আবার জটিলতার মুখোমুখি
বৃষ্টিটা এদিনও ছাড়ল না। বরং একটু জোরালো। নিচের রাস্তায় জল না জমলেও লোজন বা গাড়ি চলাচল কম। ছাদে কিছু ক্যাকটাসের ওপর পলিথিন শিট চাপিয়ে রাখতে হয়েছে। বৃষ্টিতে ওই মরুক্যাকটাস পচে যায়। ড্রইং রুমের জানালায় ঝুঁকে কর্নেল উদ্বিগ্নভাবে প্রতীক্ষা করছিলেন প্রণবের। মাঝেমাঝে বিরক্তিকর শব্দে চলে যাচ্ছে একটা করে ট্রাম। অন্যদিন শব্দটা মোটেও বিরক্তিকর মনে হয় না। কানসওয়া হয়ে গেছে। আটটা বাজলে ফের উঁকি দিলেন জানালায়। একটা নীল রঙের ফিয়াট এসে উল্টোদিকের ফুটপাতে পানের দোকানের সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভারকে দেখা যাচ্ছিল না। বোঝা গেল, সে কিছু জানতে চাইছে দোকানদারের কাছে। তারপর গাড়িটা এগিয়ে গিয়ে ঘুরল। সানি লজের নিচের তলার পার্কিং স্পটে ঢুকল। প্রণব কি?
হ্যাঁ, প্রণব। কর্নেল নিজেই দরজা খুলে ড্রইং রুমে নিয়ে এলেন তাকে। প্রণব বলল, সরি কর্নেল সরকার! গাড়িটা গণ্ডগোল করছিল। গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে ফিটফাট করতে দেরি হয়ে গেল!
ষষ্ঠীকে বলা ছিল। সে কফি এবং স্ন্যাসের ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফি ঢেলে পেয়ালা তুলে ওর হাতে দিয়ে বললেন, আগে ঠাণ্ডাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার ডার্লিং।
বৃদ্ধের অমায়িকতায় যুবকটি একটু অভিভূত যেন। তার চেহারার স্মার্টনেস একটু ক্ষয়ে গেল। নম্রভাবে হেসে বলল, হ্যাঁ-ঠাণ্ডাটা বড্ড বেড়ে গেছে।
তুমি আমার পুত্রের বয়সী। অতএব তুমিই বলছি।
স্বচ্ছন্দে। কফিতে চুমুক দিয়ে প্রণব বলল। ..রঞ্জনের ব্যাপারটা কাগজে পড়ে আমি–
এক মিনিট! তপেশের কথা বলছ কি?
প্রণব একটু হাসল।…ওর আরও দুটো নাম ছিল। তপেশ বসাক এবং বাসুদেব রায়।
তুমি জানতে?
কেন জানব না? আমরা একসঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়েছি। হি ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ওর আসল নাম রঞ্জন মিত্র। আ সেলফ-মেড বয় বলা যায় সেভেনটিজের গোড়ায় রঞ্জন কলেজ ছেড়ে পলিটিক্স করতে যায়। আই মিন, হি ওয়াজ আ নকশাল। অ্যাকশান স্কোয়াডে ছিল। আমি ওকে নিষেধ করতুম। কিন্তু ও বড্ড জেদী আর খেয়ালী প্রকৃতির ছেলে। যা একবার মাথায় ঢুকবে, তাই নিয়ে মেতে ওঠা ওর স্বভাব ছিল।
কর্নেল আস্তে বললেন, পরে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিল রঞ্জন?
হ্যাঁ। ফাস্ট্রেশান। প্রণব বাদাম তুলে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, প্রায় সাত বছর পরে ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলো একদিন। রাস্তায় দেখা। তারপরও মাঝেমাঝে দেখা হত। বছর দুই আগে কফিহাউসে একদিন দেখা। একটা ফ্ল্যাট খুঁজছে বলল। তো ওর মধ্যে দারুণ একটা অ্যাট্রাকশান ছিল, জানেন? আমাদের বাড়িটা সবে রিমডেলিং করা হয়েছে।
কর্নেল কথার মধ্যে বললেন, তুমি কেয়াকে নিশ্চয় চেনো!
প্রণব হাসল। ভীষণ চিনি। রঞ্জন আর কেয়ার বিয়ের রেজিস্ট্রেশনে আমি একজন সাক্ষী। দ্বিতীয় সাক্ষী বিমল মুখার্জি নামকরা পেইন্টার। জানেন? বিমল সুইসাইড করেছে। কাগজে বেরিয়েছিল খবর।
কর্নেল উত্তেজনা চেপে বললেন, কেয়ার দাদা সুশোভনকে নিশ্চয় তুমি চিনতে?
খুবই চিনতুম। সেও নকশাল ছিল। কেয়ার কাছে শুনেছি, দলের লোকেরাই তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে খুন করেছিল।
তুমি কি জানতে, পরে রঞ্জন ব্ল্যাকমেলার হয়ে উঠেছিল? কিছু লোককে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করত।
প্রণব নড়ে বসল।…অসম্ভব! অবিশ্বাস্য!
একটু পরে কর্নেল বললেন, সুভদ্র সিং নামে কাউকে তুমি চেনো?
সুভদ্র…সুভদ্রনামটা চেনা মনে হচ্ছে। প্রণব স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল। নন-বেঙ্গলি?
হ্যাঁ।
বুঝেছি। প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। আমাদের ব্যাচে। তার সঙ্গে তত পরিচয় ছিল। তবে রঞ্জনের সঙ্গে ছিল মনে পড়ছে।
সুভদ্র কি পলিটিক্স করত?
প্রণব হাসল। তখন সময়টাই ওইরকম। বিশেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন রাজনীতির তীর্থ। আমার কথা অবশ্য আলাদা। আসলে ফিল্ম-টিল্মের দিকে প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল আমার। হিরো হবার স্বপ্ন দেখতুম। পরে অবশ্য কয়েকটা বাংলা ছবিতে ছোটখাট রোলে চান্স পেয়েছি। তবে বাংলা ছবির ব্যাপার তো! এখানে কিস্যু হবে না। এদিকে বোম্বে যাওয়ারও অসুবিধে। প্রণব একটু গম্ভীর হলো এবার। অসুবিধে মানে–খুলেই বলি, আমি রিস্ক নিতে সাহস পাইনে।
তুমি শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে কাউকে চেনো–চিনতে?
প্রণব ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, নাঃ। কে সে?
রঞ্জন তাকে চিনত।
রঞ্জন চিনতে পারে। ওর নানা মিস্টিরিয়াস ব্যাপার ছিল। বুঝতে পারতুম না। বুঝতে চেষ্টাও করিনি। কী দরকার?
কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, ডার্লিং! আপাতত আর কিছু জানার নেই তোমার কাছে।
প্রণব বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? প্লিজ কর্নেল সরকার, একটু খুলে বলুন।
কর্নেল বললেন, আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। সব জানতে পারবে।
ফোন বাজল। কর্নেল ফোন ধরে সাড়া দিলেন। অরিজিৎ লাহিড়ীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। …হাই ওল্ড ডাভ! বৃষ্টিবাদলায় কেমন কাটাচ্ছেন?
ফাইন, ডার্লিং! কিছু বলার আছে?
খুব বিজি মনে হচ্ছে। মক্কেল আছে নাকি সামনে?
হ্যাঁ।
নতুন কেস? নাকি তপেশ বসাক সংক্রান্ত?
তোমার খবর বলো, ডার্লিং!
শ্যামল মজুমদারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিমলবাবুকে খুনের অভিযোগে! বলো কি! সেদিন বললে, খুব প্রেসার আসছে—
এসেছিল! মিরাকিউলাসলি হঠাৎ উল্টো প্রেসার এল। আই মিন, চাকাটা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করল। বিমলবাবুর পাশের ফ্ল্যাটের মিঃ অ্যান্ড মিসেস। প্রধান এবং আরও ফ্ল্যাটের কিছু লোককে জেরা করে জানা গেছে, খুনের দিন বিকেলে শ্যামল মজুমদারের সঙ্গে বিমলবাবু চড়া গলায় ঝগড়া করছিলেন।
শ্যামলবাবুর আত্মীয় তো মিনিস্টার বলেছিলে! তিনি নীরব?
অরিজিৎ হাসলেন।…আমার ধারণা খবরটা বোগাস। শ্যামলবাবুর নিজের রটনা। নৈলে সেই মিনিস্টার–যিনিই হোন, ওঁকে বাঁচাতে পাল্টা চাপ দিতেন। জামিন নিতেও কেউ চেষ্টা করছে না পর্যন্ত। এদিকে আরও একজনের নাম এই কেসে জড়িত। তাকে সনাক্ত করেছেন প্রধান দম্পতি। শ্যামলকান্তি এবং বিমলবাবুর এক বন্ধু সৌম্য চৌধুরী। তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। খোঁজা হচ্ছে।
আবার সব জট পাকিয়ে গেল, ডার্লিং! গেরো প্রায় খুলে এনেছিলুম!
সে কী!
পরে বলব। আপাতত শুধু বলছি, আবার অন্ধকারে পড়ে গেলুম। আচ্ছা, রাখছি।…
প্রণব একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। বলল, তাহলে আসি, কর্নেল সরকার।
ঠিক আছে। দরকার হলে পরে যোগাযোগ করব।
কর্নেল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। প্রণব বেরুলে হঠাৎ বললেন, এক মিনিট। তুমি সৌম্য চৌধুরি নামে কাউকে চেনো?
প্রণব হাসল…আমি একটু কম চিনি। তবে কেয়া বেশি চেনে।
কর্নেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টে তাকালেন।
প্রণব বলল, কেয়াকে আপনি তো চেনেন বুঝলুম। কথাটা তার কাছেই জেনে নেবেন।
একটু আভাস দাও, প্রণব!
সৌম্য কেয়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। বাট হি বিট্রেইড হার। তখন রঞ্জন কেয়াকে বিয়ে করে।
প্রণব সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল! কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা বন্ধ করলেন। ড্রইং রুমে ফিরে আরামকেদারায় বসে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে শুরু করলেন। আরও জটিল হয়ে গেল সব। শ্যামলকান্তিকে গ্রেপ্তারের বাধা হঠাৎ সরে গেল কেন? নেপথ্যে অন্ধকারে বসে কে খেলা করছে। এভাবে? সৌম্য চৌধুরী ফেরার হয়ে গেছেন। ঝানু লোক, বোঝা যায়। কিন্তু সুভদ্র সম্পর্কে অরিজিৎ নীরব। তার মানে, সে অভিযুক্ত নয়। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।