সাতের এক বালিগঞ্জ পার্ক
সাতের এক বালিগঞ্জ পার্কের বাড়িতে যে বয়সের ছাপা পড়েছে সেটা আর বলে দিতে হয় না। এটাও ঠিক যে বাড়ির মালিকের যদি সে ছাপ ঢাকবার ক্ষমতা থাকত, তা হলে ঢাকা পড়ত নিশ্চয়ই। তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে দত্ত পরিবারের অবস্থা এখন খুব একটা ভাল নয়। বাগানটা বোধহয় বাড়ির পিছন দিকে। সামনে একটা গোল ঘাসের চাকতির উপর একটা অকেজো ফোয়ারা, সেই গোলের দুপাশ দিয়ে নুড়িবেছানো রাস্তা চলে গেছে গাড়িবারান্দার দিকে। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে গোলোকধাম দেখে ফেলুদা কৌতুহল প্রকাশ করাতে সুবীরবাবু বললেন যে ওঁর ঠাকুরদাদার নাম ছিল গোলোকবিহারী দত্ত। বাড়িটা তিনিই তৈরি করেছিলেন।
লোকধাম যে এককালে দারুণ বাড়ি ছিল সেটা এখনও দেখলে বোঝা যায়। গাড়িবারান্দা থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে শ্বেতপাথরের বাঁধানা ল্যান্ডিং-এর বাঁদিক দিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। সামনে একটা দরজা দিয়ে ভিতরে করিডর দেখা যাচ্ছে, তার ডান দিকে নাকি পর পর দুটো ফ্র্যাট। বাঁ দিকে একটা প্ৰকাণ্ড হলঘর, যেটা দত্তরা ভাড়া দেননি। এই ঘরে নাকি এককালে অনেক খানাপিনা গানবাজন হয়েছে।
হলঘরের ঠিক ওপরেই হল দোতলার বৈঠকখানা। আমরা সেখানেই গিয়ে বসলাম। মাথার ওপর কাপড়ে মোড়া চিরকালের মতো অকেজো ঝাড়লণ্ঠন, তার যে কত ডালপালা তার ঠিক নেই। একদিকে দেয়াল গিল্ট-করা ফ্রেমে বিশাল আয়না, সুবীরবাবু বললেন সেটা বেলজিয়াম থেকে আনানো। মেঝেতে পুরু গালিচার এখানে ওখানে খুবলে গিয়ে দাবার ছকের মতো সাদা-কালো শ্বেতপাথরের মেঝেটিা বেরিয়ে পড়েছে।
সুবীরবাবু সুইচ টিপে একটা স্ট্যান্ডার্ড ল্যাম্প জ্বলিয়ে দিতে ঘরের অন্ধকার খানিকটা দূর হল। আমরা সোফায় বসতে যাব, এমন সময় বাইরের করিডর থেকে একটা শব্দ পাওয়া গেল—খট্ খট্ খট্ খট্।
লাঠি আর চটি মেশানো শব্দ।
শব্দটা চৌকাঠের বাইরে এসে মুহূর্তের জন্য থামল; আর তার পরেই লাঠির মালিকের প্ৰবেশ। সেই সঙ্গে আমরা তিনজনেই দণ্ডায়মান।
অচেনা গলার আওয়াজ পেলাম—এঁরা এলেন বুঝি?
গভীর গলা, ছফুট লম্বা চেহারার সঙ্গে সম্পূর্ণ মানানসই। এনার চুল সব পাকা, কিছুটা এলোমেলো, চোখে কালো চশমা, পরনে আদির পাঞ্জাবি আর সিস্কের পায়জামা। বিস্ফোরণ যে শুধু চোখই নষ্ট করেনি, মুখের অন্যান্য অংশেও যে তার ছাপ রেখে গেছে, সেটা ল্যাম্পের চাপা। আলোতেও বোঝা যাচ্ছে।
সুবীরবাবু দাদাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন।—বাসো, দাদা।
বসছি। আগে এঁদের বসাও।
নমস্কার, ফেলুদা বলল, আমার নাম প্রদোষ মিত্র। আমার বাঁ পাশে আমার কাজিন তপেশ।
আমিও খাটা গলায় একটা নমস্কার বলে দিলাম। শুধু হাত জোড় করাটা তো অন্ধ লোকের কাছে মাঠে মারা যাবে।
আমারই মতো হাইট বলে মনে হচ্ছে মিত্তির মশাইয়ের, আর কাজিন বোধ করি পাঁচ সাত কি সাড়ে সাত।
আমি পাঁচ সাত, বলে ফেললেন তপেশরঞ্জন মিত্ৰ।
মনে মনে ভদ্রলোকের আন্দাজের তারিফ না করে পারলাম না।
বসুন এবং বোসো বলে ভাইয়ের সাহায্য না নিয়েই আমাদের সামনের সোফায় বসে পড়লেন নীহার দত্ত। —চায়ের কথা বলেছ?
বলেছি, বললেন সুবীর দত্ত।
ফেলুদা অভ্যাসমতো ভনিতা না করে সোজা কাজের কথায় চলে গেল।
আপনি যে রিসার্চ করছিলেন, সে ব্যাপারে বাধ হয় আপনার একজন পার্টনার ছিল, তাই না?
সুধীরবাবুর উসখুসে ভাব দেখে বুঝলাম যে এ ব্যাপারটা তিনিও জানতেন, এবং আমাদের না বলার জন্য অপ্ৰস্তুত বোধ করেছেন।
পার্টনার নয়, বললেন নীহার দত্ত—অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপ্রকাশ চৌধুরী। সে আমেরিকাতেই পড়াশুনা করেছিল। পার্টনার বললে বেশি বলা হবে। আমাকে ছাড়া তার এগোনোর পথ ছিল না।
তিনি এখন কোথায় বা কী করছেন সে খবর জানেন?
না।
অ্যাক্সিডেন্টের পর তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি?
না।
এটুকু বলতে পারি যে তার একাগ্রতার অভাব ছিল। বায়োকেমিস্ট্রি ছাড়াও অন্য পাঁচ রকম ব্যাপারে তার ইন্টারেস্ট ছিল।
বিস্ফোরণটা কি অসাবধানতার জন্য হয়?
আমি নিজে সজ্ঞানে কখনও অসাবধান হইনি।
চা এল। ঘরটা কেমন যেন থমথম করছে। সুবীরবাবুর দিকে আড়াচাখে দেখলাম। তাঁরও যেন তটস্থ ভাব। ফেলুদা একদৃষ্টে চেয়ে আছে কালো চশমার দিকে।
চায়ের সঙ্গে শিঙাড়া আর রাজভোগ। আমি প্লেটটা হাতে তুলে নিলাম। ফেলুদার যেন খাওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই। ও একটা চারমিনার ধরিয়ে নিয়ে বলল——
আপনি যে ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, সেটা তা হলে অসমাপ্তই রয়ে গেছে!
সে দিকে কেউ অগ্রসর হলে খবর পেতাম নিশ্চয়ই।
সুপ্রকাশবাবু সে নিয়ে আর কোনও কাজ করেননি সেটা আপনি জানেন?
এটুকু জানি যে আমার নোটস ছাড়া তার কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। গবেষণার শেষপর্বের নোটস্ আমার কাছে ছিল আমার ব্যক্তিগত লকারে। তার নাগাল পাওয়া বাইরের কারোর সাধ্যি ছিল না। সে সব কাগজপত্র আমার সঙ্গেই দেশে ফিরে আসে, আমার কাছেই আছে। এটা জানি যে গবেষণা সফল হলে নোবেল প্রাইজ এসে যেত আমার হাতের মুঠোয়। ক্যানসারের চিকিৎসার একটা রাস্তা খুলে যেত।
ফেলুদা চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিয়েছে। আমিও ইতিমধ্যে চুমুক দিয়ে বুঝেছি এ চা ফেলুদার মতো খুঁতখুঁতে লোককেও খুশি করবে। কিন্তু চুমুক দিয়ে তার মুখের অবস্থা কী হয় সেটা আর দেখা হল না।
ঘরের বাতি নিভে গেছে। লোডশেডিং। এক’দিন থেকে ঠিক এই সময়টাতেই যাচ্ছে, সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন সুবীরবাবু।–
কৌমুদী!
বাইরে এখনও অল্প আলো রয়েছে; সেই আলোতেই সুবীরবাবু চাকরের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। –
বাতি গেল বুঝি? প্রশ্ন করলেন নীহার দত্ত। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এতে আমার কিছু এসে যায় না।
গ্র্যান্ডফাদার ক্লিকটা ঠিক এই সময় আমাদের চমকে দিয়ে বেজে উঠল—ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং। ছ’টা।
সুবীরবাবু ফিরলেন, পিছনে মোমবাতি হাতে চাকর কৌমুদী।
মাঝের টেবিলে মোমবাতি রাখায় সকলের মুখ আবার দেখা যাচ্ছে। নীহারবাবুর কালো চশমার দুই কাচে দুটি কম্পমান হলদে বিন্দু। মোমবাতির শিখার ছায়া।
ফেলুদা চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে আবার চশমার দিকে চেয়ে বলল, আপনার গবেষণার নোটস যদি অন্য কোনও বায়োকেমিস্টের হাতে পড়ে তা হলে তাঁর পক্ষে সেটা লাভজনক হবে কি?
নোবেল প্ৰাইজটা যদি লাভ বলে মনে করেন তা হলে হতে পারে বইকী।
আপনার কি মনে হয় এই কাগজপত্র চুরি করার জন্য চোর আপনার ঘরে ঢুকেছিল?
সেরকম মনে করার কোনও কারণ নেই।
আরেকটা প্রশ্ন। আপনার এই নোটসের কথা আর কে জানে?
বৈজ্ঞানিক মহলে অনেকেই এটার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারে। আর জানে আমার বাড়ির লোকেরা আর আমার সেক্রেটারি রণজিৎ।
বাড়ির লোক বলতে কি একতলার দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কথাও বলছেন?
তারা কী জানে না-জানে তা আমি জানি না। এরা ব্যবসাদার লোক। জানলেও কোনও ইন্টারেস্ট হবার কথা না। অবিশ্যি আজকাল তো সব জিনিস নিয়েই ব্যবসা চলে; এ ধরনের কাগজপত্র নিয়েই বা চলবে না কেন। বিজ্ঞানী হলেই তো আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হয় না।
নীহারবাবু উঠে পড়লেন; সেই সঙ্গে আমরাও।
আপনার ঘরটা একবার দেখতে পারি কি? ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভদ্রলোক চৌকাঠের মুখে থেমে গিয়ে বললেন, দেখবেন বইকী। সুবীর দেখিয়ে দেবে। আমি ছাতে সান্ধ্যভ্রমণটা সেরে আসি।
করিডরে বেরিয়ে এলাম চারজনে। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এসেছে। করিডরের ডাইনে বাঁয়ে ঘরগুলার ভিতুর থেকে মামবাতির ক্ষীণ আলা বাইরে এসে পড়েছে। নীহারবাবু লাঠি ঠক ঠক করে ছাতের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। শুনলাম। তিনি বলছেন, স্টেপ গোনা আছে। সতেরো স্টেপ গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে সিঁড়ি। সেভেন প্লাস এইট—পনেরো ধাপ উঠে ছাত। প্রয়োজন হলে খবর দেবেন…