গান্ধর্বী (Gandharbi) : 10
পরিবর্তনগুলো জীবনে আসে। আসবেই। কিন্তু আসে সবার অলক্ষ্যে। যার জীবনে এলো সে ধরতে পারে না, কবে সে বদলে গেল, তার জীবন বদলে গেল। দিনক্ষণ সব স্মৃতির অতলে চলে যায়। আগেকার সত্তাটার সঙ্গে একটু একটু করে পাল্টে যাওয়া নতুন সত্তাটাকে তুলনা করলে অনেক সময়ে মনে হয় এ কি সেই একই মানুষ! কখনই হতে পারে না। একি সেই একই মানুষের জীবন? কি করে এমন হল? সোহমের জীবনে পরিবর্তন এলো সচেতন ভাবে। কালবৈশাখীর মতো ঘনঘটায় চারদিক আচ্ছন্ন করে। তারপর দুমদাম শিলাবৃষ্টি, তাপমাত্রার হঠাৎ উঁচুতে উঠে যাওয়া আবার হঠাৎ অবিশ্বাস্য নীচে নেমে যাওয়া। তারপর নবাঙ্কুর ইক্ষুবনে এখনও ঝরিছে বৃষ্টি ধারা বিশ্রামবিহীন, মেঘের অন্তর পথে অন্ধকার হতে অন্ধকারে চলে গেল দিন। প্রথমটা এইরকমই মনে হয়েছিল। তমিস্রা থেকে ঘোরতর তমিস্রায়। অপালা বিয়ের দিন বলেছিল— ‘খেয়ে যাবি তো?’
সোহম বলেছিল—‘নিশ্চয়ই। মেনু কি বল আগে?’
—‘আমি জানি না রে। এরা কিসব মিষ্টি-টিস্টি খাইয়ে যাচ্ছে, স্বাদ গন্ধ কিছুই পাচ্ছি না।’
বর এসেছে রব শুনে, মেয়েদের নিচ্ছিদ্র ভিড়ের মধ্যে থেকে সে একবার উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করেছিল। অপালার বর? অপুর বর? কি রকম অদ্ভুত অবিশ্বাস্য লাগছিল তার। ভদ্রলোক টোপরটা হাতে করে খুলে নিতে সোহম দেখল ভদ্রলোক যেন সিনেমার বর। বেশ ধবধবে ফর্সা। স্বাস্থ্যবান। কেশবান। বেশ ভদ্র চোখ মুখের যুবক। অপুর সঙ্গে বয়সের ডিফারেন্সটা বোধহয় একটু বেশি। ততক্ষণে তার খাওয়া হয়ে গেছে। ভালো ভালো জিনিসই হয়েছিল। প্রদ্যোৎ যত্ন করে দাঁড়িয়ে খাওয়ালো। কিন্তু অপুরই মতন সোহমও কোনও কিছুরই স্বাদ-গন্ধ কিছুই পেলো না। পাশেই একটি যুবক চোদ্দটা ফিশফ্রাই এবং উনিশটা লেডিকেনি খেলো। সোহমের গা গুলোচ্ছিল। শেষ পদে পৌঁছবার আগেই সে আশপাশের লোকের কাছে মাফ চেয়ে উঠে পড়ল। বাবা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, বরযাত্রীদের আসরের এক পাশে। তিনি কোথাও খান না। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক হঠাৎ উঠে এসে বললেন— ‘আপনি সোহম চক্রবর্তী না?’
—‘হ্যাঁ।’ সোহম হাত জোড় করে নমস্কার জানাল।
—‘আমি শিবনাথ, মানে বরের জামাইবাবু। আপনার গান আমি কয়েক জায়গাতেই শুনেছি। বাঙলার সঙ্গীত-জগতে এখন আপনারাই আশা। ‘শিবনা—থ।’ তিনি গলা উঁচু করে ডাকলেন।
সোহম বলল— ‘এখন ওঁকে বিরক্ত করবার দরকার নেই। এই গোলমালে আলাপও হবে না ভালো করে। আমি অপুর খুব বন্ধু। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হওয়া শিবনাথদার ভবিতব্য। কেউ নিবারণ করতে পারবে না।’ সে আর দাঁড়াল না। বাড়িতে ফিরে এসে বাবা বললেন—‘খোকন, ওষুধগুলো খেয়ে নিও, আমি বনমালীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আহা! অপু মেয়েটি বড় ভালো। তেমনি চমৎকার বর হয়েছে। এ. জি. বেঙ্গলে রয়েছে শুনলাম। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। খুব ভালো হয়েছে।’
বাবা কেন হঠাৎ অত খরচ করে অপালাকে গয়না দিতে গেলেন সোহম বোঝেনি। বউদিরা বলছিল—আসল বসরাই মুক্তো সব। তার কানে এসেছে কথাটা। বাবার পয়সা অনেক। তার ওপর দাদারাও প্রত্যেকে কৃতী, প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠিত। বাবা ইচ্ছে করলে অনেকই দিতে পারেন। কিন্তু হার্মোনিয়ামটা শ্রেষ্ঠ জাতের। সোহম যখন হার্মোনিয়ম উপহার দিতে চায় জানিয়েছিল বাবা তাকে নিজে সঙ্গে করে চিৎপুরের ভালো দোকানে নিয়ে গেলেন, বিনা প্রতিবাদে, যেন খুশি হয়ে কিনে দিলেন যন্ত্রটা। ওটাই যথেষ্ট ছিল। ওটাতে অত খরচ করবার পর নিজে আবার গয়না দিয়ে আশীর্বাদ করলেন? একটা আংটি বা একজোড়া দুল-টুল নয়। একেবারে পুরো সেট। এটা তার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে। অপু প্রদ্যোৎ দিনের পর দিন তার কাছে এসে তার সঙ্গে গল্প করেছে, সেবা করেছে, অপুর সঙ্গ এতো ভালো তার আগে কখনও লাগেনি। প্রদ্যোতের সঙ্গেও তার ভারী সুন্দর একটা সখ্য জন্মে গেছে। ডক্টর বিদ্যুৎ সরকারও চমৎকার বন্ধু। কিন্তু এখনও সে জানে না, এগুলো কাকতালীয় নয়, অপালা তাকে সারাবার জন্যে প্ল্যানমাফিক গান গেয়েছে, সঙ্গ দিয়েছে ওষুধের সঙ্গে পথ্য হিসেবে। তার অসুখের সময়কার মানসিক বিকারের কথা সে এখন অনেকটাই ভুলে গেছে। খালি একবার বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়েছিল কিছু দারুণ বিভ্রান্তিকর কথা। যখন সে খেয়ে বেরোচ্ছে, তখন উল্টো দিক থেকে মাস্টারমশাই ঢুকছিলেন, তাঁর পেছনে মিতুল। ডান ভুরুর ওপর আর বাঁ গালের নীচের দিকে চিবুক ঘেঁষে কাটা দাগ। কেন? কেন মিতুলের এরকম দাগ হল মুখে! সে হঠাৎ দেখল দারুণ জমকালো সাজগোজ করা দীপালি একরকম দৌড়ে একদিক থেকে আর এক দিকে চলে গেল। মিতুলকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সে সোহমকে দেখতে পায়নি। কিন্তু মাস্টারমশাই পেয়েছিলেন। তিনি মিতুলকে একরকম আড়াল করে নিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলেন। তার বাবাও যেন শশব্যস্ত হয়ে তাকে বরের ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। কারো সঙ্গেই প্রায় দেখা হল না, কথা হল না। তার বাবা তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িতে ঠেলে তুললেন। দীপালি…রামেশ্বর ঠাকুরজী…মিতুল…কাটা দাগ…সে আবছা আবছা মনে করতে পারছে। একটা তীব্র ঘৃণা…রাগ… কার ওপর সে জানে না। সে মিতুলের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। তাতে মিতুল দারুণ ক্ষেপে যায়, তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে মুখের ওপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিতে যায়। সোহম তার কাঁধের চাড় দিয়ে দরজা খুলে ফেলে, টেবিলের ওপর একটা কি যেন পড়েছিল সে সেইটা নিয়ে মিতুলকে আক্রমণ করে। ইস্স্স্ সোহম অন্ধকারে দুহাতে মুখ ঢাকল। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে সে অপুকে কিছু বলেছিল, তার হয়ে ওকালতি করতে বলেছিল মিতুলের কাছে। তার কি সত্যিই দরকার আছে! মিতুল অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু একেবারে হৃদয়হীন, কোনও ডেপ্থ্ নেই। সে কী জিজ্ঞেস করেছিল? দিলীপ সিন্হার সঙ্গে তার সত্যিই ঘনিষ্ঠতা আছে কি না জানতে চেয়েছিল খুব সম্ভব, হয়ত একটু উত্তেজিত হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু তাইতেই মিতুল একটা পনের ষোল বছরের মেয়ে তাকে কি ভাবে অপমান করল ইতর, জানোয়ার, বাস্টার্ড। অথচ কে যে সত্যি বাস্টার্ড তা তো সোহম ভালো করেই জানে!
হায় ঈশ্বর! সে কী করেছে! মিতুল কে! তার কেউ নয়। একটা লাভলি ডল, অসভ্য, বেয়াদব! কিন্তু মিতুলকে সে আঘাত করেছে। তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ গুরুজি বা মিতুল যদি তাকে বিয়ে করতে বলে মিতুলকে? তাহলে সে কী করবে? মিতুল এমনিতে উচ্ছল স্বভাবের প্রাণবন্ত মেয়ে, ফাটা ফাটা ঘষা ঘষা খসখসে নানান রকম অদ্ভুত গলায় চমৎকার দাদরা, গজল, নজরুল গায়, পপ-সং-এ তো ফাটিয়ে দেয় কিন্তু তার ভেতরে প্রাণমন আছে কিনা সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সে এই ক বছরে মিতুলকে বহু ফুল, তাছাড়া ছোটখাটো শৌখিন উপহার দিয়েছে। সোজাসুজি না বললেও বুঝতে দিয়েছে সে তাকে ভালোবাসে। তার পরও মিতুল কি করে এরকম ব্যবহার করতে পারল?
ঘরের মধ্যে আজকে অনেক ডবল রজনীগন্ধা। সুগন্ধে ঘর ভরে রয়েছে। রাস্তার দিকের জানলাগুলো খুলে দিল সোহম। সে শীতকালেও জানলা খুলে শোয়। জামাকাপড় বদলে, দাঁত ব্রাশ করে সে বিছানার ওপর বসে রইল। বনমালী ওষুধগুলো নিয়ে এসেছে। দুটো ছোট ছোট বড়ি। চটপট সেগুলো গিলে নিয়ে সে বনমালীকে বলল— ‘তুই শুতে যা।’ বিছানার ওপর টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল সোহম। তার হাত দুটো মাথার তলায়। ধবধবে বালিশের ঢাকা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে। পায়ের তলা থেকে হালকা লাল কম্বলটা সে গায়ের ওপর টেনে নিল। চোখ-জড়িয়ে আসতে লাগল আর অমনি আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে লাগল দরবারী কানাড়া। তার মস্তিষ্কের কোষ থেকে বাইরের পরিমণ্ডলে। কিম্বা এই ঘরের হাওয়া ধরে রেখেছিল সেই দরবারী। যা আজ রাতে তার মস্তিষ্ক সঠিক পিনটা সঠিক খুঁজে ঢুকিয়ে দেবার পর পরিস্ফুট হতে লাগল। প্রথমে সে শুনতে পাচ্ছিল বড়ে গোলাম আলি। যাঁর প্রতিটি কাজ, প্রতিটি খুঁটিনাটি সে শুনে শুনে রপ্ত করবার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ সে শুনতে পায় মেয়েলি কণ্ঠের দরবারি—তার স্বাদ আলাদা। অপুর সুরবাহারের মতো গলা। ভরে যাচ্ছে ঘরের সমস্ত কোণ। সোহমের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ। শুনতে শুনতে সোহমের হঠাৎ মনে পড়ল অপালার মুখে কেমন শিশুর মতো দুধে-গন্ধ। অপু যখন গায় তখন সোহমের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরের বাঁকের সঙ্গে সঙ্গে, তালের সঙ্গে সঙ্গে বাঁক নেয়। তীব্র এক নৃত্যের আকাঙক্ষা অনুভব করে সে। অপুকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। তার নিজের শরীর মন আত্মার মধ্যে যা সঙ্গীতময় সেই অংশটুকু দিয়ে সম্পূর্ণভাবে অপুর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ব্যগ্রতা অনুভব করে সে। মিতুলের প্রতি তার যা মনোভাব তার থেকে কোথায় সূক্ষ্মভাবে একটা তফাত আছে এই অনুভবের। অপুর প্রতি তার অনুভূতি কী সুন্দর! মধু নক্তমুতোষসো মধুবৎ পার্থিবং রজঃ। তার দিবস রাত্রি, তার পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণা যেন অপুর স্পর্শে মধুময়, মধুমাধবী হয়ে গেছে। এটাই কি আসল ভালোবাসা! অপুর বিয়ের খবর শোনার পর সে একটা ধাক্কা খেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু দিলীপ সিনহার সঙ্গে মিতুলের ঘনিষ্ঠতার কথা শুনে, দিলীপ মিতুলকে আদর করছে এরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করে তার মধ্যে যে একটা উন্মাদ ক্রোধ, জিঘাংসা জেগেছিল, অপু-শিবনাথ দত্তগুপ্তর হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ঠিক সেইরকম মেজাজ তার হচ্ছে না। অপু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল এ কথা তো মনে হচ্ছেই না। অপুর সঙ্গে তার সম্পর্ক যেখানে, সেখানে কোনও শিবনাথ দত্তগুপ্তর পৌঁছনোর প্রশ্ন নেই। সেতারী যখন ঝালা বাজায় তার বাঁ হাতের টিপে সমানে মিড় দিয়ে চলে। অথচ ডান হাতে চলে চিকারির কাজ। দ্রুত থেকে দ্রুততর। অপু তেমনি যুগপৎ বাজবে। অপুর শান্ত সমাহিত ধীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই দুর্লক্ষ্য মাত্রাগুলো সে আবিষ্কার করেছে তার সূক্ষ্মতম অনুভূতি দিয়ে। কিন্তু অপুকে আদর করবার সময়ে, যা আসলে ছিল তার নিজেরই আত্মমোক্ষণ, সে মিতুলের নাম করেছে বারবার। কোনভাবে সে কলুষিত করেছে, অপমান করেছে অপুকে। কিভাবে সেই ক্ষতি সে পূরণ করতে পারে সোহম কিছুতেই ঠিক করতে পারল না। সে তো এক রকম করে ভাবছে। কিন্তু অপুর কিরকম লেগেছিল? অপু কী ভেবেছিল? তার মুখের সেই লালিমা যে গভীর অপমানের লালিমা নয় কে বলবে? অপু নিজে কোনদিন বলবে না। কোন দিন না। অপরের জন্যে সে প্রাণ দিয়ে করে। কিন্তু নিজের ব্যাপারে সে অন্যের জোর-জবরদস্তি শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়। এগুলো কিসের লক্ষণ? এই মেনে নেওয়া, এই সরে যাওয়া, এই প্রতিবাদ না করা! অত স্পর্শাবিষ্ট কলাকার যে এই বয়সেই, নিজের বিয়ের মাত্র কদিন আগে রক্ষণশীল বাড়ির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে যে অসুস্থ পুরুষ বন্ধুর কাছে এসে দিনের পর দিন নিজেকে উজাড় করে গান করতে পারে সে তো ব্যক্তিত্বহীন নয়! তাহলে? তাহলে কি অপু অভিমানী? এত অভিমানী যে অভিমান হয়েছে সেটা বুঝতে দিতেও তার অভিমান? এখন তার চোখের সামনে আর কিছু নেই শুধু রয়েছে অপালার সেই মহাশ্বেতারূপ। কাদম্বরীর মহাশ্বেতা ধবধবে ফর্সা। অপালা কালো। কিন্তু গুণী রসিক শিল্পী মানুষ ভাবগ্রাহী হন। সে দেখতে পাচ্ছে অপালা তার অজস্র ঢেউ খেলানো চুল আলুলায়িত করে, শুভ্র বেশে, হাতে বীণা নিয়ে এক অতীন্দ্রিয়লোকগ্রাহ্য অপরূপ গান গাইছে, তার চোখ টলটল করছে। অথচ অপালার ছিল বিবাহবেশ, চুল তার চিত্রবিচিত্র কবরীতে বদ্ধ। মুখে আলপনা। কত অলঙ্কার। হাতে উপহারের বাক্স।
সোহম উঠে চালিয়ে দিল বড়ে গোলামের বাগেশ্রী। যা আবারও কোনও ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে টেপ করা। গান শুনতে না পেলে তার ঘুম আসবে না এই শীতার্ত চাঁদনী রাতে। বনমালী টের পাবে। সে চুপিচুপি গিয়ে কর্তাবাবুকে অর্থাৎ বাবাকে তুলবে। এই বয়সে, একটা মানসিক ঝড় তাঁর ওপর দিয়ে চলে যাবার পর, তিনি আবারও ছোট ছেলের জন্য ঘুমোতে পারবেন না, এ হয় না। সোহম তাহলে অত্যন্ত লজ্জা পাবে, কষ্ট পাবে।
খুব নিচু স্বরে চালিয়েছে সে টেপ। শুনতে শুনতে চোখ ঢুলে আসে। চেতনার মধ্যে কোথাও মিশে যেতে থাকে বাগেশ্রীর প্রাণ-নিংড়োনো পকড়, অপালার মুখের স্বাদ, আর চুলের গন্ধ, অপুর বরের মুখ, এবং ঘুম, কিরকম ছেঁড়া-ছেঁড়া অথচ আবিষ্ট, মধুর ঘুম। যা সে কোনকালে ঘুমোয়নি।
ঘুমের মধ্যে অপালা এবং দরবারী কানাড়া তাকে সম্পূর্ণ অধিকার করে রাখে। কোনও স্পষ্ট রূপ, সঙ্গ বা সুর নয়, শুধু একটা ভাব। সে অপালার আপূর্যমান দরবারী কানাড়ার মধ্যে নিজের আত্মার সূক্ষ্ম অচলপ্রতিষ্ঠ সঙ্গীতাঙ্গকে প্রবিষ্ট করে দেয়। এক অদ্ভুত ছেদহীন, যতিহীন গান্ধর্বী রমণের অবর্ণনীয় উল্লাস তাকে রাতভর ঘুমভর আবিষ্ট করে রাখে।
পরদিন খুব ভোরবেলায় তার ঘুম ভাঙল। সে চটপট করে তার প্রাতঃকৃত্য ও সাজপোশাক করে নিল, বনমালী বেচারি অঘোরে ঘুমোচ্ছিল তাকে সে ডেকে তুলল। বলল— ‘আমি একটু মর্নিংওয়াক-এ বেরোচ্ছি বনমালী বাবাকে বলে দিস।’
বনমালী সন্ত্রস্ত হয়ে বলল— ‘সে কি খোকাবাবু, তোমার শরীর দুর্বল, একা একা, আমি সঙ্গে যাই।’
—‘কি মুশকিল, আমি ইচ্ছে মতো ঘুরব, তুই ঘরটা গুছিয়েটুছিয়ে রাখিস। বেশ কিছু গোলাপ আর অ্যাসটার রাখিস তো ঘরে!’ শেষ কথাগুলো সে বনমালীকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলল।
‘তবে কিছু খাও। আমি নিয়ে আসি।’
—‘কালকে প্রচুর নেমন্তন্ন খাওয়া হয়েছে। সকালটা কিছু খাবো না, ভাবিস না।’ সোহম আর দেরি করল না। তার গায়ে একটা কাশ্মীরি শাল। সে পুরো রাস্তাটা হাঁটতে হাঁটতে প্রেমচাঁদ-বড়াল স্ট্রীটের দিকে চলল। ভোরবেলায় কলকাতার দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে হাঁটতে ভালো লাগে। বিশেষ করে ওপরের দিকে দৃষ্টি রাখলে। কিভাবে আকাশ প্রকাশিত হচ্ছে, কিভাবে সূর্য নিজেকে ছড়াচ্ছে। কিন্তু আশপাশের দিকে নজর করলেই মুশকিল। গড়গড় শব্দ করে দোকানপাটের ঝাঁপ ওপরে উঠছে, ময়লা সংগ্রহ করতে করতে ময়লার গাড়ি চলেছে। ছোট বড় অনেক বয়সই। রাস্তার ধারে প্রাতঃকৃত্য করতে বসে গেছে। সুতরাং পুরো রাস্তাটা হাঁটবার সংকল্প বেশিক্ষণ রইল না। সে একটা ট্রামে উঠে পড়ল। একদম খালি। শুধু সে কনডাক্টর আর চালক। এই নির্জনতা, একলা থাকা, একলা একলা এই গতি সমস্তটাই সোহম উপভোগ করতে লাগল এত তীব্র এবং গভীরভাবে যেন সে আগে কখনও ভোরবেলা ওঠেনি। ট্রামে চড়েনি। ট্রামের ডিং ডিং ঘণ্টি শোনেনি। দেখেনি কিভাবে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীতকাতুরে অঘ্রানের সূর্য ইতস্তত করতে করতে মুখ বাড়ায়।
ভেতর থেকে এসরাজের আওয়াজ আসছে। কড়া নাড়ার শব্দে ভৈরবী বন্ধ হয়ে যায়। দরজা খুলেই একেবারে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন রামেশ্বর ঠাকুর। সোহম হঠাৎ তাঁকে সেই টৌকাঠের ওপরেই প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায়, নম্র গলায় বলে— ‘মাস্টারমশাই, ভালো আছেন? আপনাকে বড্ড ভাবিয়েছি, না!’ রামেশ্বর হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে ধরেন সোহমকে। দুজনে লম্বায় সমান, খালি একজন বয়স্ক, অন্যজন সদ্য যুবক।
তিনি বললেন— ‘ভেতর এসো সোহম্। আজ যেটা বাজাচ্ছিলুম এসরাজে সেটা আনন্দ ভৈরবী। ভৈরবী বাজাতে বাজাতে সুরটা এসে গেল। নোটেশন করে নিয়েছি। দিবারাত্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে তিনি হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে এইরকম কিছু দেন।’
সোহম বলল— ‘আপনার কাছে আমার অনেক অপরাধ। ক্ষমা করুন।’
মাস্টারমশাই ব্যস্ত হয়ে বললেন— ‘এই দ্যাখো, অসুস্থ অবস্থায় কি করেছো না করেছো ওসব ছেড়ে দাও। দোষ করোনি যে মাফ করবো।’
সোহম অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাল, একটু ইতস্তত করে বলল— ‘মিতুল, মিতুল কেমন আছে, মাস্টারমশাই?’
—‘ভালো আছে, সেলাই কেটে দিয়েছে। আস্তে আস্তে দাগটা মিলোতে থাকবে। তবে পুরোপুরি মিলোবে না।’
—‘মাস্টারমশার… আমি…আমি কীভাবে…আপনি যদি বলেন আমি এক্ষুনি মিতুলকে বিয়ে করতে রাজি আছি।’
—‘র্যাশলি কিছু করো না সোহম। মিতুল তো একটা বাচ্চা মেয়ে। একেবারেই তৈরি হয়নি। তোমাকেও এখনও অনেক ওপরে উঠতে হবে। ওসব চিন্তা এখন ছাড়ো। মিতুলের কাছ থেকে আমি সব শুনেছি। ও নিজেও খুব অন্যায় করেছে। আসলে ও-ও বোধ হয় তোমার সম্পর্কে কিছু উল্টো-পাল্টা কথা শুনেছিল, এবং সেগুলো সত্যি বলে ভেবে নিয়েছিল। এসব তোমাদের বয়সে হয়ে থাকে। যাকগে ওসব কথা, তুমি ওপরে চলো। মিতুল কিন্তু নেই। সে অপালার বাসর জাগছে। বিকেলবেলা বর-কন্যা বিদায় হলে তবে আসবে।’
মিতুল নেই শুনে সোহমের বুকের ভেতর থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। সে বলল— ‘এখানেই তো বেশ আছি। ওপরে কেন?’ আসলে রামেশ্বর ওপরে যাবার কথাটা বলেছিলেন একটা আবেগের মাথায়, সম্ভবত সোহমকে বোঝাতে যে তার এখানে ঠিক আগেকার মতোই অবারিত দ্বার। নয় তো তারা সাধারণত নীচের ঘরেই শেখে। খালি নিচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী একগাদা এসে গেলে, রামেশ্বর তাদের একটা দুটো পাল্টা সাধতে দিয়ে, সোহম অপালা দীপালি এদের ওপরে নিয়ে যান। এদের মতো ছাত্র-ছাত্রী তাঁর আর নেই।
একটু ইতস্তত করে সোহম বলল— ‘মাস্টারমশাই, মিতুলের চিকিৎসার খরচটা আমি…তা ছাড়া…’
রামেশ্বর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন— ‘তোমার বাবা দিতে চেয়েছিলেন। এমন কিছু হয়নি। আমি সামলে নিতে পেরেছি বাবা। তুমি ভেবো না… তোমাকে সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করছি জবাব দেবে?’
—‘বলুন।’ সোহম মুখ নিচু করেই বলল।
—‘তুমি কি মিতুলকে ভালোবাসো? বিয়ে করার কথা তুললে তাই বলছি।’
সোহম খুব আশ্চর্য হয়ে শুনল সে বলছে— ‘না। আমার অবিমৃশ্যকারিতার জন্যে মিতুলের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্যে আমি মিতুলকে বিয়ে করতে রাজি, এক্ষুনি। তাকে সুখী করারও প্রাণপণ চেষ্টা আমি করব।’
মাস্টারমশাই স্নিগ্ধ গলায় বললেন— ‘সোহম, তুমি যে এতটা ভেবেছ, এতেই ক্ষতি যা হয়েছে তার পূরণ হয়ে গেছে। তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তারও তো পূরণ করতে পারিনি বাবা। কিন্তু আর কারো হাত দিয়ে ঈশ্বর তা করিয়েছেন। মিতুলকে বিয়ে করার সংকল্প এখন থেকে তোমাকে করতে হবে না। শোনো, নাজনীন বেগম একটা স্কলারশিপ দেন প্রতি বছর, সারা ভারতের কিছু-কিছু ছেলে-মেয়ে তাঁর লখ্নৌ-এর বাড়িতে গিয়ে তালিম নেয়। তিনি চেয়েছিলেন অপালাকে। সুরলোকের ফাংশনে তিনি সবার অলক্ষ্যে উপস্থিত ছিলেন। সে সময়টা চন্দ্রকান্তজীর অতিথি হয়ে ছিলেন তো! যাই হোক। অপালা মার জীবনে সে সৌভাগ্য হল না। তুমি যদি চাও তো ওঁকে বলে আমি অপুর জায়গায় তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করি। তোমার গানও ওঁর খুব ভালো লেগেছে। বলো, রাজি আছো তো? তবে বুঝতেই পারছো উনি প্রধানত ঠুংরিরই তালিম দেবেন। বেনারসের চীজ।’
সোহম বলল— ‘আমি যাবো মাস্টারমশাই। কলকাতা আমার একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া কি রকম—এটা আমার জানা দরকার। বাবা বোধ হয় খুব আপত্তি করবেন।’
—‘সে ক্ষেত্রে যেও না। কিন্তু নাজনীনের ওখানে শুধু গান বাজনা ছাড়া আর কিছু হয় না। তিনি নিজেও ষাটের ওপরে গেছেন আমি তো বলি তিনি এখন সাধিকা। প্রত্যেক স্টুডেন্টের আলাদা ঘর। আলাদা যন্ত্র। হিন্দু হলে হিন্দু বামুনের রান্না। উনি ছাত্র-ছাত্রীদের লেভ্ল বুঝে, তার আসল প্রতিভা কোনদিকে বুঝে তালিম দেন। এদিক থেকে অসম্ভব ক্ষমতা ধরেন। বিশাল বিশাল বাগান, চত্বর আছে ওঁর প্রাসাদে, ইচ্ছেমতো ঘুরবে, ফিরবে। আর সবচেয়ে বড় কথা ভারতের সব বড় বড় ওস্তাদদের গান-বাজনা-নাচ দেখতে শুনতে পাবে। নাজনীনের এমন ইনফ্লুয়েন্স যে ইচ্ছে করলে উনি তোমার ক্ষমতার ধরন বুঝে অন্য কারো কাছেও ট্রান্সফার করে দিতে পারেন। কিছুদিনের জন্য কিছু চীজ শিখিয়ে নিতে পারেন।’
সোহম বলল— ‘আগে বাবাকে জিজ্ঞেস করি।’
আগে সে বাবার এতে বাধ্য ছেলে ছিল না। কিন্তু তার সাম্প্রতিক অসুস্থতার পর সে বাবার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। বাবার ভেতরকার ব্যগ্র ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে। তার অসুখের আগে তাদের বাড়িটা ছিল খুব সুন্দরভাবে পরিচালিত একটি হোটেলের মতো। সবার ওপরে ম্যানেজার তার বাবা। কিন্তু কারুর সঙ্গে কারুর তেমন যোগাযোগ ছিল না। ভালোবাসার অভাব বা উদাসীনতা এর কারণ নয়। এর কারণ তথাকথিত আভিজাত্য কিছুটা, আর কিছুটা প্রাত্যাহিকতার নির্বেদ। কিন্তু তার অস্বাভাবিক অসুখে আভিজাত্যের সেই আপাত-উদাসীনতার নির্মোটা খানখান হয়ে ভেঙে গেছে। বউদিরা, বিশেষত মেজবউদি দুপুরে তাকে কাছে বসিয়ে খাওয়ায়। রাত্তিরে সকলে একসঙ্গে টেবিলে বসে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে বাবার। তাঁর অফিস-ঘর নীচেই। আজকাল যে কোনও ছুতোয় তিনি হঠাৎ হঠাৎ ওপরে উঠে আসেন। ‘খোকন! খোকন!’
—‘কি বাবা? সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
—‘না মানে। বনমালীকে একটু দরকার ছিল। তুমি কি করছিলে?’
—‘পড়ছিলুম বাবা।’
—‘পড়ছিলে? আরে ঠিক আছে বনমালীকে আমি খুঁজে নিচ্ছি। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না…।’
সোহম বুঝতে পারে বনমালীকে বাবার মোটেই দরকার নেই। তিনি ছল করে সোহমের মুখটা দেখে গেলেন। ছোট ছেলের প্রকৃতিস্থ মুখ, যা তিনি হারাতে বসেছিলেন। তার হৃদয়ের ভেতরটা বাবার জন্য দ্রবীভূত হয়ে যায়।
দুদিন পর বাবার কাছে কথাটা পাড়ল সে। রামেশ্বরের নাম করল না। স্কলারশিপটার কথা যেন সে অন্য কোনও উৎস থেকে শুনেছে এমনি একটা ভাব করল। বাবার মুখটা ভারী হয়ে গেল। বললেন— ‘তোমার এবার এম. এ. ফাইন্যাল ইয়ার!’
—‘বাবা, আমি পরীক্ষাটা ঠিক সময় মতো দিয়ে যাবো। ওটা তো একটা হোস্টেলের মতো। প্রত্যেকের নিজস্ব ঘর-টর আছে।’
—‘কিন্তু কে বেগম। স্ত্রীলোক গায়িকা, সে খোকন আমি…’
—‘বাবা ওঁর ষাট বছর বয়স হয়ে গেছে। মাস্টার মশায়ের চেয়েও বড়। সাধিকা গোছের গায়িকা। মধ্যপ্রদেশের কোন এস্টেটের মহারানী। খুব ভালো লোক।’
—‘চেঞ্জ তোমার পক্ষে ভালো। ডাক্তারও সে কথা বলছেন। কিন্তু একলা তোমাকে ওই গান-বাজনার ওয়ার্ল্ডে চলে যেতে দিতে আমার মন চাইছে না খোকন।’
—‘বাবা, তোমার কথামতো আমি এম. এ করবো কথা দিচ্ছি। কিন্তু গান ছাড়া আমার সত্যি কিছু হবে না বিশ্বাস করো। আমি শুধু গান করবো, গান শিখব। একেবারে ডিভোটেড হয়ে। তোমার কোনও ভয় নেই।’
প্রতাপবাবু বললেন —‘ঠিক আছে। আমাকে একটু ডাক্তারের পরামর্শ নিতে দাও।’
অপালা যে সন্ধেবেলায় শাঁখে দীর্ঘ, দীর্ঘতর, দীর্ঘতম ফুঁ পেড়ে, পাড়া প্রতিবেশীর বিস্ময় উদ্রেক করে মাথায় আধ ঘোমটা দিয়ে শাশুড়ি আর পিসশাশুড়ির সঙ্গে সেদিনের বিকেলবেলার জলখাবার চল্লিশটা মটরশুঁটির কচুরি তৈরি করছিল, সেইদিন দুন এক্সপ্রেসে সোহম লখনৌ রওনা হয়ে গেল।
পিসিমা বললেন—‘বউমা দুরকমের পুর হবে। একটা ঝুরো ঝুরো। আরেকটা মাখো মাখো, থসথসে। ঝুরো পুরটায় জিরে ভাজার গুঁড়ো দিও। তোমার শ্বশুর ওইরকম ভালোবাসেন।’
সোহম তার তানপুরার বাক্টাকে সিটের তলায় রেখে স্বস্তি পাচ্ছিল না। সামনের ভদ্রলোক আলাপ করবার চেষ্টায় বললেন—‘কী আছে ওতে? সেতার?’
ফার্স্টক্লাস কুপে। শুধু দুজন যাত্রী। সোহম বলল—না, তানপুরা।’
—‘আপনি গাইয়ে নাকি? কী নাম বলুন তো? কনফারেন্সে যাচ্ছেন, না রেডিও প্রোগ্রাম?’
—‘একটু আধটু গাই। নাম বললে চিনবেন না। লখনৌ যাচ্ছি। কাজে।’
পিসিমা বললেন—‘বাকি পুরটা শুধু আদামৌরির হবে। ওটা বাকি সবার। ময়দাতে একটু লেবুর রস দাও মা। মচমচে হবে। শিখে নাও। শিখতে তো হবে সবই। গেরস্থ ঘরের বউ যখন। ময়ান ছাড়াও একটু পাতি লেবুর রস দিতে হয়।’
ভদ্রলোক সুটকেসের গায়ে লেখা নামটা পড়ে বললেন— ‘সোহম চক্রবর্তী। সোহম চক্রবর্তী! কেমন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! কিছু মনে করবেন না, আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমি যাচ্ছি দেরাদুন। কর্মস্থল। নিজের দেশের লোক, ভাষা, গান সব ছেড়েই থাকতে হয়। একটু বেশি কথা বলি!’
সোহম বলল—‘তাতে কী হয়েছে? আপনি কথা বলুন না।’
—‘গান যখন করেন তখন যাত্রাপথে শুনতে পাবো নিশ্চয়ই!’
—‘সোহম জানলার কাচটা টেনে নামিয়ে দিল। বড্ড হাওয়া আসছে। তার গলায় একটা সুদৃশ্য কাশ্মীরি কমফর্টার। সে হঠাৎ বিনা ভূমিকায় গেয়ে উঠল—‘যে যাতনা যতনে/আমার মনে মনে মন জানে/পাছে লোকে হাসে শুনে/আমি লাজে প্রকাশ করি নে।’
শাশুড়ি বললেন—‘এইবার ঘিয়ে ধোঁয়া উঠেছে, ছাড়ো কচুরিগুলো এক এক করে ছাড়ো। অভ্যেস আছে তো! পাশ থেকে। হ্যাঁ এই তো বেশ ফুলছে!’
ভদ্রলোক বললেন— ‘আমার নাম বিশ্বরূপ দে। মিলিটারি অ্যাকাউন্টস-এ আছি। আপাতত দেরাদুন। গান শুনতে চেয়ে এমন গান শুনতে পাবো, আমি স্বপ্নেও আশা করিনি। ক্ল্যাসিক্যাল—বেস আছে গলার। আমারও এককালে শখ-টখ ছিল।’
‘সোহমের এখন মুড এসে গেছে। সে হাতে তাল দিয়েই গাইতে লাগল ‘কানহা রে, নন্দ নন্দন/পরম নিরঞ্জন হে দুখভঞ্জন।’ রাগ কেদারা, তিনতাল। ভদ্রলোক মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলেন।
খেতে খেতে শ্বশুরমশাই বললেন—‘কচুরিগুলো ফুলেছে বটে, কিন্তু তেমন কামড় হয় নি।’
শাশুড়ি বললেন— ‘ছেলেমানুষ, নতুন শিখছে। ওই যে পাতে দিতে পেরেছে, ওই ঢের। তোমাদের বাড়ি-বগ্গে অভ্যেস কি হল জানো? বসতে পেলে শুতে চাও।’