Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » খুঁজি খুঁজি নারি – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

খুঁজি খুঁজি নারি – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

দিন আষ্টেক পরে একদিন দেখিলাম‌, সংবাদপত্রের পিছন দিকের পাতার এক কোণে রামেশ্বরবাবুর মৃত্যু-সংবাদ বাহির হইয়াছে। তিনি খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন না‌, কিন্তু তাঁহার টাকা ছিল‌, তাই বোধ হয় তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ দৈনিক পত্রের পৃষ্ঠা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে।

ব্যোমকেশ খবরের কাগজে কেবল বিজ্ঞাপন পড়ে‌, তাই তাহাকে খবরটা দেখাইলাম। আজ রমেশ্বরবাবুর নামোল্লেখে তাহার মুখে হাসি ফুটিল না‌, সে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর পাশের ঘরে গিয়া টেলিফোনে কাহার সহিত কথা বলিল।

সে ফিরিয়া আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কাকে?’

সে বলিল‌, ‘ডাক্তার অসীম সেনকে‌, পরশু রাত্রে রামেশ্বরবাবুর মৃত্যু হয়েছে। আবার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল‌, ডাক্তার সেন উপস্থিত ছিলেন; কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। ডাক্তার স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দিয়েছেন।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তোমার কি সন্দেহ ছিল যে-?’

সে বলিল‌, ‘ঠিক সন্দেহ নয়। তবে কি জানো‌, এ রকম অবস্থায় একটু অসাবধানত‌, একটু ইচ্ছাকৃত অবহেলা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রামেশ্বরবাবু মারা গেলে ওদের কারুরই লোকসান নেই‌, বরং সকলেরই লাভ। এখন কথা হচ্ছে‌, তিনি যদি উইল করে গিয়ে থাকেন এবং তাতে নলিনীকে ভাগ দিয়ে থাকেন‌, তাহলে সে-উইল কি ওরা রাখবে? পেলেই ছিঁড়ে ফেলে দেবে।’

সেদিন অপরাহ্নে নলিনী ও তাহার স্বামী দেবনাথ দেখা করিতে আসিল।

নলিনীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি; সন্তান-সৌভাগ্যের আধিক্যে শরীর কিছু কৃশ‌, কিন্তু যৌবনের অস্তলীলা দেহ হইতে সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। দেবনাথের বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ; এককালে সুশ্ৰী ছিল‌, হাত তুলিয়া আমাদের নমস্কার করিল।

নলিনী সজলচক্ষে বলিল‌, ‘বাবা মারা গেছেন। তাঁর শেষ আদেশ আপনার সঙ্গে যেন দেখা করি। তাই এসেছি।’

ব্যোমকেশ তাঁহাদের সমাদর করিয়া বসাইল। সকলে উপবিষ্ট হইলে বলিল‌, ‘রামেশ্বরবাবুর শেষ আদেশ কবে পেয়েছেন?’

নলিনী বলিল‌, ‘পয়লা বৈশাখ। এই দেখুন চিঠি।’

খামের উপর কলিকাতার অপেক্ষাকৃত দুর্গত অঞ্চলের ঠিকানা লেখা। চিঠিখানি ব্যোমকেশকে লিখিত চিঠির অনুরূপ সেই মনোগ্রাম করা কাগজ। চিঠি কিন্তু আরও সংক্ষিপ্ত—

কল্যাণীয়াষু্‌,
তোমরা সকলে আমার নববর্ষের আশীবাদ লইও। যদি ভালোমন্দ কিছু হয়‌, শ্ৰীযুক্ত ব্যোমকেশ বক্সী মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিও। ইতি—
শুভাকাঙ্খী
বাবা

পত্র রচনায় মুন্সিয়ানা লক্ষণীয়। কুশেশ্বর ও লাবণ্য যদি চিঠি খুলিয়া পড়িয়া থাকে‌, সন্দেহজনক কিছু পায় নাই। ‘ভালোমন্দ কিছু হয়-ইহার নিগূঢ় অর্থ যে নিজের মৃত্যু সম্ভাবনা তাহা সহসা ধরা যায় না‌, সাধারণ বিপদ-আপদও হইতে পারে। তাই তাহারা চিঠি আটকায় নাই।

চিঠি ফেরত দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শেষবার কবে রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?’

নলিনী বলিল‌, ‘ছ-মাস আগে। পুজোর পর বাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলুম‌, সেই শেষ দেখা। তা বৌদি। সারাক্ষণ কাছে দাঁড়িয়ে রইল‌, আড়ালে বাবার সঙ্গে একটা কথাও কইতে দিলে না।’

‘বৌদির সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই?’

‘সম্ভাব! বৌদি আমাকে পাশ পেড়ে কাটে।’

‘কোন কারণ আছে কি?’

‘কারণ আর কি! ননদ-ভাজ‌, এই কারণ। বৌদি বাঁজা‌, আমার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলেপুলে হয়েছে‌, এই কারণ।’

‘ডাক্তার সেনের সঙ্গে সম্প্রতি আপনাদের দেখা হয়েছে?

‘সেন-কাকা কাল সকালে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি বললেন‌, বাবা নাকি উইল করে গিয়েছেন।’

‘সেই উইল কোথায় আপনারা জানেন?’

‘কি করে জানিব? বাবাকে ওরা একরকম বন্দী করে রেখেছিল। বাবা অথর্ব হয়ে পড়েছিলেন‌, তোতলায় নিজের ঘর ছেড়ে বেরুতে পারতেন না; ওরা যক্ষির মত বাবাকে আগলে থাকত। বাবা যেসব চিঠি লিখতেন ওয়া খুলে দেখত‌, যে-চিঠি ওদের পছন্দ নয় তা ছিঁড়ে ফেলে দিত। বাবা যদি উইল করেও থাকেন তা কি আর আছে? বৌদি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, রামেশ্বরবাবু বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, তিনি যদি উইল করে গিয়ে থাকেন, নিশ্চয় এমন কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছেন যে সহজে কেউ খুঁজে পাবে না। এখন কাজ হচ্ছে ওরা সেটা খুঁজে পাবার আগে আমাদের খুঁজে বার করা।’

নলিনী সংগ্রহে বলিল‌, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু। বাবা যদি উইল করে থাকেন নিশ্চয় আমাদের কিছু দিয়ে গেছেন‌, নইলে উইল করার কোন মানে হয় না। কিন্তু এ অবস্থায় কি করতে হয় আমরা কিছুই জানি না–নলিনী কাতর নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে চাহিল।

এই সময় দেবনাথ গলা খাঁকারি দিয়া সর্বপ্রথম কিছু বলিবার উপক্রম করিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে একটু অপ্রতিভভাবে বলিল‌, ‘একটা কথা মনে হল। শুনেছি উইল করলে দু’জন সাক্ষীর দস্তখত দরকার হয়। কিন্তু আমার শ্বশুর দু’জন সাক্ষী কোথায় পাবেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার কথা যথার্থ; কিন্তু একটা ব্যতিক্রম আছে। যিনি উইল করেছেন তিনি যদি নিজের হাতে আগাগোড়া উইল লেখেন তাহলে সাক্ষীর দরকার হয় না।’

নলিনী উজ্জ্বল চোখে স্বামীর পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘শুনলে? এই জন্যে বাবা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।–ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি একটা উপায় করুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চেষ্টা করব। উইল বাড়িতেই আছে‌, বাড়ি সার্চ করতে হবে। কিন্তু ওরা যাকে-তাকে বাড়ি সার্চ করতে দেবে কেন? পুলিসের সাহায্য নিতে হবে। ডাক্তার অসীম সেনকেও দরকার হবে। দু-চার দিন সময় লাগবে। আপনারা বাড়ি যান‌, যা করবার আমি করছি। উইলের অস্তিত্র যদি থাকে‌, আমি খুঁজে বার করব।’

ব্যোমকেশ যখন সরকারী মহলে দেখাশুনা করিতে যাইত‌, আমাকে সঙ্গে লইত না। আমারও সরকারী অফিসের গোলকধাঁধায় ঘুরিয়া বেড়াইতে ভালো লাগিত না।

দুই দিন ব্যোমকেশ কোথায় কোথায় ঘুরিয়া বেড়াইল জানি না। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরিয়া সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল‌, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কী ঠিক হয়ে গেছে?’

সে বলিল‌, ‘খানাতল্লাশের পরোয়ানা পাওয়া গেছে। কাল সকালে পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমরা রামেশ্বরবাবুর বাড়ি সার্চ করতে যাব।’

পরদিন সকালবেলা আমরা রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। সঙ্গে পাঁচ-ছয় জন পুলিসের লোক এবং ইন্সপেক্টর হালদার নামক জনৈক অফিসার।‌

কুশেশ্বর প্রথমটা একটু লম্ফঝাম্প করিল‌, তাহার স্ত্রী লাবণ্য আমাদের নয়ন।বহ্নিতে ভস্ম করিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না‌, ইন্সপেক্টর হালদার তাঁহাদের এবং বিধবা কুমুদিনীকে একজন পুলিসের জিম্মায় রান্নাঘরে বসাইয়া তল্লাশ আরম্ভ করিলেন। ত্রিতল বাড়ির কোনও তলই বাদ দেওয়া হইল না; দুইজন নীচের তলা তল্লাশ করিল‌, দুইজন দ্বিতলে কুশেশ্বর ও লাবণ্যর ঘরগুলি অনুসন্ধানের ভার লইল‌, ব্যোমকেশ‌, ইন্সপেক্টর হালদার ও আমি তিনতলায় : রামেশ্বরবাবু তিনতলায় থাকিতেন‌, সুতরাং সেখানেই উইল পাওয়া যাইবার সম্ভাবনা বেশি।

দুইটি ঘর লইয়া তিনতলা। ছোট ঘরটি গৃহিণীর শয়নকক্ষ‌, বড় ঘরটি একাধারে রামেশ্বরবাবুর শয়নকক্ষ এবং অফিস-ঘর। এক পাশে ‘তাঁহাদের শয়নের পালঙ্ক‌, অন্য পাশে টেবিল চেয়ার বইয়ের আলমারি প্রভৃতি। এই ঘর হইতে একটি সরু দরজা দিয়া স্নানের ঘরে যাইবার রাস্তা।

আমরা তল্লাশ আরম্ভ করিলাম। তল্লাশের বিস্তারিত ব্বিরণ প্রয়োজন নাই। দুইটি ঘরের বহু আসবাব‌, খাট বিছানা টেবিল চেয়ার আলমারির ভিতর হইতে এক টুকরা কাগজ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে‌, সুতরাং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই তল্লাশ করা হইল। তল্লাশ করিতে করিতে একটি তথ্য আবিষ্কার করিলাম; আমাদের পূর্বে আর একদফা তল্লাশ হইয়া গিয়াছে। কুশেশ্বর এবং তাহার স্ত্রী উইলের খোঁজ করিয়াছে।

ব্যোমকেশ আমার কথা শুনিয়া বলিল‌, ‘হুঁ। এখন কথা হচ্ছে ওরা খুঁজে পেয়েছে কিনা।’

আড়াই ঘণ্টা পরে আমরা ক্লান্তভাবে টেবিলের কাছে আসিয়া বসিলাম। টেবিলের এক পাশে একটি পিতলের ছোট্ট হামানদিস্তা ছিল‌, রামেশ্বরবাবু তাহাতে পান ছেঁচিয়া খাইতেন; ব্যোমকেশবাবু সেটা সামনে টানিয়া আনিয়া অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। ইতিপূর্বে, নিম্নতলে যাহারা তল্লাশ করিতেছিল তাহারা জানাইয়া গিয়াছে যে সেখানে কিছু পাওয়া যায় নাই।

ইন্সপেক্টর হালদার বলিল‌, ‘তেতলায় নেই। তার মানে রামেশ্বরবাবু উইল করেননি‌, কিংবা ওরা আগেই উইল খুঁজে পেয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উইল করা সম্বন্ধে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু—‘

এই সময় ইন্সপেক্টর হালদার অলস। হস্তে গঁদের শিশির ঢাকনা তুলিলেন।

টেবিলের উপর কাগজ কলম লেফাফা পিন-কুশন গঁদের শিশি প্রভৃতি সাজানো ছিল‌, আমরা পূবইে টেবিল ও তাহার দেরাজগুলি খুঁজিয়া দেখিয়াছি‌, কিন্তু গঁদের শিশির ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসিয়া লাগিল।

কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ!

ব্যোমকেশ খাড়া হইয়া বসিল‌, ‘কিসের গন্ধ! কাঁচা পেঁয়াজ! দেখি।’

গঁদের শিশি কাছে টানিয়া লইয়া সে গভীরভাবে তাহার ঘ্রাণ লইল। শিশি কাত করিয়া দেখিল‌, ভিতরে গাঢ় শ্বেতাভ পদার্থ দেখিয়া গঁদের আঠা বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু তাহাতে পেঁয়াজের গন্ধ কেন? কোথা হইতে পেঁয়াজ আসিল?

গদের শিশি হাতে লইয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নিশ্চল বসিয়া রহিল। নিশ্চলতার অন্তরালে প্রচণ্ড মানসিক ক্রিয়া চলিতেছে তাহা তাহার চোখের তীব্র-প্রখর দৃষ্টি হইতে অনুমান করা হয়। আমি ইন্সপেক্টর হালদারের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। পেঁয়াজ-গন্ধী গঁদের শিশির মধ্যে ব্যোমকেশ কোন রহস্যের সন্ধান পাইল!

‘ইন্সপেক্টর হালদার‌, দয়া করে একবার কুশেশ্বরের স্ত্রীকে ডেকে আনবেন?’

অল্পক্ষণ পরে লাবণ্য প্রতি পদক্ষেপে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতে করিতে ঘরে প্রবেশ করিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া নিজের চেয়ার নির্দেশ করিয়া বলিল‌, ‘বসুন। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব।’

লাবণ্য উপবেশন করিল। তাহার চোয়ালের হাড় শক্ত‌, চক্ষে কঠিন সন্দিগ্ধতা। তিনজন অপরিচিত পুরুষ দেখিয়াও তাহার দৃষ্টি নরম হইল না।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার শ্বশুরমশায় কি কাঁচা পেঁয়াজ খেতে ভালোবাসতেন?’

লাবণ্য চকিতভাবে ব্যোমকেশের পানে চাহিল‌, তাহার মুখের বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হইল। সে বলিল‌, ‘ভালোবাসতেন না‌, কিন্তু যাবার কিছুদিন আগে কাঁচা পেঁয়াজের ওপর লোভ হয়েছিল। ভীমরতি অবস্থা হয়েছিল‌, তার ওপর একটিও দাঁত ছিল না; হামানদিস্তায় পেঁয়াজ ছেঁচে তাই খেতেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও। মৃত্যুর কতদিন আগে পেঁয়াজের বাতিক হয়েছিল?’

লাবণ্য ভাবিয়া বলিল‌, ‘দশ-বারো দিন আগে। চৈত্র মাসের শেষের দিকে।’

ব্যোমকেশ সহাস্যে হাত জোড় করিয়া বলিল‌, ‘ধন্যবাদ। আপনাদের মিছে কষ্ট দিলাম‌, সেজন্য ক্ষমা করবেন। চল অজিত‌, চলুন ইন্সপেক্টর হালদার। এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।’

কোথা দিয়া কেমন করিয়া কাজ শেষ হইল কিছুই বুঝিলাম না‌, আমরা গুটি গুটি বাহির হইয়া আসিলাম। ফুটপাথে নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ইন্সপেক্টর হালদার‌, আপনি চলুন আমাদের বাসায়। আপনার সঙ্গীদের আর দরকার হবে না।’

বাসায় পৌঁছিয়া সে আমাকে প্রশ্ন করিল‌, ‘অজিত‌, নববর্ষে রামেশ্বরবাবু আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন‌, সেটা কোথায়?’

এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলাম‌, ‘আমি তো সে-চিঠি আর দেখিনি। এইখানেই কোথাও আছে‌, যাবে কোথায়।’

আমাদের ব্যক্তিগত চিঠির কোনও ফাইল নাই‌, চিঠি পড়া হইয়া গেলে কিছু দিন যত্রতত্র পড়িয়া থাকে‌, তারপর পুঁটিরাম ঝাঁট দিয়া ফেলিয়া দেয়।

ব্যোমকেশ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া বলিল‌, ‘দ্যাখো-খুঁজে দ্যাখো‌, চিঠিখানা ভীষণ জরুরী। রামেশ্বরবাবু তাতে লিখেছিলেন–আমার এই চিঠিখানির প্রতি অবজ্ঞা দেখাইবেন না। তখন ও-কথায় মানে বুঝিনি–’

ইন্সপেক্টর হালদার বলিলেন‌, ‘কিন্তু কথাটা কি? ও-চিঠিখানা হঠাৎ এত জরুরী হয়ে উঠল কি করে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝতে পারলেন না! ওই চিঠিখানাই রামেশ্বরবাবুর উইল।’

‘অ্যাঁ। সেকি?’

‘হ্যাঁ। আজ গঁদের শিশিতে পেঁয়াজের রস দেখে বুঝতে পারলাম। রামেশ্বরবাবু অদৃশ্য কালি দিয়ে উইল লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।’

‘কিন্তু—অদৃশ্য কালি–’

‘পরে বলব। অজিত‌, চারিদিকে খুঁজে দ্যখো‌, পুঁটিরামকে ডাকে। ও-চিঠি যদি না পাওয়া যায়‌, নলিনী আর দেবনাথের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

পুঁটিরামকে ডাকা হইল‌, সে কিছু বলিতে পারিল না। ব্যোমকেশ মাথায় হাত দিয়া বসিল‌, তারপর পাংশু মুখ তুলিয়া বলিলল ‘থামো্‌্‌, থামো। বাইরে খুঁজলে হবে না‌, মনের মধ্যে খুঁজতে হবে।’

ইজি-চেয়ারে পা ছড়াইয়া শুইয়া সে সিগারেট ধরাইল‌, কড়িকাঠের পানে চোখ তুলিয়া ঘন ঘন ধূম উদগিরণ করিতে লাগিল।

আমরাও সিগারেট ধরাইলাম।

পনরো মিনিট পরে সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল‌, ‘সেদিন আমি কোন বই পড়ছিলাম মনে আছে?’

বলিলাম‌, ‘কবে? কোনদিন?’

‘যেদিন রামেশ্বরবাবুর চিঠিখানা এল। পয়লা বৈশাখ‌, বিকেলবেলা। মনে নেই?’

মনের পটে সেদিনের দৃশ্যটি আকিবার চেষ্টা করিলাম। পোস্টম্যান দ্বারে ঠকঠক শব্দ করিল; ব্যোমকেশ তক্তপোশে পদ্মাসনে বসিয়া একটা মোটা বই পড়িতেছিল; কালী সিংহের মহাভারত‌, না হেমচন্দ্র-কৃত রামায়ণ?

ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল‌, ‘মহাভারত‌, দ্বিতীয় খণ্ড। পিতামহ ভীষ্মের কথা উঠল মনে নেই?’

ছুটিয়া গিয়া শেলফ হইতে মহাভারতের দ্বিতীয় খণ্ড বাহির করিলাম। পাতা খুলিতেই খামসমেত রামেশ্বরবাবুর চিঠি বাহির হইয়া পড়িল।

ব্যোমকেশ উল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিল‌, ‘পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!-পুঁটিরাম‌, একটা আংটায় কয়লার আগুন তৈরি করে নিয়ে এস।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress