গানের সামুকাকা
বাইরে বিকেল হয়ে এল। জীবনেও বিকেল হব হব। এই সব মুহূর্তে পিছনে হেঁটে যেতে ইচ্ছে। করে। ঝরা পাতা আর ঝরা স্মৃতি মাড়িয়ে কবর দেওয়া জীবনকে রেজারেক্টেড করতে ইচ্ছে হয় বড়ো। কত পথ পেরিয়ে এলাম, শহর বনের দেশ বিদেশের কত বর্ণনা, কত নারী, কত সুখ, কত দুঃখ। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা লালচে-হলুদ ফুলের পাপড়ির মতো স্মৃতির টুকরো ভিড় করে মাথার মধ্যে। তারপরই বর্তমান দৌড়ে এসে মনকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করে বর্তমানের কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দেয়। ভাবা হয় না, যাওয়া হয় না। ফেলে-আসা পথ আর সঁড়িপথে। তবু। কৃচিৎ অবসরের ফাঁক-ফোঁকে স্মৃতির খড়কুটো মুখে করে সাহসী চড়ুইয়ের মতো ভাবনা উড়ে এসে ডানা ফরফর করে কিছুক্ষণ। তার পরেই আবার উড়ে যায়। আসে, যায়, বাসা বাঁধে না। পরিসর নেই।
ছেলেবেলায় আমাকে গান শেখাবার জন্যে সামুকাকা আসতেন। সামু লাহিড়ী।
সামুকাকা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। পায়ে পাম্প সু। গায়ের রং কালো। বরেন্দ্রভূমির মানুষদের তীক্ষ্ণ নাসার প্রতীকি চিহ্নে চিহ্নিত। হাসিটা ছিল বড়ো মিষ্টি।
আমি তানপুরা ছেড়ে গান গাইতাম এবং উনি দিলরুবা বাজিয়ে সঙ্গত করতেন। শেখাতেনও দিলরুবা বাজিয়েই। বড়ো চমৎকার হাত ছিল ওঁর। হাতের দরদে বড়ো যন্ত্রণা হত বুকের মধ্যে। ওই বয়েসেও। ঘরের আলো নিবিয়ে দিতে বলতেন। কোনোদিন বারান্দাতেও বসতাম। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়ত ঘরের মধ্যে। আর ওঁর দিলরুবার কান্নায় সারা পাড়া ভিজে যেত। হারমোনিয়াম ছিল না, তা নয়, কিন্তু দিলরুবা এবং তানপুরা বাঁধার কাজে লাগানো ছাড়া হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হত না। কোনোদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলে সামুকাকা মায়ের অর্গান বাজিয়েও গান শোনাতেন বা, শেখাতেন। সেদিন গান শেখার চেয়েও অনেক বড়ো প্রাপ্তি জুটত।
মা কখনো সন্ধ্যাবেলা চান করে উঠে স্নিগ্ধরূপ এবং সদ্যস্নাতা শরীরের সুগন্ধে ঘর ভরে দিয়ে এসে দাঁড়াতেন। সামুকাকাকে দু-একটি বিশেষ গান গাইতে অনুরোধ করতেন। কোনো কোনোদিন মা নিজেও গাইতেন অর্গান বাজিয়ে।
দারুণ সুরেলা ছিল মায়ের গলা। আরও একটা ব্যাপার ছিল মায়ের গানে। মা যখন গাইতেন তখন তাঁর গান যেন তাঁকে কলকাতা থেকে অনেক দূরে মায়ের ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত উশ্রী নদী, খান্ডুলিপাহাড় আর শালবনের জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। মনে হত, শুধু নিজেকেই নয়, যাঁরাই তাঁর গান শুনতেন, তাঁরাই তাৎক্ষণিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে চলে যেতেন মনে মনে।
শুনেছি, সামুকাকারা মস্ত জমিদার ছিলেন। কিন্তু দেশভাগের পর কলকাতায় এসে বেশ অসুবিধার মধ্যেই পড়েছিলেন। নইলে, আমাহেন অসুরকে সুরের জগতে হাতছানি দিতে তিনি আদৌ রাজি হতেন না। ওঁর নিজের গলাটা বা গায়কি যে খুব ভালো ছিল এমন আমার মনে পড়ে না। কিন্তু উনি খুব বড়ো জাতের শিল্পী ছিলেন। বড়ো গায়কদের মধ্যে কিছু মানুষকে দেখেছি পরবর্তী জীবনে, যাঁদের শিল্পীসত্তা বলে কিছু যে আছে একথা স্পষ্টভাবে তো দূরের কথা, অস্পষ্টভাবেও অনুভব করিনি। না তাঁদের বহিরঙ্গরূপে,না অন্তরঙ্গ রূপে। সে কারণেই সামুকাকার স্মৃতি মনে এখনও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
আমার জীবনের প্রথম গানের শিক্ষক বলেই নয়, সামুকাকাকে কোনোদিনও ভুলতে পারব না। নিশ্চয়ই এ জীবনে, অন্য একটি বিশেষ ঘটনার জন্যে।
এক রবিবার, সকালবেলা আমি বসে পড়াশোনা করছি, সামুকাকা হঠাৎ এলেন, সেই সময়ে, সেদিনে তাঁর আসার কথা ছিল না। তিনি আসতেন সপ্তাহের বিশেষ দিনে, সন্ধ্যেবেলায়। খুব আস্তে কথা বলতেন উনি। বাকি কথাটাকে উচ্চারণ করতেন বাঁকি। দেখাতে বলতেন, ঠাহর, আর কথায় কথায় বলতেন চিন্তা করো একবার। উত্তরবঙ্গের মানুষরা অনেকেই এই রকম বলে থাকেন।
খুব আস্তে আস্তে উনি বললেন, মা কোথায়? আমি ভিতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলাম।
মা চানে গেছেন।
দেরি হবে খুব?
আবার গেলাম।
ফিরে এসে বললাম, একটু।
সামুকাকা স্থির হয়ে সোফায় বসে রইলেন। ঘড়ি দেখলেন একবার। হলঘরের দেওয়ালে টাঙানো বাঘের-হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন শূন্যদৃষ্টিতে, সামান্য বিরক্তি মিশিয়ে।
চা খাবেন?
না। আজ, এখন নয়।
মা বাথরুমে গেলে বেশ সময় নিতেন। তারপর চান সেরে উঠে বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরতেন। কিউটিকুরা পাউডারের গন্ধ ছাপিয়ে উঠত চানের পরেই, পাটভাঙা শাড়ির গন্ধর সঙ্গে।
ওঁর সঙ্গে গান এবং অন্যান্য ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম আমি, কিন্তু সেদিন সব কথাই সামুকাকা এড়িয়ে গেলেন। মিনিট সাত-আট বসেই, উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎই।
বললেন, চলি। আমার একটু তাড়া ছিল। বুঝলে।
মাকে কি বলব কিছু?
বলবে? নাঃ। কী আর বলবে?
বাড়িতে ঠাকুমা আছেন। ডাকব? বাবা তো কলকাতায় নেই। তানুকাকাও নেই।
জানি। না না, ঠাকুমাকে আর ডাকবে কেন? সামুকাকা চলে যাবার মিনিট পাঁচেক পর মা এলেন। কোথায়? কোথায় গেলেন রে উনি?
উনি তো চলে গেলেন।
সে কি? আশ্চর্য মানুষ তো। হঠাৎ যখন এসেছিলেন এমন করে, নিশ্চয়ই জরুরি কথা ছিল কোনো। তুই বসালিনা কেন জোর করে?
বললেন যে, তাড়া আছে।
বাড়ি চিনিস?
আমি কী করে চিনব?
ড্রাইভারেরও তো অসুখ। ঠিকানা দিয়ে কাউকে পাঠালে হত। কী যে করি!
কী আর করবে? তেমন জরুরি কিছু হলে কি আর বসতেন না? এদিকে বোধ হয় কোনো কাজে এসেছিলেন।
জানি না।
মা বললেন।
পরের সপ্তাহে সামুকাকার সেদিন আসার কথা, সেদিন তিনি এলেন না। তার পরের সপ্তাহে এলেন, যেমন আসতেন সন্ধ্যেবেলায়। আমার ঘরের ফরাসে বসে উনি মুখ নীচু করে দিলরুবার কভারের বোতাম খুলছিলেন। সামনে তেপায়াতে জলখাবার আর চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল পাখার হাওয়াতে।
সেদিন কেন এসেছিলেন সামুকাকা? মা আপনাকে জিগগেস করতে বলেছেন। আপনিও চলে গেলেন, আর মা-ও বাথরুম থেকে বেরুলেন। মাকে কি ডাকব?
সামুকাকা, বোতাম খোলা বন্ধ রেখে উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরের নারকোল গাছগুলোর দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে, সামান্য কেশে হেসে বললেন। একটা ঘটনা…
ওঁর মুখে আশ্চর্য এক হাসি ঘাসের মতো লেগে রইল।
কি?
আমার স্ত্রী মারা গেলেন।
কখন? কবে?
ওই রবিবারই, যেদিন তোমাদের এখানে এসেছিলাম, সকাল আটটায়। কিছু টাকার দরকার ছিল। তাই…
আমি আর কথা না বলে এক দৌড়ে গিয়ে মাকে ডেকে আনলাম। মা তো শুনে কেঁদেই ফেললেন। মাকে আমি কখনো শব্দ করে কাঁদতে শুনিনি। চোখ দিয়ে জল গড়াত শুধু।
ছিঃ ছিঃ। আপনি তো ওকেও বলতে পারতেন।
সামুকাকা তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, দুর–মৃত্যুর মতো অমোঘ এবং তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য। আপনার চানের ব্যাঘাত করতে চাইনি বউদি! মৃত্যু আসেই, মানুষকে চানও করতে হয়। দুটোই অমোঘ ব্যাপার। সব হয়ে গেছে। ঠিকঠাক। কিছুই ঠেকে থাকেনি!
মা বললেন, ছিঃ ছিঃ কী যে করলেন আপনি।
বলেই, চলে গেলেন।
ফিরে এলেন খামভরতি টাকা নিয়ে।
সামুকাকা হাসলেন।
বললেন, টাকার দরকার তো ছিল তাঁরই। দোষ ছিল না। পার্টিশনের ধাক্কাটা সামলেই উঠতে পারলো না। একভাবে থেকে এসেছে ছোটোবেলা থেকে, আর এককেবারে হঠাৎই অন্যরকম। সকলে সব কিছু অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে না, বুঝলেন বউদি! ও পারেনি।
মা বললেন, এটা রাখুন। রাখুন। এই যে, শুনছেন।
দুর–বলে আবারও হাসলেন সামুকাকা।
মুখ ফিরিয়ে বললেন, সাহায্য, দান এসব নেওয়ার অভ্যাস নেই বউদি। লোককে চিরদিন তো দিয়েই এসেছি, লোকের জন্যে করেই এসেছি, নিইনি কারো কাছে থেকে কখনো। হয়তো শিগগিরই অভ্যেস করে ফেলতে পারব। কিন্তু এখনও সময় লাগবে।
মুখ নামিয়ে একটু চুপ করে থেকে বললেন, দুঃখ কষ্ট ওসব তাকেই বেজেছিল বেশি করে। সে চলে যাওয়াতে, আমার সব প্রয়োজনই আপাতত ফুরিয়ে গেছে।
একটু আবার চুপ করে থেকেই বললেন, ধরো, ধরো গান ধরো। গানের মতো জিনিস নেই। প্রাণ, মানুষের প্রাণ কত সহজে চলে যায়। এই তো! আমার হাতের মধ্যেই চলে গেল। কত বছরের। পার্টনার। গান কিন্তু থেকেই যায়। গানের প্রাণ অজেয়, অমর, আশ্চর্য। বউদি বসুন, বসুন। আজ আমরা সকলে একসঙ্গে গান গাই, গান শুনি।
চা-জলখাবার সবই তো ঠান্ডা হয়ে গেল।
মা বললেন, স্বগতোক্তির মতো।
মাকে খুব অপরাধী-অপরাধী দেখাচ্ছিল।
যাক। আপনি অর্গানে বসুন।
দিলরুবার নীলরঙা কভারটি মুখ নীচু করে খুলতে খুলতে সেই যে হেসেছিলেন সামুকাকা। সেই হাসিটির কথা এখনও মনে পড়ে বার বার। আজও সেই হাসির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারিনি। সেই হাসির মধ্যে বড়ো জ্বালা ছিল। অসহায়তা এবং হয়তো একটু ঘৃণাও!
সেই ঘৃণা কার প্রতি? তাঁর নিজের প্রতি? অথবা আমাদের প্রতিই কি? সেদিন বুঝিনি, খুবই ছোটো ছিলাম। আজও যে পুরো বুঝি এমনও নয়, কিন্তু মন বুঝি-বুঝি করে।
বড়োই লজ্জা পাই।