Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » খিলজির গুহায় অর্জুন (২০১৬) || Samaresh Majumdar

খিলজির গুহায় অর্জুন (২০১৬) || Samaresh Majumdar

ধুলোর ঝড়টা সমানে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আঠারো ঘোড়ার খুর মাটি থেকে ধুলো তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আকাশে। সেই সঙ্গে তাদের মিলিত শব্দ এত তীব্র যা দু’পাশের গ্রামের মানুষ কখনও শোনেনি। আঠারোটা ঘোড়ার গতি ছিল বিদ্যুতের মতো। ঘোড়ার পিঠে যারা লাগাম ধরে ঈষৎ ঝুঁকে বসেছিল তাদের শরীর কালো কাপড়ে মোড়া, মাথা, চোখ মুখ কালো কাপড়ের আড়ালে। প্রতিটি ঘোড়ার সঙ্গে ঝোলানো চামড়ার বন্ধনীতে উদ্যত হয়ে রয়েছে বর্শা, প্রতিটি সওয়ারির কোমরে ঝুলছে খাপে বন্দি তলোয়ার। ওরা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ওদের দেখার সাহস কোনও গ্রামবাসীর নেই। এই চতুষ্পদ জন্তুদের দুর থেকে দেখেই তারা ভয়ে যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। শিশুদের মুখে হাত চাপা দিয়েছে তাদের মায়েরা। ওই অচেনা প্রাণীদের পিঠে যারা সওয়ার হয়েছে তাদের দীর্ঘ দেহ এবং কালো পোশাকও রীতিমতো ভয়ংকর বলে মনে হয়েছে গ্রামবাসীদের। শুধু একটি গ্রাম নয়, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ওই অষ্টাদশ অশ্বারোহী যাদের নেতা ছিল সামান্য এগিয়ে। ভয়ের খবর বাতাসের আগে ছুটে যায়। অশ্বারোহীরা পৌঁছোবার আগেই গ্রামের মানুষ খবর পেয়ে যাচ্ছিল ভয়ংকর মানুষগুলো আসছে। পালাও, অন্তত দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো। ওরা আসছে পশ্চিম থেকে, লক্ষ্য উত্তরে যাওয়া।

শেষপর্যন্ত সন্ধের মুখে ঘোড়াগুলো বিশ্রাম পেল। অথবা বলা যায়, তাদের বিশ্রাম দিতে বাধ্য হল দলের নেতা। সামনে বিশাল নদী। বিশাল ঢেউগুলো অজগরের মতো ফুঁসছে। দূরে, বহু দূরে আবছা হয়ে আছে। ওপারের গাছপালা। দলনেতার কাছে খবর ছিল একটি বড় নদী তাদের পার হতে হবে। কিন্তু সেই নদীর চেহারা এমন হবে তা তার জানা ছিল না।

সামনে রাত। অতএব নদীর তীরে বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। শেষ বিকেলের নামাজ পড়ার পর যখন দলের কয়েকজন রাতের খাবার তৈরির কাজে ব্যস্ত হল তখন দলনেতা পরামর্শে বসলেন সহকারীদের সঙ্গে। কাছাকাছি কোথাও নৌকো দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া সাধারণ নৌকো, যাতে মানুষ যাওয়া আসা করে, তাতে এতগুলো ঘোড়াকে ওপারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। দলের একজন যে উত্তর ভারতের নদীগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল সে পরামর্শ দিল, ভেলা তৈরি করতে হবে। বেশ বড় অন্তত দশটি ভেলা। দুটি করে ঘোড়াকে এক-একটা ভেলায় তুলতে হবে। দশ নম্বর ভেলায় মালপত্র যাবে। কিন্তু এই দশটা ভেলা তৈরি চট করে করা সম্ভব নয়। এর জন্যে লোকজন দরকার। তা ছাড়া ভেলাগুলোকে ওপারে নিয়ে যেতে হলে স্থানীয় মাঝিদের সাহায্য প্রয়োজন। দলের ভেতর যে লোকটা স্থানীয় ভাষা কিছুটা জানে তাকেই দোভাষীর কাজটা করতে বলা হল। সন্ধের মুখে কাছাকাছি গ্রামে গেল সে। ফিরে এসে সে জানাল, সহযোগিতা করা দূরের কথা, গ্রামবাসীরা কথা বলতেই চাইছে না। সঙ্গে সঙ্গে দলনেতা সিদ্ধান্ত নিলেন, আঙুল বেঁকাতে হবে, নইলে ঘি বোতলের বাইরে আসবে না।

.

ভোর হতে না হতেই আঠারোটা ঘোড়া, সবচেয়ে কাছের গ্রাম, যেটা নদীর ধারেই রয়েছে, ছুটে গেল। মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থেকে আক্রান্ত না হওয়ায় গ্রামের মানুষ ভেবেছিল, আর বিপদ আসবে না। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল তারা। ঘোড়ার খুরের শব্দ, বিদেশি ভাষায় চিৎকার, শূন্যে তলোয়ারের আস্ফালন দেখে ঘুম ভেঙে কুঁকড়ে গেল তারা। বেছে বেছে সুস্থ সবল লোকদের লাইন করিয়ে নদীর ধারে নিয়ে আসা হল। দোভাষী তাদের বোঝাল, যদি সহযোগিতা করো তা হলে কোনও বিপদ হবে না।

যারা অবাধ্য হতে চাইল তাদের রক্তাক্ত শরীর দেখে বাকিরা বাঁচার তাগিদে বাধ্যতা স্বীকার করল। দোভাষী তাদের কী করতে হবে তা কোনওরকমে বুঝিয়ে দিলে কাজ শুরু হল। ওদের মধ্যে যারা নৌকা চালায় তারা নির্দেশ দিতে লাগল কীভাবে শক্ত ভেলা তৈরি করা যায়। লম্বা লম্বা নারকোল গাছ কেটেহেঁটে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল। বাঁশের ঝাড় থেকে লম্বা বাঁশ কেটে এনে লগি তৈরি করা হল। আর এসব করতে করতে সূর্য যখন মাঝ আকাশ পেরিয়ে গিয়েছে তখন একে একে ঘোড়াগুলোকে ভেলায় তোলা হল। জল দেখে আতঙ্কিত ঘোড়াদের সামলাতে হিমসিম খেয়ে গেল সৈনিকরা। প্রতিটি ঘোড়ার লাগাম ধরা ছাড়াও চারটে পা শক্ত করে ভেলার সঙ্গে বাঁধা হল যাতে নদীর বুকে লাফিয়ে পড়ে। যারা ভেলা তৈরি করেছিল তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করে মাঝির দায়িত্ব দেওয়া হল। অনেকটা উজানে ভেলা টেনে নিয়ে গিয়ে যখন জলে ভাসানো হল তখন ঘোড়াগুলো ভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। যতক্ষণ মাটি পাওয়া গেল ততক্ষণ লগি কাজে লাগল। তারপর তার আওতার বাইরে যেতেই লগিগুলোকেই বইঠার মতো ব্যবহার করা হতে লাগল। নদী পার হয়ে প্রায় এক মাইল নীচের পাড়ে পৌঁছানো ভেলাগুলো কিন্তু সবাই এক জায়গায় নয়। এখন সূর্য তার রোদ্দুর গুটিয়ে নিচ্ছে। ক্লান্ত মাঝিদের সেই অবস্থায় ফেলে রেখে অষ্টাদশ অশ্বারোহী অশ্ব ছোটাতে লাগল দ্রুত। যতটা পথ অন্ধকার নামার আগে এগিয়ে থাকা যায়। আবার ঘোড়ার খুরের ধাক্কায় ধুলো উড়ল, শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারধারে। সামনে গভীর জঙ্গল।

.

লোকটি বসে ছিল কিন্তু তার মধ্যে বেশ অসহিষ্ণু ভাব ফুটে উঠছিল। ওর পোশাকও বলে দিচ্ছে যে মানুষটি এই অঞ্চলের নয়। চোস্ত পাজামার ওপর লখনউ চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি, জহরকোট, দাড়ির বাহার দেখে বোঝা যায় মানুষটি শৌখিন। ওঁর বয়স আন্দাজ করা বেশ মুশকিল, চল্লিশ থেকে ষাটের যে কোনও বছরে হতে পারে।

উলটোদিকের চেয়ারে বসে অর্জুন চুপচাপ লোকটিকে লক্ষ করছিল বলেই বোধহয় তার অস্বস্তি বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আমার খবর আপনি কী করে পেলেন?

লোকটি সোজা হয়ে বসল। তারপর ইংরেজিতে বলল, আমার এক বন্ধু লখনউ কলেজে ইতিহাস পড়ায়। তার এক সহকর্মী বাঙালি যার বাড়ি এই অঞ্চলে। তার কাছ থেকেই বন্ধু আপনার কথা জেনে আমাকে বলেছে। তারপর আমি ইন্টারনেটে সার্চ করে আপনার যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই। কিন্তু সেখানে আপনার বয়স উল্লেখ করা ছিল না, আপনাকে দেখে আমি তাই অবাক হয়েছি। আমি অনেক বেশি বয়স ভেবেছিলাম। লোকটি পকেট থেকে একটি পার্স বের করল। সেটা থেকে একটা কার্ড তুলে এগিয়ে ধরল অর্জুনের সামনে। আপনি আমার নাম শুনে একটু অবাক হয়েছেন বলে মনে হল। এটা আমার ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড। দেখতে পারেন।

অর্জুন কার্ডটা নিয়ে এক পলক দেখে ফিরিয়ে দিল। লোকটি বলল, আমি মহম্মদ বিন কামরুজ্জমান খিলজি। আমার পূর্বপুরুষরা থাকতেন এখনকার আফগানিস্তানের দক্ষিণে গার্মশির শহরে। এগারোশো নিরানব্বই খ্রিস্টাব্দে আমার পূর্বপুরুষ মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি ভারতবর্ষে আসেন এবং কুতুব-আল-দিনের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। বংশ পরম্পরায় তারা যোদ্ধা ছিলেন, যদিও মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি বেশি লম্বা ছিলেন না। তার দুটো হাত হাঁটুর নীচে পৌঁছে যেত। কিন্তু কোনও কারণে তাকে ওই সেনাবাহিনীতে কোনও বড় পদ দেওয়া হয়নি বলে কাজ ছেড়ে আরও পূর্বদিকে চলে এসে উত্তরভারতের বিখ্যাত সেনাপতি মাকিক হিজবা আল-দিনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ঔধের নবাব মালিক হাসান আল-দিন নিজের বাহিনীতে নিয়ে নেন। তাকে বিশাল জমিদারি এখনকার মির্জাপুর জেলায় দান করেন। তারপর থেকে সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী তৈরি করে মহম্মদ-বিন-বক্তিয়ার খিলজি বিহার এবং বাংলা জয় করেন।

অর্জুন মন দিয়ে শুনছিল। এবার হাসল, একটা গল্প চালু আছে আপনার ওই পূর্বপুরুষকে নিয়ে। তিনি নাকি সতেরোজন অশ্বারোহী সৈন্য সঙ্গে নিয়ে গৌড় জয় করেছিলেন।

না। মাথা নাড়ল লোকটি, আমার অধ্যাপক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি এটা নেহাতই গল্পকথা। মহম্মদ-বিন-বক্তিয়ার খিলজি প্রায় দুশো অশ্বারোহী সৈন্যকে নিয়ে অ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে এগিয়েছিলেন কিন্তু তাদের কিছু পেছনে প্রায় দশ হাজার সৈন্য অনুসরণ করছিল। সময়টা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলে বারোশো এক খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলে বারোশো চার।

কিন্তু এসব কথা তো ইতিহাস বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে আছে। আপনি সেই লখনউ শহর থেকে জলপাইগুড়িতে আমার সঙ্গে কী কারণে দেখা করতে এসেছেন সেটা প্রথমে জানা দরকার। অর্জুন খুব বিনয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলল।

ঠিক তখনই মোবাইল ফোনের জোরালো রিং কানে এল। অর্জুন দেখল। মহম্মদ বিন কামরুজ্জবান খিলজি ব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে একটা দামি যন্ত্র বের করে কানে চাপলেন। কয়েক সেকেন্ড পরিশীলিত উর্দুতে কথা বললেন কিন্তু সেই কথায় বেশ উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছিল। তারপর ফোন বন্ধ করে বললেন, আমার মেয়েকে কেউ ফোনে হুমকি দিয়েছে। সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এখানে এই উত্তরবঙ্গে কেউ ওকে হুমকি দিয়েছে তা ভাবতেই পারছি না। যা হোক, আমি কি বিকেলের দিকে আপনার দেখা পেতে পারি?

নিশ্চয়। কিন্তু এখনও বললেন না কী উদ্দেশ্যে আমার কাছে এসেছেন? অর্জুন কথাগুলো বলামাত্র বাড়ির সামনে থেকে কেউ চিৎকার করে গালাগালি দিতে লাগল। ওদের এই গলিতে এরকম ঘটনা কখনওই ঘটে না। অর্জুন দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল একটি প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভার সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। অর্জুন তাকে চুপ করতে বলায় সে কাছে ছুটে এল, আমার গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে দিয়ে গেল আর আপনি বলছেন চুপ করে থাকতে। ওঃ, ছেলেটাকে যদি হাতের কাছে পেতাম।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে ভাই?

পেছন থেকে মহম্মদ বিন কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, এটা ভাড়ার গাড়ি। ওই গাড়িতেই আমি আপনার কাছে এসেছি।

*

জঙ্গলের মধ্যে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দলনেতা রাতের জন্যে বিশ্রাম নিতে বললেন অনুচরদের। শিক্ষিত সৈন্যরা জানে তাদের কী কী করতে হবে। একদল রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অন্যদল পালা করে সারারাত পাহারায় থাকবে। ঘোড়াগুলোকে গাছের নীচে বেঁধে রাখা হয়েছে। এক কোণে কাঠ জড়ো করে আগুন ধরানো হয়েছে যাতে জায়গাটি আলোকিত হয় এবং জঙ্গলের পোকার ঝক সেদিকেই ছুটে যায়। দলনেতাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামেননি।

ইনি ইখতিয়ার আজ-বিন মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি। আফগানিস্তানের দক্ষিণে এক টার্কি উপজাতির এই যোদ্ধা ভারতবর্ষে এসেছিলেন বারোশো শতাব্দির একেবারে শেষ দিকে। ভারতবর্ষে আসার পর যোদ্ধা হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল। একের পর এক নবাব বা শাসকের অধীনে কাজ করে শেষ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের ঔধের মুসলমান শাসকের অধীনে কাজ করার সময় বিহার এবং বাংলা জয় করায় পরিকল্পনা নেন। সেটা এগারোশো আটানব্বই সাল। মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজির কাছে গুপ্তচর খবর নিয়ে এল একটি বিশাল বৌদ্ধ বিহারে প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে রাখা আছে। কাল বিলম্ব না করে তিনি তার সৈন্য নিয়ে যাত্রা করেন।

তখন ভারতবর্ষের এই ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। সেই প্রভাব ছিন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মুসলমান শাসকরা। বিহারের বিখ্যাত কলেজ-শহর নালন্দা এবং বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রমশীলাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার হচ্ছিল বলে তাদের ধ্বংস করা লক্ষ্য ছিল ইখতিয়ার আদ-বিন মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজির। এই সময়েই খবরটা এল, প্রচুর ধনরত্ন বৌদ্ধ মন্দিরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা আছে।

সেদিন ভরদুপুরে বৌদ্ধবিহারের কাছে পৌঁছেও আক্রমণ করলেন না তিনি। বিহারে প্রায় দু’ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দিন রাত পাহারায় আছেন। হিন্দু সন্ন্যাসীদের দেখেছেন বক্তিয়ার খিলজি। দাড়ি জটা নিয়ে প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু গুপ্তচর খবর আনল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যারা পাহারায় আছেন তারা বেশ শক্তসমর্থ এবং মুণ্ডিত মস্তক। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগে তাদের কয়েকজনকে দূর থেকে দেখে এলেন বক্তিয়ার খিলজি। ওই মানুষগুলোর কেশহীন মাথা দেখে তার মনে হল এরা আদৌ হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতো নয়। এরা ভয়ংকর। অত্যন্ত নিষ্ঠুর। আক্রমণ করার সময় বিন্দুমাত্র দয়া দেখালে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা হবে।

সন্ধের পরে অন্ধকার একটু ঘন হলে বক্তিয়ার খিলজি তার পরিকল্পনা মতো দশজন সৈনিককে আদেশ দিলেন। বিহারের চারপাশে উঁচু দেওয়াল তুলে বাইরের লোকের দৃষ্টি বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিহারের ভেতরের গাছগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে দেওয়ালের উচ্চতা ছাড়িয়ে গিয়েছে এটা ওরা খেয়াল করেনি। ওই দশজন লম্বা রণপায়ের সাহায্যে দেওয়ালের কাছাকাছি গিয়ে কৌশলে ওপারের গাছে পৌঁছে যেতে পারল। অন্ধকারের কারণে তাদের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা দেখতে পায়নি। ওই দশজন সময় বুঝে মূল ফটক খুলে দিলে বক্তিয়ার খিলজি তাঁর সঙ্গে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্যকে আদেশ দিলেন বিহার দখল করতে এবং কোনও সন্ন্যাসীকেই জীবিত না রাখতে। তলোয়ারের আঘাতে সন্ন্যাসীদের মুণ্ডিত মস্তক দেহচ্যুত হল। বিহারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বক্তিয়ার খিলজি খুশি হলেন এই ভেবে যে তিনি বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের পথ বন্ধ করলেন। কিন্তু গুপ্তচরের সংবাদ সত্য ছিল না। তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও ধনরত্নের সন্ধান পাননি বক্তিয়ার খিলজি। কিন্তু বিশাল এক পাঠাগার দেখতে পেয়েছিলেন যেখানে বিপুল পরিমাণ প্রাচীন বই সংরক্ষিত করা ছিল। সেই পাঠাগারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে তা নিভতে কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। পাণ্ডুলিপিগুলো আগুনে দগ্ধ হওয়ার সময় যে ধোঁয়া বেরিয়েছিল তা পাশের ছোট ছোট টিলার ওপর বেশ কিছুদিন আকাশ কালো করে রেখেছিল।

.

আজ এই সন্ধের সময়েও জঙ্গলে তার নিজের ঘোড়ার ওপর বসে নালন্দার ঘটনার কথা মনে এলেই ঠোঁট কামড়ান বক্তিয়ার খিলজি। ধনরত্ন মানে হিরে জহরত ছাড়া কিছু নয়, এর বাইরে কেন তিনি ভাবতে পারেননি। ওইসব প্রাচীন পাণ্ডুলিপি যা তার আদেশে ছাই করে ফেলা হয়েছে তার মূল্য যে হিরে জহরতের চেয়েও বেশি এই জ্ঞান তাঁর ছিল না বলে এখন আফশোস হয়। সন্ন্যাসীরা তেমন ভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি। বোঝাই গিয়েছে যোদ্ধা হিসেবে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু মুণ্ডিত মস্তকের বীভৎসতা তাকে আতঙ্কিত করেছিল বলে তিনি মুণ্ড ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন এই কারণেও তার আফশোস হয়। কিন্তু যোদ্ধার কাজ দখল করা। সেটা করতে গেলে দয়ামায়া মন থেকে সরিয়ে দিতে হয়।

এখন তার লক্ষ্য বাংলা দখল করা। নবদ্বীপ পৌঁছাতে আর একটা দিন লাগবে। নদী পেরিয়ে তাঁর বাকি সৈন্যরা না আসতে পারুক, অশ্বারোহীরা ভোরের মধ্যেই পৌঁছে যাবে এখানে। তখনই শুরু করা যাবে নবদ্বীপ আক্রমণ। তিনি জানেন নবদ্বীপে যিনি রাজত্ব করছেন তিনি প্রকৃত অর্থে অথর্ব। তার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে চার বছর আগে। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন নবদ্বীপ ছাড়া গৌড়েও রাজধানী রেখেছেন। বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন রাজধানী গৌড় থেকে চলে এসেছেন নবদ্বীপে তীর্থ করতে।

বক্তিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করার আগে যাবৎ তথ্য সংগ্রহ করেছেন। লক্ষ্মণ সেন সেনবংশের রাজা, নিজেকে গৌড়েশ্বর বলে গর্ব অনুভব করেন। তার রাজত্বে কয়েকটি প্রদেশ আছে। বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ় এবং মিথিলা। এই মিথিলা বিহারের একটি জেলা হলেও সেনরাজত্বের অন্তর্গত। ঢাকার কাছে বিক্রমপুরে লক্ষ্মণ সেনের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা হত। অর্থাৎ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্ব পূর্ববঙ্গ থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ওর রাজ্য দখল করলে ভারতবর্ষের পূর্বদিকে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর একটি সুবিধে হল বাংলা ভূখণ্ডে বৌদ্ধদের কোনও প্রভাব নেই। দু-তিনটি বৌদ্ধ মন্দির থাকলেও তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। আর্যরা যেহেতু এই ভূখণ্ডে আসেনি তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তেমনভাবে প্রচারিত হতে পারেনি। অতএব বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করতে পারলেই আর কোনও প্রতিরোধের সামনে পড়তে হবে না।

রাতের খাবার খুব অল্পই খেয়ে থাকেন বক্তিয়ার খিলজি। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। এখন নিদ্রার প্রয়োজন। কিন্তু নিদ্রিত মানুষকে নিরাপত্তার জন্যে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তার নিজস্ব প্রাসাদে যে ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন তাতে নিদ্রার সময়েও আক্রমণের আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু উন্মুক্ত প্রান্তরে অথবা এই ঘন জঙ্গলে তাকে অন্যের ওপর নির্ভর করতেই হবে। নিদ্রাহীন দিনরাত মানুষকে দ্রুত অসুস্থ করে। এই দলের চারজন্য সৈন্য তার অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। অনেক পরীক্ষা করে জেনেছেন এদের কাছ থেকে কোনও বিশ্বাসঘাতকতা তাকে পেতে হবে না। শয্যা তৈরি হয়ে গেলে ওই চারজনের দু’জন দু’পাশে অস্ত্র হাতে এসে দাঁড়াল। চার ঘণ্টা পরে এরা বিশ্রামে যাবে, অন্য দু’জন এদের জায়গা নেবে। জঙ্গলের ভেতর একটু খোলা বলে বক্তিয়ার খিলজি আকাশ দেখতে পেলেন। প্রচুর তারা আকাশটাকে আলোকিত করে রেখেছে। এই তারাগুলোকে আফগানিস্তানের দক্ষিণদিকের ছোট্ট শহর গার্শশিরে বসেও দেখা যেত। তারাদের চেহারার কোনও পরিবর্তন হয় না। আজ, এই রাত্রে, হঠাৎ মনে হল, তার পক্ষে হয়তো এই জীবনে গাৰ্চশিরে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাকে থেকে যেতে হবে এই ভারতবর্ষে। ধীরে ধীরে তার বয়স বাড়বে। শরীর অশক্ত হবে, তেজ কমে যাবে। এতদিন যা ভাবেননি এখন তাই ভাবতে হবে। নিজের ভবিষ্যৎ জীবন যাতে স্বচ্ছল থাকে তাই সঞ্চয় করার সময় এখনই।

*

মহম্মদ বিন কামরুজ্জমান খিলজি জলপাইগুড়িতে এসে যে হোটেলে উঠেছেন সেটি সদ্য তৈরি হয়েছে। জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি থেকে জাতীয় সড়কের দিকে যাওয়ার রাস্তায় এই আধুনিক হোটেলটির খবর তিনি নেট থেকে জানতে পেরেছিলেন। হোটেল থেকেই যে গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া হয়েছিল তাতেই তিনি এসেছিলেন অর্জুনের কাছে। গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে কার কী উপকার হল বলে যখন ড্রাইভার চেঁচাচ্ছে তখন পাড়ায় দু’জন তরুণ একটি ছেলেকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল অর্জুনের সামনে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এ কে?

একজন তরুণ বলল, এই ছেলেটাই পাথর ছুঁড়ে কাচ ভেঙেছে অর্জুনদা।

অর্জুন ছেলেটাকে দেখল। পরনে ছেঁড়া প্যান্ট, দড়ি দিয়ে কোমর বাঁধা। গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি। বয়স বছর দশ কি বারো। ক’দিন বোধহয় স্নান করেনি।

অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই, গাড়ির কাচ কেন ভেঙেছিস?

ছেলেটা উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করল। অর্জুন একটু কড়া গলায় বলল, কথা বল নইলে পুলিশ ডাকব। পুলিশ খুব মারবে।

মুখ না তুলে ছেলেটা মিনমিনে গলায় বলল, কাল থেকে কিছু খাইনি। খুব খিদে পেয়েছে। তাই–।

তাই কী?

লোকটা বলল কাচ ভেঙে দিলে পঞ্চাশ টাকা দেবে। পঞ্চাশ টাকায় কত কী খাবার পাওয়া যায়। তাই ভেঙে দিলাম।

টাকা পেয়েছিস? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল ছেলেটা, না।

অন্যের গাড়ির কাচ, শুধু গাড়ি কেন, কোনও কিছুই ভেঙে দেওয়া খুব অন্যায় কাজ। এরকম কাজ যেই করতে বলুক কখনওই করবি না। অর্জুন পকেট থেকে টাকা বের করতে গিয়েও থেমে গেল। ছেলেটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মাকে বলল কিছু খেতে দিতে। জানলায় দাঁড়িয়ে মা সব শুনেছিলেন। বললেন, আমি ওকে দেখছি, তুই তোর কাজে যা।

অর্জুন জনাব কামরুজ্জমান খিলজির দিকে তাকাল, আপনি এই শহরে নতুন। চলুন, আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি।

ভদ্রলোক খুশি হলেন, তা হলে তো খুব ভাল হয়। আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কথা বলা যাবে।

ওরা গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার বলল, এটা কীরকম হল স্যার! ওই বদমাশ ছেলেটা আমার ক্ষতি করল আর আপনি ওকে বাড়িতে নিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন? ড্রাইভার হিন্দিভাষী।

ও যদি বাচ্চা না হত তা হলে নিশ্চয়ই বাড়িতে নিয়ে যেতাম না। দু’দিন না খাওয়া ওই বয়সের ছেলেকে যে খাবারের লোভ দেখিয়ে অন্যায় করাল তাকেই শাস্তি দেওয়া দরকার। খিদে মেটাতে ছেলেটা যা করেছে তা ন্যায় কি অন্যায় সেটাই বোঝেনি। অর্জুন হিন্দিতেই জবাব দিল।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, যে লোকটা ছেলেটাকে দিয়ে অন্যায় কাজটা করাল তার কথা ভাবুন। ভয়ংকর লোক। অন্যায় করাল অথচ টাকা দিল না। ভদ্রলোক একটু ভাবলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার গাড়ির এই কাঁচের দাম কত?

পুরনো গাড়ির কাচ বেশ কম দামে পাওয়া যায়। ড্রাইভার বলল।

ঠিক আছে। জেনে এসে বললে আমি দাম দিয়ে দেব।

আচমকা গাড়ি থামাল ড্রাইভার। মুখ ফিরিয়ে জনাব কামরুজ্জমান খিলজির দিকে তাকাল। তারপর আবার গাড়ি চালু করল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এইভাবে তাকিয়ে কী দেখলেন?

গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার জবাব দিল, আজকাল তো চারপাশে কোনও ভালমানুষ দেখতে পাই না, তাই দেখে নিলাম।

যেহেতু হিন্দিতে কথা হচ্ছিল তাই বুঝতে অসুবিধে হল না, জনাব কামরুজ্জমান খিলজি অস্বস্তিতে হাত নাড়লেন। এই সময় তার মোবাইল আবার জানান দিল। এবার পরিষ্কার উর্দুতে তিনি কথা বলতে লাগলেন। অর্জুন বুঝতে পারল ভদ্রলোক মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। মেয়েকে আশ্বস্ত করছেন। তিনি হোটেলে ফিরে আসছেন, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।

ভদ্রলোক মোবাইল বন্ধ করলে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আবার ফোন এসেছিল?

দু’বার ফোন এসেছিল কিন্তু যে করেছিল সে কথা বলেনি।

আপনারা এই শহরে কবে এসেছেন?

গতকাল সন্ধ্যায়। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমে সোজা চলে এসেছি।

এখানে কোনও পরিচিত লোক আছেন?

না। শুধু আপনার নাম ঠিকানা আর ফোন নাম্বারের ওপর ভরসা করে এসেছি।

কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে কেউ আপনাদের বিরক্ত করতে চাইছে। কেন?

সেটাই বুঝতে পারছি না। যে উদ্দেশ্যে আমি এসেছি তা এখানকার কারও জানার কথা নয়। খুব রহস্যময় লাগছে ব্যাপারটা।

গাড়ি থামল হোটেলের সামনে। বেশ কয়েকমাস পরে এদিকে এল অর্জুন। আগে যেসব জায়গা সুনসান ছিল এখন সেখানে সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে। হোটেলই হয়েছে বেশ কয়েকটা।

হোটেলের একতলায় বেশ বড় রেস্টুরেন্ট। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। তার এক কোণের টেবিলে পৌঁছে জনাব কামরুজ্জমান খিলজি মোবাইল বের করে বোতাম টিপলেন, আমরা হোটেলের রেস্টুরেন্টে আছি, তুমি নেমে এসো। ওপাশের কথা শুনে তিনি হাসলেন, আমার সঙ্গে একজন গেস্ট আছেন যাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমরা এখানে এসেছি। এখানেই কথা বলতে সুবিধে হবে। এসো।

অর্জুনকে বসতে বলে চেয়ার টেনে বসে ভদ্রলোক হাসলেন, আমার মেয়ে। ওই ফোন পেয়ে বেশ নার্ভাস হয়ে গিয়েছে। কী খাবেন বলুন?

কফি বলুন।

ব্যস? বেয়ারাকে ইশারায় কাছে ডেকে তিন কাপ কফির কথা বলে দরজার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার, আমি আমার মেয়েকেও বলিনি, কাল এয়ারপোর্টে নামার পর থেকেই আমার মনেও একটা

অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।

কারণটা কী? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

জানি না। আজ সকালে ওই অস্বস্তি ছিল না। মেয়ের ফোন আসার পর থেকেই আবার ফিরে এল। মাথা নাড়লেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি।

এবার বলুন, আপনি কেন আমার কাছে এসেছেন।

ঠিক তখনই রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখা গেল অসাধারণ সুন্দরী এক তরুণীকে যার সাদা জিনসের ওপর দুধসাদা ফুলহাতা টপ। তরুণী সোজা চলে এল অর্জুনদের টেবিলে। এসে চেয়ার টেনে বসে বলল, হাই! আপনি অর্জুন? আমি শার্লক হোমসের বয়সি কাউকে ভেবেছিলাম।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, অর্জুন, এই হল আমার মেয়ে, রোজি, এখন ইতিহাসে এম.এ. করছে।

সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াল রোজি, করমর্দনের জন্যে। অর্জুন হাত মেলাল, রোজি হাসল। আপনাকে ড্যাডি নিশ্চয়ই ফোনের কথা বলেছে?

অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

নিশ্চয়ই আমরা একজন ডিটেকটিভের সঙ্গে নিরাপদে থাকতে পারি?

সরি। আমি ডিটেকটিভ নই। আমি একজন সন্ধানী। অর্জুন এবার মুখ ফেরাল, হ্যাঁ, মিস্টার খিলজি, এবার আপনার এখানে আসার কারণ শোনা যাক।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি মুখ খুললেন, আমার পুর্বপুরুষের নাম মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি। তিনি একজন যোদ্ধা এবং দক্ষ শাসক। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সময়ের ব্যবধান প্রায় নয়শো বছর। ধরে নিচ্ছি প্রায় তিরিশ থেকে বত্রিশ পুরুষ আমাদের মধ্যে জন্মেছেন এবং চলে গেছেন। ফলে তার সম্পর্কে আমার কোনও আগ্রহ তৈরি হয়নি। কিন্তু কয়েক মাস আগে আমি যখন লখনউ থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাই তখন কৌতূহলবশত আমার প্রপিতামহের লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম। এর আগে বহুবার গিয়েও ওই ঘরে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। যে কেয়ারটেকার বাড়িটিকে দেখাশোনা করে সে প্রতিমাসে একবার লাইব্রেরি ঘরের দরজা খুলে ঝাড়পোঁচ করে থাকে। মনে রাখতে হবে ওই গ্রামের বাড়ি বাগান আমার প্রপিতামহের পিতা তৈরি করেছিলেন। তার আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা আফগানিস্তানে থাকতেন। দেশ যখন ভাগ হয়েছিল তখন আমি জন্মাইনি। আফগানিস্তানে কখনওই যাইনি। লখনউর কাছাকাছি ওই নামের শহর বেগমপুর। ওই জায়গাকেই নিজের দেশ মনে করতাম।

বেয়ারা কফি নিয়ে এল। রোজি বলল, আমি কফি তৈরি করে দিচ্ছি। নইলে তুমি বেশি সুগার নেবে।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি হাসলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। হ্যাঁ। ওই লাইব্রেরিতে ঢোকার পর আমার যেন নেশা পেয়ে যেত। খাওয়া এবং ঘুমানোর সময় ছাড়া বেশির ভাগ সময় ওখানেই কাটাতাম। আমার প্রপিতামহের চিঠি, ডায়েরি, তার বাবার ডায়েরি পড়তে পড়তে হঠাৎ আমি একটা চিঠিতে আটকে গেলাম। এটা আফগানিস্তান থেকে আমার প্রপিতামহকে যিনি লিখেছেন তিনি চিঠির নীচে নিজের নাম পুরোটা লেখেননি। উর্দুতে লেখা ওই চিঠির তারিখ আঠারোশো নব্বই সালের জানুয়ারি মাস। ওই চিঠি পড়ে আমি আবার পূর্বপুরুষ মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি সম্পর্কে প্রথম আকর্ষণ বোধ করলাম। কফিতে চুমুক দিলেন ভদ্রলোক। মন দিয়ে শুনছিল অর্জুন। কিন্তু ওই চিঠি যদি কোনও রহস্য তৈরি করে থাকে তা হলে এই ভদ্রলোক তার কাছে কেন এলেন তা বুঝতে পারছিল না।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি আবার কথা শুরু করলেন, বিহার দখল করে, হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে মেরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার চেষ্টা করে হয়তো আমার পূর্বপুরুষ অনুতপ্ত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু সেই অনুতাপের কথা তার সৈন্যরা জানত না। প্রত্যেক বড় নেতা বা সেনাপতির একজন ছায়াসঙ্গী থাকে, তারও ছিল। ফলে বাংলায় গিয়ে প্রথমে নবদ্বীপ পরে গৌড় দখল করার সময় অকারণে রক্তপাত হয়নি। এই ছায়াসঙ্গী একসময় আফগানিস্তানে ফিরে যান। কেন যান জানি না। প্রপিতামহকে যিনি চিঠি লিখেছিলেন তিনি তার বংশধর। মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি বাংলা দখল করার পর তিব্বত জয় করার চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে তিনি সাফল্য পাননি। বারোশো ছয় খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন আবার বাংলায় ফিরে আসেন তখন তার সঙ্গে মাত্র একশোজন সৈন্য ছিল। বোধহয় তখনই তার ছায়াসঙ্গী তাকে ত্যাগ করে আফগানিস্তানে ফিরে যান। তার বংশধর আমার প্রপিতামহকে চিঠিতে জানান যে ওই ছায়াসঙ্গীর একটি রোজনামচা তিনি পেয়েছেন। তিব্বত থেকে ফেরার পথে একটি গুহায় গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি। ফিরে আসার আগে ওই গুহাতে প্রচুর জিনিসপত্র, দলিল লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন তিনি। গুহার মুখ পাথর দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন যে বাইরে থেকে বোঝা যায়নি ওখানে কোনও গুহা ছিল।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজির কথার মধ্যেই রোজির মোবাইল বেজে উঠল, সে পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করে দেখে বলল, সেই এক নম্বর। অন করলে কোনও সাড়া দেবে না।

অর্জুন হাত বাড়াল, আমি একবার দেখতে পারি।

রোজি অর্জুনকে মোবাইলটা দিতে সে নাম্বার দেখল। তারপর বলল, যে ফোন করছে সে দিল্লির সিমকার্ড ব্যবহার করছে। কথাগুলো বলে সে মোবাইল অন করতেই ওপাশের কোনও শব্দ কানে এল না। অর্জুন গম্ভীর গলায় বলল, কেন বিরক্ত করছেন? দয়া করে আর ফোন করবেন না।

সে কথাগুলো বলল বাংলায়। আচমকা ওপাশে কারও কথা শোনা গেল, ইংরেজিতে বলছে, আরে! নাম্বার তো ঠিকই আছে কিন্তু পুরুষের গলায় অন্য ভাষায় কথা বলছে যে! দ্বিতীয় কণ্ঠ চাপা গলায় কিছু বললে লাইন কেটে দেওয়া হল।

রোজি ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, কী বললেন আপনি?

অর্জুন অনুবাদ করে বলল। তারপর কিছুই হয়নি এমন ভাব করে জনাব কামরুজ্জমান খিলজিকে জিজ্ঞাসা করল, তারপর?

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, প্রপিতামহকে লেখা ওই চিঠি পড়ে আমি চমকে উঠি। চিঠির সঙ্গে হাতে আঁকা একটা ম্যাপ ছিল। গুহাটা ঠিক কোন জায়গায় তা স্পষ্ট না হলেও এলাকাটা বুঝতে পারবেন শুধু ওই জায়গা সম্পর্কে ভাল জানেন এমন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আমি সাহস পাচ্ছিলাম না এইসব কথা প্রকাশ করার। কারণ ওই চিঠিতে পরিষ্কার করে বলা না হলেও একদম অকারণে আমার পূর্বপুরুষ গুহার ভেতরে কিছু লুকিয়ে রেখে মুখ বন্ধ করে আসতেন না। বৌদ্ধদের ওপর ওঁর ক্রোধ ছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ মনেস্ত্রি লুঠ করে মূল্যবান ধনরত্ন নিয়ে আসতে পারেন। নালন্দার লাইব্রেরির পাণ্ডুলিপির মূল্য না জেনে পুড়িয়ে ফেলে তিনি নিশ্চয় আফশোস করেছিলেন। বৌদ্ধ মনেস্ট্রিতে নিশ্চয়ই মূল্যবান পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ছিল। সেগুলো নিয়ে এসে হিরে-সোনার সঙ্গে গুহায় রেখে আসতে পারেন যার দাম এখন আমরা কল্পনাও করতে পারব না। তাই আমি প্রচার করতে চাইনি কিন্তু মনে হয় আমার পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা সম্পত্তি আজও গোপনে আছে।

আপনি কি ওই সম্পত্তির সন্ধানে এসেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু ওই ধনরত্ন ভোগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি।

এতক্ষণ রোজি চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিল। এবার হাত তুলল, ড্যাড, আমি একটু বলি। মিস্টার অর্জুন, আট-নয়শো বছর আগে কেউ কিছু লুকিয়ে রেখে গেলে সেটা তার বংশধরের সম্পত্তি হয় কিনা তা আমরা জানি না। কিন্তু অবশ্যই রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়। যা আমাদের পূর্বপুরুষ গুহার ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তার এখনকার বাজারদর কত তা অনুমান করা যাচ্ছে। না। কিন্তু এখানেই সমস্যা হয়েছে। ওই ধনরত্ন কোন রাষ্ট্রের সম্পত্তি হওয়া উচিত। এক, যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন তাই ওগুলো কি আফগান সরকারের হাতে যাওয়া উচিত? কিন্তু বিহার এবং বাংলার মুসলমান রাজত্ব কায়েম করার যিনি কারিগর, বাংলাতেই যাঁর মৃত্যু হয়েছিল তার সম্পত্তির ওপর বাংলা তথা ভারতের অধিকার হওয়া উচিত। সমস্যা বেড়ে গেল কারণ আমাদের পূর্বপুরুষ তিব্বতে অভিযান করেছিলেন। বেশ কয়েকটা বৌদ্ধ মনেষ্ট্রি দখল এবং ধ্বংস করে প্রচুর মণিরত্ন সংগ্রহ করেছিলেন। ফেরার সময় সেগুলোই তিনি গুহার ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন এমনভাবে যাতে মানুষের নজরে না পড়ে, তা হলে গুহার ভেতরের ওই সম্পদ তিব্বত দাবি করতে পারে। যেহেতু তিব্বত এখন চিনের দখলে এবং তিব্বতকে চিন নিজেদের দেশ বলে ঘোষণা করেছে তাই ওই সম্পদের দাবি চিন করতেই পারে। বুঝতেই পারছেন, জানাজানি হলে সমস্যাটা বেশ জটিল হয়ে যাবে।

অর্জুন একটু ভাবল। এই ধরনের কেস সে আগে পায়নি। আজকাল কোনও মামলা জটিল হলে মাথা ঘামাতে ভাল লাগে। সে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু সেই গুহাটা কোথায় তা কি আপনারা জানতে পেরেছেন?

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি মাথা নাড়লেন, না। আমার প্রপিতামহের লাইব্রেরিতে যে ম্যাপ দেখেছিলাম তা স্পষ্ট নয়। গৌড় থেকে তিব্বতে যাওয়ার পথ তখন কী ছিল তা জানি না। এখন তো সিকিম হয়ে যেতে হয়। ওই ম্যাপে লেখা আছে তিনবুড়োর মাঝখান দিয়ে দুইদিন যাওয়ার পর জঙ্গল পার হতে হবে। অনেক কিছু ইঙ্গিত হিসেবে দেওয়া আছে কিন্তু জায়গাটা ঠিক কোথায় তা স্পষ্ট বলা নেই।

ধরা যাক, গুহাটাকে খুঁজে পাওয়া গেল, তখন কী করবেন?

আমরা আটশো বছর ধরে ভারতীয়। আমি চাই ভারত সরকারের হাতে সব তুলে দিতে। আমরা সরকারের কাছে যেতে পারতাম। কিন্তু তা হলেই জানাজানি হয়ে যেত। ব্যাপারটা তখন আন্তর্জাতিক সমস্যায় পঁড়িয়ে যেত।

অর্জুন কথাগুলোর প্রতিবাদ করল না। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, আমাদের বন্ধু বলেছেন, পূর্বভারতের এই অঞ্চলটাকে আপনি খুব ভালভাবে চেনেন। এর আগে বহু রহস্যের সমাধান আপনি করেছেন।

রোজি বলল, নেটে আমি সেসব বিস্তারিত ভাবে জেনেছি। আপনি কি ওই গুহার সন্ধানে আমাদের সাহায্য করবেন?

অর্জুন বলল, এই কাজটা সত্যি আকর্ষণীয়। কিন্তু ওই গুহা যদি তিব্বত অথবা চিনের এলাকায় হয়ে থাকে তা হলে ওরা অনুমতি দেবে না। কেন খুঁজছি, কী খুঁজছি জানাতে হবে। সত্যি কথা জানালে ওরা সহযোগিতা করবে না। কিন্তু গুহাটা যদি ভারতের মধ্যে হয়ে থাকে তা হলে আমরা চেষ্টা করতেই পারি।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে এই কাজটার জন্যে কত অ্যাডভান্স করতে হবে? আমরা চাই ডিলটা প্রফেশনালি হোক।

অর্জুন মাথা নাড়ল, প্রসঙ্গটা তুলে ভাল করেছেন। এখন পর্যন্ত আমি যে কয়েকটি সত্যের সন্ধান করেছি তা সফল হওয়ার পরেই পারিশ্রমিক নিয়েছি। যে কাজ করে সাফল্য পাইনি তার জন্যে পারিশ্রমিক নেব কেন? এটা আমার গুরু শ্ৰীঅমল সোমের কাছ থেকে শিখেছি। আপনাদের এই কেসে যদি অগ্রিম নিই তা হলে মুশকিলে পড়ব। ধরুন, ওই গুহা চিনের এলাকায়, ওখানে যাওয়াই গেল না। কাজটাও করতে পারলাম না। অগ্রিম বাবদ যা নিয়েছি তা ফেরত দিতে হবে।

কী দরকার! কাজটা হয়ে গেলে তখন না হয় পারিশ্রমিক দেবেন।

রোজি জিজ্ঞাসা করল, অ্যামাউন্টটা বলবেন?

অর্জুন শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, আপনারা লখনউ থেকে প্লেনে এখানে এসেছেন। গুহা খুঁজতেও প্রচুর খরচ হবে। তার তুলনায় আমার পারিশ্রমিক খুবই সামান্য। থাক গে, প্রথমে বলুন, আপনাদের এই ইচ্ছের কথা আর কে জেনেছেন?

দু’জন। আমার বন্ধু আর তার বাঙালি অধ্যাপক বন্ধু, জনাব কামরুজ্জমান চটপট জবাব দিলেন।

অর্জুন রোজির দিকে তাকাল, আপনার কোনও বন্ধুকে বলেছিলেন?

চোখ বন্ধ করল রোজি, তারপর মাথা নাড়ল, না।

তা হলে এই যে আপনাকে কেউ ফোন করছে, আর আপনি ভয় পাচ্ছেন, এটা কেন হচ্ছে? অযথা কেউ একটা বাচ্চাকে টাকার লোভ দেখিয়ে আপনার বাবা যে গাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তার কাচ ভাঙবে কেন? এইসব ভয় তারাই দেখাচ্ছে যারা চাইছে না আপনারা এখানে থাকুন। এই শহরে প্রচুর লোক বেড়াতে আসেন। তাদের তো কেউ ভয় দেখায় না। তা হলে যারা ভয় দেখাচ্ছে তারা কি জেনে গিয়েছে কী উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন? অর্জুন প্রশ্ন করল।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, আমাদের এই শহরে আসার কারণ আপনার সঙ্গে দেখা করা। আমাদের পূর্বপুরুষের ধনসম্পত্তির সন্ধানে এখানে। আসার তো কোনও কারণ নেই। আমরা যদি নবদ্বীপ বা গৌড়ে যেতাম তা হলে আমাদের অনুসরণ করার যুক্তি থাকত না, আমি এই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

কফি শেষ করল অর্জুন। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি ছাড়া মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির আর ক’জন বংশধর জীবিত আছেন।

আমার প্রপিতামহের তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে ছিল। যতদূর জানি একটা নৌকোডুবিতে আমার পিতামহ ছাড়া বাকিরা মারা যান। আমার পিতামহের দুই ছেলে। কাকা প্রতিবন্ধী হওয়ায় বিয়ে করেননি। সারাজীবন পড়াশুনা নিয়ে থেকেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ডিগ্রি নিতে শারীরিক কারণে অক্ষম হলেও অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত। জনাব কামরুজ্জমান বললেন।

তিনি বেঁচে আছেন তো।

হ্যাঁ।

আপনার এই আবিষ্কার নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন?

হঠাৎ চোখ বড় হল ভদ্রলোকের। দ্রুত মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, ওঁর কথা মনে ছিল না। কিন্তু হুইলচেয়ার ছাড়া নড়তে পারেন না। উনি কেন আমাদের ভয় দেখাবেন? সেই ক্ষমতাও তাঁর নেই।

হঠাৎ রোজি বলল, এখন মনে পড়ছে। উনি অনেক বইপত্র ঘেঁটে একদিন বলেছিলেন একটা লোকের কথা যিনি মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির পরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তারও পদবি ছিল খিলজি। গিয়াস-উদ-দিন ইয়াজ খিলজি নামের সেই লোকটির কোনও বংশধর আছেন কিনা তা গ্র্যান্ডপা বলতে পারেননি।

অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনারা দার্জিলিং-এ কখনও বেড়াতে এসেছেন? আসেননি? আমি সাজেস্ট করছি, আজ এখানে না থেকে দার্জিলিং-এ যান, ঘণ্টা পাঁচেক লাগবে।

হঠাৎ দার্জিলিং-এ যেতে বলছেন কেন? রোজি বিরক্ত হল।

আমি একটা দিন সময় চাইছি। এই সময়টা এখানে বসে থাকতে আপনারা নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন না। দার্জিলিং-এ গেলে ভাল লাগবে।

আমাদের এই ব্যাপারটা আমরাই ঠিক করে নেব। আপনি কাল কখন জানাবেন? রোজি জিজ্ঞাসা করল।

আমাকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আটশো বছর আগে কী কী ঘটেছিল তার হদিশ চট করে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাকে একটা ম্যাপ পেতে হবে। যে পথ দিয়ে আপনাদের পূর্বপুরুষ এসে নবদ্বীপ দখল করেছিলেন, করে গৌড়ে এসেছিলেন তা জানতে হবে। যতদূর আমি ইতিহাস বইতে পড়েছি তাতে বাংলায় তার রাজধানীর নাম ছিল লক্ষণাবতী। আবার দেবকোট নামেও একটা জায়গায় ওঁর রাজধানী ছিল। এইসব তথ্য পরিষ্কার না জানলে আটশো বছর পরে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অর্জুন খুব ভেবে চিন্তে কথাগুলো বলল।

কিন্তু এসব তথ্য আপনি কী করে পাবেন? রোজি জিজ্ঞাসা করল।

পেতেই হবে। মিস্টার খিলজি, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা সহজসাধ্য নয়। আমার কাছে যেসব সমস্যা নিয়ে মানুষ আসেন সেগুলো নিয়ে কাজ করা অনেক সহজ কারণ, তার জন্যে ইতিহাস খুঁজতে হয় না। আমাদের ইতিহাস রাজা রাজড়ার হলেও তাদের অপছন্দের কথা সেই ইতিহাসে লেখা হত না। তাই মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কাজে নামলে অন্ধের মতো পথ হাতড়াতে হবে। আমি যে একদিন সময় চাইলাম, এটা একেবারেই কথার কথা। অর্জুন। বলল।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি হাত বাড়িয়ে অর্জুনের হাত ধরলেন, শাবাস, আপনার কথা শোনার পর আমি নিশ্চিন্ত হলাম। আপনি সময় নিন, আমরা আজই লখনউ ফিরে যাচ্ছি। আপনি তৈরি হয়ে ফোন করলেই আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করব। হাত ছেড়ে দিলেন তিনি।

রোজি অবাক হয়ে বলল, ড্যাডি, আমরা ফিরে যাব?

হ্যাঁ মা। আমাদের পূর্বপুরুষের ধনসম্পত্তি তো এতকাল অজানা ছিল। আমি জানতামই না ওই গুহার কথা। অবশ্য সেই গুহা কোথায় তা এখনও আমি জানি না। আটশো বছর ধরে যদি সেই গুহা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে থাকে তা হলে আরও কিছুকাল স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। তদ্দিনে মিস্টার অর্জুন যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারবেন। আপনি আমার কার্ড রাখুন। মোবাইল এবং ল্যান্ড লাইনের দুটো নাম্বারই রয়েছে, আর আমি জানি রোজি আপনাকে নিয়মিত তাগাদা দেবে। জনাব কামরুজ্জমান প্রসন্নমুখে কথাগুলো বললেন।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress