গান্ধর্বী (Gandharbi) : 24
দশটা বেজে গেলেও যখন রণো নীচেও নামল না, দরজাও খুলল না। তার ঠাকুমা অস্থির হয়ে বললেন—‘হ্যাঁরে রাগ বলে কি এতোই রাগ! তোদের ভয়কেও বলিহারি। একটা এক পটকা ছেলে তার ভয়ে বাড়িশুদ্ধু ভিরমি যাচ্ছে। যা না একবার গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে দ্যাখ না। টিটু! বনি!’ বাবা কাকা দুজনেই অফিস বেরিয়ে গেছে। লাল চোখে অপালা ঘরের কাজকর্ম সারছিল। আজকে সে নিজেই উঠেছে ন টায়। রাঁধুনি ফোটানো চা দিয়ে গেছে সে স্পর্শ করেনি, বেসিনে ঢেলে দিয়েছে চুপিচুপি। দ্বিতীয়বার চাইতে লজ্জা করেছে। সে বলল— ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’
ছাতে এখনও মোলায়েম রোদ্র। একটু উত্তুরে হাওয়া দিচ্ছে। একটা শাল গায়ে জড়িয়ে অপালা ছাতে উঠে গেল।
—‘রণো, এই রণো!’ দরজার কড়া নেই। সে প্রাণপণে ধাক্কা দিতে লাগল। কোনও সাড়াশব্দই নেই। ডান দিকে একটা জানলা আছে। ছাতের এক কোণে চলে গেলে ঘরের ভেতরটা খানিকটা দেখা যায়। অপালা চলে গেল সেই কোণে। আয়নায় খাটের মাঝখানটার প্রতিবিম্ব পড়েছে। পুরো জামা-কাপড়-পরা একটি যুবকের ঊর্ধ্বাঙ্গ। সে কিরকম এলিয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কোমরের দিকটা খাটের নীচের দিকে ঝুলছে। জেগে জেগে সাড়া না দিত একরকম। কিন্তু এতো ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্কিতেও ঘুম ভাঙছে না। অপালার বুকের ভেতরটা ভয়ে কেমন আনচান করতে লাগল। বনি টিটু পাড়ার কয়েকটি ছেলেকে ডেকে আনলো। তারা কোণ থেকে ঘরের অবস্থা দেখে গম্ভীর মুখে বলল—‘ভালো ঠেকছে না, দরজা ভাঙতে হবে।’
দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখা গেল কোনমতেই রণোর ঘুম ভাঙছে না। ঘাড়টা এলিয়ে এলিয়ে পড়ছে। মনোহর নাড়ি দেখলেন খুব ক্ষীণ। অপালা আর দাঁড়ায়নি। সে ছুটে গেছে নীচে।
সোহম আর একবার পাশ ফেরার চেষ্টা করছে, ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্ত মুখে সোহম বলল—‘সোহম চক্রবর্তী বলছি।’
—‘সোহম, আমি অপু বলছি। রণো ঘুম থেকে উঠছে না কিছুতেই, দরজা ভাঙতে হয়েছে। সোহম, শিগগিরই।’
তড়িৎ গতিতে জামা গলিয়ে নিল সোহম। ঠিক পাশেই তার ডাক্তারবন্ধু থাকেন। তাকে ঘুম থেকে তুলে যখন পৌঁছল, তখন ওদিক থেকে অ্যামবুলেন্সও পৌঁছচ্ছে। তার চোখ উল্টে দেখেই ডাক্তার বললেন, ইম্মিডিয়েটলি হসপিটাল। কিছু খেয়েছে। …না বিষ টিষ নয়। মনে হয় কোনও বাবুর্চ্যিুরেট। দেখা যাক।’
সারা দিন গেল। যখন রাতও যায় যায় কপালে করাঘাত করে পারুলবালা বললেন—‘যার মা জন্ম থেকে একবারও ফিরে দেখল না। তারের যন্তর আর পাখোয়াজ নিয়ে সারাটা জীবন নিজের খেয়ালে তা না না না করে কাটিয়ে গেল, রাত সাড়ে বারোটা একটায় মাথায় ফুল দিয়ে বাড়ি ফেরে তার ছেলের আর এর চেয়ে ভালো ভাগ্য কী করে হবে? হাউ হাউ করে কাঁদছেন তিনি।
—‘তখনই বলেছিলুম শিবু, আমাদের গেরস্ত ঘর, গেরস্ত বউই ভালো বাবা। তা কুহকে পড়লে কি আর কারো কোনও জ্ঞানগম্যি থাকে!’
হাসপাতালে শিবনাথ, সোহম, বিশ্বনাথ। অপালাকে আসতে দেওয়া হয়নি। কোনও মেয়েকেই না। কিন্তু ভোরের দিকে সবার অলক্ষ্যে অপালা বেরিয়ে পড়ল। সে আর টিকতে পারছে না। ভোরের ট্যাকসি কেন কে জানে ভদ্রমহিলাকে উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে চটপট পৌঁছে দিল। হাসপাতালের লাউঞ্জে বিশ্বনাথ ঢুলছিল, শিবনাথের চোখ লাল। সোহম পায়চারি করছে। অপালাকে শিবনাথই প্রথম দেখতে পেলেন।
—‘তুমি! তুমি কেন এলে?’
সোহম বলল—‘ঠিক আছে শিবনাথদা, ছেড়ে দিন, এসেছে যখন…।’
একটু পরেই সিসটার এসে ডাকলেন এমার্জেন্সি এগারো নম্বর।
তিনজনেই একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। —‘ভালো আছে, আউট অফ ডেঞ্জার। হী ইজ ভেরি টায়ার্ড। একজন কেউ যান।’
অপালা এগিয়ে যেতে নার্সটি বললেন—‘আপনি মা?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘যান। বেশি কথা বলবেন না।’
রণো এখন বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। তার মুখ নীলচে কালো। হাতে স্যালাইনের ছুঁচ। সামনে একটা টুল টেনে অপালা বসল। আস্তে ডাকল—‘রণো?’
অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে চাইল রণো— অপালা বলল—‘এই দ্যাখ, আমি তোর মা। মা এসেছি। আমি তোর বন্ধু রণো। কোনও ভয় নেই। দুঃখ নেই। আমরা সবাই আছি। সব্বাই। তোর বোনেরা, বাবা কাকা, আমি, সোহম মামা, দাদু-দিদা, সবাই তোর পাশে। তুই একদম ভেঙে পড়বি না।’
নার্স এসে বললেন—‘আর না!’
রণোকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলে সোহম বলল—‘ওর পক্ষে একটা চেঞ্জ অফ অ্যাটমসফিয়ার দরকার। একান্ত দরকার, শিবনাথদা। ও আমার কাছে থাকুক।’
শিবনাথ অবাক হয়ে বললেন—‘তোমার কাছে? ওখানে তো কোনও মেয়েই নেই? কে নার্সিং করবে?’
—‘ছেলেরাও ভালো নার্সিং করতে পারে, আপনার কোনও ভয় নেই।’
দাদু-দিদা প্রচণ্ড আপত্তি করছিলেন, সোহম স্থির গলায় বলল—‘ইট ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার ও এখান থেকে, আপনাদের কাছ থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। ওকে আমার কাছে যেতে দিন। আই নো হাউ টু টেক কেয়ার অফ হিম।’ রণোকে যখন জিজ্ঞেস করা হল তখন সে হ্যাঁ না, কিছুই বলল না। হঠাৎ যেন তার দুর্দান্ত জেদ, মেজাজ এবং ইচ্ছাশক্তি সব ফুরিয়ে গেছে।
সোহম তার খাটের পাশেই একটা খাট পাতিয়েছে। রণো তার ঘরেই থাকবে। পাশের বাড়ি থেকে ডাক্তার এসে প্রতিদিন দেখে যাবেন। অর্থাৎ গল্পচ্ছলে নাড়ি প্রেশার, মেজাজ সব দেখে যাবেন। বনমালী ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাবার আনছে, ফলের রস, চিকেন সুপ, দুধ, ছানা, পুডিং, স্টু। খুব মৃদুস্বরে কোনও বাজনা চড়ানো থাকে পাশের ঘরে, কখনও তা-ও না। রণো শুয়ে থাকে। শূন্য চোখে। সত্তর বাজলে সে একটা ভারী আরামের ঘুম ঘুমোয়।
বাড়ি থেকে বোনেরা, ঠাকুমা, বাবা সবাই এক এক করে তাকে দেখতে আসেন। মা এলে আর উঠতে চায় না। বনি আর টিটু এলেই সোহম তাদের সঙ্গে নানারকম খেলা খেলে। দাবা, চাইনীজ চেকার, এসব তো আছেই, আরও নানা রকম বিদেশী খেলা আছে তার কাছে। একটা পি. সি. আছে। সেটা নিয়ে টিটু যা ইচ্ছে করে। কোনও বারণ নেই। একদিন সোহম বলল—‘দেখি তোদের উচ্চারণ কিরকম দুরস্ত হয়েছে বল দিকিনি—‘শী সেলস সী শেলস অন দা সী শোর।’ খেলতে খেলতে বনি আগেই হারে, তারপর টিটু, তারপর সোহম।
—‘কেন সোহমমামু তুমি সবসময়ে জিতবে?’
—‘আরে বাবা আমি কত বছর ধরে সরগম সেধেছি, গানের বাণীর টুকরো নিয়ে বোলতান সেধেছি, আমার সঙ্গে তোরা পারবি কেন?’
হঠাৎ রণো দূর্বল গলায় বলল—‘তাহলে মায়ের সঙ্গেই তোমার লড়াই চলুক।’ অপালা চুপচাপ রণোর শিয়রের কাছে বসে থাকে। কখনও কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। যে কোনও ছুতোয় সে রণোর শরীরটা তার মুখ কপাল চুল একটু স্পর্শ করতে চায়। তার হাত ভীষণ নরম। যেন নতুন ওঠা গাছের পাতার মতো কিম্বা ফুলের পাপড়ির মতো তার স্পর্শ। রণোর ভালো লাগে খুব। কিন্তু সে বলে না।
সোহম বলল—‘অল রাইট, স্টার্ট অপু।’ অপালা বলল—‘থাক না।’
—‘বাঃ থাকবে কেন?’ দশ মিনিট হয়ে গেল তখনও সে বলে চলেছে নির্ভুল। রণো দুর্বল স্বরে আবার বলল—‘দ্যাটস গুড। শুধু গান প্র্যাকটিস করে এতোটা পরিষ্কার উচ্চারণ, এতো তাড়াতাড়ি তোমরা করতে পারছো?’
সোহম বলল—‘হ্যাঁ, আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি শুধু গান করি বলে।’
—‘কি কি পারো?’ ছেলেমানুষের মতো বলল রণো।
—‘আমরা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি, দুঃখ ভুলতে পারি, ভোলাতে পারি, অসুখ ভালো করতে পারি।’
রণো মুখটা ফিরিয়ে নিল।
সোহম বলল—‘ইন ফ্যাক্ট একবার তোর মা শুদ্ধু দিনের পর দিন গান শুনিয়ে আমাকে একটা বড় অসুখ থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিল।’
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো রণো, বলল—‘তাহলে আর ডাক্তারের দরকার কি? মা তো একটা চেম্বার খুলে বসলেই পারে। তুমি আর মা।’
সোহম বলল— ‘আমি মানসিক অসুখের কথা বলছি।’ অপালার চোখের ইঙ্গিতে টিটু বনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শিয়রের কাছে নীরবে বসা অপালার অস্তিত্ব এখন রণো ভুলে গেছে। সোহমের সঙ্গে এখন তার ভীষণ ভাব। সোহমকে সে চোখের আড়াল করতে চায় না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রণো বলল —‘মনের কথা বুঝতে পারো!’
—‘ম্যাজিশিয়ানের মতো পারি কি? তবে আমাদের অনুভূতি খুব সুক্ষ্ম হয়ে যায় রণো, কিছুটা আন্দাজ করতে পারি বই কি। যেমন বুঝতে পারি তুই প্রেমে-ট্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলি।’
—‘ইট ওয়জ নট ফর লাভ, ইট ওয়জ ফর হেট।’ যথাসম্ভব শান্ত গলায় রণো বলল।
—‘ওই হলো। লোকে বলে একটা আরেকটার উল্টো পিঠ।’
—‘না, না, ঘেন্না, আমি মেয়ে জাতটাকেই ঘেন্না করি। ন্যাকা, কুটিল, চতুর বিবেক বলে কোনও বস্তু নেই। আই হেট দেম ইন অল ফর্মস।’
—‘তোর বোধহয় একটা খুব বাজে মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল রণো, তাই এমন মনে হচ্ছে। আমারও একবার অমন হয়েছিল। বাট দ্যাট স্টেজ ইজ ওভার ফর মি, অ্যান্ড ইট উইল সুন বি ওভার ফর ইউ। লাইফ ইজ সো বিউটিফুল, অ্যান্ড উইমেন আর ভেরি ভেরি মাচ পার্ট অফ দ্যাট বিউটি।’
রণো বলল—‘জানি। আমি জানি, জীবন খুব সুন্দর। বাট আই অ্যাম শাট আউট অফ ইট।’
—‘কেন?’
—‘কী আছে আমার? টিটুর মতো ব্রেন নেই। বনির মতো লাভলিনেস নেই মায়ের মতো গলা নেই। একটা অ্যাভারেজতম বাঙালির চেয়ে আমি এতটুকু একটা ভগ্নাংশ বেশি নয়। মায়ের রেকর্ডের রয়্যালটি দিয়েই হয়ত জীবন কাটাতে হবে।’
—‘তুই একেবারে এতোটা ভেবে ফেললি রণো? কত বয়স তোর?’
—‘বাইশ। এটা কম বয়স হল। আর কবে কিছু করবো?’
—‘আরে চেষ্টাটা ঠিক ভাবে, ঠিক দিকে করতে হয়। আমরা তো আছি। একটা কথা বলি, একটা জীবন, মানে একটা সারাজীবন ধরে নে, তার প্রত্যেকটা মুহূর্ত কাজে লাগাতে হয়। কাজে লাগানো মানে শুধু শ্রম নয়, উপভোগও। দা জয়েজ অফ লাইফ আর বাউন্ডলেস।’
—‘আমিও তো তাই-ই মনে করেছিলুম। সকলে যখন আমাকে দিনরাত পড়াশুনোর জন্য টিক টিক করতো ‘আমি পারতুম না, বুঝতুম এ আমার ভালো লাগছে না। তাই বেরিয়ে যেতুম। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারতুম। আড্ডা উইথ গুড ফ্রেন্ডস একটা দারুণ রিক্রিয়েশন।’
—‘ঠিকই বলেছিস। বাট সামহাউ ইট ডিডন্ট ওয়ার্ক। ইন ইওর কেস। তাই তো? এখন যে বেঁচে উঠেছিস বুঝতে পারছিস তো লাইফ ইজ গ্রেটার দ্যান লাভ্!’
—‘ইয়া। দ্যাট কাইন্ড অফ লাভ। রানিং আফটার সামবডি লাইক ম্যাড।’ রণো এবার অর্ধেকটা উঠে বসেছে। সে তার শিয়রের কাছে বসে থাকা মাকে দেখতে পেল।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—‘তুমি আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছ কেন? উই আর টকিং অ্যাজ ওয়ান ম্যান টু অ্যানাদার।’
অপালা মৃদু গলায় বলল—‘আমাকেও ম্যান বলেই ধরে নে না।’
কিন্তু রণো আর কিছুতেই কথা বলল না।
পরদিন তখনও রণো বিকেলে ঘুম থেকে ওঠেনি, পাখিদের কাকলি আরম্ভ হয়ে গেছে রাধাচুড়ো গাছটায়, অপালা এসে তার মাথার দিকে জানলায় পিঠ করে বসে রইল। সোহম বলল—‘রণো, রণো, সন্ধে হয়ে যাচ্ছে খাবি না?’
রণো বলল ঘুম জড়ানো গলায়—‘দূর, তোমার ও দুধ আমার রোজ রোজ ভালো লাগে না।’
—‘তবে কী খাবি?’
—‘কফি।’
—‘কফি খেতে যে ডাক্তার বারণ করেছেন!’
—‘তাহলে চা।’
চাও ডাক্তার দুবার খেতে বারণ করেছেন, কিন্তু সোহম নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে এলো। সঙ্গে কিছু খাবার। রণো খাবারগুলো ছুঁলো না। শুধু চাটাই খেয়ে বলল— ‘আহ্, কতদিন পর চা খেলুম!’
সোহম বলল—‘তোর কি খুব চায়ের নেশা ছিল?’
—‘চায়ের নেশা মানে? আমি তো চকচক করে দাদুর প্লেট থেকে চা খেয়ে নিতুম, যখন এইটুকু, কান্নাকাটি করলে ঠাম্মা আমার দুধের সঙ্গে চা মিশিয়ে দিত।’
—‘মা বারণ করত না?’
—‘মা? মা কোথায়? ছোটবেলা থেকেই দেখছি দাদু ঠাম্মা ছাড়া আমার কেউ নেই। মাকে খুঁজলেই দিদা বলত, তোর মা গান গাইতে গেছে। রেডিওতে মার গান হলে আমি বন্ধ করে দিতুম। কিম্বা সেখান থেকে যতদূরে পারি চলে যেতুম। মা আমাকে কখনও আদর করত না, বনিকে টিটুকে যেভাবে করত। মা আমাকে বাড়িতে একটা অনার্ড গেস্ট-এর মতো দেখত। আই ইউজ্ড্ টু হেট মাই মাদার সোহমমামু, শী ওয়াজ দা সেন্টার অফ মাই হেট্রেড, ইনক্লডিং হার মিউজিক।
সে উঠে বসে সোহমের মুখোমুখি হল। এবং পাশের দিকে চুপচাপ বসে থাকা অপালাকে দেখতে পেলো। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল—‘তুমি? কখন এলে? দিস ইজ ভেরি আনফেয়ার মা!’
অপালা বলল—‘তুই তো ঘুমোচ্ছিলি, উঠেই বকবক করতে আরম্ভ করে দিলি। আর শুনলেই বা। আমি তো তোকে বলেইছি আমি তোর বন্ধু।’
সোহম বলল—‘অপু ঠাণ্ডা লাগিয়েছিস। এতে করে বলি তুই রোগা মানুষ ভালো করে গরম জামা পরবি! দাঁড়া। বনমালী, বনমালী!’ বলে ডাকতে ডাকতে সোহম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রণো বলল—‘আমার কথা শুনে তুমি নীডলেসলি কষ্ট পেলে তো!’
অপালা ধরা গলায় বলল— ‘আমি কষ্ট পেতে পারি এ কথা যে ভেবেছিস তাইতেই আমার অর্ধেক কষ্ট কেটে গেছে। রণো, তুই খুব ছোট্ট হয়েছিলি তো! তুলোয় করে মানুষ করতে হয়েছিল অনেক সাবধানে। আমিও তখন ছোটই। তোকে হ্যান্ডল করতে পারতুম না। তোর ঠাম্মাই সব করতেন। তারপর তোর ওপর ওঁর এমন একটা মায়া পড়ে গেল যে আমাকে তোর কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। আদর শাসন কিছুই না। তুই আসলে ওঁদের অনেক কষ্টের একমাত্র শিবরাত্রির সলতে তো! আমি ওঁদের খুব ভয় পেতুম। তুই যত আদর চেয়েছিস, সব আজ পুষিয়ে দিই, হ্যাঁ?’
রণো খুব লজ্জা পেয়ে বললো—‘কি যে বলো! আমি একটা ধেড়ে ছেলে!’
—‘কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে যে!’ অপালা বলল, ‘আমিও তো বঞ্চিত হয়েছি। তুই আমার প্রথম সন্তান, তোর জন্যে কত কান্না, কত উৎকণ্ঠা, কত স্নেহ, তোকে আদর করতে না পারার, শাসন করতে না পারার যন্ত্রণা!’ বলে অপালা অনেকক্ষণ তার ঠাণ্ডা গাল ছেলের কপালের ওপর রেখে দিল। তারপর পরম স্নেহভরে দুই গালে দুটো চুমো খেল।
সোহম ঢুকে বলল ‘অপু তুই এই কনককশনটা খেয়ে নে। তোর গলায় বেশ ঠাণ্ডা লেগেছে।’
কাপটা নিতে নিতে অপালা বলল—‘কী জিনিস এটা?’
—‘আমার ট্রেড সিক্রেট বলব কেন? নাজনীনের কাছে শেখা। গরম গরম খা, সিপ করে করে, গলায় একটু রাখিস।’
শিবনাথ এই সময়ে ঢুকে বললেন—‘কী রণো? রণজিৎ? রণজয় রণবীর কেমন আছো?’
‘ভালো বাবা।’ শিবনাথের মনে হল ‘বাবা’ ডাকটা ছেলের মুখে অনেক দিন পর শুনছেন।
একটু চা-টা খেয়ে নিয়েই শিবনাথ বললেন—‘অপু চলো।’ অপালা বলল—‘রণো, আজ আসি।’
রণো অন্যরকম চোখে তাকিয়ে বলল—‘কাল আসবে তো? সকালে?’
সোহমমামু, সকালে মার এখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না!’
‘অনায়াসেই। তবে তোমার মার তুমি ছাড়াও আবার তিনটি সন্তান আছে কিনা!’
—‘তিনটে?’ হঠাৎ হেসে ফেলল রণো, ‘ও তুমি বাবার কথা বলছো? বাবা তো কোন সকালে খেয়ে দেয়ে অফিস বেরিয়ে যায়। টিটু বনিও তো কলেজ যায়। মা তো তার পর আসতে পারে!’
—‘তাহলে তোর সঙ্গে আমার ম্যান টু ম্যান কথাগুলো কখন হবে?’
—‘রাতে! মা চলে যাবার পর! মার সামনেও কিছু কিছু হতে পারে। খুব প্রাইভেটগুলো রাতে।’
সোহম বলল—‘অপু শুনতে পাচ্ছো!’
—‘পাচ্ছি।’
—‘তোমার কি মত?’
—‘কাল টিটু বনিকে কলেজ পাঠিয়ে আসবো।’ বলে অপালা রণোর মাথায় আরেকবার হাতটা রেখে বেরিয়ে গেল। আর তখনই রণো বলল—‘সোহমমামু, কী গান গেয়ে মা তোমায় ভালো করেছিল, কী অসুখ?’
—‘অসুখটা অনেকটা তোর ধরনেরই। ডিটেল কি আর এতোদিন পর মনে আছে! তবে কারণটা এক।’
—‘সত্যি? তোমারও এরকম মনের অবস্থা হয়েছিল?’
—‘হয়েছিল।’
—‘কাটিয়ে উঠেছ?’
—‘অনেকদিন। তোর মার ওষুধে। মানে গানে।’
—‘মা তাহলে খুব বড় জিনিয়াস বলো!’
—‘শুধু জিনিয়াস নয়, রণো, তোর মা মানুষ হিসেবেও খুব উঁচুদরের।’
—‘ওই গানটা আমাকে শোনাবে? —‘যে গানটা শুনে তুমি সেরেছিলে?’
সোহম টেপ-ডেকটার কাছে গেল। তারপর মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি গাওয়া তাদের দরবারীর যুগলবন্দীর শেষ মহড়াটা চালিয়ে দিল। লো ভল্যুমে।’
অনেকক্ষণ বাদে শেষ হয়ে যাবার পর, যখন সে আস্তে আস্তে ক্যাসেটটা বার করে নিচ্ছে দেখল রণো ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় শান্ত, বাচ্চা লাগছে তাকে।
সোহম পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বনমালীকে বলতে এখুনি যেন খাবার গরম না করে, খোকাবাবু উঠলে হবে, এমনসময়ে পেছন থেকে শুনলো রণো আবিষ্ট গলায় বলছে— ‘ইটস ওয়ান্ডারফুল। এটাকে কি বলে মামু?’
—‘দরবারী কানাড়া।’
—‘এই সেই সুর যা শুনিয়ে মা তোমাকে সারিয়ে তুলেছিল!’ আপনমনেই বলছে রণো যেন নিজেকে শুধোচ্ছে।
—‘এবার খাবি তো?’
—‘বেশি কিছু নয়, বড্ড ঘুম পাচ্ছে।’
ঘরে বনমালী খাবার দিয়ে গেল, দুজনেরই। রণো খেতে খেতে বললো, ‘ওসব কিছু নয়, বলো মামু?’
—‘কি সব?’
—‘ওই সুমনটুমন? ওই মেয়েটা?’
—‘নথথিং। অ্যাবসটলি নাথিং। প্রায় প্রত্যেকের জীবনে এই ধরনের সংকট আসে। ইট ইজ সো কমন!’
—‘আসলে কি জানো তো? অপমানটা খুব লেগেছে!’
—‘ওইরকম অপমান তোর ওই সুমন কাপুরকেও অনেক খেতে হবে। হয়েছে। নো বডি ইজ স্পেয়ার্ড।’
—‘আসলে ওদের লাইফ-স্টাইল, ভ্যালুজ, সবই আমাদের থেকে এতো আলাদা। টাকা! টাকা! টাকা! জানো পকেটমানি নিয়ে কী করে? রেসের মাঠে যায় রেগুলার। কোথা থেকে টিপ্স জোগাড় করে কে জানে! তারপর পকেটমানি, ডাবল ট্রিপল … ওই করেই তো আমার ওর সঙ্গে আলাপ। রেসের মাঠে। আমাকে একটা দুর্দান্ত টিপস দিয়েছিল। পাঁচ হাজার তিনশ জিতেছিলুম। কিন্তু টাকার ব্যাপারেও কোনও দায়িত্ব নেই। নেচে কুঁদে, মদ খেয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে!’
—‘তাহলেই বোঝ!’
—‘আচ্ছা মামু তোমরাও তো ব্যবসাদার! তোমার বাবা ব্যবসা করেন। কিন্তু ওদের টাইপের সঙ্গে তো তোমাদের কোনও মিল নেই। কেন?’
—‘দ্যাখ রণো, সব কথা বলতে পারব না। কেন যে এতো তফাত। আমাদের ব্যবসাটা কয়েক পুরুষের। প্রেসের ব্যবসা। লেখাপড়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমার দাদারা সবাই কোন না কোনও পড়াশোনার চর্চায় আছেন। ঠিক টাকার পেছনে টাকারই জন্য দৌড়োনোর অ্যাটিচুড আমাদের কখনও ছিল না। তুই যাদের কথা বলছিস তারা নুভো রিশ্ টাইপ। ভারত ভাগের পর কিছু লোক সরকারি খয়রাতির সুযোগটা প্রচণ্ডভাবে লুঠে নিয়েছে, কিসের ব্যবসা, কি ব্যাপার—এ সবের ওপরেই নির্ভর করছে একটা পরিবারের কালচার, তার ভ্যালুজ।’
—‘সোহমমামু, তুমি তো এতো দেশ-বিদেশ ঘুরেছো, এত খ্যাতি, এত টাকা, নিজের হাতে রোজগার করেছো, হোয়াই আর য়ু সো ডিফরেন্ট। আমার জন্য কটা ফাংশন বাতিল করে দিলে। বম্বে যাওয়া ক্যানসেল করে দিলে। ‘গান করছো কিনা শুনতে পাই না। এতো কনসিডারেশন, স্যাক্রিফাইস, কেন তুমি এতো আলাদা?
সোহম বলল— ‘কেন? কেন কে জানে? হয়ত গানের জন্য। হয়ত তোর মায়ের জন্যও।’
—‘মায়ের জন্যও? কেন মামু? ডোন্ট মাইন্ড, ডু ইউ লাভ হার?’
সোহম প্রথমে কোনও উত্তর দিলে পারল না। রণো তাকে হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্ন করে বসবে সে ভাবেনি। কিন্তু এই ছেলেটিকে হতাশার হাত থেকে রক্ষা করতে, আত্মবিশ্বাস এবং জীবনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবার জন্য সে মনপ্রাণ দিয়ে এর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করে চলেছে, এই প্রশ্নের আঘাত এখন তাকে সইতেই হবে।
সে বলল—‘ইয়েস রণো, অ্যান্ড নো। তুমি যে সেন্স-এ কথাটা ব্যবহার করলে ঠিক সে-সেন্স-এ লভ্ এটা নয়। আবার ঠিক ভাইবোনের ভালোবাসার মতোও এটা নয়। টু বী ট্রুথফুল রণো, তুমি যদি কোন রকম আর্টিস্ট হতে পেন্টার, রাইটার, স্কালপটার, অ্যাবাভ অল মিউজিশিয়ান, তাহলে তোমাকে বোঝাতে পারতুম সমধর্মীদের মধ্যে একটা খুব সুক্ষ্ম বোঝাপড়া থাকে। সবাইকার সঙ্গে যে সবাইকার হবে, তার কোনও মানে নেই। কারুর সঙ্গে কারুর হয়। সেতারের তার বাঁধার মতো, খাদের সাটা বাজালেই, চিকারিগুলো দেখবে ঝনঝন করে বেজে উঠছে। এই এক সঙ্গে বাজার ফলে সুরের একটা অনুরণন দুজনেরই মনের আবহাওয়ায় ছড়িয়ে থাকে। এটা হলো রণো, সেই লভ্। নট দ্য কাইন্ড ইউ ফেল্ট ফর ইয়োর গার্ল ফ্রেন্ড, নর হোয়াট ইয়োর ফাদার ফীলস ফর ইয়োর মাদার।’ নিজেকে এভাবে বিশ্লেষণ করতে করতে সোহম যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। অপালার প্রতি তার অনুভূতিকে সে কখনও এভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেনি। জীবনের প্রথম আঘাতে সাংঘাতিক আহত একটি তরুণের প্রশ্নের উত্তরে সে এই বিশ্লেষণটা এক্ষুনি এক্ষুনি করল।
খাওয়া শেষ করে সে আবার টেপডেকটার দিকে গেল। শুধ্ কল্যাণের যুগলবন্দীটা চালিয়ে দিয়ে সে বলল—‘রণো, তুমি এটা যথাসাধ্য মন দিয়ে শোনো। আমি সুরে কী করতে চাইছি না বুঝলে তোমার মা এই সিকোয়েন্সগুলো করতে পারতো না। আমার পক্ষেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। এই বোঝাপড়া থেকে একটা অদ্ভুত অন্য প্রকৃতির ভালোবাসা জন্মায়। বলতে বলতেই সোহম আবার অনুভব করল তারা দুজন, সে আর অপালা তানপুরের জুড়ির তার। আসলে তারা বোধহয় কিন্নরমিথুন, কোনও দেবতার অভিশাপে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। তার এই অনুভব একান্ত নিজস্ব। একথা সে স্বভাবতই রণোকে বলল না। অপুকেও কি কখনও বলবার সুযোগ আসবে?