গর্ভগৃহে ধনভাণ্ডার
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো এক বনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সমুদ্রের ধারে ওদের জাহাজ নোঙর করে আছে। ফ্রান্সিসআরশাঙ্কো এসেছে যদি কারো সঙ্গে দেখা হয় তাহলে জেনে নেবে কোথায় এসেছে ওরা। কিন্তু প্রথমেই সব কথা জিজ্ঞেস করতে ভরসা পাচ্ছে না। কোনো কিছু না শুনেই যদি ওদের আক্রমণ করে তাহলে তো লড়াই অনিবার্য। নিজেরা তরোয়াল আনেনি। ফ্রান্সিস এসব ক্ষেত্রে লড়াইয়ের পক্ষপাতী নয়। সে ভাবছে আমাদের শুধু জানতে আসা আমরা কোথায় এলাম। লড়াই-টড়াইয়ের কোনো প্রশ্নই নেই।
দুদিন আগে এক রাতে প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে পড়েছিল ওরা। বহু কষ্টে স্রেফ মনের জোরে জাহাজডুবিরহাত থেকে বেঁচেছে। ফ্রান্সিসের শরীর এখনও দুর্বল।
বন শেষ। বেরিয়ে এল ওরা। দুটো বাড়ি দেখল। সেই পাথর, কাঠ, ঘাস দিয়ে তৈরি। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। তবে চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে।
–ফ্রান্সিস, এখন কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–বাড়ি চাই, খাদ্য চাই, পানীয় জল চাই, ফ্রান্সিস উত্তর দিল।
বাব্বাঃ, এত সব তোমাকে কে দেবে?
–দেয় দেয়, তেমন পবিত্র মানুষ পেলে তার কাছ থেকে সব পাওয়া যায়।
–দেখো, কপালে মেলে কিনা। শাঙ্কো হেসে বলল।
বনের কাছেই ওরা পেল দুটো তক্তা। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দেকা গেল তক্তা দুটো দিয়ে নিচের বড় গর্তা ঢাকা দেওয়া হয়েছে। দুজনে তক্তা দুটোর কাছে এল। শক্ত করে চেপে ধরে একটা তক্তা সরাল। অস্পষ্ট হলেও চাঁদের আলোয় এবার সিঁড়ি দেখা গেল। পাথরের সিঁড়ি।
ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো নামতে শুরু করল। নামতে নামতে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেল ওরা। এটা তাহলে মানুষের বসবাসের জন্যেই তৈরি হয়েছে। নামতে নামতে ওরা দেখল–বেশ বড় ঘর। পাথর কেটে ঘরটা তৈরি। ঘরের দু’পাশে দেয়ালের খাঁজে মশাল জ্বলছে। মশালের আলোয় সবকিছু মোেটামুটি দেখা যাচ্ছে।
ওরা দেখল এক প্রৌঢ় একটা পাথরের ছোট চাইয়ের ওপর বসে আছেন। এতক্ষণ বিড় বিড় করে কথা বলছিলেন। এবার কয়েকজন সৈন্য ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোকে ধরে প্রৌঢ়ের কাছে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা বাধা দেবার চেষ্টাও করেনি।
প্রৌঢ় ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, রাজা তুরীনের সৈন্য তোমরা। কিন্তু আমাদের রাজা পারকোনের সঙ্গে পারবে না। পারকোনকে তার প্রজারা দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে। বন্ধুর মতো ভালোবাসে। অ্যাইঅ্যাই-অ্যাই–বলতে বলতে প্রৌঢ় হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে উঠে দাঁড়ে বসে থাকা বাজপাখিটার মাথায় আঙুল চালিয়ে দিলেন। বাজপাখিটা পড়ে যেতে যেতে উঠে বসল। ফ্রান্সিস বাজপাখিটিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল। পাখনাররংখয়েরিসাদামিশেল। চোখ দুটো গোল গোল, কালো। যে জন্যে বাজপাখিটার কদর সেটা হচ্ছে ওর ঠোঁট। বঁড়শির মতো বাঁকানো। প্রৌঢ় বাজটাকে আদর করে ছেড়ে দিলেন। বাজপাখিটা আবার দাঁড়ে গিয়ে বসল। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে চেয়ে বললেন, আমাদের রাজা পারকোনের সঙ্গে রাজা তুরীনের লড়াই হবে। কবে হবে সেটা কারো জানা নেই। সেই লড়াই কালও হতে পারেবার একশো দিন পরেও হতে পারে।
ফ্রান্সিস একটু জোর দিয়ে বলল, আপনি আমাদের মিধ্যে সন্দেহ করছেন। আপনাদের এই ঘরে সৈন্যরা থাকে জানলে আসতাম না। তবে একটা কথা স্পষ্ট বলছি, আপনাদের এই কাটাকাটি-মারামারির মধ্যে আমরা নেই। তবে কেন আমাদের বন্দী করে রাখবেন।
–তাহলে তোমরা এখানে এসেছো কেন? প্রৌঢ় বললেন।
–এইকথা জানতে যে এই জায়গার নাম কী? য়ুরোপ থেকে কতদূর এই দেশ, শাঙ্কো বলল।
সেটা জেনে কী হবে? প্রৌঢ় বললেন।
তাহলে বুঝতে পারবো য়ুরোপ থেকে কত দূরে আমরা আছি। বুঝতে পারবো কবে নাগাদ দেশে পৌঁছোত পারবো।
–সে সব জেনে আর কী হবে? তোমরা তো এখান থেকে যেতে পারবে না। প্রৌঢ় বললেন।
–কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–কারণ মাটির নিচে এই ঘর-টরের কথা তোমরা জেনে ফেলেছে। এটা একটা দুর্গের মতো। এই দুর্গের কথা তোমরা জেনে ফেলেছ। তোমাদের আর বাইরে যেতে দেওয়া হবেনা।
–অর্থাৎ আমাদের এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ, তোমাদের এখন এখানেই বন্দী হয়ে থাকতে হবে। লড়াই শুরু হোক তখন তোমাদের কথা ভাবা যাবে, প্রৌঢ় বললেন।
শাঙ্কো চাপাস্বরে ওদের দেশীয় ভাষায় বলল, ফ্রান্সিস, আমরা বিপদে পড়লাম।
হু। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল, দেখুন, আমরা ভুল করে এখানে চলে এসেছি। আপনাদের রাজাটাজার কথা আমরা জানি না। ওসব জেনে কী হবে? ভুল করে এসে পড়েছি সেটা বুঝে আমাদের মুক্তি দিন।
না। তোমাদের যুদ্ধে জেতে হবে আমাদের হয়ে, মানে রাজা পারকোনের হয়ে লড়াই করতে হবে। তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবেনা।
–রাজা তুরীন আর রাজা পারকোন কবেযুদ্ধ শুরু করবেন, সেটা কে বলতে পারবে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
-কেউ বলতে পারবে না, প্রৌঢ় উত্তর দিলেন।
–তাহলে আমাদের স্বাধীন চলাফেরায় কেন বাধা দিচ্ছেন?।
কারণ আছে। তাহলে তোমাদের একটু ইতিহাস বলতে হয়। এই অঞ্চলে আমার বাবা-ঠাকুর্দা মন্ত্রী হয়ে রাজাকে রাজ্যশাসনে সাহায্য করে গেছেন। উত্তরাংশে বর্তমান রাজা তুরীনও তাদের পূর্বপুরুষরা রাজত্ব করে গেছেন। উত্তরাংশের সঙ্গে আমাদের দক্ষিণাংশের লড়াই প্রায়ই লেগে থাকে। আমার পিতা নির্বিবাদে থাকার জন্যে পাথর কেটে এই ঘর তৈরি করিয়েছিলেন। এখানেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আমিও বাস করতে লাগলাম। এই পাহাড়ের ওপাশে একটা বড় লম্বাটে ঘর বানালাম–পাথরের। ওখানে সৈন্যাবাস তৈরি করলাম। সৈন্য সংগ্রহ করতে লাগলাম। আমরা ধীরে ধীরে রাজা তুরীনের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। তাই আমরা সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি। তোমাদের মতো অভিজ্ঞ যুবকদের আমাদের সৈন্যদলে রাখতেই হবে। লড়াই শুরু হলে তোমরা আমাদের রাজা। পারকোনের হয়ে লড়াই করবে–এই জন্যেই তোমাদের চাই। কী রাজী? প্রৌঢ় বললেন।
যদি রাজী না থাকি? শাঙ্কো বলল।
–তাহলে নির্জলা উপোস করে থাকতে হবে। ফলে তোমাদের কী অবস্থা হবে বুঝতেই পারছো।
ফ্রান্সিস বুঝল সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ও বলল, আমরা একটু ভেবে দেখি। আসল কথা, সমুদ্রের তীরে আমাদের জাহাজ রয়েছে। সেই জাহাজে আছে আমার স্ত্রী ও বন্ধুরা। আমরা নাফিরলে ওদের দুশ্চিন্তা বাড়বে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রৌঢ় বললেন, আমি এখানকার রাজা পারকোনের মন্ত্রী। বয়েস হয়েছে। নিয়মিত রাজসভায় যেতে পারি না। যাকগে, দূত পাঠাচ্ছি। তোমরা যে খবর দিতে চাও তা বলে পাঠাও।
ফ্রান্সিস বলল–আমরা বিশেষ প্রয়োজন এদিকে এসেছি। আমাদের জাহাজে খাদ্য পানীয় জল ফুরিয়ে এসেছে। এখানে খাদ্য জল পাবোকিনা।
–হ্যাঁ, পাবে। আমাদের মজুদ থেকে দেয়া যাবে। কিন্তু এর জন্যে দাম লাগবে।
শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে কোমরের ফেট্টি থেকে দুটো স্ফমুদ্রা বের করে মন্ত্রীমশাইয়ের হাতে দিল। মন্ত্রী খুশী। বলল–তোমরা দুজন তো খাদ্য জল নিয়ে যেতে পারবে না।
–সেইজন্যেই আপনার দূতকে দিয়ে খবার পাঠাবো–বস্তা জলের পীপে নিয়ে যেন ছ’সাতজন বন্ধু আসে। খাদ্য, জল নিয়ে যেতে পারবে।
–সেই খবল পাঠাও। মন্ত্রী বলল।
মন্ত্রী হাতে মৃদু তালি দিলেন। একজন শুটকো চেহারার সৈন্য এগিয়ে এল। মন্ত্রী বললেন–ওকাজা এরা কী বলে শোন। সেইমত কাজ কর।
ফ্রান্সিস বলল–ভাই, তুমি সমুদ্রতীরে জাহাজঘাটায় যাও। সেখানে বেশ কটা জাহাজ নোঙর করা আছে। তার মধ্যে যে জাহাজে একটা সাদা পতাকা উড়ছে দেখবে সেটাই আমাদের জাহাজ। জাহাজে উঠেতুমি হ্যারির সঙ্গে দেখা করবে। বলবে যে আমরা এখানে খাদ্য ও জলের ব্যবস্থা করেছি। ওরা ছ’সাতজন যেন বস্তা, পীপে নিয়ে আসে।
-বেশ। ওকাজা বলল।
–তুমিই ওদের এখানে নিয়ে আসবে। তুমি কি এখনই যাবে?
–হ্যাঁ, খেয়েটেয়ে যাবো। ওকাজা বলল।
ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল। যাক–খাদ্য আর জলের একটা ব্যবস্থা করা গেল।
মন্ত্রী বললেন–ওকাজা–এদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাকর। ফ্রান্সিসদের বললেন– যাও–ওর সঙ্গে।
ঘরের পেছনে একটা ঝর্ণা। দুজনে বেশ অবাকইহল। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ। জল ঝরে পড়ছে। বেশ বড়ই ঝর্ণাটা। ফ্রান্সিস ভাবল এত জল পড়ছে কিন্তু যাচ্ছে কোথায়? দেখা গেল একটা ফাটলমত জায়গায় জল ঢুকে যাচ্ছে। অনেকেই স্নান করছে।
–স্নানটা সেরে নিলে হত না। শাঙ্কো বলল।
না। আগে বন্ধুরা আসুক। খাদ্য জল নিয়ে যাক। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান খাওয়া। ফ্রান্সিস বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্কোরা পীপে বস্তা নিয়ে এল। মন্ত্রীমশাই ওকাজাকে বললেন এদের প্রয়োজনমত খাদ্য দিয়ে দাও। ঝণা থেকে জল দাও।
ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে বিস্কোদের আসতে বলল। পেছনের দিকে একটা ঘরে নিয়ে এল। বস্তার পর বস্তা সাজানো। বোঝা গেল ভাঁড়ার ঘর। বিস্কোরা আটা ময়দা চিনি বস্তায় ঢেলে নিল।
আরো লাগলে নিতে পারেন। ওকাজা বলল।
-না না। পরে কোন বন্দরে খাবার যোগাড় করবো। বিস্কো বলল।
হ্যারি ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–কী ব্যাপার? তোমরা কী বন্দী?
-হ্যাঁ। যে কোন দিন যেকোন মুহূর্তে এদের লড়াই লাগতে পারে। এদের শত্রু এক রাজার সঙ্গে। আমাদের লড়াইতে নামিয়ে দেবার মতলব। আমরাও চুপ করে আছি। দেখি কী হয়। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–এখানে গুপ্তধন ভাণ্ডারের খোঁজ পেয়েছি। কাজেই থাকছি।
–বেশ। হ্যারি বলল।
বিস্কো হ্যারিরা খাদ্যজল নিয়ে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। হ্যারি ভাবল খুব সময়মত খাবারজল পাওয়া গেছে। এখন ফ্রান্সিসরা কবে নাগাদ মুক্তি পায় সেটাই চিন্তার।
ওকাজা ফ্রান্সিসদের কাছে এল। দুজনকে একটা ঘরে নিয়ে এল। কিছু যুবক শুয়ে বসে আছে। এরা যোদ্ধা। মেঝেয় মোটা কম্বল পাতা। ফ্রান্সিসরা বসল।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে নিজেদের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
–ফ্রান্সিস-শাঙ্কো ডাকল।
–বলো–ফ্রান্সিস বলল।
সব ব্যাপারেই বেশি ঔৎসুক ভালো না।
হ্যাঁ। এখন সেটা বুঝতে পারছি। বেশি জানতে গিয়ে এই ঝামেলায় পনলাম। নিচে নামাটা উচিত হয়নি।
শাঙ্কো বলল-শুনলাম, রাজা পারকোন প্রতি রোববার এখানে আসেন। তখন এই গর্ভগৃহে আর কেউ থাকতে পারেনা। রাজা আর একরাঁধুনি তাকে। সেই রাঁধুনিও রাতের খাবার তৈরি করে দিয়ে সন্ধ্যের আগেই এখান থেকে চলে যায়।
–তুমি এসব শুনেছো, না? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, এসব শোনা অব্দি আমার মনে একটা সম্ভাবনা জাগছে। রাজা পারকোনের এই আচরণের অর্থ কী?
-দেখ শাঙ্কো, সংসারে নানা মনোভাবের মানুষ থাকে। রাজা পারকোনও এরকম এক মানুষ। তিনি মাঝে মাঝে একা হতে ভালোবাসেন। ফ্রান্সিস বলল।
-ফ্রান্সিস, আমার কিন্তু একটা সন্দেহ হয়। শাঙ্কো বলল।
কী সেই সন্দেহ?
–নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো গুপ্ত ধনভাণ্ডারের ব্যাপার আছে।
–এ-বিষয়ে জেনেছে কিছু?
না, তবে মনে হয় মন্ত্রীমশাই এ সম্মন্ধে সব জানেন। এই ব্যাপারে কী বলেন?
চলো।
দুজনে মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে গেল। তখন মন্ত্রীমশাই পাথরের বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। শাঙ্কো আস্তে ডাকল, মন্ত্রীমশাই। মন্ত্রীমশাই সোজা উঠে বসলেন।
কী ব্যাপার? মন্ত্রী বললেন।
ফ্রান্সিস বলল, দেখুন একটা ব্যাপার আমরা শুনেছি।
কী শুনেছো? মন্ত্রী জানতে চাইলেন।
–শুনেছি রাজা পারকোনের পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার নাকি এখানেই কোথাও গোপনে রাখা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
হুঁ, তোমরা ঠিকই শুনেছো। রাজা পারকোনের পিতা অনেক চেষ্টা করেও তার হদিস পাননি।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে বলুন, আমি সেই ধনভাণ্ডারের হদিস বের করবো।
মন্ত্রী একটু অবাকই হলেন। তারপর বললেন, পারবে সেই ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে?
আমার কিছু জানা প্রয়োজন। আপনারা যদি সেসব আমাকে জানান তাহলে আমি পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে, বলছি সব। এই বলে মন্ত্রীমশাই পূর্বাপর ঐ এলাকার রাজাদের কথা সংক্ষেপে বললেন। সবশেষে যোগ করলেন, রাজা পারকোন আর রাজা তুরীন দুজনেরই ধারণা কোনো গর্ভগৃহে সেই ধনভাণ্ডার গোপনে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে সহজ হতো যদি রাজা পারকোনের পিতামহ পুত্রকে বলে যেতে পারতেন কোথায় গোপনে রাখা আছে সব ধনসম্পদ। কিন্তু তিনি তা বলে যাননি।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমি রাজা পারকোনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
–ঠিক আছে। তবে কাল রোববার। রাজামশাই একা এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটাবেন। এ সময় তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকেন।
-তাহলে তো গর্ভগৃহে কারো থাকা চলবে না। শাঙ্কো বলল।
পাহাড়ের ওপারে আরো একটা গৃহ আছে, সেখানে থাকতে হবে।
ফ্রান্সিস বলল, তাহলে যাচ্ছি। রাজা পারকোনকে আমার কথা বলবেন। দেখুন উনি রাজী হন কিনা।
নিশ্চয়ই রাজী হবেন। কত দেশ-বিদেশের লোককে তিনি নিয়ে এসে একানে রেখেছেন ঐ গুপ্ত ধনভাণ্ডারের উদ্ধারের জন্যে। কিন্তু কেউ পারেননি। অগত্যা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বললেন।
ফ্রান্সিস, শাঙ্কো নিজের জায়গায় ফিরে এল। শুয়ে পড়তে পড়তে শাঙ্কো বলল — ফ্রান্সিস কিছু সূত্রটুত্র পেলে?
–এই গর্ভগৃহেই আছে সেই গোপন ধনভাণ্ডার। ফ্রান্সিস উত্তর দিল।
–এটা ভাবছো কেন? শাঙ্কো প্রশ্ন করল।
রাজা পারকোন এই গর্ভগৃহে এসে থাকেন। অন্য কোনো গর্ভগৃহে যান না। কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–এই গর্ভগৃহেই ভালো লাগে থাকতে তাই। উত্তরেশাঙ্কো বলল।
–উঁহু, ব্যাপারটা শুধু ভালোলাগা নয়। হয়তো রাজা পারকোন সোনা-হীরে-মুক্তোর ভাণ্ডারের কিছুহদিস করতে পেরেছেন। এঅবস্থায় হয়তো আমাদের অনুমতি দেবেন না।
পরদিন অন্ধকার থাকতে থাকতেই সবাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেই গর্ভগৃহ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেল সবাই।
ভোরের দিকে রাজা পারকোন এলেন। গায়ে সাধারণ পোশাক। খাপেভরা তরোয়াল আনেননি। মাথায় মুকুট নেই।
গর্ভগৃহে নামবার পাথরের সিঁড়ির কাছে মন্ত্রীমশাই দাঁড়িয়েছিলেন। আস্তে আস্তে বললেন, এক বিদেশী ভাইকিংকে পেয়েছি। ও বলছে, গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবে। রাজা চমকে মন্ত্রীর দিকে তাকালেন। হাতের ইশারায় জানালেন নিয়ে আসতে। রাজা নিচে নেমে গেলেন। ফ্রান্সিসরা কাছেই ছিল। মন্ত্রীমশাই বললেন, দেরি করো না। চলো।
ফ্রান্সিস একা মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। দেখল রাজামশাই মন্ত্রীর আসনে বসে আছেন। সামনে পাথরের টেবিলে কালির দোয়াত আর কলম।
ফ্রান্সিসও মন্ত্রী ঐ টেবিলের কাছে এল। রাজামশাই কাগজটা এগিয়ে দিলেন। রাজামশাই কাগজে লিখলেন, তুমি সব ঘটনা জানো?
–হ্যাঁ, মোটামুটি জানি। ফ্রান্সিস মুখে বলল।
তোমার নাম কী? রাজা লিখলেন।
–ফ্রান্সিস।
গুপ্তধন খোঁজখুঁজির জন্যে তোমার যা প্রয়োজন পড়বে মন্ত্রীমশাই সেসবের ব্যবস্থা করবেন। তারপর লিখলেন–গুপ্তধন তুমি যদি উদ্ধার করতে পারো সে সবকিছুই আমার, তুমি কিছুই পাবে না।
ফ্রান্সিস পড়ে মৃদু হেসে বলল, তাই হবে।
রাজা লিখলেন সন্দেহ নেই বেশ কষ্ট করে তোমাকে গুপ্তধন উদ্ধার করতে হবে। তার বদলে তুমি কিছুই চাও না?
না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
ঠিক আছে। আগে তো উদ্ধার হোক তারপর দেখা যাবে। যাও। কাজ শুরু কর। রাজা লিখলেন।
মন্ত্রী আর ফ্রান্সিস ওপরে উঠে এল। শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল, ফ্রান্সিস, কী কথা হলো?
উনি রাজী হয়েছেন। মন্ত্রীমশাই সব ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবেন।
মন্ত্রী বললেন, এখানে আপনারা বসুন। আপনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। মন্ত্রী। চলে গেলেন।
কিছু পরে এক সৈন্য ওদের জন্যে সকালের খাবার নিয়ে এল। একটা পাথরের চাইয়ের গায়ে ওরা বসল। খাবার খেতে লাগল। সৈন্যটি দাঁড়িয়ে ছিল। খাওয়া শেষ হতে বলল, আপনারা আসুন। আপনাদের জন্যে একটা ছোট ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দুজনে ঐ সৈন্যটির পেছনে পেছনে চলল। ছোট পাহাড়টার পরেই আর একটা গর্ভগৃহ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওরা একটা ছোট ঘরের সামনে এল। সৈন্যটি বলল, এই ঘরে আপনারা দুজন থাকবেন। কোনো কিছুর দরকার হলে আমাদের বলবেন। সৈন্যটি চলে গেল।
রাত শেষ হলো। রাজা পারকোনের মৌনব্রত শেষ হলো। তিনি রাজবাড়িতে ফিরে গেলেন। ফ্রান্সিসরা আবার গর্ভগৃহে ফিরে এল।
এইবার ফ্রান্সিস কাজে নামল। শাঙ্কোকে নিয়ে রাজবাড়ি থেকে শুরু করে সব গর্ভগৃহেই গেল। একাগ্র দৃষ্টিতে সম্ভাব্য সব জায়গাগুলি দেখতে লাগল। পাথুরে দেয়াল। ঘরগুলো প্রায় একইরকম। সব গর্ভগৃহ। একই রীতি মেনে তৈরি। ফ্রান্সিস বসেছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, শাঙ্কো, চলো মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে।
দুজনে মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে এল। মন্ত্রী কাগজেকী লিখছিলেন। বললেন, আবারআমার কাছে কেন?
–সন্দেহ না মিটলে আপনার কাছেই বারবার আসতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো কী ব্যাপার? মন্ত্রীমশাই জানতে চাইলেন।
–আচ্ছা, এই গৰ্ভগৃহগুলো কি একই সময়ে একইসঙ্গে তৈরি হয়েছিল? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।
–এটা তো বলা সম্ভব নয়। তবে রাজা পারকোন এবিষয়ে কিছু বলতে পারবেন।
–কোন গর্ভগৃহটা সবচেয়ে পুরোনো? ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।
–সেটাও বলতে পারবো না। মন্ত্রী বললেন।
–রাজা পারকোন? ফ্রান্সিস বলল।
–হয়তো তার কিছু ধারণা আছে।
–আমি রাজার সঙ্গে দেখা করবো। একটু ব্যবস্থা করুন। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। আমি কিছুক্ষণ পরেই রাজসভায় যাচ্ছি। তুমিও চলো।
ফ্রান্সিসরা মন্ত্রীর সঙ্গে যখন রাজসভায় এল তখন বেশ বেলা হয়েছে। মন্ত্রী নিজের আসনের দিকে চলে গেলেন। ফ্রান্সিসরা সভার কাজ দেখতে লাগল। রাজা বিচার করছেন।
একসময় সভা শেষ হলো। প্রতিহারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকজন সামলাতে। রাজা উঠবেন সিংহাসন থেকে। মন্ত্রী এগিয়ে গিয়ে রাজাকে কিছু বললেন। রাজা আবার বসে পড়লেন। একজন প্রতিহারী এসে ফ্রান্সিসদের ডেকে নিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা একটু মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়াল। রাজা বললেন, কোনো বিষয়ে কিছু জানতে চাও?
–আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি।
-কী সমস্যা।
–আপনার পিতামহের নির্দেশে কবেকটা গর্ভগৃহ তৈরি হয়েছিল?
রাজা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, যে গর্ভগৃহে আমি রবিবার যাই সেই গর্ভগৃহটি আমার প্রপিতামহের আমলে নির্মিত।
অন্য গর্ভগৃহগুলো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
পরে আমার পিতামহঅন্য গর্ভগৃহগুলো তৈরি করেছিলেন।
তবে মান্যবর রাজা, বোঝা যাচ্ছে যে ঐ গর্ভগৃহটাই প্রথম তৈরি হয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
আমরাও তাই মনে হয়। রাজা বললেন।
মান্যবর রাজা, এই থেকে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আপনার প্রপিতামহই সব ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারপর থেকে আপনার পিতামহ, আপনার পিতা সকলেই ঐ গুপ্তধন খুঁজেছেন কিন্তু কেউ সন্ধান পাননি।
রাজা একটু থেমে বললেন, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করি। তোমার অনুমান মনে হয় ঠিক।
এবার আমাদের কাজটা অনেক সহজ হলো। ফ্রান্সিস বলল।
কী করে? রাজা জানতে চাইলেন।
এবার শুধু আপনার প্রপিতামহের তৈরি গর্ভগৃহটাই ভালো করে দেখতে হবে। অন্য গর্ভগৃহগুলো পরবর্তীকালের।
–কথাটা ঠিক বলেছো। এই সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই তুমি এগিয়ে চল।
রাজা কাঠের সিংহাসন ছেড়ে উঠলেন। ফ্রান্সিসরাও সম্মান দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল।
প্রায় মাসখানেক সময় ধরে শোনা যাচ্ছিল যে যে কোনোদিন রাজা তুরীন রাজা পারকোনের রাজ্য আক্রমণ করতে পারেন। সবশেষে সেটাই ঘটল।
সেদিন বিকেল থেকেই আকাশ প্রায় অন্ধকার মেঘে ঢাকা। সন্ধ্যের মুখে জোর হাওয়া ছুটল। ফ্রান্সিসরা প্রথম তৈরি গর্ভগৃহে ছিল। বাইরের প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝার আভাসও ওরা পায়নি।
হঠাৎ ফ্রান্সিসরা দেখল সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে চার-পাঁচজন সৈন্য নেমে এল। চিৎকার করে বলল, সবাই তৈরিহও। রাজাতুরীন আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে। চলে এসো সব।
সৈন্যদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। ওরা দ্রুতপায়ে ছুটল অস্ত্রাগারের দিকে। পোশাকের দিকে তাকাবার সময় নেই। তরোয়াল হাতে ওরা দলে দলে বেরিয়ে এল। ওরা সবাই উঠে গেলে প্রৌঢ় মন্ত্রী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। ফ্রান্সিসরা ছুটে তার কাছে গেল। মন্ত্রী বললেন, সবাই যাও। প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে।
ফ্রান্সিসরা বুঝে উঠতে পারল না কী করবে? দুজনে মন্ত্রীমশাইয়ের বিছানার কাছে এল। মন্ত্রী তখনও অল্প অল্প হাঁপাচ্ছেন। তিনি আধশোয়া হয়ে আছেন। ফ্রান্সিস বলল, রাজা তুরীন কি বেশি সংখ্যায় সৈন্য এনেছেন?
–ঠিক বুঝতে পারলাম না। ঐ অন্ধকারের মধ্যে কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। বিদ্যুৎ চমকাতে যা দেখেছি। কিন্তু তোমরা লড়াইতে নামলে না কেন?
মন্ত্রীমশাই, কিছু মনে করবেন না। আপনাদের দুই দেশই আমাদের কাছে বিদেশ। আপনাদের লড়াই আপনাদের। সমস্যার সমাধান আপনারাই করবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–কথাটা ঠিক। কিন্তু বিপদের দিনে রাজা পারকোনের হয়ে লড়াইতে নামলে রাজা খুশি হতেন।
ওপরে যাচ্ছি। অবস্থা দেখে সব বুঝে নিই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস সিঁড়ির দিকে চলল। সিঁড়ির মুখের কাছে দুজন সৈন্য তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে। আছে। ওরা বলে উঠল, উঠবেন না, উঠবেন না, জোর লড়াই চলছে।
–আমরা লড়াই দেখবো। শাঙ্কো বলল।
–খালি হাতে থাকবেন না। তরোয়াল আনুন। সৈন্যরা বলল।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকাল। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে দুটো তরোয়াল নিয়ে এলো। এবার দুজনে ওপরে উঠে এল। তেমন বৃষ্টি আর নেই। তবে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
বিদ্যুতের সেই হঠাৎ আলোতেই দেখা যাচ্ছে দু’দল সৈন্যের মধ্যে প্রবল লড়াই চলছে। ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো, রাজা পারকোন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। গুপ্তধন উদ্ধারের কাজে যাতে আমাদের কোনো অসুবিধে না হয় তা দেখার জন্য মন্ত্রীকে আদেশ দিয়েছেন। মন্ত্রী বললেন, এমন সৎ ও ঈশ্বরভক্ত রাজা দেখা যায় না।
–হ্যাঁ, তাঁকে আমাদের সাহায্য করা খুবই প্রয়োজন। শাঙ্কো উত্তর দিল।
–তাহলে চলো রাজা তুরীনকে বন্দী করি।
–চলো।
ফ্রান্সিসরা রাজা তুরীনকে খুঁজতে লাগল। দু’পক্ষের সৈন্যরা গোবরভেজা। ফ্রান্সিস রাজা তুরীনের একজন সৈন্যকে পেল। সে তাকে বলল, রাজা তুরীন কোথায় আছেন? সৈন্যটি রেগে গেল। বলল, তুমি বিদেশি, তুমি কেন আমাদের রাজাকে খুঁজছো?
–প্রয়োজন আছে। এই লড়াই থামাতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি পারবে না।
–দেখা যাক, তুমি শুধু বলল রাজা তুরীন কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–চলো৷ নিয়ে যাচ্ছি। সৈন্যটি বলল।
অন্ধকারের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি লড়াই চলছে। তার মধ্যে দিয়ে সৈন্যটি ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা একটা ঝাকড়া-মাথা গাছের কাছে এল। সৈন্যটি ইঙ্গি তে গাছের নিচে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা একজন মধ্যবয়সীকে দেখাল। রাজা তুরীন বেশ অসহায়ভাবে বসে আছেন। মাথার কঁচাপাকা চুল নাকমুখ পর্যন্ত ছুড়য়ে আছে। পোশাক সব ভিজে, বাঁ হাতে বৃষ্টিভেজা রক্তের দাগ।
তখন লড়াই থেমে গেছে। চিৎকার আর তরোয়ালে-তরোয়ালে ঠোকাঠুকি ধাতব শব্দ বন্ধ।
রাজা তুরীনের চারপাশে রাজা পারকোনের চার-পাঁচজন সৈন্য খোলা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস রাজা তুরীনের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, মাননীয় রাজা, আপনারও রাজা পারকেনের মধ্যে লড়াই চলছে শুধু একটা বিষয় নিয়ে–কে পাবে অতীতের এক রাজার গুপ্তধন।
রাজা তুরীন একটু অবাক হয়ে বিদেশি যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফ্রান্সিস বলতে।
লাগল, কিন্তু গুপ্তধন গুপ্তই থেকে গেছে, অন্তত এখন পর্যন্ত। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল, মাননীয় রাজা তুরীন, আমার বিনীত অনুরোধ যুদ্ধের কথা ভুলে যান। পরাজিত হলেও আপনার কথার মূল্য আমার কাছে কম নয়। আজকে আপনি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। তাড়াতাড়ি খেয়ে আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল রাজা পারকোনের রাজসভায় আপনাকে যেতে হবে। আমরাই নিয়ে যাবো।
-কী আর বলবো সেখানে গিয়ে! রাজা তুরীন অসহায়ভাবে বললেন।
–আপনাকে কিছুই বলতে হবেনা। শুধু আমার কাজটায় সম্মতি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি। কথাটা বলে রাজা তুরীন হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ফ্রান্সিস শান্তভাবে বলল, মান্যবর রাজা, দুঃখ করবেন না। আমি আপনাকে আপনার রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবো। আপনি শান্ত হোন।
রাতে একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া-দাওয়া সারল সবাই। রাজাতুরীনকে শুকনো পোশাক দেওয়া হলো। শোবার জায়গাও করে দেওয়া হলো।
পরদিন বেশ ভভরে ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। ও আর শুয়ে রইল না। উঠে মন্ত্রীর কাছে এল। মন্ত্রী উঠে বসেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল, মন্ত্রীমশাই, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
–কী কাজ?
রাজসভায় রাজা তুরীনকে বসাবার ব্যবস্থা করবেন।
রাজা তুরীন হয়তো রাজসভায় যেতেই চাইবেনা।
–সেটা আমি দেখবো। আপনি শুধু সম্মান জানিয়ে তাকে বসতে দেবেন।
–এখন রাজা পারকোনকে বলা। অবশ্য আমিও বলবো।
ফ্রান্সিস রাজা তুরীনের কাছে এল। রাজা তুরীন অল্প জায়গার মধ্যেই পায়চারি করছিলেন। মাথা নিচু, দু’হাত পেছনে জড়িয়ে পায়চারি করছিলেন। চোখের নিচে কালি। মাথার চুল অবিন্যস্ত। ফ্রান্সিস সামনে এসে দাঁড়াল। রাজা তুরীনও দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভারী গলায় বললেন, কী ব্যাপার? কারাগারে নিয়ে যাবে?
-না না, সেসব কিছুনা। একটু থেমে বলল, মান্যবর রাজা, আমি বিদেশি ভাইকিং। কখন আসি কখন যাই। আপনাকে একটা বিনীত অনুরোধ।
–হুঁ। রাজা মুখে শব্দ করলেন।
দু’তিন পুরুষ আগে একজন রাজা, আপনাদের পূর্বপুরুষদের একজন, পারিবারিক হীরেমুক্তো সোনার ভাণ্ডার গোপনে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আপনার আর রাজা পারকোনের শত্রুতা কমেনি। এই ভাবে দুটো পরিবারের মধ্যে মাঝে মাঝেই লড়াই দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। ঐ গুপ্ত ধনভাণ্ডার কে পাবে? ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি এত কিছু জানলে কী করে? তুরীন বললেন।
—রাজা পারকোনের মন্ত্রীর কাছ থেকে। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, এবার আমার অনুরোধ, আপনি আজ রাজা পারকোনের রাজসভায় আসুন। আপনাদের বিবাদ-বিসম্বাদ আমি মিটিয়ে দিতে চাই।
–পারবে? মৃদু হেসে রাজা তুরীন বলেন।
–আপনারা দুজনে আমার প্রস্তাব সম্মত হলেই পারবো। তাহলে সকালের খাওয়া সেরেই আমরা যাবো?
রাজা তুরীন কিছু বললেন না।
ফ্রান্সিস আর মন্ত্রীর চেষ্টায় রাজা তুরীন রাজসভায় এলেন। মন্ত্রী তাকে এক অমাত্যের আসনে বসালেন। এসময় ফ্রান্সিস রাজা পারকোনের কাছে বলল–মাননীয় রাজা, এবার আমি কিছু কথা বলতে চাই।
–বেশ বলো। রাজা পারকোন বললেন। ফ্রান্সিস রাজা তুরীনকে একই কথা বলতে রাজা তুরীন সম্মতি জানান।
ফ্রান্সিস রাজসভায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, মান্যবর রাজা, অতীতের ইতিহাঁসআপনারা জানেন। আমি সেসব কথায় যাবোনা। দুই রাজাকেঅনুরোধ করছি আপনারা ধনসম্পদের লোভেদীর্ঘকাল ধরে লড়াই চালিয়ে যাবেন না। আমার বিনীত অনুরোধ আপনারা শত্রুতা ভুলে যান। যে ধনসম্পদ নিয়ে এই লড়াই সেই গুপ্তধন এখনও কেউ উদ্ধার করতে। পারেনি। কিন্তু আমি পারবো।
দুই রাজা ভীষণভাবে চমকে উঠলেন, এই যুবকটি বলে কি!
–কত বছর ধরে খোঁজ চলছে। কেউ পারেনি, তুমি পারবে? তুরীন বললেন।
–আমাকে দিন সাতেক সময় দিন, আমি তার মধ্যেই পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলতে লাগল, আপনারা আর পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন না। মাননীয় রাজা পারকোন, রাজা তুরীনকে তার সৈন্যসহ মুক্তি দিন।
–বেশ। পারকোন বললেন।
ফ্রান্সিস বলল, এইবার প্রশ্ন ঐ ধনসম্পত্তি কার? কে পাবে ঐ ধনসম্পদ?
–আমার। রাজা তুরীন বেশ চড়া গলাতেই বললেন।
–আমার। রাজা পারকোন বললেন।
ফ্রান্সিস বলল না, কারো একার নয়। ঐ ধনসম্পদ দুভাগে ভাগ করে দুজনকে দেওয়া হবে।
-না। সব চাই আমি। রাজা পারকোন বলে উঠলেন।
–ভাগ করা চলবে না, সবটাই আমার। রাজা তুরীন বলে উঠলেন।
–তাহলে, ফ্রান্সিস বেশ গলা চড়িয়েই বলল, তাহলে আমি সেই গোপন সম্পদ আর খুঁজবো না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনাদের সমস্যা আপনারাই মেটান।
ফ্রান্সিস রাজসভার মঞ্চ থেকে নেমে আসছে তখনই শাঙ্কো এসে ফ্রান্সিসকে থামাল। রাজাদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, এর নাম ফ্রান্সিস। আমার প্রাণের বন্ধু। ফ্রান্সিস এর আগে অনেক গুপ্তধন খুঁজে বের করেছে। ও যখন বলছে এই গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে পারবে তখন জানবেন এটা ফাঁকা কথা নয়। গুপ্তধন উদ্ধারের এই চেষ্টাই শেষ চেষ্টা। আপনারা ওর সাহায্য নিন।
–বুঝলাম, কিন্তু সেসব দু’ভাগ হবে কেন। রাজা পারফোন বললেন।
–এটাও মেনে নিন। নইলে ঐ ধনসম্পত্তি গুপ্তই থাকবে। আর কেউ উদ্ধার করতে পারবেনা। ভেবে দেখুন। শাঙ্কো বলল।
রাজসভায় নৈঃশব্দ্য। সবাইরাজারদিকেতাকিয়ে। হঠাইরাজাতুরীন বললেন, এইসমস্যাটা দুই রাজ্যের মধ্যে চলে আসছেদীর্ঘকাল। যাকগে, আমি অর্ধেক পেলেই সন্তুষ্ট থাকবো।
ফ্রান্সিস রাজা পারকোনের দিকে তাকাল। পারকোন মন্ত্রীকে ডেকে কী বললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমিও অর্ধেক চাই। সভাঘরে সকলেই আনন্দপ্রকাশকরল।
রাজা তুরীন ও রাজা পারকোনের মধ্যে শত্রুতা মিটে গেল। ওই দুদেশের প্রজারা খুশি হল। যুদ্ধের পরিবেশ কারোই ভালো লাগছিল না। সবাই শান্তি চাইছিল।
রাজা তুরীন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন। দুদেশের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হল এইজন্যে একদিন উৎসব হল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকেও উৎসবে যেতে অনুমতি দেওয়া হল।
প্রাকৃতিক খেয়ালেই গড়ে ওঠা একটা বিরাট পাথরের বেদীমত। বোঝা গেল এই পাথরের চাতালেই উৎসব-টুৎসব হয়। চারপাশে দর্শকরা বসেছে। চাতাল ঘিরে বড় বড় প্রদীপজ্বালা হয়েছে। তাতে বেশ আলোকিত হয়েছে বেদী। প্রথমে মন্ত্রীমশাই বেদীতে উঠে এলেন। ভাঙা গলায় যতটা জোরেসম্ভব বললেন–দেশবাসীরা–আজকে আমাদের খুব আনন্দের দিন। আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। তার চেয়েও বড় কথা রাজা তুরীনের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়েছে। আমরা এখন পরস্পরের বন্ধু। এই উপলক্ষে আজকের এই আনন্দ সন্ধ্যা। একটু থেমে মন্ত্রী বললেন–আপনারা আনন্দ উপভোগ করুন।
মন্ত্রীমশাই বেদী থেকে নেমে গেলেন।
একদল সুসজ্জিত পুরুষ এল। বাজনদাররা বাজনা বাজাতে লাগল। হাতের রুমাল নেড়ে নেড়ে বাজনার তালে তালে ওরা নাচতে লাগল। নাচ বেশ জমে উঠল।
এরপর এল একদল মেয়ে। তারা সুরেলা গলায় গান গাইতে গাইতে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। নাচ জমে উঠল। দর্শকরা জোর গলায় উৎসাহ দিতে লাগল। নাচ শেষ হল।
এবার এল বেঢপ পোশাক পরা একটি হোঁৎকা পুরুষ। হেঁড়ে গলায় সে কি গান। শ্রোতারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তারপর আরো কিছুক্ষণ নাচগান হল। উৎসব শেষ। শ্রোতা দর্শকরা বাড়ি ফিরে চলল। ফ্রান্সিসরাও ফিরে এল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ওকাজাফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–মাননীয় রাজা আপনাদের ডেকেছেন।
-কেন বল তো?
–কী করে বলব। আপনারা চলুন। ওকাজা বলল।
–বেশ চলো।
ফ্রান্সিস, শাঙ্কো তৈরি হয়ে রাজার গর্ভগৃহের দিকে চলল।
এই গর্ভগৃহ মোটামুটি সুসজ্জিত মশালের বদলে মোটা পলতের প্রদীপ জ্বলছে। পাথরের আসনে গদীপাতা। তাতে রাজা পারকোন বসে আছেন।
ফ্রান্সিসরা মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে দাঁড়াল।
–তোমরা বিদেশি–রাজা বললেন–এ দেশের সঙ্গে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আজ আমি বিপদগ্রস্ত। আমাদের পশ্চিমে একটি রাজ্য আছে–জামিনা–সেই রাজ্যের রাজা কাদর্জা একনৃশংস রাজা। আমার রাজ্যের ওপর তার বড় লোভ। কী করে আমার রাজ্য দখল করা যায় এই তার চিন্তা। অবশ্য আর একটা লোভও আছে। আমার পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত গুপ্তধন। সে এই গুপ্তধন উদ্ধারের চেষ্টা করবে।
জানিনা রাজা কাদর্জা কতটা বুদ্ধিমান। গুপ্তধন উদ্ধার বেশ জটিল ব্যাপার। ফ্রান্সিস বলল।
উদ্ধার করতে পারুক না পারুক চেষ্টা তো করবে। এটাই কাদর্জার উদ্দেশ্য। রাজা পারকোন বললেন।
–বোঝাই যাচ্ছে কাদর্জা লড়াই চায়। আপনি আক্রান্ত হলে লড়াইই করুন। ফ্রান্সিস বলল।
–আক্রান্ত হলে লড়াই তো করতেই হবে। সেক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য চাই। যদিও এ দেশ তোমাদের নয় তবু আমার অনুরোধ যুদ্ধ হলে আমাদের হয়ে তোমরা লড়াই কর। রাজা পারকোন বললেন।
নিশ্চয়ই করবো। অবশ্য তার আগে বন্ধুদের সম্মতিটা নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই নেবে। রাজা বললেন।
কাদর্জা কবে আক্রমণ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–যেকোন দিন। কাদর্জা বিদেশ থেকে সৈন্য আমদানি করছে। সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র এনেছে। তাতেই সন্দেহ যেকোন দিন আক্রমণ করতে পারে। রাজা বললেন।
রাজা কাদর্জা সম্মন্ধে কিছু জানতে চাই। কী ধরনের মানুষ। কতটা বুদ্ধি ধরে। গুপ্তধনের লোভকতটা। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা পারকোন ওকাজাকে দেখিয়ে বললেন–ওকাজার জামিনাতেই জন্ম। ওকাজা রাজা কাদর্জা সম্বন্ধে অনেক কিছুজানে। ওর সঙ্গে কথা বলুন সব জানতে পারবেন।
ফ্রান্সিস ওকাজার দিকে তাকাল। বলল–ভাই তুমি একটু আমাদের সঙ্গে এসো। আমরা রাজা কাদর্জা ও তার দেশ জামিনা সম্মন্ধে জানতে চাই। এসো।
ফ্রান্সিস রাজা পারকোনকে সম্মান জানিয়ে চলে এল। নিজেদের ঘরে এসে বসল। ফ্রাসিস বলল–ওকাজা এবার বলতো রাজা কাদর্জা ও ঐ দেশ জামিন সম্মন্ধে।
ওকাজা আস্তে আস্তে বলতে লাগল রাজা কাদর্জার মত নৃশংস মানুষের নরকেও ঠাই হবেনা। জামিনার প্রজারা রাজা কাদর্জাকেঘৃণার চোখে দেখে। মুখে তো কিছু বলতে পারে না। জামিনায় চলছে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব। রাজার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার উপায়। নেই। গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজ্যময়। রাজার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে গুপ্তচর। টুটি চেপে ধরছে। সৈন্যাবাসের কাছেই কয়েদখানা। সঙ্গে সঙ্গে কয়েদখানায় ঢুকিয়ে দেবে। কাদর্জারকয়েদখানা সবসময়ই ভর্তি। নরকেআরএকনামকাদর্জারকয়েদখানা। একবার ঐকয়েদখানায় ঢুকলে একমাত্র মরলেই বেরিয়ে আসা যায়। নইলে নয়। ঐ কয়েদখানায় দশ-বারো বছরের ছেলেরাও রয়েছে। রাস্তায় হয়তো খেলাচ্ছলে কাদর্জার নিন্দে করেছে। প্রহরীরা ওদের ধরে নিয়ে গেছে। জামিনাতে এই অবস্থাই চলছে।
একটু থেমে ওকাজা বলল–একটা ঘটনা শুনুন। রাজা কাদর্জাকে হত্যার চেষ্টা চলেছে। বছরকয়েক। একবার রাজা কাদর্জা পাহাড়ি এলাকার জনবসতি দেখেটেখে নেমে আসছে– কোত্থেকে একটা বর্শা উড়ে এল। লাগল রাজার ডানবাহুতে। রাজা বসে পড়ল। প্রহরীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। ধারে কাছের লোকজন পালিয়ে গেল। দুর্ভাগ্য যে যুবকটি বর্শা ছুঁড়েছিল সে প্রহরীদের হাতে ধরা পড়ল। ওখানেই প্রহরীদের হাতে মারাত্মক মার খেল। কিন্তু যুবকটি কাঁদল না।
রাজাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হল। রাজার চিকিৎসা শুরু হল।
পরদিন রাজার হুকুমে ঐ পাহাড়ি জনবসতির ওপর রাজার দেড়শ দু’শ সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। নির্বিচারে মানুষ মরতে লাগল। শিশুনারীও বাদ গেল না। তাতেও হল না। বাড়িগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। সব বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
ওকাজা থামল। তারপর বলল কাদর্জার নৃশংসতার কত ঘটনা বলবো।
–সেই যুবকটির কী হল? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।
যুবকটিকে কয়েদ ঘরে আটকে রাখা হল। দুদিন না খাইয়ে এমনকি জল পর্যন্ত খেতে না দিয়ে ফাঁসি দেওয়া হল রাজবাড়ির সামনে। অনেক প্রজা ভিড় করে দেখতে এসেছিল। অনেকেই কেঁদেছে। যুবকটি কিন্তু বিন্দুমাত্র কষ্ট প্রকাশ করেনি। আমি অবাক হয়ে যুবকটির দিকে তাকিয়েছিলাম।
কাদর্জার আর এক শাস্তির নমুনা পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলা। আর একটি নদীর জলে চুবিয়ে মারা। দেশবাসী ক্ষেপে আগুন হয়ে রয়েছে। কিন্তু নিরুপায়।
–ঐ নৃশংস অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে দেশবাসীরুখে দাঁড়াতে পারছেনা? ফ্রান্সিস বলল।
ওকাজা বলল-অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ দল বাঁধে। জামিনাতেই দল বাঁধা হয়েছে। তবে এখনও বেশিদিন হয়নি। তবে সেই দল প্রজাদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। দল বাড়ছে। একদিন তারা বিদ্রোহ করবেই। ওকাজা বলল।
–এই তো কাজের কথা। ফ্রান্সিস বলল কাপুরুষের মতো পড়ে পড়ে মার খাওয়া কোন কাজের কথা নয়।
ওকাজা উঠেদাঁড়াল। বলল–চলি।
–পরে হয়তো তোমার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাকে ডাকলেই আমি আসবো৷ওকাজা বলল।
–তুমি যে বিদ্রোহের কর্তা বললে তার কি প্রস্তুতি চলছে?
–হ্যাঁ। অত্যন্ত গোপনে বিদ্রোহী নেতা পারেলার দল তৈরি হচ্ছে। আমিও সেই দলে আছি। মাঝে মাঝে জামিনায় যাই। বিদ্রোহীদের সাহায্য করি। নানাভাবে। পারেলা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও পারেলার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। একদিন বিদ্রোহ হবেই। নৃশংস কাদর্জার সন্ত্রাসের রাজত্ব শেষ হবে। জামিনায় নতুন যুগের সূচনা হবে। ওকাজা বলল।
–তাই যেন হয়। ফ্রান্সিস বলল।
ওকাজা বলল জানেন–পারেলার দলের দশজনকে কাদর্জা ফাঁসি দিয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহীদের দমাতে পারেনি। ওকাজা চলে গেল।
রাজা পারকোনের আশঙ্কা সত্য হল।
একদিন রাজা পারকোন গুপ্তচর মারফৎ সংবাদ পেল রাজা কাদর্জা তার দেশ আক্রমণ করতে আসছে। দু’একদিন মধ্যেই কাদর্জার সৈন্যবাহিনী পৌঁছে যাবে।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–সামনেই লড়াই। বন্ধুদের নিয়ে আসতে হয়।
–আমিই যাবো। কিন্তু মন্ত্রীকে বলে যেতে হবে। ওঁর অনুমতি দরকার। শাঙ্কো বলল।
–বেশ তো বলে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো মন্ত্রীর কাছে গেল। মন্ত্রী চুপচাপ পাথরের আসনে বসেছিলেন।
মাননীয় মন্ত্রীমশাই–শুনেছেন বোধহয় রাজা কাদর্জা এই দেশ আক্রমণ করতে আসছে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ শুনেছি। সামনে বড় দুর্দিন। মন্ত্রী বললেন।
–একটা কথা বলছিলাম। শাঙ্কো বলল।
–বল–মন্ত্রী বলল।
–এই লড়াইয়ে আমার ভাইকিং বন্ধুরাও অংশ নেবে। রাজা পারকোনের হয়ে তারা লড়বে। ফ্রান্সিস বলল।
-খুব ভালো কথা। মন্ত্রী বললেন।
–সমুদ্রতীরে জাহাজঘাট আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। জাহাজে বন্ধুরা আছে। তাদের মধ্যে থেকে দশ-বারোজনকে নিয়ে আসতে হবে। আপনি অনুমতি
—-হ্যাঁ। যাও। বন্ধুদের নিয়ে এসো। আমাদের জিততেই হবে। মন্ত্রী বললেন।
দুপুরে খেয়েদেয়ে শাঙ্কো সমুদ্রতীরের দিকে রওনা হল। যখন জাহাজে পৌঁছল তখন বিকেল। শাঙ্কোকে দেখে বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠল। ছুটে শাঙ্কোর কাছে এল। ওদের জিজ্ঞাসা ফ্রান্সিস ভালো আছে তো? মারিয়াও এল শাঙ্কো বলল-রাজকুমারী–কোনরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। ফ্রান্সিস সুস্থসবল আছে। তারপরশাঙ্কো পারকোনের রাজত্বে লড়াইয়ের কথা বলল। বলল–ফ্রান্সিসের সিদ্ধান্ত আমরাও লড়াইয়ে অংশ নেব। লড়াইয়ের কথা শুনে ভাইকিংরা খুশি হল। কর্মহীন অবস্থায় জাহাজে থাকা ওদের ভালো লাগছিল না।
–বেশি না। দশ বারোজন তৈরি হয়ে আমার সঙ্গে চলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুরা– তৈরি হল। জাহাজ থেকে নেমে এল। প্রত্যেকেই তরোয়াল নিল। সবাই চলল রাজা পারকোনের রাজত্বের দিকে। সন্ধ্যে নাগাদ সবাই সেখানে পৌঁছল।
বন্ধুরা ফ্রান্সিসদের সঙ্গেই রইল।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হল। তখন রাজা পারকোন এলেন। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। পারকোন বললেন–বসো বসো। সবাই বসল। পারকোন বলনেল খবর পেয়েছি কাল সকালেই রাজা কাদর্জা আমাদের রাজ্য আক্রমণ করবে। তোমরা বীরের জাতি। তোমাদের সাহায্য আমাদের অবশ্য প্রয়োজন। অনুরোধ তোমরা আমাদের হয়ে লড়াই করো।
–আমরা লড়াই করবো। ফ্রান্সিস বলল–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
–তোমাদের সাফল্য কামনা করি। রাজা পারকোন বললেন। তারপর চলে গেলেন।
পরদিন সকালেই সারা রাজ্য জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। রাজা পারকোনের, সৈন্যরা অস্ত্র হাতে ছুটে এল। রাজার গর্ভগৃহের সম্মুখে বিরাট প্রান্তর। সব সৈন্য সেখানে জড়ো হল। কিছু পরে দূরে দেখা গেল কাদর্জার সৈন্যবাহিনী আসছে। একেবারে সামনে একটা কালো ঘোড়ায় চড়ে রাজা কাদর্জা।
রাজা পারকোনের সৈন্যদের দেখে চিৎকার করতে করতে কাদর্জার সৈন্যরা ছুটে আসতে লাগল। রাজা পারকোনের সৈন্যরাও ছুটে গেল।
লড়াই শুরু হল। চিৎকারে আর্তনাদে তরোয়ালে তরোয়ালে ঠোকাঠুকির শব্দে প্রান্তর ভরে উঠল।
একপাশে ফ্রান্সিসরা লড়াই চালাল। যোদ্ধা হিসেবে ভাইকিংরা যে কম যায় না কিছুক্ষণ লড়ে কাদর্জার সৈন্যরা বুঝতে পারল।
চারজন সৈন্য ফ্রান্সিসকে ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস বিদ্যুৎগতিতে তরোয়াল চালাতে লাগল। বুকে গলায় তরোয়াল চালিয়ে ফ্রান্সিস দুজনকে মেরে ফেলল। বাকি দুজন লড়তে লাগল। ফ্রান্সিস হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে একজনের তরোয়ালে ঘা মারল। সৈন্যটির হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। সৈন্যটি হতভম্ভ হয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ও তরোয়াল খুঁজতে চলে গেল। অন্যটির বুকের কাছে তরোয়াল চালিয়ে জামা কেটে দিল। সৈন্যটি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস হঠাৎ দ্রুত শুয়ে পড়ল। গড়িয়ে গিয়ে সৈন্যটির পায়ে তরোয়ালের ঘা মারল। সৈন্যটির পা কেটে গেল। ও পা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল।
ভাইকিং বন্ধুরাও জোর লড়াই চালাল। চিৎকার গোঙানি আর্তনাদে প্রান্তর ভরে উঠল।
রাজা কাদর্জা ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তার সৈন্যদের উৎসাহ দিতে লাগল।
রাজা পারকোন শান্তস্বভাবের মানুষ। যুদ্ধবিগ্রহ মোটেই পছন্দ করেন না। যুদ্ধক্ষেত্রের এক কোণে এক গাছের নিচে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। যুদ্ধ চলল।
বেশ কয়েকঘণ্টা পরে যুদ্ধের জয়পরাজয়ের আভাস পাওয়া গেল। রাজা পারকোনের সৈন্যদের সংখ্যা কমে গেল। আহত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেল। কাদর্জার সৈন্যরা উল্লাসে চিৎকার করতে লাগল। সন্ধ্যের সময় পারকোনের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। রাজা পারকোন তাদের ফেরাবার চেষ্টা করলেন না। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন তাদের ফেরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা ফিরলো না।
যুদ্ধের ফলাফল এখন স্পষ্ট। রাজা পারকোনের জয়ের কোন আশাই রইলো না। কাদর্জার সৈন্যরা ভোলা তরোয়াল হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরতে লাগল। পারকোনের আহত সৈন্যদের হত্যা করতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। এই নিষ্ঠুরতা দেখে ওর মন বিচলিত হল। এরা কি মানুষ? কিন্তু নিরুপায়। ওরা পরাজিত।
ফ্রান্সিসদের বন্ধুরা একত্রিত হল। একদল কাদর্জার সৈন্য ওদের ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিসদের চেহারা-পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝল ওরা বিদেশী। ওদের যত রাগ পড়ল ফ্রান্সিসদের। ওপর। দড়ি দিয়ে ফ্রান্সিসদের হাত বেঁধে ফেলল। দুজন আহত ভাইকিং কোনরকমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল। তিনজন মারা গেল।
রাজা কাদর্জার সেনাপতিতখনই ওখানেএল। ফ্রান্সিসদের বন্দী দেখে খুশি হল। বলল ভালো করেছিস। এরা আমাদের অনেক সৈন্যকে মেরেছে। সন্দেহ নেই ভালো লড়িয়ে।
ফ্রান্সিস বলল–একটা কথা বলছিলাম।
-বলো। সেনাপতি বলল।
–আমাদের তিন বন্ধু মারা গেছে। আমরা তাদের কবর দিতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
কবরটবর দেওয়া চলবে না। আমরা সব মৃতদেহ পাহাড়ের গহ্বরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকাল। সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু উপায় কি। এই নির্মমতা মেনে নিতেই হবে।
সেনাপতি একটা ছোট্ট গর্ভগৃহে ফ্রান্সিসদের বন্দী করে রাখল। ফ্রান্সিসরা প্রায় জড়াজড়ি করে শুয়ে রইল। ওদিকে রাজা পারকোনের সভাঘরের পাথরের সিংহাসনে রাজা কাদর্জা বসল। হা হা করে হাসতে হাসতে একজন অমাত্যকে বলল–যান পরাজিত রাজা পারকোনকে নিয়ে আসুন। অমাত্য চলে গেল।
কিছু পরে রাজা পারকোনকে নিয়ে এল। কাদর্জা হেসে বলল–আরে–এখনও আপনার হাত বাঁধা হয়নি। প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে বলল–এ্যাই হাত বেঁধে দে। একজন প্রহরী দড়ি এনে রাজা পারকোনের দুহাত বেঁধে দিল।
–আমার সঙ্গে লড়তে এসেছিলেন। আপনার দুঃসাহস। ফল দেখলেন তো? আমাকে যুদ্ধে হারায় এই অঞ্চলে কেউ নেই। কাদর্জা বলল।
পারকোন কোন কথা বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এবার আসল কথায় আসি–রাজা কাদর্জা বলল–আপনার কোন পূর্বপুরুষ আপনাদের ধনসম্পদ এখানকার কোন গর্ভগৃহে গোপনে রেখে গেছে। সেই ধনসম্পদ আমার চাই। এবার বলুন কোথায় আছে সেই ধনভাণ্ডার। কাদর্জা গলা চড়িয়ে বলল।
–আমি জানি না। রাজা পারকোন মৃদুস্বরে বললেন।
–জোরে বলুন। কাদর্জা চেঁচিয়ে বলল।
–আমি জানি না। পারকোন জোরে বললেন।
বাজে কথা আপনি জানেন। আমি লড়াই করতে আসছি শুনে সেই ধনভাণ্ডার বাইরে বের করেন নি। এবার বলুন কোথায় সেই ধনভাণ্ডার? কাদর্জা বলল।
-আমি কিছু জানি না। পারকোন বললেন।
–এ্যাই–চাবুকওয়ালাকে ডাক। কাদর্জা চিৎকার করে বলল।
একপাশ থেকে কালো পোশাক পরা একজন লোক চাবুক হাতে এগিয়ে এল।
–মার চাবুক। চাবুকের মারনা খেলে মুখ খুলবেনা। কাদর্জা বলল।
লোকটি পারকোনের পিঠ লক্ষ্য করে চাবুক চালাল। বাতাসে শশ শব্দ উঠল। পারকোনের শরীর কেঁপে উঠল।
মার চাবুক। কাদর্জা চেঁচিয়ে বলল। আবার চাবুকের মার নেমে এল। রাজা পারকোনের পিঠের দিকে জামা ছিঁড়ে গেল। কালশিটে দাগ ফুটে উঠল।
এবার বলুন। কোথায় সেই গুপ্তধনভাণ্ডার? কাদর্জা বলল।
–আমি জানি না। রাজা পারকোন একই স্বরে বললেন।
–আপনি জানেন। পাছে আমি জেনে ফেলি তাই কোন কথাই বলছেন না। ঠিক আছে। আজকে থাক। সারারাত ভাবুন। কালকে আবার চাবুক মারা হবে। কাদর্জা বলল।
রাজা পারকোনের মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। হাত তুলে বললেন–মাননীয় রাজা কাদর্জা– রাজা পারকোনকে এভাবে চাবুক মেরে কোন লাভ নেই। কারণ উনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। যদি জানতেন তাহলে কি এতদিনে উদ্ধার করতেন না?
-ঠিক আছে। আমার সেনাপতিকে আমি এ দেশের রাজা করে দিয়ে যাবো। সে গুপ্ত ধনভাণ্ডারের খোঁজ করবে। উদ্ধার হলে সমস্ত ধনভাণ্ডার আমার হবে। আর কোন দাবিদার থাকবেনা। কাদর্জা বলল।
–ঠিক আছে। এটা আপনি করতে পারেন। মন্ত্রী বললেন।
–আপনি কে? মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রাজা কাদর্জা বলল।
–আমি রাজা পারকোনের মন্ত্রী। মন্ত্রী বললেন।
-দেখছি আপনাকে বন্দী করা হয় নি। কাদর্জা বলল।
আমার মত বৃদ্ধকে বন্দী করে কী লাভ? আমি ছুটোছুটিও করতে পারবো না, তরোয়াল হাতে লড়তেও পারবোনা! আমি বড়জোর বুদ্ধি দিতে পারি। প্রয়োজনে পরামর্শ দিতে পারি। মন্ত্রী বললেন।
যাক গে–আপনাকেআর বন্দী করা হবেনা। আমার সেনাপতি এখানে নতুন রাজা হবে। আপনি তার পরামর্শদাতা হয়ে থাকবেন। বদলে ভালো মাইনে পাবেন। কাদর্জা বলল।
আপনাকে ধন্যবাদ। মন্ত্রী বললেন।
ফ্রান্সিস যে ঘরে বন্দী হয়ে ছিল রাজা পারকোনকে সেই ঘরেই ঢোকানো হল। পারকোন ঘাসপাতা ছড়ানো মেঝেয় শুয়ে পড়লেন। রাজার শরীরের দশা দেখে ফ্রান্সিসরা চমকে উঠল। কী নির্মমভাবে চাবুক মারা হয়েছে। রাজা কিন্তু গোঙাচ্ছেন না।
ফ্রান্সিস রাজার কাছে গেল। আস্তে আসতে বলল,
মাননীয় রাজা–খুব কষ্ট হচ্ছে?
রাজা শুকনো ঠোঁটে হাসলেন। নিম্নস্বরে বললেন–চাবুক খেয়ে কষ্ট হবে না?
–আপনাকে চাবুক মারা হল কেন? হ্যারি জানতে চাইল।
–রাজা কাদর্জার ধারণা আমি আমার পূর্বপুরুষদের ধনসম্পত্তির হদিশ জানি। যাতে আমি হদিশ বলে দিই তাই নির্মমভাবে চাবুক মারা। রাজা পারকোন বললেন।
ফ্রান্সিসদের দলে ভেন ছিল না। ভেন থাকলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত।
শাঙ্কো জালায় রাখা জল থেকে কাঠের গ্লাশে এক গ্লাশ জল নিয়ে এল। রাজার পিঠে কালশিটে দাগের ওপরআস্তে আস্তে জল বুলিয়ে দিতে লাগল। রাজা একটু নড়ে উঠেস্থির হলেন। চুপ করে শুয়ে রইলেন।
শুধু যুদ্ধে জয়লাভ করেই রাজা কাদর্জা সন্তুষ্ট রইল না। সে লুঠ করা শুরু করল। সে চারপাঁচজন অনুচর নিয়ে গর্ভগৃহগুলো অধিবাসীদের সোনা, হীরে, মুক্তো, দামি পাথর লুঠ করতে শুরু করল। কেউ বাধা দিতে সাহস পেল না। অবাধ লুঠ চলল। রাজা কাদর্জা খুব # খুশি। অনেক মণিমুক্তো দামি গয়না পেল।
কাদর্জা দেশে ফিরে যাবার জন্যে তৈরী হল। রাজা পারকোনের সভাঘর সেনাপতিকে রাজা করার জন্যে আয়োজন চলল। রাজার দুত এদেশীয়দের মধ্যে প্রচার করল রাজা। পারকোনের রাজার সভাগৃহে আসার জন্যে।
রাজসভাগৃহে ভালোই লোক হল। এদেশীয়রা তো ছিলই কাদর্জার সৈন্যরাও সারি দিয়ে দাঁড়াল।
রাজসিংহাসনের কাছে রাজা কাদর্জা দাঁড়াল। সেনাপতি নিচে থেকে উঠে এল। রাজা কাদর্জা তরোয়াল খুলে সেনাপতির দুই কাঁধ ছোঁয়াল। হাত বাড়িয়ে সিংহাসন দেখাল। সেনাপতি আস্তে আস্তে গিয়ে সিংহাসনে বসল। সেনাপতি ঐ দেশের রাজা হয়ে গেল। উপস্থিত সৈন্যরা হৈ হৈ করে আনন্দ প্রকাশ করল। এদেশীয়রা মুখে কোন শব্দ করল না। আস্তে আস্তে রাজসভা ছেড়ে চলে গেল।
এবার ফেরার পালা। রাজা কাদর্জার হুকুমে রাজা পারকোন আর ফ্রান্সিসদের পেছনে রাখা হল। তাদের আগে পিছে সৈন্যরা একেবার সামনে কালো ঘোড়ার ওপরে কাদর্জা।
তখন সকাল। রোদ্দুরের তেমন তেজ নেই। আকাশ মেঘলা। শোভাযাত্রা চলল জামিনার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল।
কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? হ্যারি বলল।
–হয়তো আমাদের বিচারটিচার হবে। তারপর শাস্তি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের অপরাধ? শাঙ্কো বলল।
–রাজা পারকোনের হয়ে লড়েছি। কাজেই আমাদের সহজে ছেড়ে দেবে না। আমাদের জীবন সংশয়। ফ্রান্সিস বলল।
শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল। কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা। যুদ্ধ জয় করে ফিরছে। রাজা কাদর্জা মাঝে মাঝেই তরোয়াল উঁচিয়ে হা হা করে হাসছে।
হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই শোভাযাত্রা চলল। সবাই ভিজে একশা। কাদর্জাও বাদ গেল না। কাদর্জা নড়লও না। ঠায় বসে রইল।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শোভাযাত্রা জামিনাতে ঢুকল। সদর রাস্তার ধারে ধারে লোকজন জড় হল ঠিকই। কিন্তু কোথাও কোন আনন্দ উচ্ছ্বাস নেই। কাদর্জা বেশ ক্রুদ্ধ হল। দেশজয় করে ফেরার পরেও প্রজাদের মধ্যে আনন্দ উল্লাস নেই। কিন্তু উপায়ও তো নেই। কিছু করারও নেই। শোভাযাত্রা রাজবাড়ির সামনে এসে শেষ হল।
লোকজন ফ্রান্সিসদের দেখে বেশ অবাকই হল। এরা কারা? এদের বন্দী করে আনা হয়েছে কেন? রাজা ঘোড়া থেকে নেমে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়ল। সৈন্যরা সৈন্যাবাসের দিকে চলল। প্রহরীদের দলপতি ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। সৈন্যদের থেকে ফ্রান্সিসদের আলাদা করল। ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল রাজবাড়ির পূর্ব কোণারদিকে। বোধহয় ওদিকেই কয়েদ ঘর।
ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরের সামনে নিয়ে আসা হল। ঠং-ঠং শব্দে লোহার দরজা খোলা হল। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস আবার কয়েদ ঘরের জীবন। জীবনের বেশ কিছুটা সময় কয়েদ ঘরেই কেটে গেল।
–ঠিকই বলেছে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
কয়েদ ঘরে ঢুকল ফ্রান্সিসরা। বেশ বড় ঘর। বন্দীদের সংখ্যাও অনেক। হতেই হবে। রাজা কাদর্জার রাজত্বে এটা অস্বাভাবিক কিছুনয়। কারো মুখে রাজার নিন্দা শুনলে সৈন্যরা ধরে এনে কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দেয়। কাজেই বন্দীর সংখ্যা বেশি হবে এটা স্বাভাবিক।
ফ্রান্সিস দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। হ্যারি পাশে বসল।
শাঙ্কো দরজার কাছে গেল। প্রহরীদের ডেকে বলল–ভাই ঘরেই তো আটকে আছি। তবে আর হাত বাঁধা থাকে কেন? হাত খুলে দাও।
দলপতি যদি চায় তবেই তোমাদের হাত ভোলা হবে। প্রহরী বলল।
–দলপতির সঙ্গে কথা বলবো। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। বলছি। প্রহরী বলল।
একটু পরেই দলপতি এল। দলপতির মুখে দাড়ি গোঁফ। বেশদীর্ঘদেহী। বলিষ্ঠ। বলল– কী ব্যাপার?
বলছিলাম পুরোনো বন্দীদের তো হাত খোলা। তবে আমাদেরও হাত খোলা থোক। ঘরেই তো আটকা আছি তবে আর হাত বাঁধা থেকে কী হবে। শাঙ্কো বলল।
দলপতি কিছুক্ষশ শাঙ্কোরমুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল–বেশ। তোমাদের বাঁধা হাত খুলে দেওয়া হচ্ছে। খোলা হাতপা নিয়ে যে ক’টা দিন বাঁচার বাঁচো।
–ঠিক বুঝলাম না। শাঙ্কো বলল।
–তোমাদের বাঁচার কোন আশা নেই। রাজা কাদর্জা বেশ কিছুদিন ফাঁসিটাসি দেখেন না। তোমাদের ফাঁসিতে লটকিয়ে সেই দৃশ্য দেখবেন। লোকের কষ্ট যন্ত্রণা মৃত্যু দেখলে রাজা কাদর্জা খুব খুশি হল। ওসব উপভোগ করেন। দলপতি বলল।
শাঙ্কো বুঝল ওদের রেহাই নেই। রাজা কাদর্জা নিশ্চয়ই ওদের ফাঁসি দেবে। বলল– আমরা তো বিদেশী আমাদের বাঁচামরা নিয়ে রাজা অত ভাবছে কেন?
–তোমরা রাজা পারকোনের হয়ে লড়াই করেছে। কাজেই তোমাদের শাস্তি পেতে হবে। দলপতি বলল।
–তাই বলে ফাঁসি? শাঙ্কো বলল।
–এতে তো কষ্ট কম। রাজা অপরাধীকে কষ্ট দিয়ে মারেন। তোমরা কষ্টকর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলে। দলপতি বলল।
–হুঁ। শাঙ্কো মুখে শব্দ করল।
একজন প্রহরী একটা ছোরা হাতে ঘরে ঢুকল। একে একে ফ্রান্সিসদের হাতবাঁধা দড়ি কেটে দিল। ফ্রান্সিসদের কষ্টটা কমল। বাঁধা হাতের অস্বস্তি থেকে বাঁচা গেল।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। ডাকল–ফ্রান্সিস?
–বলল। ফ্রান্সিস বলল।
–একটা কথা বলছিলাম। শাঙ্কো বলল।
কী কথা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–রাজা পারকোনের হয়ে লড়াই করাটা বোধহয় আমাদের উচিত হয়নি। শাঙ্কো বলল।
–এ কথা বলছো কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–দলপতি বলছিল আমাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। কারণ রাজা পারকোনের হয়ে আমরা লড়াই করেছি। শাঙ্কো বলল।
আমাদের ফাঁসি হবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। দলপতি তাই বলল। শাঙ্কো বলল।
–রাজা পারকোনের হয়ে লড়াই করে আমরা কোনো ভুল করি নি। রাজা পারকোন একজন প্রজাবৎসল সৎ রাজা। আমরা তার জয় চেয়েছি। হেরে গেছি সেটা আলাদা। কথা। ফ্রান্সিস বলল,
–ফাঁসির হাত থেকে তো বাঁচার কোনো উপায় নেই। শাঙ্কো বলল।
–সেটা দেখতে হবে।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল–রাজা পারকোনকে দেখে এলাম। খুবই কাহিল হয়ে পড়েছেন গায়ে বেশ জ্বর। অজ্ঞান-টজ্ঞান না হয়ে যায়।
ঠিক তাই ঘটল। রাজা পারকোন জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হ্যারি ফ্রান্সিসকে। বলল–তার চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। নইলে মারা যাবেন। শাঙ্কো ছুটে গেল রাজার কাছে। কাঠের গ্লাশে জল নিয়ে রাজার মাথায় ঢালল। কপালে জল বুলিয়ে দিতে লাগল।
ফ্রান্সিস উঠে লোহার দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে বলল–তোমাদের দলনেতাকে ডাকো।
–পারবো না। প্রহরী বলল।
–ভাই রাজা পারকোন জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তার এক্ষুনি চিকিৎসার প্রয়োজন। ফ্রান্সিস নরম সুরে বলল–নইলে মানুষটা মারা যাবে।
দলনেতা আসবে না। প্রহরী বলল।
–তোমাকে আমি ভাই বলে বলছি। দলনেতাকে আসতে খবর দাও। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি পারবো না। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে। কাছে এসে দেখো। ফ্রান্সিস বলল।
প্রহরী দরজার কাছে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। হাতের নাগালের কাছে আসতেই ফ্রান্সিস দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওর গলা চেপে ধরল। প্রহরী তরোয়াল তুলতে গেল। ফ্রান্সিস তার আগেই লোহার দরজায় ওর মাথা ঠুকে দিল। প্রহরী ওমাগো বলে চিৎকার করে উঠল। প্রহরীরা সব ছুটে এল।
শাঙ্কোরাও উঠে এসে দরজার কাছে ভিড় করল। প্রহরীরা তরোয়াল চালাবার আগেই ফ্রান্সিস প্রহরীকে ছেড়ে দিল। বলল–এবার যাও। দলনেতাকে ডেকে আনন। প্রহরীটির কপাল থেকে রক্ত বেরিয়ে এল। ও কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। শাঙ্কো চেঁচিয়ে– বলল–শিগগির দলনেতাকে ডেকে আনো। ভাইকিংরা একসঙ্গে ধ্বনি তুলল-ও হো-হো। প্রহরীরা ঘাবড়ে গেল।
এখানকার গোলমাল শুনল দলনেতা। সে প্রায় ছুটে এলো। বলতে লাগল কী ব্যাপার? এত গোলমাল কীসের?
ফ্রান্সিস বলল-রাজা পারকোন জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এক্ষুনি বৈদ্যকে ডেকে নিয়ে আসুন।
দলনেতা বলল–চাবুকেরমার খেয়েছে তো। সহ্য করতে পারেনি। যাক গে–রাজাকে বলছি। উনি অনুমতি দিলে বৈদ্যকে ডাকা হবে।
হ্যারি বলল–একজন মানুষ এত সাংঘাতিক অসুস্থ তার চিকিৎসার জন্য রাজার অনুমতি লাগবে? অবাক কাণ্ড।
–এই জামিনায় রাজার অনুমতি ছাড়া কিছু হবার উপায় নেই। যাক গে–আমি দেখছি। দলপতি চলে গেল।
শাঙ্কো নিজের পোশাক ছিঁড়ে জলে ভিজিয়ে রাজার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল। রাজা তখনও জ্ঞান ফিরে পান নি।
কিছুক্ষণ পরে দলনেতা বৈদ্যকে নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল–যাক রাজা কাদর্জা তাহলে চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছে।
বৈদ্যের মাথা ঢাকা সাদা কাপড়ের টুপি মত। দাড়ি গোঁফ ইয়া মোটা গলায় নানা রঙের পাথরের মালা। গায়ে টকটকে লাল রঙের জামা। কাঁধে ঝোলা।
দরজা খোলা হল। প্রহরীরা দরজার দুপাশে খোলা তরোয়াল নিয়ে দাঁড়াল। বৈদ্য আর দলনেতা ঘরে ঢুকল। বৈদ্য রাজার কাছে গেল। বসল। কাঁধের ঝোলা নামাল। রাজার চোখের পাতা খুলে দেখল। কপালে গলায় হাত বোলাল। রাজার ঠোঁট ফাঁক করে দেখল দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
বৈদ্য এবার ঝোলা থেকে মাটির মুখ ঢাকা ভড় বের করল। সেটা থেকে দুটো বড়ি বের করল। তারপর রাজার দুই নাকের ফুটোতে চেপে ধরল। বড়ি দুটোয় নিশ্চয়ই কোন গন্ধ আছে। গন্ধ নাক দিয়ে মাথায় গেল।
কিছুপরে রাজার শরীরটা নড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজা চোখ মেলে তাকালেন। শূন্য দৃষ্টি। কিছু নির্দিষ্টভাবে দেখছেন বলে ফ্রান্সিসদের মনে হল না। বৈদ্য নাক থেকে বড়ি দুটো সরিয়ে নিল।
আবার ঝোলা থেকে একটা কাপড়ের পুটুলি বের করল। পুটুলি থেকে দুটো কালো বড়ি বের করল। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল-খাইয়ে দাও।
হ্যারি কাঠের গ্লাসে জল এনে দিল। শাঙ্কো ওর ঊরুর ওপর রাজার মাথাটা শুইয়ে দিল। এতে মাথাটা উঁচু হল। শাঙ্কো এবার গলা চড়িয়ে বলল–মাননীয় রাজা, মুখ খুলুন। বড়ি দুটো খেয়ে নিন। রাজার ততক্ষণে শরীরের সাড় ফিরেছে। আস্তে আস্তে মুখ খুললেন। শাঙ্কো বড়ি দুটো খাইয়ে দিল।
এবার ফ্রান্সিস রাজাকে তুলে বসাল। বৈদ্যকে রাজার পিঠ দেখাল। কালসিটে দাগ আর জায়গায় জায়গায় কালচে রক্ত জমে আছে। বৈদ্য দলনেতার দিকে তাকাল। দলনেতা বলল–চাবুক মারা হয়েছিল। ওষুধ দিন।
বৈদ্য ঝোলা থেকে একটা চিনেমাটির বোয়াম বের করল। মুখ খুলে বৈদ্য সবজে রঙের আঠালো কিছু বের করল। ওষুধটা রাজার পিঠে ঠেকাতেই রাজার সারা শরীর কেঁপে উঠল। বৈদ্য আস্তে আস্তে ওষুধটা কালসিটের ওপর লাগিয়ে দিল। রাজার বোধহয় একটু স্বস্তি পেলেন। চুপ করে বসে রইলেন।
বৈদ্য পোটলা ভড় ঝোলায় ভরল। শুধু ঝোলা থেকে ওষুধটা একটা ছোট্ট ভড়ে ভরে দিয়ে শাঙ্কোকে দিল। বলল–রাতে কালকে লাগিয়ে দিও। চিন্তার কিছু নেই। সেরে যাবে।
বৈদ্য চলে গেল। দলপতি গলা চড়িয়ে বলল,
–চিকিৎসার ব্যবস্থা তোতা হল। এবার চ্যাঁচামেচি বন্ধ কর।
ফ্রান্সিসরা কেউ কিছু বলল না। ফ্রান্সিসদের চিন্তা এইসব ওষুধে রাজা পারকোন সুস্থ হবেন তো? তারপরেই ভাবল কয়েকদিনের মধ্যেই তো ফাঁসি মৃত্যু। সুস্থ হওয়া না হওয়া সমান।
ফ্রান্সিসদের মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েদঘর থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় পালাতে গেলে। আরো কিছু বন্ধু মারা যাবে। ফাঁসির হাত থেকে বাঁচার উপায় ভাবতে হবে। দুহাত বাঁধা থাকবে। দৌড়ে পালানো যাবে না। গভীরভাবে উপায় ভাবতে হবে। ফ্রান্সিস ঘাসপাতার বিছানায় শুয়ে পড়ল।
শাঙ্কো তখনই এল। বলল–রাজা পারকোন কি বাঁচবে?
–দেখা যাক। ওষুধ তো পড়েছে। এর বেশি এখানে আমরা আর কী করতে পারি। এখন তো আমাদের ভেন নেই। ফ্রান্সিস বলল।
ওদিকে রাজা কাদর্জা খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ফ্রান্সিসদের ফাঁসির ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। রাজবাড়ির সামনে একটা ছোট্ট প্রান্তর। তারপরেই বড় বড় গাছগাছালির বন। তারই কাছে ফাঁসিকাঠের মঞ্চ তৈরি হতে লাগল।
প্রহরীরা নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে কথাবার্তা বলে। তাই থেকে ফ্রান্সিসরা ফাঁসির মঞ্চের কথা জানতে পারল।
ফ্রান্সিসদের মন প্রায় ভেঙে গেল। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই চুপ। একটাই চিন্তা ওদের আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই নেই। নীরবতা ভেঙে এক বন্ধু বলে উঠল– আমরা রাজা পারকোনের হয়ে লড়তে গিয়ে ভুল করেছি। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠল।
–কোন ভুল করি নি। এক সৎ প্রজাবৎসল রাজার হয়ে লড়াই করেছি। দুর্ভাগ্য হেরে গেছি। কিন্তু এরকম একজন নৃশংস রাজার পাল্লায় পড়বো স্বপ্নেও ভাবিনি। রাজা কাদর্জা আমাদের ফাঁসি দেবে এতটা ভাবতে পারিনি। কথাগুলো বলে ফ্রান্সিস হাঁপাতে লাগল। হ্যারি বলে উঠল–ফ্রান্সিস একটা প্রশংসনীয় মানবিক কাজ করেছে। তার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। আমি রাজা কাদর্জার কাছে যাচ্ছি। ওরকম একটা রাজার কাছে প্রার্থনা করা অপমানজনক। কিন্তু আমি প্রার্থনা করব। বলবো-আমাকে ফাঁসি দিন। কারণ আমার নির্দেশেই আমার বন্ধুরা লড়তে এসেছিল। এজন্য আমিই দায়ী। আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। বন্ধুদের মুক্তি দিন।
–রাজা কাদর্জার মত লোক এই প্রার্থনা শুনবে না। বন্ধুদের মুক্তি দিতে রাজি হবে না। শাঙ্কো বলল।
–একবার বলে তো দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। দরজায় শব্দ করল। একজন প্রহরী এগিয়ে এল। বলল কী ব্যাপার?
দলপতিকে খবর দাও একজন বন্দী কথা বলবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আবার তোমরা ঝামেলা পাকাচ্ছো। প্রহরী বলল।
–আমার অনুরোধ দলপতিকে আসতে বল। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। এই শেষবার। দলপতিকে আর ডাকতে বলবে না। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দলপতি এল। কয়েদঘরের দরজার কাছে এসে বলল–আবার কী হল? ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে বলল–আমার একটা অনুরোধ ছিল।
কী অনুরোধ? দলপতি বলল।
রাজা কাদর্জার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে দিন। কাদর্জা বলল।
সম্ভব নয়। দলপতি বলল।
-একটু চেষ্টা করে দেখুন। বলবেন ভাইকিংদের দলপতি একটা অনুরোধ জানাতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। ফ্রান্সিস বলল।
–অনুরোধটা কী? দলপতি জানতে চাইল।
–সেটা আমি রাজাকেই বলবো। আপনি দেখাকরার ব্যবস্থাটা করে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার কপাল ভালো রাজা কাদর্জা এখন খুব খোশ মেজাজে আছেন। এতগুলি লোকের ফাঁসি উনি কখনও দেখেন নি। সেটা দেখবেন। এই আনন্দে আত্মহারা। দলপতি বলল।
–মানুষ এরকমও হয়। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা কাদর্জা এরকমইমানুষ। যাকগে দেখি রাজার সঙ্গে কথা বলে। দলপতি চলে গেল।
হ্যারি গলা চড়িয়ে বলে উঠল–ফ্রান্সিস–তোমার জীবনের বিনিময়ে আমরা মুক্তি চাই না। বন্ধুদের মধ্যেও গুঞ্জন উঠল। কয়েকজন বন্ধু বলে উঠল–তুমি অনুরোধ করবে না।
–অনুরোধ করেই দেখা যাকনা। তোমরা নিশ্চিন্ত থাক রাজা রাজি হবেনা। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে দলপতি এল। হেসে বলল–রাজা কথা বলতে রাজি হয়েছেন।
–তাহলে-দরজাটা খুলতে বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। ফ্রান্সিস বেরিয়ে এল। চারজন প্রহরী খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল। সবচেয়ে আগে দলপতি।
রাজবাড়ির মন্ত্রণাকক্ষে ফ্রান্সিসকে নিয়ে আসা হল। একটা বড় শ্বেতপাথরের টেবিল। চারপাশে চেয়ার সাজানো।
ফ্রান্সিসকে চেয়ারে বসিয়ে দলপতি ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। অনুচ্চস্বরে বলল–রাজা আসছেন।
কিছু-পরে রাজা কাদর্জা ঘরে ঢুকলেন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল না। রাজা কড়া চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালে না কেন?
ফ্রান্সিসের প্রায় মুখের ডগায় এসে গিয়েছিল–আপনার মত একটা নরপশুকে। কষ্টে নিজেকে সংযত করল। বলল–আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট।
–হেঁটে তো এলে। রাজা বলল।
–অনেক কষ্টে। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা কাদর্জা চেয়ারে বসল। আলখাল্লার মত জামার পকেট থেকে চৌকোনো নস্যির কৌটো—বের করল। সজোরে এক টিপ নস্যি নিল। বলল বলো আমার সঙ্গে তোমার কি প্রয়োজন?
–একটা কথা বলছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো। রাজা বলল।
–রাজা পারকোনের হয়ে আমরা লড়াই করেছিলাম। আমার নির্দেশেই আমার বন্ধুরা এই লড়াই করেছিল। কাজেই এর পুরো দায়িত্ব আমার। ফ্রান্সিস বলল।
–তুই তাহলে দলের পাঠা। রাজা বলল।
হ্যা। তাই আমার অনুরোধ-বিনীত অনুরোধ আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। আমার বন্ধুদের মুক্তি দেওয়া হোক। রাজা হো হো করে হেসে উঠলকী যে বলো। অতগুলো মানুষকে একসঙ্গে ফাঁসি দেবকী রোমাঞ্চকর। সেখানে একজনের ফাঁসি দেখে কী হবে।
–তাহলে আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
-না-না। সবার ফাঁসি হবে একসঙ্গে। আমি বলে দিয়েছিমঞ্চেও একটা লম্বা পাটাতন থাকবে। ফাঁসির সময় পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হবে একসঙ্গে সবাই ঝুলবে। কী চমৎকার।
ফ্রান্সিসের আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। এরকম একটা নির্মম মানুষের সঙ্গে কী কথা?
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের বাইরে এল। পায়ের ব্যথাটা যদি রাজা মিথ্যে বুঝতে পারে বলা যায় না হয়তো দলপতির তরোয়াল খুলে নিয়ে ওকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করতে পারে। এইরকম মানুষ সব পারে।
বাইরে এসে প্রহরীদের পাহারায় ফ্রান্সিস চলল। দলপতি বলল–তুমি রাজাকে মিথ্যে কথা বললে কেন?
–আমি একথার উত্তর দেবনা। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? দলপতি বলল।
–তোমাদের বিশ্বাস নেই। ফ্রান্সিস বলল।
কয়েদঘরে ঢুকতে বন্ধুরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–ভাইসব, যা বলেছিলাম। তাই হল। রাজা গররাজি। একসঙ্গে এতজনের ফাঁসি দেখতে রাজা উদগ্রীব হয়ে আছে। এ নাকি এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য। এরকম মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলতেও ঘৃণা হয়। রাজা ঘরে ঢুকতে আমি উঠে দাঁড়াই নি। রাজা বেশ ক্ষেপে গেল। আমি পায়ে ব্যথা বলে সমস্যাটার পাশ কাটিয়েছি। যাহোক রাজা রাজি হয়নি। অবশ্য এটা আমি আগেই জানতাম।
বন্ধুরা কেউ কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিসকে ওরা প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। একা ফ্রান্সিসের ফাঁসি হবে না–এটা জেনে ওরা খুশিই হল। ফ্রান্সিসদের সঙ্গেই সবাই মৃত্যুবরণ করবে। সবাই এই সংকল্প নিল।
পরদিন সকাল হল। ফাঁসির মঞ্চে দড়িটড়ি টাঙানো হল। যারা ফাঁসি দেবেতারা ঝুলন্ত দড়ির, ফস টেনে টেনে দেখল। মঞ্চের পেছনটায় পাকার শুকনো ডালপাতা। ওসব রাখা হয়েছে কেন প্রহরী সৈন্যরা বুঝল না। ওরা ওসব ফেলেও দিল না। তখন ফাঁসি হবে তার উত্তেজনা।
প্রহরীরা দল বেঁধে দুহাত বাঁধা ফ্রান্সিসদের সারি বেঁধে নিয়ে আসছে।
রাজা অনেক আগেই এসে গেছে। মঞ্চের মুখোমুখি একটা সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তার নিচে রাজার সিংহাসন এনে পাতা হয়েছে। রাজা এল। তার সাজসজ্জার বহর কত। মাথায় বোধহয় নতুন মুকুটটা রোদ পড়ে ঝকঝক্ করছে। গায়ে সোনালি-রূপালি কাজ করা আলখাল্লার মত।
ফাঁসি দেখতে খুব বেশি লোক আসে নি। এই ঘৃণ্য ঘটনা দেখার আগ্রহ অনেকমানুষেরই নেই। তবু রাজার উৎসাহে কমতি নেই। হাত-পা নেড়ে দলপতিকে নানা নির্দেশ দিচ্ছে। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই লক্ষ্য ফাঁসির মঞ্চ।
ফ্রান্সিসরা সার বেঁধে আসছে।
হঠাৎ ওকাজা কোত্থেকে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। হাত বাঁধা ফ্রান্সিস মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল। ওকাজা ফ্রান্সিসদের হাত ধরে তুলতে তুলতে বিড় বিড় করে বলল–আগুন-মঞ্চ পল্কা–পেছনে জঙ্গল।
ওকাজা এক ছুটে চলে গেল। ফ্রান্সিস চোখ বুজে যীশুকে স্মরণ করল। গলা চড়িয়ে দেশীয় ভাষায় বলল–সবাই পালাবার জন্য তৈরী থাকো। পেছনের জঙ্গলে আত্মগোপন।
ফ্রান্সিসরা মঞ্চে উঠল। ফাঁসুড়েরা ফ্রান্সিসদের ওপর থেকে ঝোলানো ফাঁসগুলোর ঠিক নিচে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। হঠাৎ মঞ্চের পেছনের শুকনো ডালপাতায় কোত্থেকে একটা জ্বলন্ত মশাল উড়ে এসে পড়ল। শুকনো ডালপাতায় সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠল। ফাঁসুড়েরা হতবাক। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। আগুন মঞ্চেও ছড়াল। দর্শকদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎমঞ্চ ডানদিকে একেবারে কাত হয়ে মাটি ছুঁল। প্রহরীরা, সৈন্যরা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। পীপেভর্তি জল আনছে আগুন নেভাবার জন্যে। হঠাৎ রাজার মাথার ওপরের সামিয়ানা ভেঙে পড়ল। ফ্রান্সিসরা কাত হওয়া মঞ্চ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। শাঙ্কো রাজা পারকোনকে কাঁধে তুলে নিয়ে জঙ্গ লের দিকে ছুটল। এবার ফ্রান্সিসরাও ছুটল।
সৈন্যরা তরোয়াল উঁচিয়ে ছুটে আসতে লাগল। সৈন্যরা জঙ্গলের কাছে পৌঁছোবার আগেই ফ্রান্সিসরা বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। গভীর বন। সৈন্যরা ওদের খুঁজে বের করতে পারবেনা।
ফ্রান্সিসরা গাছগাছালির নিচে দিয়ে চলল। কিন্তু দুহাত বাঁধা থাকায় খুবই অসুবিধে হচ্ছিল। মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ফ্রান্সিসরা বেশ কিছুদূরে এল।
সবাই হাঁপাতে লাগল। বেশ কষ্ট করে রাজা পারকোন ফ্রান্সিসদের সঙ্গে সঙ্গে এল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল
–সবাই বসে পড়ল। বিশ্রাম নাও। সবাই এখানে ওখানে বসে পড়ল।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। মাথা নিচু করে ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর বুকের কাছ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে জামার তলা থেকে ছোরাটা বের করল। তারপর ঘষে ঘষে শাঙ্কোর হাতের দড়ি কেটে দিল। ছোরা নিয়ে এবার শাঙ্কো একে একে সকলের হাতের দড়ি কেটে দিল। হাত খোলা পেয়ে ফ্রান্সিসদের অস্বস্তি কাটল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–এখন কী করবে?
-বুঝতে পারছি না। এই বনটা তো পার হয়ে যাই। তারপরে নিশ্চয়ই লোকজনের বসতি পাব।
–হ্যাঁ। এ ছাড়া তো কোন উপায় নেই। হ্যারি বলল।
হঠাৎ সামনের দিকে শুকনো ডালপাতা ভাঙার শব্দ উঠল। সকলেই শুনল সেটা। ফ্রান্সিস কান খাড়া করল। শব্দটা সামনে থেকেই আসছে।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–সবাই লড়বার জন্য তৈরি হও। রাজা কাদর্জার সৈন্যরা বোধহয় আসছে। নিরস্ত্র অবস্থাতেই লড়বো আমরা। আর বন্দী হব না।
ডালপাতা ভাঙার শব্দ কাছে এল। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। শুধু রাজা পারকোন বসে আছে। এক্ষুনি উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই।
তিনজন লোক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ওকাজা!
ফ্রান্সিস হেসে বলল–ওকাজা সময়মতই এসেছে। আমরা কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
–আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। ওকাজা বলল।
–কোথায় যাবো? ফ্রান্সিস বলল।
–বিদ্রোহীদের আস্তানায়। আসুন। ওকাজা বলল।
ওকাজারা সামনে এগিয়ে চলল। ফ্রান্সিসরা পেছনে পেছনে চলল। এই দিনের বেলাও বনতল অন্ধকার। সাবধানে পা ফেলে চলতে হচ্ছে। নইলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা।
বেশ কিছুটা যেতে গাছগাছালির আড়ালে ফ্রান্সিসরা দেখল একটা বড় ঘর। সবটাই কাঠের। ফ্রান্সিসরা ওকাজার পেছনে পেছনে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ঘর থেকে এক বলিষ্ঠ যুবক বেরিয়ে এল। মুখে দাড়ি গোঁফ। খুব বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। বলল-ওকাজার কাছ থেকে আপনাদের কথা শুনেছি। ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে এসেছেন। আপনাদের মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছি। ভেতরে আসুন।
ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। ওকাজা ফ্রান্সিসদের কাছে এল। নিম্নস্বরে বলল–ঐ যুবকটিই পারেলা। বিদ্রোহীদের নেতা। ফ্রান্সিস পারেলার কাছে গেল। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। বলল–রাজা কাদর্জার মতনরপশুর সন্ত্রাসের রাজত্ব আপনারা শেষ করুন।
–আমরা সেই চেষ্টাতেই আছি। পারেলা বলল।
ফ্রান্সিস টানা পাতা দড়ি দিয়ে শুকনো ঘাস বুনে তৈরি বিছানায় বসল। হ্যারিরাও বসল। হ্যারি বলল
–ফ্রান্সিস–রাজা পারকোনের চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে কর। পিঠের ঘাটা শুকিয়ে গেছে কিন্তু দুর্বলতাটা এখনও যায় নি।
–ঠিক বলেছো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ওকাজাকে ডাকল। ওকাজা এল। ফ্রান্সিস বলল–ওকাজা–একটা উপকার যে করতে হয়।
বলুন কী উপকার। ওকাজা বলল।
–রাজা পারকোনকে রাজা কাদর্জার হুকুমে চাবুক দিয়ে মারা হয়েছিল। পিঠে ঘাটা সেরেছে কিন্তু দুর্বলতাটা যায় নি। যদি ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দাও।
–নিশ্চয়ই। ওকাজা বলল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছু পরে ওকাজা এক বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। বৃদ্ধের কাঁধে ঝুলছে বুনো লতা দিয়ে তৈরি ঝোলা। বোঝা গেল এই বৃদ্ধই বৈদ্য।
ফ্রান্সিস বৃদ্ধকে রাজা পারকোনের কাছে নিয়ে গেল। চাবুক মারার কথা বলল। বৃদ্ধ চুপ করে সব শুনল। তারপর রাজার পিঠের ছেঁড়া পোশাক সরিয়ে দেখল। বলল– ভেতরে এখনও ঘা আছে। সম্পূর্ণ সারে নি।
বৈদ্য ঝোলার মুখ খুলল। কয়েকটা শুকনো পাতা বের করল। রাজার পিঠে চেপে চেপে বসিয়ে দিল। পাতাগুলো চেপ্টে লেগে রইল। বৈদ্য তারপর ঝোলা থেকে একটা ছোটো চিনেমাটির বোয়াম বের করল। বোয়াম থেকে চারটে কালোবড়ি বের করল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–এখন একটা বড়ি খাইয়ে দিন। কাল থেকে দৈনিক একটা করে বড়ি খাবে। দিন দশেকের মধ্যে আগেরশক্তি ফিরে পাবেন। বৈদ্য চলে গেল।
তৃষ্ণার্ত ফ্রান্সিসরা জল খেল। এবার খিদে। হ্যারি সেকথা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস ওকাজাকে ডাকল। ওকাজা কাছে এলে বলল–সেই সকালে কিছু খেয়েছি। এখনো কিছু খাওয়া জোটে নি।
–কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের খেতে দেওয়া হবে। সকাল থেকে কী কষ্ট হয়েছে। আপনাদের তা তো আমরা জানি। ওকাজা চলে গেল।
কিছু পরে ওকাজা এল। গলা চড়িয়ে বলল–আপনাদের খেতে দেওয়া হচ্ছে।
এবার ফ্রান্সিস ভালো করে চারদিকে দেখল। অনেক যুবক শুয়ে বসে আছে। ঘরের এককোণে জলের জালা। অন্য কোনে তরোয়ালের স্তূপ। বর্শাও রয়েছে।
প্রত্যেকের সামনে লম্ফটে পাতা পেতে দেওয়া হল। কম পোড়া তিনকোণা রুটি আর তরিতরকারির ঝোল। একটা করে ঝোলসহ মাছের টুকরোও দেওয়া হল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা চেটেপুটে খেল।
রাত হল। সারাদিনের উত্তেজনায় ক্লান্ত ফ্রান্সিসরা ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু বেলায় ঘুম ভাঙল ফ্রান্সিসের। হাতমুখ ধুয়ে এসে সকালের খাবার খেতে বসল। হ্যারি পাশে এসে বসল। বলল–
-এখন কী করবে?
–কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। কয়েকটা দিন এখানে বিশ্রাম নেব। তারপর যা করবার করবোফ্রান্সিস বলল।
খেয়েদেয়ে শুয়ে বসে কয়েকদিন কাটাল।
সেদিন ফ্রান্সিস ওকাজাকে কাছে ডাকল। বলল,
–ওকাজা আমরা এখন কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। রাজা পারকোনের রাজত্ব চালাচ্ছে রাজা কাদর্জার সেনাপতি। ওখানে যাওয়া যাবেনা। এখানে তো থাকা যাবেইনা।
–এক কাজ করতে পারেন। উত্তর দিকে একটা দেশ আছে কানজেন। রাজা নয় রানি ইদিন ঐ দেশের প্রধান। মন্ত্রী অমাত্যের সহায়তায় রাজত্ব চালায়। খুব বুদ্ধিমতী। কানজেন-এ আশ্রয় নিতে পারেন। তারপর আমরা এই জামিনায় আমাদের শাসন কায়েম করতে পারলে এখানে চলে আসবেন। ততদিন কানজেন-এ থাকুন।
ফ্রান্সিস এই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলল। হ্যারি বলল–ওকাজা ভালো বুদ্ধিই দিয়েছে। কানজেনেই চলো। আশ্রয়, আহার দুটোই মিলবে। রাজা কাদর্জার রাজত্ব শেষ। হলেই আমরা চলে আসবো।
বনজঙ্গল গাছগাছালি কেটে এখানে ঘর বানানো হয়েছে। চারিদিকে গাছ। কাজেই ঘরটা দৃষ্টির আড়ালেই থাকে। কিন্তু দূর্ভাগ্য ওকাজাদের আর ফ্রান্সিসদের।
তখন দুপুরের খাওয়া সেরে শাঙ্কো ঘরটার বাইরে একটু দূরে একটা গোড়া কাটা গাছের গোড়ায় বসেছিল। হঠাৎ শুকনো পাতাডাল ভাঙার শব্দে ফিরে তাকাতেই দেখে দুজন রাজা কাদর্জার সৈন্য। সৈন্য দুজন হতবাক। শাঙ্কোরও মুখে কথা নেই। শাঙ্কো সেই অবস্থাটা কাটিয়ে উঠল। দ্রুত ছুটল সৈন্য দুজনের দিকে। সৈন্য দু’জন তখন পালাতে ব্যস্ত। শাঙ্কো মাথা নিচু করে পোশাকের নিচ থেকে ছোরাটা বের করল। তারপর একটা সৈন্যকে লক্ষ্য করে ছোরা ছুঁড়ল। পরিষ্কার হাত শাঙ্কোর। ছোরাটা সৈন্যটির গলায় গেঁথে গেল। ও বসে পড়ল। শাঙ্কো অন্যটির দিকে ছুটে গেল। কিন্তু সেই সৈন্যটি লাফ দিয়ে সরে গেল। তারপর গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।
এবার সমূহ বিপদ। এই ঘরের কথা রাজা কাদর্জার কাছে গোপন থাকবেনা। নিশ্চয়ই নতুন সেনাপতিকে সৈন্যসহ পাঠাবে এই ঘরের খোঁজে। শাঙ্কো ভাবল এসব। ও দ্রুত পারেলার কাছে গেল। ঘটনাটা বলল। পারেলা তখন গলা চড়িয়ে বলল-কাদর্জা এই আস্তানর খোঁজ পেয়ে যাবে। এক মুহূর্তও দেরি না। সব অস্ত্রশস্ত্র জঙ্গলে লুকিয়ে রাখো। তারপর যে যেদিকে পারো পালাও। আমরা সংখ্যায় কম। লড়াই করবো না। সাত দিন। পরে সবাই এখানে চলে আসবো।
পারেলার দলের লোকেরা তরোয়াল বর্শা সব জঙ্গলে লুকিয়ে ফেলল। তারপর যে যেদিকে পারল পালালো।
ফ্রান্সিস জোরে বলল–ভাইসব–উত্তরদিকে পালাও।
ফ্রান্সিসরা উত্তরমুখো ছুটল। কিছুদূর যাবার পর পেছনে কার্জার সৈন্যদের চিৎকার ডাকাডাকি শুনল। ফ্রান্সিস জোরে বলল-জলদি।
একসময় ফ্রান্সিসরা বনভূমি থেকে বেরিয়ে এল। সামনে বিস্তৃত প্রান্তর। ফ্রান্সিসরা দ্রুত ছুটল। বনের বাইরে এসে কাদর্জার সৈন্যরা ওদের দেখে ফেলতে পারে।
প্রান্তর শেষ। সামনে বাড়িঘরদোর। জনবসতি। কাঠপাথরে তৈরি প্রথম বাড়িটার কাছে এল ওরা। বন্ধুরা অনেকেই হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল।
ফ্রান্সিসও ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। কথা বলতে পারছে না। একটুক্ষণ দম নিয়ে ফ্রান্সিস বাড়ির সামনের দরজাটার কাছে এল। দেখল দরজা খোলা।
ফ্রান্সিস ডাকল—কেউ আছেন? কোন সাড়াশব্দ নেই। আবার ডাকল–কেউ আছেন?
–কে? ভেতর থেকে শোনা গেল। একটু পরে একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। পাকা দাড়ি গোঁফ। গায়ে ঢোলা জামা।
ফ্রান্সিস বলল–আমরা বিদেশী ভাইকিং। এদেশে ঘটনাচক্রে এসেছি। রাজা কাদর্জা আমাদের ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। অনেক কষ্টে আমরা পালিয়ে এসেছি।
–রাজা কাদর্জা? ওতো সাংঘাতিক মানুষ। বৃদ্ধ বলল।
হ্যাঁ, আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। যা হোক আমরা এখন এখানে আশ্রয় চাই। খাদ্যও চাই। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই বাড়ি থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের দেখে একটু অবাকই হল। এতজন বিদেশি। হ্যারি বলল–এটা বোধহয় রানি ইচিনার রাজত্ব?
–হ্যাঁ। যুবকটি বলল–কিন্তু আপনারা?
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সবই বলল। যুবকটি বলল–তাহলে আপনারা এখন কী চান?
–আমরা আপনার বাড়ীতে আশ্রয় চাই। খাদ্যও চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–তা দেব কিনা বাবা বলুক। যুবকটি বলল।
–এরা আশ্রয়হীন। বিপদগ্রস্ত। এদেশ ওদের কাছে বিদেশ। কোথায় আর আশ্রয় পাবে? আমাদের বাড়ীতেই থাকুক। বৃদ্ধ বলল।
–তুমি রাজি হলে আমার আপত্তি নেই। যুবকটি বলল–তবে বেশিদিন আপনাদের আশ্রয় ও খাদ্য দিতে পারবো না।
–না-না। আজকের রাতটা। কাল আমরা রানির দরবারে যাবো। আশ্রয় খাদ্য চাইবো। মনে হয় উনি ব্যবস্থা করে দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। আপনারা থাকুন। তবে ছোট ঘর। আপনাদের কষ্ট হবে। বৃদ্ধ বলল।
–আমরা কয়েদঘরে থেকে অভ্যস্ত। আমাদের কোন কষ্ট হবে না। হ্যারি বলল।
ঘরের জিনিসপত্র সরানো হল। ভাইকিংরা যুবকটিকে সাহায্য করল।
ফাঁকা ঘরে মোটা কাপড় পেতে দেওয়া হল। ফ্রান্সিসরা বসল। রাজাপারকোন শুয়ে পড়লেন। ফ্রান্সিস পারকোনের কাছে এল। বলল–এখন নিজেরহারানো রাজ্যে ফিরে যেতে পারবেন?
–তোমাদের পোশাক পরে বনভূমি পার হয়ে চলে যেতে পারবো। এখন শরীরে জোর হয়েছে। তবে শাঙ্কো যদি আমাকে বনভূমিতে পৌঁছে দেয় তাহলে ভালো হয়। রাজা পারকোন বললেন।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো আপনাকে নিয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে ফ্রান্সিসদের খেতে দেওয়া হলো। আনাজের তরকারী মাছের ঝোলমত। পরিষ্কার রুটি। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেল।
শাঙ্কো রাজা পারকোনকে নিয়ে রওনা হল। রাজা পারকোন সকালের খাবার খেল। বললেন–ফ্রান্সিস তোমার কাছে ঋণী রইলাম।
ফ্রান্সিস রানির বাড়ির দিকে চলল। যুবকটিই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
রানির পাথরের বাড়ি খুব বড় নয়। তবে দেখতে সুন্দর। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস, রানি যদি আশ্রয়, খাদ্য না দেয় তবে খুবই বিপদে পড়বে।
–না, না। বলবো আমরা কিছুদিন থাকবো প্রয়োজনে আপনার হয়ে লড়াই করব। ফ্রান্সিস বলল।
আবার পরের হয়ে লড়াইয়ে নামবে? শাঙ্কো বলল।
–এক্ষুনি তো আর লড়াই হচ্ছে না। আমরা যে তার সহায় এটা তো বোঝাতে হবে। নইলে আমাদের গুরুত্ব কী? ফ্রান্সিস বলল।
–দেখো বলে। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিসরা সভাঘরে ঢুকল। অনেকেই ওদের দিকে তাকিয়ে দেখল। এই বিদেশিরা কোত্থেকে এল? প্রহরীরা ফ্রান্সিসদের আটকালো না। কাঠের সিংহাসনে রানি ইরিনা বসে আছেন। দুপাশেমন্ত্রী ও অমাত্যরা। ঘরটায় তেমন আলো ঢোকে নি। রানি বিচার করছেন। রানির মাথায় মুকুট। পরনে ঝলমলে পোশাক। দেখতে সুন্দরী। চেহারায় ব্যক্তিত্ব আছে।
একটা বিচার শেষ হল। ফ্রান্সিসরা ততক্ষণে রানির নজরে পড়েছে। সভাঘরে ভর্তি লোক। বোঝা গেল রানি জনপ্রিয়। হয়তো তার সুশাসনই তাঁকে জনপ্রিয় করেছে।
ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল। বিচার চলল।
বেশ কিছুক্ষণ বিচার চলার পর বিচারপর্ব শেষ হল। রানি হাততালি দিলেন। আস্তে আস্তে সভার লোকজন বেরিয়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বিচারসভা নির্জন হল। ফ্রান্সিসরা তখনও দাঁড়িয়ে। এবার রানি ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলেন।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ফ্রান্সিস বলল– আপনার কাছে আমাদের কিছু নিবেদন ছিল।
–বলো কী নিবেদন? রানি বললেন। তখন ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলল।
–ও। রাজা কাদর্জা তো একটা সাক্ষাৎ শয়তান। দু’দুবার এই কালজেন আক্রমণ করেছিল। আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা বিপদমুক্ত এই। উত্তরের এক দেশ। বুনোদের রাজত্ব। ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের দেশ আক্রমণ করে। হেরে পালিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে কতদিন ওদের আক্রমণ করে। হেরে পালিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে কতদিন ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারবো জানি না। তবে আমার বীর সৈন্যরা হার স্বীকার করতে জানে না। এটাই আমার ভরসা। যাকগে–তোমরা কী চাও বলো।
–আমরা আপনার কাছে আশ্রয় চাই। আমরা কিছুদিন এখানে থাকবো। তারপর ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তোমরা ভাইকিং–দক্ষ জাহাজচালকদুঃসাহসী। প্রয়োজনে তোমরা আমার সহায় হবে–এই আশাআমার। রানি বললেন।
–আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবো। এমন কি যদি আপনি চান আপনার হয়ে লড়াই করবো। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে তো খুবই ভালো হয়। রানি বললেন।
রানি আঙ্গুল নেড়ে সেনাপতিকে ডাকলেন। অমাত্যদের পাশে বসা সেনাপতি দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সেনাপতি রোগা লম্বা। এ কী লড়াই করবে? শাঙ্কো ভাবল।
সেনাপতি মাথা নিচু করে সম্মান জানিয়ে দাঁড়াল। রানি ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বললেন এদের থাকার জন্যে সেনানিবাসের একটা ঘর ছেড়ে দিন। সেনাদের সঙ্গেই ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এরা কিছুদিন থাকবে। আপনি একটু দেখাশোনা করবেন।
–যে আজ্ঞে। সেনাপতি মাথা নিচু করে বলল। তারপর ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–আমার সঙ্গে আসুন।
সবাই সভাঘরের বাইরে এল। বেশ রোদ বাইরে। এলেমেলো বাতাস বইছে।
সভাঘরের বাইরে একটা ছোট মাঠ মতো। তারপরেই কতকগুলো লম্বাটে ঘর টানা চলে গেছে। ঘরের বারান্দায় মাঠে সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা ফ্রান্সিসদের বেশ অবাক চোখেই দেখল। সেনাপতি কাকে ডাকল। একজন সৈন্য এগিয়ে এল। কোমরে ঝোলানো চাবির বড় গোছা।
সেনাপতি একা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে তালা ঝুলছে। সেনাপতি চাবিওয়ালা সৈন্যটিকে ইঙ্গিত করল। চাবিওয়ালা সৈন্যটি তালা খুলে দিল। সেনাপতি দরজা খুলে বলল এই ঘরে আপনারা থাকবেন। প্রয়োজনে আমার খোঁজ করবেন। এখন আপনারা বিশ্রাম করুন।
ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। বেশ খোলামেলা ঘর। ভালো হাওয়া খেলছে।
ঘরের মেঝেয় মোটা কাপড়ের চাদর পাতা। ফ্রান্সিস বসল। শুধু ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। শুয়ে থেকেই বলল–বিস্কো, বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। শাঙ্কো ফিরে এসে আমাদের খুঁজবে। ও সহজেই যেন আমাদের দেখা পায়।
বিস্কো বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। তখনই দেখল শাঙ্কো সভাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। বিস্কো চিৎকার করে ডাকলো–শাঙ্কো, আমরা এখানে।
শাঙ্কো তখন বিস্কোকে দেখতে পেয়েছে। মাঠ পার হয়ে বিস্কোর কাছে এল। দুজনে ঘরে ঢুকল। শাঙ্কো বলল ফ্রান্সিস, রানি তাহলে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করল।
হা। বদলে অবশ্য বলতে হল লড়াই হলে রানির হয়ে আমরা লড়বো।
নিরুপায়। এমনি এমনি কে কাকে আশ্রয় দেয়, খাদ্য দেয়। স্বার্থের ব্যাপারটা– থেকেই যায়। ফ্রান্সিস বলল।
যাক গে। তোমার অভিমতের বিরোধিতা কখনও করিনি, করবোও না। সব মেনে নিলাম। প্রয়োজনে লড়াই করবো। শাঙ্কো বলল।
রাজা পারকোনের অবস্থা কী দেখলে? পারবে নিজের দেশে ফিরে যেতে? হ্যারি বলল।
–পারবে। তবে বন পার হতে কষ্ট হবে। পেছল গাছের গুঁড়ি। তার মধ্যে দিয়ে যাওয়া। কী আর করার আছে। উনি তো আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন না। শাঙ্কো বলল।
উনি যা ভালো বুঝেছেন, করেছেন। আমাদের কিছু করণীয় নেই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসদের একঘেয়ে দিন কাটতে লাগল। সকাল বিকেল ওরা সৈন্যদের কুচকওয়াজ দেখে। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়।
বিকেলে ফ্রান্সিস একা সদর রাস্তায় যায়। তারপর নাক বরাবর হাঁটতে শুরু করে। বাড়িঘর দোকানপাট দেখে। রাত হতেই ফিরে আসে। এভাবেই দিন কাটছিল ফ্রান্সিসদের। সেদিন সকালে সৈন্যদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সবাই ব্যস্ত। একজন সৈন্যকে কাছে পেয়ে শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল–কী হয়েছে ভাই?
–বুনো রাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করতে আসছে। সৈন্যটি বলল।
–তাহলে তো লড়াই। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। সৈন্যটি বলল।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। লড়াইয়ের কথা বলল।
রানি ইরিনা সভাঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সৈন্যরা সেখানে গিয়ে জড় হল।
রানি ইরিনা গলা চড়িয়ে বলতে লাগলেন আমার বীর সেনানীরা, দূত খবর এনেছে বুনো রাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করতে আসছে। সব তৈরি হও। এর আগেও ওদের আমরা লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছি। এবারও ওদের হারাতে হবে। জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই চালাতে হবে। জয় আমাদের হবেই। রানি ইরিনা থামলেন।
রানি ইরিনার গায়ে আঁটোসাঁটো পোশাক। মাথার চুল চেপে বাঁধা। হাতে খোলা তরোয়াল। বোঝা গেল রানি ইরিনাও লড়াই করবেন।
উত্তরের পাহাড়ি এলাকা দিয়ে বনো রাজার সৈন্যরা ছুটে আসতে লাগল। হাতে বর্শা। মাত্র কয়েকজনের হাতে তরোয়াল ওরা রানি ইরিনার সৈন্যদের কাছে আসতেই ইরিনার সৈন্যরা বুনো রাজার সৈন্যদের আক্রমণ করল। লড়াই শুরু হল। আৰ্তনাদ গোঙানি।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কী করবে?
কথা দিয়েছি। রানি ইরিনার হয়ে লড়াই করবো। ভাইসব–সেনাপতি আমাদের তরোয়াল দিয়ে গেছে। উনি আগে থেকেই আঁচ করেছিলেন দু’একদিনের মধ্যে বুনোরা আক্রমণ করতে পারে। তরোয়াল নাও। লড়াই।
ফ্রান্সিসরা অল্পক্ষণের মধ্যেই তরোয়াল নিয়ে লড়াইয়ের মাঠে নামল। বুনোরা বর্শা বিঁধিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু একবার বর্শা বিঁধিয়ে দিলেই ওদের বর্শা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিসরা সেই সুযোগ নিল। তরোয়াল চালিয়ে ওদের আহত করতে লাগল।
নিজের সৈন্যদের সঙ্গে মিশে রানি ইরিনাও লড়াই করতে লাগলেন। নিপুণ হাতে তরোয়াল চালাতে লাগলেন।
ফ্রান্সিসরা ঘুরে ঘুরে লড়াই করতে লাগল। ফ্রান্সিস অবাক হয়ে দেখল রানি ইরিনা নিপুণ হাতে তরোয়াল চালাচ্ছে। বুনন সৈন্য মারা পড়ছে। পরিশ্রমে রানির মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। তবুতরোয়াল চালানোয় বিরাম নেই।
ফ্রান্সিসদের দুই বন্ধু আহত হল। শাঙ্কো লড়াই থামিয়ে বন্ধু দুজনকে এক এক করে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বুনোদের রাজাকে দেখল। মুখে হলদেটে গোঁফ দাড়ি। মাথার হলদেটে চুল চুড়োকরে বাঁধা। হাতে তরোয়াল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। বুনো রাজার সঙ্গে লড়াই করতেলাগল। ফ্রান্সিস বুনো রাজার মাথার ওপর দিয়ে তরোয়াল ঘুরিয়ে আনল। বুনো রাজা চমকে গেল। ফ্রান্সিস সেইসুযোগ ছাড়লনা। বুনো রাজারহাতলক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। বুনো রাজার হাত বেশ গভীরভাবে কেটে গেল। বুনো রাজা বসে পড়ল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। দু’জন বুনো সৈন্য রাজাকে ধরে ধরে লড়াইয়ের জায়গা থেকে সরিয়ে নিল।
ওদিকে কোন বুনো সৈন্যের ছোঁড়া বর্শা রানি ইরিনার কাঁধে লাগল। রানি তরোয়াল ফেলে হাত দিয়ে কাঁধ চেপে ধরলেন। রক্ত পড়তে লাগল।
দু’তিনজন সৈন্য রানি ইরিনাকে ধরে ধরে লড়াইয়ের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। সভাঘরের বারান্দায় রানিকে শুইয়ে দিল। একজন সৈন্য কোমরের ফেট্টি খুলে রানির ক্ষতস্থানে বেঁধে দিল। রক্ত পড়া বন্ধ হল।
রানির আহত হওয়ার সংবাদে রানির সৈন্যদের একাংশ কেমন মুষড়ে পড়ল। লড়াইয়ে আর মন নেই যেন। বুনো সৈন্যরা এই সুযোগ কাজে লাগল। পূর্ণোদ্যমে আক্রমণ চালাল। রানির সৈন্যরা হেরে যেতে লাগল।
অভিজ্ঞ ফ্রান্সিস বুঝল জেতার আশা নেই। রানির সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করল। কিছু সময় পরে যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি স্পষ্ট হল। চারদিকে প্রচুর বুনন সৈন্যরা। রানির সৈন্যরা নেই বললেই চলে।
ফ্রান্সিস হাতের তরবারি মাটিতে ফেলে গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–আর লড়াই নয়। অস্ত্রত্যাগ কর।
বুনোরা যুদ্ধজয়ের আনন্দে আত্মহারা। নিরস্ত্র ফ্রান্সিসদের আক্রমণ করল না। একদল বুনো সৈন্য ফ্রান্সিসদের ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিসরা আত্মসমর্পণ করল। বুনোরা ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল রানির কয়েদঘরের দিকে। যেতে যেতে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস, আবার কয়েদঘর। বুনোরা আমাদের নিয়ে কী করবে জানি না। এবার পালানোর পরিকল্পনা।
–সেটা আমি আগে থেকেই ভাবছি। একটা আশাবুনোরা বোধহয় আমাদের হত্যা করবে না। শুধু বন্দী করে রাখবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিছুই বলা যায় না। ওদের মতলব এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। হ্যারি বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
রানির কয়েদঘরের বেশ বড়। আগে থেকেই কিছু বন্দী ছিল। তাদের হাতপা বাঁধা নয়। ফ্রান্সিস বলল–হয়তো আমাদেরও হাত-পা বাঁধবে না। ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের ঘাসের বিছানায় বসল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস, যে করেই হোক পালাতে হবে।
সর্ব দেখিটেখি। তারপর পালানোর উপায় ভাববো। ফ্রান্সিস বলল।
কয়েদগরের লোহার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বুনো সৈন্যরা খোলা তরোয়াল হাতে কয়েদঘর পাহারা দিতে লাগল।
ওদিকে কয়েকজন প্রহরী রানি ইরিনাকে ধরাধরি করে অন্তঃপুরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিল। রানি ব্যথায় গোঙাতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরে বৈদ্য এল। রানির চিকিৎসা শুরু হল।
বুনোদের আহত রাজাকে বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হল।
বুনো রাজা সেনাপতিকে ডেকে পাঠাল। সেনাপতি বুনো রাজার কাছে এল। রাজা বলল–রানিকে যে বৈদ্য চিকিৎসা করতে এসেছে তাকে ধরে নিয়ে এসো। সে আমারও চিকিৎসা করবে।
সেনাপতি অন্তঃপুরের দিকে চলল।
রানির প্রহরীরা সেনাপতিকে বাধা দিতে সাহস পেল না। বৈদ্য তখন রানির ক্ষতস্থানে সবজে রঙের আঠালো একটা ওষুধ লেপে দিচ্ছিল।
রানির শয়নকক্ষে ঢুকে সেনাপতি দেখল–বৈদ্য রানির শয্যার পাশে বসে আছে। বুনো সেনাপতিকে দেখে রানি উঠে বসতে গেল। বৈদ্য বলল–এখন নড়াচড়া করবেন না। রানি বুনো সেনাপতিকে বলল–এখানে কী চাই? প্রহরী? প্রহরীর এগিয়ে এল। কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেনাপতি বলল–আপনি তো এখন আমাদের বন্দিনী। আমরা যা বলবো আপনি, তাই শুনতে বাধ্য। তবে আমি আপনার কাছে আসিনি। আমাদের রাজাও আহত। ঐ এক ভাইকিং দস্যুর অস্ত্রাঘাতে। তার চিকিৎসার জন্য বৈদ্যকে নিয়ে যেতে এসেছি।
–ও। রানি আর কিছু বললেন না। সেনাপতি বৈদ্যকে বলল চলুন। বৈদ্য উঠে দাঁড়াল। বলল–চলি মাননীয়া রানি। যে ওষুধগুলো দিয়ে গেলাম নির্দেশমত খাবেন। ভয়ের কিছু নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘা শুকোতে থাকবে। অল্পদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবেন। বৈদ্য সেনাপতির সঙ্গে রানির শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এল।
সভাঘরের বারান্দায় সেনাপতির পেতে দেওয়া মোটা চাদরের ওপর বুনো রাজা শুয়েছিল। বৈদ্যকে দেখে উঠে বসল। সৈন্য পাশে বসল। বুনো রাজার ক্ষতস্থান দেখতে লাগল। বলল, দেখছি রক্ত এখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। যাকগে–আমি রক্তপড়া বন্ধ করে দিচ্ছি।
বৈদ্য কাঁধ থেকে ঝোলা নামল। ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে একটা কাঁচের বোতল বের করল। বোতলে কালো কালো বড়ি। সেনাপতিকে বলল–জল আনুন। সেনাপতি প্রায় ছুটে গেল। একটু পরেই কাঠের গ্লাশে জল নিয়ে এল। বৈদ্য বলল–মাননীয় রাজা–এই বড়িটা খেয়ে ফেলুন। বুনো রাজা বড়িটা খেল।
বৈদ্য এবার রানিকে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটাই সেনাপতিকে দিল। একটা ন্যাড়ায় বাঁধা বড়িগুলো সেনাপতি নিল। রানির ক্ষতস্থানে যে ওষুধ লাগিয়েছিল সেই ওষুধই বুনো রাজার ক্ষতস্থানেও লাগিয়ে দিল। বুনো-রাজা একটু ঝাঁকিয়ে উঠে চুপ করে গেল।
সন্ধ্যে হয়ে এল। বুনো রাজা সেনাপতিকে ডাল। সেনাপতি এলে বলল–এখন আমার অনেক ভালো বোধ হচ্ছে। আমি দেশে ফিরে যাবো।
–অসুস্থ শরীরে পারবেন? সেনাপতি বলল।
–হ্যাঁ পারবো। এবার তোমাকে কী করতে হবে বলি। রানি কোথায় আছে?
–অন্তঃপুরের শয়নকক্ষে। সেনাপতি বলল।
–রানিকে কয়েদখানায় ঢোকাও। বুনো রাজা বলল।
–কিন্তু অন্তঃপুরে থাকলেও তো একরকম বন্দিনীই থাকবে। সেনাপতি বলল।
উঁহু। –যে কোন মুহূর্তে প্রহরীদের সাহায্যে পালাতে পারবে। কয়েদঘরই উপযুক্ত জায়গা। বুনো রাজা বলল।
–কিন্তু ঐ কয়েদঘর-সেনাপতি আমতা আমতা করে বলল।
-আরে, রানি আর রানি নেই। যুদ্ধে হেরে এখন তো সাধারণ মানুষ। যেখানে থাকতে বলবো সেখানেই থাকতে হবে। তুমি যাও রানিকেকয়েদঘরে নিয়ে যাও। বুনো রাজা বলল।
সেনাপতি রানির শয়নকক্ষে এল।
–আবার কী হল? রানি বলে উঠলেন।
হল অনেককিছু–সেনাপতি বলল–রাজার হুকুম আপনাকে কয়েদঘরে থাকতে হবে। সেনাপতি বলল।
–কী বললে? রানি ভীষণভাবে চমকে উঠে বসলেন।
রাজার হুকুম। আপনার রাজবাড়িতে থাকা চলবে না। সেনাপতি বলল।
–আমি যাবো না। রানি বললেন।
–তাহলে আপনাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। রাজার হুকুম আমাকে তালিম করতেই হবে। সেনাপতি বলল।
–বেশ। জোর করেই নিয়ে যাও। রানি বললেন। রানির প্রহরীরা কয়েকজন সবই দেখছিল শুনছিল। তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। তাদের সকলের মাননীয় রানিকে কয়েদঘরে থাকতে হবে?
সেনাপতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরে পাঁচ-ছ’জন সৈন্য নিয়ে ঢুকল। বলল– রানিকে কয়েদঘরে নিয়ে চলো। বুনো সৈন্যরাও একটু অবাক হলো। কিন্তু সেনাপতির নির্দেশ। মানতেই হবে।
ওরা বিছানার কাছে গিয়ে রানির ডানহাত ধরল। রানির বাঁ কাঁধে বর্শার ক্ষত। রানি একবার তার প্রহরীদের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছুবললেন না। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে সৈন্যদের কাছে গেলেন। তারপর হেঁটে চললেন। রানিকে ঘিরে সৈন্যরাও চলল।
কয়েদঘরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে ফ্রান্সিসরা রানিকে দেখল। ওরা অবাক হয়ে গেল। রানি কয়েদঘরে থাকবেন?
ঢং-ঢং শব্দে কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। রানি কয়েদঘরে ঢুকলেন।
ফ্রান্সিস ঘরের কোণার দিকে রানির জন্যে একটা জায়গা করে দিল। রানি বসলেন। একটু কষ্ট করেই বসতে হল। বাঁ কাঁধে বর্শার ক্ষত।
রানির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। নিজের জায়গায় চলে এল। হ্যারি বলল–বুনো রাজা বুনোর মতই এই কাণ্ড করল। রানিকে কয়েদঘরে ঢোকাল। রানি তো একজন মহিলা তাকে এই জঘন্য পরিবেশে বন্দী করে রাখা–কোনভাবেই এটাকে মেনে নেওয়া যায় না।
রানি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত অপমানজনক মনে করলেন। নিজের তৈরি কয়েদঘরে নিজেই বন্দী। রানি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলেন।
ফ্রান্সিস তার আহত দুই বন্ধুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিল। বৈদ্য তাদের ওষুধ দিয়েছিল। ওষুধ ক্ষতস্থানে লাগিয়ে বড়ি খেয়ে ওরা এখন অনেকটা সুস্থ।
বিকেলে বৈদ্য এল। কয়েদঘরে ঢুকে রানির ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল। খাওয়ার জন্যে কয়েকটা বড়িও দিয়ে গেল। ফ্রান্সিসের বন্ধুদের খাওয়ার জন্যে কালো বড়ি দিয়ে গেল। ফ্রান্সিসদের বন্ধুদেরও জন্য কালো বড়ি দিয়ে গেল। রানি অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলেন।
একদিন পরে সন্ধ্যেবেলা বুনো সৈন্যদের খুব হৈ হল্লা শোনা গেল।
রাত হতেই হৈ-হল্লা বাড়ল। হুল্লোড় চলল।
প্রহরীরা রাতের খাবার দিতে এল। খেতে খেতে হ্যারি জিজ্ঞেস করল–এত হৈ হুল্লা কীসের ভাই?
–ব্বাঃ আমরা যুদ্ধে জিতেছিনা। যুদ্ধজয়ের উল্লাস আনন্দ চলছে। দেশ থেকে পাঁচ পিপে আরক আনা হয়েছে। একটু পরেই নেশার আরক খাওয়া শুরু হবে।
প্রহরীরা চলে গেল। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস বুঝলে কিছু?
–হ্যাঁ। বুঝলাম সৈন্যরা নেশাটেশা করবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের পালানোর সুবর্ণ সুযোগ। বুনোদের নেশার আরক। মানে সাংঘাতিক নেশার জিনিস। আরক খেলে কেউ উঠে দাঁড়াতে পারবে না। হ্যারি বলল।
উত্তেজনায় ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল–ভাইসব, মুক্তির উপায় পেয়ে গেছি। ঘটনা আমাদের স্বপক্ষে এলে আমরা অনায়াসে পালাতে পারবো।
ওদিকে সৈন্যদের হৈ-হল্লার শব্দ স্থিমিত হয়ে এল।
কিছুপরে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নেশার আরক খেয়ে সৈন্যরা সব মাঠে গাদাগাদি হয়ে পড়ে আছে। এমন কি প্রহরী দুজনও কয়েদঘরের সামনে খোলা তরোয়াল হাতে শুয়ে পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে নেশার আরক সবাই খেয়েছে।
ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। দেখল চাবিওয়ালা পাহারাদারটি লম্বালম্ফিপড়ে আছে। অনড়। কোমরে চাবির গোছা। ফ্রান্সিস দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়াল। প্রহরীটিকে ধরতে পারল না। কিন্তু প্রহরীটিকে ধরতে না পারলে চাবির গোছা পাওয়া যাবে না।
বন্ধুরা অনেকেই এসে তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। সবাই উত্তেজিত। পালাবার সুযোগ এসেছে।
–হ্যারি, প্রহরীটাকে কী করে কাছে আনা যায়? ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি বলল–শাঙ্কো–খাবার দেবার আগে প্রহরীরা একটা লোহার দিয়ে দরজায় ঘা দেয়–ঐ ডাটা নিয়ে এসো।
শাঙ্কো দ্রুত দরজায় ঝোলানো লোহার ডা’টা নিয়ে এল। হ্যারি ডাটা দেখে লাফিয়ে উঠল। বলল–ফ্রান্সিস যা চেয়েছি ঠিক পেয়ে গেছি।
–ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো। ফ্রান্সিস বলল।
-বুঝলে না? ডাটার মাথাটা দেখ বাঁকানো। ডাটা দরজার ফাঁক দিয়ে বের করে বাঁকানো মাথাটা চাবিওয়ালা প্রহরীর কোমরের ফেট্টিটায় আটকে নাও। তারপর ওকে। টেনে টেনে দরজার কাছে নিয়ে এসো। তখন চাবি হাতের মুঠোয়।
ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বললসাবাস হারি।
ফ্রান্সিস কাজে লাগল। লোহার ডাটা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে বের করল। তারপর চাবিওয়ালা প্রহরীর কোমরের ফেট্টিতে আটকে টানতে লাগল। আস্তে আস্তে প্রহরীর শরীরটা দরজার কাছে আসতে লাগল। তারপর একেবারে নাগালের মধ্যে। ফ্রান্সিস চাবি খুঁজতে লাগল। শাঙ্কো বলল–আমি দেখেছিদরজার চাবিটা। শাঙ্কো সবচেয়ে বড় চাবিটা দেখাল। প্রহরী জড়ানো গলায় কী বলল। উঠতে পারল না।
এবার দরজা খোলা। ফ্রান্সিস ভেতর থেকেহাত বাড়িয়েতালায় চাবি ঢোকাতেলাগল। একটু এদিক ওদিক করতে চাবি ঢুকে গেল। ফ্রান্সিস ডানদিকে মোচড় দিল। তালা খুলে ঝুলে রইল!
ফ্রান্সিস দ্রুত রানির কাছে গেল। বলল–মাননীয়া রানি কয়েদঘরের দরজা খুলেছি। আমরা পালাচ্ছি। আপনি অসুস্থ। কী করবেন?
–তোমাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করতে পারবো না। আমি মন্ত্রীর বাড়িতে আত্মগোপন করবো। পরে আরো সৈন্য সংগ্রহ করে বুননদের তাড়াবো। রানি বললেন।
–তাহলে আমার বন্ধু আপনাকে মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছে দেবে। চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখল মাঠে সব সৈন্য জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। চাঁদের আলোয় দেখল বুনোদের রাজা একটা কাঠের সিংহাসনে চিৎপাৎ হয়ে পড়ে আছে।
ফ্রান্সিসরা খুব সাবধানে মাটিতে পড়ে থাকা সৈন্যদের গায়ে পা না ঠেকিয়ে মাঠটা পার হল।
ওদিকে শাঙ্কো রানিকে ধরে ধরে মন্ত্রীর বাড়ির দিকে চলল। রানি ছুটতে পারছিলেন না। যতটা দ্রুত সম্ভব চললেন। মন্ত্রীর বাড়ির সামনে এল দুজনে। শাঙ্কো আস্তে বলল ডাকাডাকি করা যাবে না বা দরজায় ধাক্কা দেওয়া যাবেনা–কোনরকম শব্দ করা চলবে না। নিশ্চয়ই পেছনের দিকে দরজা আছে। সেদিকে চলুন।
দুজনে পেছনের দরজার কাছে এল। শাস্কো দরজায় মৃদু টোকা দিল। কিন্তু ভেতরে কারো সাড়াশব্দ নেই।
এবার শাঙ্কো গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করল। দরজার ফাঁক দিয়ে ছোরাটা ঢোকাল। তারপর খুব জোরে ওপরের দিকে ছোরাটা টানল। খিল খুলে গেল।
–ঢুকে পড়ুন। শাঙ্কো বলল। রানি দ্রুত ঢুকে পড়ল। শাঙ্কো ছুটল ফ্রান্সিসদের ধরবার জন্যে।
সদর রাস্তায় এসে চাঁদের আলোয় দেখল ফ্রান্সিসরা বেশ দূরে চলে গেছে। শাঙ্কো প্রাণপণে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেইফ্রান্সিসদের ধরল।
এবার ভাইকিংরা দ্রুত ছুটতে লাগল। গভীর রাত। রাস্তা জনশূন্য। ফ্রান্সিসরা ছুটল।
ছুটতে ছুটতে ওরা গৃহকর্তার বাড়ির কাছে এল। শাঙ্কো বলল–চলোনা–এই গৃহকর্তার বাড়িতে বাকি রাতটা কাটিয়ে
পাগল হয়েছ। এই কালজেন ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা ছুটতে ছুটতে সেই বনভূমির কাছে এল। তারপর বনভূমিতে ঢুকে প্রায় নিকষ অন্ধকারে কিছুদূর গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–দাঁড়াও। এবার বিশ্রাম।
সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানে ওখানে গাছের গুঁড়িতে ঘাসে ঝরাপাতায় সবাই বসে পড়ল। অনেকটা পথ ছুটে এসেছে। কমবেশি সবাই হাঁপাচ্ছে তখন।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এবার কী করবে?
–এই অন্ধকারে বন পার হতে গেলে জখম হওয়ার সম্ভাবনা। তার চেয়ে দিনের বেলা–একটু আধটু আলো পাওয়া যাবে তখন পার হওয়াই নিরাপদ। ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সবাই ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ কেউ গাছের গুঁড়িতেই শুয়ে পড়ল। কেউ ঝরাপাতায়, কেউ ঘাসে।
ভোর হল। পাখিপাখালির ডাক শুরু হল। ফ্রান্সিসরা সজাগ হলো। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল চলো।
সবাই উঠে দাঁড়ালো। বনতল দিয়ে চলল। আবছা দেখা যাচ্ছে গাছের গুঁড়ি ডালপাতা। সেসবের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসরা চলল।
হঠাৎই দেখল বিদ্রোহী পারেলাদের বড় ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস দুঃখ পেল। ও মনেপ্রাণে পারেলাদের সাফল্য কামনা করল।
বনভূমি শেষ। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–আমরা ছুটে রাজা কাদর্জার রাজ্য পার হয়ে যাবো। কেউ দাঁড়িয়ে পড়বে না। প্রাণপনে ছুটবে। — ফ্রান্সিসের কথামতোই বন্ধুরা প্রাণপনে ছুটল। রাস্তার লোকজন দাঁড়িয়ে দেখল। এরা ছুটছে কেন?
রাস্তায় টহলরত কিছু সৈন্য ফ্রান্সিসদের চিনল। কিন্তু ওরা কী করবে বুঝে ওঠার আগেই ফ্রান্সিসরা অনেক দূরে চলে গেল। রাজা কাদর্জার রাজ্য জামিনা ষে হল।
এবার রাজা কাদর্জার সেনাপতির রাজত্ব।
তখন দুপুর। সবারই খিদে পেয়েছে। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস, চলো কারো বাড়িতে আশ্রয় নি। খেয়ে বিশ্রাম করে সন্ধ্যের সময় এই রাজত্ব পার হই।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–তা মন্দ বলোনি। অন্ধকারে পার হয়ে যাবো।
–তাহলে একটা বাড়ি দেখি। শাঙ্কো বলল। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে এসে আঙ্গুল দিয়ে একটা বড় বাড়ি দেখাল। বলল–ঐ বাড়িতেই চল।
ওরা ঐ বাড়ির দরজার কাছে এল। বাইরের দরজা খোলা। দেখল একজন মাঝবয়সীস্ত্রী লোক উঠোনে পাতা মোটা কাপড়ের ওপর বসে আসন বুনছে। দুটি ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি করেছে।
দরজায় ফ্রান্সিসদের দেখে মহিলাটি একটু চমকালো। ফ্রান্সিসদের বিদেশী পোশাকই তার কারণ।
মহিলা দরজার কাছে এগিয়ে গেল। হ্যারি মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল–মা, আমরা বিদেশি। সেই কানজেন রাজ্য থেকে আসছি। আমরা খুবই ক্ষুধার্ত। খাদ্য চাই। বিশ্রাম চাই। আপনি কি তার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
একটু চুপ করে থেকে মহিলা বলল–আমার স্বামী তো কাজে গেছে। সে থাকলে ভাবতাম না। কিন্তু তোমরা বিদেশী অতিথি। তোমাদের কি না খাইয়ে ফেরাতে পারি? তোমরা উঠোনে বসো। আমি সব জোগাড়-টোগাড় করছি।
মহিলাটি উঠোনে আর একটা মোটা চাদর বিছিয়ে দিল। ফ্রান্সিসরা বসল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল।
মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তখনই একটি বড় মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলতে লাগল। ফ্রান্সিসরা কেউ কেউ ছেলেমেয়ে দুটিকে ডেকে নিয়ে আদর করল।
কিছুক্ষণ পর মহিলাটি ঝোলাভর্তি বোধহয় আলুটালু, আনাজ নিয়ে ঢুকল। বলল– তোমাদের ভাগ্য ভাল মাছ পেয়েছি।
রান্না চলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্না হয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা উঠোনেই খেতে বসল। মাছ ঝোলতরকারি শাক দিয়ে ফ্রান্সিসরা মোটামুটি পেট পুরেই খেল।
ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল।
বিকেল হল। মহিলাটির স্বামী ফিরল। হ্যারি গৃহকর্তার কাছে গেল। বলল–আমরা বিদেশী। আপনার বাড়িতে অতিথি হয়েছি। আপনার স্ত্রী আমাদের খেতে দিয়েছেন। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। সন্ধ্যে হলেই আমরা চলে যাবো।
–রাতেও থেকে যেতে পারেন। গৃহকর্তা হেসে বলল।
–না। আমাদের তাড়া আছে। হ্যারি বলল।
শাঙ্কো কোমরবন্ধনী থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে বলল–এটা আপনাকে নিতেই হবে।
-না-না। আপনারা অতিথি। ভদ্রলোক বললেন।
–তবু কিছু তো কেনাকাটা করতে হয়েছে। নিন। শাঙ্কো বলল।
–বেশ। দাও। গৃহকর্তা সোনার চাকতি নিল।
সন্ধ্যে হল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–আর দেরি নয়। ছোটো। রাজা কাদর্জার সেনাপতির রাজত্বে ছুটে আমরা দক্ষিণ দিকে চলে যাবো। সেখানে পাহাড়ি এলাকায় কোন গুহায় আশ্রয় নেব।
ফ্রান্সিসরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তারপর অন্ধকারে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সৈন্যাবাসের কাছে এল। ফ্রান্সিসরা গলা চড়িয়ে বলল–কেউ দাঁড়িয়ে পড়বেনা। সমান গতিতে ছুটবে।
সৈন্যাবাস থেকে কয়েকজন সৈন্য অলস দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসদের দৌড়ে যেতে দেখল। ফ্রান্সিসরা দৌড়ুচ্ছে কেন ওরা বুঝল না।
পাহাড়ি এলাকার কাছাকাছি এসেছে তখনই সেনাপতির একদল সৈন্যকে দক্ষিণ দিক থেকে আসতে দেখা গেল। সৈন্যদের কয়েকজন ফ্রান্সিসদের চিনল। ওরা নিরস্ত্র। খালি হাতে ফ্রান্সিসদের ধরতে এল। খালি হাতে লড়াই লেগে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন সৈন্য আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
ফ্রান্সিসরা আর দাঁড়ালনা। আবার ছুটতে শুরু করল। সৈন্যরা আর পিছু ধাওয়া করল না।
ম্লান জ্যোৎস্নায় পাহাড় জঙ্গল এলাকা দেখা গেল।
ফ্রান্সিস স্থির করেছিল পাহাড়ের কোন গুহায় ওরা আত্মগোপন করবে। দিনকয়েক অপেক্ষা করে রাজা পারকোনের খোঁজ করবে। রাজা পারকোনকে পেলে তার সৈন্যদের জড়ো করবে। নিজেরাও যুদ্ধের জন্য তৈরি হবে। রাজা কাদর্জা তার সেনাপতি আভিন্দাকে এই রাজ্যের রাজা করে দিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস স্থির করল আভিন্দার সৈন্যদলকে আক্রমণ করবে। এখন ওরা নিশ্চিন্ত। এই সুযোগেই আক্রমণ করতে হবে।
ফ্রান্সিসরা ঝোঁপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহাড়টার ঢালের দিকে চলল। ওরা অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিল যে বর্তমান রাজা আভিন্দার সৈন্যদের মুখোমুখি হতে হবেনা। ওরা নিশ্চিন্ত মনেই বনের মধ্য দিয়ে চলল। বনজঙ্গল শেষ হতেই ওদের থমকে দাঁড়াতে হল। সামনেই পাহাড়ের পাদদেশে রাজা আভিন্দার একদল সৈন্য বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে। এই আকস্মিক ঘটনায় নিরস্ত্র ফ্রান্সিসরা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। ওদের ওপর পাথর ছোঁড়ো। ভাইকিংরা সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে রাজা আভিন্দার সৈন্যদের দিকে ছুঁড়তে লাগল। এবার আভিন্দার সৈন্যরাও ফ্রান্সিসদের দিকে পাথর ছুঁড়তে লাগল। পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি চলল। দুপক্ষেই কয়েকজন আহত হল।
শাঙ্কো আর বিস্কো পাহাড়ের ধার থেকে একটা বড় পাথরের চাই ঠেলে গড়িয়ে দিল। পাথরের চাই গড়িয়ে আভিন্দার সৈন্যদের ওপর পড়ল। সবাই সরে যেতেও পারল না। পাথরের চাঁই-এর নিচে চাপা পড়ে কয়েকজন সৈন্য মারা গেল। কিন্তু সৈন্যরা দলে ভারি। অল্পক্ষণের মধ্যেই দ্রুত ওরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বুঝল–এখন লড়াই করতে যাওয়া বোকামি। ওদের হাতে লড়াইয়ের অস্ত্র নেই। লড়তে গেলে মরতে হবে। ততক্ষণে সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে ফেলেছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল আত্মসমর্পণ কর। এছাড়া বাঁচার কোন উপায় নেই।
ভাইকিংরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। সৈন্যদের দলনেতা এগিয়ে এল। বলল– রাজবাড়ির দিকে চলো। কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না।
সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে নিয়ে চলল। সবাই বনের মধ্যে ঢুকল। ছাড়া ছাড়া গাছের বন। বনতল ততটা অন্ধকার নয়। এখানে ওখানে ভাঙা ভাঙা রোদ দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে হ্যারি বলল ফ্রান্সিস আবার বন্দীদশা।
–পালাবার উপায় বের করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-দেখ ভেবে। হ্যারি বলল।
সবাই চলল। যেতে যেতে দু’একজন ভাইকিং বন্ধু দেশীয় ভাষায় বলল ফ্রান্সিস–লড়াই করে পালাতে পারতাম।
–না। পারতে না। লড়াই করতে গেলে বেশ কিছু বন্ধুর প্রাণ যেত। আমি সেটা চাই না। সময়সুযোগ বুঝে ঠিক পালাবো। এখন বন্দীদশাই মেনে নাও। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই চলল। রাস্তার লোকেরা ওদের দেখে একটু অবাকই হল। এই বিদেশীরা এখানে কেন?
সবাই পাথরের সিঁড়ি দিয়ে গর্ভগৃহে নেমে গেল। রাজসভার একপাশে ফ্রান্সিসদের দাঁড় করিয়ে রাখা হল। ফ্রান্সিস তখনও ভেবে পাচ্ছে না রাজা আভিন্দা ওদের নিয়ে কী করবে। বন্দী করে রাখবে না মুক্তি দেবে। তবে এটাও বুঝল মুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম। ওদের কয়েদঘরেই পাঠানো হবে।
বিচারসভা শেষ। সৈন্যদের দলনেতা এগিয়ে গিয়ে রাজা আভিন্দাকে কিছু বলল। রাজা ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল।
–তোমরা রাজা পারকোনের হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। রাজা আভিন্দা বলল।
–হ্যাঁ। করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? রাজা আভিন্দা বলল।
রাজা পারকোনকে একজন সৎও ন্যায়পরায়ণ রাজা বলে মনে করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা পারকোন এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
–হ্যাঁ। শুনেছি। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করে বলল।
–তোমরা ফাঁসির মঞ্চ থেকে পালিয়েছে। আভিন্দা বলল।
হা। ফ্রান্সিস আবার মাথা ওঠানামা করল।
–কিন্তু এবার আমার পাল্লায় পড়েছে। পালাবারসব রাস্তা বন্ধ করে দেব। আভিন্দা বলল।
–আপনি রাজা। নিশ্চয়ই তা পারেন। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা আভিন্দা দলনেতার দিকে তাকাল। বলল–সব কটাকে কয়েদঘরে ঢোকাও। পরে ফাঁসিতে লটকাবো।
দলনেতা ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–চলো সব।
ফ্রান্সিসরা দলনেতার পেছনে পেছনে চলল। কয়েকজন সৈন্য বর্শা হাতে ফ্রান্সিসদের পেছনে পেছনে চলল। বোঝা গেল আভিন্দা ওদের পালাবার কোন সুযোগই দেবে না।
গর্ভগৃহের একটা ঘরের সামনে এল সবাই। ঘরটার দরজা লোহার। দরজায় তালা ঝুলছে। দুজন প্রহরী বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে। একজন চাবির গোছা কোমর থেকে খুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তালা খুলল। দলপতি হাতের ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকতে বলল। ফ্রান্সিসরা একে একে ঘরটায় ঢুকল। ঘরে একটা মশাল জ্বলছে। মশালের অলোতে দেখা গেল ঘরটা বেশ ছোট। পাথর কাটা দেয়াল। মেঝেয় গম গাছের শুকনো পাতা বিছানো। দুজন বন্দী শুয়ে আছে। ফ্রান্সিসদের ঢুকতে দেখে ওরা উঠে বসল। ফ্রান্সিসরা বসল। বেশ অসুবিধার মধ্যেই বসতে হল। ঘরের ঐ ছোট মেঝেয় ছড়িয়ে বসার উপায় নেই। ফ্রান্সিস দুপা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল। ভাইকিং বন্ধুরাও কেউ কেউ হাত পা গুটিয়ে কেউ কেউ কুকুর কুণ্ডলী হয়ে শুল। হ্যারি ফ্রান্সিসের পাশেই বসে ছিল। বলল–পালানোর উপায় ভাবো।
বন্দী হবার সময় থেকেই ভাবছি। এবার সব ভালোভাবে নজর দিতে হবে। দেখা যাক–কোন ফাঁক পাই কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
বিকেল হল। প্রহরীরা বিকেলের খাবার দিয়ে গেল। পোড়া রুটি আনাজপাতির ঝোল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা গোগ্রাসে খেল। অনেকে আবার খাবার চাইল। প্রহরীরা কোন কথাই বলল না। চলে গেল। অগত্যা অপেক্ষা করতে হবে রাতের খাবারের জন্যে।
কয়েকদিন কাটল। শুয়ে বসে। আভিন্দা মাত্র একদিন এসেছিল। হেসে বলেছিল– রাজা কাদর্জা শুনেছেন তোমাদের বন্দী করা হয়েছে। আমাদের একসঙ্গে ফাঁসি দেবার দিন স্থিরকরবেন রাজা কাদর্জাই। এরকম একটা গণফাঁসি দেখবার জন্যে উনি উগ্রীবহয়ে আছেন। মানুষের মৃত্যু দেখতে উনি খুব ভালোবাসেন। ফ্রান্সিসরা কেউ কোন কথা বলল না।
–দেখা যাক রাজা কাদর্জা কোনদিনটা স্থির করেন? আভিন্দা হেসে বলল।
–দিনটা রাজা কাদর্জার জন্মদিন হলে ভালো হয়। হ্যারি বলল।
–ব্বাঃ আভিন্দা প্রায় লাফিয়ে উঠল–ভালো বলেছো তো। এ মাসের বাইশ তারিখ রাজা কাদর্জার জন্মদিন। আজকে আঠারো তারিখ। মাত্র চারদিন পরে। ব্বাঃ। আজকেই এই কথাটা রাজা কাদর্জাকে বলার জন্যে তোক পাঠাবো। এবার ফ্রান্সিস বলল–এখানে কি অন্য কোন কয়েদঘর নেই?
–কেন বলো তো? রবার্তো বলল।
–এই ছোট ঘরটায় আমাদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।
আভিন্দা হা হা করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল–আর তো মোটে তিন রাত বেঁচে থাকবে। চারদিনের দিন তো তোমাদের জীবন শেষ। একটা দিন একটু কষ্ট করে থাকো। ফ্রান্সিসরা আর কেউ কোন কথা বলল না।
আভিন্দা চলে গেল। যাবার সময় প্রহরীদের বলে গেল–কড়া পাহারায় রাখছি। একজনও যাতে পালাতে না পারে। যদি পালায় তোরা মরবি।
রাতে খাওয়া শেষ হল। হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস।
–হুঁ। বলো!
–রাজা কাদর্জা নরপশু। সে গণ ফাঁসি দেখার জন্যে মুখিয়ে আছে। তার আগেই আমাদের পালাতে হবে। গভীরভাবে ভেবে উপায় বের কর। হ্যারি বলল।
উপায় একটা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–উপায় আছে? হ্যারি সাগ্রহে বলল।
–হ্যাঁ। তবে পালানো নয়। অন্যভাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কীভাবে? হ্যারি জানতে চাইল।
–রাজা আভিন্দাকে লোভানি দিতে হবে। ধনভাণ্ডারের লোভ বড় সাংঘাতিক। ফ্রান্সিস বলল।
পারবে ওকে কব্জা করতে? হ্যারি বলল।
–অবশ্যই পারবো। কাল সকালে রাজা আভিন্দার সঙ্গে কথা বলবো। দেখা যাক ও কতটা লোভী হয়।
পরদিন সকালের খাবার খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। প্রহরী এগিয়ে গেল। কিন্তু ফ্রান্সিসের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বুঝল প্রহরীরা খুব সাবধান হয়ে গেছে।
রাজা আভিন্দাকে একবার আসতে বলো।
–কেন? প্রহরী বলল।
–সেটা রাজাকেই বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা এখন রাজসভায় বসবেন। প্রহরী বলল।
–বিচারটিচার সেরেই যেন আসেন। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার কথায় রাজা আসবেন না। প্রহরী বলল।
–তুমি গিয়ে বলবে এই গর্ভগৃহের গুপ্ত ধনভাণ্ডার নিয়ে আমি কথা বলবো। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল।
–বেশ। বলে দেখি। প্রহরী বলল।
প্রহরী আর একজন প্রহরীকে পাহারায় রেখে চলে গেল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে প্রহরীটি ফিরে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–রাজা আসছেন। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল–বোঝ ধনলিপ্সা কী জিনিস। রাজকার্য ছেড়ে রাজা ছুটে আসছে।
ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতেই রাজা আভিন্দা এসে হাজির। হেসে বলল—গুপ্ত ধনভাণ্ডারের ব্যাপারে তোমরা কী বলতে চেয়েছো শুনলাম।
–হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। এখানকার গর্ভগৃহগুলোর মধ্যে কোথাও আছে রাজা : পারকোনের পিতামহের গুপ্ত ধনভাণ্ডার। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা শুনেছো তবে। রাজা আভিন্দা বলল।।
রাজা পারকোনই বলেছেন–ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার নাম কী? আভিন্দা জানতে চাইল।
–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি পারবে সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে? আভিন্দা বলল।
–হ্যাঁ। পারবো। ফ্রান্সিস মাথা কাত করে বলল। এবার হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এর আগে অনেক গুপ্তধন খুঁজে বের করেছে। বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে।
–বেশ। দেখ চেষ্টা করে। আভিন্দা বলল।
–কিন্তু আমার শর্ত আছে। ফ্রান্সিস বলল।
তার মানে সেই ধনভাণ্ডার তুমি নেবে। আভিন্দা বলল।
–না। একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেব না। ফ্রান্সিস বলল।
—তবে কী শর্ত? আভিন্দা বলল।
–আমরা দুজন কয়েদ হয়ে থাকবে। বাকি আমার সব বন্ধুদের মুক্তি দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
আগে গুপ্তধন আবিষ্কার কর। তারপর তোমাদের মুক্তির কথাভাবা যাবে। আভিন্দা বলল।
–না। আগে বন্ধুদের মুক্তি চাই। ফ্রান্সিস বলল।
আভিন্দা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা তুলে বলল ঠিক আছে। আমার গুপ্তধন চাই। গুপ্তধন উদ্ধার হলে তার ভাগীদার কেউ হবে না। তুমি তো কিছুই পাবে না। আভিন্দা বলল।
–আমি কিছু চাইবোও না। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। আর একটা কথা। এই গুপ্তধনের খোঁজাখুজির ব্যাপারটা রাজা কাদর্জাকেও জানানো চলবেনা। আভিন্দা বলল।
–তার মানে আপনি একাই গুপ্তধনের সবটাই নেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা আভিন্দা হেসে বলল–তুমি বেশ বুদ্ধিমান।
বন্ধুরাও বলে বটে। ফ্রান্সিস এতক্ষনে হেসে বলল।
মনে হয়, তুমি পারবে। আভিন্দা বলল।
দেখি চেষ্টা করে। তবে আমার কিছু বলার আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বলো। আভিন্দা বলল।
–আমাদের দুজনকে সবরকম স্বাধীনতা দিতে হবে। সব গর্ভগৃহ আমরা খুঁজবো। যেখানে প্রয়োজন পড়বে যাবো। কেউ আমাদের বাধা দেবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। তবে খোঁজার কাজ সন্ধ্যার আগেই এই কয়েদ ঘরে থাকতে হবে। আর এই রাজ্যের বাইরে কোথাও যেতে পারবেনা। আভিন্দা বলল।
–বেশ। আমি মেনে নিলাম। ফ্রান্সিস মাথা কাত করে বলল।
এবার রাজা আভিন্দা প্রহরীদের দিকে তাকাল। বলল–কাল সকালে দুজন বাদে বাকি সবাইকে ছেড়ে দিবি। রাজা আভিন্দা চলে গেল।
রাতে খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস।
–হুঁ। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল।
বন্ধুরা বলছিল তোমার আমার বন্দীত্বের বিনিময়ে ওরা মুক্তি চায় না। হ্যারি বলল।
–ওরা আবেগ তাড়িত হয়ে এসব বলছে। ঠিক আছে আমি সব বুঝিয়ে বলছি। ফ্রান্সিস উঠেদাঁড়াল। ওর দেশীয় ভাষায় বলল–ভাইসব তোমরা আমাকে আর হ্যারিকে ভালোবাসো। তাই আমারা বন্দী হয়ে থাকবো এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এখন আবেগটাবেগের কথা বলল না। শোন–তোমরা মুক্তি পেয়ে জাহাজে ফিরে যাবে না। দক্ষিনের পাহাড়ের কোন গুহায় আশ্রয় নেবে। রাজা পারকোন ঐ এলাকায় কোন গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত সৈন্যরাও নিশ্চয়ই রয়েছে। তোমরা ওখানে আশ্রয় নিয়ে রাজা পারকোনোর খোঁজ করবে। সময় লাগলেও এটা করবে। রাজা পারকোনকে পেলে তার সৈন্যদের সন্ধান করে বের করবে। যত সৈন্য এভাবে জড়ো করা সম্ভব হবে। আমি সময়মত তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। তারপর দলে ভারি হয়ে আমরা রাজা আভিন্দার নিশ্চিন্ত সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। তারপর লড়াই। রাজা আভিন্দাকে এই রাজ্য থেকে তাড়াবো। রাজা পারকোনকেসিংহাসনে বসাবো। তারপর গুপ্তধন খুঁজবো। খুঁজে পাই তো রাজা পারকোনকে সব দিয়ে আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। এছাড়া অন্য কোন উপায়ে আমি হ্যারি মুক্তি পাবো না। এবার বলো আমার পরিকল্পনা সঠিক কিনা। ফ্রান্সিস থামল। বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কিছু পরে শাঙ্কো উঠে দাঁড়িয়ে বলল– ফ্রান্সিস তোমার পরিকল্পনা আমরা মেনে নিলাম। অন্য দু’চারজন বন্ধুও বলল–আমাদের কোন আপত্তি নেই।
–আমি তোমাদের কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বসে পড়ল। একটু পরেই শুয়ে পড়ল।
পরেরদিন সকালের খাবার খেয়ে ভাইকিংরা তৈরি হল। সকলেরই চিন্তা সামনে অনেক কাজ।
ঢং ঢং শব্দে কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। একজন প্রহরী দরজায় দাঁড়িয়ে বলল তোমরা কোন দু’জন বন্দী থাকবে? হ্যারি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল–ও আর আমি।
–বেশ। বাকিরা বেরিয়ে এসো। রাজার হুকুম মুক্তি পেয়ে তোমরা সবাই তোমাদের জাহাজে চলে যাবে। এই রাজ্যে থাকবেনা। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল।
এবার সবাই একে একে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল। গর্ভগৃহগুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে সিঁড়ির কাছে এল। দেখল সিঁড়ির গোড়ায় মন্ত্রীমশাই দাঁড়িয়ে। মন্ত্রীমশাইওদের দিকে তাকিয়ে বলল–সব শুনেছি। তোমাদের দুই বন্ধু কি পারবে গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে?
–চেষ্টা তো করুক। শাঙ্কো বলল।
না পারলে কিন্তু নতুন রাজা সহজে ছেড়ে দেবে না।
হতে পারে। তবে আমাদের দুই বন্ধুকে কয়েদঘরে রাখা অসম্ভব। শাঙ্কো বলল।
দেখা যাক। মন্ত্রী বললেন।
সিঁড়ি দিয়ে শাঙ্কোরা ওপরে উঠে এল। চলল দক্ষিণমুখো রাজ্যের সীমান্তের দিকে। রাজা আভিন্দার সৈন্যরা দেখল সেটা। পাহাড়টা জঙ্গল বাঁদিকে রেখে শাঙ্কোরা অনেক দূরে চলে এল।
শাঙ্কো হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। গলা চড়িয়ে বলল–আর দূরে যাবো না। এবার পাহাড় জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে পাহাড়ে যাবো।
সবাই ফিরে দাঁড়াল। ফিরে চলল পাহাড়ের দিকে। নিঃশব্দে। পাহাড়টার তলায় এসে সবাই থামল। তারপর দল বেঁধে পাহাড়ে উঠতে লাগল। কিছুদূর উঠতেই একটা গুহা দেখতে পেল। গুহার মুখে এসে দাঁড়াল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে গুহার মধ্যে ঢুকল। বাইরের আলো থেকে এসে কিছুই দেখতে পেল না। অন্ধকার চোখে সরে আসতে দেখল গুহাটা খুবই ছোটো। ও গুহা থেকে বেরিয়ে এল। বন্ধুদের কাছে এসে বলল–গুহাটা ছোট। বড় গুহা খুঁজতে হবে। চলো সব। ওপর দিকে। ওপর দিকে উঠে ওরা গুহা খুঁজতে লাগল। পেলও একটা গুহা। শাঙ্কো গুহাটায় ঢুকতে যাবে, চারপাঁচজন যোদ্ধা খোলা বর্শা হাতে ছুটে এল। বন্ধুরা দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো যোদ্ধাদের দেখেই বুঝল–ওরা রাজা পারকোনের যোদ্ধা। গায়ে নীল পোশাক। শাঙ্কো দ্রুত দুহাত ওপরে তুলে বলল–আমরা ভাইকিং। তোমাদের বন্ধু। রাজা পারকোনের যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা শাঙ্কোদের চিনল, ভাইকিং এরা শাঙ্কো এগিয়ে গেল। বলল-রাজা পারকোন কোথায়?
–এই গুহাতেই আছেন। একজন যোদ্ধা বলল।
–আমাদের তার কাছে নিয়ে চলো। শাঙ্কো বলল।
এসো। একজন যোদ্ধা বলল।
সবাই গুহার মধ্যে ঢুকল। অন্ধকার চোখে সরে আসতে সবাই দেখল একটা মোটা কাপড়ের ওপর রাজা পারকোন বসে আছেন। বেশ বড় গুহা। আর যোদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছে। একপাশে উনুন জ্বেলে রান্না হচ্ছে। শাঙ্কোর খিদে বেড়ে গেল। সেই সকালে খেয়েছে। এখন শেষ বিকেল। গুহার পাথরের গর্তে মশাল জ্বলছে।
শাঙ্কো রাজা পারকোনের কাছে গেল। রাজা পারকোন হেসে বললেন–তোমরাআমার প্রাণ বাঁচিয়েছো। তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কিন্তু মান্যবর, আপনি এখনও আপনার রাজত্ব ফিরে পান নি।
একটু চুপ করে থেকে রাজা পারকোন বললেন–সে কি আর ফিরে পাবো?
নিশ্চয়ই পাবেন। আমরা আপনাকে আপনার রাজত্ব ফিরিয়ে দেব। শাঙ্কো বলল।
–সেটা কি পারবে? রাজা পারকোন বললেন।
–সেটা নির্ভর করছে আপনার সৈন্যদল কতটা আমাদের সাহায্য করতে পারবে তার ওপর। কারণ আমরা সংখ্যায় বেশি নই। আপনার অন্য সৈন্যরা কোথায় আছে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–এই পাহাড়ের কোন গুহায় পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে। পারকোন বললেন।
—তাদের আমরা একত্র করবো। তারপর সময় সুযোগ বুঝে নতুন রাজা আভিন্দার সৈন্যদের আক্রমণ করবো। শাঙ্কো বলল।
লড়াই হবে।
নিশ্চয়ই লড়াই হবে। আমরা অবশ্যই জয়ী হবো। আপনি নিশ্চিত জানবেন। শাঙ্কো বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। রাজা বললেন।
এবার আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করুন। সেইসকালে খেয়ে বেরিয়েছি। আমরা ক্ষুধার্ত। শাঙ্কো বলল।
নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হবে। রাজা পারকোন গলা চড়িয়ে ডাকলেন।
–মিনাকা–মিনাকা রান্নার জায়গাতে ছিল। রাজার কাছে এগিয়ে এল।
–এদের খেতে দাও। রাজা পারকোন বললেন।
–এদের জন্যে রান্না করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার দেওয়া হবে। মিনাকা নিজের জায়গায় চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে মিনাকা শাঙ্কোর কাছে এল। বলল–আপনারা খেতে আসুন।
শাঙ্কোরা খেতে বসল। কোন গাছের তিনকোনা পাতা পেতে দেওয়া হল। খেতে দেওয়া হল রুটি আর আনাজপাতির ঝোল। ক্ষুধার্ত শাঙ্কোরা তাই পেট পুরে খেল। তারপর শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল।
শাঙ্কো আর দেরি করল না। মিনাকাকে নিয়ে সন্ধ্যের মুখে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে অন্য গুহার খোঁজ করতে লাগল। মিনাকাই ওকে একটু দূরের এক গুহামুখে নিয়ে এল। বলল–এই গুহাতেও কিছু সৈন্য আশ্রয় নিয়েছে। গুহামুখে দাঁড়িয়ে মিনাকা আস্তে করে নাম ধরে ডাকল। একজন যোদ্ধা বর্শা হাতে বেরিয়ে এল। মিনাকাকে দেখে বলল–এসো। মিনাকা আর শাঙ্কো গুহাটায় ঢুকল। গুহায় মশাল জ্বলছে। সেই আলোয়শাঙ্কো দেখল প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন যোদ্ধা গুহার মেঝেয় শুয়ে বসে আছে। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসবআমরা ভাইকিং। আমরা স্থির করেছিনতুন রাজা আভিন্দাকে এই রাজ্য থেকে তাড়াবো। তোমাদের সঙ্গে আমরাও লড়াই করবো। রাজা পারকোনকে তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে দেব। সময় হলেই তোমাদের ডাকা হবে। তোমরা লড়াইয়ের জন্যে। তৈরি থেকো। শাঙ্কো থামল। যোদ্ধারা কেউ কোন কথা বলল না। মিনাকা গলা চড়িয়ে। বলল–বন্ধুরা–এটাই শেষ লড়াই। আমাদের জিততেই হবে।
দুজনে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। চলল পাহাড়ের পূর্বদিকে। এবার পেল একটা ছোট গুহা। সেখানেও দশ-পনেরোজন রাজা পারকোনের যোদ্ধাদের পেল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে তাদেরও একটা কথা বলল। বেরিয়ে এল।
বাইরে চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। সেই আলোয় খুঁজে খুঁজে মিনাকা শাঙ্কোকে আর একটা গুহার মুখে নিয়ে এল। মশালের আলোয় দেখা গেল এখানেও ত্রিশ-চল্লিশজন, যোদ্ধা রয়েছে। শাঙ্কো আগের কথাগুলো বলল। যোদ্ধারা নীরবে কথাগুলো শুনল। কেউ কোন কথা বলল না।
বাইরে এসে মিনাকা বলল–আর সব.গুহা রাজা রবার্তোর রাজত্বের দিকে। ঐসব গুহায় বোধহয় কেউ আশ্রয় নেয়নি। এবার চলুন নিচের জঙ্গলে। শুনেছি সেখানেও কিছু যোদ্ধা আত্মগোপন করে আছে।
দু’জনে পাহাড় থেকে নিচের বনজঙ্গলে নেমে এল। ছাড়া ছাড়া গাছের জঙ্গল। গাছের। ডালপাতার ফাঁক দিয়ে এখানে ওখানে ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে। কিছুদূর যেতে ওরা দেখল তিন-চারটে গাছের জটলা। সেই জটলার মাথায় ডাল কেটে তৈরি ডালপাতার ছাউনি। সেই ছাউনির কাছাকাছি আসতে অন্ধকার থেকে একটা বর্শা ছুটে এল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বর্শাটা মিনাকার মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। মিনাকা চাপাস্বরে বলল–আমি মিনাকা। বর্শা ছুঁড়ো না। সেই ছাউনি থেকে দুজন যোদ্ধা বর্শা হাতে বেরিয়ে এল। ভাঙা জ্যোৎস্নায় মিনাকাকে চিনল। শাঙ্কোকে দেখিয়ে বলল–এঁরা ভাইকিং। দুঃসাহসী। তোমাদের কিছু বলবেন। শোন। শাঙ্কো চাপাগলায় আগের কথাগুলো বলল। ছাউনির ভেতর থেকে আরো কিছু যোদ্ধা বেরিয়ে এল। সবাইশাঙ্কোর কথা শুনল। কিছু বলল না। শুধু একজন যোদ্ধা বলল–আমরা তৈরি থাকবো।
শাঙ্কোরা রাজা পারকোনের গুহায় ফিরে এল।
ওদিকে ফ্রান্সিস গুপ্ত ধনভাণ্ডারের খোঁজে সব গর্ভগৃহেই খোঁজ করতে লাগল। তিন চারদিন ধরে খোঁজ চলল। হ্যারি সঙ্গেই থাকলো।
সেদিন হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস—কিছু হদিশ করতে পারলে?
আমরা প্রথম যে গর্ভগৃহে নেমেছিলাম সেই গর্ভগৃহটা রাজা পারকোনের পিতামহ প্রথম তৈরি করেছিলেন। ওটাতেই আছে গুপ্ত ধনভাণ্ডার। এখন ঐ গর্ভগৃহের কোথায় গোপনে রাখা আছে সেই ধনভাণ্ডার এটাই খোঁজ করতে হবে। অন্য গর্ভগৃহগুলোও খুঁটিয়ে দেখেছি। সেসব গর্ভগৃহপরে তৈরি হয়েছে। কাজেই প্রথম গর্ভগৃহই খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
–সেটাই দেখা হ্যারি বলল।
–হুঁ। কিন্তু এখন শুধু খোঁজার ভান করবো। সেসব দেখে রাজা আভিন্দা খুশিই হবে। আগে লড়াই। তারপর ভালোভাবে খোঁজ করবো।
পরদিনই ফ্রান্সিসরা দেখল বেশ বড় এক সৈন্যদল সৈন্যাবাস ছেড়ে রাজা কাদর্জার রাজত্বেরদিকেচলেছে। তারমানে রাজা আভিন্দা এখন নিশ্চিন্তা ধরেই নিয়েছে আর লড়াইয়ের সম্ভাবনা নেই। কাজেই বড় একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সিসখুশিরস্বরে বলে উঠল–
–হ্যারি আমি এটাই চাইছিলাম। আভিন্দার যে সৈন্যরা রইল তারা যতটা নিশ্চিন্ত হবে ততটাই ওরা হার স্বীকার করবে। আর দেরি না। কালকে গভীর রাতে রবার্তোর সৈন্যাবাস আক্রমণ করতে হবে। দুজনে নয়। আমি কাল একা দুপুরে শাঙ্কোদের খোঁজে যাবো। খবর দেব। কালকে রাতেই আক্রমণ করা হবে। আর সময় নষ্ট করবো না।
পরদিন দুপুরে ফ্রান্সিস একজন প্রহরীকে বলল–আমি ঐ পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে যাচ্ছি। গুপ্তধনের খোঁজ করতে।
তোমার বন্ধু যাবে না? প্রহরী জানতে চাইল।
—না। আমি একাই যাবো। রাজা জানতে চাইলে বলবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিস পাহাড়ের দিকে চলল। কিছুপরেজঙ্গলে ঢুকল। কিছুদূর যেতে যেতে ডালপালা ছাওয়া ছাউনিটা দেখল ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বর্শা হাতে তিন চারজন যোদ্ধা ছুটে বেরিয়ে এসে ফ্রান্সিসকে ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসও সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে চাপাস্বরে বলে উঠল–আমি ভাইকিং। তোমাদের বন্ধু। যোদ্ধারা বর্শা নামাল। ফ্রান্সিস বলল–আজ গভীর রাতে নতুন রাজা আভিন্দার সৈন্য রাজা কাদর্জার রাজ্যে চলে গেছে। ওদের সৈন্য সংখ্যা কমে গেছে। এখনই লড়াইয়ের ঠিক সময়। রাজা আভিন্দা ছেড়ে যেতে বাধ্য। তোমাদের ঠিক সময়ে ডাকা হবে। তোমরা লড়াইয়ের জন্যে তৈরি থাকবে। আমি রাজা পারকোনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো উনি কোথায় আছেন? একজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। বলল–চলুন। রাজা পারকোনের কাছে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
তাহলে খুবই ভালো হয়। ফ্রান্সিস বলল।
যোদ্ধাটি এগিয়ে চলল। পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসও চলল।
বনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে যোদ্ধাটি বলল–তাহলে আপনি কিছু সৈন্যকে চলে যেতে দেখেছেন।
-হ্যাঁ। রাজা আভিন্দার সৈন্য সংখ্যা কমে গেছে। এই সুযোগ আর আসবে না।
বনের পরে যোদ্ধাটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিসও চলল।
একসময় ওরা রাজা পারকোনের গুহার সামনে এল। দু’জন যোদ্ধা বা হাতে ছুটে এল। যোদ্ধাটিকেবিকেলের আলোয় দেখে বশানামাল।
দু’জনে গুহার মধ্যে ঢুকল। শাঙ্কো ছুটে এল। ফ্রান্সিসের হাত ধরে রাজা পারকোনের কাছে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে রাজা আভিন্দার সৈন্যসংখ্যা কমে যাওয়া আর আক্রমণের পরিকল্পনা সবই বলল।
-সন্দেহ নেই বর্তমান অবস্থা আমাদের অনুকুলে। কিন্তু পারবে কি ওদের হারাতে? রাজা পারকোন বললেন।
অনায়সে পারবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার রাজ্য আপনাকে ঠিক ফিরিয়ে দিতে পারবো। নতুন রাজা আভিন্দাকে এই রাজ্য থেকে তাড়াবো। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখো চেষ্টা করে। পারকোন বললেন।
ফ্রান্সিস এবার শাঙ্কোর দিকে তাকাল। বলল রাজার সব সৈন্যকে বলেছো এই লড়াইয়ের কথা?
–হ্যাঁ বলেছি তৈরি থাকতে। সময়মতো সবাইকে জমায়েত করবো। শাঙ্কো বলল।
আজ গভীর রাতে আক্রমণ করবো। তুমি সবাইকে জড়ো করে রাজা আভিন্দার সৈন্যাবাসের পেছনে নিয়ে আসবে। তারপর নিদ্রিত সৈন্যদের ওরা কিছু বোঝার আগেই আক্রমণ করবো। বুঝেছো? ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তুমি কয়েদঘর থেকে বেরোবে কী করে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–আমি আর কয়েদঘরে ফিরে যাবো না। সন্ধ্যের পর থেকেই সৈন্যাবাসের পেছনের দিকে চেষ্টনাট গাছটার নিচে থাকবো। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু হ্যারি একা থাকবে। ওর কোন বিপদ হবে না তো। শাঙ্কো বলল।
–না। কারণ রাজা আভিন্দা ধরে নেবে বন্ধুকে কয়েদ রেখে পালাবো না। ঠিক ফিরে আসবো। তাছাড়া শুধুআজকের রাতটা। কাল ভোরের এই রাজ্যের ইতিহাস পাল্টেযাবে। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক আছে। আমরা শেষ রাতে যাবো। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। বলল–মাননীয় রাজা আমি যাচ্ছি। কাল সকালে আপনি আবার এই রাজ্যের রাজা হবেন।
ভাইকিং বন্ধুদের কাছে এল ফ্রান্সিস। বলল ভাইসব–শাঙ্কোকে সব বলে গেলাম। ও যা বলবে শুনবে। শক্ত দেহমন নিয়ে লড়াই করবে। আমাদের জয় হবেই।
–ফ্রান্সিস–তোমার জন্যে আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত। বিস্কো বলল।
–সেটা জানি বলেই আজকে রাতের লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস গুহার বাইরে এল। মিনাকা এগিয়ে এল। বলল চলুন আপনাকে অন্য দিক দিয়ে পাহাড় থেকে নামিয়ে দিচ্ছি যাতে রাজা অভিন্দার সৈন্যদের নজরে না পড়েন। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস কিছু জংলা গাছের ডাল দিয়ে আস্তে আস্তে রাজা আভিন্দার সৈন্যদের আবাসের পেছনে চেস্টনাট গাছটার নিচে পাতলা ডালপাতার আড়াল তৈরি করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ওখান থেকে সৈন্যবাসে সৈন্যদের চলাফেরা কথাবার্তারশব্দ পাচ্ছিল।
রাত হল। সৈন্যাবাসে ঘন্টা বাজল। রাতের খাওয়া শুরু হল। খাওয়াদাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিসদের ক্ষুধাবোধটা এবার মাথা চাড়া দিল। কিন্তু আজ রাতে কিছু খাওয়া হবে না। একেবারে নির্জলা উপোস।
সৈন্যরা যে যার ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক নিস্তব্দ হয়ে গেল। শুধু দূরের বন থেকে ভেসে আসছে গাছের ডালপাতায় বয়ে যাওয়া বাতাসের শশন্ শব্দ।
ফান্সিস আকাশর দিকে তাকাল। উজ্জ্বল চাঁদ। চারদিকে জ্যোস্নার ছড়াছড়ি। তারায় ছাওয়া আকাশ। ভাবল–কোথায় আমার মাতৃভূমি। আর কোথায় আমি ডালপাতার আড়ালে ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। অপেক্ষা করছি এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের জন্য। যদি এই লড়াই করতে গিয়ে মরে যাই। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে এই চিন্তাটা তাড়াল।
রাত গভীর হল। ফ্রান্সিস পাশ ফিরে পাহাড়ের দিকে তাকাল। শাঙ্কোরা এখনও আসছেনা।
কিছু পরেই ও ফিস্ ফিস্ ডাক শুনল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। দেখল, বন্ধুরা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে বর্শা হাতে রাজা পারকোনের যোদ্ধারা। সংখ্যায় তারা কম নয়।
চাঁদের আলোয় সবই দেখা যাচ্ছিল। ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে সৈন্যবাসের সামনের দিকে সবাইকে যেতে ইঙ্গিত করল। সৈন্যাবাসের বারান্দায় উঠে ফ্রান্সিস সবাইকে ভাগ ভাগ করে ঘরের দরজার সামনে দাঁড় করাল। দু’জন যোদ্ধাকে দাঁড় করালো অস্ত্রঘরের সামনে কে কোন প্রহরী ছিল না।
এবার ফ্রান্সিস চাপা গলায় যোদ্ধাদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বলল–দরজা বন্ধ থাকলে লাথি মেরে ভাঙো। ঘরে ঢুকে আক্রমণ কর। একটু থেমে ফ্রান্সিস এবার বলে উঠল–ভাঙো একসঙ্গে।
ভাইকিংরা যোদ্ধারা একসঙ্গে দরজায় লাথি মারতে লাগল। সময়ের একটু এদিক ওদিক হতে দরজা ভেঙে যেতে লাগল। সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠবার আগেই ভাইকিংরা তরোয়াল হাতে। যোদ্ধারা বর্শাহাতে আভিন্দার সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিরস্ত্র সৈন্যরা মরতে লাগলআহত হতে লাগল। কয়েকজন সৈন্য অস্ত্রঘরের সামনে এল। দেখল–বর্শা উঁচিয়ে দু’জন যোদ্ধা দাঁড়িয়ে। ওরা লাফ দিয়ে প্রান্তরের ওপর নামল তারপর ছুটে পালাতে লাগল। যারা মারা গেল না তেমন আহত হল না। তারা প্রান্তরে নেমে ছুটে পালাতে লাগল। আহতদের আর্তনাদে গোঙানিতে ভরে উঠল সৈন্যাবাস। আভিন্দার সৈন্যরা সহজেই হার স্বীকার করল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বললআর কাউকে হত্যা করবে না। বন্দী কর। ভাইকিংরা সৈন্যাবাসের মালখানা থেকে দড়ি নিয়ে এল। আভিন্দার সৈন্যদের বন্দী করতে লাগল।
ওদিকে গর্ভগৃহের সৈন্যাবাসের সৈন্যরা এই লড়াইয়ের শব্দ চিৎকার আর্তনাদ অস্পষ্ট শুনল। এই গর্ভগৃহে বেশি সৈন্যদের রাখা যাচ্ছিল না বলে রাজা আভিন্দা ওপরে সৈন্যদের জন্য বাড়ি তৈরি করিয়েছিল। সেই সৈন্যরা হেরে গেল। এবার গর্ভগৃহের সৈন্যাবাস থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে এল। প্রান্তরের ওপর আসতে ফ্রান্সিস এক বন্ধুর হাত থেকে তরোয়াল নিয়ে ওদের দিকে ছুটে গেল। বাঁ হাত তুলে বলে উঠল–তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। লড়াই করতে এলে কেউ বাঁচবে না। ওপরের সৈন্যাবাসের সবাই হার স্বীকার করেছে। তোমরাও আত্মসমর্পণ কর। লড়াই মৃত্যু রক্তপাত আমরা চাইনা।
সৈন্যরা থমকে দাঁড়াল। দেখল ভাইকিংরা রাজা পারকোনের সৈন্যরা ওদের চেয়ে অনেক বেশি। ওদের জেতার কোন উপায় নেই। একজন সৈন্য তার বর্শা মাটিতে ফেলে দিল। একে একে সবাই বর্শা ফেলে দিল। সবাইকে বন্দী করা হল।
তখন আকাশ সাদাটে হয়ে গেছে। পূর্ব আকাশেকমলা রং ধরেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই।
ওদিকে বাইরের লড়াইয়ের শব্দ রাজা আভিন্দার কানে এল। সে বিছানা ছেড়ে উঠে সৈন্যাবাসের দিকে গেল। একজন সৈন্যও নেই। তাহলে ওপরে লড়াই চলছে।
আভিন্দা ওপরে উঠে এল। তখন সূর্য উঠেছে। নিস্তেজ রোদ পড়েছে প্রান্তরে সৈন্যাবাসে। সেই আলোয় রাজা আভিন্দা দেখল তার সৈন্যরা সব বন্দী। তখনও আহতদের গোঙানি শোনা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসেরদিকেতাকিয়েআভিন্দাবলল–আমার সৈন্যরা হেরে গেছে।
-হ্যাঁ। আপনার হাত বাঁধবো না। তবে আপনাকে এই মুহূর্তে যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় জামিনায় আপনার নরপশু রাজা কার্জার কাছে চলে যেতে হবে। আবার রাজা পারকোন এখানকার রাজা হবেন।
কিন্তু গুপ্তধন? আভিন্দা বলল।
–গুপ্তধনের আশা ছাড়ুন। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে গুপ্তধন খুঁজে দেবে বলে তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছিলে? আভিন্দা বলল।
হ্যাঁ। আপনাকে এখান থেকে তাড়াতে। তবে সেই গুপ্তধন আমি নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবো। তবে সেটা পাবেন রাজা পারকোন। আপনি বা কাদর্জা নন।
আভিন্দা ভালো করেই বুঝল লড়াইয়ে সে হেরে গেছে। এখন এই রাজত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। বলা যায় না যেতে না চাইলে হয়তো এরা তাকে ফাঁসিও দিতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত সম্পদ কিছু নিয়ে যেতে পারবো না? আভিন্দা জানতে চাইল।
না। যে পোশাক পরে যে ভাবে আছেন সেই ভাবেই এই রাজ্য আপনাকে ছেড়ে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
আভিন্দা আর কিছু বলল না। প্রান্তরের ওপর দিয়ে উত্তরমুখো হেঁটে চলল। ফ্রান্সিস আভিন্দার বন্দী সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল–আভিন্দার সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও বিদেয় হও। আর এখানে লড়াই করতে এসো না।
বন্দী সৈন্যরা আভিন্দার পেছনে পেছনে চলল। কিছুপরে ওরা প্রান্তরের শেষে চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকাল। বলল–শাঙ্কো তুমি রাজা পারকোনের গুহায় যাও। রাজাকে সসম্মানে এখানে নিয়ে এসো। এখন আমার দুটো কাজ–রাজা পারকোনকে তার রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া আর গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার।
শাঙ্কো কিছু বলল না। চলল উত্তরমুখো পাহাড়টার দিকে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–রাজা পারকোনের সৈন্যদের আর বন্ধুদের বলছি–যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। পারকোনের সৈন্যরাও বর্শা উঁচিয়ে হৈ হৈ করে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–এবার তোমরা বিশ্রাম করতে পারো। বন্ধুরা, সৈন্যরা চলে গেল।
ফ্রান্সিস প্রান্তরেই দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে শাঙ্কোর সঙ্গে রাজা পারকোন এলেন। প্রায় ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরলেন। বলে উঠলেন সাবাস ফ্রান্সিস। তোমার জন্যেইআমি আমার রাজত্ব ফিরে পেলাম।
–এবার গর্ভগৃহে আপনার রাজসভাঘরে চলুন। আপনাকে আপনার সিংহাসনে বসিয়ে আমি আমার কর্তব্য শেষ করতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। চলো। রাজা পারকোন বললেন।
সম্মুখে রাজা পারকোন পেছনে ফ্রান্সিস শাঙ্কোরা এগিয়ে চলল গর্ভগৃহের দিকে। সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামল। রাজসভাঘরে এল। রাজা পারকোন গিয়ে সিংহাসনে বসলেন। তখনই মন্ত্রীমশাই এলেন। শাঙ্কো তাকে ধরে ধরে মন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দিলেন।
মন্ত্রী ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি আমাদের মহামান্য রাজাকেতার রাজত্ব ফিরিয়ে দিলে। কিন্তু আর একটা কাজ যে রইল।
গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করা। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যা–মন্ত্রী বললেন।
এবার খোঁজাখুঁজি শুরু করবো। ফ্রান্সিস বলল।
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি যেন সফল হও। মন্ত্রী বললেন।
–মহামান্য রাজা–ফ্রান্সিস বলল–আমি সব গর্ভগৃহই খুঁজেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই গর্ভগৃহগুলোর কোন একটাতেই আছে গুপ্ত ধনভাণ্ডার। এবার আমার একটা প্রশ্ন প্রত্যেক গর্ভগৃহের পাথুরে ছাদে আছে ঢালুর মত কিছু। ওগুলো কী?
ওগুলো আমাদের রাজবংশের প্রতীক চিহ্ন। তাছাড়া ওগুলোর ফাকফোকর দিয়ে বাইরের বাতাসও চলাফেরা করে। রাজা পারকোন বললেন।
এছাড়া ওগুলোর আর কোন গুরুত্ব নেই? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না। পারকোন মাথা নাড়লেন।
–ওগুলো সবই কি পাথরের? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। পাথর কেটেই ওগুলো বানানো হয়েছে। রাজা বললেন।
–কে তৈরি করে বসিয়েছিলেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
আমার প্রপিতামহ। উনিই ওগুলো তার আদেশেই তৈরি হয়েছিল এবং লাগানো হয়েছিল। রাজা বললেন।
–আপনি নিজে কি কখনও ওগুলো ওপরে উঠে কাছ থেকে দেখেছিলেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না–না। অত উঁচুতে উঠে–প্রয়োজন মনে করি নি। রাজা বললেন।
–আমি ঐ প্রতীক চিহ্নগুলো কাছ থেকে ভালো করে দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। দেখো। কথাটা বলে রাজা পারকোন সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মন্ত্রীও উঠে দাঁড়ালেন।
রাজা বললেন–আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এলেন। পেছনে মন্ত্রী। দুজনে সিঁড়ির দিকে চললেন। সভা ভঙ্গ হল।
ঘরে এসে ফ্রান্সিস শুকনো গম পাতার বিছানায় শুয়ে পড়ল। হ্যারি এসে পাশে বসল। বলল–কিছু সূত্রটুত্র পেলে?
না। এখনও পাই নি। তবে গর্ভগৃহগুলো আমি মোটামুটি তন্নতন্ন করে দেখেছি। কিন্তু ধনভাণ্ডার গুপ্তভাবে রাখা যায় এমন কোন জায়গা পাইনি। বাকি আছে ঐ রাজকীয় প্রতীকচিহ্নগুলো খুঁটিয়ে দেখতে। ফ্রান্সিস বলল।
অত উঁচুতে? কী করে দেখবে? হ্যারি বলল।
–মই বানাবো। গাছের ডাল কেটে। জোড়া দিয়ে দিয়ে মই তৈরি করবো। তারপর মইয়ে উঠে ঐগুলো দেখবো। শাঙ্কোকে বল মন্ত্রীমশাইকে বলে দুটো কুড়ুলের ব্যবস্থা কর। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো চলল কুড়ুল আনতে। মন্ত্রীর নির্দেশে দুটো কুড়ুল পেলও।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কুড়ুল নিয়ে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এল। চলল পাহাড়টার নিচে জঙ্গলের দিকে। খুঁজে খুঁজে দুটো টানা লম্ফ গাছ পেল। ফ্রান্সিস কুড়ুল চালিয়ে গাছটা কাটল। দুভাগ করল। খ খ করে ডাল কাটল সিঁড়ির জন্যে। তারপর সেগুলো বুনো, শুকনো লতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উঁচু মই হয়ে গেল।
মই নিয়ে ফিরে এল দুজনে। ফ্রান্সিস বলল–প্রথমে দূরের গর্ভগৃহগুলো দেখবো। চলো।
দূরের গর্ভগৃহটায় এল দুজনে। মেঝেয় এসে দাঁড়াল। গর্ভগৃহের লোকেরা বেশ অবাক হয়েই ওদের কা দেখতে লাগল। মই পাতা হল। ফ্রান্সিস সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বেয়ে পাথুরে ছাদের কাছে উঠে গেল। তারপর হাত বাড়িয়ে ঢালমত প্রতীকটা ধরল। ওটার ফোকরগুলোয় হাত রাখল। বাতাস লাগল হাতে। জোর বাতাস নয়। হালকা বাতাস। ফ্রান্সিস হতাশ হল। তাহলে হাওয়া চলাচলের জন্যেই প্রতীকগুলো গেঁথে বসানো হয়েছে।
— ফ্রান্সিস মই বেয়ে নেমে এল। শাঙ্কো বলল–তাহলে হাওয়া চলাচলের জন্যেই ওগুলো গাঁথা হয়েছে।
-হ্যাঁ। তাই তো দেখলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–অন্য গর্ভগৃহগুলো দেখবে? শাঙ্কো বলল।
হা। একটা প্রতীক পাবোই যেটা অন্য কারণে গাঁথা হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে সব কটাই খুঁটিয়ে দেখতে হয়। শাঙ্কো বলল।
–তাই দেখবো। চলো ফ্রান্সিস বলল।
পরের গর্ভগৃহে এল। ফ্রান্সিস মই বেয়ে উঠল। ততক্ষণে গর্ভগৃহের অধিবাসীরা মই ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস মইয়ে চড়ে কী দেখছে সেটা ওরা বুঝল। জন্মাবধি ঐ প্রতীকচিহ্ন ওরা দেখে আসছে। কারো মনেই কোনদিন ওটা নিয়ে কোন ঔৎসুক্য জাগে ওরা বুঝল না এই বিদেশীরা ওটা এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কেন।
এবারও ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে মৃদু বাতাস অনুভব করল। তাহলে এগুলো হাওয়া চলাচলের জন্যেই গাঁথা হয়েছে। প্রতীকচিহ্নও রাখা হল আবার ফোকর রেখে বাতাস চলাচলের পথও হল।
একে একে সব গর্ভগৃহের প্রতীকগুলোই দেখা হল। কিন্তু কোন প্রতীকচিহ্নেইনতুনত্ব কিছু নেই। একইরকমভাবে তৈরি সব। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। তবে কি কোন গর্ভগৃহের দেওয়ালে লুকোনো কোন গর্ত আছে? তাহলে তো এবার দেওয়ালগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল সে কথা।
শাঙ্কো বলল–তাহলে তো সেভাবেই সন্ধান চালাতে হবে।
–তার আগে প্রথম গর্ভগৃহটা দেখতে হয়। এটাই দেখা বাকি। এই গর্ভগৃহটাই রাজা পারকোনের পিতামহ প্রথম তৈরি করেছিলেন। এখানেই রাজাদের সভাঘর। রাজা পারকোনের পূর্বপুরুষরা এই গর্ভগৃহের সিংহাসনে বসেই রাজত্ব করে গেছেন। কাজেই এই গর্ভগৃহের গুরুত্ব রয়েছে। চলো।
প্রথম গর্ভগৃহটায় নামল ওরা। সভাঘরের ওপাশেই যোদ্ধাদের থাকবার ঘর। ফ্রান্সিসরা যখন মই বসাচ্ছে তখনই দুজন তিনজন করে যোদ্ধারা মইয়ের কাছে এসে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস সিঁড়ির মাথায় চলে এল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল এই প্রতীকচিহ্নে কোন ফোকর নেই। এটা অন্যরকম। হাত দিয়ে ছুঁতেই হাত পিছলে গেল। পাথর নয় কাঁচ। কাঁচের তৈরি এই প্রতীকচিহ্ন। কালো রং করা। তার ভেতরটা অস্পষ্ট। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সবগুলো পাথরের। এটা কাঁচের কেন? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাহলে কি এর ভেতরেই কি রাখা আছে গুপ্ত ধনভাণ্ডার?
ফ্রান্সিস নিচের দিকে তাকিয়ে ডাকল শাঙ্কো?
–বলো। শঙ্কো ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল।
–একটা পাথরের টুকরো নিয়ে এসো।
শাঙ্কো ঘরের এদিকওদিকতাকিয়ে পাথরের টুকরো খুঁজল। পেলও। পাথরের টুকরোটা নিল। মই ছেড়ে সরে যাওয়া চলবে না। কাজেই ও পাথরের টুকরোটা ফ্রান্সিসের দিকে ছুঁড়ে দিল। ফ্রান্সিস লুফে নিল। তারপর কাঁচটার ওপরের দিকে আস্তে আস্তে ঠুকতে লাগল। যোদ্ধারা অবাক হয়ে ফ্রান্সিসদের কা দেখতে লাগল।
বারকয়েক আস্তে আস্তে ঠুকে একবার জোরে ঠুকল। কাঁচ ভেঙে ফুটো হয়ে গেল। কাঁচের টুকরো নিচে পড়ল। যোদ্ধারা দেখল। পাথর থেকে কাঁচ পড়ছে। সবাই হতবাক।
ফ্রান্সিসভাঙা কাঁচের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে আবছা দেখলহীরে পান্না বসানো নেকলেস-এর অংশ। ফ্রান্সিস এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। স্থির মইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখানেই মহামূল্যবান অলঙ্কার টলঙ্কার সোনারচাকতিও থাকতে পারে। এইসবযদিনিচেপড়ে যায় তাহলে যোদ্ধারা আর সাধারণ লোকেদের মধ্যে লুঠ করার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। খুনোখুনিও লেগে যেতে পারে। এত মূল্যবান গুপ্ত ধনভাণ্ডার। লোভর্তমানুষেরা উন্মাদ হয়ে যাবে।
ফ্রান্সিস মই বেয়ে বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে এল। দু’তিনজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। একজন বলল–কী ব্যাপার? ওখানে উঠেছিলে কেন?
-বাতাস চলাচলের ফোকর ঝুঁজে গিয়েছিল। মেরামত করে দিয়ে এলাম।
-ও। যোদ্ধাটি মুখে শব্দ করল। যোদ্ধারা সাধারণ লোকেরা একজন দু’জন করে চলে যেতে লাগল।
–পেয়েছো? শাঙ্কো ওদের দেশীয় ভাষায় চাপাস্বরে বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিসও দেশীয় ভাষায় বলল–শিগগিরি রাজার কাছে যাও। রাজা যেন এক্ষুনি তার দেহরক্ষীদের নিয়ে এখানে আসেন। কোন ব্যস্ততা দেখিও না।
শাঙ্কো আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ওপরে উঠেই ছুটল রাজার গর্ভগৃহের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে রাজার শয়নকক্ষের সামনে আসছে তখনই দেহরক্ষীরা ওকে আটকাল। শাঙ্কো বলল–শিগগির রাজা পারকোনকে আসতে বলল। গুপ্তধন উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজার দেহরক্ষীরা রাজারশয়নকক্ষে ঢুকে রাজাকে সংবাদটা জানাল। শোবার পোশাক পরেই রাজা পারকোন বেশ দ্রুত শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। হেসে বললেন গুপ্তধন পাওয়া গেছে?
–হ্যাঁ। আপনি কয়েকজন সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে আসুন।
–কোথায়? রাজা জানতে চাইলেন।
–আপনার সভাগৃহের গর্ভগৃহে।
রাজা প্রহরীদের আসতে ইঙ্গিত করে সিঁড়ির দিকে চললেন।
রাজার সঙ্গে সবাই সেই গর্ভগৃহে নামল। শাঙ্কো মইয়ের নিচে তখনও কিছু অত্যুৎসাহী লোকআর যোদ্ধরা দাঁড়িয়ে আছে।
রাজাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়াল। রাজা ফ্রান্সিসকে বললেন—তুমি উদ্ধার করতে পেরেছো?
ফ্রান্সিস বলল–হ্যাঁ। তারপর ওপরের প্রতীক চিহ্নটি আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল–ওটা পাথরের তৈরি নয়। কাঁচের তৈরি। কালো রং করা। ওটা ভাঙলে মহা মূল্যবান হীরে মুক্তো সোনা ঝরে পড়বে। আপনার প্রহরীদের বলুন-সেসময় এই জায়গাটা ঘিরে রাখতে।
-বেশ। তুমি কাঁচ ভাঙো। রাজা বললেন। তারপর প্রহরীদের গোল করে দাঁড় করালেন।
ফ্রান্সিস সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। তারপর হাতের পাথরটা সজোরে কাঁচের ঢাকনাটায় ঘা মারল। কালো কাঁচ ভেঙে পড়ল। সঙ্গে ঝর ঝর করে পড়তে লাগল দামি দামি অলঙ্কার সোনা রুপোর চাকতি। মেঝের ঝরে পড়ল সেসব। যোদ্ধারা লোকেরা অবাক বিস্ময়ে সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডারের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বা শাঙ্কো অবাক হল না। এরকম দৃশ্য ওরা আগেও দেখেছে।
রাজা পারকোনও বিস্ময়ে হতবাক। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও এই গুপ্ত ধনভাণ্ডার তিনি উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি হা হা করে হাসতে হাসতে মূল্যবান হীরের অলঙ্কার মুক্তোর মালা দুহাতে তুলে তুলে রেখে দিতে লাগলেন।
তারপর হাসি থামিয়ে দুজন দেহরক্ষীকে বললেন–তোমরা এইসব একটা কাপড়ে বেঁধে নিয়ে আমার সঙ্গে চলো৷ দেহরক্ষী দুজন একটা কাপড় পেতে সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার বাঁধল। সেটা তুলে নিয়ে রাজা পারকোনের পেছনে দাঁড়াল।
এবার রাজাপারকোন ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন-তোমারও তো কিছুপ্রাপ্য হয়।
না। আমরা কিছু নেবনা। একাইবিনীত নিবেদন-রাজা তুরীন যেন তার প্রাপ্য পান।
–এই ধনভাণ্ডার আমার পূর্বপুরুষের। তুরীনের প্রাপ্য হয় কী করে? রাজা পারকোন বললেন।
–কিন্তু গুপ্ত ধনভাণ্ডারের কিছুঅংশ রাজা তুরীনও পাবেন এই কথা বলেই আপনাদের শত্রুতা আমি মিটিয়েছিলাম।
–সে পরে দেখা যাবে। রাজা পারকোন বললেন।
–ঠিক আছে। না হয় পরেই দেখবেন। ফ্রান্সিস বলল।
উদ্ধার করা ধনভাণ্ডার নিয়ে রাজা পারকোন চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–এখন আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। আর সময় নষ্ট করবো না।
গর্ভগৃহ থেকে সবাই বেরিয়ে এল। চলল দক্ষিণমুখো। ওদিকেই বন্দর, যেখানে ওদের জাহাজ রয়েছে।
কিছুদূর যেতেই পূব আকাশে কমলা রং ছড়িয়ে সূর্য উঠল। ফ্রান্সিসরা হাঁটতে লাগল।
জাহাজঘাটে যখন পৌঁছল তখন একটু বেলা হয়েছে। ফ্রান্সিসরা দেখল মারিয়া আর কয়েকজন ভাইকিং জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ভাইকিংরা জাহাজেউঠতে উঠতে ধ্বনি তুলল—ও—হো–হো। মারিয়া হাসিমুখে এগিয়েএল। ফ্রান্সিস হেসে বলল-মারিয়া এবারও আমার হাত খালি। কিছুইআনতে পারিনি।
–আমার তাতে কোন দুঃখ নেই। মারিয়া হেসেই বলল।
ফ্রান্সিস ডাকল–ফ্লেজার। ফ্লেজার এগিয়ে এল।
–এখনই জাহাজ ছাড়ো–আমাদের মাতৃভূমির দিকে। সবাই হৈ হৈ করে উঠল। তারপর যে যার কাজে লেগে গেল।
ঘর ঘর শব্দে নোঙর তোলা হল। জাহাজ চলতে শুরু করল। খুলে দেওয়া পালে জোর হাওয়া লাগল। হাওয়ার তোড়ে পালগুলো ফুলে উঠল।
পূর্ণবেগে জাহাজ সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে চলল।