Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আকাশের ভোরের আলো

আকাশের ভোরের আলো ভাল করিয়া তখনও ফোটে নাই—দেবু বিছানা ছাড়িয়া ওঠে। শৈশব হইতেই তাঁহার এই অভ্যাস। একা দেবুর নয় পল্লীর অধিকাংশ লোকই, দিন শুরু হইবার পূর্ব। হইতেই দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আরম্ভ করে। মেয়েরা উঠিয়া দুয়ারে জল দেয়, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করে, নিকায়, পুরুষেরা গরু-বাছুরকে খাইতে দেয়। ইহা ছাড়াও যাহার বাড়িতে যখন ধানোনার কাজ থাকে, তখন তাহার বাড়িতে জীবনের সাড়া জাগিয়া ওঠে রাত্রির শেষ প্রহর হইতে। রাত্রির নিস্তব্ধ শেষ-প্রহরে পেঁকির শব্দ ওঠে দুম-দুম-দুম করিয়া একটি নির্দিষ্ট তালে; মৃদু কথাবার্তার সাড়া পাওয়া যায়, কেরোসিনের ডিবের আলোর আভাস জাগে। পল্লীর এই সময় ওই নূতন ধানের সময় অনেক বাড়ি হইতে চেঁকির সাড়া ওঠেই। আজ কোনো বাড়িতেই সাড়া। ওঠে নাই। ইতুলক্ষ্মীর পর্ব, শস্যের উপর ভেঁকির আঘাত দিতে নাই; আজ সঞ্চয়ের দিন।

বিলুকে দেবু বলিল—দেখ আজ বাইরের উঠানটাও নিকুতে হবে। গোমস্তা এসেছে—এখন কিছুদিন বাড়িতেই পাঠশালা বসবে।

গোমস্তা আসিয়াছে, চণ্ডীমণ্ডপে এখন গোমস্তার কাছারি বসিবে। গ্রাম্য দেবোত্তর সম্পত্তির সেবাইত হিসাবে চণ্ডীমণ্ডপের মালিক জমিদার; তবে সাধারণের ব্যবহার্য স্থানসাধারণের ব্যবহারের অধিকার আছে। সেই অধিকারেই গ্রামের লোক ব্যবহার করে সেই দায়িত্বে। চণ্ডীমণ্ডপটির রক্ষণাবেক্ষণও তাহারাই করে। চাঁদা করিয়া খড় তুলিয়া তাহারাই ছাওয়ায়, প্রয়োজন হইলে ভাঙা-ফুটো তাহারাই মেরামত করায়, এমনকি চণ্ডীমণ্ডপটি তাহারাই একদা নিজেরা চাঁদা তুলিয়া সৃষ্টি করিয়াছিল। সে অনেক পূর্বের কথা, তখনকার জমিদার মালিক হিসাবে তাহাতে সম্মতি দিয়াছিলেন মাত্র। তাহার অধিক দিয়াছিলেন গোটা দুই তাল গাছ চালকাঠের জন্য।

চণ্ডীমণ্ডপে প্রণাম করিয়া দেবু মাঠের দিকে বাহির হইয়া গেল; গ্রামের প্রবীণারা তখন বাবা-শিব ও মা-কালীর দুয়ারে জল ছিটাইয়া প্ৰণাম করিতেছে। জলে-জলে দেবতার ঘরের চৌকাঠের নিচের কাঠ একেবারে পচিয়া খসিয়া গিয়াছে, কপাটের নিচের খানিকটাও ক্ষয়িষ্ণু হইয়াছে। এবার মেরামত না করাইলে পূজার সময় ভোগের সামগ্রীর গন্ধে বিড়াল তো ঢুকিবেই—কুকুর প্রবেশ করিলেও আশ্চর্য হইবার কিছু থাকিবে না।

ঘোড়া পুরোহিত বলে—এত করে জল দিও না, মা-সকল, জল একটুকুন কম করেই দিও; তোমাদেরই পরনোকের পথে কাদা হবে, পেছল হবে-তাতেই বলছি। শেষে রথের চাকা গেড়ে গিয়ে আর উঠবে না।

মোড়লপিসি মূর্খের মত জবাব দেয়, বলে—রথের ঘোড়া তো আর তোমার ওই তেঠেঙে বেতো ঘোড়া নয়, ঠাকুর, তার লেগে আর তোমাকে ভাবতে হবে না। পুরোহিত হাসিয়া বলে—আমার ঘোড়া সেই রথের ঘোড়ারই বাচ্চা মোড়লপিসি। আমার ঘোড়ার তো তিনটে ঠ্যাঙ, ওর মা-বাবার মাত্তর দুটো, শোন নাই, ডান ঠ্যাঙটা লটর-পটর, বা ঠ্যাঙটা খোঁড়া, বাবা বদ্যিনাথের ঘোড়া।

জগন ডাক্তার বলে আরও কর্কশ কঠোর কথা, বলে—কেউ চোর, কেউ উঁচড়া, কেউ ছেনাল; হিংসুটে-বদমাশ-কুঁদুলি তো সবাই; সকালে আসেন সব পুণ্যি করতে! নিয়ম করে দাও, দেবতার দোরে জল দিতে হলে সবাইকে রোজ একটি করে পয়সা দিতে হবে; দেখবে একজনাও আর আসবে না। দেখ না পুকুরের জল সব ঘড়া ঘড়া আনছে আর ঢালছে।

দেবু কোনো কথাই বলে না। জগনের কথা অবশ্য মিথ্যা নয়; যে অপবাদ সে দেয়, তাহা। অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু নিত্য-নিয়মিত প্রথম প্রভাতে দেবু যখন ইহাদের দেখে, তখন ওই পরিচয়গুলির কোনো চিহ্নই তাহাদের চোখেমুখে ভাবে ভঙ্গিতে সে দেখিতে পায় না। সম্পূৰ্ণ স্বতন্ত্র একদল মানুষকে সে দেখে। তখন ইহারা প্রত্যেকেই যেন এক এক কল্পলোকের যাত্ৰী! ইহারা যদি সদাসর্বদা এমনই মানুষ থাকিত। কিন্তু এই চণ্ডীমণ্ডপ হইতে বাহির হইয়া বাড়িতে পা দিতে না দিতেই প্রতিটি জনই আবার নিজমূর্তি ধারণ করে। কেহ আপনার দুঃখ-কষ্টের জন্য ভগবানকে শতমুখে গালি পাড়ে; কেহ হয়ত ঘাট হইতে অন্যের বাসন তুলিয়া লয়, কেহ হয়ত রাস্তায় প্রতীক্ষা করে পাইকারের অর্থাৎ গরু-বাছুরের দালালের, বুড়ো গাইটাকে বেচিয়া দিবে, দালালেরা বুড়ো গাই লইয়া কি করে সে সকলেই জানে। কিন্তু কয়েকটা টাকার লোভও সংবরণ করা তখন ইহাদের সাধ্যের অতীত। মানুষেরা আশ্চর্য, মানুষেরা বিচিত্ৰ—একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দেবু চণ্ডীমণ্ডপ হইতে নামিয়া আসিল।

কৃষাণেরা মাঠে চলিয়াছে; বাউরি, ডোম, মুচি প্রভৃতি শ্ৰমিক চাষীর দল। পরনে খাটো কাপড়, মাথায় গামছাখানা পাগড়ি করিয়া বাধা। তাহার সঙ্গে একখানা পরনের কাপড়ই গায়ে র্যাপারের মত জড়াইয়া হুঁকো টানিতে টানিতে চলিয়াছে। অন্য হাতে কাস্তে। ধান কাটার পালা এখন। গ্রামের চাষী গৃহস্থেরাও অধিকাংশই নিজহাতে কৃষাণদের সঙ্গেই চাষ করে, তাহারাও কাস্তে হাতে চলিয়াছে। খাটে খাটায় দুনো পায় অর্থাৎ চাষে যাহারা নিজেরাও সঙ্গে খাঁটিয়া চাষী মজুরদের খাটায়, তাহাদের চাষে দ্বিগুণ ফসল উৎপন্ন হয়—এই প্রবাদবাক্যটা ইহারা আজও মানিয়া চলে। এ গ্রামে কেবল দুই-চারিজন নিজেরা চাষে খাটে না। হরেন্দ্র ঘোষাল ব্রাহ্মণ, জগন ঘোষ একে কায়স্থ তায় আবার ডাক্তার, দেবু ঘোষ পাঠশালার পণ্ডিত, শ্ৰীহরি সম্প্রতি কুলীন সদ্‌গোপ এবং বহু ধন-সম্পত্তির মালিক, এই কয়জনই চাষে খাটে না। সতীশ বাউরি তাহাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে মাতব্বর গোছের লোক। লোকটির নিজের হালগরু আছে। জমি অবশ্য তাহার নিজের নয়—পরের জমি ভাগে চাষ করে। বেশ বিজ্ঞধরনের কথা কয়। দেবুকে দেখিয়া হেঁট হইয়া সে প্রণাম করিল, বলিল—পেনাম হই পণ্ডিতমশায়!… সঙ্গে সঙ্গে দলের সকলেই প্রণাম করিল।

দেবু প্রতিনমস্কার করিয়া বলিল-মাঠে যাচ্ছ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। সতীশ নিজের সঙ্গীদের বলিলপণ্ডিতমশায়ের মত মানুষটি আর দ্যাখলাম না। পেনাম করলে অনেক মণ্ডল মশাইরা তো রা পর্যন্ত কাড়ে না। পণ্ডিতমশায় কিন্তুক কপালে হাতটি ঠেকাবেই। কখনও তুইকারি শুনলাম না উহার মুখে।

দেবু কথা বলিল না, দ্রুতপদে আগাইয়া যাইবার চেষ্টা করি। কিন্তু সতীশ বলিলহ গো, পণ্ডিতমশায়—এ কি হবে বলেন দেখি?

–কিসের? কি হল তোদের?

–আজ্ঞে, একা আমাদের লয়, গোটা গায়ের নোকেরই বটে। এই সেটেলমেন্টোরের কথা বলছি। সাত দিন পরেই বলছে আরম্ভ হবে। দিনরাত হাজির থাকতে হবে, নোয়ার শেকল টেনে মাপ হবে; তা হলে ধান কাটাই বা কি করে হয় আর পাকা ধানের ওপর শেকল টানলে ধানই বা থাকে কি করে?

–গোমস্তা কি বললেন? পালই বা কি বলল?

–আজ্ঞে ঘোষমশাই বলুন।

–ঘোষ মশায়?

–আজ্ঞে, উনি এখন ছিহরি ঘোষ মশাই গো! ঘোষ বলতে হুকুম হয়েছে। জমিদারের কাগজ-পত্তরে, মায় আদালতে পর্যন্ত ঘোষ করে লিয়েছেন পাল কাটিয়ে।

—তাই নাকি? ওঁরা কি বললেন? কাল তো তোমরা গিয়েছিলেন সব!

আজ্ঞে ডাক হয়েছিল, গিয়েছিলাম। তা ওঁরা বললেন–দিনরাত খেটে ধান কেটে ফেল সব সাত দিনের মধ্যে। তাই কি হয় গো? আপনিই বলেন ক্যান পণ্ডিতমশায়?

দেবু চুপ করিয়া রহিল, কোনো উত্তর দিল না। কাল সমস্ত রাত্রি সে এই কথাটাই ভাবিয়াছে। কিন্তু কোনো উপায়ই স্থির করতে পারে নাই। সতীশ বলিল—হোথা থেকে এলাম তো দেখি, ডাক্তারবাবু পাড়ায় এসেছেন, বলছেন–টিপছাপ দিতে হবে, দরখাস্ত পাঠাবেন। তা হ্যাঁ মশায়, দরখাস্তে কি হবে গো? এই তো ঘরপোড়ার লেগে দরখাস্ত করলাম—কি হল? তা ছাড়া দরখাস্ত করলে সেটেলমেন্টোর হাকিম যদি রেগে যায়!


বাংলাদেশে ইংরাজি ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় কোনো জরিপবন্দি হয় নাই। তখনকার দিনে সীমানা-সরহদ্দ লইয়া দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মকদ্দমার আর অন্ত ছিল না। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে গভর্নমেন্ট হইতে পঁয়ত্রিশ বৎসর ধরিয়া জরিপ করিয়া মাত্র গ্রামগুলির সীমানা নির্ধারিত হইয়াছিল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে জরিপ আইন পাস হইবার পর বাংলাদেশে নূতন জরিপের এক পরিকল্পনা হয়। প্রতিটি টুকরা জমি, তাহার বিবরণ এবং তাহার স্বত্ব-স্বামিত্ব নির্ধারণ করিবার জন্যই এ জরিপের আয়োজন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাহার জের এই গ্রামাঞ্চলে আসিয়া পড়িয়াছে। গ্রাম্য লোকগুলি বিভীষিকায় একেবারে ক্ৰস্ত হইয়া উঠিয়াছে।

জরিপের সময়ে এতটুকু ক্রটিতে হাকিম নাকি বেত লাগায়, হাতকড়ি দিয়া জেলে পাঠাইয়া দেয়। এই ধরনের নানা গুজবে অঞ্চলটা উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।

আরও আছে, জরিপের পর প্রজাদের জরিপের খরচের অংশ দিতে হইবে। না দিলে অস্থাবর ক্রোক হইবে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হইবে।

তাহার পর জমিদার দাবি করিবে খাজনা-বৃদ্ধি; প্রতি টাকায় চার আনা, আট আনা, এমনকি টাকায় টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধিও হইতে পারে, হাইকোর্টের নাকি নজির আছে। নাখরাজ বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইবে। বজায় থাকিলে সেস লাগিবে, সে সেসের পরিমাণ নাকি খাজনারই সমান—কম নয়; এমনি আরও অনেক কিছু হইবে।

ফিরিবার পথে দেবু দেখিল—জনকয়েক মাতব্বর ইতিমধ্যেই চণ্ডীমণ্ডপে সমবেত হইয়াছে; সকলে তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছিল। দেবু চণ্ডীমণ্ডপেই উঠিয়া আসিল। হরিশ প্রশ্ন করিলহয়েছে?

রাত্রে তাহার একখানা দরখাস্ত লিখিয়া রাখিবার কথা ছিল। কিন্তু দেবুর দরখাস্ত লেখা হইয়া ওঠে নাই। দরখাস্তে তাহার আস্থা নাই। দরখাস্তের প্রসঙ্গে মনে পড়িয়া গিয়াছিল কয়েকটি তিক্ত ঘটনার স্মৃতি। নিজে সে এককালে কয়েকবার দরখাস্ত করিয়াছিল, সেই দরখাস্তের ফলের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল।

তখন বাপের মৃত্যুর পর সদ্য সে স্কুল ছাড়িয়া নিজের হাতেই চাষ করিত। সেদিন মাঠে সে হাল চালাইতেছিল। খাকি পোশাক-পরা টুপি মাথায় পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর মাঠের পথে যাইতে যাইতে তাহাকে ডাকিয়া বলিয়াছিল—এই শোন্।

দেবু এই অভদ্রজনোচিত সম্ভাষণে অসন্তুষ্ট হইয়াই উত্তর দেয় নাই।

—এই উল্লুক!

দেবু এবারও উত্তর দেয় নাই। দেবুর সেই প্রথম দরখাস্ত। দরখাস্ত করিয়াছিল পুলিশ সাহেবের কাছে। তদন্ত হইল মাস কয়েক পর। তদন্তে আসিলেন ইন্সপেক্টর।

দেবুর অভিযোগ শুনিয়া তিনি মিষ্ট কথায় ব্যাপারটা মিটাইয়া দিলেন, বলিলেনদেখ বাপু, জমাদার বাবু তোমার বাপের বয়সী। তুই বললেও তোমার রাগ করা উচিত নয়। উল্লুক বলাটা অন্যায় হয়েছে, যদি উনি বলে থাকেন।

দেবু বলিল—উনি বলেছেন।

—বুঝলাম, কিন্তু সাক্ষী কে বল?

সাক্ষী ছিল না। ইন্সপেক্টর বলিলেন—যাক, তুমি বাড়ি যাও। কিছু মনে কোরো না।

দেবুর ক্ষোভ কিন্তু মেটে না।

দ্বিতীয় দরখাস্তের অভিজ্ঞতা বিচিত্র। জমিদার বৈশাখ মাসে খাসপুকুর হইতে মাছ ধরিবার ব্যবস্থা করিয়াছিল। সেইটিই একমাত্র পানীয় জলের পুকুর। জল অল্পই ছিল, সেই জল আরও খানিকটা বাহির করিয়া দিয়া মাছ ধরিবার কথা হইল। গ্রামের লোকে শিহরিয়া উঠিল। বলিল–ওটুকু জল, কেটে বের করে দিলে থাকবে কতটুকু? তার উপর মাছ ধরলে যে কাদা ছাড়া কিছু থাকবে না। আমরা খাব কি?

গোমস্তা বলিল—জমিদারের বাড়িতে কাজ, তিনিই বা মাছ কোথায় পাবেন বল?

প্রজারা খোদ জমিদারের কাছে গেল; জমিদার বলিলেনতোমরা মাছ দাও, নয় মাছের দাম দাও।

তরুণ দেবু এক দরখাস্ত করিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে। কিন্তু কিছুই হইল না। জমিদারের চাপরাসীরা শোভাযাত্ৰা করিয়া আসিয়া মাছ ধরাইয়া পুকুরটাকে পঙ্ক-পৰ্ব্বলে পরিণত করিয়া দিয়া গেল। দেবুর ক্ষোভের আর সীমা রহিল না। হঠাৎ সাত দিন পর, অকস্মাৎ দারোগাকনস্টেবল-চৌকিদারের আগমনে গ্রামখানা ক্ৰস্ত হইয়া উঠিল। তাহাদের সঙ্গে একজন সাহেবি পোশাক-পরা অল্পবয়সী ভদ্রলোক। দারোগা আসিয়া দেবুকে ডাকিল। বলিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাহাদুর ডাকছেন তোমাকে।

দেবু অবাক হইয়া গেল। সাহেব নিজে আসিয়াছেন। কিন্তু এখন আসিয়া ফল কি? সাহেবকে সে নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল। সাহেব প্রতিনমস্কার করিলেন। সে আরও আশ্চর্য হইয়া গেল সাহেবের কথায়।

—আপনি দেবনাথ ঘোষ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

দারোগা বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর বলতে হয়।

সাহেব বলিলেন—থাক। তারপর সমস্ত শুনিলেন-পুকুর নিজে দেখিলেন। পুকুরের পাড়ে দাঁড়াইয়া জলের অবস্থা দেখিয়া তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। দেবুর আজও মনে আছে ভদ্রলোকের চোখ হইতে ফোঁটাকয়েক জল ঝরিয়া পড়িয়ছিল। রুমালে চোখ মুছিয়া সাহেব বলিলেন—তাই তো দেবুবাবু, এসে তো কিছু করতে পারলাম না আমি।

দেবু বলিল-আমি দরখাস্ত করেছিলাম পাঁচ দিন আগে হুজুর!

—ডাকে যেতে এক দিন লেগেছে। দরখাস্ত যথানিয়মে পেশ হতেও কোনো কারণে দেরি হয়েছে। সে কারণ আমি একোয়ারি করব। তারপর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেনদেবনাথবাবু, এসব ক্ষেত্রে দরখাস্ত করবেন না। নিজে যাবেন, একেবারে আমাদের কাছে গিয়ে সরাসরি জানাবেন। দরখাস্ত?—শব্দটা উচ্চারণ করিতে করিতে তিনি হাসিয়াছিলেন।

সাহেব গ্রামের জন্য একটা ইদারা মঞ্জুর করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও শেষ পর্যন্ত হয় নাই। কারণ, সাহেব এ জেলা হইতে চলিয়া যাওয়ার সুযোগে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কঙ্কণার বাবু সেটা অন্য গ্রামে মঞ্জুর করিয়া দিয়াছে। এ গ্রামের মেম্বার হিসাবে শ্রীহরিও তাহাতে সম্মতি ভোট দিয়াছে। দেবনাথ জমিদারের মাছ ধরার জন্য দরখাস্ত করিয়াছিল। সাজাটা তাহারই জন্য গোটা গ্রামের লোক ভোগ করিল।

দরখাস্ত! একটা গল্প তাহার মনে পড়ে। কোনো রাজার বাড়িতে আগুন লাগিয়াছিল; রাজা ছিলেন দার্জিলিঙে। আগুন নিভাইবার হাঁড়ি বালতি কিনিবার জন্য বরাদ্দ না থাকায় রাজার নিকট টেলিগ্রাম করা হইল। হুকুম টেলিগ্রামে আসিলেও চব্বিশ ঘণ্টার পর। ততক্ষণে সবকিছুকে ভস্মসাৎ করিয়া আগুন আপনা-আপনি নিভিয়া গিয়াছে। দরখাস্তের কথায় ওই গল্প তাহার মনে পড়ে, মুখে তিক্ত হাসি ফুটিয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই সাহেবকে। মিঃ এস. কে. হাজরা, আই—সি—এস। দেবু তাহাকে শ্রদ্ধা করে।

দেবু উত্তর দিল—না হরিশ-কাকা, লেখা হয় নাই।

লেখা হয় নাই শুনিয়া হরিশ, ভবেশ প্রভৃতি প্রবীণগণ সকলেই অসন্তুষ্ট হইল। হরিশ। বলিল—তুমি বললে লিখে রাখবে, ভার নিলে! জল খাওয়ার পর গায়ের লোক সব আসবে, দস্তখত করবে। এখন বলছ হয় নাই! এ কি রকম কথা হে? পারবে না বললে ডাক্তারই লিখে রাখত।

ভবেশ বলিল—এাই কথা। স্পষ্ট কথার কষ্ট নাই। বললেই তো অন্য ব্যবস্থা হত।

দেবু হাসিল, বলিল-দরখাস্ত না হয় আমি এখনই লিখে দিচ্ছি ভবেশদাদা, কিন্তু দরখাস্ত। করে হবে কি বলতে পার?

সকলেই চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হরিশ বলিল—তা হলে কি করব বল? কিছু করতে তো হবে, এমন করে-ধর–আপনাকেই বা পেবোধ দিই কি বলে?

—এক কাজ করবেন?

–কি, বল?

–পাঁচখানা গায়ের লোক ডাকুন, তারপর চলুন সকলে মিলে সদরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।

–তাতে ফল হবে বলছ?

–দরখাস্তের চেয়ে বেশি হবে নিশ্চয়।

সকলে আপনাদের মধ্যেই আবার গুঞ্জন শুরু করিল।

পাঠশালার ছেলেরা ইতিমধ্যে চণ্ডীমণ্ডপেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল; দেবু তাহাদের বলিল—এইখানেই এসেছ সব? আচ্ছা আজ এইখানেই ওই পাশে বসে সব পড়তে আরম্ভ কর। কালকে যে পদ্যের মানে লিখতে দিয়েছিলাম সবাই লিখেছ তো? খাতা আন সব রাখ এইখানে।

হরিশ ডাকিল–দেবু!

–বলুন!

—তবে না হয় তাই চল। না কি গো? তোমাদের মত কি? হরিশ জিজ্ঞাসু নেত্রে সকলের দিকে চাহিল।

ভবেশ উৎসাহিত হইয়া উঠিয়া বলিল হরির নাম নিয়ে তাই চল সব। ধরে তো আর খেয়ে ফেলবে না সায়েব! আমি রাজি। বল হে সব বল, আপন আপন কথা বল সব!

মনে মনে সকলেই একটা উত্তেজনার উচ্ছ্বাস অনুভব করিল। হরেন ঘোষাল সর্বাপেক্ষা বেশি উত্তেজিত হইয়াছিল, সে সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বুকে হাত রাখিয়া বলিল-আই হ্যাম রেডি! এস্পার কি ওভার, যা হয় হয়ে যাক।

–ব্যস, তাই চল, কাল সক্কালেই!

–হ্যাঁ! হ্যাঁ! হ্যাঁ!

এবার একটা সমবেত সম্মতি প্রায় ঐকতানের মত ধ্বনিত হইল।

–কিন্তু!–ভবেশের একটা কথা মনে পড়িয়া গেল।

–কিন্তু কি? হরিশ বলিল—আবার কিন্তু করছ কেনে?

–পাঁজিটা একবার দেখবে না? দিন-খ্যান কেমন–?

–তা বটে। ঠিক কথা।

সকলে মুহূর্তে সায় দিয়া উঠিল।

দেবু তিক্ত স্বরে বলিল—আপনারা মানেন কিন্তু রাজার কাজে তো পাজি মানে না। দশ দিন যদি ভাল দিন-ক্ষণ না থাকে?

ঘোষাল উত্তেজিত স্বরে বলিলড্যাম ইওর পাজি! বোগাস্ ওসব।

দেবু বলিল-মামলার দিন থাকলে যে মঘাতেও যেতে হয়।

হরিশ একটু ভাবিয়া বলিলতা ঠিক। রাজদ্বারে পাঁজি-পুঁথি নাই।

দেবু বলিলভোর ভোর বেরিয়ে পড়লে দশটা নাগাদ ঠিক কোর্টের সময়েই গিয়ে পৌঁছানো যাবে। আপন আপন খাবার সকলে সঙ্গে নেবেন; চিড়ে গুড় যে যা পারেন। একটা দিন বৈ তো নয়।

ঠিক এই সময় চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া উপস্থিত হইলগোমস্তা দাশজী, শ্ৰীহরি ঘোষ, ভূপাল নন্দী এবং আরও কয়েকজন; তাহার মধ্যে একজন খোকন বৈরাগীলোকটি এ অঞ্চলে রাজমিস্ত্রির কাজ করিয়া থাকে।

দাশজী হাসিয়া বলিল—কি গো, দেবু মাস্টারের পাঠশালায় সব আবার নূতন করে নাম লেখালেন নাকি? ব্যাপার কি সব?

কে কি উত্তর দিত কে জানে, কিন্তু সে দায় হইতে সকলকে নিষ্কৃতি দিয়া হরেন ঘোষাল সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিল—উই আর গোয়িং টু দি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট-কাল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে যাচ্ছি সব ধান কটা না হওয়া পর্যন্ত খানাপুরী স্টড বন্ধ রাখতে হবে।

ভ্রূ নাচাইয়া দাশজী প্ৰশ্ন করিল, ঘোষাল মহাশয়ের হাত কটা? দুটো না চারটে?

এমন ভঙ্গিতে সে কথাগুলি বলিল যে, ঘোষাল কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হইয়া চুপ করিয়া গেল। তারপর সে-ই চিৎকার করিয়া উঠিল—ব্রাহ্মণকে তুমি এত বড় কথা বল?

দাশজী সে কথার উত্তর দিল না, শ্ৰীহরির হাতে একখানা কাগজ ছিল, সেখানা টানিয়া লইয়া বলিল এই দেখ। বেশি লাফিয়ো না। জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেপ্তার। সেটেলমেন্টের কার্যে বাধা দেওয়ার অপরাধে জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেপ্তার হইয়াছেন। এই নাও, পড়ে দেখ। সে কাগজখানা মজলিসের মধ্যে ছড়িয়া ফেলিয়া দিল।

ঘোষালই কাগজখানা কুড়াইয়া লইয়া হেড লাইনে চোখ বুলাইয়া বলিয়া উঠিল—মাই গড়! পাংশু বিবৰ্ণ মুখে কাগজখানা দেবুর দিকে বাড়াইয়া দিল। দেবু কাগজখানা পড়িতে আরম্ভ করিল।

শ্ৰীহরি বলিল-আমাকে তো আপনারা বাদ দিয়েই সব করছেন, তা করুন। আমি কিন্তু আপনাদের কথা না ভেবে পারি না। ওসব করতে যাবেন না। পাথরের চেয়ে মাথা শক্ত নয়। তার চেয়ে চলুন বিকালবেলা সেটেলমেন্ট হাকিমের সঙ্গে দেখা করে আসি। দাশজী যাবেন, আমি যাব, মাতব্বর জনকয়েক আপনারাও চলুন। ভাল রকমের ডালিও একটা নিয়ে যাই। মাছ একটা ভালই পড়েছে, বুঝলেন হরিশখুড়ো, পাকি বার সের।

বলিতে বলিতেই বোধ করি তাহার একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। দাশজীকে বলিলা গো, সেই ইয়ে, মানে মুরগির জন্য লোক পাঠানো হয়েছে তো? সবাই মিলে ধরে পেড়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আর, ওই না-রাজি দরখাস্ত করা, কি একেবারে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে দরবার করতে যাওয়াও একরকম সরকারের হুকুমের বিরোধিতা করা। তাত আমাদের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। নাকি গো? শ্ৰীহরি জিজ্ঞাসা করিল গোমস্তা দাশজীকে।

দেবু কাগজখানা দাশজীর হাতেই ফেরত দিল, তারপর মজলিসের দিকে পিছন ফিরিয়া অখণ্ড মনোযোগের সহিত সে ছেলেদের পড়াইতে আরম্ভ করিল। সে ইহাদের জানে। ইহারই মধ্যে সব সঙ্কল্প তাসের ঘরের মত ভাঙিয়া পড়িয়াছে। সে উঠিয়া গিয়া। ব্ল্যাকবোর্ডের উপর খড়ি দিয়া লিখিল, মুখে বলিতে লাগিল, এক মণ দুধের দাম যদি পাঁচ টাকা দশ আনা হয়।

ওদিকে মজলিসে আবার পরামর্শের গুঞ্জনধ্বনি উঠিল। হরেন ঘোষালেরই চাপাগলা বেশ স্পষ্ট শোনা যাইতেছিলভেরি নাইস হবে! ভেরি গুড পরামর্শ!

দাশজী এবার খোকন মিস্ত্রিকে বলিল—ধ দড়ি ধ। ভূপাল তুই ধর একদিকে।

খোকন বৈরাগী খানিকটা বাবুই ঘাসের দড়ি হাতে অগ্রসর হইয়া আসিল, সর্বাগ্রে ভূমিষ্ঠ হইয়া দেবদেবীকে প্রণাম করিল—তারপর জোড়হাতে বলিল—আরম্ভ করি তা হলে?

দাশজী বলিল-দুগ্‌গা বলে, তার আর কথা কি? শুনছেন গোহরিশ মণ্ডল মশায়, ভবেশ পাল! চণ্ডীমণ্ডপ পাকা করে বাঁধানো হচ্ছে। আপনারাও একটা অনুমতি দেন।

–বাঁধানো হচ্ছে? পাকা করে? সমস্ত মজলিসসুদ্ধ লোক অবাক হইয়া গেল।

–হ্যাঁ। একটা কুয়োও হচ্ছে—ওই ষষ্ঠীতলায়। ঘোষমশায়, মানে, আমাদের শ্ৰীহরি ঘোষ গ্রামের উপকারের জন্য এইসব করে দিচ্ছেন।

শ্ৰীহরি নিজে হাত জোড় করিয়া সবিনয়ে বলিল—অনুমতি দেন আপনারা সবাই।

হরিশ বলিল-দীর্ঘজীবী হও বাবা। এই তো চাই। তা মা-ষষ্ঠীকে আর ধুলোয় মাটিতে রাখছ ক্যানে? ষষ্ঠীতলাটিও বাধিয়ে দাও।

শ্ৰীহরি বলিল—বেশ তো, তাও হোক। ষষ্ঠীতলা বলে খেয়ালই হয় নাই আমার।

হরিশ মজলিসের দিকে চাহিয়া বলিলতা হলে সেটেলমেন্টারের সম্বন্ধে দাশজী যা বলেছেন তাই ঠিক হল; বুঝলেন গো সব? দরখাস্ত-টরখাস্ত লয়।

শ্ৰীহরির খুড়া ভবেশ অকস্মাৎ ভ্রাতুষ্পত্রের গৌরবে ভাবাবেগে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল, উঠিয়া আসিয়া শ্ৰীহরির মাথায় হাত দিয়া আশীৰ্বাদ করিয়া বলিল মঙ্গল হবে, তোমার মঙ্গল হবে বাবা।

শ্ৰীহরি খুড়াকে প্রণাম করিল।

ঘোষাল চুপি চুপি বলিল, যি উইল ডাইছি এইবার নিশ্চয় মরবে। হঠাৎ এত বড় সাধু? এ তো ভাল লক্ষণ নয়! মতিভ্ৰম—দিস ইজ মতিভ্ৰম!

মজলিস ভাঙিয়া গিয়াছে। সকলে বাড়ি চলিয়া গিয়াছে। ওদিকে জলখাবারের বেলা হইয়াছে। রোদ মন্দিরের চূড়া হইতে গা বাহিয়া আটচালার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়াছে। দেবু ছেলেদের ছুটি দিয়া বলিল কাল থেকে আমার বাড়িতে পাঠশালা বসবে, বুঝেছ? সেইখানে যাবে সবাই।

–বাঁধানো হয়ে গেলে আবার এইখানেই বসবে তো পণ্ডিতমশায়?

–পাকা হলে বসবে বৈকি। যাও আজ ছুটি।

সে উঠিল, উঠিতে গিয়া তাহার নজরে পড়িল বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী এতক্ষণে টুকটুক করিয়া চণ্ডীমণ্ডপের উপরে উঠিতেছে। দেবু সম্ভাষণ করিয়া বলিল–চৌধুরীমশায় এত বেলায়?

–হ্যাঁ একটু বেলা হয়ে গেল। সকালে আসতে পারলাম না। দরখাস্তে সই করবার ডাক ছিল।

দেবু হাসিয়া বলিল–কষ্টই সার হল আপনার, দরখাস্ত করা হল না।

চৌধুরী হাসিয়া বলিলপথে আসতে তা সব শুনলাম। সদরে যাবার পরামর্শ হয়েছিল তা-ও শুনলাম। আবার নতুন হুকুম শুনলাম, বিকেলে আসতে হবে। তাই চলুন, বিকেলে দেখা যাক কি হয়।

–আমি যাব না চৌধুরীমশাই।

বৃদ্ধ দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল যা–পাঁচজনে ভাল বোঝে করুক, পণ্ডিত, আপনি মন খারাপ করবেন না।

দেবু জোর করিয়া একটু হাসিল।

–চলুন পণ্ডিত, আপনার ওখানে একটু জল খাব।

–আসুন, আসুন। দেবু ব্যস্ত হইয়া অগ্রসর হইল।

চলিতে চলিতে বৃদ্ধ বলিল–ও কিছু হবে না, পণ্ডিত! একদিন আমারও ভাল দিন ছিল–আর তখন ডালি দেওয়া তো হরির লুটের শামিল ছিল গো। আজকাল বরং একটু কম হয়েছে। তা দেখেছি বিশেষ কিছু হয় না। তার চেয়ে বরং সবাই মিলে গিয়ে পড়লে। কিছু হইত এ কথাও ভরসা করিয়া বলিতে পারি না।

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—এতটুকু সাহস নাই, মতিস্থির নাই; এরা মানুষ নয়, চৌধুরীমশায়! সে আর আত্মসংবরণ করিতে পারি না, চোখ ফাটিয়া জল আসিল। চোখ মুছিয়া হাসিয়া সে আবার বলিল—জানেন, পাঁচখানা গায়ের লোক যদি সদরে যেত, আমি বলতে পারি চৌধুরীমশায়, কাজ নিশ্চয় হত। সায়েব নিশ্চয় কথা শুনত। প্ৰজার দুঃখ শুনবে না কেন? হাজরা সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে সেবার বলেছিলেন। আমার মনে আছে।

বৃদ্ধ হাসিল—আপনি মিছে দুঃখু করছেন পণ্ডিত।

–দুঃখ একটু হয় বৈকি।

–একটা গল্প বলব চলুন।

জল খাইয়া কলার পেটোয় তামাক খাইতে খাইতে চৌধুরী বলিল—অনেক দিন আগে মহাগ্রামের ঠাকুরমশায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম প্রয়াগে কুম্ভস্নান করতে। হরেক রকমের সন্ন্যাসী দেখে অবাক হয়ে গেলাম। নাগা সন্ন্যাসী দেখলাম-উলঙ্গ বসে রয়েছে সব। কেউ বুক পর্যন্ত বালিতে পুঁতে রয়েছে, কেউ ঊর্ধ্ববাহু, কেউ বসে আছে লোহার কাঁটার আসনে, কেউ চারিদিকে অগ্নিকুণ্ড জেলে বসে রয়েছে। দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বললাম-স্বর্গ এদের হাতের মুঠোয়। আঃ! শুনে ঠাকুরমশায় বললেন চৌধুরী, একটা গল্প বলি শোন।

তখন সত্যযুগের আরম্ভ। সবে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। সবাই তখন সাধু; সত্যযুগ তো! বনে কুটির বেঁধে সব থাকেন ফলমূলে জীবন ধারণ চলে, ভগবানের নাম করেন, আর পরমানন্দে দিন বাটে। মা-লক্ষ্মী তখন বৈকুণ্ঠে, অন্নপূর্ণা কৈলাসে, মানে সোনা-রুপো, এমনকি অন্নেরও পর্যন্ত প্রচলন হয় নাই সংসারে। যাক্‌, এইভাবে এক পুরুষ কেটে গেল। তখন অকালমৃত্যু ছিল না, কাজেই হাজার বছর পরে একসঙ্গে একপুরুষের মৃত্যুর সময় হয়ে এল। মানুষেরা ঠিক করলেন—চল, আমরা সশরীরে স্বর্গে যাব। যেমন সঙ্কল্প তেমনি কাজ। বেরিয়ে পড়ল সব।

বদরিকাশ্ৰম পার হয়ে হিমালয়ের পথে পিঁপড়ের সারির মত মানুষ চলতে লাগল। ওদিকে স্বৰ্গদ্বারে দ্বারী ছিল, সে দেখতে পেলে, কোটি কোটি মানুষ কলরব করতে করতে সেই দিকেই চলে আসছে। সে ভয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে—দেবরাজ, মহা বিপদ উপস্থিত!

–কিসের বিপদ হে?

–কোটি কোটি কারা স্বর্গের দিকে চলে আসছে পিঁপড়ের সারির মত। বোধহয় দৈত্য-সৈন্য!

—দৈত্য-সৈন্য? বল কি?

সঙ্গে সঙ্গে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। এমন সময় এলেন দেবর্ষি নারদ। বললেন দৈত্য নয় দেবরাজ, মানুষ।

–মানুষ?

–হ্যাঁ, মানুষ। তোমাদের অস্ত্রে তাদের কিছুই হবে না; কারণ পাপ তো তাদের দেহে নাই, সুতরাং দেব-অস্ত্র অচল। দিব্যাস্ত্ৰ ফুলের মালা হয়ে যাবে তাদের গায়ে ঠেকে।

—তবে উপায়? এত মানুষ যদি সশরীরে এখানে আসে তবে ইন্দ্ৰ আর কথা বলতে পারলেন না। সবাই হয়ত দাবি করবে এই সিংহাসন!

শেষে বললেনচল নারায়ণের কাছে চল সব।

নারায়ণ শুনে হাসলেন। বললেন–আচ্ছা, চল দেখি। বলে প্রথমেই তিনি পাঠালেন মা। অন্নপূর্ণাকে।

অন্নপূর্ণা এসে পথে পুরী নির্মাণ করে ফেললেন—ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করে রাখলেন এক-অন্ন। পঞ্চাশ ব্যঞ্জনে। তারপর মানুষের সেই দল সেখানে আসবামাত্র তাদের বললেন পথশ্রমে বড়ই ক্লান্ত তোমরা, আজকের মত তোমরা আমার আতিথ্য গ্রহণ কর।

মানুষেরা পরস্পরের মুখের দিকে চাইল, রান্নার সুগন্ধে সকলেই মোহিত হয়ে গেল। দলের কতক লোক কিন্তু মোহ কাটিয়ে বললে—স্বর্গের পথে বিশ্রাম করতে নাই! তারা চলে গেল। যারা থাকল তারা অন্ন-ব্যঞ্জন খেয়ে পেট ফুলিয়ে সেইখানেই শুয়ে পড়ল। বললেমা, আমরা এইখানেই যদি থাকি, রোজ এমনি খেতে দেবে তো?

মা বললেন-–নিশ্চয়।

থেকে গেল তারা সেইখানেই।

যারা থামে নি, তারা চলল এগিয়ে। নারায়ণ তখন পাঠিয়ে দিলেন লক্ষ্মীকে। লক্ষ্মীর পুরী সোনার পুরী! সোনার পথ, সোনার ঘাট; সোনার ধুলো পুরীতে। দেখে মানুষের চোখ বেঁধে গেল।

মা বললেন—এসব তোমাদের জন্যে বাবা। এস-এস; পুরীতে প্রবেশ কর।

একদল প্রবেশ করলে।

পথে আরও এক পুরী তখন নিৰ্মাণ হয়ে আছে। ফুলের বাগান চারিদিকে, কোকিল ডাকছে, ভুবন-ভুলানো গান শোনা যাচ্ছে—আর এক অপূর্ব সুগন্ধ ভেসে আসছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অপ্সরার দল, এক হাতে তাদের অপরূপ ফুলের মালা আর এক হাতে সোনার পানপাত্র। তারা ডাকছে—আসুন, বিশ্রাম করুন; আমরা আপনাদের দাসী, সেবা করবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। আপনারা তৃষ্ণার্ত এই পানীয় পান করুন।

সে পানীয় হচ্ছে স্বৰ্গীয় সুরা। দলে দলে লোকে সেখানে ঢুকে পড়ল।

নারায়ণ বললেন, দেখ তো ইন্দ্র, আর কেউ আসছে কি না?

ইন্দ্ৰ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন না।

–ভাল করে দেখ।

একটা কি নড়ছে, বোধহয় একজন মানুষ!

নারায়ণ বললেন—স্বৰ্গদ্বার খুলে রাখ, তুমি নিজে পারিজাতের মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাক। আমার মত সম্মান করে স্বর্গে নিয়ে এস। ওর পায়ের ধুলোয় স্বৰ্গ পবিত্র হোক।

হাসিয়া চৌধুরী বলিল—জানেন পণ্ডিত, গল্পটি শেষ করে ঠাকুরমশায় বলেছিলেন চৌধুরী, এরপর কেউ গুরু হয়ে ভক্তের রসালো খাদ্যদ্রব্যে ভুলবে, কেউ মোহন্ত হয়ে সোনা-রুপোসম্পত্তি নিয়ে ভুলবে, কেউ সেবাদাসীর দল নিয়ে স্ত্রীলোকে আসক্ত হবে। স্বর্গে যাবে। কোটি কোটির মধ্যে একজন। দুঃখ করবেন না পণ্ডিত। মানুষের ভুল-ভ্রান্তি-মতিভ্ৰম পদে পদে। এরা মানুষ নয় বলে দুঃখ করছেন? মানুষ হওয়া কি সোজা কথা? আচ্ছা আমি উঠি তা হলে। ওই ডাক্তার আসছেন—উনি এসে পড়লে আবার খানিকক্ষণ দেরি হয়ে যাবে। আমি চলি।

বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি নামিয়া পড়িল।

গল্পটি দেবুর বড় ভাল লাগিল। বিলুকে আজ গল্পটি বলিতে হইবে। আশ্চর্য বিলুর ক্ষমতা, একবার শুনিলেই সে গল্পটি শিখিয়া লয়।

ডাক্তার আসিয়া বিনা ভূমিকায় বলিল—শুনলাম সব।

দেবু হাসিল, বলিল—তুমি সকাল থেকে কোথায় ছিলে হে?

–অনিরুদ্ধের বাড়ি। কামার-বউয়ের আজ আবার ফিট হয়েছিল।

–আবার?

–হ্যাঁ। সে সাংঘাতিক ফিটু, ঘরে মেয়ে নাই, ছেলে নাই, সে এক বিপদ। তবু দুর্গা মুচিনী ছিল, তাই খানিক সাহায্য হল। বউটার বোধহয় মৃগীরোগে দাঁড়িয়ে গেল। অনিরুদ্ধ তো বলছে অন্য রকম। মানুষে নাকি তুক্‌ করেছে।

–মানুষে তুক্‌ করেছে?

–হ্যাঁ, ছিরে পালের নাম করছে। যাক গে! এ দিকের এ যা হয়েছে ভাল হয়েছে দেবু। পরে সব ঝুঁকি পড়ত তোমার আর আমার ঘাড়ে। জে.এল. ব্যানার্জীর অ্যারেস্টের খবর জান তো? হয়ত আমাদেরও অ্যারেস্ট করত। আর সব শালা সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকত। আচ্ছা, আমি চলি। সকাল থেকে রোগী বসে আছে, ওষুধ দিতে হবে।

ডাক্তার ব্যস্ত হইয়াই চলিয়া গেল। দেবু একটু হাসিল। ডাক্তারের এই ব্যস্ততার অর্ধেকটা সত্য বাকিটা কৃত্রিম। রোগীদের জন্য জগনের দরদ অকৃত্রিম; চিকিৎসকের কর্তব্য সম্বন্ধে সে সত্যই সজাগ। শত্রু হোক মিত্র হোক-সময় অসময় যখনই হোক ডাকিলে সে বাহির হইয়া আসিবে, যত্ন করিয়া নিজে ঔষধ তৈয়ারি করিয়া দিবে। কিন্তু আজিকার ব্যস্ততাটা কিছু বেশি, একটু অস্বাভাবিক। জে.এল. ব্যানার্জীর গ্রেপ্তারের সংবাদে ডাক্তার বেশ একটু ভয় পাইয়া গিয়াছে, আসলে সে আলোচনাটা এড়াইতে চাহিল।

–পণ্ডিতমশাই গো! বাড়ির ভিতর থেকে কে ডাকিল।

–পণ্ডিত পিছন ফিরিয়া দেখিল—বিলু দাঁড়াইয়া হাসিতেছে; সে-ই ডাকিয়াছে।

রাগের ভান করিয়া দেবু বলিল-দুষ্ট বালিকে, হাসিছে কেন? পড়া করিয়াছ?

বিলু খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; দেবু উঠিয়া আসিয়া বলিল-আজ ভারি সুন্দর একটা গল্প শুনেছি, তোমাকে বলব, একবার শুনেই শিখতে হবে।

বিলু বলিলখোকার কাছে একবার বস তুমি। কামার-বউকে একবার আমি দেখে আসি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress