Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গান্ধর্বী || Bani Basu » Page 28

গান্ধর্বী || Bani Basu

বিদ্বজ্জনেরা বলে থাকেন একমাত্র দুর্বল উপন্যাসেরই উপসংহার বা এপিলোগ থাকে। এপিলোগ প্রমাণ করে লেখক তাঁর বক্তব্য উপন্যাসের পরিসরে বলে উঠতে পারলেন না। কিন্তু টলস্টয়ের মতো বিশ্ববরেণ্য ঔপন্যাসিককেও তাঁর এপিক-উপন্যাস ‘ওয়র অ্যান্ড পীস’-এর শেষে উপসংহার যোজনা করতে হয়েছিল। বিশ্বের অনেক জ্ঞানীগুণী সমঝদার ব্যক্তি এর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। আবার অনেক সমানভাবে জ্ঞানীগুণী সমঝদার ব্যক্তি এর নান্দনিক কৈফিয়ত দিয়েছেন। আসল কথা প্রাত্যহিক জীবনের শুধু দিনযাপনের ধারা যে খণ্ড সময়ের কখনও মহিমময়, কখনও প্রলয়ংকর, কখনও রোম্যান্টিক পদক্ষেপকে মুছে ফেলে অসামান্য সামান্যতায় বয়ে চলে এই উপলব্ধি টলস্টয়ের মতো মহান শিল্পীও তাঁর সমুদ্রপ্রতিম উপন্যাসের বিশাল ব্যাপ্তিতে প্রকাশ করতে পারেননি। কিংবা তাকে সচেতনভাবে মূল উপন্যাস থেকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন। আমি ঠিক উপন্যস লেখার জন্য কলম ধরিনি। তবু হয়তো দ্বিতীয় কারণেই উপসংহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। আমার মা-এর জীবন এই ক’বছর ধরে আমাকে শুধু ভাবিয়েছে আর ভাবিয়েছে। অসম্ভব সে চাপ আমি সহ্য করতে পারিনি। তাই এই জীবনকাহিনী।

ন জানমি দানং, ন চ ধ্যানযোগম্
ন জানামি তন্ত্রং, ন চ স্তোত্রমন্ত্রম,
ন জানামি পূজাং ন চ ন্যাসযোগম্
গতিত্বং গতিত্ত্বং ত্বমেকা ‘জননী।’

আমি গানের লোক নই। তার ন্যাস জানি না। তন্ত্র-তন্ত্রীর কিছুই জানি না। পূজাও জানি না। মন্ত্রও জানি না। আমার জননীর আমার ওপর যে বিপুল অভিঘাত তাকেই প্রায় সম্বল করে এগিয়েছি। সাহায্য নিয়েছি বহু ডায়েরি, চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার, স্বীকারোক্তি, টেপ, নিজের প্রত্যক্ষ দর্শন এবং সর্বোপরি কল্পনার।

উপরিউক্ত ঘটনার কয়েক মাস পর যখন তাঁকে মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স-এ নিয়ে যাবার আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ, সেই সময়ে আমার মা একরকম বিনা আড়ম্বরে মারা যান। রাত্রে শুতে গেলেন, সকালে আর উঠলেন না। তাঁর মুখে কোনরকম যন্ত্রণার ছাপ ছিল না। সাধারণত শবদেহের মুখে যে শিথিল প্রশান্তি থাকে তা নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু। আমার তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি যেন এতদিনে তাঁর নিজের ঘরে, নিজের মায়ের কোলে জন্মালেন। এক বিরাট শিশুর মতো। সেই আনন্দের বিভা তাঁর মুখে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই মৃত্যুর দৃশ্যে এতো গরিমা ছিল যে আমরা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। রামেশ্বর ঠাকুর যাঁকে আমরা গানদাদু বলে ডাকতাম তিনি এসে মায়ের মাথা স্পর্শ করে গীতাপাঠের ভঙ্গিতে বললেন— ‘কণ্ঠ থেকে বৈখরী, হৃদয়ে মধ্যমা, স্বাধিষ্ঠানে পশ্যন্তী, তার পরও গভীরে চলে গেলে নাদ আর মনুষ্যকর্ণে ব্যক্ত থাকে না। তা পরা-বাক, পরা নাদ হয়ে যায়। সুরলোকের পথে চলতে চলতে কোনও অন্যমনস্ক দেবগন্ধর্ব যদি এই মর্ত্যভূমিতে এসে পড়ে তার কষ্টের শেষ থাকে না। সে যা দেবার দিয়ে যায়, দিতে চায়, কিন্তু আমরা মানুষ এমন কি মনুষ্যগন্ধর্বরাও তার কতটুকুই বা বুঝতে পারি! সে ঐশী বস্তু ধরে রাখি এমন সাধ্যই বা আমাদের কই?’

মা তাঁর কণ্ঠ হারাবার পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অজস্র ছবি এঁকেছিলেন। আমরা মার জন্য বাজার ঢুঁড়ে শ্রেষ্ঠ কাগজ, পেনসিল, রং ও নানা নম্বরের তুলি কিনে আনতাম। মার সব ছবিই ছিল গানের ছবি। তাতে রঙ, শুধু রঙের প্রাধান্য। কখনও ঢেউয়ের মতো। কখনও বর্তুলাকার, কখনও খাড়া খাড়া আরও কত আকারের কত বিভিন্ন বর্ণছায়ের রঙ। কখনও পটময় রঙ ছিটিয়ে ছিটিয়ে অদ্ভুতভাবে সেগুলো যুক্ত করতেন। তিনি নিজেই ছবিগুলোর নামকরণ করতেন। ‘আলাপ মালবকৌশিক।’ ‘মধুমাধবী সারং।’ ‘সরোদে হংসধ্বনির জোড়’, ‘পগ্ ঘুঙরু বাঁধ মীরা নাচি রে’, সোহমের হলক, ‘ম্যায় গিরিধারীকে ঘর জাঁউ।’ অজস্র অজস্র। সেই অদ্ভুত ভাঙা-ভাঙা ফিসফিসে গলায় আমাদের বোঝাতেন ‘এটা মীরার নাচ বুঝতে পারছিস না? মীরার নাচ! নীল রঙগুলো কি রকম তোড়ে ঘুরছে দ্যাখ? তলার দিকটা টকটকে লাল। নাচতে নাচতে মীরার চরণ রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে।’

মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছবির একটা প্রদর্শনী করি আমরা। সোহমমামার উদ্যোগে। কোনও কোনও ছবি দেখে এখানকার গুণীরা মুগ্ধ হন। যে চিত্রশিল্পী নয় তার হাতে রঙের এমন বলিষ্ঠ ব্যবহারও এরকম হার্মনি, মেলডি, ড্রয়িং-এর এমন সাবলীলতা তাঁরা আশা করেননি। আমি জানি না। খালি ছবিগুলো দেখতে দেখতে আমি একেবারে মগ্ন হয়ে যেতাম এবং প্রায় প্রত্যেক ছবির রেখায়িত বর্ণোদগারের মধ্যে আমি একটি নারীমূর্তি আবিষ্কার করতাম। কখনও সে পটের নানা জায়গায় নানা বিভঙ্গে ছড়িয়ে আছে, কখনও তা নদীস্রোতের মতো বহতা। কখনও বা একটা বিভোর তম্বুরা যার থেকে শিল্পীকে আলাদা করা যায় না। সোহমমামার ধারণা এইগুলো মায়ের নিজের প্রবেশ তাঁর শিল্পের মধ্যে। গানের সঙ্গে তাঁর অভিন্নতার অভিজ্ঞান। মীরা, কবীর, তুলসীদাস যেমন ‘তুলসীদাস অতি আনন্দ’, ‘কহত বীর শুনো ভাই সাধো।’ ইত্যাদি বলে ভজনটিকে নিজের নামাঙ্কিত করে দিতেন, চিত্রকলার ভাষায় অনুস্যূত এই নারীবিগ্রহও অনেকটা তাই।

মিতুলমাসি ছবিগুলি দেখে সঙ্গে সঙ্গে প্যারিসে একটি প্রদর্শনীর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। মিতুলমাসি ও শেখরণের চেষ্টায় অবশেষে যখন প্যারিসে প্রদর্শনী হল তখন সেখানকার গুণী শিল্পীরা এবং শিল্প মোদীরা অভিভূত হয়ে যান। এবং প্রায় অকল্পনীয় মূল্যে ছবিগুলো বিক্রি হয়ে যায়। কেউ বললেন, ফোবিজম্, কেউ বললেন সুররিয়্যালিজম, বেশির ভাগই বললেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের এমন প্রকাশ তাঁরা আর দেখেননি। ছবিতে নাকি সংগীত তার সমস্ত অঙ্গ নিয়ে অর্থাৎ সুর, তাল এমনকি নৃত্য পর্যন্ত নিয়ে মূর্ত। শুধু একটি ছবি যা মা প্রথম এঁকেছিলেন এবং বারবার আঁকতেন যেন এঁকে এঁকে তৃপ্তি হত না সেই ‘দরবারী কানাড়া’র ছবিগুলো আমরা বিক্রি করিনি। আরও কিছু রয়ে গেছে সোহমমামা ও মিতুল মাসির কাছে।

আমি আমার মাকে জীবনে কিচ্ছু দিতে পারিনি। একজন মেয়ের যেমন মাকে ভীষণভাবে প্রয়োজন হয়, একজন মায়েরও তেমনি মেয়েকে সাংঘাতিকভাবে প্রয়োজন। আমি তাঁকে দিয়েছিলাম শুধু প্রতিরোধ, উদাসীনতা এবং মাঝে মাঝে একটু মনোযোগের ভিক্ষা। তিনি আমার কাছ থেকে কিছু চাননি। শুধু চেয়েছিলেন তাঁর কণ্ঠের যে উত্তরাধিকার আমি জন্মসূত্রে পেয়েছি তারই যেন চর্চা করি। আমি তাঁকে সেটুকুও দিইনি। দিইনি কারণ আমাদের পূর্ব প্রজন্ম অর্থাৎ দাদু-ঠাকুমা এঁরা মায়ের সঙ্গীতজীবনকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য এবং সন্দেহের চোখে দেখতেন। আমার ধারণা ছিল গানের চর্চা করলে আমিও অমনি অবজ্ঞাত হব। আমাকেও অমনি লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু মাকে না শোনালেও গান না গেয়ে আমি থাকতে পারতাম না। বাথরুমে গাইতাম চাপা গলায়, বাগানে গাইতাম, বন্ধুদের বাড়িতে, স্কুল কলেজের কমনরুমে গাইতাম খোলা গলায়। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আমি অভিনিবেশ দিয়ে গান শিখছি সোহমমামার কাছে। জানি মার ঈশ্বরদত্ত গলা ছিল, তার ওপর পাঁচছ’বছর বয়স থেকে সাধনা করে গেছেন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। আমার এখনই কুড়ি পেরিয়ে গেছে। আর কি পারবো? কিন্তু সোহমমামা উৎসাহ দেন, বলেন ‘মার মতো না-ই পারলি, হয়ত মিতুলমাসির মতো পারবি। তোর তো মনে হয় যেন সাধা গলা। আর যদি বড় গাইয়ে হতে না-ও পারিস, শুনিয়ে হতেও তো পারবি! উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বুঝে শোনার আনন্দ এত বেশি যে সেটাই একটা জীবনের লক্ষ্য হতে পারে।’

বিজ্ঞান যাই বলুক, আমার ধারণা মানুষ ঊর্ধ্বলোকের নানান স্তর থেকে জন্মায়। আমার মা এসেছিলেন গানদাদু কথিত গন্ধর্বলোক থেকে। একেবারে আপাদমস্তক শিল্পী। দেবগন্ধর্বদের জীবনে শিল্পের প্রতি এই ভালোবাসায় কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু মায়ের জীবনে তাঁর গান্ধর্বী প্রকৃতি ও মানবী হৃদয়বৃত্তির বড় মর্মন্তুদ দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে যার চূড়ান্ত পরিণতি তাঁর কণ্ঠ রোধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু তাঁর মধ্যেকার শিল্পী নিজেকে কিছুতেই মূক রাখতে পারেনি। তিনি মুখর হয়ে উঠেছিলেন ছবিতে। যাঁরা বোঝেন তাঁরা বলেন তিনি পেরেছিলেন।

এই সমস্ত বিদেশী স্বীকৃতির পর মা বহু মরণোত্তর পুরস্কার পেলেন। সরকারি, বেসরকারি, গানের জন্য, ছবির জন্য। সে সব আমরা তিন ভাই বোন নিলাম। আমাদের পরিবার শুধু মায়ের ছবি বিক্রির টাকাতেই বিরাট ধনী হয়ে গেল। দাদা মাকে যেরকম বাড়ি তৈরি করে দিতে চেয়েছিলো। তার চেয়েও সুন্দর বাড়ি আমরা বানিয়েছি। শুধু সেখানে মা থাকেন না। স্কুলে ভর্তি করার সময়ে মা ভয়ে ভয়ে চুপি চুপি আমাদের নাম দিয়েছিলন সোহিনী আর সাহানা। কিন্তু সে নাম আমরা ব্যবহার করতাম না। সকলেই আমাদের টিটু বনি বলেই ডাকত। আজ স্কুল কলেজের রেজিস্টারে বন্দী সেই নামটাকে এই জীবনকাহিনীতে আমি পরম গৌরবের সঙ্গে মুক্তি দিলাম।

সোহিনী দত্তগুপ্ত

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
Pages ( 28 of 28 ): « পূর্ববর্তী1 ... 2627 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress