Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গয়াপতির বিপদ || Shirshendu Mukhopadhyay

গয়াপতির বিপদ || Shirshendu Mukhopadhyay

গয়াপতির বিপদ

দারোগা গয়াপতির ভারী ফ্যাসাদ। কিছুতেই তিনি ডাকাত ঝালুরামকে ধরতে পারছেন না। ধরা দূরে থাকুক, ঝালুরামের চেহারাটা কেমন, সে কালো না ফর্সা, লম্বা না বেঁটে, হাসিখুশি না গোমড়ামুখো, তাও তিনি জানেন না। অথচ সরকার জোর তাগাদা দিচ্ছেন, ঝালুরামকে ধরতে না পারলে গয়াপতির বদলি অবধারিত।

তা ঝলুরামকে ধরাও সোজা কথা নয়। তার বন্দুক-পিস্তল আছে, হাতি-ঘোড়া-মোটরগাড়ি আছে, ছদ্মবেশ ধরতেও সে খুব ওস্তাদ লোক। যাদের বাড়িতে ঝালুরাম ডাকাতি করেছে, তারা কেউ সঠিকভাবে ঝালুরামের চেহারার বর্ণনা দিতে পারে না। কেউ বলে লম্বা, কারো মতে বেঁটে, কেউ বলে ফর্সা, কারো দাবি কালো। এ পর্যন্ত পনেরোজন ঝালুরামের বিবরণ পাওয়া গেছে। কিন্তু গয়াপতি জানেন, ঝালুরাম এক এবং অদ্বিতীয়। গত দুবছর ধরে এই শান্তির এলাকাকে ঝালুরাম ভারী সমস্যাসংকুল করে তুলেছে। বাড়ি লুটছে, দোকান লুটছে, আড়ত সাফ করে নিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায়-ঘাটে লোকের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে। এখন ঝালুরামের নাম শুনলে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, কেউ চোখ বুজে ফেলে, কেউ ঘামতে থাকে, কেউ বা ঠাণ্ডা মেরে যায়।

ঝালুরামের আবির্ভাব হওয়ার আগে গয়াপতি সুখেই ছিলেন। মাছ দুধ-ফল-সবজি-মাংস-ডিমের অভাব হত না। খাওয়া-দাওয়াটা বেশ হত। রাতে ঘুমোতেন, দিনে ঘুমোতেন, প্রায় সারাক্ষণই একটা ঘুম-ঘুম ভাব লেগে থাকত তার মনটা খুব প্রশান্ত থাকত, চারদিকটা ভারী শান্তিময় ও সুন্দর ছিল। গয়াপতির বেশ একটা বড়সড় ভুড়ি হয়েছে, গায়ে-গতরে থলথল করছে চর্বি। ওঠা, হাঁটা কাজকর্ম করা বা খাটা-খাটুনির অভ্যাসটাই মরে গেছে। ঠিক এই সময়ে একদিন দুম করে দুর্দান্ত ঝালুরাম তার এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সব তছনছ করে দিল। প্রতিদিন কোথাও-না কোথাও ঝালুরাম কিছুনা-কিছু করছেই। দুবছরে মোট সাতশ ত্রিশ দিনে সে এগারো শো বাহান্ন রকমের লুটপাট, ছিনতাই, জখম ইত্যাদি করেছে।

গয়াপতির খিদে ক্রমশ কমে আসছে। রাতে একটু আধটু ঘুম এখনো হয় বটে, কিন্তু দিনের ঘুমটা আর আসতে চায় না আজকাল। ঘুম-ঘুম ভাবটাও আর নেই। গয়াপতির বুড়ি মা আজকাল প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, “বড্ড রোগা হয়ে গেছিস গয়া। চোখের তলায় কালি পড়েছে, হাঁটার সময় তোর পেটটা আর আগের মতো দোল খায় না, জুতোর শব্দটাও তেমন দুমদাম করে হয় না।”

গয়াপতির গিন্নি আগে মোটা-মোটা সোনার বালা, চুড়ি, এগারো ভরির বিছে-হার পরে থাকতেন সবসময়। একদিন গয়াপতি দেখলেন, তার গিন্নি সব গয়না খুলে রেখে শুধু দু গাছি করে সরু চুড়ি আর সুতোর মতো সরু হার পরে আছেন। গয়াপতি হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “গয়না খুলে ফেলেছ যে?”।

গিন্নি আমতা-আমতা করে বললেন, “সবাই বলছে চারদিকে খুব চোর ডাকাতের উপদ্রব, গয়না দেখানোটা নাকি ঠিক নয়।”

শুনে গয়াপতি গুম মেরে গেলেন। দারোগার বউ চোরডাকাতের ভয় খাচ্ছে। তার মানে, গয়াপতির যোগ্যতায় তার নিজের বউয়েরও বিশ্বাস নেই!

সেইদিন থেকে গয়াপতি মরিয়া হয়ে উঠলেন। ঝালুরামের যে-কোনো খবর পেলেই ছুটে যান। কিন্তু কিছুতেই শেষ পর্যন্ত হদিশ করে উঠতে পারেন না। সবাই আড়ালে দুয়ো দেয়।

সেবার সোনাগড়ের হাটের কাছে ঝালুরাম তার স্যাঙাতদের নিয়ে জড়ো হয়েছে বলে এক আড়কাঠির কাছে খবর পেয়ে গয়াপতি সদলবলে ছুটলেন। গিয়ে দেখেন নির্দিষ্ট জায়গায় এক খুনখুনে বুড়ি ঘরের মাটির দেয়ালে খুঁটে দিচ্ছে। আড়কাঠি মাথা চুলকে বলল, “এই বুড়িটাই ঝালুরাম। ছদ্মবেশে রয়েছে বোধহয়।”

গয়াপতি সন্দেহের শেষ রাখলেন না। বুড়িকে ধরে তুলে নিয়ে এলেন থানায়। বুড়ি পরিত্রাহি শাপশাপান্ত করতে থাকে। খবর পেয়ে শহর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এসে কাণ্ড দেখে হাসির ছররায় গয়াপতিকে ঘায়েল করে চলে গেলেন।

আবার আর-এক চরের কাছে খবর পেয়ে গয়াপতি চুপিসাড়ে কলসিপোতা গায়ের চাকলাদারদের নারকোলবাগানে হাজির হলেন! খবর ছিল, মরা নারকোলগাছের নীচে ঝালুরাম সাধু সেজে বসে আছে। গয়াপতি সাধুর লেংটিরও সন্ধান পেলেন না, তবে সেখানে ধুনির ছাই খানিকটা ছিল বটে। যে লোকটা খবর এনেছিল, সে বলল, “এই নারকোলগাছটাই আজ্ঞে ঝালুরাম। এটাকে গ্রেফতার করুন।”

শুনে গয়াপতির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। লোকটাকে কান ধরে কয়েকটা চড়-চাপড় দিলেন। পরে কিন্তু খবর পেয়েছিলেন যে, লোকটা মিথ্যে বলেনি। মরা নারকোলগাছের ফাঁপা খোলের মধ্যেই নাকি ঝালুরাম গা ঢাকা দিয়েছিল। কদিন বাদে গিয়ে দেখলেন, বাস্তবিকই নারকোলগাছের গায়ে একটা চৌকো দরজা। সেটা খুললে ভিতরে দিব্যি একজন সেঁধোতে পারে। ফলে গয়াপতির এক গাল মাছি।

হরগঞ্জের শ্রীপতি হাজরা এসে একদিন বলল, “হুজুর, আমার কেলে গরুটা পাচ্ছি না। তার জায়গায় গোয়ালে একটা রাঙা গাই কে বেঁধে রেখে গেছে। বড় সন্দেহ হয়, রাঙা গাইটার ভাবগতিক দেখে। গরুর মতো ডাকে না, খোল ভুষি ঘাস এসব খেতে চায় না। ভাত দিলে খায়। মনে হচ্ছে গরুর ছদ্মবেশেই না আবার ঝালুরাম এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

ছুটলেন গয়াপতি। গরুটার ওপর অনেক খোঁচাখুঁচি চলল। শেষে পাশের গাঁ হরবল্লভপুরের রহমত খবর পেয়ে ধেয়ে এসে গয়াপতির পায়ে পড়ে বলল, “হুজুর, ওটা ঝালুরাম নয়, নির্য গরুই বটে। ও হল আমার দুলালি। শ্রীপতিদার কেলে গাই আমার গোয়ালে বাঁধা রয়েছে।”

গয়াপতি দমে গিয়ে বললেন, “হুম!”

ঝালুরামের পিছনে দৌড়ঝাঁপ করতে-করতে গয়াপতি বাস্তবিকই টসকে গেছেন। জীপগাড়িতে চড়ে তাঁর গায়ে-গতরে প্রচণ্ড ব্যথা। ইদানীং দুর্গম জায়গায় যেতে হয় বলে ঘোড়াতেও চড়তে হচ্ছে। তার ফলে মাজায় বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা। ঝালুরামের কথা ভাবতে ভাবতে সবসময়ে এমন দাঁত কিড়মিড় করেন যে, দুটো বুড়ো দাঁত নড়ে গেল। আজকাল এমন সন্দেহবাই হয়েছে যে, থানার সেপাই, বাড়ির চাকর, এমন কী নিজের মা বা বউকে পর্যন্ত বিশ্বাস করেন না। এরা যে-কেউই ঝালুরাম হতে পারে বলে আজকাল তার সন্দেহ হয়। হাতে সবসময়ে খোলা রিভলভার। খেতে, শুতে, মান করতে বা বাথরুমে যেতেও হাতে সেটা থাকে। ফলে কেউ ভয়ে তার কাছে ঘেঁষে না।

কাণ্ড দেখে গয়াপতির মা ঝালুরামকে উদ্দেশ করে শাপশাপান্ত করতে লাগলেন, “কেন রে খ্যাংরাফো, পালিয়ে বেড়াচ্ছিস? তোকে সাপে বাঘে খায় না রে? না খায় তো আমার সুমুখে একবার আয় দেখি বুক চিতিয়ে, ঝাটা দিয়ে তোর বিষ ঝেড়ে দিই। বদমাশ কোথাকার, আমার বাছা খুঁজে-খুঁজে হেদিয়ে পড়ল, আর কোন্ আকেলে তুই তার চোখে ধুলো দিয়ে বেড়াচ্ছিস? বাছা আমার যেমন না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে রোগা হয়ে গেল, তোরও তাই হোক। শুকিয়ে আমসি হয়ে যা, না খেয়ে উপোসি থেকে তোর পেট-পিঠের চামড়ায় ঘষাঘষি হোক।”

গয়াপতির গিন্নি গিয়ে হেকমতপুরের জাগ্রত কালীবাড়িতে জোড়া পাঠা মানত করে এলেন। শুনে গয়াপতির মা বললেন, “জোড়া পাঁঠা কি গো, ঝালুরাম ধরা পড়লে আমি জোড়া মোষ দেব। তাতেও না হলে জোড়া হাতি দেব, এই বলে রাখলাম।”

গয়াপতি সবই শুনেছেন এবং বুঝেছেন। তিনি যে ঝালুরামকে ধরতে পারবেন এ বিশ্বাস কারো নেই। সেটা বুঝতে পেরে তিনি আরও গুম হয়ে যান। রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন।

একদিন সকালে থানায় নিজের অফিসঘরে বসে যখন এমনি ভাবেই ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ একটা লম্বা-চওড়া লোক ঘরে ঢুকেই তার বুকের দিকে পিস্তল বাগিয়ে ধরে বলল, “হাত তুলুন।”

গয়াপতি রিভলভার সুষ্ঠু হাত ওপরে তুলে সভয়ে বললেন, “মেরো না বাবা ঝালুরাম!”

লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি ঝালুরাম নই, আর আপনাকে মারার ইচ্ছেও নেই। তবে আমি শুনেছি যে, আজকাল আপনি সবসময়ে রিভলভার বাগিয়ে থাকেন আর সবাইকে সন্দেহ করেন। তাই প্রাণের ভয়ে একটু ভয় দেখাতে হল। এখন আপনি যদি আপনার রিভলভারটা খাপে ভরেন, আমিও পকেটে পুরব।”

গয়াপতি হাঁফ ছেড়ে রিভলভার খাপে ঢোকালেন। লোকটাও কথামতো কাজ করল। তারপর বসে এক গাল হেসে বলল, “ আমি গোয়েন্দা বরদাচরণ। নরনাথ চাটুজ্যে আমাকে ভাড়া করে এনেছেন তাদের বাড়ির সোনার হংসেশ্বরীর মূর্তি পাহারা দেওয়ার জন্য। তাদের ভয়, ডাকাত ঝালুরাম মূর্তিটা লুট করবে।”

গয়াপতি নাক সিঁটকোলেন। প্রাইভেট গোয়েন্দা বরদাচরণের নাম তিনি শুনেছেন। লোকটা লাউঁচুরি বা বড় জোর ছেলেচুরির কেস করে। তাই গয়াপতি খুবতাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ঝালুরামের ব্যবস্থা আমিই করব। আর কারো এখানে নাক গলাতে হবে না।”

বরদাচরণ মৃদু হেসে বললেন, “আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি আজকাল লাউঁচুরি, গরুচুরির মতো ছোটোখাটো কেস নিই না। মাত্র দু মাস আগে আমি একটা পুকুরচুরি ধরেছি।”

গয়াপতি চমকে গিয়ে বললেন, “বটে?”

“তবে আর বলছি কী? গয়েরকাটার রাম সিংয়ের বাড়ির ঈশান কোণের মস্ত পুকুর রাতারাতি চুরি হয়ে গেল। রাতেও টলটলে জল ছিল তাতে। সকালে দেখা গেল বিশাল গর্ত পড়ে আছে। জল তো নেই-ই, অন্তত বিশ মন মাছও সেই সঙ্গে উধাও। তিন দিনের মধ্যে ধরে ফেললাম, রাম সিংয়ের এক জ্ঞাতি ভাই রাবণ সিং বাড়ির সবাইকে সিদ্ধির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় তারপর রাতে ডিজেল পাম্প চালিয়ে পুকুরের সব জল নিজের একটা মজা দিঘিতে চালান করে এবং বিশ মন মাছ নিয়ে গিয়ে শহরে বেচে দেয়। আরো শুনবেন? মাত্র একমাস আগে আমি দুটো আন্তর্জাতিক চোরাই চালানের দলকে ধরি। আমেরিকার বড়লোকেরা বায়না ধরেছে তাজমহল এবং এভারেস্ট চাই। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেবে তার জন্য। মাসখানেক আগে এক অমাবস্যার রাত্রে চারটে লোক আমেরিকায় চালান দেওয়ার জন্য তাজমহলের ভিত খুঁড়ছিল। তক্কেতক্কে আমি গিয়ে পালের গোদাকে চেপে ধরি। বাকি তিনজন পালায় বটে, কিন্তু হাতের ছাপ সহ শাবল ফেলে যায়। সেবারের মতো তাজমহল আমেরিকায় চালান হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায় এবং পুরো দলটাই ধরা পড়ে। তার কিছুদিনের মধ্যেই নেপাল গভরমেণ্টের ডাকে নেপালে গিয়ে আমি এভারেস্ট চুরিও আটকাই। চোরেরা এভারেস্ট শৃঙ্গ ভেঙে টুকরো করে সাধারণ পাথর হিসেবে আমেরিকায় চালান দিচ্ছিল। আমেরিকায় পাথরের চালান যাচ্ছে শুনেই আমার সন্দেহ হয়। আমেরিকায় তো পাথরের অভাব নেই। তাই চালানের পাথর পরীক্ষা করেই আমি বুঝতে পারলাম, এ সাধারণ পাথর নয়। সেগুলোর গায়ে তখনো বরফ লেগে আছে। অনুসন্ধানে পুরো দলটাই ধরা পড়ল। নেপাল গভরমেন্ট গোপনে জাপান থেকে ইনজিনীয়ার আনিয়ে টুকরো পাথর সিমেন্টে জুড়ে ফের এভারেস্ট শৃঙ্গ রাতারাতি মেরামত করে ফেলল। সুতরাং…”

গয়াপতি বহুদিন বাদে এই প্রথম একটু হাসলেন। বললেন, “আপনি কি ঘনাদার কেউ হন?”

গোয়েন্দা বরদাচরণ ঘনাদার গল্প পড়েননি। আসলে গোয়েন্দাগিরি করে পড়াশুনোর সময়ও পান না। তবু ভাবলেন, ঘনাদা বোধহয় একজন কেওকেটা হবে। তাই পিছপা না হয়ে বললেন, “দূর সম্পর্কের মাসতুতো ভাই।”

যাই হোক, এরপর গয়াপতি আর বরদাচরণের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুজনে গোপনে নানারকম পরামর্শ আঁটতে লাগলেন।

কিছুদিনের মধ্যে খবর রটে গেল যে, দারোগা গয়াপতি নিখোঁজ হয়েছেন। ওদিকে চাটুজ্যে-বাড়ির সোনার হংসেশ্বরী মূর্তি পাহারা দেওয়ার জন্য শহর থেকে যে গোয়েন্দাকে আনানো হয়েছিল, সেও বেপাত্তা। ফলে চারদিকে খুব হৈ-চৈ পড়ে গেল। সবাই বুঝল, এ হচ্ছে ঝালুরামের কাজ। স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত ভাবনায় পড়ে গেলেন।

ওদিকে ভাবনায় পড়েছে স্বয়ং ঝালুরামও। এতকাল এ এলাকায় সে-ই ছিল এক ডাকাত-সম্রাট। কিন্তু দিন সাতেক হল সে এমন তিন চারটে ডাকাতির খবর পেয়েছে, যেগুলো তার দলের কাজ নয়। ঝালুরামের এলাকায় তার অনুমতি না নিয়ে ডাকাতি করবে, এত সাহস কার! ঝালুরামের খাওয়া কমে গেছে, ঘুম ছুটে গেছে। চারদিকে তার চোরেরা নতুন ডাকাতদের খোঁজ নিচ্ছে।

মনসাপোতার গভীর জঙ্গলের ভিতর এক ভাঙা মন্দিরে ঝালুরামের আস্তানায় এক রাত্রে দুজন লোককে ধরে আনা হল। একজন মোটাসোটা, থলথলে। অন্যজন বেশ লম্বা-চওড়া। ঝালুরাম মশালের আলোয় চোখ দিয়ে দুজনকে ভাল করে মেপে দেখল। তারপর হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “তোরাই ডাকাত?”

ঝালুরাম দেখতে রোগা। ল্যকপ্যাক সিং। মাথায় তেমন উঁচুও নয়। কিন্তু তার হুংকার শুনলে মালুম হয়, যন্ত্রটা ছোট হলেও বিপজ্জনক।

লোক দুটো কেঁপে কেঁপে বলল, “আজ্ঞে।”

ঝালুরাম অট্টহাসি হেসে ওঠে। লম্বা লোকটা ভয়েভয়ে বলে, “হুজুর, আমাদের কেউ দলে নেয়নি বলে দুজনে মিলে ছোটোখাটো কাজ করি। কিন্তু আপনার মতো মহান ডাকাত যদি আমাদের দলে ভর্তি করে নেন, তবে আমরা আলাদা কাজ কারবার ছেড়ে দেব।”

ঝালুরাম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলে, “আমার দলে ডাকাতি করবি? দেখি তোদের এলাম! দুজনে পঞ্চাশটা করে ডিগবাজি খা।”

ডিগবাজি খেতে খেতে লোকদুটো হেদিয়ে জিভ বার করে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগল। ঝালুরাম হেসে লুটোপুটি, সেই সঙ্গে তার পঞ্চাশজন স্যাঙাতও।

এরপর ঝালুরাম হুকুম দেয়, “রণপায়ে চড়ে পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে আয়…দু মাইল দৌড় দে…স্রোতের নদী সাঁতরে পার হ…সুপুরি গাছ বেয়ে ওঠ…বিশ হাত ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়…লাঠি তরোয়াল আর রাম-দা চালিয়ে দেখা…বন্দুকের নিশানা দেখা…অমাবস্যার রাতে একলা শ্মশানে মড়ার খুলি কোলে নিয়ে বসে থাক্‌..”

আর এই সব হুকুম তামিল করতে করতে লোক দুটোর জান কয়লা। প্রাণপাখি খাঁচা-ছাড়া হওয়ার উপক্রম। আড়ালে মোটা লোকটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে, ‘ইচ্ছে করে, দৌড়ে গিয়ে বেটার টুটি ধরি।” লম্বা লোকটা তখন তার হাত চেপে ধরে চুপি-চুপি বলে, “না গয়াবাবু, এখন নয়। সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। অপেক্ষা করুন।”

সব কিছুরই শেষ আছে। লোকদুটোর ট্রেনিংও একদিন শেষ হল। ঝালুরাম তাদের ডেকে বললে, “তোদের দিয়ে কোনরকমে কাজ চলতে পারে। আজ আমরা চাটুজ্যে-বাড়ির হংসেশ্বরীর সোনার মূর্তি লুট করতে যাচ্ছি। তোরাও থাকবি দলে। আজ তোদের পরীক্ষা।”

শুনে ছদ্মবেশী গয়াবাবু আবার দাঁত কিড়মিড় করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বরদাচরণ ঠিক সময়ে কনুইয়ের গুতো দিয়ে তাকে সতর্ক করে দিলেন।

নিশুত রাতে ঝালুরামের দল চাটুজ্যে-বাড়ি ঘিরে ফেলল। ‘রে রে’ করে চেঁচাচ্ছে ডাকাতরা। আর সে চেঁচানি এমন সাঙ্ঘাতিক যে, মাটি সুষ্ঠু কাঁপতে থাকে। চাটুজ্যে-বাড়ির ভিতরে ছেলে-বুড়ো-মেয়েরা মড়াকান্না জুড়ে দিয়েছে। ঝালুরাম নাক সিঁটকে বলল, “এ বড় ছোট ডাকাতি। ছোটলোকদের কাজ। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা। নতুন দুটোকে ডাক তো।”

নতুন দুজন এগিয়ে এলে ঝালুরাম বলল, “আজ আর আমরা হাত লাগাচ্ছি না। আমার দলবল বাড়ি ঘিরে রইল। আমি ওদিকের বটগাছতলায় মাদুর পেতে ঘুমোতে যাচ্ছি। তোরা দুজনে বাড়িতে ঢুকে সব চেঁছে-পুঁছে নিয়ে আয় গে যা। মনে রাখিস, হংসেশ্বরীর মূর্তিটা আনতে যেন ভুল না হয়। আধঘণ্টার বেশি সময় দেব না কিন্তু। চটপট যা।”

হুকুম পেয়ে দুজনে গিয়ে পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকল। ঢুকেই গয়াপতি বললেন, “বরদাবাবু! এখন উপায়?”

বরদাচরণ ভ্রূ কুঁচকে ভাবিত মুখে বললেন, “হুকুম-মতো কাজ করে যান। অন্য উপায় তো দেখছি না।”

“কিন্তু আমি যে কখনো সত্যিকারের ডাকাতি করিনি! বাধোবাধো ঠেকছে যে!”

বরদাচরণ দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “আর আমিই বুঝি করেছি!”

গয়াপতি বিরসমুখে বলেন, “তা সত্যি কথা বলতে কী, ডাকাতির ট্রেনিং নেওয়ার সময় আপনার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল এ-ব্যাপারে আপনার কিছু পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। আমার চেয়ে সব বিষয়েই আপনি বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তার ওপর এখন আবার ডাকাতিতেও বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।”

বরদাচরণ শ্লেষের হাসি হেসে বলেন, “গয়াবাবু ডাকাতরা তো রাতে ডাকাতি করে, কিন্তু এখানকার লোক জানে যে, আপনি এখানে দিনে ডাকাতি করতেন। রোজ মাছ দুধ পাঠা মুর্গি ভেট নিতেন, প্রতি মাসে নগদ টাকায় নিয়মিত ঘুষ খেয়েছেন। কাজেই এই ছোটখাটো একটা ডাকাতিতে আপনার লজ্জার কারণ দেখছি না।”

গয়াপতি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেন, “একটা প্রাইভেট গুলবাজ টিকটিকির এত বড় আস্পদ্দা! কালই তোমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এই এলাকা থেকে বের করে দেব।”

বরদাচরণ সমান তেজে বলেন, “বেশি চালাকি করো না হে গয়াপতি, বাইরে ঝালুরাম মোতায়েন আছে। যদি বলে দিই যে, তুমি আসলে অপদার্থ দারোগা গয়াপতি, তবে সে হেঁসো দিয়ে তোমার পেট ফাসাবে।”

ঝালুরামের উল্লেখে গয়াপতি কিছু মিইয়ে গেলেন। সত্যি বটে, ঝালুরামের দল এখন ঘিরে আছে চারদিক। গড়বড় করলে বিপদ হতে পারে।

গয়াপতি শ্বাস ছেড়ে বলেন, “ঝালুরামকে আমিও বলে দেব যে তুমি প্রাইভেট গোয়েন্দা বরদাচরণ। তোমারও গর্দান যাবে।”

এইভাবে দুজনের মধ্যে একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠল। হঠাৎ চাটুজ্যে বাড়ির বড় ঘড়িতে একটা বাজার টং শব্দ হতেই দুজনে সচেতন হলেন। সময় বেশি নেই। ঝালুরাম মোটে আধঘণ্টা সময় দিয়েছে।

বরদাচরণ বললেন, “ঝগড়াটা এখন মুলতুবি থাক গয়াবাবু। হাতে কাজ রয়েছে, বাইরে ঝালুরাম।”

গয়াপতিও মাথা নেড়ে বলেন, “থাকল। কিন্তু আপনাকে এই বলে রাখলাম, এসব ঝামেলা মিটে গেলে একদিন আপনার সঙ্গে আমার কুস্তি হবে। দেখব তখন কার কত ক্ষমতা!”

“আমিও দেখব। আমি জুডোর ব্ল্যাক বেল্ট।”

“বেল্ট আমারও আছে।” বরদাচরণ হেসে বলেন, “সে বেল্ট তো ঝোলা ভুঁড়ি বাঁধার জন্যে। জুডোর ব্ল্যাক বেল্ট তা নয়। অনেক প্যাঁচ পয়জার শেখার পর ব্ল্যাক ব্লেট দেওয়া হয়। ওটা একটা মস্ত সম্মান।”

“রাখো রাখো। সম্মান দেখিও না। এলাকায় আমি রাস্তায় বেরোলে লোকে পথ ছেড়ে দেয় জানো?”

“জানি। পাছে তোমার ছায়া মাড়াতে হয় সেই ঘেন্নায় লোকে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়।” বরদাচরণ বলেন।

ঝগড়াটা ফের পাকিয়ে উঠেছিল, কিন্তু বাইরে ঝালুরামের একটা হুংকার শোনা গেল এই সময়ে, ‘কই রে! হল তোদের?”

কেঁপে উঠে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরল।

গয়াপতি বলেন, “বরদাবাবু! আর দেরি নয়।”

বরদাবাবুও বলেন, “না। আর দেরি করা মোটেই ঠিক নয়।” কঁপতে কাঁপতে গয়াপতি চলেন, তার দু-পা আগে বরদাচরণ। বরদাচরণ কঁপছেন

বটে, কিন্তু একটু ঘামছেন। বাগান পার হয়ে সদর দরজায় পৌঁছে দুজনে মুশকিলে পড়লেন। সদর দরজা বন্ধ। কী করে বন্ধ দরজা বাইরে থেকে খুলতে হয় তা ঝালুরাম তাদের শিখিয়ে দেয়নি।

“এখন উপায়?” গয়াপতি বলেন।

“তাই তো!” বরদাচরণও ভাবিত হলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, “আরে দূর! খুব সোজা ব্যাপার। আমি তো গোয়েন্দা বরদাচরণ। চাটুজ্যে বাড়ির সবাই আমাকে জানে।”

“আমাকেও।” গয়াপতি হার মানেন না।

“তাহলে আর মুশকিল কিসের? পরিচয় দিলেই দরজা খুলে দেবে।”

তাই হল। ধুতির খুঁটে মুখের কালি মুছে, ছদ্মবেশের পরচুলা, নকল গোঁফ, লম্বা জুলপি খুলে ফেললেন দুজনে। গয়াপতি একটা নকল আঁচিল গালে লাগিয়েছিলেন, সেটা খুঁটে তুলে ফেললেন। বরদাচরণ খানিকটা প্লাস্টার দিয়ে নিজের নাকটাকে বড় বানিয়েছিলেন, প্লাস্টারটুকু তিনিও টান মেরে খুলে ফেললেন। তারপর দুজনে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকাডাকি করে নিজেদের পরিচয় দিতে লাগলেন। তাঁদের গলার স্বর কারো অচেনা নয়। খানিক বাদে নরনাথ চাটুজ্যে দরজা খুলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বললেন, “যাক, আপনারা এসে গেছেন তাহলে?”

গয়াপতি সঙ্গে-সঙ্গে চাটুজ্যের বুকে বল্লম ধরেন। আর বরদাচরণ চাটুজ্যেকে বেঁধে ফেলেন চটপট। চাটুজ্যে শুধু করুণ চোখে চেয়ে বললেন, “কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। আমার ঠাকুর্দা কথাটা বলতেন।”

এরপর লুটতরাজ খুবই সহজ হয়ে গেল। বাধা দেওয়ার কেউই ছিল না। যে যার প্রাণভয়ে ব্যস্ত। আধণ্টার মাথায় বমাল সমেত গয়াপতি আর বরদাচরণ হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। বেরোবার আগে দুজনেই অবশ্য তাদের ছদ্মবেশ পরে নিয়েছেন।

বরদাচরণের হাতে সোনার মূর্তিটা দেখে ঝালুরাম তার পিঠ চাপড়ে বলে, “সাবাস!”

গয়াপতি একটু তেতো গলায় বলেন, “হুঁঃ! ও ওটা আনতে পারত নাকি? মূর্তিটা শানের ভিতে গাঁথা ছিল। আমি টেনে হিঁচড়ে না নড়ালে ওর একার সাধ্য ছিল না।”

ঝালুরাম গয়াপতিরও পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “তোরও এলেম কম নয়। কতগুলো সোনার গয়না এনেছিস?”

শুনে বরদাচরণ বললেন, “গয়না খুঁজে বের করার মতো বুদ্ধি যদি ওর পেটে থাকত! ডাকাত পড়ার খবর পেয়েই মেয়েরা সব কচুবনে গয়না ফেলে দিয়েছিল। আমিই বুদ্ধি করে বের করি।”

ঝালুরাম তখন আবার বরদাচরণের পিঠ চাপড়ায়। তাতে গয়াপতি ফুঁসে উঠে বলেন, “চাটুজ্যের বুকে বল্লম ধরেছিল কে শুনি! তোমার সাহস হত?”

বরদাচরণ বলেন, “আর চাটুজ্যেকে বাঁধল কে? সেটাও জোর গলায় বলো।”

এইভাবেই দুজনে প্রচণ্ড ঝগড়ায় লেগে পড়েন। ডাকাতরা চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের ঝগড়া দেখে। ঝালুরাম দুজনেরই পিঠ চাপড়ে একবার একে আর একবার ওকে সাবাস দিতে থাকে। কিন্তু ঝগড়া তাতে বাড়ে বই কমে না। একে সাবাস দিলেও চটে ওঠে, ওকে দিলে এ ফুঁসে ওঠে। চেঁচানির চোটেসারা গঞ্জের ঘুম ছুটে যায়। আর কখন যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিস নিয়ে এসে গোটা দলটাকে ঘিরে ফেলেছেন তাও ডাকাতরা ভালমতো টের পায় না।

গয়াপতির মা দু-দুটো মানত করেছিলেন। ঝালুরাম ধরা পড়লে জোড়া হাতি দেবেন, আর নিরুদ্দেশ গয়াপতি ফিরে এলে জোড়া উট।

কিন্তু সস্তায় হাতি বা উট পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *