Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গরুড় পুরাণ || Prithviraj Sen » Page 8

গরুড় পুরাণ || Prithviraj Sen

শ্রীহরি বললেন–এবার পাঁচ পিশাচের গল্প বলছি শোনো।

সংসারের অশান্তি সহ্য করতে না পেরে এক ব্রাহ্মণ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল এক অরণ্যে। ঘুরতে ঘুরতে গভীর অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করল। দেখতে পেল অত্যাশ্চর্য ভয়ঙ্কর দৃশ্য–গাছের ডাল থেকে ঝুলছে একটা মরা দেহ। আর পাঁচটা প্রেত সেই দেহ থেকে মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে, আর উল্লাস করছে।

ব্যাপার স্যাপার দেখে ব্রাহ্মণের পিলে চমকে গেল। সর্বাঙ্গ কঁপছে। পিশাচ তো নয়, যেন পাঁচ পাঁচটা জ্যান্ত কঙ্কাল। কোটরাগত চোখ। পেট-পিঠ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। হাড়গুলো গোনা যায়। নাকহীন।

ব্রাহ্মণকে দেখে তারা মরাটাকে ফেলে এগিয়ে এল জ্যান্ত টাটকা মাংস খাবে বলে। সরু সরু কাঠির মতো পা ফেলে ছুটে এল, লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল। এবার শুরু হল, ব্রাহ্মণকে নিয়ে টানা হাঁচড়া। প্রত্যেকেরই একই কথা–আমি আগে ধরেছি তাই আমি আগে খাব।

ব্রাহ্মণ দেখল এই প্রেত-পিশাচের হাত থেকে একমাত্র শ্রীগোবিন্দই তাঁকে রক্ষা করতে পারে, নতুবা প্রাণটা দিতে হবে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভগবানকে স্মরণ করল–হে কৃষ্ণ, হে মধুসূদন, বিপদত্তারণ, এই সঙ্কট থেকে আমাকে রক্ষা করো। তুমি আমার একমাত্র ভরসা, তুমিই অগতির গতি ।

ব্রাহ্মণের সেই আকুল প্রার্থনা আমার সিংহাসন নড়িয়ে দিল। ব্রাহ্মণকে ওই পিশাচদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেখানে গেলাম।

তখন পিশাচেরা ব্রাহ্মণকে নিয়ে আকাশপথে ওড়ার তোড়জোড় করছে, নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে খাবে বলে হয়তো। তখনই গাছের ডাল থেকে কীভাবে মরাদেহটা পড়ে গেল। পিশাচেরা তা লক্ষ্য করে ফিরে এল নীচে। একটাকে সামলাতে গিয়ে আর একটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তারা তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণকে নিয়ে ওই মরাদেহের সামনে এল।

জীবন্ত আর মৃত–দুটি দেহ নিয়ে তখন পিশাচেরা উড়ে চলেছে শূন্যপথে। আমি তাদের অনুসরণ করলাম, অবশ্য গোপনে। ঠিক সেই সময় ওই পথ দিয়ে যক্ষমণিভদ্র যাচ্ছিল। তাকে বললাম, ওই পিশাচদের হাত থেকে ওই মরদেহটা ছিনিয়ে নাও, দেখো ব্রাহ্মণের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

আমার আদেশ পেয়ে যজ্ঞ বিশাল আকারের এক পিশাচের রূপ ধরল। সে তার লম্বা লম্বা হাতে ওই শব কেড়ে নিল পাঁচ পিশাচের কাছ থেকে।

পর্বতের মাথায় ব্রাহ্মণকে রেখে পিশাচেরা মণিভদ্রকে তাড়া করল। তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে তারা মানবে কেন? কিন্তু মণিভদ্রের শক্তির কাছে তারা হেরে গেল। মণিভদ্র বাগিয়ে দিল এক ঘুষি, মাথা ঘুরে পড়ে গেল সবকটা পিশাচ। মণিভদ্রও পালিয়ে গেল। তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এল পর্বতের উপর, এবার আয়েস করে ব্রাহ্মণকে খাবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ব্রাহ্মণকে স্পর্শ করতেই তারা বিদ্যুৎ পিষ্টের মতো ছিটকে গেল। তারা তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে দাঁড়াল।

পিশাচদের এমন অনুগত ভাব দেখে ব্রাহ্মণ আশ্চর্য হল।

পঞ্চ-পিশাচ বলল–হে ব্রাহ্মণ, আমাদের মাফ করুন। না জেনে আর একটা পাপ কাজ করে ফেলেছিলাম।

বিস্মিত কণ্ঠে ব্রাহ্মণ বললেন–তোমাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

–আপনার স্পর্শে আমরা গতজন্মের সব কথা মনে করতে পারছি।

ব্রাহ্মণ বললেন– তোমাদের পরিচয় কী?

–আমি হলাম পর্য্যুষিত, পিশাচদের মধ্যে একজন বলল, আর এদের নাম সূচীমুখ, শীঘ্রক, রোধক আর লেখক।

–তোমারা পিশাচ হলে কীভাবে?

প্যুষিত জবাব দিল–পিতৃশ্রাদ্ধাদি শেষ করে ব্রাহ্মণ ভোজন করলাম। কিন্তু এক ব্রাহ্মণ তখনও এসে পৌঁছাননি। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল। ওই ব্রাহ্মণের জন্য অপক্ষো না করে খেয়ে নিলাম। তারপরেই ওই ব্রাহ্মণ এসে হাজির হলেন। কিন্তু কী খেতে দেব? খাবার তো নেই, তাই পাত্রগুলোর গায়ে লেগে থাকা খাবার আর নিজের এঁটো খাবার থেকে কিছুটা নিয়ে ওই ব্রাহ্মণকে ভোজন করালাম। এ হল চরম পাপ। যার ফলে পিশাচ হলাম। সেই থেকে আমি হলাম পর্য্যুষিত।

সূচীমুখ তার কাহিনী শোনাল–ক্ষত্রিয় বংশে আমার জন্ম হলেও তার ধর্ম মানতাম নয়। ভীষণ উগ্র স্বভাব ছিল আমার। পরের ওপর অত্যাচার করে সুখ পেতাম। একবার এক ব্রাহ্মণীকে ধরে খুব আঘাত করলাম। যা কিছু ছিল, সব কেড়ে নিলাম। সঙ্গে ছিল তার পাঁচ বছরের ছোটো ছেলে। জল খেতে চাইল। কিন্তু আমি তাকে জল খেতে দিলাম না। বরং তাকে বেত দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলাম। একরত্তি ছেলে। পারে কি সহ্য করতে অত মার। ছটফট করতে করতে মারা গেল। এ দৃশ্য দেখে, ব্রাহ্মণ আর বেঁচে রইল না, একটা কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিল।

দিনের পর দিন আমার অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে লাগল। এর জন্য কোনো তাপ অনুতাপ হত না আমার। মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতাম। তাদের মুখকে সূচী করেছিলাম। তাই পিশাচত্ব লাভ করলাম, হলাম সূচীমুখ। বিশাল পিশাচদেহ পেলাম আমি, কিন্তু মুখ পেলাম ক্ষুদ্র সূচের ছ্যাদার মতো। আপনার স্পর্শে আমি পিশাচমুক্ত হলাম।

শীঘ্ৰক বলল–আমি এক নরাধম, এমনকি সারা দুনিয়া ঢুড়েও দ্বিতীয়টি পাবেন না। বণিক বংশে জন্ম নিয়েছিলাম। সর্বদা অকাজ-কুকাজে মেতে থাকতাম। একবার আমি আর আমার দাদা বিদেশে সওদা করতে গিয়ে প্রচুর মুনাফা করে ফিরে এলাম।

নদীপথে ফিরছি। মনে এক বদবুদ্ধি এল, এর কারণ আমি জানি না। ভাবলাম, দাদাকে যদি এখানেই সরিয়ে দিতে পারি, তাহলে মুনাফার অর্ধেক ভাগ দিতে হবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নৌকা নিয়ে এলাম। দাদাকে নিয়ে চূড়ায় নামলাম। তারপর দাদাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিমেষে দ্রুত লাফিয়ে উঠলাম নৌকোতে, নির্দেশ পেয়ে মাঝি নৌকো ছেড়ে দিল।

বাড়ি ফিরে এলাম। কাঁদতে কাঁদতে বৌদিকে বললাম–দস্যুদের আক্রমণ রুখতে গিয়ে দাদা মারা গেছে।

স্বামীর শোকে বৌদি কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর চিতা সাজিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিল।

ধনসম্পদ সব আমার হল। মন ভরে সব ভোগ করলাম। কিন্তু এমন মহাপাপ করলাম, যার ফলে আমি পিশাচত্ব লাভ করলাম।

এরপর চতুর্থ পিশাচের পরিচয় প্রদানের পালা। সে বলল–আমি রোধক। চাষির ঘরে জন্ম। মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে ভরা সংসার। আমার ভাই কোনো কাজকর্ম করতে চাইত না, শুধু ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসত। খাওয়ার সময় হলেই তার টিকি পাওয়া যেত। তাই তার বিষয়-আশয় আলাদা করে দিলাম। সে পৃথক হল। কয়েকদিনের মধ্যে জমি-জায়গা বিক্রি করে দিল। দুবেলা খাওয়া পর্যন্ত জুটল না। মা-বাবাকে নিয়ে আমি তখন বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছি।

ছেলে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরছে। কোনো মা-বাবা তা সহ্য করতে পারে বলুন? আমার সংসার থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে মা তার ছোটো ছেলেকে খাবার জোগাত। আমি একদিন টের পেয়ে মাকে যাচ্ছে-তাই করে বকাবকি করলাম। ওদের ঘরে আটকে রেখে দিয়ে তালা, লাগিয়ে দিলাম। সেই দুঃখে মা বাবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল।

আর আমার ভাই? সেও অনাহারে একদিন মা-বাবার পথ অনুসরণ করল। আমি হলাম পাপী পাপের ফলে হলাম পিশাচ।

–অবন্তী নগরে আমার জন্ম। পঞ্চম পিশাচ বলতে শুরু করল। রাজপুরোহিত ছিলাম। ছিলাম খুব লোভী, রাজমন্দিরে ঠাকুরের গায়ে সোনার অলংকার যা ছিল, আমি চুরি করলাম। রাজা চুরির খবর পেয়ে ঘোষণা করলেন যে চোরকে ধরতেই হবে। তাকে শূলে চড়াব।

আমার কানেও এই রাজপ্রতিজ্ঞার কথা পৌঁছে গেল। ঠিক করলাম, রাজাকে খুন করব। একদিন প্রকাশ্যে রাজবাড়িতে প্রবেশ করলাম। সকলের পরিচিত বলে কেউ বাধা দিল না আমায়। রাজার ঘরে গিয়ে পালঙ্কের নীচে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। রাত হল ক্রমশ তা ঘন হল। ধারালো অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাজার গলা কেটে ফেললাম। সেখান থেকে মন্দিরে বেরিয়ে এলাম। এসে বাকি সব গয়নাগাঁটি প্রতিমার গা থেকে চলে খুটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে নিলাম। তারপর চোরের মত সেখান থেকে চলে এলাম। বনের পথ ধরলাম। পড়লাম এক হিংস্র বাঘের মুখে। সে আমাকে ভক্ষণ করল। জীবনে যত পাপ করেছি তার যন্ত্রণা ভোগ করলাম পিশাচ হয়ে। বিগ্রহের গায়ে আঁচড় কাটায় আমি হলাম লেখক পিশাচ।

পাঁচ পিশাচের কাহিনী শেষ হল। ব্রাহ্মণ জানতে চাইল-তারা এখন কোথায় থাকে? কী খায়?

পিশাচেরা জবাবে বলল-লজ্জা, ধর্ম, ক্ষমা, ভীতি, জ্ঞান যেখানে বিরাজ করে সেখান থেকে

আমরা যোজন যোজন দূরে থাকি। এসব যেখানে নেই সেখানেই আমরা বাস করি। যা খাই তা তো নিজের চোখেই আপনি দেখলেন। অনাচারীদের রক্ত-মাংস আমরা আহার করি। আপনি একজন সিদ্ধযোগী। তাই আপনার স্পর্শে আমরা আজ ধন্য হলাম। পূর্বস্মৃতি ফিরে পেলাম।

শ্রীহরির মুখ থেকে গরুড় এই কাহিনী শ্রবণ করছিল।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–ওদের কথাবার্তা আমি অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। আমি তারপর ওদের সামনে নিজমূর্তি ধারণ করে দাঁড়ালাম। ওরা আমাকে দেখে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি তাদের নিরস্ত করলাম। ছটা দিব্য বিমানে করে ওই পাঁচ পিশাচ আর বিশ্বকসেন নামে ওই ব্রাহ্মণকে নিয়ে গেলাম বৈকুণ্ঠধামে।

গরুড় শ্রীহরির চরণে প্রণাম নিবেদন করে বলল–হে ভগবান, আপনি দয়াময়, আপনার অসাধ্য কিছুই নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *