ওরা তখন খেতে বসেছে
০৬.
ওরা তখন খেতে বসেছে।
হঠাৎ দরজায় ক্ষিতীশকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
“তোমাকে দরকার, একটু বাইরে এসো।”
কোনিকে লক্ষ করে কথাগুলো বলে, সে দরজা থেকে সরে গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে দেখে নিয়েছে কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ, ফ্যান এবং সম্ভবত তার মধ্যে কিছু ভাত আছে আর তেতুল। পাঁচটি প্রাণী কলাই আর অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে বসে। ঘরে একটা তক্তপোশ। তোষক নেই, শুধু চিটচিটে ছোট কয়েকটা বালিশ। দেয়ালে টাঙানো দড়িতে কিছু ময়লা জামা-প্যান্ট। খোলার চালের এই ঘরে একটি মাত্র জানলা, যার নিচেই থকথকে পাঁকে ভরা নর্দমা।
কোনি কৌতূহলী চোখে বেরিয়ে এল।
“এই ফর্মটায় সই করে দাও, আর আজ বিকেলে আমার সঙ্গে জুপিটার ক্লাবে যাবে।”
ফর্মটা হাতে নিয়ে কোনি যেন কেমন এক ফাঁপরে পড়ল। “কলম আছে আপনার কাছে?”
ক্ষিতীশের কাছে নেই।
“পেন্সিলে লিখলে হবে?”
“না, কালিতে সই করতে হবে।”
কোনি ছটে গিয়ে কোথা থেকে কলম যোগাড় করে আনল। ক্ষিতীশের দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় কলম বাগিয়ে সে জানতে চাইল, “ইংরিজিতে না বাঙলায়?”
“যা খুশি।”
ধরে ধরে, বিড়বিড়িয়ে বানান করে কোনি ইংরাজীতেই সই করল। সেটা দেখে ক্ষিতীশ বলল, “কোন ক্লাশে পড়ো?”
“ভাইভে।”
“স্কুলে যাও?”
“নাম কেটে দিয়েছে।”
“আজ ঠিক চারটের সময় কমলদিঘির পশ্চিম দিকের বড়গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে। তোয়ালে, কস্ট্যুম সব নিয়ে যাবে।”
“তোয়ালে নেই।”
“আমি নিয়ে যাব। তুমি ঠিক সময়ে আসবে।”
.
ঠিক সময়েই কোনি হাজির ছিল। ক্ষিতীশ ওকে নিয়ে ক্লাবে ঢুকল। অফিস ঘরে হরিচরণ আর প্রফুল্ল বসাক। ক্ষিতীশ ফর্মটা প্রফলের হাতে দিল। সেটা পড়ে প্রফুল্ল বলল, “সুইমার?
“হ্যাঁ।”
“ট্রায়াল দিতে হবে।”
“তার মানে?” ক্ষিতীশ বিরক্ত হয়েই বলল, “আমি বলছি তাতে হবে না?”
“তা কি করে হয়! ক্লাবের একটা নিয়ম আছে তো। ট্রেনার যদি বলে তবেই সুইমার। যে-সে, যাকে-তাকে এনে সুইমার বলবে আর জলে নেমে যদি ডুবে যায় তখন আমরাই তো হাগামায় পড়ব।”
প্রফুল্ল কথাগুলো বলতে বলতে হরিচরণের দিকে তাকাল। জানলার বাইরে তাকিয়ে হরিচরণ তখন মুচকি হাসছে।
“যে সে! আমি তাহলে যে সে?” ক্ষিতীশ বিড়বিড় কয়ল থমথমে ধরে। কোনি অবক হয়ে দেখছে, দলে দলে ছেলেরা কস্ট্যুম পরে ক্লাব থেকে বেরোচ্ছে। তিন-চারটি মেয়েও আছে তার মধ্যে। বাইরে হৈ চৈ জলের ধারে নভিস ছেলেদের।
“বেশ তাহলে ট্রায়াল নেওয়া হোক।”
হরিচরণ মুখ ফেরাল এতক্ষণে। কোনিকে আপাদমস্তক দেখে বলল, “মেয়েটি কে?”
“আমার চেনা মেয়ে। গুড মেটিরিয়াল। স্ট্রোক শেখাতে হবে।”
“গুড মেটিরিয়াল!” হরিচরণ ঠোঁট বেঁকিয়ে শব্দগুলো দুমড়ে মুখ থেকে বার করল। কোনিকে আর একবার দেখে নিয়ে, গম্ভীরস্বরে বলল, “এ ক্লাবের কাউকে স্ট্রোক শেখাতে হলে, শেখাবে ক্লাবেরই ট্রেনাররা। কাল সকালে আসুক। বন্দনা কি টুনু ওর ট্রায়াল নেবে।”
ক্ষিতীশ কয়েক সেকেণ্ড হরিচরণ ও প্রফুল্লর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আচ্ছ।”
বেরিয়ে এসে কোনি বলল, “কি হল ভর্তি করাল না?”
“পরীক্ষা দিতে হবে। কোনি, আমাদের দুজনকেই পরীক্ষা দিতে হবে।”
কথাটা বুঝতে পারল না কোনি। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, “দুজনকেই। কেন, আপনি সাঁতার জানেন না?”
“সাঁতার নয়, আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে অপমান সহ্য করার।”
ক্ষিতীশ জলের ধারের রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। দুটি ক্লাবের প্রায় চারশো ছেলে কমলদিঘিতে দাপাদাপি করছে, কয়েকটি মেয়েও আছে। দুটো ডাইভিং বোর্ডে কয়েকটি ছেলে। তারা জলে লাফাচ্ছে নিছকই লাফাবার জন্য। বিষণ্ণচিত্তে ক্ষিতীশ মাথা নাড়ল। কাজের কাজ কেউই করছে না। সুহাস জলে নামছে। একবার সে তাকাল মাত্র তার দিকে।
হরিচরণ ক্লাব অফিসের জানলা থেকে চেঁচিয়ে বলল, “সুহাস, দুটো ফোর হানড্রেড, তারপর হানড্রেড বাটারফ্লাই, ব্যাক অ্যান্ড ব্রেস্টস্ট্রোক ইচ, মনে আছে তো?”
সুহাস ঘাড় নাড়ল।
ক্ষিতীশ হাসল। মাত্র এগারোশো মিটার, এই ট্রেনিংয়ে এরা উন্নতি করবে! তবে সুহাসের স্ট্রোক নিঁখুঁত। ক্ষিতীশ বলল, “কোনি, ওই যে ছেলেটা জলে নামল ওকে লক্ষ করে দেখো কেমনভাবে হাত পাড়ি দেয়।”
কোনি একাগ্র হয়ে তাকিয়ে রইল সুহাসের সাঁতারের দিকে। ক্ষিতীশ এক সময় বলে উঠল, “হাতটা মাথার ঠিক সামনে জলে ঢুকে সামনে চলে যাচ্ছে, তারপর নীচে নামছে, তারপর টেনে উরু পর্যন্ত আনছে। সব থেকে দরকার স্পীডে হাত চালানো। তার মানে এলোপাথাড়ি গঙ্গায় যেভাবে করো তা নয়। সুন্দরভাবে জলে হাতের ঢোকাটা আর শক্ত কব্জি খুব দরকার। আসল স্পীডটা আসে কাঁধের, পিঠের আর হাতের মাসলের শক্তি থেকে। এজন্য তোমার একসারসাইজ করতে হবে। এই শক্তিটাকে গুছিয়ে কাজ করালে তবেই স্পীডটা আসবে। মাথাটা কিভাবে রয়েছে দেখেছ? তুমি যেমন এধার ওধার নাড়াও, সেই রকম করছে কি? মুখ জলে ডুবিয়ে কেমন এগোচ্ছে। শুধু নিঃশ্বাস নেবার জন্য মাথাটা, ওই দ্যাখো পাশে ঘোরাল। বেশি মাথা নাড়ালে স্পীড কমে যায়। কাঁধটা জল থেকে উঠে আছে।”
কোনি শুনছে কি শুনছে না বোঝা গেল না। সাঁতারুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে বলল, “আচ্ছা এই মেয়েটার নাম কি?”
ক্ষিতীশ একটু হতাশ হয়েই বলল, “জানি না।”
“ওর কস্টুমটা কিসের, গেঞ্জির?”
“নাইলনের– খুব দামি।”
“খুব সুন্দর রঙটা।”
ক্ষিতীশ কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, “তোমাকে কিনে দেবে একটা–”
কোনি ঘরে দাঁড়াল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
“যেদিন তুমি এই রকম স্ট্রোক দিতে শিখবে।” ক্ষিতীশ আঙুল দিয়ে সাঁতরে যাওয়া সুহাসকে দেখাল।
কোনি তীক্ষ্ণ চোখে সুহাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “দু’দিনে শিখে নেব।”
“ভাল। কাল সকাল ঠিক সাড়ে ছটায় আজ যেখানে দাঁড়িয়েছিলে, সেখানে দাঁড়াবে। কস্ট্যুম সঙ্গে আনবে। পাশ তুমি করে যাবেই সেজন্য ভাবছি না। কিন্তু স্ট্রোক শেখানোর ভার পান্না কি নির্মলের উপর যদি পড়ে তাহলে তো সব মাটি হয়ে যাবে।”
কিন্তু কোন পাশ করেও ভর্তি হতে পারল না।
সকালে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া দেখল। কোনি অনায়াসে দুশো মিটার সাঁতরালো, জলে দ’হাত তুলে রইল, ঝাঁপ দিল ডাইভিং বোর্ডের নীচতলা থেকে।
বিকেলে অফিস ঘরে প্রলে তাকে বলল, “সম্ভব নয়, আর মেম্বার নেওয়া যাবে না, সেক্রেটারির স্ট্রিক্ট অর্ডার। জলে আর হাত-পা ছোঁড়ারও জায়গা নেই, এত ভীড়। আজকেই তো দুজনকে রিফিউজ করতে হল।”
“তাহলে আগেই সেটা আমাকে বলা হল না কেন?” ক্ষিতীশ রাগে ফেটে পড়তে গিয়েও সামলে নিল।
“বলার কথাটা মনে ছিল না।”
বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসার মতো ক্ষিতীশ ক্লাব থেকে বেরিয়েই দেখল স্টার্টিং প্লাটফর্মে হরিচরণ দাঁড়িয়ে। কথা বলছে দুটি ছেলের সঙ্গে।
“হরিচরণ,” ক্ষিতীশ চীৎকার করে উঠল, “চিফ ট্রেনার হতে চেয়েছিলিস, হয়েছিস। এরপরও এসব কি হচ্ছে?”
হরিচরণ বিরক্তিভরে ফিরে তাকিয়ে বলল “কি আবার হচ্ছে?”
“আমার মেয়েটাকে ভতি করলি না কেন?”
“প্রফুল্লর কাছে যাও।”
“ওসব ছে’দো ওজর অনেক শোনা আছে। তবে এই বলে রাখলম, দেখবি ওই মেয়ে তোদের মুখে চুনকালি দেবে। সেদিন আফসোস করবি।”
“ওই মেয়ে, যাকে কাল এনেছিলে! ভালো, ভালো, তাই দিক। একটা মেয়ে সুইমার বেঙ্গল পাচ্ছে তাহলে!”
“বেল নয়, ইন্ডিয়া পাবে। রেলিংয়ে ধরা মঠোটা শক্ত করে নিজেকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ক্ষিতীশ ভাগা গলায় চেঁচিয়ে যেতে লাগল, “ওলিম্পিকের গুল মেরে সুইমার তৈরী করা যায় না রে, ধরা একদিন পড়বিই।”
প্রফুল্ল ক্লাব থেকে বেরিয়ে এল।
“কি আবোলতাবোল চীৎকার করছ ক্ষিদ্দা।”
‘বেশ করছি। কর্পোরেশনের জমিতে আমি দাঁড়িয়ে। তোদের ইতরোমোটা শুধু দেখছি। মেয়েটাকে তোরা ভর্তি করলি না, ভেবেছিস আর বুঝি ক্লাব নেই। পৃথিবীতে শুধু জুপিটারই একমাত্র ক্লাব।”
‘তা হলে যাও না অন্য ক্লাবে।” হরিচরণ চেঁচিয়ে উঠল। “ওই তো পাশেই একটা ক্লাব রয়েছে।”
“তাই যাব, তাই যাব।”
ক্ষিতীশ হনহন করে এগিয়ে গেল অ্যাপোলোর দিকে। পিছনে জমে যাওয়া ভীড়টাকে উদ্দেশ্য করে প্রফুল্ল বলল, “পাগল মশাই, পাগল।”
অ্যাপোলোর গেটে পৌঁছে সংবিৎ ফিরল ক্ষিতীশের। দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের প্রতি অবাক হয়ে ভাবল, এখানে আমি এলাম কেন? এরা তো জুপিটারের শত্রু। আমি কি নেমকহারাম হলাম!
ক্ষিতীশকে দেখতে পেল অ্যাপোলোর অন্যতম ভাইস-প্রেসিডেন্ট নকুল মুখুজ্জে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের কাছে এসে বলল, “কি বাপার, ক্ষিতীশ যে! তুই এখানে?”
হঠাৎ ক্ষিতীশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “তোমাদের এখানে জায়গা হবে নকুলদা! জুপিটার আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে।”
“যাঃ কি আজেবাজে বকছিস। তোকে তাড়াবে কে?”
“সত্যি বলছি নকুলদা, তাড়িয়ে দিয়েছে। আমায় টাকা পয়সা দিতে হবে না। একটা মেয়ে পেয়েছি, তাকে শেখাবার সুযোগটুকু দিও তা হলেই হবে।”
“ভেতরে আয়, আগে সব শুনি।”
“তার আগে বলে রাখি, আমি কিন্তু জুপিটারের লোক, অ্যাপোলো কোনদিনই আমার ক্লাব হবে না।”
“তাহলে তোকে আমরা নোব কেন?”
“আমাকে নয়, মেয়েটাকে না। আমি ওকে শেখাব। ও যদি সম্মান আনে তাহলে সেটা হবে অ্যাপোলোর।”
“আচ্ছা আচ্ছা, ভেতরে চল।”
“আগে বলো, আমার শর্তে রাজী! অ্যাপোলোর তুমিই সব, তোমার কথায় ক্লাব ওঠে বসে। তুমি কথা দিলে তবেই ঢুকব।”
নকুল মুখুজ্জে কিছুক্ষণ স্থির চোখে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোর জুপিটার থেকে বেরিয়ে আসা মানে আমাদের শত্রুর দুর্গের একটা খিলেন ভেঙ্গে পড়া। অ্যাপোলোর ছাদের নীচে যদি তুই আসিস, সেটাই আমাদের ভিকট্রি হবে। আচ্ছা, কথা দিলাম।”
গেট অতিক্রম করার আগে ক্ষিতীশ একবার পিছন ফিরল। কমলদিঘির জলে ছায়া পড়েছে পশ্চিমের দেবদার, আর রাধাচূড়া গাছের। জুপিটারের বিরাট ঘড়িটার কালো ডায়ালে কাঁটা দুটো আবছা লাগল ক্ষিতীশের পুরু লেন্সে। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড একটা মোচড় সে অনুভব করল। চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো।
সেই রাতে ঘুম এল না ক্ষিতীশের। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রাতটা কাটাল। বারবার একটা কথাই তার মনে পাক দিয়ে ফিরল : “আমি কি ঠিক কাজ করলুম? অ্যাপোলোয় যাওয়া কি উচিত হল?”
ভেলো উত্তেজিত হয়ে হাজির হল সকালেই।
“ক্ষিদ্দা, তুমি অ্যাপোলোয় জয়েন করেছ? বেশ করেছ। তোমাকে তো সেই কবে বলেছিলাম, এটা হল যুদ্ধ। ন্যায়-অন্যায় বলে যুদ্ধে কিছু নেই, শত্রু-মিত্র বাছ-বিচার করে কোন লাভ নেই।”
ক্ষিতীশ চুপ করে রইল।
“জুপিটারকে এবার শায়েস্তা করা দরকার। বুঝলে ক্ষিদ্দা, তুমি শুধু ওই নাড়ির সম্প-টল্পকগুলো একটু ভুলে যাও…”
‘“ভেলো!”
ক্ষিতীশের একটা হাত তোলা। চোয়াল শক্ত। পর, লেনস ভেঙ্গে চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে। ভেলো এক পা পিছিয়ে গেল।
“আর একটি কথা যদি বলেছিস তো—”
ভোলো বিড়বিড় করে বলল, “আমার ভুল হয়ে গেছে। আমায় মাপ করে ক্ষিদ্দা।”
.
০৭.
“না না না, কতবার বলব কনুইটা অতটা ভাঙ্গবে না–হাতটা অমন তার মতো লাফিয়ে উঠল কেন? উহুঁ উহুঁ…হল না, বাঁ হাতটা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাঁধটাও এগোচ্ছে আর ডান কাঁধটা পিছিয়ে যাচ্ছে, এতে স্কোয়ার শোল্ডার পোজিশানটা যে ভেঙ্গে যাচ্ছে…নে নে, আবার কর…ওকি! জলের বাইরে হাত নিয়ে যাবার সময় শরীরের পাশের দিকটা বেঁকে তেউড়ে শুয়োপোকা চলার মতো হয়ে যাচ্ছে যে …দ্যাখ আমাকে দ্যাখ। তোর কনুইটা কেন বাঁক খাচ্ছে না বোঝার চেষ্টা কর…এইভাবে, এই রকম। আর হাতের আঙুল জল টানবার সময় ফাঁক করবি না। জলের ওপর থাবড়ে থাবড়ে হাত ফেলিস দেখেছি, ওভাবে নয়। পরিষ্কারভাবে সোঁত করে ঢুকে যাবে। আগে আঙুল তারপর কঞ্জি থেকে পরো হাতটা। আর নিঃবস নেওয়াটা ভাল করে বুঝে নে। যদি ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে নিঃশ্বাস নিস, তাহলে বা হাতটার কঞ্জি যখন জলে ঢুকছে তখন মাথা ঘোরাবি। মাথা নিচু রাখার জন্য থুতনিটা বুকের দিকে টেনে রাখবি। মাথার লাইন এধার ওধার হবে না। ডান হাতটা যখন উঠবে তার তলা দিয়ে উঁকি দেবে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে। আর ডান হাত যেই জলে ঢুকছে সেই সঙ্গে তোর মুখও আবার জলে ডুবছে।…যা যা আবার কর। দু’হপ্তা হয়ে গেল এখনো একটা জিনিসও ঠিক মতো করতে পারলি না।”
জলের ধারে সিমেন্ট বাঁধানো সরু পাড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ সমানে বকবক করে চলেছে। কোনি পাড়ের ধারে খানিকটা সাঁতরায় আর থেমে থেমে ওর দিকে তাকায়। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে এই ব্যাপার চলেছে। এখন সাড়ে আটটা।
‘‘আর পাচ্ছি না ক্ষিদ্দা।”
“কেন! বলেছিলি দু’দিনেই সুহাসের মতো স্ট্রোক শিখে নিবি। দু’দিন ছেড়ে তো সতেরো দিন হয়ে গেল।”
জলের মধ্যে দাঁড় সাঁতার কাটতে কাটতে কোটি চাপা রাগ নিয়ে বলল, “করছি তো আমি। আপনি খালি হচ্ছে না হচ্ছে না বলেই যাচ্ছেন।”
“না হলে কি বলব, হচ্ছে?”
“হচ্ছেই তো।”
“কিচ্ছু হয়নি। যা বলছি আবার কর।”
“আমার ভাল লাগছে না।”
কোনি পাড়ের দিকে এগিয়ে এল। ক্ষিতীশ কি করবে ভেবে না পেয়ে বলল, “স্ট্রোক শিখলে কিন্তু নাইলন কস্ট্যুম দেব।”
“দরকার নেই আমার।”
বাঁধানো পাড়ে দু’হাতের ভরে কোনি জল থেকে উঠে এল। ক্ষিতীশ বুঝতে পেরেছে ওকে খাটাতে হলে জোরজবরদস্তিতে কাজ হবে না। কিছু একটা প্রাপ্তিযোগ না থাকলে ওকে উৎসাহিত করা যাবে না।
“উঠে পড়লি যে, ক্ষিদে পেয়েছে?”
কোনি কথা বলল না। এগিয়ে গেল রেলিংয়ের গেট লক্ষ করে।
“ক্ষিদে তো পাবেই। ভাবছি দুটো ডিম, দুটো কলা আর দুটো টোস্টের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়।”
কোনি দাঁড়িয়ে পড়েছে। ক্ষিতীশ মনে মনে হিসেব করে দেখল, প্রায় এক টাকার ধাক্কা।
“আজ থেকে?”
ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল। কোনি কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, “আমি কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাব।”
ক্ষিতীশ একটু কৌতূহলী হয়েই বলল, “বাড়িতে কেন!”
“এমনিই। বাইরে আমি খাব না।”
“তাহলে আরো একঘন্টা জলে থাকতে হবে।”
ক্ষিতীশ কথাটা বলেই মনে মনে ব্যথিত হল। লোভ দেখিয়ে ক্ষুধায় অবসন্ন কোনিকে আরো পরিশ্রম করানো অমানুষিক কাজ হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, সাধ্যের বাইরে গিয়ে পরিশ্রম করে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবেই, নয়তো কিছুতেই সাধ্যটাকে বাড়ানো যাবে না। খাটুক, আরো খাটুক। যন্ত্রণায় ঝিমঝিম করবে শরীর, টলবে, লুটিয়ে পড়তে চাইবে যন্ত্রণার পাঁচিলের সামনে। আর তখন জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ দিতে হবে ওই পাঁচিলটাকে। এজন্য চরিত্র চাই, গোঁয়ার রোখ চাই।
…”নাম, নাম দাঁড়িয়ে আছিস কেন! দুটো ডিম, দুটো কলা, দুটো মাখন টোস্ট।”
যন্ত্রণা কি জিনিস সেটা শেখ। যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় না হলে, তাকে ব্যবহার করতে না শিখলে, লড়াই করে তাকে হারাতে না পারলে কোনদিনই তুই উঠতে পারবি না।
…”ঠিক আছে, ঠিক আছে, কনুই অতটা উঠবে না। মুখ ডুবিয়ে।”
যন্ত্রণা আর সময় তোর অপোনেন্ট। ও দুটোকে আলাদা করা য়ায় না। যন্ত্রণাকে হারালে সময়কেও হারাতে পারবি। সময়কে হারালে পারবি যন্ত্রণাকে হারাতে।
রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ মনে মনে কোনির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠছে। কমলদিঘিতে এখন সাঁতার কাটছে একমাত্র কোনি। মাঝখানের চওড়া ঘাটে তিনচারজন বাইরের লোক স্নান করছে। বাসন ধুচ্ছে একটি স্ত্রীলোক। জুপিটার এবং অ্যাপোলোর নম্বর খেলা স্টাটিং প্ল্যাটফর্মগুলো পাশাপাশি প্রায় পঞ্চাশ মিটারের ব্যবধানে। সেগুলো এখন জনশূন্য। শুধু জুপিটারের স্প্রীং বোর্ড থেকে ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছে গোটাচারেক উটকো বাচ্চা ছেলে। জুপিটারের ক্লাবের বারান্দায় বেঞ্চে বসে দুটি লোক তেলে ভাজা খেতে খেতে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে।
অ্যাপোলো ক্লাবের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অমিয়া আর বেলা। কোনির সাঁতার দেখতে তারা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াল। অমিয়া দিন সাতেক পর আজ জলে নেমেছিল। কলেজের পরীক্ষার জন্য সে ব্যস্ত। অমিয়া না থাকলে বেলা নাকি ট্রেনিংয়ে জুত পায় না। দু’জান আজ আধ মাইল করে সাঁতরেছে।
“কে রে মেয়েটা?” অমিয়া জিজ্ঞাসা করল।
“ক্ষিদ্দার আবিষ্কার।” বেলা চোখ পাকিয়ে বলল, “শুনিসনি, হরিচরণদা কি বলছিল সেদিন? ক্ষিদ্দা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে জুপিটারকে ডাউন দেবে ওই মেয়েটাকে দিয়ে।”
“সে কিরে, ও তো এখনো হাতের টান দিতেই শেখেনি। সামনের বছরই আমি কিন্তু জুপিটারে ফিরে যাব। যেখানে ক্ষিদ্দা আছে সেখানে আমি নেই। পাঁচ জনের সামনে ট্যাঁকোস ট্যাঁকোস করে কথা শোনাবে, ও আমার সহ্য হয় না।“
“আমিও তাহলে যাব।”
দু জনে আর একবার কোনির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তখন অমিয়া হেসে বলল, “কম্পিটিশনে পড়লে মেয়েটা তো আমার পা ধোয়া জল খাবে।”
.
প্রায় পৌনে দশটা। বাজার নিয়ে ফিরতে আজ দেরি হবেই। ক্ষিতীশ ব্যস্ত হয়ে হাঁটছে, পিছনে কোনি। একটা অস্টিন ফুটপাথ ঘেষে ক্ষিতীশের পাশে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে বেরিয়ে এল বিষ্টু ধরের মুখ।
“ও ক্ষিতীশবাব, আপনাকেই খুঁজছি যে। যে ইস্পিচটা লিখে দিলেন সেটা কেমন যেন ঠিক বাগে আনতে পাচ্ছি না, একটু ডিসকাসন করলে ভাল হতো। আজকেই তো বিকেলে সভা।”
“কিন্তু আমার যে এখুনি বাজার করে বাড়ি পৌঁছতে হবে।’
“গাড়িতে উঠুন। বাজার সেরে গাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে ডিসকাসটা করে ফেলব।”
বিষ্টু ধর মোটরের দরজা খুলে দিল। ব্যস্ত হয়ে ক্ষিতীশ গাড়িতে উঠছে, তখন জামায় টান পড়ল।
“খাবারের কি হবে?”
“ওহ তোর ডিম-কলা।” ক্ষিতীশ বিব্রত হয়ে, কি বলবে ভেবে পেল না।
“আমাকে বরং পয়সাটা দিয়ে দিন, কিনে নোব।”
কথা না বলে ক্ষিতীশ পকেট থেকে একটা টাকা বার করে কোনির হাতে দিয়ে বলল, “বিকেলে ঠিক সময়ে আসিস।”
গাড়ি চলতে শুরু করলে বিষ্টু ধর জিজ্ঞাসা করল, “কে মেয়েটা?”
“আমার ভবিষ্যৎ।” ক্ষিতীশ হেসে বলল।
.
লীলাবতী যথারীতি তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ না করে বিষ্টু ধরকে নিয়ে বারান্দায় বসল। বিশু আর খুশি এগিয়ে এল ক্ষিতীশকে দেখে। বিষ্টু কুঁকড়ে গিয়ে বলল, “ও দুটোকে সরান। দেখলে গা সিরসির করে।”
বিড়াল দুটিকে ক্ষিতীশ ছোট্ট ধমক দিতেই ওরা বারান্দা থেকে নেমে গেল। “দারণ ট্রেনিং তো।”
“ওদের ভালবাসি তাই কথা শোনে। ভালবাসলে সবকিছু করিয়ে নেওয়া যায়, মানুষকে দিয়েও।”
“তার মানে মানুষ আর জানোয়ারকে একই লাইনে ফেলছেন।”
“তা কেন। জানোয়ার দেখলে মানুষের গা সিরসির করে, কিন্তু মানুষ দেখলে জানোয়ারের করে কিনা আমি জানি না।”
“অই অই, অমনি ত্যারাব্যাকা কথা শুরু হয়ে গেল।” বলতে বলতে বিষ্টু ধর পকেট থেকে বক্তৃতা লেখা কাগজটা বার করল। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি জায়গাগুলো। রাস্তায় রবারের বল ফাইনাল, চিফ গেস্ট বিনোদ ভড়। বুঝলেন না, ওর দলের ছেলেরা থাকবে। ফস করে যদি কিছু প্রশ্ন করে বসে আর যদি জবাব দিতে না পারি তাহলে আওয়াজ খাবো, বেইজ্জত হবে।”
ক্ষিতীশ কাগজটা মন দিয়ে পড়ে বলল, “হুঁ, কি জানতে চান?”
“ওই যে লিখেছেন, ‘ট্যালেন্ট ঈশ্বরের দান। সেটা ফুটিয়ে তোলা যায় কিন্তু তার বদলি হিসাবে কোনকিছুই সে জায়গায় বসানো যায় না। যার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে, সেটা যদি সে ব্যবহার না করে তাহলে তাকে অপরাধী হিসবে গণ্য করতে হবে।’ কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে বহু ট্যালেন্টওলা লোক আছে, যারা শুধু খাওয়া-পরার ধান্দাতেই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব আগে মানুষের দরকার বেঁচে থাকা, এটা তো মানেন?”
ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল।
“রাশিয়া-টাশিয়ায় বড় বড় খেলোয়াড়দের খাওয়া-পরার চিন্তা করতে হয় না। গভরমেন তাদের গুরত্ব স্বীকার করে, স্টেটই তাদের সব কিছু দেয়। সেই রকম আমাদের দেশেও গভরমেনকে দেখা উচিত যাতে প্লেয়াররা খাওয়া-পরার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এসব কথা একটু বলা দরকার, বুঝলেন না, পাবলিক এখন লেফটিস্ট ধরনের তো।”
কিন্তু ভারত বা বাংলা তো কম্যুনিস্ট দেশ নয়, এখানে গণতন্ত্র। এখানে প্লেয়ারকে সব কিছুরই জন্য লড়তে হবে। গণতন্ত্রে এই স্বাধীনতাটা আছে– লড়াইয়ের স্বাধীনতা।”
“আপনি কি সব কিছুরই, মানে খাওয়া-পরার জন্যও জানোয়ারের মতো কামড়া কামড়ি করে বাঁচতে চান?”
“মানুষ হিসেবে নিশ্চয় চাই না কিন্তু সুইমিং কোচ হিসেবে, হ্যাঁ চাই। আরামে সব জিনিস পাওয়া যায় না, বুঝলেন, আপনার পাবলিককে বলবেন যে, একটা সুইমারকে খেটে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উঠতে হয়। পড়ুন পড়ুন, লেখাটা পড়ুন তো।”
ক্ষিতীশ উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় পায়চারি শুরু করল। বিষ্টু ধর ভীরুচোখে ক্ষিতীশের দিকে এবং বিশু-খুশির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পড়তে লাগল– “বিরাট বিরাট খেলোয়াড়ের গৌরবের ছটায় আলোকিত হয় তার দেশ। যদি প্রশ্ন করি, অসট্রেলিয়ার কথা উঠলে সব আগে কাদের নাম আপনার মনে ভেসে উঠবে? নিশ্চয় ডন ব্র্যাডম্যান, ডন ফ্রেজার, কেন রোজওয়ালের নাম। যদি বলি ব্রাজিলের প্রধান মন্ত্রীর নাম কি? পারবেন কেউ বলতে? কিন্তু পেলের নাম আপনারা সবাই শুনেছেন! ইথিওপিয়! ছোট্ট দেশ, গরীব দেশ, অখ্যাত দেশ। কিন্তু বিকিলা যখন দৌড়ল, দেশটা বিখ্যাত হয়ে গেল।”
বিষ্টু ধর দম নেবার জন্য থামল। ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে পড়ে একমনে শুনছিল। বলল, “কিন্তু শুধু মেডেল ধোয়া জল খেয়ে আপনার কি আমার চলবে না। মেডেল তুচ্ছ ব্যাপার কিন্তু একটা দেশ বা জাতির কাছে মেডেলের দাম অনেক, হিরোর দাম অনেক। দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে একজন হিরো, সে সাঁতারুই হোক আর সেনপতিই হোক, আদর্শ স্থাপন করে। তবু, ওদের মধ্যে তফাত আছে, বড় সাঁতার জীবনের ও প্রাণের প্রতীক, সেনাপতি মৃত্যুর ও সের। সাঁতার অনেক বড় সেনাপতির থেকে। যুদ্ধজয়ী সেনাপতি সমীহ পায়, আবার ঘৃণাও পায়। কিন্তু বিরাট সাঁতারু, সারা পৃথিবীকে প্রেরণা দেয়।”
“আপনি খালি সাঁতারু সাঁতারু বলছেন কেন, ফুটবলার ক্রিকেটার এদের নাম করুন। বাঙালিরা যা ভালবাসে মিটিংয়ে তাই তো বলব।”
“যা খুশি বলন, কিছু যায় আসে না। শুধু বলবেন, যারা আমাদের জন্য প্রাণ নিয়ে আসে, আমরা তাদের অবহেলা করি। ভুলে যাই তাদের খাদ্য দরকার, মাথার উপর ছাদ দরকার, খড়ের চালা যদি হয় তাও। আমরাই বাধ্য করি তাদের উঞ্ছবৃত্তি করতে। আমরাই তাদের শেখাই চালাকি করতে, মিথ্যে বলতে।…এইসব বলার পর আপনার লাইনের কথাবার্তায় চলে আসবেন। খুব কড়া কড়া কথায় গভরমেন্টকে এক হাত নেবেন।”
“তাহলে একটু গুছিয়ে লিখে দিন। আমার যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে।”
ক্ষিতীশ ভ্রূকুটি করে তাকাল। বিষ্টু ধর তাড়াতাড়ি বলল, “এজন্য নিশ্চয়ই ফি দোব।”
“ফি চাই না, একটা চাকরি চাই। যে কোনো চাকরি, অন্তত শদেড়েক টাকার।”
“চাকরি!” বিষ্টু ধর অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “কোথায় পাব?”
“আপনার তো ব্যবসা আছে। আমার এখন নিয়মিত টাকার দরকার। এইভাবে, বক্তৃতা তো সারা জীবন লেখা যাবে না।”
“আচ্ছা আমি দেখব’খন।”
আধঘন্টার মধ্যেই ক্ষিতীশ লিখে দিল। বিষ্টু ধর চলে যাবার পর রান্না চাপিয়ে দিল। উঠোনের দেয়ালে গাঁথা বড় হুকে রবারের দুটো দড়ির প্রান্ত আংটায় বেঁধে আটকাবার কাজে লেগে পড়ল। রবার দুটোর অপর প্রান্তে দুটো হাতল। এই রবার পুলি টেনে ব্যায়াম করবে কোনি। কাজটা শেষ করে সে ছোট পাশ-বালিশের মতো চটের থোলে সের দশেক বালি দিয়ে ভরতে শুরু করল। ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের সময় এই ওজন ঘাড়ে নিয়ে কোনিকে ব্যায়াম করতে হবে।
লীলাবতী বাড়িতে ঢুকে ক্ষিতীশের কাজ দেখে অবাক হয়ে বলল, “এগুলো আবার যে বার করলে, ব্যাপার কি?”
“কোনির জন্য।”
“কে কোনি!”
“একটা মেয়ে। ওকে তৈরী করব, মেয়েটার মধ্যে জিনিস আছে। একেবারে আকাঁড়া মাটি, গড়তে পারলে দারুণ সুইমার হবে। তোমাকে এনে দেখাব। ভীষণ গরীব।”
লীলাবতী ঘরে ঢুকে গেল। ক্ষিতীশ ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “ভীষণ গরীব, খেতে পায় না। ভাবছি এখানেই ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করব।”
ঘরের মধ্যে থেকে লীলাবতীর শুকনো কঠিনস্বর ভেসে এল, “ঘরটা নেওয়াই ঠিক করলুম। ওরা রাজী হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা সেলামিতে, এখন টেনেটুনে চলতে হবে, বাজে খরচ একদম বন্ধ।”
ক্ষিতীশ আর কথা বাড়াল না। বিকেলে অ্যাপোলোয় গিয়ে দেখল কোনি আসেনি। পরদিন সকালে কোনি এল আধঘন্টা দেরীতে। ক্ষিতীশ রেগে তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কোনি বলল, “খাবারের বদলে বরং আমাকে রোজ একটা করে টাকা দেবেন।”
ক্ষিতীশের রাগটা মুহূর্তে অবাক হয়ে গেল।
“তার মানে? রোজ একটা করে টাকা দিতে হবে আমাকে তুই সাঁতার শিখবি বলে? এটা কি আমার পিতৃদায়?”
“অতো খাটাবেন আর খেতে দেবেন না?”
কোনির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ক্ষিতীশ হেসে ফেলল, কোনিও হাসল। দুজনের মধ্যে নিঃশব্দে যেন একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল।
“তুই একটা আস্ত শয়তান। আমাকে চিনে ফেলেছিস দেখছি। দাঁড়া, তোকে আগে সাঁতারের মজাটা পাইয়ে দি, তারপর দেখব জলে নামিস কি নামিস না। এখন আমি তোকে খাটাচ্ছি, তখন তুই খাটার জন্য পাগল হয়ে উঠবি।”
কোনি কথাগুলো শুনল মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে। ক্ষিতীশ সেটা লক্ষ করে আবার বলল, “লেকে একমাইল সাঁতারে যে মেয়েটার কাছে হেরেছিস, তার নাম হিয়া মিত্র। নামটা মনে রাখিস।”
কোনির চোখ দুটো সরু হয়ে এল। মুখ ঘুরিয়ে সে কস্ট্যুমের কাঁধের পটি ঠিক করতে লাগল।
“মনে রাখিস, অমিয়া বলেছে তোকে পা ধোয়া জল খাওয়াবে।”
কোনি ঘুরে দাঁড়াল। শীর্ণ দেহটা ঝাঁকিয়ে রুক্ষস্বরে বলল, “কস্ট্যুম সাত দিনে আমি আদায় করব। কিন্তু লাল রঙের আমি পরব না, আমার রঙ কালো!”
অমিয়া আর বেলা পঞ্চাশ মিটার কোর্সে কিকিং বোর্ড নিয়ে প্র্যাকটিস করছে। কোনি পাড়ের কাছাকাছি। ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। দু’চোখে শুধু অনুমোদন আর কণ্ঠে বিড়বিড়: ‘হারামজাদী কোথাকার আমাকে নিয়ে এতদিন রসিকতা হচ্ছিল! দাঁড়া, তোর ওষধ আমি পেয়েছি–হিয়া মিত্তির।’
“ক্ষিতীশ, চলছে কেমন?”
নকুল মুখুজ্জে রেলিংয়ে দু’হাত রেখে শুকনো গলায় বলল, “তুই কি কিছুই খবর রাখিস না! বি এ এস এ-র সিলেকশন কমিটি থেকে আমাকে আউট করে দিয়েছে। এ সবই জুপিটারের ধীরেনের কারসাজি। এদিকে অ্যাপোলোর আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। দু-একটা টাকাওলা লোক যোগাড় করে দিতে পারিস, প্রেসিডেন্ট করে রাখব।”
ক্ষিতীশের হঠাৎ মনে পড়ল বিষ্টু ধরকে। বলল, “চেষ্টা করব। কিন্তু নকুলদা, বি এ এস এ থেকে আউট হয়েছ বলে দুঃখ পাচ্ছ কেন! একটা ক্লাব ঢের বেশি গুরত্বপ স্টেট অ্যাসোসিয়েশনের থেকে। ক্লাবই সুইমার তৈরী করে, ওবা করে মোড়লি।”
“কিন্তু মোড়লদের দলাদলি ঝগড়া প্রতিপত্তির লোভ সুইমারের জীবন শেষ করে দিতে পারে।” নকুল মুখুজ্জে হেসে উঠে বলল, “জেনে রাখ এবার অ্যাপোলোর কেউ বেঙ্গল টিমে আসছে না, শুধু ওই দুটো মেয়ে ছাড়া।” আঙুল দিয়ে সে অমিয়া আর বেলাকে দেখাল। “ওরা, জেনে রাখ, সামনের বছরই জুপিটারে ফিরে যাচ্ছে।”
নকল মুখুজ্জে চলে যাবার পর ক্ষিতীশ আবার কোনির দিকে মন দিল।
“হাঁটু ভেঙ্গে পায়ের পাড়ি…হাঁট, ভেঙে। বলে দিয়েছি না, পা যখন পিছনে ঠেলবি তখন হাঁটু ভাঙ্গবে, ওঠার সময় সোজা থাকবে।”
এই পর্যন্ত চীৎকার করে বলেই তার মনে হল, অমিয়া বা বেলা শুনে নিয়ে যদি এইভাবে কিকিং শুরু করে। তারপরই ভাবল, এখন আর ওদের পক্ষে আদ্যিকালের সিজার-কিক ছেড়ে এই শক্ত কিকিংয়ে আসা সম্ভব নয়। তা হলেও, শুনে নিয়ে ওরা হরিচরণকে বলে দিতে পারে। হরিটা অন্যদের এই ভাবে শেখাবে হয়তো।
হাত নেড়ে ক্ষিতীশ ডাকল কোনিকে। পাড়ের কাছাকাছি আসতেই ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, “যা বলছিলুম হচ্ছে না কেন? গোড়ালিটা টানটান থাকবে… এই রকম পিছন দিকে টান করে ঠেলে রাখবি। আর কিক করার সময় যতটা না নিচের দিকে, তার থেকে পিছন দিকেই পায়ের ধাক্কা বেশি দিতে হবে। এইভাবে শোলার সাঁতার কেটে চারটে গোল্ড জিতেছে টোকিওয়া……আবার কর…… সিক্স বিট, এক চক্কর হাত পাড়ি আর সেই সঙ্গে ছ’টা করে পা মারবি,…..করে যা, করে যা।”
ট্রেনিং শেষে ফেরার পথে ক্ষিতীশ জিজ্ঞাসা করল, “তোর দাদার খবর কি রে, আসতে বলিস একদিন। দেখে যাক কেমন তুই শিখছিস।”
কোনি জবার দিল না। ক্ষিতীশ লক্ষ করল ওর মুখটা কেমন যেন করুণ আর গম্ভীর হয়ে উঠল।
“দাদার অসুখ হয়েছে। দু’দিন কাজে যায়নি।”
“তাহলে তো দেখতে যেতে হয়। আচ্ছা পরে একদিন দেখতে যাব। আর শোন, আজ বিকেলে তোর ওজনটা নোবো। এবার থেকে একসারসাইজ শুরু করতে হবে। খাওয়াও বাড়াতে হবে। ট্রেনিং চার্ট, ডায়াট চাট আমি তৈরী করেছি। ভিটামিন কি কি লাগবে সেটা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। হেমোগ্লোবিন লেভেল যদি পারি তত টেস্ট করাব।”
ক্ষিতীশ কথা বলতে বলতে বাজারের কাছে এসে দাঁড়াল। একটা টাকা কোনির হাতে দিয়ে বাজারের দিকে এগোচ্ছে, কোনি ডাকল—
“ক্ষিদ্দা, আর দুটো টাকা দেবেন? তাহলে দু’দিন আর আমায় দিতে হবে না।”
“টাকা? কিসের জন্য?” ভ্রূ কিঞ্চিত হল ক্ষিতীশের।
“চাল কিনব। দাদা তো কাজে যেতে পারছে না।”
কোনি চুপ করে গিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে রইল।
প্রশ্ন না করে ক্ষিতীশ আরো দুটি টাকা দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝেও গেল, প্রতিদিন ডিম-কলা খাওয়ার জন্য যে টাকা দিয়েছে সেটা কিসে ব্যয় হয়।
.
ঘন্টাখানেক পরই ক্ষিতীশ হাজির হল কোনিদের ঘরের দরজায়। তক্তপোশে ময়লা ছেড় কথার উপর কমল শয়ে। একদাষ্টে জানলার বাইরে তাকিয়ে। সব ছোট ভাইটে আর মা উননে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির সামনে বসে। ঘরে আর কেউ নেই। ক্ষিতীশ গলা খাঁকারি দিতে কমল তাকাল, অবাক হল এবং উঠে বসতে গিয়ে দুর্বলতার জন্য টুলে পড়ল।
“আসুন। একটু আগেই কোনি বলছিল আপনি একদিন আসবেন। কি আর দেখবেন আমায়!” কমল চট করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “দেখার আর কিছু নেই। আমি ফিনিশ হয়েই গেছি।”
ক্ষিতীশ তক্তপোশের ধার ঘেঁষে বসল।
“কি হয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা?”
মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে কমল মাথা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ। আপনি কিন্তু বেশিক্ষণ বসবেন না। ছোঁয়াচে রোগটা।”
“ওষধ খাচ্ছ?”
কমল প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “কোনির দ্বারা কিছু হবে কি? ও আমাকে রোজ বলে কি কি শিখল। খুব রোখা মেয়ে। যদি বলে করব, তাহলে করবেই। ওকে দিয়ে যদি করাতে পারেন, ওর একটা ভবিষ্যৎ যদি গড়ে দিতে পারেন—”
“হবে। প্রথম প্রথম একটু চঞ্চল ছটফটে থাকে, মন বসলে আমার মনে হয় ও কিছু, একটা পারবে।”
“একটা ভাইকে চায়ের দোকানের কাজে দিয়েছি, পনেরো টাকা মাইনে। কোনিকে একটা সুতোর কারখানায় লাগিয়ে দোব ভাবছি। কথাবার্তা বলেছি, ষাট টাকা দেবে। কিন্তু ওর সাঁতার তাহলে আর হবে না।”
কোনি ঘরে ঢুকল। ক্ষিতীশকে দেখে অবাকই হল। দাদার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সে কমলের মাথায় হাত রাখল।
“আমি চাই না কোনি সাঁতার বন্ধ করুক। আমার নিজের খুব ইচ্ছে হতো বড় সাঁতারু হব, অলিম্পিকে যাব। আমার দ্বারা কিছুই হল না, এখন যদি কোনি পারে। আপনি বলছেন, ওর হবে?”
ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল, “খদি খাটে, যদি ইচ্ছে থাকে।”
“কি রে, শুনলি তো।” কমল মুখ উঁচু করে তাকাল। “ইচ্ছে থাকলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। ইণ্ডিয়া রেকর্ড ভাঙ্গতে হবে তোকে। তারপর এশিয়ান, তারপর অলিম্পিক। পারবি না?”
কমলের স্বর অদ্ভুত করুণ একটা আবেদনের মতো শোনাল। কোনির মুখে ধীরে ধীরে অস্বস্তি, তারপর চাপা ভয় ফুটে উঠল। ঘরের মধ্যে তখন কেউ কথা বলছে না। হাঁড়িতে ভাত ফোঁটার শব্দটা শুধু সেই মুহূর্তে একমাত্র জীবন্ত ব্যাপার।
কমল আবার বলল, “পারবি না?”
কোনি আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল।
.
০৮.
ক্ষিতীশ সারা সকাল অ্যাপোলোয় অপেক্ষা করেছে, কোনি আজও আসেনি। গত দু’ সপ্তাহে একবেলাও সে কামাই করেনি। ক্ষিতীশ ভয়ে রয়েছে, এই বুঝি কস্ট্যুম দাবী করে বসে। এখনো সে সমানে বলে যাচ্ছে, “হয়নি হয়নি, ইণ্ডি খানেকের বেশি জল থেকে হাত উঠবে না।……অতটা পাশের দিকে হাত যাচ্ছে কেন-ওকি, দুটো হাত ঠিকমতো সমানে চলছে না কেন?”
বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিতীশ মাথা নাড়ে। আর ভাবে কস্ট্যুম আজই কিনতে হবে দেখছি। কখনো কখনো সে জলে নেমে সাঁতার কেটে স্ট্রোক দেখিয়ে দেয়। ওদের পাশ দিয়েই অন্যরা সাঁতার কেটে যায়, বেলা গড়িয়ে যায়, কমলদিঘির জুল জুন শুন্য হয়ে আসে। কোনি যখন বিরক্ত হয়ে ওঠে, ক্ষিতীশ বলে, “দাদার কাছে তো খুব ঘাড় নেড়েছিলিস! ভিকট্রি স্ট্যাণ্ডে ওঠা খুব সহজ ব্যাপার ভেবেছিস! রেকর্ড করাটা গঙ্গায় আম কুড়োনো নয়, বুঝলি?” ফেরার পথে গল্প করেছে পৃথিবীর বড় বড় সাঁতারুর, তাদের আন্তরিকতার, নিষ্ঠার পরিশ্রমের।
অপেক্ষা করে অবশেষে ক্ষিতীশ বেরিয়ে পড়ল অ্যাপোলো থেকে। বিষ্টু ধরের বাড়ি পৌঁছল মিনিট দশেকের মধ্যে। তাকে দেখেই বিষ্টু ব্যস্ত হয়ে বলল, “এই একটু আগে দর্জিপাড়া বয়েজ লাইব্রেরির লোকেরা এসেছিল ওদের আনয়াল সোশ্যালে চিফ গেস্ট করার জন্য। প্রেসিডেন্ট হবে কে জানেন? ঐ বিনোদ ভড়। আমি রাজী হয়ে গেছি। ওখানে দারুণ একটা ইস্পিচে ওকে ডাউন দিতে হবে। বুঝলেন, ক্ল্যাপ ওকে পেতে দেব না।”
বিষ্টু ধরের উত্তেজিত মুখ দেখে ক্ষিতীশ চটপট মতলব ভেঁজে নিয়ে বলল, “শুধু একটা বক্তৃতায় ডাউন দিয়ে কি লাভ হবে। লোকে কিছুদিন মনে রেখে তো ভুলে যাবে। তার থেকে এমন একটা কিছু দরকার, যাতে বিনোদ ভড় রেগুলার ডাউন খায়।”
“কি রকম?” বিষ্টু কৌতূহল দেখাল। “রেগুলার ডাউন কিভাবে সম্ভব!”
“ভাবতে হয়েছে, তিনদিন ধরে ভেবেছি।” ক্ষিতীশ নিজেকে গুরত্ব দেবার জন্য গলার স্বর ভারিক্কি করে তুলল। “ভেবে দেখলুম বিনোদ ভড় যে যে অর্গানাইজেশনে আছে, তার পাল্টাগুলোয় ঢুকতে হবে। ও যদি ড্রামা ক্লাবে থাকে, আপনাকেও ড্রামা ক্লাবে ঢুকতে হবে। ও যদি কোন হরিসভার পৃষ্ঠপোষক হয়, আপনাকেও একটি হরিসভায় ঘাঁটি করতে হবে। ও যদি কোন সুইমিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়……”
“আছে।” বিষ্টু ধর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “জুপিটারের প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড়।”
ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে বলল, “আপনাকে জুপিটারের রাইভল ক্লাবে ঢুকতে হবে।”
“সেটা তো অ্যাপোলো। কিন্তু ঢুকব কি করে? বিষ্টু ধর বিমর্ষ গলায় বলল। “পারেন একটা কিছু করে দিতে?
“চেষ্টা করতে হবে। আজও আমি নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে কথা বলেছি। সাত হাজারের কমে রাজী হচ্ছে না।”
“সাত হাজার! মানে?”
“মানে, প্রেসিডেন্ট হতে গেলে ডোনেশন তো দিতে হবে। অমনি অমনি কি আর হওয়া যায়। বিনোদ ভড়ও তলায় তলায় চেষ্টা করছে ওর দাদাকে অ্যাপোলোয় ঢোকাবার জন্য। পাঁচ হাজার পর্যন্ত অফার করেছে।”
“কিন্তু সাত হাজার! কমসম করা যায় না?”
“কতো কমাবেন? পাঁচ হাজার অফার তো পেয়েই গেছে। বিনোদ ভড় এম এল এ, মন্ত্রী হবারও চান্স খুব, ওকে তো সবাই হাতে রাখতে চাইবে। আপনি যদি বেশি টাকা না দেন তাহলে ওদের লাভটা কি হবে বলুন?”
“তা তো বটেই।” বিষ্টু ধর চিন্তিত হয়ে পেটে হাত বুলাতে লাগল।
ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ করে আবার বলল, “দেরী করলে চলবে না। দু-একদিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে। বিনোদের পার্টি উঠে-পড়ে লেগেছে।”
“বেশ, সাত হাজারই দোব। কিন্তু……”
বিষ্টু ধরের কথা শেষ হবার আগেই চাকর ঘরে ঢুকে জানাল, একজন ‘মাইজি’ দেখা করতে এসেছে।
এরপর ক্ষিতীশকে অবাক করে ঘরে ঢুকল লীলাবতী। ক্ষিতীশকে এখানে দেখে সেও অবাক। তবে কোন কথা বলল না।
“টাকাটা এনেছি।” লীলাবতী তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যে বিষ্টু ধরকে বলল।
ব্যস্ত হয়ে বিষ্টু বলল, “পাশের ঘরে আসুন, আপনার রসিদ-টসিদ সব রেডি করা আছে।”
ওরা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরই বিষ্টু একা ঘরে ফিরে এল। ক্ষিতীশ তখন কৌতূহলে ফেটে পড়ার মতো অবস্থায়।
“কি ব্যাপার, কিসের টাকা?”
“ওই একটা ঘর ভাড়া নেওয়ার ব্যাপার। হাতিবাগানে আমার একটা বাড়িতে, এরা দোকান করবে, টেলারিং শপ। তাই কিছু টাকা দিয়ে গেল।”
“পাঁচ হাজার টাকা!”
বিষ্টু ধর চমকে উঠল। “কি করে জানলেন!”
“টাকাটা যার কাছ থেকে নিলেন সে আমার স্ত্রী। ওর কাছ থেকে সেলামি নেওয়া মানে আমার কাছ থেকেই নেওয়া।”
বিষ্টু ধর ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল ক্ষিতীশের গম্ভীর মুখ দেখে। তোতলা বারে বলল, “আমি তো তা জানতাম না।”
“আমিও জানতাম না আপনিই বাডিওলা। যাই হোক, এবার আমরা দুজনেই জানলাম। জানার পর আপনি কি টাকাটা এখন নেবেন?”
বিষ্টু আরো তোতলা হয়ে গেল। “ইয়ে, এটা তো ব্যবসার ব্যাপার…আমাকে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে।”
ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল। “চলি। বিনোদ ভড় কোর্টে বেরিয়ে গেছে। তা রাত্তিরেই দেখা করব ওর সঙ্গে।”
“না না, প্লিজ যাবেন না।
“হাজার দুয়েক টাকা ডোনেশন আর একটা নাইলনের কি বেলনের কস্ট্যুম কেনার জন্য একশো টাকা যদি দিতে পারেন তা হলে গারান্টি দিচ্ছি অ্যাপোলোর প্রেসিডেন্ট করে দেবই। তবে এই সেলামির টাকাটা ফেরত দিতে হবে। তাছাড়া বক্তৃতাও আমি আর লিখে দিতে পারব না।”
“বিষ্টু ধর চূর্ণ বিচূর্ণ। কথা বলার আর ক্ষমতা নেই। দুটি চোখ ছলছলিয়ে উঠেছে। শুধু মাথাটি নেড়ে বলল, “গাছে অনেক দূর উঠে গেছি। মই কেড়ে নিলে নামতে পারব না।”
বিষ্টু ধর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং একশো টাকার নোটের বান্ডিল নিয়ে ফিরে, সেটা ক্ষিতীশের হাতে দিয়ে বলল, “উনি আপনার স্ত্রী হন তো?”
‘‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি!”
বিষ্টু জিভ কেটে কান মলল। ক্ষিতীশ আর অপেক্ষা করল না। বেরিয়ে আসছে, তখন শুনল বিষ্টু কর কণ্ঠে বলছে, “আমার বক্তৃতাটার কি হবে?”
“দোব দোব, লিখে দোব।”
বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশ নোটের বাণ্ডিলটা নিজের বাক্সে রেখে দিয়ে ভাবতে শুরু করল, এবার কি করবে! টাকাগুলো লীলাবতীকে ফেরত দিতেই হবে, কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু আদায় করে নিতে হবে। এবং তা করতে হবে কোনিরই জন্য।
লীলাবতী বাড়িতে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, “ওখানে তুমি কি করছিলে?”
“মাঝে মাঝে যাই বুদ্ধি পরামর্শ দিতে। তুমি কেন গেছলে?”
“ওর কাছ থেকেই তো ঘর নিয়েছি। সেলামির টাকাটা দিতে গেছলুম।”
ক্ষিতীশ হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, “আগে যদি আমায় বলতে তাহলে টাকাটা দিতে হতো না। আমি বারণ করলে বিষ্টু ধরের সাধ্যি নেই টাকা নেবার, তবে বললে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে।”
“দ্যাখো না একবার বলে, অনেকগুলো টাকা। দেবার সময় গা করকর করছিল।” লীলাবতী ব্যগ্র হয়ে বলল।
“কিন্তু কোনিকে যে ওর বাড়িতেই খাওয়ার ব্যবস্থা করব ভাবছিলাম। এরপর কি অতোগুলো টাকা ফেরত দেবার কথা বলা যায়। মেয়েটাকে যে খাটাব, তার জন্য কিছু তো করতে হবে। দাও গামছাটা, চান করে আসি।”
বিকেলে লীলাবতী অন্য মতি ধরে বলল, “পরের মেয়ের জন্য তো খুব মাথা-ব্যথা। আর আমি যে এত কষ্ট করে দোকানটা দাঁড় করালাম, তিল-তিল করে টাকা জমিয়ে ব্যবসাটা বড় করার চেষ্টা করছি, তাতে একটু সাহায্যও কি করবে না!”
ক্ষিতীশ বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার আগে শুধু বলে গেল, “আচ্ছা দেখছি।”
অ্যাপোলোয় সারা বিকেল অপেক্ষা করল ক্ষিতীশ, কোনি এল না। নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে দেখা হল।
“প্রেসিডেট পেয়েছি, কত টাকা ডোনেশন চাও নকুলদা?”
নকুল একটু হকচকিয়ে বলল, ‘কত টাকা মানে? এখন বটবাব, পাঁচশো দিচ্ছে, ও টিপে টিপে দেয়।”
“ঠিক আছে। আমি দু’হাজারী ধরেছি।”
ক্ষিতীশ তারিয়ে তারিয়ে নকুল মখজের অবস্থাটা লক্ষ করার পর বিষ্টু ধর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে বলল, “কিছু ভেব না তুমি, ঢাকা এসে যাবে। তবে আমার ওই মেয়েটার পরো ট্রেনিং ফেসিলিটি দিতে হবে কিন্তু।”
নকুল মুখুজ্জে একগাল হেসে মাথাটা হেলিয়ে বলল, “নিশ্চয়।”
অ্যাপোলো থেকে বেরিয়ে ক্ষিতীশ ভাবল, মেয়েটা কেন আজ এল না, একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। বড্ড ফাঁকিবাজ। কিছুর একটা লোভ না দেখালে খাটতেই চায় না। তবে একটা দুর্বলতা আছে, সেটা ওর অপমানবোধ। ক্ষিতীশের প্রায়ই মনে পড়ে, প্রাইজ না নিয়ে লেক থেকে কোনির চলে আসা আর ঘুরে দাঁড়িয়ে তার বিজয়ীর নামটি শোনার সেই ভঙ্গিটি। দাদার কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে থাকা মেয়েটি হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠেছিল।
বস্তির মধ্যে আলো নেই। ক্ষিতীশ একটু অসুবিধায় পড়ল ঘরটা খুঁজে বার করতে। অবশেষে একটা বাচ্চা ছেলে তাকে দেখিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে কুপি জ্বলছে। কোনির ছোট ভাই দুটো মেঝেয় ঘুমিয়ে। তক্তপোশে সম্ভবত ওর মা শুয়ে। ক্ষিতীশ ডাকল, “কোনি।”
ঘর থেকে নিঃশব্দে কোনি বেরিয়ে এল।
“ব্যাপার কি তোর! আজ যাসনি কেন? এভাবে কামাই দিলে, আর তাহলে যেতে হবে না। তোর দাদাকে আমি জানিয়ে দেব, হবে-টবে না কিছু তোর দ্বারা।” বিরক্তস্বরে ক্ষিতীশ বেশ জোরেই কথাগুলো বলল।
কোনি কথা না বলে একইভাবে দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ক্ষিতীশের পিছন থেকে খনখনে স্বরে কে বলে উঠল, “কেমন লোক গা তুমি, কাল রাতে মেয়েটার দাদা মরে গেল আর তুমি এখন তাকে ধমকাতে নেগেছ?”
ক্ষিতীশ প্রথমে বুঝতে পারেনি সে কি শুনল। পিছনে তাকিয়ে বলল, “কে মরে গেছে?
“জান না দেখছি। কাল বিকেল থেকে মুখে অক্ত উঠল, ভলকে ভলকে, রাত্তিরেই কাবার। কোনির দাদা গো!”
ক্ষিতীশ বার দুয়েক কেঁপে উঠল এবং শুনল কোনি খুব ক্লান্ত এবং শান্ত স্বরে বলছে, “ক্ষিদ্দা, এবার আমরা কি খাব?”
.
০৯.
রাগে চীৎকার করে উঠল ক্ষিতীশ, “পারতেই হবে, পারতেই হবে। কোন কথা শুনব না।”
পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঢিলটা তুলে সে কোনির দিকে ছুঁড়ে মারল। “পায়ে পড়ি ক্ষিদ্দা, আর আমি পারছি না।”
“মাথা ফাটিয়ে দেব তোর…মরে যা তুই, মরে যা, মরে যা।” ক্ষিতীশ ঢিল খুঁজে পেল না। এধার ওধার তাকিয়ে মালির ঘরের গায়ে দাঁড় করানো সরু বাঁশের লগাটাকে দেখতে পেল।
“ক্ষিদ্দা, আমি আর পারব না।”
ক্ষিতীশ রেলিং টপকে ছুটে গিয়ে লগাটা আনল। কোনি পাড়ের কাছে এগিয়ে এসেছে। ক্ষিতীশ দ’হাতে লগাটা তুলে জলে আঘাত করল। কোনির মুখের হাত তিনেক সামনে সেটা পড়ল। আবার সে লগাটা দ’হাতে উঁচু করে জলে আঘাত করল।
“মাথা ভেঙ্গে দেব। জল থেকে উঠবি তো মরে যাবি। এখনো দুশো মিটার বাকি।”
কোনি জল থেকে ওঠার জন্য পশ্চিমের স্টাটিং প্ল্যাটফর্মের পিছন দিকে এগোতেই ক্ষিতীশ লগা তুলে পাড় ধরে ছুটল। কোনি থমকে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের কিনার ধরে উঁকি দিতে লাগল। ক্ষিতীশ প্ল্যাটফমে উঠতে পারছে না, কেননা পাড় থেকে সেটা অন্তত বারো হাত দরে এবং মাঝে কোন সেতু নেই।
“ক্ষিদ্দা ক্ষিদ্দা, আমায় এবেলা ছেড়ে দাও। ওবেলা আমি পুষিয়ে দোব।” কোনি ফোঁপাচ্ছে।
“কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আমার রুটিন অনুযায়ী কাজ চাই। যতক্ষণ না কাজ পাচ্ছি আজ তোকে উঠতে দেব না।”
প্ল্যাটফর্ম ধরা দু’হাতের মধ্যে মুখটা গুঁজে কোনি কাঁদছে। ক্ষিতীশ পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। সকাল ন’টা বেজে গেছে। কমলদিঘির জালে আর কেউ নেই এখন। বেঞ্চগুলোয় অনেকেই বসে, কমলদিঘির ভিতরের পথ দিয়ে পথিকের আনাগোনা। তাদের অনেকে কৌতূহলে তাকাচ্ছে ক্ষিতীশের দিকে। কেউ কেউ দাঁড়িয়েও পড়ছে।
কোনি সাঁতরাচ্ছে। পশ্চিম থেকে পুবের প্ল্যাটফর্মের দিকে। ক্ষিতীশও লগা হাতে পাড় ধরে পুবদিকে হাঁটছে। বিশ্বাস নেই, হয়তো ওপারে পৌঁছেই কোনি জল থেকে উঠে পড়তে পারে।
ওর ক্লান্ত হাত দুটো যেন কেউ জল থেকে টেনে তুলে আবার নামিয়ে রাখছে। মুখ ফিরিয়ে হাঁ করে বাতাস গিলছে। তখন চোখ দুটো দেখাচ্ছে যেন ঘুমে অচ্ছন্ন। গলায় ঝোলান স্টপওয়াচটা মুঠোয় ধরে ক্ষিতীশ বিড়বিড় করে আপন মনে বকে যাচ্ছে : জানি রে জানি কষ্ট হচ্ছে, হাত-পা খুলে খুলে আসছে, কলজে ফেটে যাচ্ছে। যাক যাক, তুই যন্ত্রণা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যা। তুই জানিস ক্ষিদে যখন থাবা মারে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, তখন কেমন লাগে। তুই পারবি বুঝতে, যন্ত্রণা কি জিনিস। ফাইট কোনি ফাইট–
…মার খেয়ে ইস্পাত হয়ে উঠতে হবে। যন্ত্রণাকে বোঝ, ওটাকে কাজে লাগাতে শেখ, ওটাকে হারিয়ে দে।…কাম অন কোনি, জোর লাগা, আরো জোরে–
…ট্রেনিং করে করে নিজেকে বাড়াতে হবে কোনি। যন্ত্রণাকে তুই বল, ‘দেখে নেব আমাকে কাঁদাতে পারিস কিনা, আমাকে ভয় দেখাতে পারিস কিনা’, বলে যা কোনি, ‘ক্ষিদ্দা তোমাকে খুন করব। তুমি শয়তান, ছিঁড়ে খাবো তোমাকে। কমলদিঘিকে টগবগ করে ফুটিয়ে তোল তোর রাগে।
…মানুষের ক্ষমতার সীমা নেই রে, ওরা পাগলা বলছে, বলুক। মূর্খ, মূর্খের দল সব। ঘন্টাখানেক আরামে হাত-পা ছড়িয়ে ওরা চ্যামপিয়ন বানাবার স্বপ্ন দেখে…ট্রেনিং ট্রেনিং
–আরো পঞ্চাশ মিটার এখনো যেতে হবে, শরীরটাকে যন্ত্রণায় ঘষে ঘষে শানিয়ে তোল। দেখবি কি অবাক তোকে করে দেবে ওই শরীর, যা অসম্ভব ভাবছিস তাকে সম্ভব করে দেবে। সোনার মেডেল-ফেড়েল কিছু নয় রে, ওগুলো এক একটি চাকতি মাত্র। ওগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো ঢুকে আছে সেটাই আসল– মানুষ পারে, সব পারে।
কোনি সাঁতার শেষ করে দু’ হাতে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁপাচ্ছে মাথা নিচু করে। একবার সে মাথা ঘুরিয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। দু’চোখে ঘণা আর আক্রোশ। ক্ষিতীশ সেটা লক্ষ করল। লগাটা যথাস্থানে রেখে সে ক্লাবে ঢুকে একটা মোটা খাতা খুলে বসল। এটা কোনির লগ-বুক। প্রতি বেলার ট্রেনিং-এ কাজের ও সময়ের হিসাব ছাড়াও খাওয়ার, ওজনের, নাড়ির স্পন্দনের, রক্তের হেমোগ্লোবিন স্তর পরীক্ষার, আয়রন ও ভিটামিন ট্যাবলেটের তালিকাও এতে লেখা আছে।
লগ-বুকে লিখতে লিখতে ক্ষিতীশ দেখল কোনি ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ক্লাব থেকে। প্রতিদিন বেরোবার আগে একবার ‘যাচ্ছি’ বলে যায়। আজ বলল না। ক্লাব থেকে কোনি যায় ক্ষিতীশের বাড়ি। সেখানেই ওর খাওয়া। ঠিক দশটায় তাকে ‘প্রজাপতি’-র-রোলার-শাটারের তালা খুলতে হয়। দোকান ঝাঁট দিয়ে, কাউন্টার মছে, কুজোয় জল তুলে, তাকে ফাইফরমাশ খাটতে হয়। পরে আবার আসে ভাত খেতে। তখন ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে, পনেরো মিনিট ব্যায়াম করে অ্যাপোলোয় যেতে হয়। সাঁতার থেকে আবার প্রজাপতিতে। দোকান বন্ধ করে সে লীলাবতীর সঙ্গে ফেরে। রাত্রে খেয়ে ফিরে যায় বস্তিতে মা ও ভাইয়েদের কাছে। কোনি মাইনে পায় চল্লিশ টাকা।
আজ কোনির দেরী হয়ে গেছে। ক্ষিতীশের বাড়ি না গিয়ে, সে প্রায় ছুটতে ছুটতে প্রজাপতিতে এল। লীলাবতী নিজেই দোকান খুলেছে। পাশের ফোটগ্রাফি দোকানের ছেলেটি ভারী শাটারটা তুলে দিয়ে গেছে। লীলাবতী ওকে দেখেই রাস্তার দিকে আঙুল তুলে বলল, “বেরিয়ে যাও। তোমায় আর দরকার নেই।”
ফ্যাকাসে হয়ে গেল কোনির মুখ। মুখ নামিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকল। এই সময় খদ্দের আসায় লীলাবতী আর কিছু বলল না। কোনি একে একে তার কাজগুলো করে গেল। ক্লান্তিতে এবং খিদেয় তখন সে ঝাপসা দেখছে, পা টলছে।
তার খুব ঘুমোতে ইচ্ছে করছে কিন্তু দোকানে বসার মতো জায়গাও তার জন্য নেই। একবার সে ভয়ে ভয়ে লীলাবতীকে বলল, “বৌদি, একটু বাড়ি যাব?”
বিরাট একটা মোটা খাতার উপর ঝুঁকে ফ্রকের মাপ লিখতে লিখতে লীলাবতী কড়া বরে বলল, “না।”
কোনি সরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। কাজটা থেকে বরখাস্তু হলে চল্লিশটা টাকা থেকে তাদের সংসার বঞ্চিত হবে।
ওদিকে ক্ষিতীশ বড় একটা থলি হাতে অ্যাপোলো থেকে বেরিয়ে তখন একটার পর একটা দর্জির দোকান ঘুরছে কাপড়ের ছাঁট কেনার জন্য। তিনটে লণ্ড্রির সঙ্গে তার বন্দোবস্ত হয়েছে। মার্কা দেওয়া নম্বর টুকরো কাপড়ে লিখে জামা কাপড়ে বেধে কাঁচতে পাঠাবার জন্য লণ্ড্রিগুলোর দরকার হয় এই ছাঁট। ছাঁট থেকে সমান মাপে কাপড় টুকরো করে কেটে ক্ষিতীশকে বিক্রি করতে হয়। ওরা দৈনিক প্রায় তিন কিলো কেনে। ক্ষিতীশ টাকা ছয়-সাত লাভ করে।
দুপর প্রায় একটা নাগাদ ক্ষিতীশ ছাঁট ভর্তি থলি নিয়ে কোনিদের ঘরের দরজায় হাজির হল। কোনির মা বেরিয়ে আসতেই সে ঝাঁজিয়ে উঠল, “কাল রাতে কোনি কখন ঘুমিয়েছিল?”
“কেন, রোজ যেমন সময়ে ঘুমোয়।” জড়োসড়ো হয়ে কোনির মা বলল।
“ঠিক বলছ?” ক্ষিতীশ তীর দষ্টিতে তাকাল। “আজ এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ল কেন তাহলে? দ্যাখো মেয়ে, আমার কাছে কিছু লুকোলে কিন্তু ঠিক ধরা পড়ে যাবে। ঠিক করে বলল, কখন কোনি ঘুমিয়েছে।”
“না বাবা, আপনার কাছে মিছে বলব না। কাল রাতে কোন যাত্রা শুনতে গেছল। রাত একটা নাগাদ ফিরে শুয়েছে।”
“হুঁ।” থলিটা এগিয়ে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল, “এগুলো কেটে রেখো আজই, কাল সকালে কোনির হাত দিয়ে ক্লাবে পাঠিও।”
পাঁচটা টাকা কোনির মার হাতে দিয়ে, ফেরার আগে ক্ষিতীশ বিষণ্ণ স্বরে বলল, “ছোট মেয়ে, ওর তো সখ হবেই। কিন্তু ওর ভালর জনাই তোমাকে কড়া হতে হবে। যে কোন খেলা সাধনার জিনিষ। সিদ্ধিলাভ করতে হলে সন্ন্যাসীর মতোই জীবন যাপন করতে হয়। বহু ছোটখাট ব্যাপার আছে সাধনার পক্ষে যা ক্ষতিকর। যাত্রা নিশ্চয় দেখবে, কিন্তু এখন এই ট্রেনিংয়ের সময় বিশ্রাম নষ্ট করে নয়। এগুলো তোমায় বুঝতে হবে।”
বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশ দেখল লীলাবতী অপেক্ষা করছে। তখনি সে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে খুবই সাধারণভাবে জিজ্ঞাসা করল, “কোনি খেয়েছে?”
লীলাবতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ওকে দিয়ে, আমার কোন কাজ হবে না, ঝিমোয় শুধু। বসতে দিই না, দাঁড়িয়েই আজ ঘুমোচ্ছিল।”
“আজ ওকে খুব খাঁটিয়েছি।”
“তাতে আমার কি লাভ। পাঁচ হাজার টাকা বাঁচিয়ে দিয়ে অন্যদিক থেকে সেটা নিয়ে নিচ্ছ।”
“ওর খাওয়ার জন্য তো মাসে পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি।”
“রোজ দুধ ডিম মধ, মাসে পঞ্চাশ টাকায় কি হয়?”
ক্ষিতীশ তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে উঠে পড়ল। ঘরে এসে দেখে কোনি মেঝেয় অকাতরে ঘুমোচ্ছ। বালিশের বদলে দুটি হাত জড়ো করে মাথার নিচে রাখা।
ক্ষিতীশ ওর পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একটু পরেই কোনি নড়ে উঠে আরো গুটিসুটি হয়ে সরে এল ক্ষিতীশের দিকে। বিড়বিড় করে কি যেন বলল। ক্ষিতীশ ঝুঁকে পড়ল শোনার জন্য।
‘দাদা?”
“হ্যাঁ।”
একটা পাতলা হাসি কোনির মুখে চারিয়ে গেল। “আমায় কুমীর দেখাবে বলেছিলে।”
“দেখাব, চিড়িয়াখানায় তোকে নিয়ে যাব।” ফিসফিস করে ক্ষিতীশ বলল। “আরো অনেক জায়গায় আমরা যাব–বেলুড় মঠ, ব্যাণ্ডেল চার্চ, ডায়মণ্ড হারবার, জাদুঘর, অনেক অনেক জায়গায়। তারপর তুই যাবি দিল্লী, বোমবাই, মাদ্রাজ; তারপর যাবি আরো দূরে টোকিও, লণ্ডন, বার্লিন, মস্কো, নিউইয়র্ক।”
ঘুমের মধ্যেই কোনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“ক্ষিদ্দা আমাকে কষ্ট দেয় দাদা। আমি ঠিক মেডেল এনে দোব তোমায়।”
কোনি মুখে হাসি নিয়ে ঘুমের মধ্যে ডুবে গেল। ক্ষিতীশ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোকে আরো কষ্ট দেব রে, আরো দেব।”
.
রবিবার প্রজাপতি বন্ধ থাকে। সেদিন কোনির ট্রেনিংয়ে ছুটি। ক্ষিতীশের কাঁধে ঝুলছে থলি। তাতে আছে কাগজের মোড়কে রুটি, আলু, ছেঁচকি, গুড়, সিদ্ধডিম আর কলা।
ওরা দুজন বাড়ি থেকে দশটায় বেরিয়েছে। চিড়িয়াখানায় ঘণ্টা তিনেক ঘরে পুকুরধারে ঘাসে বসেছে। ক্ষিতীশ খাবারের মোড়ক দুটো বার করে বলল, “জল খাওয়াটাই মুশকিল হবে। ওয়াটার বটলটা আনলে হতো।”
ওদের থেকে কিছু দূরে, স্কুল ইউনিফর্ম পরা জনা তিরিশ মেয়ে হৈচৈ করে হাজির হল। সঙ্গে চারজন টিচার। দুজন দরোয়ান খাবারের ঝুঁড়ি বয়ে আনল। ওরা গোল হয়ে খেতে বসেছে। কোনি কৌতূহলভরে মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আর রুটি চিবোচ্ছে।
“ক্ষিদ্দা, ওদের কাছে জল আছে। চাইব?”
“কি করে বুঝলি?”
“ওই তো বড় ড্রামটা থেকে জল দিচ্ছে।”
“দ্যাখ তাহলে।”
কোনি এগিয়ে গেল ড্রামের কাছে দাঁড়ানো টিচারের দিকে। ক্ষিতীশ দেখল, কোনি তাকে কিছু বলতেই তিনি কোনিকে আপাদমস্তক দেখে মুখ ফিরিয়ে কি একটা জবাব দিলেন। তাইতে কোনি অপ্রতিভ হয়ে ফিরে এল।
“দিল না তো।” কোনির মুখটা থমথমে। শুধু বলল, “বড়লোকদের মেয়েদের স্কুল।”
“তাই দিল না বুঝি!” ক্ষিতীশ কৌতুকের সুরে বলল।
“বড়লোকরা গরীবদের ঘেন্না করে।”
ক্ষিতীশ এবার একটু অবাক হল। এইসব ধারণ্য এইটুকু কোনির মাথায় ঢুকল কি করে?
“তোকে কে বলল, বড়লোকরা গরীবদের ঘেন্না করে?”
“আমি জানি। দাদা আমায় বলেছিল, টাকা থাকলেই সবাই খাতির করে।”
“চল, জল খেয়ে আসি কল থেকে।”
ওরা দু-চার পা এগিয়েছে, তখনই একটি মেয়ে ‘শুনুন, শুনুন’ বলতে বলতে ছুটে এল। হাতে জলভরা প্লাস্টিকের দুটি প্লাস।
ওরা ঘুরে দাঁড়াল। এবং দুজনেই চিনতে পারল জলের প্লাস হাতে মেয়েটি হিয়া মিত্র।
“আপনারা জল চেয়েছিলেন না? আমাদের মিস নন্দী বড্ড কড়া মেজাজের। ওর ব্যবহারের জন্য মাপ চাইছি।”
হিয়া জলভরা একটা গলাস এগিয়ে ধরল কোনির সামনে। কোনি এখন অদ্ভুত আচরণ করে বসল। ধাঁ করে সে গ্লাসে আঘাত করল হাত দিয়ে। গ্লাসটা হিয়ার হাত থেকে ছিটকে ঘাসে পড়ল। হতভম্ব শুধু হিয়াই নয়, ক্ষিতীশও।
“চাই না তোমাদের জল। আমাদের কলের জলই ভাল।”
কোনি হন হন করে একাই এগিয়ে গেল। ক্ষিতীশ অপ্রতিভ হয়ে বলল, “আমি মাপ চাইছি এবার তোমার কাছে।”
হিয়া ব্যথিত মুখে বলল, “এই প্লাসের জলটা তাহলে আপনি খান।”
“নিশ্চয় নিশ্চয়।”
কোনিকে দারণ বকবে ভেবেছিল ক্ষিতীশ। কিন্তু সে কিছুই বলেনি। হিয়াই যে কোনির ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী এটা ক্ষিতীশ বুঝে গেছে। বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবে চারদিন সে গেছে নিছকই পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করার ভান করে। হিয়ার ট্রেনিং সে দেখেছে। শুধু তাই নয়, পকেটে হাত ঢুকিয়ে লুকিয়ে স্টপওয়াচে হিয়ার পুরো দমে সাঁতারের সময় নিয়েছে। ক্ষিতীশের মনে হয়েছে, হিয়ার প্রতি কোনির হিংস্র আক্রোশটা ভোঁতা করে দেওয়া ঠিক হবে না। এটা বুকের মধ্যে পুষে রাখুক। এটাই ওকে উত্তেজিত করে বোমার মতো ফাটিয়ে দেবে আসল সময়ে।
ক্ষিতীশ তাই বকুনি দেওয়ার বদলে বলেছিল, “হিয়া তখন আমাকে কি বলল জানিস? বলল, মেয়েটা আমার কাছে মার খেয়েছে তাই জ্বলে পুড়ে মরছে।”
এরপর ক্ষিতীশ লক্ষ করল, কোনি জল থেকে উঠতে দেরী করছে।
.
১০.
দুর্গা পুজোর আগেই ক্লাবগুলোর প্রতিযোগিতা একটার পর একটা হয়ে গেল। ক্ষিতীশ একটিতেও কোনিকে নামায়নি, এমনকি অ্যাপোলোর প্রতিযোগিতাতেও নয়। যদিও এখন তার সময় অমিয়ার সময়ের প্রায় সমান, তবু ক্ষিতীশের ধারণা এখনো তার প্রকাশের উপযুক্ত সময় আসেনি। হিয়ার সময় এখন কত, সেটা না জানা পর্যন্ত কোনিকে সে বার করতে চায় না। এখন অনেকেই জেনে গেছে ক্ষিতীশ একজন সাঁতারু তৈরী করছে। বালিগঞ্জ ক্লাবে সে গেলেই প্রণবেন্দর নির্দেশে হিয়া এমনভাবে সাঁতার কাটে কিংবা জল থেকে উঠে পড়ে, যার ফলে ক্ষিতীশ ওর সময় নিতে পারে না। হিয়াও কোন প্রতিযোগিতায় নামেনি। তাইতে ক্ষিতীশ কিছুটা ভাবনায় পড়ল। প্রত্যেক ক্লাবের, এমনকি স্টেট চ্যামপিয়নশিপের ভিকট্টি স্ট্যাণ্ডেও অমিয়া আর বেলাকে উঠতে দেখা গেল।
একদিন খবরের কাগজে একটা খবর দেখে ক্ষিতীশ কেটে রেখে দিল। বোমবাইয়ে মহারাষ্ট্র স্টেট চ্যামপিয়নশিপে রমা যোশি নামে একটি মেয়ে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে সময় করেছে এক মিনিট ১২ সেকেন্ড। এক-কুড়ির উপরে সময় করাই ভারতীয় মেয়েদের রেওয়াজ, সেখানে এক-বারো! ক্ষিতীশ এরপর কোনির ট্রেনিং আরো কঠিন করে তুলল।
এবার জাতীয় সাঁতার চ্যামপিয়নশিপ দিল্লীতে। পুজোর পর বাংলা দল রওনা হয়ে গেল। অমিয়া মেয়েদের দলের অধিনায়িকা। বাংলার মেয়েরা একটি সোনা, দুটি রপো, দুটি ব্রোঞ্জ নিয়ে ফিরল। সোনাটি অমিয়ার, ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে। রমা যোশি একাই ছয়টি সোনা জিতল চারটি ব্যক্তিগত রেকর্ড করে।
শীত এসে গেছে। কমলদিঘির জলও কমে গেছে। সোয়েটার পরা লোকেরা এখন সেখানে বেড়ায়। কেউ আর জলে নামে না। কিন্তু অব্যাহত কোনির দু’বেলা জলে নামা। আপত্তি করেছিল অনেকেই। ক্ষিতীশ জবাবে শুধু বলেছে, “যদি পারে তাহলে নামবে না কেন? সারা বছরই ট্রেনিংয়ে থাকা দরকার। প্র্যাকটিশ চাই, প্র্যাকটিশ। মুভমেন্টগুলো যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, স্বাভাবিক হয়ে আসে। তা না হলে স্পীড বাড়ান যাবে না। এদেশে মাত্র ছমাস সাঁতার হয়, তাই তো এই শোচনীয় দশা।”
কোনিকে বাকি তিনটি স্ট্রোকও ক্ষিতিশ ইতিমধ্যে শিখিয়ে দিয়েছে। ফ্রি স্টাইল, বাটার ফ্লাই, ব্যাক এবং ব্রেস্ট এই চার রকমের স্ট্রোক মিলিয়ে কোনি এখন দিনে দু’মাইল হাড়ভাঙ্গা সাঁতার কাটে। কঞ্চির মতো শরীরটার ওজন বেড়ে হয়েছে ৫০ কেজি।
বছর ঘরে নতুন বছর এল।
একদিন ভেলো, প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়ানো ক্ষিতীশকে বলল “ক্ষিদ্দা, এ বছর ওকে কম্পিটিশনে নামাবে তো?”
ক্ষিতীশ তখন কোনির দুটো পায়ের গোছ বাঁধছিল রবারের দড়ি দিয়ে। পা বাঁধা অবস্থায় শুধু মাত্র হাতের পাড়িতে ওকে ‘পুল’ করতে হবে। ক্ষিতীশ অন্যমনস্কের মতো বলল, “সিজন শুরু হয়ে গেছে?”
“সিজন কি তোমার জন্য বসে থাকবে নাকি। কর্পোরেশন তো অনেকদিন কমলদিঘিতে জল ছেড়েছে, হুঁশ নেই—”
ভেলো কথা থামিয়ে ফেলল। ক্ষিতীশ হাত তুলে রয়েছে। কোনি স্টার্টিং পজিশ্যনে।
“অন ইওর মার্ক……গেট সেট……” ক্ষিতীশ হাতটা নামাল। কোনি ঝাঁপাবার সঙ্গে সঙ্গে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে পিছন ফিরে বলল, “কি বলছিলিস?”
“হরিচরণরা ভয় পেয়ে গেছে।”
ভেলোর ধারেকাছে কেউ নেই, তবু সে এধার ওধার তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “অমিয়া ও বেলা জুপিটারে আবার চলে এসেছে তো, সে খবর রাখো কি? ওদের ট্রেনিং চার্ট তৈরী করছে হরিচরণ। অমিয়া বলছে অতো ট্রেনিং লোড নিতে পারবো না। তাই নিয়ে হরির সঙ্গে তক্কাতক্কি হয়েছে। হরি বলেছে, যদি ক্ষিদ্দার মেয়েটার হাতে মার না খেতে চাস তো হার্ড ট্রেনিং আরম্ভ কর।”
“করেও কোন লাভ নেই। কোনি এখন যে টাইম করছে, অমিয়ার পক্ষে সেখানে পৌঁছন সম্ভব হবে না।”
“তা হলে এবার ওকে জুপিটারের চ্যামপিয়নশিপে নামিয়ে, অমিয়াকে মার খাওয়াও। মনে আছে কি বলে অপমান করেছিল!”
জলে কোনির দিকে চোখ রেখে ক্ষিতীশ জবাব দিতে ভুলে গেল। ভেলো ধড়মড়িয়ে বলল, “যা বলতে এসেছিলুম সেটাই বলা হয়নি। আর একটা দরজির দোকান ঠিক করেছি। দিনে প্রায় হাপ কেজি মাল হয়। ওরা তোমার জন্য রেখে দেবে, তুমি কালই যেও। এই নাও ঠিকানাটা।”
ভেলো চলে যাবার পর ক্ষিতীশ স্টাটিং ব্লকের উপর বসে ওর কথাগুলো মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল। তখনই দেখল ধীরেন ঘোষ আর বদু চাটুজ্জে কমলদিঘির পশ্চিম গেট দিয়ে ঢুকে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকেই।
“ক্ষিদ্দা দেখছি উঠে-পড়ে লেগেছে। কদ্দূর হল?”
ক্ষিতীশ যথাসম্ভব নিরাসক্ত হবার চেষ্টা করে ধীরেনকে বলল, “কিসের কদ্দূর!”
“এই তোমার চ্যামপিয়ন তৈরী করার। এবার দিল্লীতে দেখলুম বোমবাইয়ের রমা যোশিকে। অসাধারণ, ফ্যান্টাস্টিক। ইণ্ডিয়ায় এ রকম মেয়ে সুইমার কখনো হয়নি।”
“হ্যাঁ, ভালোই টাইম করেছে।” ক্ষিতীশ নিপ্রাণস্বরে বলল।
“তোমার এই গঙ্গা থেকে কুড়োনো মেয়েটা কেমন টাইম করছে?” বদু চাটুজ্জে নস্যির ডিবেটা রেলিংয়ে ঠুকে ঢাকনিটা খুলতে খুলতে বলল, “ডন ফ্লেজারের টাইম ধরে ফেলেছে?”
“আর একটু বাকি আছে। কাল পরশুই ধরে ফেলবে।” ক্ষিতীশের চোখ জোড়া মিটমিট করে উঠল।
কোনি তখন কিকিং বোর্ড ধরে স্প্রিন্ট করে যাচ্ছে। বদু চাটুজ্জে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “ঠাট্টা করলে আমার সঙ্গে!”
“ঠাট্টা! জলে নেমে এক বছরেই ডনের টাইম ধরে ফেলেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। এমন সিরিয়াস কথার পর কি ঠাট্টা চলে? আগে অমিয়াকে বিট করুক, তারপর বড় বড় ব্যাপার ভাবা যাবে।”
“তা বটে।” ধীরেন ঘোষ বিজ্ঞের মতো বলল। “তবে অমিয়াকে বিট করা আর সম্ভব হলো না। এইটেই ওর লাস্ট সিজন। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বিয়ের পরই চলে যাবে কানাডায়।”
ক্ষিতীশ সচকিত হয়ে উঠল। কোনি যদি অমিয়াকে না হারায়, তাহলে বিরাট একটা অপূর্ণতা ক্ষিতীশের জীবনে যেন রয়ে যাবে। চিরকাল যেন তাকে অতৃপ্ত থেকে যেতে হবে।
“তাহলে কোনিকে এবার তো নামিয়ে জানতে হয় বেঙ্গল চ্যামপিয়নের থেকে কত পিছনে রয়েছে।”
“না না, তা করতে যেও না।” বদু চাটুজ্জে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। “সবে শুরু করছে। বাচ্চা মেয়ে এখুনি বড় রকমের মার খেয়ে গেলে সেটব্যাক হবে। তাতে ওর ক্ষতিই হবে।”
“হোক। তবু তো পরে বলতে পারবে, অমিয়ার পা ধোয়া জল খেয়েছি।”
সেইদিনই নকুল মুখুজ্জেকে ক্ষিতীশ জানাল, এবার জুপিটারের কম্পিটিশনে কোনির এন্ট্রি অবশ্যই যেন দেওয়া হয়।
ক্ষিতীশ এবার আরো সতর্ক, আরো হিসেবী, আরো কঠিন হল কোনির ট্রেনিং সম্পকে। তীক্ষ্ণ নজর রাখল কোনির হাবভাব, শোয়া, খাওয়া এবং বিশ্রামের দিকে। প্রতিমাসে একবার রক্তে হেমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করে পরিশ্রমের ভার বাড়িয়ে যেতে লাগল। অ্যাপোলোর ছেলেদের সঙ্গে এখন তাকে প্রতিযোগিতা করিয়ে সময় নেয়। ক্ষিতীশ একদিন কাগজে বড় অক্ষরে লাল কালিতে ‘৭০’ লিখে ক্লাবের বারান্দায় দেয়ালে সেটে দিল। কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে সে হেসে বলল, “অত বছর আমায় বাঁচতে হবে কিনা, সেটা যাতে মনে থাকে তাই চোখের সামনে রাখলাম রোজ দেখার জন্য।”
আসলে ওটা হচ্ছে ৭০ সেকেণ্ড। সময়টা কোনির চোখে প্রতিদিন ভাসিয়ে রাখার জন্য শুধু ক্লাবেই নয়, বাড়িতেও দেয়ালে লিখে রেখেছে। রমা যোশি এখন লক্ষ্যের পাত্রী। এক মিনিট ১০ সেকেন্ডে কোনিকে এই বছরই সাঁতরাতে হবে।
“অসম্ভব বলে কিছুই নেই রে।” কোনিকে রাত্রে খাওয়ার পর বাড়ি গেছে দেবার সময় ক্ষিতীশ বলে, “বুঝলি, আমাদের শত, হচ্ছে সময়। এই ঘড়িটা।”
ক্ষিতীশ পকেট থেকে টপ ওয়াচটা বার করে কোনির চোখের সামনে ধরে। কোনি সেটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকে। বারবার চাবি টিপে দেখে কাঁটাটা থরধরিয়ে কেমন এগোচ্ছে।
“ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের দিকে এগোতে হলে, ছোটখাট রেকর্ডগলো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগোতে হবে।”
“ক্ষিদ্দা, অমিয়াদির রেকর্ড কষে ভাঙ্গবো?”
ঘড়িটা কানে লাগিয়ে কোনি হঠাৎ প্রশ্নটা করল।
ক্ষিতীশ হেসে বলল, “কেন?”
“আজ দোকানে এসেছিল ব্লাউজ করাতে। আমাকে সকলের সামনে বলল, তুই এখানে ঝিয়ের কাজ করিস? জানো ক্ষিদ্দা, আমার খুব লজ্জা করল। আমার হাতের লেখাটা এতো খারাপ, নইলে খাতায় মাপ লেখার কাজ করতে পারতাম। তুমি বৌদিকে একটু বলবে? আমি রোজ তাহলে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করব।”
“বলব।” ক্ষিতীশ মদ, স্বরে বলল। “লজ্জা কখনো পুরোটা জিততে পারবি না। কাউন্টারের ওধারে বসলে খানিকটা জেতা হবে। ক্ষমতা দিয়ে জিততে হয়। তোর আসল লজ্জা জলে, আসল গর্বও জলে। যখন তোর ক্ষমতা খানিকটা বাড়াতে পারবি, শুধু তোর কেন, তখন আমারও মন তাতে বাড়বে, মানুষের মান বাড়বে।”
‘মানুষেরও?” কোনি হকচকিয়ে বলল।
ক্ষিতীশ ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বুকে ভারী গলায় বলল, “হ্যাঁ, মানুষেরও। মানুষ শব্দের থেকে জোরে আকাশে উড়েছে, দশ সেকেণ্ডের কমে ডাগায় একশো মিটার ছুটছে, জলে মেয়েরা এক মিনিটের বাধা ভেগেছে। স্বপ্নেও ভাবা যায়নি এমন সব পদ্ধতি লেবরেটরিতে, অপরেশন টেবলে মানুষ শিখেছে এই শরীরের আয়ু বাড়াতে। একদিন আসবে যখন আলোর গতিকে মানুষ হার মানাবে, ইচ্ছা মত বয়সটা বাড়াবে। এই যে রেকর্ড ভেঙ্গে মানুষ জলে, স্থলে, আকাশে এগোচ্ছে, এ সবই মানুষের মুক্তির চেষ্টা, এই ঘড়িটার হাত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। একদিন সব ঘড়ি ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে মানুষ, সময়কে হারিয়ে দেবে মানুষ—”
“ক্ষিদ্দা, কাঁধে লাগছে।” কোনি অক্ষটে কাতরে উঠল। কোনির কাঁধে উত্তেজিত আঙুলগুলো চেপে বসে গেছে। ক্ষিতীশ লজ্জা পেয়ে হাতটা নামিয়ে নিল।
“অনেক সময় আবোলতাবোল বকি। তুই এসব কথা বুঝতে পারিস?”
কোনি মাথা নাড়ল। ক্ষিতীশ যেন তাতে নিশ্চিত হল, এমন স্বরে বলল, “তোর পক্ষে এসব শক্ত কথা। তবে আরো বাড়ো হ, বুঝতে পারবি।”
‘ক্ষিদ্দা, তুমি কিছু বললে না, আমার টাইম অমিয়াদির রেকর্ডের থেকে কত পেছনে।”
“বলব বলব, একেবারে কম্পিটিশনেই দেখিয়ে দেব ব্যাটাদের, কে কার পায়ের জল খায়।”
এর তিনমাস পরই ক্ষিতীশ অ্যাপোলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠল, “বদমাইসি, এসব হচ্ছে ধীরেনের বদমাইসি। কোনির এন্ট্রি নেবে না কেন? অ্যাপোলোর সঙ্গে ঝগড়া, তাই বলে সুইমারদের ওপর ঝাল ঝাড়বে! প্রোটেস্ট করো, ইনজাংশন দাও…যা খুশি ইচ্ছে মতো করবে, এটা কি মগের মুল্লুক!”
নকুল মুখুজ্জে আর বিষ্টু ধর এবং আরো অনেকে সেখানে বসে। ক্ষিতীশ পায়চারি করছিল, থমকে জুপিটার ক্লাবের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “কোথায় নেমে গেছে–অপদার্থর ক্লাবটাকে কোথায় নামিয়ে এনেছে। এখন ভয়ে ইতরোমো শুরু করেছে। ভেবেছে এইভাবে ক্ষিতীশ সিংগীকে আটকাবে।”
ফিসফিস করে বিষ্টু ধর বলল, “এসব বিনোদ ভড়ের পরামর্শে হয়েছে। পাবলিককে এটা জানানো উচিত। প্রেস কনফারেন্স ডাকবো আমি।”
নকুল মুখুজ্জে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
এন্ট্রি রিফিউজ করার অধিকার ক্লাবের আছে। ওরা আলেছে ডেট পেরিয়ে গেছে, তই নেবে না। লাস্ট ডেট কবে সেটা তো ওরা বলে দেয়নি, সুতরাং আইনের ফাঁক রেখেছে। প্রোটেস্ট, ইনজাংশন কিছুই চলবে না।”
৫৫
“এটা মরালিটির ব্যাপার।” ক্ষিতীশ অধৈর্য ভগিতে নিজের বুকে চাপড় দিল। “এটা খেলার, এটা সাহসের, এটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।”
নকুল মুখুজ্জের ঠোঁট বিদ্রূপে মুচড়ে উঠল। বিষ্টু ধর উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তাহলে একটা ডিমনস্ট্রেশন করলে কেমন হয়। বিক্ষোভ প্রতিবাদ জুপিটারের সামনে, বিনোদ ভড়ের বাড়ির সামনে? একটা মিছিলও যদি পাড়ায় পাড়ায়—”
“ওতে অনেক ঝামেলা।” নকুল ঠাণ্ডা স্বরে বিষ্টু ধরকে মিইয়ে দিল। “জুপিটারেরই পাবলিসিটি হবে, ওদের ইজ্জৎ একটুও তাতে কমবে না। আপনার ইলেকশন পর্যন্ত লোকে এসব মনেও রাখবে না। তার থেকে বরং অন্য কিছু ভাবা যেতে পারে। ক্ষিতীশ, তুই কি নিশ্চিত যে, কোনি এখন অমিয়াকে হারাতে পারে?”
“নিশ্চয়।” ক্ষিতীশ বলল দাঁতে দাঁত চেপে।