যমজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে
গল্পে শোনা যায়, যমজ ভাইয়ের ক্ষেত্রে যমদূতেরা রামের বদলে শ্যামকে লইয়া যায়, শ্যামের বদলে আসিয়া ধরে রামকে। তাদের অনুকরণে হইলেও ক্ষেত্র বিস্মৃততর করিয়া লইয়া রাম অপরাধ করিলে মানুষ অতিবুদ্ধিবশত প্রায়ই শ্যামকে লইয়া টানাটানি করে। পুলিশও মানুষ, সুতরাং এক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হইল না। পরদিনই একটা পুলিশ তদন্ত হইয়া গেল। অনিরুদ্ধ আক্ৰোশের কারণ দেখাইয়া ছিরু পালকে সন্দেহ করিলেও পুলিশ আসিয়া মাঠআগলদার সতীশ বাউরির বাড়ি খানাতল্লাশ করিয়া সব তছনছ করিয়া তাহাকে টানিয়া আনিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকটাকে জেরায় নাজেহাল করিয়া অবশেষে ছাড়িয়া দিল। অবশ্য অনিরুদ্ধের সন্দেহ অনুযায়ী একবার ছিরু পালের খামার-বাড়িটাও ঘুরিয়া দেখিল, কিন্তু সেখানে দুই বিঘা জমির আধ-পাকা ধানের একগাছি খড়ও কোথাও মিলিল না।
পুলিশ আসিয়া গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপেই বসিয়াছিল। গ্রামের মণ্ডল-মাতব্বরেরাও আসিয়া চন্দ্ৰমণ্ডলের নক্ষত্র সভাসদের মত চারিপাশে জমকাইয়া বসিয়া উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করিয়া পরস্পরের মধ্যে কথা বলিতেছিল। ছিরু পাল বসিয়াছিল পুলিশের অতি নিকটেই এবং অত্যন্ত গম্ভীরভাবে। তাহার আকৰ্ণবিস্তৃত মুখগহ্বরের পাশে চোয়ালের হাড় দুইটা কঠিন ভঙ্গিতে উঁচু হইয়া উঠিয়াছিল। অনিরুদ্ধ সম্মুখেই উবু হইয়া বসিয়া মাটির দিকে চাহিয়া কত কি ভাবিতেছিল। তদন্ত-শেষে পুলিশ উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধও উঠিল। সে চাহিয়া না দেখিয়াও স্পষ্ট অনুভব করিতেছিল যে, সমস্ত গ্রামের লোক কঠিন প্রতিহিংসা-তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। প্রত্যক্ষ যন্ত্ৰণা সহ্য করা যায়–নিরুপায় হইয়া মানুষকে সহ্যও করিতে হয়, কিন্তু যন্ত্রণারও ভাবী ইঙ্গিত বা নিষ্ঠুর কল্পনা মানুষের পক্ষে অসহ্য। সে পুলিশেরই পিছন পিছন উঠিয়া আসিল।
পুলিশ চলিয়া যাইতেই চণ্ডীমণ্ডপে প্রচণ্ড কলরব উঠিল। সমবেত জনতার প্রত্যেকে আপন আপন মন্তব্য ঘোষণা আরম্ভ করিল; কেউ কাহারও কথা শোনে না দেখিয়া প্রত্যেকেই আপন আপন কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব উচ্চগ্রামে লইয়া গেল। সদ্গোপ সম্প্রদায়ের কেহই অবশ্য শ্ৰীহরি ঘোষকে সুনজরে দেখে না; কিন্তু অনিরুদ্ধ কৰ্মকার যখন পুলিশে খবর দিয়া তাহার বাড়ি খানাতল্লাশ করাইল, বাড়িতে পুলিশ ঢুকাইয়া দিল, তখন অপমানটাকে তাহারা সম্প্রদায়গত করিয়া লইয়া বেশ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। বিশেষ করিয়া সেদিন অনিরুদ্ধের সমাজকে উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্যজনিত অপরাধের ভিত্তির উপর আজিকার ঘটনাটা ঘটিবার ফলে বিষয়টা গুরুত্বে রীতিমত বড় হইয়া উঠিয়াছে।
দেবনাথ ঘোষের গলাটা যেমন তীক্ষ তেমনি উচ্চ, এ গ্রামে সকল কলরবের ঊর্ধ্বে তাহার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সে দুই অর্থেই। চাষীর ঘরে দেবনাথ যেন ব্যতিক্রম! তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিমান যুবক দেবনাথ; তাহার ছাত্র-জীবনে সে কৃতী ছাত্র ছিল। কিন্তু আৰ্থিক অসাচ্ছল্য এবং সাংসারিক বিপর্যয়হেতু ম্যাট্রিক ক্লাস হইতে তাহাকে পড়া ছাড়িতে হইয়াছে। সে এখন এই গ্রামেরই পাঠশালার পণ্ডিত। গ্রাম্যজীবনের ব্যবস্থা শৃঙ্খলার বহু তথ্য সে ব্যগ্ৰ কৌতূহলে অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছে। সে বলিতেছিল—কামার, ছুতোর, নাপিত কাজ করব না বললেই চলবে না। কাজ করতে তারা বাধ্য।
শ্ৰীহরি কেবল তেমনি গম্ভীরভাবে পাঁতে দাঁতে চাপিয়া বসিয়াছিল, এতখানি যে হইবে সে তাহা ভাবিতে পারে নাই। ওদিকে শ্রীহরির খামারবাড়িতে শুকাইতে দেওয়া ধান পায়ে পায়ে ওলটপালট করিয়া দিতে দিতে ছির মা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও নিষ্ঠুরতম আক্ৰোশে নির্মম অভিসম্পাত দিতেছিল অনিরুদ্ধকে।
অন্যদিকে অনিরুদ্ধের বাড়িতে পদ্ম উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে পথের দিকে চাহিয়া বাহির দরজাটিতে দাঁড়াইয়া ছিল। থানা-পুলিশকে তাহার বড় ভয়। ছিরু র মায়ের অশ্লীল গালিগালাজ এবং নিষ্ঠুর অভিসম্পাতগুলি এখান হইতে স্পষ্ট শোনা যাইতেছিল। ছিরু পালের বাড়ি এবং তাহাদের বাড়ির মধ্যে ব্যবধান মাত্র একটা পুকুরের এপার ওপার। শব্দ তেরছা ভাসিয়া আসে। পথটা তিনপাড় বেড় দিয়া খানিকটা ঘুর-পথ। গালাগালি শুনিয়া পদ্মের মুখখানা থমথমে হইয়া উঠিয়াছিল। পদ্ম দুরন্ত মুখরা মেয়ে; গালিগালাজ অভিসম্পাত সে-ও অনেক জানে। সে কাহারও স্পষ্ট নামোল্লেখ না করিয়া তাহাদের অবস্থার সহিত মিলাইয়া এমনভাবে অভিসম্পাত দিতে পারে যে শব্দভেদী বাণের মত উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির একেবারে বুকে গিয়া আমূল বিধিয়া যায়। কিন্তু আজ দারুণ উৎকণ্ঠায় কে যেন গলা চাপিয়া ধরিয়াছে। এই সময় অনিরুদ্ধ আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। অনিরুদ্ধকে দেখিয়া গভীর আশ্বাসে সে স্বস্তির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল; পরমুহুর্তেই চোখমুখ দীপ্ত করিয়া বলিল—শুনছ তো? আমিও এইবার গাল দেব কিন্তু!
অনিরুদ্ধের অবস্থাটা তখন ঠিক শীতের বরফের মত অনুতপ্ত, স্থির ও কঠিন। সে রুক্ষকণ্ঠে বলিলনা, গাল দিতে হবে না ঘরে চল।
পদ্ম ঘরের দিকে আসিতে আসিতে বলিল না। শুধু শুধু ঘরে যাব? কানের মাথা খেয়েছ? গালাগালগুলো শুনতে পাচ্ছ না?
—তবে যা, গাল দিগে; গলা ফাটিয়ে চিৎকার কর্ গিয়ে। মক্ গিয়ে।
পদ্ম গজগজ করিতে করিতে গিয়া ভাড়ার ঘর হইতে তেল বাহির করিয়া আনিয়া বলিল কি খোয়ারটা আমার করছে শুনতে পাচ্ছ না তুমি?
পদ্ম ও অনিরুদ্ধ নিঃসন্তান—তাই ছিরু র মা অনিরুদ্ধের নিষ্ঠুরতম মৃত্যু কামনা করিয়া পদ্মের জন্য কদৰ্যতম অশ্লীলতম ভবিষ্যৎ উপজীবিকার নির্দেশ দিয়া অভিসম্পাত দিতেছে। তেলের বাটি পাশে রাখিয়া সে স্বামীর একখানা হাত টানিয়া লইয়া তাহাতে তেল মাখাইতে বসিল। কর্কশ ও কঠিন হাত; আগুনের অ্যাঁচে রোমগুলি পুড়িয়া কামানো দাড়ির মত করকরে হইয়া আছে। শুধু হাত নয়, হাত-পা-বুকমোট কথা সম্মুখভাগের প্রায় অনাবৃত অংশটাই এমনি দগ্ধরোম। তেল দিতে দিতে পদ্ম বলিলবাবা, হাত-পা নয় যেন উখো!
অনিরুদ্ধ সে কথায় কান না দিয়া বলিল-আমার গুপ্তিটা বার করে বেশ করে মেজে রাখবি তো।
পদ্ম স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-আমারও দা আছে, কাল মেজে ঘষে শান দিয়ে রেখেছি, নিজের গলায় মেরে একদিন দু-খানা হয়ে পড়ে থাকব কিন্তু।
–কেন?
—তুমি খুনখারাপি করে ফাঁসি যাবেআর আমি হাড়ির ললাট ডোমের দুৰ্গতি ভোগ করে বেঁচে থাকব?
অনিরুদ্ধ কথার কোনো উত্তর দিল না, কেবল বলিল-হুঁ-উ!–অর্থাৎ পদ্মের হাড়ির ললাট ডোমের দুৰ্গতির সম্ভাবনার কথাটা সে ভাবিয়া দেখে নাই, নতুবা ছিরেকে জখম করিয়া জেল খাঁটিতে বা হত্যা করিয়া ফাসি যাইতে বর্তমানে তাহার বিশেষ আপত্তি ছিল না।
পদ্ম বলিল,—বারণ করলাম থানা পুলিশ কোরো না। কথা কানেই তুললে না! কিন্তু কি হল? পুলিশ কি করলে? গায়ের সঙ্গে কেবল ঝগড়া-বিবাদ বেড়ে গেল। আর আমি গাল দোব। বললেই একেবারে বাঘের মত অ্যাঁকিয়ে উঠছ—না দিতে পাবি না।
রুদ্ধক্রোধ অনিরুদ্ধ বিরক্তিতে অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল; কিন্তু কোনো কঠিন কথা বলিতে তাহার সাহসও হইল না, প্রবৃত্তিও হইল না। বন্ধ্যা পদ্মকে লইয়া তাহাকে বড় সন্তৰ্পণে চলিতে হয়; সামান্য কারণে নিতান্ত বালিকার মত সে অভিমান করিয়া মাথা খুঁড়িয়া, কাঁদিয়াকাটিয়া অনৰ্থ বাঁধাইয়া তোলে; আবার কখনও প্রবীণা প্ৰৌঢ়া যেমন দুরন্ত ছেলের আবদারঅত্যাচার সহ্য করে তেমনি করিয়া হাসিমুখে অনিরুদ্ধের অত্যাচার সহ্য করে অনিরুদ্ধের হাতে মার খাইয়াও তখন সে খিলখিল করিয়া হাসে। কখন কোন্ মুখে পদ্ম চলে—সে অনিরুদ্ধ অনেকটা বুঝিতে পারে। আজিকার কথার মধ্যে তাহার আবদারের সুর ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে; সেইটুকু বুঝিয়াই সে দারুণ বিরক্তি সত্ত্বেও আত্মসংবরণ করিয়া রহিল। কোনো কথা না বলিয়াই পদ্মর হাত হইতে সে আপনার পাখানা টানিয়া লইয়া বলিল-কই, গামছা কই?
পদ্ম কিন্তু এইটুকুতেই অভিমানে ফোঁস করিয়া উঠিল; অনিরুদ্ধ ভুল করে নাই। পদ্ম আজ ছোট মেয়ের মতই আবদেরে হইয়া উঠিয়াছে। মুখে সে কিছু বলিল না বটে, কিন্তু বিদ্যুতের মত চমকাইয়া মুখ তুলিয়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিল,-পরমুহূর্তেই তেলের বাটিটা তুলিয়া লইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।
বিরক্তিতে ভ্ৰকুটি করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—বেলার পানে তাকিয়ে দেখেছিস? ছায়া কোথা গিয়েছে দেখ। এদিকে তিনটে বাজে।
গম্ভীর মুখে চকিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বাড়ির উঠানের ছায়া লক্ষ্য করিয়া পদ্ম গামছাখানা আনিয়া অনিরুদ্ধের হাতে দিয়া বুলিল—বস, আমি জল এনে দিই, বাড়িতেই চান করে নাও।
গামছাখানা কাঁধে ফেলিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তাতে দেরি হবে, পদ্ম। আমি এই যাব আর আসব। পানকৌড়ির মত ভুক করে ড়ুবব আর উঠব। ভাত তুই বেড়ে। বলিতে বলিতেই সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
পদ্ম ভাত বাড়িতে গিয়া রান্নাঘরের শিকলে হাত দিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। ডাল-তরকারি সব ঠাণ্ডা হিম হইয়া গিয়াছে। সেসব বাবুর মুখে রুচিবে কি? বাবু নয় নবাব। যত আয় তত ব্যয়। কামার, কুমার, নাপিত, স্বর্ণকারইহাদের অবশ্য খরচে বলিয়া চিরকাল বদনাম; কিন্তু উহার মত খরচে পদ্ম আর কাহাকেও দেখে না। ওপারের শহরে কামারশালা করিয়া খরচের বাতিক তাহার আরও বাড়িয়া গিয়াছে। এক টাকা সেরের ইলিশমাছ এ গ্রামে কে খাইয়াছে? এখন গরম একটা কিছু না করিয়া দিলে নবাব কেবল ভাতে-হাত করিয়াই উঠিয়া পড়িবে! খিড়কির ডোবাটার পাড়ে পদ্ম প্রথম আশ্বিনেই কয়েক ঝাড় পেঁয়াজ লাগাইয়াছিল, সেগুলো বেশ ঝাড়েগোছে বড় হইয়া উঠিয়াছে। পেঁয়াজের শাক আনিয়া ভাজিয়া দিলে কেমন হয়? পদ্ম খিড়কির দিকে অগ্রসর হইয়াই লক্ষ্য করিল—দুয়ারের পাশে কে যেন দাঁড়াইয়া আছে। সাদা কাপড়ের খানিকটা মধ্যে মধ্যে দেখা যাইতেছে। সে শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িয়া গেলগতকালের ছিরু পালের সেই বীভৎস হাসি! কয়েক পা পিছাইয়া আসিয়া সে প্রশ্ন করিল—কে? কে দাঁড়িয়ে গো?
সাড়া পাইয়া মানুষটি চকিত গতিতে ঘরে প্রবেশ করিল। পদ্ম আশ্বস্ত হইল—পুরুষ নয়, স্ত্রীলোক। পরমুহুর্তেই সে স্তম্ভিত হইয়া গেল-এ-যে ছিরু পালের বউ! বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হইবে না; এককালে সুন্দরী ছিল সে, কিন্তু এখন অকালবার্ধক্যে জীর্ণ এবং শীর্ণ। চোখে তাহার যত ক্লান্তি তত সকরুণ মিনতি। ছিরু পালের বউ বিনা ভূমিকায় দুটি হাত জোড় করিয়া সামনে দাঁড়াইয়া বলিল ভাই, কামার বউ।
পদ্ম কোনো কথা বলিতে পারিল না; ছিরু পালের বউকে সে ভাল করিয়াই জানে, এমন ভাল মেয়ে আর হয় না। কত বড় ভাল ঘরের মেয়ে সে তাও পদ্ম জানে। তাহার কতখানি দুঃখ তাও সে চোখে দেখিয়াছে, কানে শুনিয়াছে—ছিরু পালের প্রহার সে দূর হইতে স্বচক্ষে দেখিয়াছে; তদুপরি ছিরু র মায়ের গালিগালাজ সে নিত্যই শুনিতেছে।
ছিরুর বউ তাহার সম্মুখে আসিয়া ঈষৎ নত হইয়া বলিল—তোমার পায়ে ধরতে এসেছি ভাই।
দুই পা পিছাইয়া গিয়া পদ্ম বলিলনা-না-না সে কি?
–আমার ছেলে দুটিকে তোমরা গাল দিও না, ভাই; যে করেছে তাকে গাল দিও-কি বলব আমি তাতে!
ছিরু পালের সাতটি ছেলের মধ্যে দুইটি মাত্র অবশিষ্ট; তাও পৈতৃক গুপ্ত ব্যাধির বিষে জর্জরিত একটি রুণ, অপরটি প্রায় পঙ্গু!
সন্তানবতী নারীদের উপর বন্ধ্যা পদ্মের একটা অবচেতনগত হিংসা আছে। এই মুহূর্তে কিন্তু সে হিংসাও তাহার স্তব্ধ হইয়া গেল। সে আপনা-আপনি কেবলি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
ছিরু পালের স্ত্রী বলিল—তোমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। চাষীর মেয়ে—আমি জানি। তুমি ভাই এই টাকা কটা রাখ—বলিয়া সে স্তম্ভিত পদ্মের হাতে দুখানি দশ টাকার নোট জিয়া দিয়া আবার বলিল লুকিয়ে এসেছি, ভাই, জানতে পারলে আমার আর মাথা থাকবে না বলিয়াই সে দ্রুতপদে ফিরিল। দরজার মুখে গিয়া আবার একবার ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাত দুটি জোড় করিয়া বলিল-আমার ছেলে দুটির কোনো দোষ নাই ভাই। আমি হাত জোড় করে যাচ্ছি।
পরমুহূর্তে সে খিড়কির দরজার ওপাশে অদৃশ্য হইয়া গেল। পদ্ম যেন অসাড় নিস্পন্দ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল—
কিছুক্ষণ পরে তাহার এই স্তম্ভিত ভাব কাটিয়া গেল অদূরবর্তী একটা কোলাহলের আঘাতে। আবার একটা কোথায় গোলমাল বাঁধিয়া উঠিয়াছে। সকল কোলাহলের উর্ধ্বে একজনের গলা শোনা যাইতেছে। পদ্ম উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; অনিরুদ্ধ কি? না, সে নয়। তবে? ছিরু পাল? কান পাতিয়া শুনিয়া পদ্ম বুঝিলনা, এ ছি পালের কণ্ঠস্বরও নয়। তবে? সে দ্রুতপদে আসিয়া বাহির দরজার সম্মুখে পথের উপর নামিয়া দাঁড়াইল। এবার সে স্পষ্ট চিনিতে পারিল এ কণ্ঠস্বর এ গ্রামের একমাত্র ব্রাহ্মণ বাসিন্দা হরেন্দ্র ঘোষালের। পদ্ম এবার নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত দুই-ই হইল। মুখে খানিকটা ব্যঙ্গহাস্যও দেখা দিল। হরেন্দ্র ঘোষালের মাথায় বেশ খানিকটা ছিট আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। গ্রামের সকলকে টেক্কা দিয়া তাহার চলা চাই। ছিরু পাল সাইকেল কিনিলে, সে সাইকেল এবং কলের গান দুই-ই কিনিয়া ফেলিল, টাকা যোগাড় করিল জমি বন্ধক দিয়া। ছিরু পাল নাকি রহস্য করিয়া একবার রটনা করিয়াছিল—সে এবার ঘোড়া কিনিবে। হরেন্দ্র মান রক্ষার জন্য চিন্তিত হইয়া মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াছিল—ছিরু পাল ঘোড়া কিনিলে সে একটা হাতি কিনিবে। আজ আবার বামুনের কি বোঞ্ছ মাথায় চাপিয়াছে কে জানে? পথে। কোনো একটা ছোট ছেলেও নাই যে জিজ্ঞাসা করে।
ঠিক এই সময়েই পদ্ম দেখিল অনিরুদ্ধ আসিতেছে। কাছে আসিয়া পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া সে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
পদ্ম বলিল—মরণ-হাসছ কেন? অনিরুদ্ধ হাসিয়া প্রায় গড়াইয়া পড়িল।
—যা গেল! ব্যাপারটা বলে তবে তো মানুষে হাসে! এত চেঁচামেচি কিসের; হল কি? হরু ঠাকুর এমন চেঁচাচ্ছে কেন?
—ঠাকুরকে ভারি জব্দ করেছে। আধখানা কামিয়ে দিয়ে। আবার হাসিতে সে ভাঙিয়া পড়িল।
বহুকষ্টে হাস্য সংবরণ করিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তারা নাপিত মহা ধূর্ত!
কাপড় ছাড়িয়া খাইতে বসিয়া এতক্ষণে অনিরুদ্ধ কোনোমতে কথাটা শেষ করিল। সেটা এই—তারা নাপিতও তাহাদের দেখাদেখি বলিয়াছে, ধান লইয়া গোটা বৎসর সমস্ত গ্রামের লোকের ক্ষৌরির কাজ সে করিতে পারিবে না। যাহাদের জমি নাই—হাল নাই—তাহাদের ধান পাওয়া যায় না। যাহাদের আছে তাহারাও সকলে দেয় না। সুতরাং ধান লইয়া ক্ষৌরির কারবার ছাড়িয়া সে নগদ কারবার শুরু করিয়াছে। হঠাকুর কামাইতে গিয়াছিল—তারা নাপিত পয়সা চাহিয়াছিল। খানিকটা বকাইয়া অবশেষে পয়সা দিব বলিয়াই হঠাকুর কামাইতে বসে।
অনিরুদ্ধ বলিল—তারা নাপিত—একে নাপিত ধূর্ত, তায় তারা। আধখানা কামিয়ে বলে–কই, পয়সা দাও ঠাকুর। হরু বলে—কাল দোব। তারাও অমনি ক্ষুর, ভাঁড় গুটিয়ে ঘরে ঢুকে বলে দিয়েছে—তা হলে আজ থাককাল বাকিটা কামিয়ে দেব। এই চেঁচামেচি গালাগালি-হিন্দি ফার্সি ইংরেজি। গাঁয়ের লোকেরা সব আবার জটলা পাকাচ্ছে।
অনিরুদ্ধ আবার প্রবল কৌতুকে হাসিয়া উঠিল এবং সে হাসির তোড়ে তোর মুখের ভাত ছিটাইয়া উঠানময় হইয়া গেল।
পদ্মের খানিকটা শুচি-বাতিক আছে; তাহার হুঁ-হাঁ করিয়া উঠিবার কথা, কারণ সব উচ্ছিষ্ট হইয়া যাইতেছে। কিন্তু আজ সে কিছুই বলিল না। অনিরুদ্ধের এত হাসিতেও সে এতক্ষণের মধ্যে একবার হাসে নাই। কথাটা অনিরুদ্ধের অকস্মাৎ মনে হইল। সে গভীর বিস্ময়ে পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল-তোর আজ কি হল বল্ দেখি?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পদ্ম বলিল—ছিরু পালের বউ লুকিয়ে এসেছিল।
–কে? বিস্ময়ে অনিরুদ্ধ সচকিত হইয়া উঠিল।
–ছিরু পালের বউ গো! তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত কথাগুলি বলিয়া পদ্ম কাপড়ের খুঁটেবাধা নোট দুইখানি দেখাইল।
অনিরুদ্ধ নীরব হইয়া রহিল।
পদ্ম আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আহা, মায়ের প্রাণ।
অনিরুদ্ধ আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া অকস্মাৎ গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া পড়িল, যেন। অ্যাঁকি দিয়াই নিজেকে টানিয়া তুলিল; বলিলবাবাঃ! রাজ্যের কাজ বাকি পড়ে গিয়েছে। এইবার খেয়েদেয়ে দেড় ক্ৰোশ পথ ছুটতে হবে।
পদ্ম কোনো কথা বলিল না। অনিরুদ্ধ হাত-মুখ ধুইয়া মসলা মুখে দিয়া একটা বিড়ি ধরাইল। এবং একমুখ হাসিয়া বলিল—একখানা নোট আমাকে দে দেখি।
পদ্ম কুঞ্চিত করিয়া অনিরুদ্ধের মুখের দিকে চাহিল। অনিরুদ্ধ আরও খানিকটা হাসিয়া বলিল ললাহা আর ইস্পাত কিনতে হবে পাঁচ টাকার। ছিরে শালাকে টাকা দিতে খদ্দেরের পাঁচ টাকা ভেঙেছি। আর
পদ্ম কোনো কথা না বলিয়া একখানা নোট অনিরুদ্ধের সম্মুখে ফেলিয়া দিল।
অনিরুদ্ধ কুড়াইয়া লইয়া হাসিয়া বলিল-আমি নিজে একটি–। মাইরি বলছি—একটি টাকার এক পয়সা বেশি খরচ করব না। কতদিন খাই নাই তুই বল?
অর্থাৎ মদ।
তবু পদ্ম কোনো কথা বলিল না। অকস্মাৎ যেন অনিরুদ্ধের উপর তাহার মন বিরূপ হইয়া উঠিয়াছে।