গান্ধর্বী (Gandharbi) : 27
শিবনাথের ঘুমটা মাঝরাতে ছাঁত করে ভেঙে গেল। রিস্ট ওয়াচটা পাশেই থাকে। তুলে দেখলেন রাত তিনটে বেজে পাঁচ ছয় মিনিট হয়েছে। তার পরেই তাঁর খেয়াল হল অপালা বিছানায় নেই। ধড়মড় করে উঠে বসলেন শিবনাথ। ছাতে এসে ডাকলেন ‘অপু! অপু! এপ্রিল মাসের আকাশ। ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে। আকাশে ফুটফুট করছে তারা। তাঁর ডাক হাওয়া ছাতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেল ‘অপু! অপু!’ একবার মনে হল ডানদিকের অন্ধকার অংশটার পাঁচিলের কাছে কে দাঁড়িয়ে আছে। অপুর কি ঘুম ভেঙে গেছে। ছাতে এসে হাওয়া খাচ্ছে। এরকম হতেই পারে। ওর আজকাল ঘুম ভালো হয় না। কাছে গিয়ে দেখলেন না প্যারাপেটটার ওপর কি রকম আলো অন্ধকারে একটা নারীমূর্তির মায়া সৃষ্টি হয়েছিল। শিবনাথ পাগলের মতো পাঁচিলের এদিকে ওদিকে ছুটে যেতে লাগলেন, অনেকটা ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন রাস্তায় কোথাও কোনও থেঁতলানো শবদেহ পড়ে আছে কি না। ভয়ে তাঁর বুকের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। না, নেই। তিনি আস্তে আস্তে দোতলায় নামেন। সব চুপচাপ। ঘরগুলো ভেতুর থেকে বন্ধ। শুধু রণোর ঘরের পর্দাটা উড়ছে। সে দরজা বন্ধ করে ঘুমোতে পারে না। শিবনাথ ছেলের ঘরে ঢুকলেন। অপুর কি হঠাৎ ছেলের জন্য মন কেমন করে উঠেছে? সে কি মাঝরাতে নীচে এসে শুলো! না। রণো একটা বালিশ মাথায়, একটা বালিশ পায়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমোচ্ছে। শিবনাথ নীচে নামতে নামতেই বুঝতে পারলেন গান-ঘরে আলো জ্বলছে। উঠোনের ওপর গিয়ে পড়েছে ঘরের আলো। ঘরের বাইরে থেকেই তিনি দেখতে পেলেন যে লম্বা নিচু চৌকিতে তানপুরো থাকে, অপালা তার সামনে বসে নিচু হয়ে কী করছে! তিনি তাকে পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছেন। তানপুরাটা তার বিঁড়েশুদ্ধু পাশে শোয়ানো। পেছন থেকে আস্তে আস্তে ঢুকলেন শিবনাথ। অপালা টের পেলো না। সে ঝুঁকে খুব মন দিয়ে কি করছে! শিবনাথ দেখলেন, সেই চৌকির ওপর সে বনির চার্টপেপারগুলো পর পর সাজিয়েছে, কাগজ চাপা দিয়ে সেগুলো শোয়ানো, চৌকিবন্দী। অপালার হাতে তুলি পাশে প্যালেটে রঙ। তিন চারখানা চার্টপেপার জুড়ে সে মন দিয়ে একটা বড় সাইজের অখণ্ড ছবি আঁকছে আপন মনে। শিবনাথ দেখলেন পট জুড়ে শুধু ডানদিক থেকে বাঁদিকে বয়ে গেছে নানা রঙের বর্ণিল ঢেউ। কখনও বিভিন্ন বর্ণের ঢেউগুলি মিশে আছে, কখনও আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কখনও ঢেউ কুঁচির আকার নিয়েছে, কখনও তালগোল পাকিয়ে যেন ঘুরছে। ঢেউগুলি যেন নিজেদের মোচড়াচ্ছে, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কম্পনে এসে আবার বিভক্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। শিবনাথ ডাকলেন ‘অপু! অপু! কী করছো? তাঁর গলা কাঁপছে। অপালা চমকে ফিরে তাকালো, তার মুখে এরকম অদ্ভুত হাসি শিবনাথ কখনও দেখেননি। সে ফিসফিস করে বলল— ‘বঝতে পারছে না, না? কিচ্ছ বঝতে পারছো না? দরবারীর আলাপ করছি। এই দেখো এইগুলো মিড়, এই যে উদারার কোমল নিখাদ থেকে মুদারার কোমল গান্ধার পর্যন্ত একটা মিড় টেনেছি, কোমল গান্ধারে দেখো দুলছি অনেকক্ষণ, ঋষভ ছুঁয়ে এবার সায়ে কিরে আসছি। এইবারে উঠছে এখানে দেখো মা পা কোমল ধা কোমল নি মুদারার সা! আলাপের থেকে আমি গানের বন্দিশ আলাদা করতে পারছি না কিছুতেই। দেখো তানগুলো কিভাবে এসে গেছে, এই ছোট ছোট ছুট। চার আবর্তন গান করে এই দেখো সোমে ফিরলাম। এইবার আবার আরম্ভ করব একটা…’ শিবনাথের চোখ ছলছল করছে। তিনি অপালার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন— ‘অপু তোমার গলা আবার ঠিক হয়ে যাবে, ফিরে আসবে, তুমি আবার গাইতে পারবে। কেন এমন করছো? আমি আর সোহম তোমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালে নিয়ে যাবো। আমরা আছি তো!’
অপালা তেমনি ভাঙা ভাঙা ফিসফিসে গলায় বলল— ‘গাইতে না পেরে আমার দম আটকে আসছে গো! তাই গাইতে বসেছিলাম। তুমি একটু দূর থেকে দ্যাখো, এই সমস্ত আলাপচারি জুড়ে কিন্তু আমি, অপালা, একটা মেয়ে গাইছি এটাও আছে। মানে আমি নয়, আমার ভেতরের যে মানুষটা গান গায়। আমার ভেতরটা। সেটা।’
শিবনাথকে দেখতেই হলো। সত্যিই অপালা দেখিয়ে দেবার পর মনে হল তিনি এই অজস্র রঙের ঢেউয়ের মধ্যে শায়িত, খুব লীলায়িত, অনেকটা তানপুরার মতো গুরু নিতম্বিনী তথী একটি তন্ময় নারীমূর্তি বা বলা যায় নারী ভাবনা, নারী-ভঙ্গি দেখতে পাচ্ছেন। চোখ কান হাত পা কিছুই নেই। শুধু একটি তরঙ্গিত ভঙ্গিমা।
অপালা বলল— ‘এখনও শেষ হয়নি, শেষ হলে বুঝতে পারবে। শিবনাথ সেইখানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। রাত্তির তাঁকে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল—‘আমি… আমি কিন্তু গান ছাড়া কিছুকেই তেমন করে ভালোবাসতে পারি না।’ রাত্রির দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালো সেই বহুকাল আগে বলা কথার নির্যাস। তার ছবিতে শেষ টান না দিয়ে অপালা উঠবে না। দীর্ঘ চার-পাঁচ ঘণ্টাও এক আসনে বসে থাকবার অভ্যাস তার আছে। যখন শেষ পর্যন্ত শেষ হল তখন নটা বেজে গেছে, ঘরের সামনে ভিড় জমে গেছে। টিটু বনি, রণো, তাদের দাদু, দিদা। পারুলবালা, হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠলেন—‘হে ভগবান, তুমি এমন কেন করলে? মা ভবতারিণী যা চাও দেবো মা, আমার বউমার গলা ফিরিয়ে দাও মা! এমনি করলে ও যে আমার পাগল হয়ে যাবে গো!’
টিটু ঠাম্মার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল ‘ঠাম্মা চুপ করো। চুপ করো প্লীজ। এটা মড়া কান্নার সময় নয়।’ সে, একমাত্র সে-ই অনুভব করছিল, সে আজ একটা দুর্লভ, অতি-দুর্লভ প্রায় দৈবী মুহূর্তের জন্ম দেখতে পাচ্ছে।