Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গোরু (১)

গোরুর ইংরিজি কাউ। কিন্তু কোনও গোরুর নামও যে কাউ হতে পারে সেটা জানা গেল ইম্ফলের এক খবরে।

কাউ নামে ইম্ফল শহরের এই বলদটি সংবাদ সৃষ্টি করেছে। সে অন্যান্য ধর্মের ষাঁড়ের মতোই পথচারী এবং বলশালী, সংস্কৃত শ্লোকের ভাষায় বলা যেতে পারে তার ভোজন যত্রতত্র, শয়ন হট্টমন্দিরে। তাকে অনেকে খাবার দেয়, অনেকে দেয় না। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনও বাড়াবাড়ি, জোরাজুরি নেই। তরকারির দোকানে গিয়ে সে মুখ বাড়ায়, তরকারিওলা তাকে সামান্য কিছু দিল কি দিল না, তারপর পরের দোকানে চলে গেল। গৃহস্থবাড়ির দরজাতে গিয়েও তাই। কিছু মিলল তো কাউ খুশি মনে জাবর কাটতে কাটতে পরের দরজায় গেল। না মিললেও তার কোনও ক্ষোভ, ক্রোধ বা উষ্মা নেই, সরল মনে সে চলে যায়।

কাউয়ের মতো পথের গোরু সব জায়গাতেই দেখা যায় বলবান অথচ বিনীত, নিরভিমান, পরমুখাপেক্ষী। কাউ সংবাদ হয়েছে অন্য কারণে। কারণটি রীতিমতো রাজনৈতিক। সে গোরুমুক্তি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। এমনিতে অন্য কোনও গোরু বা মানুষের উপরে তার কোনও রাগ দেখা যায় না। কিন্তু কাউ যদি দেখে কোনও গোরুকে মানুষ খাটাচ্ছে, যেমন গাড়ি টানাচ্ছে বা লাঙল চালাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে যায়। কাউয়ের সামনে দিয়ে কোনও গোরুর গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। চোখে পড়লেই শিং তুলে দৌড়ে আক্রমণ করবে, গাড়িতে যুক্ত বলদ বা ষাঁড় দুটিকে মুক্ত না করা পর্যন্ত গাড়োয়ানের পরিত্রাণ নেই। পারতপক্ষে কাউ যখন যে রাস্তায় থাকে, সে পথ দিয়ে কোনও দুঃসাহসী গাড়োয়ানও গাড়ি নিয়ে যায় না। কৃষকদেরও যথেষ্ট বিপদ, শহরতলির রাস্তা ধরে জোয়ালে বাঁধা গোরু নিয়ে মাঠে চাষ করতে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে, এই দৃশ্য চোখে পড়লেই কাউ ছুটে আসবে। কৃষকেরা প্রাণের ভয়ে চাষের গোরু আলাদা করে মুক্ত অবস্থায় নিয়ে যায়, তার আগে বা পরে লাঙল নিয়ে যায়, যাতে কাউ জোয়ালে বদ্ধ অবস্থায় চাষের গোরু দেখতে না পায়।

দিগদিগন্তে, গ্রামে গ্রামে, জনপদে ইম্ফলের প্রবল পরাক্রান্ত কাউয়ের এই গোরুমুক্তি আন্দোলন যদি প্রসারিত হয় তা হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এই সুপ্রাচীন দেশের সনাতন ঐতিহ্যের প্রতীক গো-শকট লুপ্ত হয়ে যাবে এবং ক্ষেতে চাষ ঘোড়া দিয়ে কিংবা ট্রাক্টর দিয়ে করতে হবে।

কাউ কেন এ রকম করে ? গোরুর মনস্তত্ববিদ থাকলে হয়তো জার্মান ও লাটিন শব্দ কণ্টকিত একটা সাড়ে সাত পাতা ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। কিন্তু তার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে গোরুর যে বুদ্ধির অভাব নেই সে বিষয়ে আমি নিজেই সাড়ে সাত পাতা লিখতে পারি।

বছর পঁচিশ আগে কালীঘাটে একটা বিখ্যাত ষাঁড় ছিল। যে কোনও ফৌজদারি মামলার আসামির মতো তার একাধিক নাম ছিল (বলহরি ওরফে শিবু।) কেওড়াতালার দিকে দেখেছি স্থানীয় লোকেরা তাকে বলহরি বলে ডাকে, এদিকে হাজরার মোড়ের দিকে তার নাম ছিল শিবু। বহুরকম গোলমেলে কার্যকলাপ ছিল এই বলহরি ওরফে শিবুর। একাধিকবার সে বসুশ্রী কফিহাউসের দোতলায় উঠবার চেষ্টা করেছে। বোধ হয় কারও খোঁজে যেত। চারু মার্কেট থেকে জগুবাবুর বাজার—দক্ষিণ কলকাতার এই বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল তার সাম্রাজ্য। আমাদের পুরনো বাড়ির ভাঙা সংকীর্ণ প্যাসেজে একেকদিন রাতে সে পথ আটকে শুয়ে থাকত, তাকে টপকিয়ে বাড়ি ঢুকতে হত। গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে একটি পর্বতপ্রমাণ তীক্ষ্ণশৃঙ্গ বলীবর্দকে অতিক্রম করে গৃহপ্রবেশ খুব মধুর ছিল না, তার অত্যাচারে বেশ কিছুদিন আমাকে নৈশভ্রমণ বন্ধ রাখতে হয়।

চুরি করে বা জোর করে খাওয়া, নিরীহ পথিককে তাড়া করে যাওয়া, শিশু ও মহিলাদের ভয় দেখিয়ে তাদের হাত থেকে মিষ্টি বা শিঙাড়ার চুপড়ি ছিনিয়ে নিয়ে অতি দ্রুত গলাধঃকরণ করা ইত্যাদি ষণ্ডজনিত বহুরকম অন্যায় সে করত। একবার কী কারণে উত্তেজিত হয়ে কালিকা সিনেমার দশ আনার লাইনের নিরীহ দর্শকদের সে গুঁতিয়ে দেয়। কয়েকবার নির্বিকার চিত্তে ট্রামলাইনে শুয়ে থেকে সে দক্ষিণ কলকাতার ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বানচাল করে দেয়; এদিক দিয়ে সে পাতাল রেলের পূর্বসুরী।

এই রকম সব নানাবিধ কুকর্ম করার জন্যেই সে দাগী আসামিদের মতো দুটি নামের সুবিধে গ্রহণ করে। রাসবিহারী পাড়ার লোকের নালিশ শুনে কালীঘাট ফাঁড়ির পুলিশ যখন বলহরিকে খুঁজতে বেরিয়েছে, তখন সে নিশ্চিন্ত চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিশ মুখার্জি—রোডে সেখানে সে শিবু নামে পরিচিত।

বলহরি যে সব সময় বেআইনি কাজ করত তা কিন্তু নয়। হাজরার দক্ষিণ-পশ্চিম মোড়ে জুতো পালিশওলাদের বেআইনি অবস্থান সে একাধিকবার গুঁতিয়ে তছনছ করে দেয়। একটি অশ্লীল পত্র-পত্রিকার দোকানের সব বইপত্র কিছু খেয়ে ফেলে, কিছু ছিঁড়ে পদদলিত করে সে পর্নো-বিপণিটি তুলে দেয়।

আমরা তাকে তার মধ্য-যৌবনে দেখেছি। তখন তার রাশভারী, অভিজাত ভাব। উত্তেজিত বা ক্রুদ্ধ না হলে ছুটোছুটি, গুঁতোগুঁতি করত না। তবে তার বুদ্ধি তখন তুঙ্গে। বলহরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিশ্বকর্মা পুজোর সময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি কাটাকাটি দেখত। ঘুড়ি কেটে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে হেলতে-দুলতে সমবেত দৌড়বাজ বালকদের উপেক্ষা করে, কখনও শিং দিয়ে সরিয়ে, সে একটু মাথাটা তুলে উড়ন্ত ঘুড়িটা মুখে ধরে খেয়ে নিত। ঘুড়ির প্রতি প্রচণ্ড আসক্তি ছিল তার। কালীঘাটে রথের মেলায় যে বেশ কয়েক বছর ঘুড়ির দোকান বসেনি তার প্রধান কারণ বলহরির অত্যাচার। হাজরার মোড়ে যখন প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাফিক আলো এল সে সময় লাল-সবুজ-হলুদের পার্থক্য সে আমাদের অনেক আগে বুঝতে পেরেছিল। প্রৌঢ় বলহরিকে দেখেছি ট্রাফিক লাইটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবুজ আলোর প্রতীক্ষায়।

তবে শেষের দিকে বলহরি বড় অলস হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই নড়াচড়া করত না, খাদ্যসংগ্রহে যেতে চাইত না। তখন শুধু রুমাল খেত বলহরি। নিঃশব্দে পথচারীর পকেট থেকে সে রুমাল তুলে নিত। নিষ্কলঙ্ক ইস্পাতের ছুরি দিয়ে মাখন কাটার মতো ছিল তার উত্তোলন ক্ষমতা। নিরীহ, অসহায় পথিক ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেত না। শেষে তার এই কর্মপদ্ধতি এত সাবলীল হয়ে ওঠে যে, কোনও কুমারী মেয়ের কোমরে শাড়িতে গোঁজা রুমালও যদি বলহরি জিভ দিয়ে তুলে নিত মেয়েটি বুঝতেই পারত না।

অনেকদিন বলহরিকে দেখিনি। মাসখানেক আগে কালীঘাটের পুরনো পাড়ায় গিয়ে তার খোঁজ করেছিলাম। একালে তাকে বিশেষ কেউ চেনে না। এক প্রাচীন ভদ্রলোক বললেন যে কলিযুগের প্রারম্ভে যখন কালীঘাট পার্কের পাশে প্রথম মেট্রোরেলের টিনের চালা উঠল তখন একদিন রাতে বৃদ্ধ বলহরি উন্মত্তের ন্যায় নিষ্ফল আক্রোশে প্রচণ্ড গুঁতিয়ে কয়েকটি টিনের চালা ধরাশায়ী করে উত্তরের দিকে চলে যায়; সে কাশী কিংবা বৃন্দাবন চলে গেছে।

আমি বুঝতে পারছি যে এই ইম্ফলের কাউ কিংবা কালীঘাটের বলহরিকে নাকি পাঠক-পাঠিকারা বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না।

তার থেকে দুটো নির্ভরশীল বিলিতি গোরুর গল্প বলি। লস এঞ্জেলসের কাছে একটা খামারে দেখেছিলাম এক বৃদ্ধ কৃষক তাঁর বাছুরের সঙ্গে দাবা খেলছেন। আমি বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, ‘আপনার বাছুর তো খুব চালাক, দাবা খেলতে পারছে !’ বুড়ো হেসে বলেছিলেন, ‘তেমন চালাক কিছু নয়, তেমন খেলতে পারছে না, এই তো পাঁচবারের মধ্যে তিনবারই হেরেছে।’

আরেকবার বার্সেলোনাতে এক মেমসাহেব আমাকে এক স্পেনীয় গোরুর গল্প শুনিয়েছেন। গল্পের গোরু আমাদের দেশে দুয়েকবার গাছে ওঠে, কিন্তু সেই নীলনয়নার বুলফাইটের দেশের গোরু রেস্তোরাঁয় বিয়ার খেতে ঢুকেছিল। গোরুটি মানুষের মতো চেয়ারে ভব্য হয়ে বসে এবং বেয়ারাকে ডেকে বিয়ারের অর্ডার দেয়। যথা সময়ে পান শেষ করে বিল মিটিয়ে দেয়। যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সাহেব তাকে সাহস করে বলেন, ‘দেখুন, আজ চল্লিশ বছর এই জায়গায় কাজ করছি কিন্তু কোনও গোরুকে বিয়ার খেতে আসতে দেখিনি।’ গোরুটি তিক্ত হেসে বলেছিল, ‘আগে যেমন দেখেননি, পরেও আর দেখবেন না। গোরুদের সাধ্য কি বিয়ার খায়, বিয়ারের যা দাম !’

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *