আবার একটি আত্মহত্যা
ভোরে গার্ডেনিং-এর জোব্বা এবং হাতে সিন্থেটিক চামড়ায় দস্তানা পরে খুরপি হাতে ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ডে যান কর্নেল। সূর্য ওঠার পর ষষ্ঠী কফি দিয়ে এল। মোড়ায় বসে কফি খেতে-খেতে বললেন, খবরের কাগজগুলো এখানে দিয়ে যাবি।
ষষ্ঠী দাঁত বের করে বলল, একটা কথা বলি বাবামশাই?
বল!
কিছু গণ্ডগোল বেইধেছে, তাই না? নতুন ক্যাস ধইরেছেন, বাবামশাই!
কর্নেল হাসলেন।…তুই তাহলে সত্যি গোয়েন্দা হয়ে উঠছিস, ষষ্ঠী।
ষষ্ঠী সাহস পেয়ে বলল, আইজ্ঞে বাবামশাই, বাইরে থেকে এসে এইরকম মুখভার, ছাদে বসে কাগজ পড়া–এদিকে এই সক্কালবেলা এক মেয়েছেলে এসে বাবামশাইয়ের জন্যে বসে আছে–
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, মেয়েছেলে এসে বসে আছে?
আইজ্ঞে!
হতভাগা, বলছিস না সে-কথা?
বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখেছি। ষষ্ঠী বিব্রতভাবে বলল। বললুম, বাবামশাইয়ের লামতে দেরি আছে। বললে, ততক্ষণ রোয়েট করব। তা কী করব? মেয়েছেলে– মুখখানা দেইখ্যে মায়া হল।
কর্নেল কফির পেয়ালা হাতে হন্তদন্ত নেমে গেলেন। ড্রইং রুমের ওধারে ছোট্ট ওয়েটিং রুম। ড্রইং রুমটি বিশাল এবং যাদুঘর-কাম-লাইব্রেরি বলা চলে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। খুলে একটু অবাক হলেন। তপেশ বসাকের বিধবা স্ত্রী বসে আছে! বললেন, আসুন! ভেতরে আসুন!
সে ড্রইং রুমে ঢুকে বলল, কাল আপনি গেলেন, কার্ড দিলেন–তখন। কথাটা মনে পড়েনি।
উত্তেজনা চেপে কর্নেল বললেন, আপনার নাম কী মা?
রমা। আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন।
বেশ, বলো রমা!
রমা বলল, আমি কর্পোরেশন স্কুলের টিচার। খবরের কাগজ কেনার পয়সা জোটে না। কাগজ পড়তেও ভাল লাগে না। তো আমাদের স্কুলে কাগজ আসে। আপনি যাওয়ার পর মনে পড়ল, কাগজে মিতুর বাবার নামে একটা ছবি বেরিয়েছে দেখেছিলুম।
ছবিটা চিনতে পেরেছিলে?
রমা আস্তে বলল, আপনাকে বাসুদেবের কথা বলেছিলুম!
ছবিটা বাসুদেবের?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টে রমাকে লক্ষ্য করছিলেন কর্নেল। বুঝলেন, কাল যখন ওদের বাসায় যান, তখনই যেন রমা জানত-সম্ভবত মনে না পড়াটা একটা অজুহাত। কাল সারাদিন এবং রাত্রি পর্যন্ত ভেবেছে। হয়তো শ্বশুরের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছে। তারপর জানাতে এসেছে। কিছু মানুষ থাকে, ঝটপট সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। রমা সেই দলের। বললেন, চা খাবে? কিংবা কফি?
রমা সলজ্জ মুখে বলল, আজ্ঞে না। আমি উঠি। বাসায় ফিরে স্কুলে যেতে হবে।
তুমি কি আর কিছু বলতে চাও, রমা?
একটা কথা—
স্বচ্ছন্দে বলো।
আমাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না তো?
কেন ও কথা মনে হলো তোমার?
একটু চুপ করে থাকার পর রমা কুণ্ঠিত ভাবে বলল, বাসুদেব কিছুদিন লুকিয়ে বেড়াত। মিতুর বাবা বলতেন। ওকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
কেন জানো? তপেশবাবু কিছু বলেননি?
রমা মাথাটা দোলাল। ফের আস্তে বলল, সে প্রায় আট-ন বছর আগের কথা। তখন খুব খুনোখুনি বোমাবাজি হত আমাদের পাড়ায়। দিনদুপুরে রাস্তার মোড়ে একজনকে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে–
কলিং বেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী একগাদা খবরের কাগজ নিয়ে এল। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটা কাগজে চোখ রাখলেন। রমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসি স্যার! কাইন্ডলি দেখবেন যেন কোনো ঝামেলায় না পড়ি। আমরা খুব গরিব মানুষ!
কর্নেল একটু হাসলেন মুখ তুলে।…বাসুদেব কোথায় থাকত জানো না?
আজ্ঞে না। জানলে নিশ্চয় বলতুম।
আচ্ছা, এস।
রমা চলে গেল। কর্নেল খবরের কাগজটার প্রথম পাতার শেষ কলামের নীচে একটা খবর পড়ে চমকে উঠলেন। বক্স করে বোল্ড লেটারে ছবিশুদ্ধ ছেপেছে।
শিল্পীর আত্মহত্যা
স্টাফ রিপোর্টার : প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়কে গতরাত্রে তার স্টুডিওতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশের মতে, বিমলকুমার আত্মহত্যা করেছেন। একটা চিরকুটে তিনি লিখে গেছেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। একটি, ৩২ ক্যালিবারের রিভলবার পাওয়া গেছে। কয়টি কার্তুজের একটি ফায়ার করা, বাকিগুলি আস্ত আছে। মুখের ভেতর নল পুরে ট্রিগার টেনেছেন বলে পুলিশের ধারণা। রিভলবারটির নল মুখের ভিতর আটকে ছিল এবং ট্রিগারে আঙুল ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগামী এপ্রিল মাসে প্যারিসে তার ছবির প্রদর্শনী হওয়ার কথা।…
এরপর বিমলকুমারের জীবনী সংযোজিত হয়েছে। কর্নেল দীর্ঘ দুমিনিট চুপচাপ বসে রইলেন। একটা ছবি হারিয়ে তাহলে চিত্রকর শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করে বসলেন!
হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ, ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত।
দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই। আমি উত্থিত।
কিছু খবর পেয়েছ কি?
কিসের? আপনার তপেশ বসাকের কোনো নতুন খবর হয়নি। আপনি এবার দেখছি সত্যিই না–
অরিজিৎ! এইমাত্র কাগজে চিত্রশিল্পী বিমলকুমারের আত্মহত্যার খবর পড়ে তোমাকে রিং করছি।
কী অবাক!
সত্যিই অবাক হবার কেস। তুমি কি দফতরের সূত্রে রাত্রে এ সম্পর্কে কোনো খবর পাওনি?
পেয়েছিলুম। হি ইজ দা ফেমাস পেইন্টার। কিন্তু এ নিয়ে আপনার উত্তেজনার কারণ কী?
প্লিজ, চলে এস। এক মিনিট! একটা কথা।
বলুন!
সঙ্গে এই সুইসাইড কেসের তথ্য যতটা পারো, নিয়ে এস!
টালিগঞ্জ থানা হয়ে আসছি। অপেক্ষা করুন। কেসটা ওরা ডিল করছে।
কর্নেল ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালেন। গার্ডেনিং জোব্বা এবং দস্তানা খুলতে গেলেন। আবার মনে হলো, একটা ছবি হারিয়ে মাথার ঠিক রাখলেন না বিমলকুমার?
কিন্তু–
একটু চমকে উঠলেন। ঠিক একইভাবে তপেশ বসাক নামধারী বাসুদেব রায় আত্মহত্যা করেছে। মুখের ভেতর আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঢুকিয়ে ট্রিগারে চাপ। চাপা শব্দ। তবে বাসুদেব কষ্ট পেয়েছিল। পিস্তলের গুলি মগজ ভেদ করে গিয়েছিল। সোজা তার গতি। রিভলবারের গুলি ক্রুর মতো পেঁচিয়ে মগজটাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। মৃত্যুযন্ত্রণা হয়তো টেরই পাননি বিমলকুমার।