ওরা এখানে কেন?
গঙ্গার ধারে মোতিগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। টিলাপাহাড়ের ওপর একটা ভাঙা কেল্লাবাড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে গঙ্গার জলে বুনোহাঁসের ঝাঁক দেখছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এইসময় লেন্সের সামনে হলুদ পর্দা সূক্ষ্ম সরল রেখা সারবদ্ধ এবং লাল ছোপ। রক্তের মতো দগদগে। চমকে উঠেছিলেন। তারপর টের পেলেন, বাইনোকুলারের ওপর একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসেছে। বোকা প্রজাপতিটা জানে না, এই লোকটা জাল পেতে প্রজাপতি ধরে।
কর্নেল একটু হাসলেন। এটুকু ক্ষীণ স্পন্দনেই চমকে উঠে প্রজাপতিটা উড়ে গেল। বাইনোকুলার নামিয়ে তাকে দেখতে থাকলেন। ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে প্রজাপতিটা নিচে উড়ে চলেছে। এক ঝক বুনো ফুল ফুটে আছে ঝোঁপের ভেতর। সেখানে গিয়ে বসল সে।
সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি। আবার চোখে বাইনোকুলার রাখলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ হাঁস দেখার পর বাঁদিকে ঘুরলেন। শহরের শেষপ্রান্তে গঙ্গার পাড়েই একটা সুন্দর পার্ক। তার ওদিকে ইতস্তত ছড়ানো সুদৃশ্য সব বাড়ি। বিকেলের রোদ্দুরে আর কুয়াশায় রহস্যময় হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। পার্কের একপ্রান্তে ফুলঝোঁপের আড়ালে একটা বেঞ্চ। বেঞ্চে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোক বসে আছে। দুজনে মুখোমুখি বসার ফলে বাইনোকুলারে শুধু পুরুষটির পিঠের দিকটা বড় হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল।
তারপর দুজনে সোজা হয়ে বসল। অমনি বাইনোকুলারে প্রকাণ্ড হয়ে পাশাপাশি একই লাইনে দুটি মুখ ভেসে উঠল। সৌম্য চৌধুরি এবং কেয়া রায়!
কর্নেল হন্তদন্ত নামতে থাকলেন কেল্লাবাড়ি থেকে। পার্কটা সিকি কিলোমিটার, দূরে। পৌঁছে ওদের আর দেখতে পেলেন না। বেঞ্চ খালি।
বিমলকুমারকে হত্যার অভিযোগে সৌম্য চৌধুরির নামেও পরোয়ানা ঝুলছে। সেই সৌম্য এই মোতিগঞ্জে এসেছেন এবং সঙ্গে কেয়া! কেয়ার সঙ্গে পুরনো প্রেমের একটা রফা হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেন ওঁরা এই মোতিগঞ্জে?
হোটেল পারিজাতে উঠেছেন কর্নেল। হোটেলে পৌঁছে দেখেলেন লবিতে তার জন্য অপেক্ষা করছে হাথিয়াগড়ের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সুরেশ চতুর্বেদী। পরনে সাদা পোশাক। কর্নেলকে দেখে উঠে এলেন। কর্নেল বললেন, কতক্ষণ?
মিনিট পনেরো।
মিঃ শর্মা?
ভীষণ ব্যস্ত। একটা গ্রামে হরিজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের।
আসুন।
দোতলায় পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা স্যুট বুক করেছেন কর্নেল। নিচে গঙ্গা। হোটেলটা একটা টিলার গায়ে পাথুরে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। পাড় ধসার সম্ভাবনা নেই। পুবের ব্যালকনিতে বসলেন দুজনে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটানি আছে। তবু নিচে গঙ্গা। সূর্যাস্তের রাঙা নরম আলোয় ঝলমলে। অলৌকিক বলে মনে হয় এখন।
কর্নেল বললেন, ফোনে সব কথা বলা সম্ভব নয় বলে একটু কষ্ট দিলুম আপনাকে।
সুরেশ চতুর্বেদী হাসলেন।…কোনো কষ্ট না। কেসটা সম্পর্কে আমি আগ্রহী।
সব বলবখন। আগে একটা কথা জানতে চাই।
বলুন!
মোতিগঞ্জে কোনো মিনিস্টারের বাড়ি আছে কি?
চতুর্বেদী আঙুল তুলে একটা দিক দেখিয়ে বললেন, চারজন মিনিস্টারের বাড়ি আছে। দুজন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী, বাকি দুজন বিহার মন্ত্রিসভার সদস্য।
পশ্চিমবঙ্গের কোনো মন্ত্রীর বাড়ি নেই?
না। নেই।
আপনি নিশ্চিত?
অবশ্যই।
এই চারজনের মধ্যে কেউ বাঙালি?
নাঃ।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, এখানে বাঙালি তো প্রচুর আছেন?
তা ঠিক। একসময় মোতিগঞ্জ বাঙালি টাউনই ছিল বলতে পারেন।
বাঙালি বড়লোক আছেন নিশ্চয়?
আছেন। সবাই ব্যবসায়ী। একজন অবশ্য অ্যাডভোকেট আছেন–প্রচুর পয়সা। তিনপুরুষের বাসিন্দা ওঁরা।
নতুন বাড়িও হয়েছে দেখেছি কয়েকটা।
হয়েছে। হচ্ছে।…চতুর্বেদী হাসতে লাগলেন। কতলোকের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে মোতিগঞ্জে। মোতিগঞ্জে মাটির দাম এখন আগুন।
কর্নেল কফি-পকৌড়ার অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। শিগগির এসে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে চতুর্বেদী বললেন, ফাইন! এবার বলুন শুনি, রহস্যটা কি।
কর্নেল সংক্ষেপে চাপা স্বরে আগাগোড়া সবটা বললেন। শুধু সৌম্য ও কেয়ার কথাটা বললেন না। সৌম্য ফেরারী আসামী। চতুর্বেদী কর্তব্যপরায়ণ অফিসার। বলে ধারণা হয়েছে কর্নেলের। জানলে পরে এখনই থানায় খবর পাঠাবেন। কিন্তু কর্নেল সৌম্যকে ধরিয়ে দিতে চান না। এ মুহূর্তে সৌম্যই তার কম্পাসের কাটা।
চতুর্বেদী সিগারেট ধরিয়ে বললেন, একটা ধারণা আমার মাথায় এসেছে। সেই মন্ত্রী ভদ্রলোক যদি বাঙালি হন এবং পশ্চিমবঙ্গের হন, তিনি বেনামে এখানে একটা বাড়ি করতেও পারেন। সেই বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে থাকতেও পারেন। প্রোটোকল অনুসারে পুলিশকে তার জানানোর কথা–অর্থাৎ তার উপস্থিতির সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত থাকে। কিন্তু এটা সরকারি রীতিনীতির ব্যাপার। কোনো মন্ত্রী পুলিশকে না জানিয়েও এখানে গোপনে মাঝে মাঝে আসতে পারেন বৈকি। নিশ্চয় পারেন। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। তারপর ধরুন, খুঁজে বের করা গেল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করবেন কীভাবে? ফিল্মটা তো তিনিই হাতিয়ে নিয়েছেন বলছেন আপনি!
কর্নেল আস্তে বললেন, কিছু করা যাবে না, সেটা ঠিক। কিন্তু অণি শব মুখোমুখি হতে চাই।
লাভটা কী?
সত্যকে জানা।
চতুর্বেদী হেসে বললেন, সত্যকে জানা! বুঝলুম না, কর্নেল!
মিঃ চতুর্বেদী, আমার মানসিক গঠনটাই এরকম। খুনী বা কোনো মারাত্মক অপরাধীকে শাস্তি দেবার জন্য আইনগত পদ্ধতি আছে। আদালত আছে। শেষ পর্যন্ত সে বেকসুর খালাস পেতেও পারে। বহু ক্ষেত্রে পেয়েছে। কিন্তু আমি আসলে ঘটনার মূলটাকে আবিষ্কার করেই তৃপ্তি পাই। মানুষের নাটকীয়তা আমাকে টানে মিঃ চতুর্বেদী! এ আমার নিছক রহস্যভেদের নেশা নয়, জীবনকে তলিয়ে দেখা ও বোঝার একটা আগ্রহ মাত্র।
আপনি দার্শনিক!
মিঃ চতুর্বেদী! বরং আমাকে বিজ্ঞানী বললেই খুশি হবো। ঠিক পদার্থবিজ্ঞানীর পদার্থ সম্পর্কে কৌতূহলের মতোই মানুষের জীবন সম্পর্কে আমার কৌতূহল আছে। বাই দি বাই, আপনি কি আজই হাথিয়াগড়ে ফিরবেন?
না। নাইট হল্ট করব। জিপ আনিনি। ট্রেনে এসেছি। শীতের রাতে ট্রেনজার্নি আমার বিশ্রী লাগে।
কোথায় থাকছেন?
আমার এক কলিগের কোয়ার্টারে। চতুর্বেদী সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, কিন্তু সেই মিনিস্টার ভদ্রলোককে খুঁজে বের করবেন কী ভাবে পুলিশের সাহায্য ছাড়া? বরং এক কাজ করা যায়। এখানে আই বি-র লোকেরা এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না, খোঁজ নিতে পারি।
কিন্তু–
চতুর্বেদী বাধা দিয়ে বললেন, ভাববেন না। ইনফর্মেশান ব্রাঞ্চের লোকেদের সঙ্গে সর্বত্র সাধারণ পুলিশের লোকেদের সম্পর্ক ভাল নয়। আদায় কঁচকলায় সম্পর্ক বলা চলে। সমস্যা হলো, আই বি জেনারেল পুলিশের লোকের সাহায্য ছাড়া আবার কোনো অ্যাকশান নিতে পারে না। তবে আমার ডিপার্টের সঙ্গে আই বি ডিপার্টের একটা বোঝাঁপড়া আছে।
এটা গোখরো সাপ নিয়ে খেলা, মিঃ চতুর্বেদী!
বুঝতে পারছি। খুব প্রভাবশালী লোক এবং—
কেরিয়ারিস্টরা যা হয়, তাই।
সুবিধাবাদী লোক বলুন!
ঠিক বলেছেন। কর্নেল আস্তে বললেন, লোকটি একসময় লেফটু এক্সট্রিমিস্ট দলে ছিল। দলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্ভবত দলকে খতম হওয়ার মুখে ফেলে দিয়ে বিপক্ষে ঢুকেছিল এবং পুরস্কার স্বরূপ মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। সুশোভন গোড়ার দিকেই সেটা টের পেয়ে দলকে জানিয়ে দিয়েছিল। পরিণামে পাল্টা সুশোভনকে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করে সে নিজের হাতে ওকে খুন করে। সে একজন খুনী চরিত্রের লোক। মিঃ চতুর্বেদী, লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে–অথচ তাকে দেখলে তা বোঝা যায় না। এই আমার ধারণা।
তেমন মন্ত্রী কেউ পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আপনি তো সহজেই জানতে পারতেন!
না মিঃ চতুর্বেদী।
জানাটা সহজ নয়। কেন? বয়স একটা ফ্যাক্টর। নিশ্চয় তিনি প্রবীণ নন। অতএব–চতুর্বেদী থামলেন।
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, একই বয়সের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড প্রত্যেকের মোটামুটি একই রকম। সবাই এঁরা বামপন্থী ছিলেন আগে। এঁদের মধ্যে মাত্র একজন কিছুকাল উগ্রবামপন্থী হয়েছিলেন। সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ প্রসঙ্গে খবরের কাগজে নিশ্চয় সে-সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত ছিল। তাই সেই খবর উধাও হয়ে গেছে সব কাগজের অফিসের ফাইল থেকে! পুলিশের ফাঁইল থেকেও।
হ্যাঁ–এও একটা পয়েন্ট। ওই যে বললেন, মাত্র কিছুকাল–ওটাই গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ বামপন্থী নেতা–হয়তো ওই পিরিয়ডে সে নেতাও ছিল না, বিশিষ্ট কর্মীই ছিল–কিছুকালের জন্য সুবিধাবাদের দরুন উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়ে আলাদা এবং উল্লেখযোগ্য কোনো খবর কাগজে নাও বেরুতে পারে।
ওই সুশোভনের মৃত্যুর খবরে ছাড়া তার নাম তত আলোচ্য ছিল না।
ঠিক। সুশোভনের মৃত্যুর খবরের মধ্যে একটু উল্লেখ থাকা সম্ভব।
কাজেই দেখুন, তাকে খুঁজে বের করা কঠিন।
হ্যাঁ, সমস্যাটা এবার স্পষ্ট হলো। চতুর্বেদী একটু চুপ করে থেকে বিরক্তভাবে ফের বললেন, কিন্তু কেয়াদেবী তো তাঁকে চেনেন। কেন আপনাকে বলেননি?
ভয়ে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
ভয়ে, নাকি অন্য কোন কারণে?
কর্নেল একটু ভেবে বললেন, ভয়ও একটা কারণ। তবে অন্য কারণও থাকতে পারে। যাই হোক, আপনি কালকের দিনটা থাকুন মিঃ চতুর্বেদী!
ঠিক আছে। বলে চতুর্বেদী আবার একটা সিগারেট ধরালেন।
মিঃ চতুর্বেদী!
চতুর্বেদী অন্যমনস্কভাবে বললেন, বলুন কর্নেল!
সেই মন্ত্রী এখন মোতিগঞ্জে এসেছেন।
চতুর্বেদী চমকে উঠে তাকালেন।
কর্নেল আস্তে বললেন, হ্যাঁ। তিনি এসেছেন। কারণ–
বলেই থেমে গেলেন। চতুর্বেদী তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কর্নেল আর সে কথায় গেলেন না। কারণটা ব্যাখ্যা করলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন। ঘরে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডাটা বেড়ে যাচ্ছে।