কুড়িয়ে-বাড়িয়ে-চেয়েচিন্তে চুরি-ডাকাতি করে খেতাম। রাত্তিরের দিকটায় ওই আপনাদের পুবদিককার দালানের বাইরের বারান্দায় চট পেতে শুয়ে থাকতাম।……তা বাবু, খুব পোলাও রাঁধার গন্ধ পাচ্ছি যে, বাড়িতে কি ভোজ?”
“রোববারে ভালমন্দ হয় একটু।”
“হয়? বাঃ, বেশ। তা আপনারা ব্রাহ্মণভোজন করান না?”
“তুমি কি বাপু ব্রাহ্মণ?”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “ছিলাম বোধহয়। অনেককালের কথা তো। কিন্তু মনে হয় ছিলাম যেন ব্রাহ্মণই। নিদেন দরিদ্রনারায়ণসেবাও তো করতে পারেন।”
স্পর্ধা দেখে হরিবাবু অবাক হন। লোকটা নির্লজ্জও বটে। তবে একেবারে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতেও তার বাধছে। লোকটা একটা পেতলের চাবি আর একটা সংকেত দিয়েছে। কোনো গুপ্তধনের হদিস কি না তা হরিবাবু জানেন না। গুলগপ্পোও হতে পারে। হরিবাবু খুব কটমট করে লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “ঠিক আছে, ব্রাহ্মণভোজন বা দরিদ্রনারাণসেবা যা হয় একটা হবে’খন। তবে সে সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “সে আর বলতে। সব বাড়িতেই এক ব্যবস্থা। আমারও হলেই হল।”
‘হ্যাঁ, কি বলছিলে যেন?”
পঞ্চানন্দ মুখটা করুণ করে বলল, “আজ্ঞে সেই হিমালয় থেকে টানা হেঁটে আসছি। মানুষের শরীর তো। একটু বসে-টসে একটু হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে কথাটথা বললে হয় না? শিবুবাবুর ঘরখানা যদি ফাঁকা থাকে তো তার দাওয়াতেই গিয়ে একটু বসি চলুন।”
হরিবাবু দোনোমনো করে বললেন, “ঘর ফঁকাই আছে। বাবার ল্যাবরেটরিতে আমরা কেউ ঢুকি না। আমার ছেলে মাঝে-মাঝে খুটখাট করে গিয়ে। তা এসো।”
শিবু হালদারের ল্যাবরেটরি খুব একটা দেখনসই কিছুই নয়। বাড়ি থেকে কিছুটা তফাতে, খুব ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ে প্রায় ঢাকা, লম্বা একটা একতলা দালান। এদিকটা খুব নির্জন। ইদানীং সাপখোপের বাসা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, শিশিবোতল, জার, রাসায়নিক এখনও আছে। কেউ হাত দেয়নি। বারান্দাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেই দাওয়ায় বসে পঞ্চানন্দ জামার ঝুল দিয়ে ফের মুখ মুছল। তারপর বলল, “পোলাওয়ের গন্ধটা খুব ছড়িয়েছে কিন্তু মশাই। তা বেগুনি-টেগুনিও হবে নাকি? চাটনি? মাংস তো বলতে নেই, হচ্ছেই। মাছও কি থাকছে সঙ্গে? দই খান না আপনারা? আগে এদিককার রসোমালাই খুব বিখ্যাত ছিল, আর ছানার গজা।”
হরিবাবু আবার রেগে যাওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “এটা কি বিয়েবাড়ি নাকি? ওসব খাওয়ার গপ্পো এখন বন্ধ করো। কাজের কথা বলো দেখি।”
পঞ্চানন্দ বেশ জেঁকে বসল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে একটা আরামের শ্বাস ফেলে বলল, “এইখানটাতেই শুয়ে থাকতাম এসে। শিবুবাবু অনেক রাত অবধি ঘরের মধ্যে কী সব মারণ-উচাটন করতেন।”
হরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “মোটেই মারণ-উচাটন নয়। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন।”
“ওই হল। তা একদিন রাত্রিবেলা সবে চোখদুটো লেগেছে, তখন এসে আমাকে ঠেলে তুললেন, ‘ওরে ওঠ ওঠ, দেখে যা কাণ্ডখানা।’ তা চোখ কচলাতে কচলাতে গিয়ে ঢুকলাম শিবুবাবুর জাদুঘরে। বললে বিশ্বাস করবেন না যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া!”
“কী দেখলে?”
“একখানা কাঁচের বাক্সে ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতির ঘন ধোঁয়া আর সাদা আগুনের ঝলকানি। শিবুবাবু কী বললেন জানেন? বললেন, “জাপানিরা নাকি বড়-বড় গাছের বেঁটে-বেঁটে চেহারা করতে পারে। তাকে বলে বানসাই।”
“জানি। এক বিঘত বটগাছ, ছ’আঙুল তেঁতুলগাছ তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। তা শিবুবাবু সেইরকমই একখানা বানসাই অ্যাটম বোমা বানিয়েছেন। কাঁচের বাক্সের মধ্যে বিঘতখানেক উঁচু সেই কাণ্ডখানা হল সেই বানসাই অ্যাটম বোমার কাজ।“
“বলো কী?”
“সে তো গেল একটা ঘটনা। বৃত্তান্ত আরও আছে।”
“আছে? বলে ফেলো?”
“শুনবেন? আপনার খিদে পাচ্ছে না?”
“খিদে? না, এই তো লুচি খেলাম। ও হো, না না, আমি তো লুচি খাইনি। হা, খিদে তো পেয়েছে হে।”
পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “ঠিক করতে পারছেন না তো? শিবুবাবুও তাই বলতেন, আমার বড় ছেলেটা একেবারে অকালকুষ্মান্ড না হয়ে যায় না। তা না হয় হল, কিন্তু আবার কবিও না হয়ে বসে।”
একটু সংকুচিত হয়ে গিয়ে হরিবাবু বললেন, “কবিদের ওপর তার খুব রাগ ছিল নাকি?”
“রাগ ছিল না আবার! কবি শুনলেই খেপে উঠতেন। অবশ্য খেপবারই কথা। বয়সকালে ঝুড়ি ঝুড়ি কবিতা লিখে লিখে কাগজে পাঠাতেন, কেউ ছাপত না। হন্যে হয়ে উঠেছিলেন ছাপানোর জন্য। এমনকি, তিন-চারজন সম্পাদককে ধার পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তবু ছাপা হয়নি। কবিদের ডেকে এনে খুব খাওয়াতেন, কবিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, এক কবি তার চেনসুন্ধু সোনার ঘড়ি ধার নিয়ে আর ফেরত দিল না। আর এক কবি…”
তার বাবা শিবু হালদারও কবিতা লিখতেন শুনে হরিবাবুর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু হলেন না, ব্যাজার মুখে বললেন, “থাক, আর শুনতে চাই না।”
“সে না হয় না-চাইলেন, কিন্তু খিদের ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত এইবেলা করে নিন। লুচি খেয়েছেন কি খাননি, খিদে পেয়েছে কি পায়নি এসব বেশ ভাল করে ভেবেচিন্তে ঠিক করে নিন। লুচি যদি না খেয়ে থাকেন, তবে আর অবেলায় সেটা খেয়ে কাজ নেই। বরং ব্রাহ্মণভোজন লাগিয়ে দিন। জিনিসটারও সঙ্গতি হল, খানিক পুণ্যিও পেয়ে গেলেন।”
“তুমি বড্ড বেশি বাচাল তো হে।”
“আজ্ঞে পেটটা ফাঁকা থাকলে আমার বড় কথা আসে। সে যাকগে, যা বলছিলাম। একদিন মাঝরাত্তিরে ল্যাবরেটরি-ঘরে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড শুনে ঘুম ভেঙে গেল। তড়াক করে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি তিনটে এই জোয়ান কালা সাহেব শিবুবাবুকে রাম-ধোলাই দিচ্ছে। দেখে আমি ভিরমি খাই আর কী, কিন্তু ভিরমি খেতে খেতেও দেখলাম শিবুবাবু তিনটে সাহেবকেই একে একে নিকেশ করে ফেললেন।”
হরিবাবু কেঁপে উঠে বললেন, “বলো কী?”
“তাও আলপিন দিয়ে।”
“অ্যাঁ! আলপিন?”
“তবে আর বলছি কী? ঠিক আলপিন নয় বটে, তবে ও-রকমই সরু আর ছোট্ট পিস্তল ছিল তাঁর, মুখ থেকে সুতোর নালের মতো সূক্ষ্ম গুলি বেরোত। সাহেবরা তো অত কলকজা জানে না। শিবুবাবু তাদের খুন করে আমাকে ডাকলেন। দু’জনে ধরাধরি করে তিন-তিনটে লাশকে ওই বাগানের পশ্চিমধারে পুঁতলাম। দেখছেন না ওখানে কেয়াগাছটার কেমন বাড়বাড়ন্ত। জৈব সার পেয়েছে কিনা।
০৩.
হরিবাবু লোকটাকে বিশ্বাস করছেন না ঠিকই, কিন্তু কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কেয়াঝোঁপটার দিকে তাকিয়ে একটু দুর্বল গলায় বললেন, “গুলমারার আর জায়গা পাওনি? আমার বাবাকে খুনি বলে বদনাম দিতে চাও?”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে আত্মরক্ষার জন্য খুন করলে সেটাকে খুন বলে ধরা হয় না। আইনেই আছে। শিবুবাবু তো নিজেকে বাঁচাতে খুন তিনটে করেছিলেন। এখনও ওই কেয়াঝোঁপের এলাকার মাটি খুঁড়লে তিনটে কঙ্কাল পাওয়া যাবে। শাবল-টাবল নেই বাড়িতে? দিন না, খুঁড়ে দেখাচ্ছি।”
হরিবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “থাক্ থাক্, তার দরকার নেই। পঞ্চানন্দ তার খড়িওঠা গা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “একটু চান-টান করা দরকার, বুঝলেন! খাঁটি সর্ষের তেল ছাড়া আমার সহ্য হয় না। এক টুকরো গন্ধসাবান কি পাওয়া যাবে?”
রাগে হরিবাবু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। চোখ দিয়ে লোকটাকে প্রায় ভস্ম করে দিতে দিতে বললেন, “আর কী কী চাই তোমার বাপু?”
পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “আরও কিছু চাই বটে, কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না। তা ক্রমে ক্রমে বলব’খন। এখন একটু তেল আর সাবান হলেই হয়। আমার গরম জল লাগে না, গামছারও দরকার নেই আর ফুলেল তেল না হলেও চলবে।”
“বটে।”
লোকটা গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “দাড়িটা বড্ড কুটকুট করছে তখন থেকে। আট গণ্ডা পয়সা পেলে সেলুনে গিয়ে কামিয়ে আসতাম। আর মাথার অবস্থাটাও.দেখুন, চুল একেবারে কাকের বাসা। তা ধরুন আরও পাঁচসিকে হলে চুলটার একটা গতি হয়।”
“ব্ল্যাকমেল করার ফিকিরে আছ তো? দেখাচ্ছি ব্ল্যাকমেল!”
“মেল? আজ্ঞে মেট্রেনের কথা উঠছে কেন বলুন তো? আমার তো এখন কোথাও যাওয়ার নেই? তবে ফিকিরের কথা যদি বলেন তো বলতে হয়, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি খুব ফিকিরের লোক। শিবুবাবু যখন আকাশী জামা বানালেন, তখন সেই জামা পরে আমিও তাঁর সঙ্গে আকাশে উঠে যেতুম। হেঃ হেঃ! খুব মজা হত মশাই। দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে আকাশে ঘুরে বেড়ানো। মেঘের রাজ্যে ঢুকে সে যে কী রগড়ই হত! তা তখন একদিন একটা ফিকির খেলল মাথায়। একদিন দুধ চিনি সব সঙ্গে নিয়ে গিয়ে খানিকটা মেঘ মিশিয়ে দিব্যি আইসক্রিম বানিয়ে খেলুম দুজনায়। শিবুবাবুও বলতেন, পঞ্চানন্দ, তুই খুব ফিকিরের লোক।”
“আকাশী জামা?” হরিবাবুর চোখ একদম রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেল।
“তবে আর বলছি কী? শিবুবাবু পাগলা গোছের ছিলেন বটে, তবে বুদ্ধির একেবারে চেঁকি। ফটাফট আজগুবি সব জিনিস বানিয়ে ফেলতেন।”
“কই, আমি তো এইসব আবিষ্কারের কথা শুনিনি?”
“খুব গোপন রেখেছিলেন কিনা। সর্বদাই শত্রুপক্ষের চরেরা ঘুরঘুর করত যে। ওই তিনটে সাহেব খুন হল কি এমনি-এমনি? তারাও মতলব নিয়েই এসেছিল। আরও সব আসত। মিশমিশে কালো লোক, চ্যাপটা নাক আর ঘোট চোখ-অলা লোক, বাদামি রঙের ঢ্যাঙা চেহারার লোক, বেঁটে বক্কেশ্বর চেহারার লোক। তারা বড় ভাল লোকও ছিল না। একদল তো চিঠি দিয়েছিল, যদি আকাশী জামার গুপ্ত কথা আমাদের না জানান, তো আপনার ছেলে হরিকে চুরি করব।”
“বলো কী?”
“আজ্ঞে একেবারে নিয্যস সত্যি। চুরি করে নিয়ে মেরেই ফেলত বোধহয়। সেই ভয়ে শিবুবাবু শেষ দিকটায় সব লুকিয়ে-টুকিয়ে ফেললেন, জিনিসও আর তেমন বানাতেন না। তবু ওলন্দাজের হাতে প্রাণটা দিতে হল।”
“তার মানে? ওলন্দাজটা আবার কি?”
“আচ্ছা মশাই? আপনার কি খিদে-তেষ্টা নেই নাকি? আপনার না থাক, আমার আছে। যদি অসুবিধে থাকে তো বলুন, আমি না হয় অন্য জায়গায় যাই। তখন থেকে বকে-বকে মুখে ফেকো উঠে গেল।”
হরিবাবু একটু নরম গলায় বললেন, “আচ্ছা বাপু বোসো, তেল পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই দিকে কলাঝাড়ের ওপাশে একটা কুয়ো আছে, চানটান করে নাও গে।”
খুবই চিন্তিতভাবে হরিবাবু ফিরে এলেন ঘরে। বাচ্চা চাকরটাকে ডেকে তেল দিয়ে আসতে বললেন। এক টুকরো সাবানও।
হরিবাবুর স্ত্রী এসে বললেন, “লাটসাহেবটি কে?”
“ইয়ে, বাবার বন্ধু।”
“শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু ওইটুকু একটা ছোঁড়া। তোমার মাথাটা গেছে।”
“ঠিক বন্ধু নয়, ওই সাকরেদ ছিল আর কী।”
“তুমি ঠিক জানো, নাকি মুখের কথা শুনে বিশ্বাস করলে?”
হরিবাবু বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, ”খুব চিনি। ছেলেবেলায় কতবার দেখেছি।”
মিথ্যে কথাটা বলে একটু খারাপও লাগছিল হরিবাবুর। তবে না বললেও চলে না। এ বাড়ির কেউ হরিবাবুর বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখে না। কিন্তু হরিবাবু জানেন, মাঝেমধ্যে একটু-আধটু গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেললেও তিনি বোকা লোক নন।
তাঁর স্ত্রী অবশ্য আর উচ্চবাচ্য করলেন না। আপনমনে হরিবাবুর নির্বুদ্ধিতার নানা উদাহরণ দিতে দিতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। হরিবাবু রোদে বসে তেল মাখতে মাখতে হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আকাশী জামার কথা ভাবতে লাগলেন। আকাশী জামা হাতে পেলে তার ভারি উপকার হত। পৃথিবীর এইসব গণ্ডগোল এড়িয়ে দিব্যি ওপরে গিয়ে বসে কবিতার পর কবিতা লিখে যেতেন।
ভাবতে ভাবতে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন যে, তেল-মাখা অবস্থাতেই বসে রইলেন। স্নান-খাওয়ার কথা আর মনেই রইল না। মেঘের বিছানায় বসে, মেঘের বালিশে ঠেস দিয়ে কবিতা লিখতে যে কী ভালই না লাগবে! মাঝে মাঝে মেঘ থেকে আইসক্রিম বানিয়ে খেয়ে নেবেন। তবে তার ভারি সর্দির ধাত, আইসক্রিম সহ্য হবে কি?
কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকতেন তা বলা শক্ত। হঠাৎ একটা জোরালো গলা খাকারির শব্দে সচেতন হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, বেশ তেল-চুকচুকে চেহারা। নিয়ে পঞ্চানন দাঁড়িয়ে আছে। গাল-টাল কামানো, ফিটফাট। অমায়িক হেসে বলল, “আজ্ঞে স্নানের পর খাওয়ারও একটা নিয়ম আছে। তা কবিদের বেলায় কি কোনো নিয়মই খাটে না?”
“কেন, নিয়ম খাটবে না কেন?”
“আপনারা সাধারণ মানুষ নন জানি, কিন্তু খিদে তো পাওয়ার কথা। আমাদের গায়ে ভজহরি কবিয়ালকেও দেখেছি, ঝুরিঝুরি কবিতা লিখে ফেলত লহমায়। তারও কাছাকোছার ঠিক থাকত না, এ পথে যেতে ও-পথে চলে যেত, রামকে শ্যাম বলে ভুল করত, ঘোর অমাবস্যায় পূর্ণিমার পদ্য লিখে ফেলত, কিন্তু খিদে পেলে সে একেবারে বক-রাক্ষস। হালুম-খালুম বলে লেগে যেত খাওয়ায়। আপনি যে দেখছি তার চেয়েও ঢের এগিয়ে গেছেন।”
“অ! হ্যাঁ, খাওয়ার একটা ব্যাপার আছে বটে। খিদেও পেয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না পেটে এ-রকম একটা খুটখাট হচ্ছে কেন।”
“কী রকম বলুন তো? রাতের বেলায় ইঁদুর যেমন খুটখাট করে বেড়ায় সে-রকম তো?”
“হা হা, অনেকটা সে-রকম।”
“তা হলে বলতে নেই আপনার খিদেই পেয়েছে। এবার গা তুলে ফেলুন, নইলে গিন্নিমা আমাদের ব্যবস্থাও করবেন না কিনা। আমারও পেটে ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি লেগে গেছে।”
হবিবাবু খুবই অন্যমনস্কভাবে স্নান-খাওয়া সেরে নিলেন। দুপুরবেলায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে পিতলের চাবিটা খুব নিবিষ্টমনে দেখলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তার সন্দেহ হতে লাগল, বাবা তাঁর আবিষ্কার করা জিনিসগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছেন। ঈশান কোণে তিন ক্রোশ দূরে কোথাও। সেখানে.এই পিতলের চাবি দিয়ে গুপ্ত দরজা খুলে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে।
হরিবাবু যখন এইসব ভাবছেন তখন অন্যদিকে পঞ্চানন্দ দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়ির চাকরের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। চাকর কুয়োতলায় বাসন মাজছিল। পঞ্চানন্দ সেখানে গিয়ে ঘাসের ওপর জেঁকে বসে বলল, “ওফ, কত পাল্টে গেছে সব।”
চাকরটা বলল, তা আর বলতে! আগে জলখাবারের জন্য পাঁচখানা রুটি বরাদ্দ ছিল, এখন চারখানা। আগে চিনির চা দিত, আজকাল গুড়ের। আর জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বাড়লেও বেতন সেই পুরনো রেটে। ওটাই কেবল পাল্টয়নি।”
পঞ্চানন্দ কথাটা কানে না-তুলে বলল, “ত্রিশ বছর আগে যা দেখে গিয়েছিলুম তা আর কিছু নেই। তবে ভূত তিনটে নিশ্চয়ই আছে, না রে?”
‘ভূত! তা থাকতে পারে।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “আহা, অত হালকাভাবে নিচ্ছিস কেন? যে কোন ভূতের কথা বলছি না। এ হল তিনটে সাহেব-ভূত। তখন তো খুব দাপাদাপি করে বেড়াত।”
চাকর কাজ থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “সাহেব-ভূত! এ-বাড়িতে ছিল নাকি?”
“থাকবে না মানে! যাবে কোথায়? ওই কেয়াঝোঁপের নীচে মাটির তলায় তাদের লাশ চাপা আছে না?”
“সত্যি বলছ?”
“মিথ্যে বলার কি জো আছে রে? নিজের হাতে পুঁতেছি তাদের। ওই পোঁতার পর থেকেই তাদের এখানে-সেখানে রাত-বিরেতে দেখা যায়। দেখিসনি?”
“আমি মোটে দুমাস হল এসেছি। এখনও দেখিনি।”
পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলে, “মাঝে-মাঝে দেখা যায় না বটে। বিশেষ করে এই সময়টায় ওরা নিজেদের দেশে বেড়াতে যায়। ফিরে এসেই আবার লাগাবে’খন কুরুক্ষেত্রে।”
“তিনটে সাহেব খুন হল কী করে?”
পঞ্চানন্দ গলা নামিয়ে বলল, “সে অনেক গোপন কথা।”
চাকরটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “সাহেব-ভূতের কথা জানি না, তবে এ বাড়িতে একটা পাহাড়ি ভূত আছে। বেঁটেখাটো মজবুত চেহারা।”
“বলিস কী?”
“কোমরে আই বড় ছোরা। দেখবে’খন যদি থাকো। ওই যে বুড়োকর্তার জাদুইঘর,ওর দাওয়ায় রাত-বিরেতে বসে থাকে এসে।”
কথাটা শুনে পঞ্চানন্দ হঠাৎ যেন কেমন ফ্যাকাসে মেরে গেল।
০৪.
ন্যাড়া কুস্তিগির বটে, তবে খুব যে সাহসী এমন নয়। কোঁদো কেঁদো চেহারার তার কয়েকজন কুস্তিগির বন্ধু আছে। পিছনের বাগানের একধারে মাটি কুপিয়ে কয়েক টিন তেল ঢেলে মাটি নরম করে হুশহাশ শব্দে তারা সেখানে কুস্তি লড়ে। সকলেরই মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। সেইজন্য তাদের বলা হয় ন্যাড়ার দল। সপ্তাহে একদিন গজ পালোয়ান এসে কুস্তির নানারকম কূট-কৌশল তাদের শেখায়। গজ পালোয়ান ঠিক পেশাদার কুস্তিগির নয়। একটু সাধু-সাধু ভাব আছে। কৌপীন পরে এবং সারা বছর শীতে গ্রীষ্মে আদুল গায়ে থাকে। ইদানীং মাথায় একটু জট দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য এমন কিছু সাংঘাতিক নয়। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। বয়সও তেমন বেশি বলে মনে হয় না। তবে মুখে কালো দাড়িগোঁফের জঙ্গল থাকায় বয়স অনুমান করা শক্ত। বছর-দেড়েক আগে শহরের পূর্বপ্রান্তে চক সাহেবের পোড়া বাংলো বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার ধারে গজ পালোয়ানকে রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তখনও পরনে কৌপীন, পায়ে খড়ম। অচেনা লোককে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে লোকে ধরাধরি করে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সুস্থ হয়ে ওঠার পর পুলিশ তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও পেটের কথা বের করতে পারেনি। গজ পালোয়ান কোথা থেকে এসেছে, কে তাকে ছোরা মারল, এসব এখনও রহস্যাবৃত। তবে সেই থেকে গজ পালোয়ান এই শহরেই রয়ে গেছে। চক সাহেবের বাগানবাড়িতেই তার আস্তানা। সাধু গোছের রহস্যময় লোককে দেখলেই বহু মানুষের ভক্তিভাব দেখা দেয়। গজের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। লোকে অযাচিত হয়ে এসে চালটা ডালটা দিয়ে যায়, প্রণামীও পাওয়া যায় কিছু। সম্ভবত তাইতেই গজ পালোয়ানের চলে যায়।
গজ পালোয়ানের আস্তানায় ক্রমে ছেলে-ছোঁকরারাও জুটতে শুরু করল। গজ তাদের কাউকে কুস্তি শেখায়, কাউকে লগা বা ছোরা খেলা শেখায়, কাউকে শেখায় ম্যাজিক। যার যেরকম ধাত। ফলে শহরের ছেলে-ছোঁকরাদের এখন সময় কাটে মন্দ নয়। গজকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তারাও কিছু কিছু দেয়। ন্যাড়া গজ পালোয়নের অন্ধ ভক্ত।
ডন বৈঠক, নানারকম ব্যায়াম আর আসন এবং সেই সঙ্গে কুস্তি লড়ে ন্যাড়ার চেহারাটাও হয়েছে পেশ্লায়। সারা গায়ে থানা থানা মাংস কে যেন খুঁটের মতো চাপড়ে দিয়েছে। কাউকে চেপে ধরলে দম বন্ধ হবে নির্ঘাত। কিন্তু পালোয়ান ন্যাড়াকে বীর বলা যাবে কিনা সন্দেহ। বাড়িতে চোর এলে ন্যাড়ার নাকের ডাক তেজালো হয়ে ওঠে। পাড়ায় মারপিট লাগলে ন্যাড়া মাথাধরার নাম করে বিছানা নেয়।
আজ ছুটির দিন ন্যাড়া সারা সকাল খুব কুস্তি লড়েছে। দুপুরে সেরটাক মাংস, ছ-টুকরো মাছ, আধসের পোলাও সাবড়ে উঠে বেশ তৃপ্ত বোধ করে নিজের ঘরে বসে আয়নায় ল্যাটিসমাসের খেলা দেখছিল। হ্যাঁ, তার ল্যাটিসমাস বেশ ভালই। হাত দুখানা তার মুগুরের মতোই মজুবত। একখানা পাথরের চাঁইয়ের মতো বুক। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে দেখতে ন্যাড়া একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। এত মুগ্ধ যে, ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে যখন একটা লোক নিঃশব্দে ঢুকল তখন সে টেরও পেল না।
লোকটা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ন্যাড়ার মাসলের খেলা দেখে আপনমনেই বলে উঠল, “‘উরে বাস রে, এ যে দেখছি সাতটা বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারবে না।”
এমন চমকানো ন্যাড়া বহুঁকাল চমকায়নি। বুকের ভিতর প্রথমেই তার হৃৎপিণ্ডটা একটা ব্যাঙের মতো লাফ মারল। তারপর একটা লাফের পর ব্যাং যেমন অনেকক্ষণ থেমে থাকে তেমনি থেমে রইল। ন্যাড়ার ঘাড় শক্ত হয়ে গেল, হাত পা অসাড় হয়ে গেল, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল বরফের মতো। গলা দিয়ে দুর্বোধ্য একটা শব্দ বেরিয়ে এল, “ঘোঁক! ঘোঁক!’
লোকটা ন্যাড়ার জলে-পড়া মুখচোখ আয়নার ভিতর দিয়ে দেখতে লাগল। তারপর একগাল হেসে বলল, দিব্যি খেলিয়ে তুলেছেন তো শরীরখানা। একেবারে কোপানো খেত, এখানে-সেখানে চাপড়া উল্টে আছে। আহা, এই গন্ধমাদন দেখলে শিবুবাবু বড় খুশি হতেন।”
ন্যাড়া পলকহীন চোখে আয়নার ভিতর দিয়ে লোকটাকে দেখছিল। আসলে সে দেখতে চাইছিল না। কিন্তু চোখ বুজে ফেলার চেষ্টা করে সে টের পেল, চোখের পাতাও অবশ হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই সে চেয়েছিল। এরকম ফটফটে দিনের বেলায় ভূত-প্রেত বা চোর-ডাকাতদের হানা দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে তাতে ভরসাও তো কিছু নেই। এই যে দিব্যি দুপুরবেলা আস্ত একখানা উটকো ভূত তার ঘরে নেমে এসেছে এরই বা কী করা যাবে?
ভূত নাকি খোনা সুরে কথা বলে। কিন্তু এখন ভয়ের চোটে ন্যাড়ার গলা থেকেই খোনা স্বর বেরিয়ে এলে, “আমার যে বৰ্ড শীত ঔরছে! আঁমি যে কেমন ভয়-ভয় পাচ্ছি। ওঁরে বাবা রে!”
লোকটা শশব্যস্ত এগিয়ে এসে ন্যাড়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এঃ, খোকাবাবু, ঠিক সেই ছোট্টবেলাটির মতোই ভয় পাও দেখছি। এঃ মা, দ্বৈপায়নকে ভয় কি খোকা? তোমাকে পিঠে নিয়ে কত ঘুরেছি, মনে নেই? সেই যে যখন এইটুকুন ছিলে, ঝুমঝুমি বাজাতে, মনে, নেই?”
ন্যাড়ার ঘাড় একটু নরম হল। সে লোকটার দিকে হতভম্বের মতো চেয়ে। বলল, আপনি কে?”
লোকটা মাথা চুলকে বলে, “এই তো মুশকিলে ফেললে! লোকে যখন জিজ্ঞেস করে আপনি কে’ তখনই আমি সবচেয়ে বিপদে পড়ে যাই। আমি লোকটা যে আসলে কে আজকাল আমি নিজেই ঠাহর করতে পারি না। তবে শিবুবাবু আমাকে খুব চিনতেন।”
ন্যাড়া বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আপনি আমার পিলে চমকে দিয়েছেন।“
লোকটা মাথা চুলকে একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, “তা চমকানো জিনিসটা ভাল। মাঝে-মাঝে চমকালে মানুষের বাড় খুব তাড়াতাড়ি হয়। গাঁয়ের দেশে দেখবে পুকুরে বেড়াজাল ফেলে মাছ ধরা হয়, তারপর ফের সেগুলোকে জলে ফেলে দেওয়া হয়। ওই যে ধরা হয় তাতে মাছ খুব চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে গিয়ে পেল্লায় সাইজের হয়ে দাঁড়ায়।”
ন্যাড়া নিশ্চিন্ত হয়ে তার ডানহাতের বাইসেপটা বাঁ হাত দিয়ে একটু পরীক্ষা করে নিয়ে বলে, “ঠিক কথা তো?”
“আজ্ঞে চারুদত্তর কথা মিথ্যে হয় খুব কম।”
“চারুদত্ত! সে আবার কে?”
“কেন, আমি! নামটা ভাল নয়?”
“এই যে বললেন আপনার নাম দ্বৈপায়ন!”
“বলেছি? বুড়ো বয়সে মাথাটাই গেছে। আমার ঠাকুরদার মাথার দোষ ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে যাকে-তাকে কামড়াতেন। সেই দোষটাই বর্তেছে আমার ওপর। না না, ভয় পেয়ো না থোকা। তোমাকে আমি কামড়াব না। আমার নাম দ্বৈপায়নও বটে, চারুদত্তও বটে। আরও কয়েকটা আছে, সব মনে পড়বে ধীরে ধীরে। তা, বলছিলাম কি, শিবুবাবুর যে ছেলে পুলিশে চাকরি করে, সে কোথায়?
“সেজদা! সেজদা তো সেই কুমড়োডাঙায়।”
“অনেকটা দুর নাকি?”
“হ্যাঁ, যেতে দেড় দিন লাগে। চারটে খাল পেরোতে হয়।”
“বাঃ বাঃ। খবরটা ভাল। তা খোকা, তোমাদের বন্দুক-টন্দুক নেই? শিবুবাবুর আমলে কিন্তু ছিল।”
“আছে, কিন্তু ব্যবহার হয় না।”
“খুব ভাল, খুব ভাল, বন্দুক বড় ভাল জিনিসও নয়। ওসব বিদেয় করে দেওয়াই ভাল। তা তুমিই বুঝি কুস্তিগির?”
“হ্যাঁ।”
“বাঃ বেশ। এরকমই চাই। তা সময়মতো দু’একটা প্যাঁচ-টাচ শিখিয়ে দেব’খন।”
“আমি গজ পালোয়ানের কাছে শিখি।”
“গজ পালোয়ান! সে আবার কে?”
“ওই যে চক সাহেবের বাড়িতে যার আখড়া।” কথাটা শুনে লোকটার মুখটা একটু যেন অন্যরকম হয়ে গেল।
০৫.
ন্যাড়াকে আর বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করল না পঞ্চানন্দ। কয়েক মিনিটেই সে বুঝে নিয়েছে ন্যাড়া কীরকম লোক। তাই সে বলল, “তা বেশ ছোটবাবু, কুস্তিটুস্তি খুব ভালো জিনিস। তুমি বরং তোমার মাসল-টাসল দ্যাখো। পঞ্চানন্দ বেরিয়ে এসে বাড়িটার এদিক-সেদিক সতর্ক পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বলতে নেই বাড়িটা বেশ বড়ই। একতলা দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর। বড় বড় বারান্দা। চাকর-বাকরদের থাকার জন্যে বাড়ির হাতার মধ্যেই আলাদা ঘর আছে। দেখেশুনে পঞ্চানন্দ খুশিই হল। ঘরদোরের চেকনাই দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এদের বেশ পয়সাকড়ি আছে। এরকমটাই আশা করেছিল সে।
ঘুরতে ঘুরতে একতলার একখানা ঘরে ঢুকে পড়ল পঞ্চানন্দ। সেই ঘরে ওস্তাদ খৈয়াম খয়ের ছবির সামনে জরিবাবু ধ্যান করছিলেন তখন। বিকেলের রেওয়াজ শুরু করার আগে গুরুর ছবির সামনে একটু ধ্যান তিনি রোজই করেন। তারপর তানপুরাটাকে প্রণাম করে তুলে নেন। শুরু হল সুরের খেলা।
খৈয়াম খাঁ লখনউতে থাকেন। রগচটা বুড়ো মানুষ। বিশেষ কাউকে পাত্তা দেন না। যে-সব শিষ্যকে গানবাজনা শেখান, তারা তাকে যমের মতো ডরায়, আবার ভক্তিও করে। তাঁর চেহারাটা দেখবার মতো। বিশাল যমদূতের মতো পাকানো গোঁফ, মাথায় মস্ত পাগড়ি, গায়ে গলাবন্ধ কোট। চেহারাটা রোগাটে হলেও বেশ শক্তপোক্ত। চোখ দুখানা ভীষণ রাগী-রাগী। তার ফোটোর চোখের দিকে তাকালেও একটু ভয়-ভয় করে। শোনা যায় একসময় খৈয়াম খাঁ ডাকাতি করে বেড়াতেন। মানুষ-টানুষ মেরেছেনও মেলা। একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে এক বাড়ির দোতলা থেকে লাফ মারতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে যায়। ভাঙা ঠ্যাং নিয়েই পালিয়ে যান অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে। তারপর মাস-চারেক পায়ে প্লাস্টার। বেঁধে ঘরে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন সময় কাটানোর জন্য গান ধরেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই গায়ক হয়ে ওঠেন। খৈয়াম খাঁ এতই উঁচুদরের ওস্তাদ যে, সুর দিয়ে তিনি প্রায় যা-খুশি তা-ই করতে পারেন বলে একটা কিংবদন্তি আছে। শক্তি আছে বলে বৈজ্ঞানিকরা বিশ্বাস করেন, তার নাকি সাক্ষাৎ প্রমাণ খৈয়াম খয়ের গান। একদিন নাকি খৈয়াম খাঁ সকালবেলায় তাঁর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পোষা পায়রা ওড়াচ্ছিলেন। সেই সময়ে একটা বাজপাখি তার একটা পায়রাকে তাড়া করে। খৈয়াম খাঁ শুধু একটা তান ছুঁড়ে দিলেন আকাশে। সেই শব্দে
বাজপাখিটা কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে পড়ে গেল। আর একবার একটা বন্ধ দরজার তালা খোলা যাচ্ছিল না। খৈয়াম খা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শুধু গুনগুন করে ভাঁজলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে তালা কড়াত করে খুলে গেল। এমনও শোনা যায়, খৈয়াম খাঁর রেওয়াজের সময় নাকি রাজ্যের ভূত-প্রেত এসে চারদিকে ঘিরে বসে হাঁ করে গান শোনে। তাদের দেখা যায় না বটে, কিন্তু গায়ের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়।
এহেন খৈয়াম খাঁর শিষ্য বলেই জরিবাবুরও গানের ওপর অগাধ বিশ্বাস। তিনি জানেন ঠিক মতো ঠিক জায়গায় ঠিক সুর লাগাতে পারলে যে-কোনও অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। প্রায় সময়েই তিনি একটা নেবানো মোমবাতি সামনে নিয়ে বসে রেওয়াজ করেন। কোনওদিন সুরের আগুনে মোমটা দপ করে জ্বলে উঠবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। গান গেয়ে তিনি জানালার কাঁচের শার্সি ফাটিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। জরিবাবু জানেন এই বাড়িতে ভূত আছে। তিনি দেখলেও ঝি-চাকরেরা বহুবার দেখেছে। গান গাওয়ার সময় প্রায় তিনি অনুভব করার যেষ্টা করেন ভূতেরা গান শুনতে এসেছে কি না। আজও তেমন কিছু স্পষ্টভাবে অনুভব করেননি। হয়তো এ-বাড়ির ভূতদের গানে তেমন আগ্রহ নেই। তবে আগ্রহ তিনি জাগিয়ে তুলবেনই। নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে গেলে যে মোমবাতিও জুলবে, শার্সিও ফাটবে এবং ভূতও আসবে, এই বিশ্বাস তার আছে।
আজ গুরুর ছবির সামনে ধ্যান করতে করতে জরিবাবু যেন স্পষ্টই খৈয়াম খাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। এরকম মাঝেমাঝে পান। ধ্যানে কথাবার্তাও হয় তাদের। আজ জরিবাবু ধ্যানে দেখলেন খৈয়াম খাঁ বিকেলে তার বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারি করছেন। করতে করতে একটা গোলাপ গাছের সামনে দাঁড়ালেন। গাছটায় অনেক কুঁড়ি হয়েছে, তবে একটা ফোঁটা ফুল নেই। খৈয়াম খ গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজলেন। অমনি ফটাফট কুঁড়িগুলো ফুটে মস্ত মস্ত গোলাপফুল হয়ে হাসতে লাগল। খৈয়াম খাঁ জরিবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “সুর মে রগড়ো, সুর মে মরো। বুঝলি ব্যাটা, সুরের পিছনে অসুরের মতো লেগে থাকতে হয়। সুরই সিঁড়ি, সুরই সড়ক, সুরই সম্পদ। বুঝলি?”
“জি হাঁ, খাঁ সাহেব।”
“রেওয়াজ করতে করতে গলা দিয়ে রক্ত উঠবে, তবু ছাড়বি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবি, ভিরমি খাবি, খিদে পাবে, তবু রেওয়াজ ছেড়ে উঠবি না। আমি একসময়ে দিনে আঠারো ঘণ্টা রেওয়াজ করেছি জানিস?”
“জানি খাঁ সাহেব।”
“তবে শুরু করে দে। সুরে ফুল ফুটিয়ে দিয়ে যা দুনিয়ায়। গান গাইবি এমন যে, মড়ার দেহে পর্যন্ত প্রাণসঞ্চার হয়ে যাবে।”
ভক্তিভরে গুরুদেবকে প্রণাম করে জরিবাবু ধ্যান শেষ করে তানপুরাটা তুলে নিলেন। তারপর পূরবীতে ধরলেন তান। আজ গলায় যেন আলাদা মেজাজ লেগেছে। খুব সুর খেলছে।
চোখ বুজে গাইতে গাইতে হঠাৎ তাঁর গায়ে কাঁটা দিল। কেমন যেন শিরশির করতে লাগল ঘাড়ের কাছটা। তিনি একটা গন্ধ পাচ্ছেন। চেনা গন্ধ নয়। অচেনা গন্ধ। ঠিক বোটকা গন্ধ বলা যায় না বটে, কিন্তু বোঁটকা কথাটাও তো গোলমেলে। বোঁটকা বলতে ঠিক কোন গন্ধটাকে বোঝায়, তাই বা ক’জন বলতে পারে। তার ওপর সব ভূতের গায়ে কি আর একরকমের বোঁটকা গন্ধ হবে? হেরফের হবে না?
গাইতে গাইতেই বড় করে একটা শ্বাস নিলেন। না, কোনও ভুল নেই। একটা অদ্ভুত গন্ধ। সন্দেহ নেই, গানের টানে অদৃশ্যের জগৎ থেকে কেউ একজন এসেছে। একজন? না একাধিক?
চোখ খুলতে ঠিক সাহস হল না জরিবাবুর। মানুষটা তিনি খুব সাহসীও নন। ভূতপ্রেতকে ভয় পান। ভূতেরা তাঁর গান শুনুক এটা তিনি চান বটে, কিন্তু তারা একেবারে চোখের সামনে এসে হাজির হোক এটা তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। ভূত ভূতের মতোই থাকবে, আড়ালে-আবডালে। চক্ষুলজ্জা বজায় রেখে।
খুব সাবধানে জরিবাবু তান ছাড়তে ছাড়তে বা চোখ বন্ধ করে রেখে ডান চোখটা সিকিভাগ ফাঁক করলেন। ঘরের মধ্যে সন্ধের অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে উঠেছে। শব্দসাধনা করার জন্য ঘরের জানালা সব কটকটে আঁটা বলে আরও অন্ধকার লাগছে। জরিবাবু তান ছাড়তে ছাড়তে কোনাচে দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখার চেষ্টা করলেন। প্রথমটায় কিছু দেখতে পেলেন না। তারপর হঠাৎ চোখে পড়ল দরজার দিকে একটা আবছায়া মূর্তি।
জরিবাবুর গলায় পূরবীতে হঠাৎ কঁপন লাগল।
সে এমন কাঁপন যে, সুরটা পূরবী ছেড়ে হঠাৎ বেসুরো হয়ে তারসপ্তকে চড়ে বসল। কিছুতেই সেখান থেকে নামে না। জরিবাবুর হাত কাঁপতে লাগল, পা কাঁপতে লাগল, গলা কাঁপতে লাগল। এবং তারপর তিনি টের পেলেন গলা দিয়ে সুর নয়, কেবল “ভূ…..ভূ….ভূ শব্দ বেরিয়ে আসছে।
ভূতটা হঠাৎ নড়ে উঠল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “না গো মশাই, হচ্ছে না। গলায় জোয়ারি ছিল ভালই, কিন্তু সুরটা কেটে গেল।”
জরিবাবুর অবশ হাত থেকে তানপুরাটা ঝনাত করে পড়ে গেল। কঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আর হবে না।”
“কী হবে না?”
“আর কখনও গাইব না।”
“সে কী! গাইবেন না কেন? গান তো ভাল জিনিস। মন ভাল থাকে, ফুসফুস ভাল থাকে, গলায় ব্যায়াম হয়। গাইবেন না কেন। খুব গাইবেন। আমাদের গাঁয়ের করালী ওস্তাদ এমন গান গাইত যে, আশেপাশের সাতটা গাঁয়ে কখনও চোর আসত না। গান ভারি উপকারী জিনিস।”
জরিবাবু কেমন যেন ক্যাবলার মতো খানিক লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন। তার মনে হতে লাগল, এই ভূতটা যথার্থ ভূত না হতে পারে। হয়তো চোর।
চোরকেও জরিবাবু যথেষ্ট ভয় পান। গলা-খাঁকারি দিয়ে তিনি একটু ধাতস্থ
হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “আপনি কোনটা?”
‘‘আজ্ঞে, তার মানে?”
“মানে ইয়ে, আপনি ভূত না চোর?”
পঞ্চানন্দ এই কথায় দাঁত বের করে খুব একচোট হাসল। তারপর ঘাড়টাবে চুলকে ভারি লজ্জার ভাব দেখিয়ে বলল, “আজ্ঞে বোধহয় দুটোই।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে ভূতেরা কি কেউ কখনও চোর ছিল না? নাকি চোররাই কেউ কখনও মরে ভূত হয় না?”
“ছিল। হয়।”
“তাহলে? আমি ভূতও বটি, চোরও বটি।”
“দুটোই?”
পঞ্চানন্দ ঘাড় হেলিয়ে নির্বিকার মুখে বলল, “দুটোই। তবু বলি মশাই, সন্দেহও একটু আছে। বছর-কুড়ি আগে ত্রিশূল পর্বত থেকে নামবার সময় বরফের উপর দিয়ে পিছলে তিন হাজার ফুট গভীর এক খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। আমারই দোষ। বঙ্কুবাবা বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, ওরে পঞ্চানন্দ, তোকে যে চৌম্বক খড়মজোড়া দিয়েছি, সেটা ছাড়া কখনও বেরোসনি, পিছলে যাবি। তা তাড়াহুড়োয় সেকথা ভুলে খালিপায়ে বেরিয়ে ওই বিপত্তি। সাতদিন জ্ঞান ছিল না। পরে জ্ঞান-টান ফিরলে, খাদ থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠেও এলাম। কিন্তু যে আমি উঠে এলাম, সে আসল পঞ্চানন্দ না পঞ্চানন্দর ভূত, তা মাঝে মাঝে ঠিক করতে পারি না মশাই। এমনও হতে পারে যে, খাদে পড়ে আমি অক্কা পেয়েছিলাম আর আমার ভূতটা উঠে এসেছে। আর চোর কি না? মশাই, আমি লুকোব না আপনার কাছে, হাতটার দোষ আমার বহুদিনের।”
জরিবাবু কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে দুর্বল গলায় একবার ডাকলেন, “ওরে ন্যাড়া, এদিকে আয়।”
“ন্যাড়া! ন্যাড়ার অবস্থা আপনার চেয়েও খারাপ। একটু আগে দেখে এসেছি শয্যা নিয়েছেন।”