Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গুরুচন্ডালি || Shibram Chakraborty

গুরুচন্ডালি || Shibram Chakraborty

গুরুচন্ডালি

সীতানাথবাবু ছিলেন সেকেণ্ড পন্ডিত, বাংলা পড়াতেন। ভাষার দিকে তাঁর দৃষ্টি একটুও ভাসা ভাসা ছিল না—ছিল বেশ প্রখর। ছেলেদের লেখার মধ্যে গুরুচন্ডালি তিনি মোটেই সইতে পারতেন না।

সপ্তাহের একদিন ছিল ছেলেদের রচনার জন্যে ধরা। ছেলেরা বাড়ি থেকে রচনা লিখে আনত—একেক সময়ে ক্লাসে বসেও লিখত। সীতানাথবাবু সেইসব রচনা পড়তেন, পড়ে পড়ে আগুন হতেন। ছাত্রদের সেই রচনা পরীক্ষা করা, সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতোই একটা উত্তপ্ত ব্যাপার ছিল সীতানাথবাবুর কাছে।

এত করে বকেও, গুরুচন্ডালি দোষ যে কাকে বলে, ছাত্রদের তিনি তা বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। উক্ত দোষমুক্ত করা তো দূরে থাক।

সেদিনও তিনি ক্লাসসুদ্ধু ছেলের রচনার খাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন—

দেখতে দেখতে তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠল, হাতের দু-রঙা পেনসিলের লাল দিকটা ঘষঘষ করে চলতে লাগল খাতার উপর—রচনার লাইনগুলো ফসফস করে লাল দাগে কেটে কেটে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। এর চেয়ে ছেলেদের চাবকে লাল করা যেন সোজা ছিল ঢের—ছিল ঢের আরামের—আর তা করতে পারলে যেন গায়ের ঝাল মিটত তাঁর।

খাতাগুলো পাশে সরিয়ে রেখে তিনি বললেন—‘এ আর কী দেখব! খালি গুরুচন্ডালি। কত বার করে বলেছি হয় সাধু ভাষায় লেখো, নয় কথ্য ভাষায়। যেটাতেই লেখো তা ঠিক হবে। কিন্তু আগাগোড়া এক রকমের হওয়া চাই। সাধু ভাষায় আর কথ্য ভাষায় মিশিয়ে খিচুড়ি পাকানো চলবে না। না, কিছুতেই না। কিন্তু এখনও দেখছি সেই খিচুড়ি!’

গণেশ বলল—‘আমি সাধুভাষায় লিখেছি সার।’

‘সাধু ভাষায় লিখেছ? এই তোমার সাধু ভাষা?’ সীতানাথবাবু গাদার ভেতর থেকে তার খাতাটিকে উৎখাত করেন—‘কী হয়েছে এ? দুগ্ধফেননিভ শয্যায় ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িল? দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে—’

‘কেন সার, ‘‘করিয়া’’ তো লিখেছি আমি? করিয়া কি সাধু ভাষা হয়নি সার?’

‘কিন্তু ধপাস? ধপাস কী ভাষা? দুগ্ধফেননিভের পরেই এই ধপাস?’

গণেশ এবার ফেননিভের মতোই নিভে যায়, টুঁ শব্দটি করতে পারে না।

‘কত বার বলেচি তোমাদের যে ভাষায় খিচুড়ি পাকিয়ো না। হয় সাধু ভাষায় নয় কথ্য ভাষায়—যেটায় হয় একটাতে লেখো। কিন্তু দেখো, আগাগোড়া যেন এক রকমের হয়। গণেশের এই বাক্যটিকে তোমাদের মধ্যে নিখুঁত করে বলতে পার কেউ?’

‘পারি সার।’ মানস উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দাঁড়িয়েই মাথা চুলকাতে লাগল সে। ধপাস-এর সাধুভাষা কী হবে তার জানা নেই। খানিক মাথা চুলকে, খানিক আমতা আমতা করে সেনিজেও ধপাস করে বসে পড়ল। তার মানসে যে কী ছিল তা জানা গেল না।

সরিৎ উঠে বলল—‘কীসে বলব সার? কথ্য ভাষায় না অকথ্য ভাষায়?’

‘যাতে তোমার প্রাণ চায়’

‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়েস করে বসল।’

‘দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে আয়েস?’ সীতানাথবাবু মুখখানা—উচ্ছের পায়েস খেলে যেমন হয়—তেমনি ধারা হয়ে ওঠে—‘ওহে বাপু! গুরুচন্ডালি কাকে বলে তা কি তোমাদের মাথায় ঢুকেছে? মনে করো যে, যে চাঁড়ালটা আমাদের এই স্কুলে ঝাঁট দেয় সেযদি হেডমাস্টারমশায়ের সঙ্গে একাসনে বসে তাহলে সেটা যেমন দৃষ্টিকটু দেখাবে, কতকগুলি সাধুশব্দের মধ্যে একটা অসাধু শব্দ ঢুকলে ঠিক সেইরকম খারাপ দাঁড়ায়। কিন্তু দুজন চাঁড়াল স্বচ্ছন্দে গলা ধরাধরি করে যেতে পারে—কারও চোখেই খারাপ দেখায় না। কথ্য ভাষার যে শব্দ সাধু ভাষার শব্দের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসতে পারে না, সেই কথাই আবার অন্যান্য কথ্য শব্দের সঙ্গে মিশ খেয়ে বেশ মানিয়ে যেতে পারে, যেমন উদাহরণস্বরূপ—’

‘বলব সার? এতক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি।’ বলে ওঠে গণেশ—‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়াস সহকারে বসিল। কিংবা উপবেশন করিল। হয়েছে এবার সার?’

‘কিংবা আরও বেশি সাধুতা করে আমরা বলতে পারি—’ নিরঞ্জন উঠে বলে—‘আসন গ্রহণ করিল। কিংবা আসন পরিগ্রহ করিল।’

দীপক বলে—‘সমাসীন হইলও বলা যায়।’

‘আবার তুই এর মধ্যে সমাস ঢোকাচ্ছিস?’ গণেশ তার কানের গোড়ায় ফিসফিস করে—‘এতেই কেঁদে কুল পাইনে, এর উপরে ফের সমাস?’

‘যেমন উদাহরণস্বরূপ—’ সীতানাথবাবু বলতে থাকেন, কিন্তু তাঁর বলার মাঝখানেই পিরিয়ডের ঘণ্টা বেজে যায়। উদাহরণের স্বরূপ প্রকাশের আগেই তাঁকে ক্লাস ছেড়ে যেতে হয়। নিজের বক্তব্য আরেক দিনের জন্যে মুলতুবি রেখে সমস্ত প্রশ্নটাই আমূল রেখে যান।

দিন কয়েক পরে গণেশ রেশন আনতে গিয়ে দেখল যে সেকেণ্ড পন্ডিতমশাইও সরকারি দোকানে এসেচেন। লম্বা লাইনের ফাঁকে সীতানাথবাবুও দাঁড়িয়ে। সেই কিউয়ের ভেতর মহল্লার ঝাড়ুদার—নিশ্চয়ই সেচন্ডাল—যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পাড়ার গুণ্ডারা। তারাও কিছু সাধু নয়। বরং তাদের প্রচন্ডালই বলা যায়। প্রচন্ড তাদের দাপট। পাড়ার সার এবং অসার—সবাই এক সারের মধ্যে সমানে খাড়া। রীতিমতো গুরুচন্ডালি।

সীতানাথবাবু ছিলেন সারির মাঝামাঝি। গণেশ অনেক পরে এসে শেষের দিকে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সীতানাথবাবুকে। চন্ডালদের মধ্যে গুরুদেব, ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ এই অভাবিত মিলনদৃশ্য দেখে সেঅবাক হল। সে-দৃশ্য অবাক হয়ে দেখবার মতোই।

সীতানাথবাবুর দৃষ্টি কোনো দিকে ছিল না। অজগরের মতো বিরাট লাইন যেন কচ্ছপের গতিতে এক-পা এক-পা করে এগুচ্ছিল।

কতক্ষণে রেশন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন, হাঁড়ি চড়িয়ে চান সেরে নাকে-মুখে দুটি গুঁজে পাড়ি দিবেন স্কুলে, সেই ভাবনাতেই সমস্ত মন পড়েছিল তাঁর।

সহসা এক বালসুলভ তীক্ষ্ণকন্ঠ তাঁর কানে এসে পিন ফোটাল। ফুটতেই তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন।

‘সার সার! ব্যগ্র হন কল্য। ব্যগ্র হন কল্য।’ শুনতে পেলেন তিনি।

শুনেই তিনি পিছন ফিরে তাকালেন। দেখতে পেলেন গণেশকে। কিউয়ের শেষে দাঁড়িয়ে চিৎকার ছাড়ছে।

ব্যগ্র হন কল্য? তার মানে? কেন তিনি ব্যগ্র হবেন? আর হন যদি-বা, তো তা কালকে কেন? ব্যগ্র যদি হতেই হয় তো আজকেই কেন নয়? এই মুহূর্তেই-বা নয় কেন? আর এই মুহূর্তে ব্যগ্র হয়েই-বা কী হবে? কিউ-এর লাইন তো আর ছেলেদের খাতার লাইন না যে পেনসিলের এক খোঁচায় ফ্যাশ করে কেটে এগিয়ে যাবেন। যতই তাড়া থাক, যতই ব্যগ্র হন, আগের লোকদের কাটিয়ে এগুবার একটুও উপায় নেই এখানে। ফাঁড়ার মতোই অকাট্য এই লাইন।

‘সার সার—পুনরায় পুনরায়। ব্যগ্র হন কল্য। ব্যগ্র হন কল্য।’ আবার সেই আর্তনাদ।

সীতানাথ বাবুর ইচ্ছে করে, এক্ষুনি গিয়ে—বেশ একটু ব্যগ্রভাবেই—গণেশের কান দুটো ধরে মলে দেন আচ্ছা করে। কিংবা তুলে ধরে এক আছাড় মারেন ওকে। কিন্তু ওকে আছড়াবার এই ব্যগ্রতা দেখাতে গিয়ে লাইনের জায়গা পা-ছাড়া করার কোনো মানে হয় না।

আস্তে আস্তে এগিয়ে দোকানের ভেতর পৌঁছে রেশনের দাম দিতে গিয়ে তাঁর চোখ কপালের কানায় ঠেকল—যেমন একটু আগে তাঁর কান চোখা হয়ে উঠেছিল। দ্যাখেন যে তাঁর পকেট মারা গেছে। পকেটের যেখানে টাকার ব্যাগটা থাকে সেখানটা ফাঁকা।

বৃথা হইচই না করে বিরস মুখে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন।

‘সার, তখন আমি কী বলছিলাম? আমি অত করে বললাম, তা আপনি কান দিলেন না। আদৌ কর্ণপাত করলেন না।’ গণেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। দোকানের মুখে পৌঁছে মাস্টারের সম্মুখে পড়েছে।

‘কী বলছিলে তুমি? তুমি তো আমায় কাল ব্যগ্র হতে বলছিলে? আর এদিকে আমার আজ সর্বনাশ হয়ে গেল।’

‘কাল ব্যগ্র হতে বলেছি? মোটেই না। আমি বলছিলাম আপনার ব্যাগ গ্রহণ করল। আপনার পরেই যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, সেই হতভাগাই পেছন থেকে আপনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে—’

‘তা পকেট মারল বলতে তোর কী হয়েছিল রে হতমুখ্যু?’ সীতানাথবাবুর সমস্ত রাগ এখন গণেশের ওপর গিয়ে পড়ে—‘সোজাসুজি তা বললে কী হত? তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত? পকেট মারছে সার—বলতে কি আটকাচ্ছিল তোমার পাপ মুখে?’

‘ছি ছি!’ গণেশ নিজের জিভ কাটে—‘অমন কথা বলবেন না সার। পকেট মারছে সেকথা কি আপনার সামনে আমি উচ্চারণ করতে পারি? পকেট প্রহার করছে বললেও তো শুদ্ধ হয় না। আর বলুন, গুরুমশায়ের কাছে এমন চন্ডালের মতন ভাষা কি বলা যায়? ও-কথা—অমন কথা বলবেন না সার। ব্যাগ গ্রহণ করল বলেছি—জানি যে, তাও সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়নি, গুরুচন্ডালি একটুখানি যেন রয়ে গেছে, কিন্তু কী করব, ব্যাগের সাধুভাষা যে কী—তা তো আমার জানা নেই সার। কত করে ভাবলুম, কিন্তু কিছুতেই ব্যাগের শুদ্ধটা আমার মাথায় এল না। এদিকে ভাবতে ভাবতে ব্যাগসুদ্ধ নিয়ে সটকাল।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *