Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কড়া নাড়তেই দরজা খুলল || Humayun Ahmed

কড়া নাড়তেই দরজা খুলল || Humayun Ahmed

কড়া নাড়তেই দরজা খুলল।

অতসী মুখ বের করল। মিসির আলি বললেন, ভালো আছ অতসী? অতসী স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।

তোমার বাবা বাসায় আছেন তো? অতসী জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, আমি ভেবেছিলাম তোমরা আসবে আমার কাছে। তোমরা এলে না। শেষে নিজেই এলাম। ঠিকানা বদলেছ, খুঁজে বের করতে কিছু সময় লেগেছে। আজ কি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করা যাবে? না আজও যাবে না?

যাবে।

তাহলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াও। ঘরে ঢুকি।

অতসী দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, তুমি কি আমাকে দেখে অবাক হয়েছ? অতসী নিচু গলায় বলল, না, অবাক হই নি। আপনি আসবেন আমি জানতাম। বসুন, বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।

অতসী ভেতরে চলে গেল। অম্বিকাবাবু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঢুকলেন। লুঙ্গি পরা, খালি গা। কাঁধের ওপর ভেজা গামছা। তিনি অবাক হয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মেয়ের মতো তিনিও পলক না- ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারেন।

মিসির আলি বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।

অম্বিকাবাবু বললেন, স্যার বসুন। আপনি মিসির আলি। আগেও একবার এসেছিলেন। আমার মেয়ে আমাকে বলেছে। কি ব্যাপার স্যার?

আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আপনি বসুন। আমি বেশিক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করব না।

অম্বিকাবাবু বসলেন। মনে হচ্ছে একটু ভয় পাচ্ছেন। বারবার ভেতরের দরজার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন! মনে হচ্ছে তিনি চাচ্ছেন তাঁর মেয়ে এসে বসুক তাঁর কাছে।

অম্বিকাবাবু।

বলুন।

আপনি ওসমান গনিকে চেনেন, তাই না?

জ্বি, চিনি।

তিনি হাত দেখাবার জন্যে আপনার কাছে আসতেন?

জ্বি।

তাঁর স্ত্রীও কি এসেছিলেন?

এক দিন এসেছিলেন।

ওসমান গনি প্রায়ই আসতেন?

মাঝে-মাঝে আসতেন। উনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।

উনি কি পামিস্ট্রি বিশ্বাস করতেন?

না। উনি নাস্তিক ধরনের মানুষ। কোনো কিছুই বিশ্বাস করতেন না।

আপনি তাঁর মেয়েটিকে চেনেন?

না।

কখনো দেখেন নি?

না।

অতসী বলছিল। আপনার শরীর খারাপ। কী রকম খারাপ?

আমার মানসিক কিছু সমস্যা আছে। মাঝে-মাঝে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। তখন কি করি বা কি না করি কিছুই বলতে পারি না। কিছু মনেও থাকে না।

আপনি যে আমার কাছে গিয়েছিলেন তা মনে আছে?

জ্বি-না, মনে নেই। আমাকে কী বলেছিলেন–কিছুই মনে নেই?

না। স্যার, ঐ সময় আমার মাথার ঠিক ছিল না।

অতসী চা নিয়ে ঢুকল। আগের মতো দুধ-চিনি ছাড়া চা নয়। দুধ-চা। চায়ের সঙ্গে বিসকিট আছে। চানাচুর আছে। মনে হচ্ছে আগের হতদরিদ্র অবস্থা এরা কাটিয়ে উঠেছে।

অম্বিকাবাবু!

বলুন!

আপনি কি কখনো ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গিয়েছেন?

না।

কখনো যান নি?

না।

উনি কখনো আপনাকে যেতে বলেন নি?

না।

অতসী দু কাপ চা এনেছিল। মিসির আলি তাঁর কাপ শেষ করলেন। কিন্তু অম্বিকাবাবু নিজের কাপ ছুঁয়েও দেখলেন না। তিনি সারাক্ষণ বসে রইলেন মাথা নিচু করে। তাঁর দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে।

ওসমান গনি যে মারা গেছেন তা কি আপনি জানেন?

জানি।

কীভাবে জানলেন? পত্রিকায় পড়েছেন?

অম্বিকাবাবু জবাব দিলেন না। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে লাগলেন।

উঠি অম্বিকাবাবু।

আচ্ছা।

আরেকদিন এসে আপনাকে হাত দেখিয়ে যাব।

অম্বিকাবাবু মৃদু গলায় বললেন, এখন আর হাত দেখতে পারি না। অসুখের পর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।

তাহলে গল্প করার জন্যেই না-হয় আসব। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

অম্বিকাবাবু কিছু বললেন না। মিসির আলি রোজ ভিলায় ফিরে এলেন। রোজ ভিলা তাঁর কাছে এখন নিজের বাড়িঘরের মতোই লাগছে। অন্যের বাড়িতে থাকছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন-এ নিয়ে কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। রোজ তিলায় আজ নিয়ে পঞ্চম দিন! এখন পর্যন্ত আব্দুল মজিদ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলেন নি। যদিও এ-বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ বাস করে। দু জন বাবুর্চি আছে। এক জন একতলায় থাকে। সে পুরুষ। নাম মকিম মিয়া। অন্যজন মহিলা-জাহানারা। সে থাকে দোতলায়। দোতলায় ওসমান গনি সাহেবের দূর সম্পর্কের এক ফুপূও থাকেন। আশির কাছাকাছি বয়স হুইল চেয়ারে করে মাঝেমধ্যে বারান্দায় আসেন। এই বৃদ্ধা মহিলার দেখাশোনা করার জন্যে অল্পবয়স্কা একটি মেয়ে আছে। সালেহা নাম।

নাদিয়ার কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্যেই একজন কাজের লোক আছে। অ্যাংলো মেয়ে নাম এলিজাবেথ। ডাকা হয় এলি করে।

দোতলার পুরোটাই নারীমহল। পুরুষদের সন্ধ্যার পর সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। একতলায় পুরুষ রাজত্ব। এখানে সবাই পুরুষ। দুজন ড্রাইভার। তিনজন দারোয়ান। দু জন মালী। এরাও একতলার বাসিন্দা। তবে এরা মূল বাড়িতে থাকে না! বাড়ির পিছনে ব্যারাকের মতো একসারিতে কয়েকটা ঘর আছে, এরা থাকে। সেখানে! মূল বাড়িতে সাফকাত নামের এক ভদ্রলোক থাকেন। সবাই তাঁকে ম্যানেজার সাহেব ডাকেন। ভদ্ৰলোকের সঙ্গে মিসির আলিয়া কয়েকবারই দেখা হয়েছে। কখনো কথা হয় নি। সাফাকাত সাহেবের সঙ্গে মুখোমুখি হলেই তিনি দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যান। মিসির আলির কয়েকবারই ইচ্ছা করেছে ডেকে জিজ্ঞেস করেন– আপনি আমাকে দেখলে এমন করেন কেন?

শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয় নি। মিসির আলি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চাচ্ছেন, কিন্তু গোছাতে পারছেন না। সব এলোমেলো হয়ে আছে। অনেকগুলি প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।

রাত নটার মতো বাজে। মিসির আলি তাঁর শোবার ঘরে খাতা খুলে বসেছেন। পেনসিলে নোট করছেন। এখন লিখছেন সেইসব প্রশ্ন, যার উত্তর তিনি বের করতে পারছেন না :

(১) ওসমান গনির মতো ধনবান এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি প্রায়ই আসতেন অম্বিকাবাবুর কাছে। অম্বিকাবাবু কখনো এ—বাড়িতে আসেন নি। যদিও উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। ওসমান গনি অনায়াসে ডেকে পাঠাতে পারতেন অম্বিকাবাবুকে। কেন তা করেন নি?

(২) ওসমান গনি পামিস্ট্রি বিশ্বাস করতেন না। তাহলে ঠিক কোন প্রয়োজনে অম্বিকাবাবুর কাছে তিনি যেতেন? অম্বিকাবাবুর কথা অনুযায়ী ওসমান গনি তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। কেন পছন্দ করতেন? অম্বিকাবাবুর চরিত্রের কোন দিকটি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল?

(৩) অম্বিকাবাবু এবং তাঁর কন্যা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। এরা দু জনই আমাকে ভয় পাচ্ছে! কেন? আমার সঙ্গে যাতে দেখা না-হয় সে-কারণে এরা বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। কেন?

দরজায় টোকা পড়ছে। মিসির আলি বললেন, কে?

স্যার, আমি মজিদ। রাতের খাবার নিয়ে এসেছি স্যার।

মিসির আলি উঠে দরজা খুলে দিলেন। মজিদ বলল, খাওয়া শেষ হবার পর আপা তাঁর সঙ্গে আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।

আমি দোতলায় যাব, না। তিনি নিচে নেমে আসবেন?

স্যার, আমি আপনাকে দোতলায় নিয়ে যাব।

নাদিয়া দোতলার বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। মিসির আলি ঢুকতেই হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?

ভালো।

আপনার তদন্ত কেমন এগুচ্ছে?

এগুচ্ছে।

বসুন। বলুন তো কি জন্যে ডেকেছি?

বুঝতে পারছি না।

জোছনা দেখার জন্যে ডেকেছি। বারান্দা থেকে সুন্দর জোছনা দেখা যায়। ঘরে এবং বাগানের সব বাতি নিভিয়ে দিতে বলব, তখন দেখবেন, কী সুন্দর জোছনা! স্ট্রট ল্যাম্পগুলি সব সময় ডিসটর্ব করে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আজ স্ট্রীট ল্যাম্প জ্বলছে না।

অ্যাংলো মেয়েটি চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন। কেমন পুরুষালি চেহারা। সে রোবটের মতো কাপে চা ঢালছে। নাদিয়া বললেন, এলি, তুমি বাতি নিভিয়ে দিতে বল। আমরা জোছনা দেখব।

এলি মাথা নাড়ল। মোটেই বিস্মিত হল না। তার অর্থ হচ্ছে বাতি নিচিয়ে জোছনা দেখার এই পর্বটি নতুন নয়। আগেও করা হয়েছে।

মিসির আলি সাহেব।

বলুন।

আপনি মজিদ ছাড়া আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?

এখনো করি নি, তবে করব।

সময় নিচ্ছেন কেন?

গুছিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। গুছিয়ে আনলেই জিজ্ঞেস করব।

ওরা নিজ থেকে কিছু বলছে না?

না।

নাদিয়া হাসতে-হাসতে বললেন, এরা কি আপনাকে গোপনে বলে নি এ-বাড়িতে ভূত আছে? গভীর রাতে বাথরুমে গেলে আপনা-আপনি বাথরুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়? মজিদ নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে আপনাকে এই কথা বলেছে এবং অনুরোধ করেছে যেন আমি না-জানি। কি, করে নি?

করেছে।

আপনার বাথরুমের দরজা কি কখনো বন্ধ হয়েছে?

এখনো হয় নি।

নাদিয়া সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, আমার বাথরুমের দরজাও বন্ধ হয়নি। ওদের প্রত্যেকের বেলাতেই নাকি হয়েছে। আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন মিসির আলি সাহেব?

না, করি না।

আমিও করি না।

আপনার বাবা–তিনি কি করতেন?

নাদিয়া কিছু না-বলে সিগারেটে টান দিতে শুরু করলেন। হাতের ইশারায় এলিজাবেথকে চলে যেতে বললেন। এলিজাবেথ চলে গেল, এবং তার প্রায় সঙ্গে— সঙ্গেই ঘরের সব বাতি নিতে গেল। নদিয়া বললেন, খুব সুন্দর জোছনা, তাই না মিসির আলি সাহেব?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর। আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনার বাবা কি ভূত বিশ্বাস করতেন?

তিনি নাস্তিক ধরনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে ভূতপ্ৰেত বিশ্বাস করা শুরু করলেন।

কেন?

ঠিক বলতে পারব না কেন। তাঁকে কখনো জিজ্ঞেস করি নি।

মিসির আলি বললেন, বাথরুমের দরজা বন্ধ হওয়া-সংক্রান্ত ভয় পাওয়া শুরু হল কখন? আপনার মার মৃত্যুর পর, না তারো আগে?

তারো আগে। এর একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটা আপনাকে বলি। আপনার তদন্তে সাহায্য হতে পারে। আপনি পা উঠিয়ে আরাম করে বসুন। টী-পট ভর্তি চা। চা খেতেখেতে গল্প শুনুন। তার আগে বলুন, জোছনা কেমন লাগছে।

ভালো লাগছে।

জোছনা দেখার এই কায়দা কার কাছ থেকে শিখেছি জানেন? বাবার কাছ থেকে। তিনি এইভাবে জোছনা দেখতেন। যে-রাতে খুব পরিষ্কার জোছনা হত, তিনি টেলিফোন করে দিতেন মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র সাহেবকে। তারা বাসার সামনের স্ট্রীট লাইটের বাতি নিভিয়ে দিত। ক্ষমতাবান মানুষ হবার অনেক সুবিধা।

মিসির আলি পা উঠিয়ে বসলেন। নাদিয়া গল্প শুরু করল—

আমার বাবা বিয়ে করেছিলেন খুব অল্প বয়সে। বছর বয়সে। আমার মার বয়স তখন পনের। ভালবাসার বিয়ে। বাবার তখন খুব দুর্দিন যাচ্ছে। টাকা পয়সা নেই। পরের বাড়িতে থাকেন। এর মধ্যে নতুন বৌ, যাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নানান দুঃখ-কষ্টে তাঁদের জীবন কাটছে। শুরুটা সুখের নয়, বলাই বাহুল্য। এর মধ্যে মা কনসিভ করে ফেললেন। এই অবস্থায় নতুন একটি শিশু। পৃথিবীতে আনা চরম বোকামি। কাজেই বাবা-মা দু জন মিলেই ঠিক করলেন, শিশুটি নষ্ট করে দেওয়া হবে। হলও তাই। আনাড়ি ডাক্তার। অ্যাবোরশান খুব ভালোভাবে করতে পারল না, যে-কারণে মার সন্তানধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল। বিয়ের দশ বছর পরেও তাঁর আর কোনো ছেলেমেয়ে হল না। ততদিনে বাবা দু হাতে টাকা রোজগার করতে শুরু করেছেন। অর্থের সুখ বলতে যা, তা তাঁরা পেতে শুরু করেছেন। বড় সুখের পাশাপাশি বড় দুঃখ থাকে। তাঁদের বড় দুঃখ হল-সন্তানহীন জীবন কাটাতে হবে এই ধারণায় অভ্যস্ত হওয়া।…..

মার জন্যে এটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। বাবা সেই কঠিন ব্যাপারটা একটু সহজ করবার জন্যে একটা ছ মাস বয়সী ছেলে দত্তক নিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ছেলেটি দত্তক নেবার সঙ্গে-সঙ্গেই মা কনসিভ করলেন। আমার জন্ম হল। ছেলেটির সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান ন মাসের মতো।……

আমরা দু জন একসঙ্গে বড় হচ্ছি। সঙ্গত এবং স্বাভাবিক কারণেই মার সমস্ত স্নেহ তখন আমার দিকে। ছেলেটিকে তিনি সহ্যও করতে পারেন না। আবার কিছু বলতেও পারেন না-করণ ছেলেটিকে বাবা খুব পছন্দ করতেন।….

মা একেবারেই করতেন না। ছেলেটা ছিল লাজুক ধরনের। কারো সঙ্গে বিশেষ কথাটথা বলত না। মা অতি তুচ্ছ অপরাধে তাকে শাস্তি দিতেন। শাস্তিটা হল আর কিছুই না, বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া। বাথরুম ছিল মার জেলখানা। অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে বাথরুমে থাকার মেয়াদ ঠিক হত।

মিসির আলি কাপে চা ঢালতে-ঢালতে বললেন, আপনাকে কি এই জাতীয় শাস্তি পেতে হয়েছে?

না, আমাকে এ-ধরনের শাস্তি কখনো দেওয়া হয় নি। যাই হোক, যা বলছিলাম-এক রাতের কথা। মা ছেলেটিকে শাস্তি দিয়েছেন। বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ছেলেটিকে বাথরুমে ঢোকানোর পর খুব ঝড় শুরু হল। ঘরের জানালার বেশ কয়েকটা কাঁচ ভেঙে গেল। আমাদের বাসার পিছনে বড়ো একটা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল। ঐ গাছ ভেঙে বাড়ির ওপর পড়ল। মনে হল পুরো বাড়ি বুঝি ভেঙে পড়ে গেল। আমি চিৎকার করে কাঁদছি। কারেন্ট চলে গেছে। সারা বাড়ি অন্ধকার। বিরাট বিশৃঙ্খলার মধ্যে সবাই ভুলে গেল ছেলেটির কথা! তার কথা মনে হল পরদিন ভোরে। বাথরুমের দরজা খুলে দেখা গেল সে বাথটাবে চুপচাপ বসে আছে। তাকিয়ে আছে বড়-বড় চোখে। তার দেহে যে প্রাণ নেই, তা তাকে দেখে মোটেই বোঝা যাচ্ছিল না। ছেলেটি মারা গিয়েছিল ভয়ে হার্টফেল করে। বাথরুম-সংক্রান্ত ভয়ের শুরু সেখান থেকে। গল্পটা কেমন লাগল মিসির আলি সাহেব?

মিসির আলি জবাব দিলেন না।

নাদিয়া হাই তুলতে-তুলতে বলল, রাত অনেক হয়েছে। যান, ঘুমিয়ে পড়ুন। আজ সারা রাত যদি বাতি না জ্বালানো হয় আপনার কি অসুবিধা হবে?

জ্বি-না, অসুবিধা হবে না।

মজিদ আপনার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। অসম্ভব সুন্দর একটা জোছনা রাত। ইলেকট্রিক বাতি জ্বালিয়ে এ-রাত নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

রাত বেশি হয় নি। বারটা দশ। ঘর অন্ধকার করে মোমবাতি জ্বালানোর কারণেই বোধহয়—নিশুতি রাত বলে মনে হচ্ছে মিসির আলি খানিকক্ষণ লেখালেখি করার চেষ্টা করলেন। লেখার বিষয়–অনিদ্ৰা। অনিদ্ৰা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা। এই প্ৰবন্ধটি তিনি গত দু বছর ধরে লেখার চেষ্টা করছেন। যখনই কিছু মনে হয় তিনি লিখে ফেলেন। আজ কিছুই মনে আসছে না। তবু লিখছেন!

স্যার।

মিসির আলি চমকে তাকালেন! আব্দুল মজিদ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

কি ব্যাপার?

একটা চার্জ লাইট নিয়ে এসেছি স্যার। আপা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

দরকার ছিল না।

আপা বললেন, আপনি রাত জেগে পড়াশোনা করেন। মোমবাতির আলোয় পড়তে অসুবিধা হবে।

ঠিক আছে, রেখে যাও।

ফ্যান চলছে না। গরম লাগছে। মিসির আলি বায়ান্দায় এসে বসলেন। ধারান্দার এক কোণার মেঝেতে আরো একজন বসে আছে। মিসির আলিকে দেখে সে পিলারের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিল। মিসির আলি বললেন, কে ওখানে? সাফকাত সাহেব না?

জ্বি স্যার।

লুকিয়ে আছেন কেন? এখানে আসুন, গল্প করি।

সাফকাত পিলারের আড়াল থেকে বের হয়ে এল। খুব অনিচ্ছার সঙ্গে এল। মিসির

জ্বি-না স্যার।

না কেন? চেয়ারে বসতে অসুবিধা আছে?

সাফকাত বসে পড়ল। মিসির আলি বললেন, আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন কেন? দেখা হলেই পালিয়ে যান কিংবা পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। রহস্যটা

সাফকাত, জবাব দিল না। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল।

সাফকাত সাহেব।

জ্বি স্যার।

আপনি বাথরুমে গিয়েছেন আর আপনা আপনি আপনি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, এ-রকম কি কখনো হয়েছে?

দু বার হয়েছে স্যার।

শেষ কবে হল? ওসমান গনি সাহেবের মৃত্যুর আগে, না পরে?

উনার মৃত্যুর আগে।

কত দিন আগে?

আট দিন আগে।

খুব ভয় পেয়েছিলেন?

জ্বি।

দরজা কতক্ষণ বন্ধ ছিল?

বলতে পারি না। ভয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। দরজা খুলে এরা আমাকে বের করে। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যায়। দু দিন ছিলাম হাসপাতালে।

এত ভয় পেলেন কেন?

হঠাৎ করে বাথরুম অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর ঘন্টার শব্দ শুরু হল।

ও আচ্ছা-ঘন্টার শব্দ হচ্ছিল।

জ্বি-গির্জায় ঘন্টার যে-রকম শব্দ হয় সে-রকম শব্দ।

গির্জার ঘন্টার শব্দের কথা আপনি জানলেন কীভাবে?

আমার বাড়ি স্যার বরিশালের মূলাদি। ঐখানে ক্যাথলিকদের একটা গির্জা আছে।

বাতি নিভে গেল, গির্জার ঘন্টার শব্দ হতে লাগল, আর কী হল?

ফুলের গন্ধ পেলাম স্যার।

কি ফুল?

কাঁঠালিচাঁপা ফুল।

এই বাড়িতে আপনি তাহলে খুব ভয়ে-ভয়ে থাকেন?

জ্বি স্যার। কোনো সময়েই বাথরুমের দরজা বন্ধ করি না। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও স্যার ভাবছি। চাকরি কোথাও পাচ্ছি না। চাকরির বাজার খুব খারাপ। তা ছাড়া–

তা ছাড়া কী?

আপা আমাকে খুব পছন্দ করেন। উনাকে একা ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা করে না।

আপনার আপা প্রসঙ্গে বলুন, উনি কেমন মেয়ে?

খুব তেজী মেয়ে স্যার। খুব সাহসী। সন্ধ্যার পর থেকে এ-বাড়ির লোকজন ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। কিন্তু আপার মনে কোনো ভয়ডর নেই। রাতে-বিরাতে এক-একা ঘুরে বেড়ান। তাছাড়া স্যার দেখুন, বাবার এত বড় বিজনেস, সব তিনি নিজে দেখছেন। ভালোভাবে দেখছেন।

আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে চাঁদ ঢাকা পড়বে। সাধের জোছনা বেশিক্ষণ দেখা যাবেনা। মিসির আলি উঠে পড়লেন। ঘুম পাচ্ছে। ঘরে ঢোকামাত্র আব্দুল মজিদ এল পানির গ্লাস ও বোতল নিয়ে।

এখনো জেগে আছ মজিদ?

জ্বি স্যার ঘর অন্ধকার-ঘূমাতে ভয়ভয় লাগে। আপনার কি আর কিছু লাগবে?

না। কাল সকালে বৃদ্ধ মহিলাটির সঙ্গে কথা বলব।

জ্বি আচ্ছা স্যার?

উনি ঘুম থেকে ওঠেন কখন?

বুড়ো মানুষ তো স্যার, রাতে ঘুম হয় না। ফজর ওয়াক্তে ঘুম ভাঙে।

আমি খুব ভোরেই ওঁর সঙ্গে কথা বলব।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

তুমি চলে যাও। আমার আর কিছু লাগবে না।

মজিদ তবু দাঁড়িয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে?

মজিদ নিচু গলায় বলল, বাড়িঘর অন্ধকার। বাথরুমে যদি যান দরজাটা খোলা রাখবেন স্যার!

আমার ভূতের ভয় নেই মজিদ।

স্যার, ভূতের ভয় আমারো ছিল না। কিন্তু এই দুনিয়ায় অনেক কিছু আছে। আমরা আর কতটা জানি! একটু সাবধান থাকলে ক্ষতি তো স্যার কিছু না।

আচ্ছা, দেখা যাক।

রাতে মিসির আলি কয়েকবারই বাথরুমে গেলেন। প্রতিবারই দরজা বন্ধ রাখলেন। এবং আশা করতে লাগলেন দরজা আটকে যাবে।–কিছুতেই ভেতর থেকে খোলা যাবে না। কিন্তু তেমন কিছু হল না।

মিসির আলি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। বিজলি চমকাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। দোতলার বারান্দায় চটি ফটফটিয়ে হাঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নাদিয়া হাঁটছে নিশ্চয়ই। মেয়েটা তাহলে সত্যি-সত্যি ঘুমায় না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *