কেন, কেন এবং কেন?
বিকেলে রোদ্দুর আরও ফুটেছে। কিন্তু ছাদের প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে বেশিক্ষণ থাকা কঠিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কাছাকাছি উঁচু বাড়ি নেই বলে শীতের হাওয়ার দাপট বরাবরই এমন। তাতে আড়াইদিনের বৃষ্টি গেল। কর্নেল সেই মরু ক্যাকটাসগুলির ওপর থেকে পলিথিন শিট তুলে তাদের রোদ্দুর খেতে দিলেন। তারপর নেমে এলেন নিচের ড্রইংরুমে।
কেয়া চলে যাওয়ার পর থেকে এই কেসের ৮ দফা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বারবার মাথার ভেতর মাছির ঝাঁকের মতো ভনভন করছিল। টেবিলের সামনে বসে সেগুলি কাগজে লিখে ফেলে তাকিয়ে রইলেন। কিছু কি বাদ পড়ে গেছে?
হুঁ, সুশোভন রায়ের মৃত্যুসংক্রান্ত খবর সব কাগজের লাইব্রেরি থেকে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। পুলিশ দফতর থেকেও একটা ফাঁইলের তিনটে পাতা উধাও। এটা ৯ নম্বর সূত্র। সুশোভনের মৃত্যুর খবর এবং পুলিশ ফাঁইলের নথিতে সুশোভন সংক্রান্ত তথ্যে এমন কিছু ছিল, যা ওই প্রভাবশালী খুনী লোকটিকে জড়িত করে থাকবে। তাই এই সতর্কতা।
এর পরের প্রশ্ন, শ্যামলকান্তি মজুমদার বিহার থেকে ফেরার পথে জলপ্রপাতের কাছে কর্নেলকে ধাক্কা মেরেছিল। একটু হলেই কর্নেল দেড়শো ফুট নিচের পাথরে দলা পাকানো হাড়গোড় ভাঙা লাশ হয়ে পড়ে থাকতেন। গে ক্লাব থেকে ফেরার সময় গাছপালার ছায়ার ভিতর লুকিয়ে শ্যামলকান্তিই কি তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলেন? টেলিফোনে গলার স্বর বদলে তিনিই কি শাসিয়েছিলেন? কেয়াকে বেনামী চিঠিও কি তাঁরই কীর্তি?
যদি তাই হয়, শ্যামলকান্তির মোটিভ কী? উনি কর্নেলকে এই কেস থেকে সরাতে–এমন কী, প্রাণে মেরেও সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কেন? ওঁর আত্মীয় নাকি কোন এক মিনিস্টার। দুয়ে দুয়ে চার করলে সেই মিনিস্টারই সুশোভনের খুনী। তার স্বার্থেই কি শ্যামলকান্তির এই আচরণ?
তাহলে হঠাৎ চাকা উল্টোদিকে ঘুরল কেন? শ্যামলকান্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করল বিমলকুমারকে হত্যার অভিযোগে এবং অরিজিৎ বলেছেন, এ ব্যাপারে উঁচ মহল থেকে চাপ এসেছে–উল্টো চাপ। সেই মিনিস্টারের কাছে হঠাৎ শ্যামলকান্তি বিপজ্জনক বস্তুতে পরিণত হলেন কেন?
কেয়া আভাসে বলে গেল, শ্যামলকান্তিও সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে ব্ল্যাকমেইল করতেন–অন্যভাবে। নট ইন ক্যাশ, বাট ইন কাইডস্। কর্নেল নড়ে বসলেন। নগদ টাকা নয়, পারমিট, কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি আদায় করতেন।
শ্যামলকান্তি এবং সৌম্য চৌধুরী কি বিমলবাবুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে ডবল ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিলেন? নগদ টাকাও দাবি করেছিলেন। কি? এই সিদ্ধান্তে অনিবার্যভাবে আসা যায়। সিদ্ধান্তটি কিছুক্ষণ যাচাই করার পর কর্নেল রঞ্জন মিত্রের দেয়াল ক্যালেন্ডারটি বের করলেন। তারপর ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।
অরিজিৎ! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।
বলুন বস্!
খুশমেজাজে আছ, মনে হচ্ছে ডার্লিং!
ইয়া। রুটিন জব নিয়ে থাকলে মেজাজ খুশ থাকে। করছি তো নেহাত চাকরি।
শ্রীলক্ষ্মী ব্যাংকের ফাঁইলটা কি একটু দেখবে?
কী ব্যাপার?
এই ডেটগুলো বলছি। দেখ তো, এর কাছাকাছি সময়ে তপেশ বসাকের অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ ডিপজিট জমা পড়েছে।
এক মিনিট।…হুঁ, বলুন!
১৯৮০ সালের ১৭ জুন?
পাঁচ হাজার টাকা জমা পড়েছে ২০ জুন। ক্যাশ।
২২ জুন?
২৫ জুন পাঁচ হাজার টাকা। ক্যাশ।
৫ আগস্ট?
৬ আগস্ট দশ হাজার টাকা। ক্যাশ।
১২ অক্টোবর?
১৭ অক্টোবর ক্যাশ দশ হাজার টাকা।
১৯ অক্টোবর?
২৮ অক্টোবর ক্যাশ দশ হাজার টাকা।
দাবি বাড়ছিল উত্তরোত্তর। কর্নেল হাসলেন। ১৫ ডিসেম্বর? ডিসেম্বর–না ডিসেম্বরে নেই। তারপর আর ডিপজিট নেই। ওটাই শেষ ডিপজিট।
আচ্ছা, ছাড়ছি।…
কর্নেল ফোন রেখে কাগজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারিখ এবং টাকার পরিমাণ থেকে কিছু বের করা যায় কি না ভাবতে থাকলেন। জুন মাসের চিহ্নিত তারিখ দুটিতে রঞ্জন যে টাকা আদায় করেছিল, তা ব্যাংকে জমা দিতে তিনদিন সময় লেগেছে। আগস্টের চিহ্নিত তারিখের টাকা জমা দিতে যথাক্রমে পাঁচদিন এবং নদিন লেগেছে।
তা থেকে অনিবার্য সিদ্ধান্ত করা চলে : বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রঞ্জন টাকা আদায় করেছে এবং কখনও নিরাপত্তার স্বার্থে বুকপোস্টে প্রিন্টেড ম্যাটার লিখে কোনো পত্রিকার পাতার ভেতর নোটগুলি ভরে পাঠিয়েছে নিজের নামে। যেমন এই শেষবার করেছিল।
রঞ্জন তার শিকারের পেছনে সব সময় ওত পেতে বেড়াত, সেটা স্পষ্ট। ২৮ অক্টোবর শেষ ডিপজিট। এদিকে ১৫ ডিসেম্বর ঢ্যারা চিহ্নিত এবং জে লেখা। তার মানে, ওই তারিখে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, পায়নি। তার শিকার সময় চেয়েছিলো।
মাই গুডনেস! কর্নেল নড়ে বসলেন আবার। মোতিগঞ্জের ডাকঘর থেকে রঞ্জন বুকপোস্টে টাকা পাঠিয়েছিল–সেদিন ছিল ১৫ জানুয়ারি! জে অবশ্যই জানুয়ারির আদ্যক্ষর। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারা কাটা। তার মানে ১৫ জানুয়ারি টাকা দেবার কথা ছিল–মোতিগঞ্জে। রঞ্জন টাকা পেয়েছিল।
আর বাঘের পেছনে ফেউয়ের মতো শ্যামলকান্তিও যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মোতিগঞ্জে উনিও ছিলেন সেদিন। স্টেশনে ওঁকে দেখেছেন কর্নেল। হাথিয়াগড়েও দেখেছেন ফের। আলাপ হয়েছে। তারপর কোলকাতা ফিরেছেন ওঁর সঙ্গে। জলপ্রপাতের ধারে ধাক্কা।
কিন্তু নিছক রক্তমাখা জামাকাপড়ের জোরেই কি ব্ল্যাকমেল করা সহজ ছিল প্রভাবশালী সিকারকে? হত্যাদৃশ্যের ফোটো পাওয়া যায়নি রঞ্জনের স্যুটকেসে। অথচ শুধু রক্তমাখা পোশাকগুলো হারিয়েই অমন নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করে বসল রঞ্জন!
হুঁ, এখানেই ভাইটাল পয়েন্ট। স্যুটকেস হারিয়ে সে বিপন্ন বোধ করার দরুন সুইসাইড করে বসল। কেন? আর কী ছিল স্যুটকেসে? কর্নেল চোখ বুজে দুলতে শুরু করলেন অভ্যাসমতো।