কৈশোর
নীপাবৌদির সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়ে গেল পরের দিনই আকস্মিকভাবে।
আমায় কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে নেমন্তন্ন করে না। রাস্তাঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। আমি অবশ্য তাতে বিশেষ আপত্তি করি না। হাতের লক্ষ্মী যেমন পায়ে ঠেলতে নেই, তেমনি খাওয়ার নেমন্তন্ন উপেক্ষা করাও মূর্খতা।
সকালবেলা বাজারে গেছি, বর্ষার প্রথম ইলিশ উঠেছে, কিন্তু দাম গলাকাটা তবু ইলিশ বলে কথা! এরপর ইলিশ যখন শস্তা হবে, তখন পেটে ডিমও এসে যাবে, তেমন স্বাদ থাকবে না। একজন ইলিশ মাছওয়ালার সামনে দিয়ে দু’তিনবার পাক খেয়ে গেলুম, গোটা নেওয়া যাবে না, যদি কেটে বিক্রি করে তবে আধখানা নেওয়া যেতে পারে।
পেছন থেকে কাঁধে হাত দিয়ে তপনদা বলল, কীরে, নীলু, ইলিশ মাছ কেনার কথা ভাবছিস নাকি?
আমি হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই ঠিক বলতে পারলুম না। ধরা-পড়া চোরের মতন হাসলুম একটু।
তপনদার কাছে শ’দুয়েক টাকা ধার করেছিলুম মাস ছয়েক আগে। এখন তপনদা যদি মনে করে, আমি ধার শোধ না করে এত দামের ইলিশ কিনছি, তা হলে সেটা লজ্জার ব্যাপার। আমি তো নিজের টাকায় বাজার করি না, বাড়ির টাকা, তা কি তপনদা বুঝবে? এমনও হতে পারে, সেই ধারের কথাটা তপনদার মনে নেই। কিন্তু আমার মনে আছে।
তপনদা বলল, আজ আর ইলিশ কিনিস না।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, কেন, ভালো না? পচা? কানকোয় রং করা? তপনদা বলল, না, খুবই ভালো। আসল গঙ্গার। কাঁধের কাছে নীলচে রং, পেটটা চওড়া, এ একেবারে খাঁটি জিনিস। আমি এক জোড়া কিনেছি। তুই এক কাজ কর, আজ বেলে মাছ শস্তা আছে, বাড়ির লোকদের জন্য বেলে মাছ নিয়ে যা!
তপনদা আমায় টাকা ধার দিয়েছে বলে আমি বাড়ির জন্য কী বাজার করব তারও নির্দেশ দেবে? এই নিয়ে আমি অপমানিত বোধ করতে গিয়েও থমকে গেলুম। তপনদার স্বভাবই হচ্ছে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা!
আমি বাজিয়ে দেখার জন্য বললুম, আমাদের বাড়ির কেউ বেলে মাছ পছন্দ
করে না।
তপনদা বলল, তা হলে গুর্জালি কেন্। আরে সস্তায় মাছ কিনে বাজারের পয়সা থেকে কিছু মারতে শিখিসনি?
—গুর্জালি মাছ আমি শীতকালে ছাড়া খাই না!
–আরে তোর কথা এর মধ্যে আসছে কোথা থেকে। বলছি না বাড়ির লোকেদের জন্য! তুই তো আজ দুপুরে ইলিশ মাছ খাচ্ছিসই!
—কোথায় খাচ্ছি?
—জোড়া ইলিশ কিনেছি কি আর এমনি এমনি? কিন্তু একটা কণ্ডিশন, তুই এক টাকার বেশি খরচ করতে পারবি না!
—তপনদা, তোমার বাড়িতে কি টিকিট কিনে ইলিশ মাছ খেতে হবে নাকি?
-টিকিট না। এক টাকা দিয়ে একটা বেলুন কিনে নিয়ে যাবি। তাহলে ঐ কথা রইল। দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে ঠিক চলে আসিস! দেরি করে এলে কিন্তু পেটির মাছ পাবি না, শুধু গাদা!
তপনদা চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই আমি তার হাত টেনে ধরে বললুম, আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, বেলুন কিনে সঙ্গে নিয়ে ইলিশ মাছ খাওয়ার রহস্যটা কী? তপনদা মহা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল, আরে, তোরা কি বাংলা কথার মানে বুঝিস না? আজ টিংকুর মুখে-ভাত, তাকে বেলুন উপহার দিবি!
—তুমি একটা স্টেপ বাদ দিয়ে গেছ, তপনদা! টিংকুর মুখে-ভাতের কথাটা বলতে ভুলে গেছ!
—বুঝে নিতে হয়। বুদ্ধি খরচ করতে হয়। ও, তোর যা নেই, তা আবার খরচ করবি কী করে! টিংকুর মুখে-ভাতে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব খেতে আসবে। কিন্তু আমি ইলিশ মাছ খাওয়াচ্ছি বলে সবাই কুড়ি-পঁচিশ-তিরিশ টাকা দিয়ে টিংকুর জন্য উপহার কিনে আনবে, তা আমি টলারেট করব না! তিরিশ টাকা খর্চা করে দু’তিন পিস ইলিশ খাওয়ার মধ্যে আর মজা কী রইল, বল? এক টাকার বেলুনই যথেষ্ট!
—টিংকু তা হলে আজ অনেক পাচ্ছে?
—না রে, জনা দশ-বারো হবে। তোকে নিয়ে তেরো জন। এই রে, আনলাকি নাম্বার হয়ে যাচ্ছে যে? মুস্কিল হলো! তেরো তো চলতে পারে না!
–তা হলে আমি বাদ? আমার কপালটাই এরকম।
—অমনি ধাঁ করে কপালের দোষ দিয়ে দিলি? সামান্য ইলিশের জন্য ভাগ্য মেনে বসলি?
–তুমিই বা তা হলে আনলাকি থারটিন মানো কেন?
—শোন, নিজেকে গুনতে ভুলে গেসলুম। আমায় নিয়ে চোদ্দ। ঠিক আছে, পারফেক্ট। চলে আসিস তা হলে!
এই নেমন্তন্নতে আমার একটা অধিকার আছে। আজকের বাজারের ইলিশ মাছের ওপর আমি লোভের নিঃশ্বাস ফেলেছি।
দরকারের সময় বেলুন পাওয়াই কি সোজা! সকালবেলায় কোথায় বেলুনওয়ালা পাব? পার্কে, দু’একটা ইস্কুলের সামনে ঘুরতে হলো আমাকে। কোথায় বেলুন! একটাকা দিয়ে আর কী-ই বা কেনা যেতে পারে? তপনদার যা মেজাজ, বেলুনের বদলে অন্য কিছু নিয়ে গেলে হয়তো বাড়িতে ঢুকতেই দেবে না।
শেষ পর্যন্ত আবার বাজারে গিয়ে, একটা মনোহারি দোকানে গিয়ে খুঁজে পেলুম বেলুন, একজনের কাছ থেকে সাইকেল পাম্প চেয়ে নিয়ে সেটাকে ফোলালুম ভালো করে। তারপর সেই উড়ন্ত বেলুনের সুতো আঙুলে বেঁধে হাজির হলুম তপনদার বাড়িতে।
আর কেউই বেলুন আনেনি অবশ্য। বর্ষার দুপুরে আমার মতন বেলুন খোঁজার ধৈর্য কিংবা সময় আর কারই বা আছে। অনেকেই দামি দামি উপহার এনেছে, নীপাবৌদি এনেছে রুপোর চামচ। তাই নিয়ে তপনদা সবাইকেই বকাবকি করছেন বটে, কিন্তু কেউ গ্রাহ্য করছে না।
তপনদা হঠাৎ ঘোষণা করে বসল, যে-যে দামি উপহার এনেছে সে সে ইলিশ খেতে পাবে না।
তপনদার স্ত্রী শিখা একটা কেটলি এনে বললে, মাথা গরম হয়ে গেছে, দিই জল ঢেলে দিই?
সত্যিসত্যি জল ঢেলে শিখা তপনদার জামা-টামা ভিজিয়ে দিল। তপনদা যেমন খামখেয়ালি, শিখাও তেমনি পাগলি ধরনের। অনেক দিন চিরকুমার সভার সদস্য হয়ে থেকে তপনদা বিয়ে করেছে মাত্র তিন বছর আগে। এখনো যেন বিবাহিত জীবনে ঠিক ধাতস্থ হয়নি।
তপনদার সঙ্গে শিখার বয়েসের অনেক তফাত, সেজন্য তাকে কেউ আমরা বৌদি বলি না। শিখা তপনদার ছাত্রী ছিল, সেইজন্য তপনদা এখনো সবার সামনে শিখাকে তুই তুই বলে কথা বলেন।
জামা পাল্টে এসে তপনদা নীপাবৌদিকে জিজ্ঞেস করল, চন্দনটা সেই হাতিবাড়ি না পাঁচপাহাড়ীতে গিয়ে বসে আছে, সেখান থেকে কবে ফিরবে?
নীপাবৌদি মৃদু গলায় বলল, ঠিক নেই। খুব নাকি কাজের চাপ
তপনদা বলল, চন্দন কি সেই পাহাড়ে একটা খনি খুঁড়ছে নাকি?
নীপাবৌদি একটু হেসে বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। মাথায় যখন যে কাজের নেশা চাপে।
আমি বুঝতে পারলুম, নীপাবৌদি ম্যানেজ করে যাচ্ছে। তপনদা এখনো ওদের ভেতরের গণ্ডগোলটা জানে না। তপনদা চন্দনদার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, সেও টের পায়নি? জানলে তপনদা একটু কিছু তুলকালাম করতই।
আমি নীপাবৌদিকে জিজ্ঞেস করলুম, মুমু এল না?
নীপাবৌদি বলল, অনেক করে তো বললুম, আসতে চাইল না। ওর পরীক্ষার পড়া আছে।
তপনদা বলল, না এসেছে ভালোই হয়েছে। বড়দের আড্ডার মধ্যে ছোটদের অত না থাকাই ভালো।
তপনদার আর এক বন্ধুর স্ত্রী যমুনা বলল, ওমা, আজ টিংকুর মুখে-ভাত, আজ ছোটদেরই তো আসবার কথা।
তপনদা বলল, মুখে-ভাতের সঙ্গে ছোটদের কী সম্পর্ক? বড় হলে ওর যখন জন্মদিন হবে, তখন ছোটরা আসবে! আজ ছুটির দিন আমরা আড্ডা দেব, তা ছাড়া মুমুটা ইলিশ মাছ খায় না। আজকালকার বাচ্চারা মাছই খেতে চায় না। দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। টিংকুটাকে আমি মাছ ছাড়া কিছুই খাওয়াব না! এখন থেকে বাড়িতে নো মাংস, নো ডিম! ইলিশ দিয়ে হাতেখড়ি।
আমি ভয় পাচ্ছিলুম, সর্বঘটে কাঁঠালি কলাটিও এখানে এসে হাজির হবে কিনা। নেমন্তন্ন না করলেও সে আসতে পারে। অবশ্য আমি গতকালই রওনা দেব এমন কোনো কথা দিইনি। আগামীকাল কলকাতার বাইরে যাচ্ছি, এই খবরটা কোনো এক সময় নীপাবৌদিকে জানিয়ে দিতে হবে, যাতে লালুদার কানে পৌঁছে যায়।
তপনদা যেখানে উপস্থিত থাকে, সেখানে অন্য কেউ কথা বলার বিশেষ সুযোগ পায় না, তপনদার কথা শুনতে শুনতে অন্যদিকে মন ফেরানোও যায় না। নেভার আ ডাল মোমেন্ট যাকে বলে!
একটু বাদে আলমারি খুলে তপনদা একটা বোতল বার করে বলল, কে কে জিন খাবে?
শিখা বলল, অ্যাই না-না, আজ ওসব চলবে না! মেয়ের মুখে-ভাতের দিন তোমরা হৈ-হল্লা করবে—
তপনদা চোখ পাকিয়ে বলল, মেয়ের মুখে-ভাত বলে বাপ কেন জিন খাবে না! শুরুতেই এই। এরপর বলবি, মেয়ে নেকাপড়া কচ্ছে, তুমি বাড়িতে বন্ধুদের ডাকবে না। মেয়ে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, তুমি বাথরুমে ঢুকে বসে থাকো! আমার ওরকম বাবা হবার দরকার নেই!
শিখা তর্কের মধ্যে না গিয়ে কপাত করে বোতলটা কেড়ে নিয়ে দৌড়লো। তারপর শুরু হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চোর-পুলিশ খেলা। তিনখানা ঘর জুড়ে ওদের হুড়োহুড়িতে আমরা তটস্থ!
শেষ পর্যন্ত প্রায় ধরা পড়ার অবস্থায় শিখা সেই বোতলটা যমুনার হাত পাচার করতে গেল, যমুনা ঠিক ধরতে পারল না। বোতলটা মাটিতে পড়ে চুরমার! যারা এক বিন্দু মদ খায় না, তারা পর্যন্ত আফশোসের সঙ্গে বলে উঠল, ইস!
এরপর অন্য কোনো স্বামী হলে দারুণ রেগে বাড়ি মাথায় করত। কিন্তু তপনদা অন্য ধাতুতে গড়া। নিজের পরাজয়টা বীরের মতন মেনে নিয়ে হেসে বলল, এক হিসেবে ভালই হলো, ইলিশের সঙ্গে জিনটা ঠিক চলে না। স্বাদটা ঠিক পাওয়া যায় না।
শিখা বলল, আমার দাদা আসতে দেরি করছে। তুমি নীচের দোকান থেকে দাদাকে একটা টেলিফোন করো।
তপনদা সঙ্গে সঙ্গে হাসিটা মুছে ফেলে বলল, কেন, তোর দাদাকে আমি টেলিফোন করতে যাব কেন? তোর দাদা যখন ইচ্ছে আসবে, না হয় আসবে না!
শিখা বলল, দাদা না এলে শুরু করা যাচ্ছে না। মামার হাত দিয়ে টিংকুকে প্রথম পায়েস খাওয়াতে হবে না?
তপনদা বলল, মামার হাত দিয়ে প্রথম খাওয়াতে হবে মানে? কেন? আহ্লাদ নাকি? বাকি জীবনটা মামা টিংকুকে খাওয়াবে? মামার ভরসায় ও জন্মেছে!
শিখা বলল, বাজে কথা বলো না। যা নিয়ম, যাও, দাদাকে একবার টেলিফোন করো! একটু নীচে যাও।
তপনদা বলল, হবে না, আমার দ্বারা ওসব হবে না। আমি শ্বশুরবাড়ির লোকদের অত খাতির করতে পারব না। তোর আবার সাত গণ্ডা ভাই। বিয়ে করে এই এক ঝামেলা হয়েছে, বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে গাদাগুচ্ছের শালা ইনহেরিট করেছি! এর থেকে নীপাকে বিয়ে করলেই অনেক ভালো ছিল। নীপার মোটে একটি মাত্র ভাই, সেও ফরেনে থাকে, চন্দনের কত সুবিধে!
শিখা ঠোঁট উল্টে বলল, ইস, নীপাবৌদি তোমার মতন মুডি লোককে বিয়ে করত? কক্ষনো না!
তপনদা নীপাবৌদির কাঁধে হাত রেখে বলল, আরে শিখা, তুই জানিস না! তুই তখন পুঁচকে মেয়ে ছিলি! নীপাকে বিয়ে করলেও করে ফেলতে পারতুম। চন্দনের সঙ্গে যে নীপার বিয়ে হলো, সেটা তো আমারই স্যাক্রিফাইস!
অন্য অনেকে হেসে উঠল, শিখা তাকাল নীপাবৌদির দিকে।
নীপাবৌদি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না রে, তুই মোটেই বিশ্বাস করিস না এ কথা।
তপনদা বলল, অ্যাই, এখন অস্বীকার করো না! চন্দন আর আমার সঙ্গে তোমার ঠিক একই দিনে আলাপ হয়নি? একটা বিয়ে বাড়িতে? আমরা দু’জনেই তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি, চন্দনের চেয়ে আমার চেহারাও এমন কিছু খারাপ নয়। আমরা দু’জনেই এক সঙ্গে নীপাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলুম মেট্রোতে। কী যেন ফিল্মটা ছিল, নীপা? মনে আছে?
যমুনা বলল, তোমার সঙ্গে নীপার শুধু আলাপ হয়েছিল। আর চন্দনের সঙ্গে হয়েছিল প্রথম দর্শনেই প্রেম!
তপনদা বলল, প্রেম হতে পারত, তাও হতে পারত, আমি ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতুম। চন্দন ওকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা শোনাত, ওসব কবিতা আমারও কম মুখস্ত ছিল না। আসলে, আমি তখন বিয়ে করব না বলে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি, নীপাও শুনে ফেলেছিল সে কথা!
নীপাবৌদি বলল, মোটেও সে জন্য না। আপনার সঙ্গে আমার প্রেম করা অসম্ভব ছিল। আপনি খুব নস্যি নিতেন। আমি নস্যির গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারি না।
আবার সকলের এক দমক হাসি। অন্য একজন বলল, সত্যি তপন এত নস্যি নিত যে বাড়িতে সব সময় নস্যির গুঁড়ো উড়ত।
শিখা বলল, আমি এসে নস্যির নেশা কী রকম একেবারে ছাড়িয়ে দিয়েছি। যমুনা বলল, সত্যি শিখা, এটা তোমার খুব কৃতিত্ব বলতে হবে। তোমার বর নস্যির নেশা ছেড়ে এখন অন্য কোনো নেশা ধরেনি তো?
তপনদা বলল, শিখার আবার কৃতিত্ব কী? ওর কথা শুনে আমি চলি? আসলে আমার কোনোই নেশা নেই, যখন যেটা ইচ্ছে ধরতে কিংবা ছাড়তে পারি।
শিখা বলল, এখন নেশা হয়েছে বাজার করা। রোজ বাজার যাওয়া চাই, আর এক রাজ্যের জিনিস কিনে আনবে।
তপনদা বলল, এই নেশা আমার আগেও ছিল। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ত। নীপা, তোমার মনে নেই? সেই যে একদিন….সব বলে দেব?
নীপাবৌদি সকলের দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভভাবে বলল, কিছুই বলে দেবার নেই গো! তপনদা বানাচ্ছে।
তপনদা বলল, বানাচ্ছি, আমি বানাচ্ছি? তুমি হস্টেল থেকে পালিয়ে প্রায়ই দুপুরের দিকে আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসতে না? একদিন আমার বুকে মাথা দিয়ে কী কান্না কেঁদেছিলে।
নীপাবৌদি বলল, এই, মিথ্যে কথা।
তপনদা চোখ পাকিয়ে বলল, মিথ্যে কথা? তবে সব বলি? তখন চন্দন আর আমি এক ফ্ল্যাটে থাকি। চন্দন মফস্বলের ছেলে, কলকাতায় থাকার জায়গা ছিল না। একজন বুড়ি আমাদের রান্না করে দিত। সেই বুড়িটা আবার ডুব মারত মাঝে মাঝে। তখন হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হতো আমাদেরই। সেই অবস্থায় একদিন নীপা এসে পড়ল। আমাদের অবস্থা দেখে তার কী দুঃখ। কী ঠিক বলছি, না মিথ্যে বলছি?
নীপাবৌদি বলল, হ্যাঁ, তোমাদের এখানে আসতুম বটে, চন্দন তখন আমায় ইংরিজি দেখিয়ে দিত। কিন্তু তোমার বুকে মাথা রেখে কাঁদব কেন?
তপনদা বলল, আসছি, আসছি, সে কথায় পরে আসছি। আমাদের রান্নার কষ্ট দেখে তুমি বললে একদিন রেঁধে দেবে আমাদের জন্য। ঠিক তো? আমি চন্দনকে বললুম, এতদিন বুড়ির হাতে রান্না খেয়েছি, আজ এক সুন্দরী তরুণীর হাতের রান্না, তবে তো ভালো করে বাজার করে আনতে হয়। আমি ছুটলুম বাজারে, তোমাকে আর চন্দনকে নিরিবিলিতে খানিকক্ষণ থাকার চান্স দিয়ে—মনে আছে?
নীপাবৌদি অন্য শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে বলল, উঃ, তপনদার যা কাণ্ড। তিন রকম মাছ নিয়ে এসেছিল সেদিন বাজার থেকে। আমি তখন একটু আধটু রান্না শিখেছি, কাজ চালাতে পারি, তা বলে তিন রকম মাছ? এর কোনো মানে হয়? তাও আবার আস্ত আস্ত! ওই মাছ কী করে কুটতে হয়, তা আমি আজও জানি না!
তপনদা বলল, সেদিন তুমি কেঁদে ফেলেছিলে না!
নীপাবৌদি বলল, মোটেই কাঁদিনি। রেগে গিয়েছিলুম বটে!
তপনদা বলল, হ্যাঁ কেঁদেছিলে, আলবাৎ কেঁদেছিলে?
যমুনা বলল, কাঁদলেও আপনার বুকে মাথা রেখে কাঁদবে কেন? আপনার সারা গায়ে তো নস্যির গন্ধ।
তপনদা বলল, সেদিন আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদেনি ঠিকই, সেদিন লাফিয়ে লাফিয়ে নাকিকান্না কেঁদেছিল। কী রকম দেখবে, ও মাঁ এঁত মাঁছ…
শিখা বলল, থাক, তোমাকে আর নেচে নেচে দেখাতে হবে না।
তপনদা বলল, অখাদ্য রেঁধেছিল নীপা, নুন নেই, ঝাল নেই, কই মাছের ঝোলের কড়াইতে তো অনায়াসে গামছা পরে নেমে চান করা যায়!
নীপাবৌদি বলল, এই মিথ্যুক। তোমরা আহা আহা বলে সব চেটেপুটে খেলে, বললে দারুণ দারুণ, আর এখন এতদিন বাদে সবার সামনে এই কথা বলছ? তপনদাটা কী নিমকহারাম!
তপনদা বিস্ময়ে চোখ গোল করে বলল, তোমার কোনো রান্নায় নুনই ছিল না। তা হলে নিমকহারাম কী করে হবো?
শিখা বলল, জানো নীপাবৌদি, ও এই রকমই কথা বলে। আমার রান্নাও নাকি যাচ্ছেতাই।
তপনদা বলল, অ্যাই চুপ কর, তুই সেদিনকার মেয়ে, তুই কী জানিস রে? সেই দুপুরবেলাটা, বোধহয় নীলুও এসে পড়েছিল। নীলুটা তখন বাচ্চা ছেলে, চোদ্দ পনেরো বছর বয়েস হবে বোধহয়। খাওয়ার গন্ধ শুঁকে শুঁকে নীলুটা ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে এসে পড়ে। আজ যেমন এসেছে। সেদিনও অত মাছটাছ দেখে নীলু জোর করে খেতে বসে গেল। এই নীলু, তোর মনে নেই? সেদিনের রান্না কেমন হয়েছিল?
তপনদা আমার চোখে চোখ ফেলতেই আমি মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বললুম, হ্যাঁ, খুব ভালো মনে আছে। সেদিনের সব কটা রান্না চমৎকার হয়েছিল। বিশেষ করে কই মাছের কালিয়াটা নীপাবৌদি যা রেঁধেছিল না, আজও যেন মুখে লেগে আছে সেই স্বাদটা।
তপনদা হুংকার দিয়ে বলে উঠল, নীলুটা একটা হাড় হারামজাদা। সব সময় মেয়েদের দিকে টেনে কথা বলবে। এক নম্বরের মিথ্যেবাদী।
শিখা বলল, বেশ হয়েছে। নীলুকে তুমি হ্যাংলা বললে কেন, তোমার মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিয়েছে। আজও নীলু মোটেই নিজে নিজে আসেনি, আমি নিজে নীললোহিতকে নেমন্তন্ন করেছি। কী নীলু, তাই না?
তপনদা আমার দিকে চোখ টিপে বলল, এই জন্যই তো শাস্ত্রে বলেছে স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং ইত্যাদি, অর্থাৎ ওরা চোখে-মুখে মিথ্যে কথা বলতে পারে। আরও একটা সংস্কৃত আছে, পথি নারী বিবর্জিতা।
শিখা বলল, থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এখানে কেউ সংস্কৃত শুনতে চায় না। তুমি ফোন করবে না আমার দাদাকে? টিংকু কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
তপনদা বলল, একবার বলেছি না, আমি শ্বশুরবাড়ির লোকদের তেল দিতে পারব না। তুই টিংকুকে ততক্ষণ বুকের দুধ খাওয়া, মুখে-ভাতের দিনে দুধ খেলে কিছু নিয়মভঙ্গ হয় না। তুই ততক্ষণ তোর বুকটা এনগেজড রাখ, তা হলে হিংসে তোর বুক জ্বলবে না, আমি আমার বুকে নীপার মাথা রাখার ঘটনাটা বলি?
নীপাবৌদি বলল, চল রে, শিখা, আমরা ওঘরে যাই।
তপনদা বলল, এই পালাচ্ছ কেন? বাকিটা শুনে যাও। তুমি চলে গেলেও বাকিদের শোনাব। তারপর বুঝলে, সেই মাছের ঝোল খেয়েই হোক আর যে জন্যই হোক, চন্দনের তো টাইফয়েড হয়ে গেল। সে কী জ্বর। একশো পাঁচ, সাড়ে পাঁচ। নীপা এসে তাকে সেবা করে। সেবা মানে কী, বুকে হাত বোলানো। প্রেমের সেবা ঐ রকমই হয়। পাড়ার ডাক্তারটা দু’ দিন পরে বলে কী, এ কেস আমি সামলাতে পারব না, পেশেন্টকে হাসপাতালে পাঠান। আমি পড়লুম মহাবিপদে। চন্দনের আত্মীয়স্বজন কেউ কলকাতায় নেই, আমি নিজের রিস্কে কী করে হাসপাতালে দিই…হাসপাতালগুলো অধিকাংশই তো নরককুণ্ড, সেদিনই কাগজে খবর বেরিয়েছে যে একটা হাসপাতালের ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে কুকুরে একজন রুগীর পা খেয়ে ফেলেছে….। অথচ পাঠাতে হবেই, চন্দন তখন প্রায় অজ্ঞান। সেই সময় নীপা আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কী কান্নাই না কাঁদল। কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, তপনদা, তুমি ওকে হাসপাতালে পাঠিও না, ও মরে যাবে, প্লিজ…কী নীপা, এটাও মিথ্যে কথা? সেদিন বুঝি আমার গায়ে নস্যির গন্ধ ছিল না?
নীপাবৌদি এবার আর প্রতিবাদ করল না। লজ্জা পেয়ে মুখখানা নিচু করে রইল।
তপনদা সগর্বে বলল, সেই জন্যই তো বলছিলাম, বন্ধুর জন্য আমি স্যাক্রিফাইস করেছি কতখানি! চন্দনকে হাসপাতালে পাঠালেই ও খতম হয়ে যেত, আমি নীপাকে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করে নিতুম। নস্যির অভ্যেস ছাড়তে আর কতক্ষণ লাগত আমার।
নীপাবৌদি বলল, সত্যি তপনদা সেবার যা সেবা করেছিল, তার তুলনা হয় না। হাসপাতালে তো পাঠালই না, নিজের ঘড়ি, সোনার মেডেল এই সব বিক্রি করে সবচেয়ে বড় ডাক্তার যোগেশ মুখার্জিকে ডেকে আনল, তারপর দিন রাত জেগে—
তপনদা নিজের প্রশংসা চাপা দিয়ে বলল, চন্দনের কী ফাট। একটু জ্ঞান—-ফিরতেই আমাকে তড়পে বলল, তুই আমাকে হাসপাতালে দিলি না কেন? আমি তাকে কী করে বলি যে তোমার প্রেয়সী কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ করে ফেলছিল যে গো।
শিখাবৌদি বলল, ঐ তো দাদা এসে গেছে।
এর পর আর আড্ডা জমল না। মুখে-ভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল পাশের ঘরে। আমি বসে রইলুম এই ঘরেই। মনটা ভারি ভারি লাগছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথা। সত্যি কী দারুণ প্রেম দেখেছি চন্দনদা আর নীপাবৌদির। সেই প্রেমও নষ্ট হয়ে যেতে পারে?
চন্দনদা যখন বিয়ে করে, তখনও নিজের বাড়ি ভাড়া হয়নি। মানে, একটা বাড়িতে টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছিল, পজেশান পায়নি। চন্দনদাদের বিয়ে হয়েছিল তপনদার এই ফ্ল্যাটে, ফুলশয্যা হয়েছিল এই ঘরখানাতে। নীপাবৌদির মনে পড়ছে না সেসব কথা!
বাবা হিসেবে তপনদা একেবারে আনাড়ি। ও ঘরে টিংকুকে নিয়ে অনেক হৈ চৈ হচ্ছে, তপনদা চলে এল এ ঘরে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, চন্দনটা থাকলে এই সব গল্প আরও ভালো জমত, কী বল! নীপাকে একেবারে যাকে বলে সবার সামনে…কী রকম লজ্জা পেয়ে ব্লাশ করছিল। চন্দনটা কী হারামজাদা, মাসের পর মাস সেই কী এক হাতিঘোড়ার পাহাড়ে গিয়ে বসে আছে? আমার মেয়ের মুখে-ভাত, তাও এল না?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি চিঠি লিখেছিলে?
তপনদা বলল, চিঠি লিখতে হবে কেন? টিংকুর কবে মুখে-ভাত হবে, তার একটা হিসেব নেই ওর? ভারি কাজ দেখানো হচ্ছে। মুমুর প্রথম বছরের জন্মদিনে আমি ম্যাড্রাস থেকে চলে এসেছিলুম। সারপ্রাইজ দিয়েছিলুম ওদের দু’জনকে। আমি একবার ভাবলুম, চন্দনদার সঙ্গে নীপাবৌদির এখনকার সম্পর্কটা কি তপনদাকে জানিয়ে দেব?
তারপরই মনে হলো, এটা আমার মুখ থেকে না শোনাই ভালো। তপনদা যতই সিনিক্যাল ভাব দেখাক, এই খবর শুনে নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পাবে। তপনদার মতে এ জীবনটা শুধু ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে কাটিয়ে দেবার কথা, অভিমান-বিরহ—বিচ্ছেদ এসব নেহাত ছেলেমানুষি ব্যাপার।
অপরকে যারা কষ্ট দেয়, তাদের মতন বোকা আর হয় না, কারণ তারা অপরকে আনন্দ দেওয়ার বিশুদ্ধ তৃপ্তির স্বাদটাই সারা জীবনে পায় না। তবু কত মানুষ যে এই বোকামি করে।
কোনো এক সময় বাথরুমে হাত ধুতে গিয়ে দেখি, পেছনের সরু বারান্দাটার এক কোণে, দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে নীপাবৌদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যাতে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না বেরোয়, সেই জন্য আঁচল দিয়ে চাপা দিয়ে আছে মুখ।
কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একা একা কান্নার মতন করুণ দৃশ্য আর হয় না। আমার বুকটা মুচড়ে উঠল। নীপাবৌদির মন থেকে প্রেম সরে গেলে কি এমন কান্না বেরিয়ে আসতে পারে? কিংবা এ কান্না কি অনুতাপের। পুনর্মিলনের আকুতির? কে জানে।
আমি দেখে ফেলেছি জানতে পারলে নীপাবৌদি লজ্জা পাবে, তাই ছায়ার মতন চট করে সরে গেলুম।
একটু পরে খাবার পরিবেশনের সময় আবার দেখি নীপাবৌদির অন্য চেহারা। কান্নার চিহ্নমাত্র নেই, চোখ দুটো একটু ফোলা হলেও মুখে হাসি। যেন মেঘলা দিনে ঝলমলে রোদ উঠেছে।
নীপাবৌদি লেখাপড়া জানা মেয়ে। ব্যাঙ্কের অফিসার, লোকজনের সামনে কিছুতেই বিন্দুমাত্র দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। এরই মধ্যে একদিন লালুদার মুখে শুনেছিলুম, চন্দনদা মুমুর পড়ার খরচ মানি অর্ডার করে পাঠালেও নীপাবৌদি ফেরত দিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে যথেষ্ট রোজগার করেন, মেয়ের দায়িত্ব পুরোপুরিই নিতে চান, চন্দনদার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেবেন না। এ রকম তেজ নীপাবৌদিকে মানায়। কিন্তু নীপাবৌদি যে ভেতরে ভেতরে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহই নেই। এখন আমার মনে হচ্ছে, সব দোষ চন্দনদার।
আমার দু’ পীস ইলিশ খাওয়া হয়ে গেছে, নীপাবৌদি এসে বলল, নীলু, তুমি আরও মাছ নাও! আর দু’খানা পেটির মাছ, আর এই মুড়োটা।
আমি দুর্বল আপত্তি করে বললুম, না-না, আমার আর চাই না, অনেক খেয়েছি।
তপনদা বলল, এই নীপা, ওকে আর দিও না, কম পড়ে যাবে। ও অন্তত পাঁচখানা পেটি সাঁটিয়েছে। রবাহূতকে আবার অত খাতির কী। তা ছাড়া দ্যাখো না, শিখার বাড়ি থেকে দু’ জন আসবার কথা ছিল, পাঁচজন এসে গেছে। শ্বশুরবাড়ি না পঙ্গপাল।
শিখা বলল, এই অসভ্য। মোটেই দু’জনকে বলা হয়নি। তুমি এমন—
টেবিলের অন্যদিকে বসেছেন শিখার বড়দা। তিনি তপনদার স্বভাব বেশ ভালোই জানেন মনে হলো, তিনি মুচকি হেসে বললেন, এখনো বাকি আছে, আরও চার-পাঁচজন আসছে।
নীপাবৌদি বলল, কম পড়ুক আর যাই পড়ুক, নীলুকে আমি বেশি করে খাওয়াবই। নীলু সেদিনকার কই মাছ রান্নার প্রশংসা করে আমার মান বাঁচিয়েছে।
তপনদা বলল, মূর্খের প্রশংসার কী-ই বা দাম আছে? কই মাছের কালিয়া খেয়েছে বলল না ইডিয়েটটা? বাপের জন্মে কেউ কখনো শুনেছে যে কই মাছের কালিয়া হয়? তুমি পুড়িয়ে ফেলেছিলে, তাই কালো কালো ঝোলটার ও নাম দিয়েছে কালিয়া।
নীপাবৌদি আমার থালায় দু’খানা মাছ তুলে দিয়ে বলল, যদি পোড়া মাছ খেয়েও ও প্রশংসা করে থাকে, তা হলেও বুঝতে হবে ওর শিভালরি আছে। তোমার মতন রস-কষহীন নয়। মেয়েদের সব সময় ছোট করে তোমরা কী আনন্দ পাও?
তপনদা জিজ্ঞেস করল, তোমরা মানে? আমি তোমায় সব সময় খোঁচাই বটে, কিন্তু চন্দন তো একেবারে পত্নীপ্রেমে গদগদ।
আমি চমকে মুখ তুলে তাকালুম নীপাবৌদির দিকে। অবশেষে কি নীপাবৌদির মনের ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে?
নীপাবৌদি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আজকাল খবরের কাগজ খুললেই তো দেখি স্বামী আর দেওররা মিলে বউকে মারে।
তপনদা বলল, শাশুড়িদের বাদ দিচ্ছ কেন?
তপনদা বাজারে আমাকে বলেছিল, খেতে আসবে তেরো জন, তাকে নিয়ে চোদ্দ, আসলে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ, ইলিশ মাছও দুটোর বদলে পাঁচখানা এসেছে, কোনো কিছুই কম পড়ার কথা নয়। তবে একসঙ্গে এত লোকের এই ফ্ল্যাটে জায়গা হওয়া মুশকিল।
খাওয়া-দাওয়ার পরে আমার সরে পড়তে বাধা নেই। কিন্তু এর মধ্যে তপনদা হঠাৎ পান কিনতে চলে গেল, এবং মনের ভুলে আমার চটিটা পায়ে দিয়ে গেছে। আমি খালি পায়ে যাই কী করে?
শিখার বিভিন্ন দাদা-বৌদি ও মাসি মিলে আট-দশজনই এসেছে। শিখার প্রথম সন্তানের মুখে-ভাতে তার বাপের বাড়ির লোকেরা আসবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তাদের কারুকে চিনি না। কার সঙ্গে কী কথা বলব ভেবে না পেয়ে আমি কিছুটা সময় কাটাবার জন্য উঠে গেলুম ছাদের দিকে। চল্লিশ-বিয়াল্লিশটা পান দোকান থেকে সাজিয়ে আনতে তপনদার কম সময় লাগবে না।
তপনদা-চন্দনদাদের অবিবাহিত জীবনে আমি দু’ তিনবার এসেছি এই ছাদে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়াতে। এ বাড়ির একতলায় সবই দোকানঘর। তাই ছাদে ওঠার লোক বিশেষ নেই। এই ছাদেই ম্যারাপ বেঁধে চন্দনদার বিয়ের খাওয়া—দাওয়া হয়েছিল। আমি বোধহয় তখনো স্কুলের ছাত্র। চিলেকোঠায় বসে সন্দেশ—রসগোল্লা পাহারা দিয়েছি।
সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আসতেই চিলেকোঠায় কাদের যেন কথা শুনতে পেলুম। মহিলা কণ্ঠস্বর।
লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের কথা শোনার মধ্যে একটা অপূর্ব উত্তেজনা আছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেললুম প্ৰায়
মেয়েদের একটা আলাদা গোপন জগৎ থাকে, তা পুরুষদের কাছে তারা কখনো প্রকাশ করে না। মেয়েদের ইস্কুলের বাথরুমের দেয়ালে কী লেখা থাকে, কিংবা আদৌ কিছু লেখা থাকে কি না, তা কি আমরা কোনোদিন জানতে পারব? মেয়েরা পুরুষদের বাদ দিয়ে শুধু যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তখন নাকি তাদের সম্পূর্ণ অন্য একটা পরিচয় বেরিয়ে পড়ে। একজন মহিলা লেখিকাই একথা লিখেছেন। কিন্তু মহিলা লেখিকারাও এমন চালাক, কিছুতেই নিজেদের সেই গোপন জগৎটা আমাদের জানাবেন না।
গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল, ঘরের মধ্যে রয়েছে দু’জন, যমুনা আর নীপাবৌদি। দরজাটা বন্ধ হলেও পাল্লা দুটোর মধ্যে আধ ইঞ্চি ফাঁক। প্ৰায় অব্যবহৃত, পুরোনো দরজা। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে সিগারেটের ধোঁয়া।
আমি জানি নীপাবৌদি সিগারেট খায় না। বছরখানেক আগে নীপাবৌদি চন্দনদাকে সিগারেট ছাড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু যমুনা সিগারেট খায় এবং নিজে গাড়ি চালায়। বেশ ডাকাবুকো ধরনের মেয়ে। যমুনার ডিভোর্স হয়ে গেছে বিয়ের তিন-চার বছরের মধ্যে। এখন সে উইমেনস লীব-এর একজন দারুণ প্রবক্তা।
আমি খুব সাবধানে সেই দরজায় কান পাতলুম।
প্রথম কথাটাই বেশ চমকে ওঠার মতন। নারী স্বাধীনতার প্রবল সাপোর্টার যমুনা বলছে, আমার মনে হয় নীপা, চন্দনের সঙ্গে তোর মিটিয়ে নেওয়াই ভালো। যাই বল, একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বিশেষত রাত আটটা-নটার পর। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে।
নীপাবৌদি বলল, রোজ রোজ একজন পুরুষমানুষের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো। আমি এখন বেশ আছি।
যমুনা বলল, চন্দন কি শেষের দিকে প্রায়ই ঝগড়া করত? চন্দনের নেচার তো সেরকম নয়। একটু গোঁয়ার ধরনের হলেও মনটা…
—ঠিক ঝগড়া নয় রে, যমুনা। কেমন যেন খিটখিটে ভাব। যেন আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না। আমি বুঝতে পারতুম, ওর ভালোবাসাটাই চলে গেছে। আর ভালোবাসাই যদি না থাকে, তা হলে শুধু শুধু একটা নিয়মরক্ষার সম্পর্ক রাখার কী মানে হয়?
—সেটা ঠিক বলেছিস। অভিজিতের সঙ্গে আমার ভালোবাসা হলোই না। আমি বুঝতে পেরেছিলুম, অভিজিৎ ভালোবাসতে জানেই না। ও শুধু বুঝত সেক্স! আমি একটি মেয়ে, ওর কাছে নিতান্তই একটি সেক্স সিম্বল! এইটা ভাবলেই ঘেন্নায় আমার গা রি-রি করত।
—চন্দন আমাকে ভালোবাসত ঠিকই। কিন্তু ঐ মেয়েটা আসবার পর…আমার সব চেয়ে কষ্ট হতো কিসে জানিস! ঐ মেয়েটার নাম আমি একবার উচ্চারণ করলেই চন্দন একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত। ওইটাই সবচেয়ে খারাপ সাইন, তাই না? আমার মুখে ও ঐ মেয়েটার নামও শুনতে পারত না।
–তুই তা হলে ডিভোর্সের কথা ভাবছিস?
—তা ছাড়া আর কী? আমি সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট, চন্দনের দয়া চাই না। ভালোবাসা যদি না থাকে, তা হলে সম্পর্ক কাট-অফ করাই ভালো।
—তারপর কী করবি?
—একা থাকব! মুমুর ভার আমি নেব। মুমুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। দ্যাটস্ ইমপসিবল। দ্যাখ যমুনা, অভিজিতের সঙ্গে থাকার সময় তোর যে বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি, এক হিসেবে বেঁচে গেছিস! সন্তানের ওপর যে টান সেটা স্বামী কিংবা প্রেমিকের টানের চেয়েও অনেক বেশি, সেটা আমি এখন বুঝছি!
যমুনা চুপ করে গেল একটু। ওর সিগারেটের গন্ধে আমারও সিগারেট টানার জন্য মনটা আনচান করছে খুব। কিন্তু যদি আমার উপস্থিতি ওরা টের পেয়ে যায়, যমুনা আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ওর ধোঁয়ায় গন্ধ চাপা পড়ে যাবে। বিষে বিষেক্ষয়।
যমুনা খানিকটা উদাসীন গলায় বলল, হ্যাঁ, সন্তান সম্পর্কে তুই ঠিকই বলেছিস, সেটা আমি বুঝি। কিন্তু তারপরেও একটা কথা আছে রে, নীপা! তুই মুমুর দেখাশুনো করবি। ওর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করবি সব সময়, এসব তো মাদারলি ইনটিংকট! কিন্তু তুই তো শুধু মাদার নয়, তুই একটা উয়োম্যান। একসময় তোর মনে হবে, মেয়ের জন্য তুই তোর জীবনটা উৎসর্গ করে দিলি। একটা নোব্ল স্যাক্রিফাইস! কিন্তু একথাও তোকে বলছি, এই সব স্যাক্রিফাইস—ট্যাক্রিফাইসগুলো আসলে খুব বোরিং। একসময় তোর মনে প্রশ্ন জাগবেই—মেয়ে কোনো সময়ে স্বাধীন হয়ে চলে যাবে, কিন্তু আমার জীবনটার কী হবে? আমার জীবনটা কি এরকম ব্যর্থই হয়ে যাবে? শূন্য পড়ে থাকবে?
–আমি ঠিক এই অ্যাঙ্গেলে ভাবিনি!
—সামনে অনেকখানি জীবন পড়ে আছে। ভাবতে তো হবেই। একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একজন পুরুষমানুষ, যার বুকটা বেশ চওড়া, সে যখন একবার জড়িয়ে ধরে, তখন আমাদের শরীরে যে একটা উত্তেজনা হয়, তার কোনো তুলনাই হয় না।
—যে-কোনো পুরুষের জড়িয়ে ধরাতে তোর এরকম হয়!
—আরে নাঃ। আমি ক্যাজুয়াল সেক্সের কথা বলছি না। একজন পুরুষ, যাকে মোটামুটি চিনি, খানিকটা মনের মিল আছে, রুচির মিল আছে…এটা শুধু আমাদেরই হয় না, পুরুষদের আরও বেশি হয়! বেশির ভাগ পুরুষই তো বোকা রোমান্টিক। দেখিস না, একটু ছোঁয়া লাগলে, একটু গায়ে গায়ে ঘেঁসাঘেঁসি হলেই ওরা কী রকম লাল হয়ে ওঠে। কত পুরুষ অন্যমনস্কভাবে আমাদের বুক ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করে, দেখেছিস?
—তা আর দেখিনি! কলকাতা শহরে ট্রামে-বাসে যাতায়াত করি।
—আমি প্রায়ই ভাবি, একটুখানি বুক ছুঁয়ে দিয়ে ওদের কী আনন্দ হয়? আমরা তো কিছুই ফিল করি না, তাই না?
—আমার ভাই বুকের এই জায়গাটা ছুঁয়ে দিলে শরীর ঝনঝন করে। তবে ট্রামে-বাসের যে-কোনো বদলোক ছুঁলেই হয় না। বিশেষ কেউ।
—সেরকম তো হয়ই। তোকে একটা কথা বলি শোন, আমার যখন ষোল—সতেরো বছর বয়েস, তখন আমার একজন আত্মীয়, নীপা, তোকে নামটা বলব না, তুই চিনে ফেলবি—সে রেগুলার আমার বুকের এইখানটায় হাত দিত। আমি তখন কী ভাবতুম জানিস? আমি ভাবতুম, আমার তো খুব ভালো লাগছে ঠিকই, কিন্তু ও হাত দিয়ে কী আনন্দ পাচ্ছে? ওর কি হাতে, আঙুলের ডগায় সেক্স আছে?
দুই সখী এবার হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল।
আলোচনাটা সেদিকে এগোচ্ছে, তাতে আমার পক্ষে আর এখানে এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমি যেন গেঁথে গেছি সিঁড়ির মুখটায়, উঠতে পারছি না। আমার কান-ফান গরম হয়ে গেছে।
নীপাবৌদি আর যমুনা আমার চেয়ে বড়ো জোর পাঁচ-সাত বছরের বড়। ইস্কুল-কলেজে পড়ার সময় এই বয়েসের ব্যবধান অনেকখানি। কিন্তু তারপরের জীবনে চার-পাঁচ বছরের তফাত এমন কিছুই না। ওরা আমার প্রতি একটা ছোট ছোট ভাব করলেও আমি অনায়াসে ওদের বন্ধু হতে পারি।
কিন্তু এখন যদি আমি সাড়া দিয়ে বলি, এসো, নীপাবৌদি আর যমুনা, আমরা নারী-পুরুষের এই সব ছোয়াছুঁয়ির ব্যাপার নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করি, অমনি ওরা গুটিয়ে যাবে। আসল মনের কথা আর বলবেই না। কিংবা ধমকাবে। এই অসভ্য, তুমি আমাদের কথা শুনছ কেন, যাও, নিচে যাও!
যমুনার চেয়ে নীপাবৌদিই হাসছে বেশি। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে বাথরুমের পেছন দিকের সরু বারান্দাটায় যাকে একা একা কাঁদতে দেখেছিলুম, সে আর এই মহিলা কি এক? এত বিপরীত পরিবর্তন! সেইজন্যই তপনদা বলে, মেয়েদের চরিত্র অতি জটিল। কিছুতেই বোঝার উপায় নেই।
এভেলিউশানের দিক থেকে মেয়েরা উচ্চাঙ্গের প্রাণী, তাই তারা জটিল। সেই তুলনায় পুরুষরা কিছুটা নিম্নস্তরের তাই তারা সরল। খুব সম্ভব পুরুষ ও নারীজাতির মধ্যে আজও ঠিক মতন সমঝোতা হয়নি! পুরুষ-আধিপত্যের বদলে গোটা পৃথিবীতে একবার নারী-আধিপত্যের ট্রায়াল দিলে কেমন হয়? আমি মীরার ভজন গাইব। ম্যায়নে চাকর রাখো জী!
হাসি থামিয়ে যমুনা আর নীপাবৌদি আবার কথা শুরু করেছে। এবারে আরও রোমাঞ্চকর বিষয়।
যমুনা জিজ্ঞেস করল, তোর বাড়িতে একজন লোক প্রায়ই আসে, ঐ যে রে, কার্তিক কার্তিক চেহারা। লাল গাড়ি চড়ে। তাকে তুই খুব প্রশ্রয় দিচ্ছিস মনে হচ্ছে। চন্দন নেই, মানে অনুপস্থিত, সেই সুযোগে লোকটা নাকি প্রায়ই আসে তোর কাছে?
—তুই লালুদার কথা বলছিস? এসব গুজব তোর কানে কে তুলল রে, যমুনা?
–বাতাসে কথা ভেসে আসে।
—লালুদা অনেক রকম সাহায্য করে। অনেক কাজ আছে যা পুরুষমানুষরা ছাড়া ঠিক হয় না। বাড়িতে একটা মিস্তিরি খাটাতে গেলেও, যদি সেই মিস্তিরি দ্যাখে যে বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই, অমনি সে কাজে ফাঁকি দেবে, পয়সা ঠকাবার চেষ্টা করবে।
–হ্যাঁ, অনেক কাজ আছে, যা পুরুষমানুষ ছাড়া হয় না!
–এই, তুই হাসছিস যে! আমি ঐ সেন্সে বলিনি। লালুদার কাছ থেকে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
—এই উপকারী মানুষটির সঙ্গে তুই কি কোনো অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়ছিস নাকি? ডিভোর্সের আগেই বোধহয় সেটা ঠিক নয় রে! তোর বদনাম হবে। চাকরির জায়গায় অসুবিধে হবে। এদেশে সবাই তো মরাল গার্জেন! অবশ্য, চন্দন বেশ কয়েক মাস নেই, তোর শরীরের দিক থেকে একটা প্রয়োজন আছে। সেটা যদি ঐ লোকটা…
—ধ্যাৎ, পাগল হয়েছিস! লালুদার সঙ্গে অ্যাফেয়ার? আমি চিন্তাও করতে পারি না। এক-একজন লোক থাকে, চেহারা-টেহারা খারাপ নয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে সেক্সের কোনো প্রশ্নই আসে না। লালুদা কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরলেও আমি কিছু ফিল করি না, শরীরে একটুও উত্তেজনা হয় না! তাছাড়াও একটা কথা বলছি, চন্দনের ওপর আমার অনেক রাগ আছে ঠিকই, চন্দন কমপ্রোমাইজ করতে এলেও আমি আর রাজি হবো না। একবার ও আমাকে অপমান করেছে, বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর কখনো ওর সঙ্গে একসঙ্গে থাকব না। কিন্তু, তবুও, চন্দনকে আমি যে-রকম ভালোবেসেছিলাম, একেবারে সব কিছু দিয়ে, সেটা কিছুতেই যাচ্ছে না। এখনো আমি অন্য কোনো পুরুষমানুষের কথা ভাবতে পারি না।
—এইজন্যই তো একজন পুরুষকে এতখানি ভালোবাসা ঠিক নয়। ওরা লাই পেয়ে যায়। টেকন ফর গ্রান্টেড বলে ধরে নেয়। পুরুষদের কিছুটা দিয়ে আর অনেকখানি নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয়, যাতে ওরা সর্বক্ষণ আরও একটু পাবার জন্য ছটফট করে…
নীচে থেকে তপনদার গলা শোনা গেল। তপনদা হেঁকে বলছে, নীলুটা কোথায় গেল রে? হারামজাদাকে আমি আজ এমন মারব। একটা পচা, পুরোনো চটি পায়ে দিয়ে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে। রাস্তায় বেরিয়েই স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল, কী ঝামেলা। পা টেনে টেনে এত দূর আসতে হলো আমাকে। সে ব্যাটা নিশ্চয়ই নতুন চটিটা মেরে দেবার তালে আছে।
এইবার নীপাবৌদিরা দরজা খুলবে। আমি হুড়মুড়িয়ে নীচে নামতে গিয়েই একটা আছাড় খেলুম। ভাগ্যিস মাথা ফাটেনি, ডান পায়ের গোড়ালিটা মচকে গেছে মনে হচ্ছে, সে এমন কিছু না!