কৈশোর
সেই যে একদিন লালুদা আমাকে এক রাত্তিরে নিজে গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল, তার থেকে আমার বাড়িটা চিনে গেছে, মাঝে মাঝে আসে। আমাকে বাড়িতে না পেলেও আমার মায়ের সঙ্গে, বৌদির সঙ্গে গল্প করে। যে-কোনো বয়েসের মেয়ে ও মহিলাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে লালুদার।
এতদিনে জানা গেছে যে লালুদার ভালো নাম অনিন্দ্যকান্তি মজুমদার, কিন্তু এরকম একটা চমৎকার নাম সে ব্যবহার করার সুযোগই পায় না। আমার বৌদি পর্যন্ত দু’তিন দিনের আলাপেই তাকে লালুদা বলতে শুরু করে দিয়েছে।
আমার আপন বৌদিও বেশ ভক্ত হয়ে গেছে লালুদার। আমার অনুপস্থিতে একদিন বাথরুমের কমোড ওভারফ্লো করছিল, সেই সময় লালুদা এসে হাজির। এটা এমনই একটা বিচ্ছিরি সমস্যা যে বাড়িতে অতিথি এলেও জেনে যায়। লালুদা প্রায় চোখের নিমেষেই রাস্তা থেকে একটা কলের মিস্তিরি ডেকে এনে সেটা সারিয়ে দেবার ব্যবস্থা করল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সুতরাং লালুদার নামে ধন্য ধন্য পড়ে যাবেই।
আমার বাড়িতে এরকম লাল গাড়িওয়ালা লালুদার ঘন ঘন আসাটা আমার ঠিক পছন্দ হয় না। বৌদি যদি দাদাকে লুকিয়ে কারুর সঙ্গে একটু প্লেটোনিক প্রেম করতে চায়, তাতে আমার আপত্তি করার কী আছে। কিন্তু লালুদার তুলনায় আমি যে কত নিষ্কর্মা ও অপদার্থ, তা আমাকে প্রায়ই শুনতে হচ্ছে।
একদিন দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে লালুদা আমাকে ধরে ফেলল। আর এক মিনিট সময় পেলে ট্রামে উঠে পড়ে আমি লালুদাকে এড়িয়ে যেতে পারতুম, কিন্তু লালুদা প্রায় আমার নাকের ডগায় ঘ্যাঁচ করে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বলল, এই যে নীলমাধব, চলো, টলি ক্লাবে লাঞ্চ করতে যাবে নাকি? আমি ঐ দিকেই যাচ্ছি।
চাকরি-বাকরি করি না বটে, কিন্তু এইটুকু আমি জানি যে লাঞ্চের নেমন্তন্ন মানেই কাজের কথা। ব্যবসাদারদের এটাই নিয়ম। ডিনার মানে ফুর্তি, লাঞ্চ মানে কাজ।
আমি ভাত-ডাল-মাছের ঝোল খেয়ে বেরিয়েছি অবশ্য, কিন্তু তাকে তো লাঞ্চ বলে না। টলি ক্লাবে কোনোদিন ঢুকিনি। ঠিক আছে, দেখাই যাক না, ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়।
গাড়িতে ওঠার পর লালুদা বলল, সিগারেট আছে। লাঞ্চের আগে যদি এপিটাইজার চাও, দ্যাখো, গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে ভড়কার বোতল আছে, চুমুক দাও আসল রাশিয়ান ভড়কা।
আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলুম, লালুদা, আপনি সত্যিই এসব খান না?
—নেভার ইন মাই লাইফ। নেভার টাচ্ড় ইট! তবে অন্যদের খাওয়ায় আমি আপত্তি করি না! আমি লিবারাল মাইণ্ডেড লোক। তারপর কতদূর কী হলো?
—আপনি প্রগ্রেস রিপোর্ট চাইছেন তো? অনেক দূর! আপনার ভাগ্নীর বেহালার বাড়িতে আমি গেছি?
—অ্যাঁ, বাড়ি পর্যন্ত চলে গেছ?
—হ্যাঁ, লালুদা। ও বাড়িতে গেছি। আপনার ভাগ্নী, আপনার দিদির সঙ্গে আলাপ হলো। ও বাড়িতে আমি চা-বিস্কুট খেয়েছি।
—আমার দিদি? বেহালার বাড়িতে আমার দিদি থাকবে কেন? আমার পিসতুতো দিদি থাকে চন্দননগরে। আমার ভাগ্নী বেনু চন্দননগরের মেয়ে। সেই বাড়িতেই একদিন চন্দনকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বেনুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলুম!
—চন্দননগরের মেয়ের সঙ্গে চন্দনদার প্রেম! অনবদ্য! ইনসিডেন্টালি, লালুদা, ঐ মেয়েটির নাম বেনুও নয়, রেণুও নয়, রোহিণী।
—রোহিণী? তবে তুমি কার বাড়িতে গিয়ে উঠলে হে, নীলরতন? কোন মেয়ের সঙ্গে ভাব করলে? যাঃ, সব গুবলেট করে ফেললে?
—আপনি যে মেয়েটিকে সেদিন দেখিয়ে দিলেন, সে চন্দননগরে থাকে বলছেন? সে বেহালার বাসে কেন উঠল তবে?
—বেহালায় ওর শ্বশুরবাড়ি। সে বাড়িতেও আমি একবার গেছি। একজন ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার ভাগ্নীর, সে বেচারা হঠাৎ জলে ডুবে মারা গেল। স্যাড, ভেরি স্যাড! হ্যাণ্ডসাম, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, আমার ভাগ্নীর সঙ্গে যা মানিয়েছিল।
—সেই ডাক্তারের নাম অম্বর সেনগুপ্ত?
—হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিকই বলেছ! কিন্তু তুমি কোন মেয়ের বাড়িতে হানা দিলে বলো তো? সে বেচারার হয়তো কোনো দোষই নেই, শুধু শুধু তোমার মতন একজন বেকারের সঙ্গে….
—আমি ঠিক বাড়িতেই গেছি, লালুদা। আপনার দিদি নয়, যার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, তিনি আপনার ভাগ্নীর শাশুড়ি! আর আপনার ভাগ্নীর নাম ডেফিনিটলি রোহিণী!
—বাড়িটা কী রকম বলো তো?
—সাদা রঙের। একতলা। বসবার ঘরে হিমালয়ের রেঞ্জের ছবি। এডমাণ্ড হিলারির সই করা ছবি।
—হ্যাঁ, পাহাড়-টাহাড়ের ছবি আছে ঠিকই। তুমি বলছ ওর নাম রোহিণী? ডাকনাম, ডাকনাম, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, রিনি। তাহলে খুব কাছাকাছিই বলেছি, বলো!
—না, লালুদা, বেনুর সঙ্গে রোহিণী কিংবা রিনির আকাশ-পাতাল তফাত। মোটকথা, আপনার ভাগ্নীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় তো হয়েছেই, বেশ ভাব হয়েছে, যে কোনোদিন তাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নিয়ে আসতে পারি। কবে আনব বলুন!
—অ্যাঁ? এতদূর?
—হ্যাঁ, অনেক দূর। অলরেডি তার সঙ্গে আমার পাশাপাশি, ছবি তোলা হয়ে গেছে। আপনি যদি আরও মাখো মাখো ছবি চান, তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
—দাঁড়াও, দাঁড়াও, এক্ষুনি অতটা দরকার নেই। এখন আমরা অন্য একটা অ্যাঙ্গেল ভাবছি!
—কোন্ অ্যাঙ্গেল?
—চলো, টলি ক্লাবে গিয়ে বসি, তারপর সব কিছু ডিসকাস্ করব।
—তার আগে, লালুদা, আমার কিছু ব্যাকগ্রাউণ্ড ওয়ার্ক করা দরকার। আপনার ভাগ্নী সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
—শুট!
—আপনার ভাগ্নীর বিয়ে হয়েছিল এক ডাক্তারের সঙ্গে। চন্দনদা জিওলজিস্ট। এদের মধ্যে যোগসূত্রটা কী? আপনি যে আলাপ করিয়ে দিলেন, সেটা কখন, কী পারপাসে? তখন কি আপনার ভাগ্নীর বিয়ে হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ, তা হয়েছে! কিন্তু সেদিন সে চন্দননগরে বাপের বাড়ি গিয়েছিল। আমি চন্দনকে সেখানে নিয়ে যাই, প্রাকটিক্যালি জোর করে। কেন জানো? তুমি কি জানো, আমার ভাগ্নী, হেনা, একসময় নামকরা মাউন্টেনীয়ার ছিল? অনেক পাহাড়ে চড়েছে?
—সে কথা অনেকেই জানে। কিন্তু ওর নাম হেনা নয়, বেনু নয়, রেণুও নয়। রিনি কিংবা রোহিণী।
—ঠিক আছে, রোহিণী। বঙ্কিমচন্দ্রের কোনো নভেলের নায়িকা তো, হ্যাঁ, ঠিক আছে, ছেলেবেলা থেকেই মেয়েটা খুব ডাকাবুকো। খামোখা পাহাড়ে দৌড়োয়। সে যাকগে,. ঐ রোহিণী, আমার ভাগ্নী, একটা মেয়েদের দল করে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা না নন্দাদেবী নামে চূড়োয় উঠবে ঠিক করেছিল।
—মাকালু পীক!
—ঐ হলো একই কথা। তা মেয়েদের দল নিয়ে যাবে, সাজ-সরঞ্জাম, লোক-লস্কর, অনেক টাকারও তো দরকার? চাঁদা তুলছিল, বুঝলে? তখন আমার মনে পড়ল, চন্দনের কোম্পানি তো এইসব ব্যাপারে টাকা খরচ করে, নিজেদের পাবলিসিটির জন্য অনেক কিছু দেয়-টেয়, তাই ওদের মধ্যে আমি যোগাযোগ করিয়ে দিলুম।
—পরোপকার!
—যোগাযোগ করিয়ে দিলেই অনেক কাজ হয়, বুঝলে নীলধ্বজ! দুনিয়াটাই চলছে যোগাযোগের ওপর। কেউ দেবে, কেউ নেবে। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে….আর, নজরুল কী খাঁটি কথাই লিখে গেছেন! বিজনেসের ব্যাপারটা উনি ভালো বুঝতেন।
এতক্ষণ খাইনি, এবার আমি গ্লোভ কম্পার্টমেণ্ট খুলে বোতলটা বার করে রাশিয়ান ভদকায় দিলুম এক চুমুক। নজরুল না, রবীন্দ্রনাথ, এঁরা কেউ কি ভালো ব্যাবসা বুঝতেন? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল দূরে থাক, লালুদার অনর্গল কথা শুনে আমার নিজের নাম এবং বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবার জোগাড়!
খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আমি বললুম, লালুদা, একটা স্টিল কোম্পানি পাহাড়ের অভিযানে টাকা দেয়। টি ভি সিরিয়ালে টাকা দেয়। খেলার মাঠে টাকা দেয়। এসব বুঝলুম। এর মধ্যে প্রেম আসে কী করে? মাকালু অভিযান টিমে চোদ্দটা মেয়ে ছিল, তার মধ্যে আপনার ভাগ্নীর সঙ্গেই চন্দনদার প্রেম হলো কেন?
–তুমি কি জানো, আমার ভাগ্নীই বেস্ট অব দা লট? দেখতে-শুনতে, চেহারায়-কথাবার্তায়, তার মতন মেয়ে তুমি এদেশে কটা পাবে, দেখাও তো! তোমার মতন ছেলে তার নখের যুগ্যি নয়, না, না সরি সরি, আমি অন্য কনটেক্সটে বলছি। তোমার এলেম আছে স্বীকার করছি। কিন্তু আমার ভাগ্নী সত্যিই এক্সর্টা-অর্ডিনারী মেয়ে কি না বলো?
—কিন্তু তিনি একটি বিবাহিতা মহিলা, চন্দনদাও নিজের বউ-মেয়েকে ভুলে তার প্রেমে পড়ে গেলেন?
—প্রথমে প্রেম হয়নি তো! প্রথম দিকে ফর্মাল আলাপ-পরিচয়, যে রকম হয় আর কি! ঐ যে পাহাড়ে গিয়ে রোহিণীর বরটা, সেই ডাক্তার, সে পা পিছলে পড়ল আর মরল! ভেরি স্যাড! তার পর থেকেই, মানে, আমার ভাগ্নী বিধবা হয়ে ফেরার পর থেকেই চন্দন ওর সম্পর্কে বেশি ইন্টারেস্টেডে হয়ে পড়ল। এদিকে নীপা একটু একটু জানতে পেরে ফুঁসছে!
লালুদার গাড়ি একটা গেটের মধ্য দিয়ে ঢুকতেই স্যালুট করতে লাগল দারোয়ানরা। লালুদা এখানে বেশ হোমরা-চোমরা লোক। আশ্চর্য, এই ধরনের ভুলোমনা, গোলগাল ধরনের বোকাসোকা লোকেরাও জীবনে উন্নতি করে কী করে? আরও একটা ব্যাপার বুঝতে পারি না, লালুদা ব্যাবসা করে, তবু তার হাতে এত অফুরন্ত সময়!
গাড়ি থেকে নামবার আগে লালুদা আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এই রে! চটি পরে এসেছ? প্যান্টের সঙ্গে চটি? তাহলে তো তোমায় ঢুকতে দেবে না!
আমি কাচুমাচু হয়ে বললুম, এমনি আড্ডা মারতে বেরুচ্ছিলুম, তাই…কেন, প্যান্টের সঙ্গে চটি পরা অপরাধ? তা হলে আমি চলে যাচ্ছি!
লালুদা নেমে গাড়ির পেছনের সীটের পেছন থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স টেনে তুলে বললেন, এমার্জেন্সির জন্য সঙ্গে রাখি। যদি কিছু মনে না করো,
এর মধ্যে একটা স্ট্র্যাপ শু আছে, সেটা একবার পরে দেখবে?
—লালুদা, দরকার নেই, আমি চলে যাচ্ছি!
—আরে! তোমাকে একটা জরুরি কথার জন্য ডেকে এনেছি। লাঞ্চ না খেয়েই চলে যাবে কেন? জুতোটা পরে নাও!
নিজের চটি খুলে, অপরের জুতো পায়ে দিতে হলেই ব্যক্তিত্ব একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। আমি একটা কাঠের পুতুলের মতন মেপে মেপে পা ফেলে লালুদার পেছন পেছন ঢুকলুম ক্লাবের মধ্যে।
এমন আহামরি কিছু না। এর চেয়ে আমাদের কফি হাউস অনেক ভালো।
একটা ছোট টেবিলে আলাদাভাবে বসে লালুদা খানসামাকে ডাকল। আমার দিকে একটা মিনিউ কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল, কী খাবে ঠিক করো! স্টেক, রোস্ট, ফিলে, সিজলিং, যা তুমি চাও।
এসবের আমি মানেই বুঝি না। সেফ সাইডে থাকার জন্য আমি বললুম, লালুদা, আপনি যা অর্ডার দেবেন, আমিও তাই খাব।
লালুদা সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, আজ শুক্কুরবার। আজ তো আমি কিছু খাই না। আমার উপোস। শুধু একটা ফলের রস নেব। তুমি খাও, তোমার যা ইচ্ছে অর্ডার দিতে পারো!
এটা একটা চূড়ান্ত রকমের স্নবারি ছাড়া আর কী! যে শুধু ফলের রস খাবে, তার এতদূর গাড়ি চালিয়ে আসার কী মানে হয়? আমাকে টলি ক্লাব দেখিয়ে মুগ্ধ করে দেবার চেষ্টা?
আমি বললুম, লালুদা, আমিও ফলের রস!
এবার বোঝো! খানসামাটি মুখের এমন ভাব করেছে, যেন আমরা নরকের কীট! দুপুরবেলা, একটা টেবিল জুড়ে বসে আমরা শুধু ফলের রসের অর্ডার দিচ্ছি? হাড়-হাভাতে আর কাকে বলে।
লালুদা সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, আরে না-না, তুমি কেন শুধু ফলের রস খাবে? ভালো করে খাও। এখানে অনেক খাবারের বেশ নাম আছে। ভালো করে। যদি চাইনিজ চাও, তাও পেতে পার!
আমি বললুম, জয় সন্তোষী মা! আমিও শুক্কুরবার কিছু খাই না!
লালুদা সট সট করে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর করুণভাবে বলল, নীলাম্বর, আমি শুক্কুরবার বাড়িতে কিছু খাই না, ইয়ে, মানে, ক্লাবেরও অনেকে জানে—মানে, তুমি যদি কিছু বেশি করে অর্ডার দাও, আমি তোমার থেকে শেয়ার করতে পারি, মানে, তুমি অর্ডার দেবে, আমরা দু’জনে ভাগ করে খাব—
খাবার আসতে দেরি হবে। তার আগে আমি একটা ভড়কার অর্ডার দিলুম। লালুদা অবশ্য আমার ভড়কার গ্লাসে চুমুক দিল না। লালুদা সত্যিই মদ-টদ খায় না। ওর নেশা পরস্ত্রীদের শুধু উপকার করে যাওয়া।
লালুদা বলল, শোনো, নীলাম্বুজ, তোমাকে একটা শক্ত কাজ করতে হবে এবার।
আমি বললুম, আমাকে শুধু নীলু বলুন না। তাতে আপনার অনেক পরিশ্রম বেঁচে যাবে। মাথা খাটিয়ে নতুন নতুন নাম বার করতে হবে না!
লালুদা চোখ মুখ উদ্ভাসিত করে বলল, নীলু? এত সহজ? এ কথা আগে বলোনি কেন? তোমার তো কী একটা খটোমটো নাম!
আমি বললুম, নীলধ্বজের চেয়ে কম খটোমটো। সে যাকগে, নীলু, শুধু নীলুই চলবে। আপনি তো আমার নামের নীল অংশটা ঠিক মনে রাখতে পারেন দেখছি!
—শোনো নীলু, তোমাকে আর একবার ছোটপাহাড়ীতে যেতে হবে। চন্দনের সঙ্গে তোমার ঝগড়া-টগড়া নেই তো?
–না, তা নেই।
—তাহলে ঠিক আছে। তুমি ছোটপাহাড়ীতে গিয়ে কয়েকদিন থাকো, আস্তে আস্তে চন্দনকে কালটিভেট করো। সেবারে তুমি মুমুকে সঙ্গে করে নিয়েই গণ্ডগোল করেছিলে। মুমুর ব্যাপারে ও খুব টাচি!
—আমি মুমুকে নিয়ে যাইনি, ও নিজে থেকে, নিজের জমানো পয়সায় টিকিট কিনে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মাঝপথে।
—ঐ একই কথা হলো।
—না মোটেই এক কথা নয়, লালুদা! আমি মুমুকে বাড়ি থেকে পালাতে বলিনি!
–তোমরা বড্ড তর্ক করো। বাঙালি ইয়াংম্যানরা তর্ক করে করেই গেল। সেইজন্য তাদের দিয়ে কোনো কাজ হয় না। যাই হোক, শোনো রতন, তোমাকে এবার—
—রতন আবার কোথ থেকে পেলেন? বললাম না, নীলু!
—ও হ্যাঁ, নীলু! নীলু, নীলু, নীলু, নীলু–ব্যাস, এবার ঠিক আছে। তুমি এবার ছোটপাহাড়ীতে গিয়ে আস্তে আস্তে চন্দনের কান ভাঙাবে। তাড়াতাড়ি করার কিছু দরকার নেই। মানে চন্দনও জেদি, নীপাও জেদি, এদের দু’জনের মধ্যে একটা অন্তত ব্রীজ থাকা তো দরকার। নইলে কেউ কারুর দিকে ফিরবে না! চন্দন সত্যিই ডিভোর্স করতে চায় কি না, সেটা বুঝে নিতে হবে। যদি চায় তো তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলাই ভালো। অলরেডি, পাড়ায়, নীপার অফিসে, মুমুর ইস্কুলে ফিসফাস হতে শুরু করেছে, লোকে ঠিক জেনে যায়, হাসি-ঠাট্টা করে, এটা নীপার পক্ষে ক্ষতিকর, মুমুর পক্ষে তো আরও বেশি। ঠিক কিনা বলো!
—তা ঠিক।
—সেইজন্যই একটা কিছু হেস্তনেস্ত করা দরকার। আগে ভেবেছিলুম, আমার ভাগ্নীর নামে যদি একটা বদনাম রটানো যায়, সে অন্য কারুর সঙ্গে প্রেম করছে, ভিক্টোরিয়ায় তার সঙ্গে অন্য একজনের ছবি, এই সব দেখলে আর জানলে চন্দনের মন বিষিয়ে যাবে। সে আর আমার ভাগ্নীর দিকে ঝুঁকে থাকবে না।
—আপনি চন্দনদার সাইডটা বেশি করে দেখছেন। আর আপনার ভাগ্নী, ঐ রোহিণী যে মনে আঘাত পাবে, সে কথা ভাবলেন না?
—আরে ওসব মনের কষ্ট-টস্ট দু’দিনে মিলিয়ে যায়। সে ইয়াং, সুন্দরী মেয়ে। অনেক গুণও আছে, তার কি আর বিয়ের পাত্র জুটবে না? ঢের জুটবে! তাছাড়া, ঐ আইডিয়াটা আমরা ড্রপ করেছি। আমার ভাগ্নী এখন বাদ!
—অ্যাঁ। আইডিয়া ড্রপ করেছেন? আমি এত কষ্ট করে তার বাড়ি খুঁজে বার করলুম, তার সঙ্গে ভাব জমালুম, এখন বলছেন আপনার ভাগ্নী বাদ?
—আরে শোনো ভালো করে। চন্দন না হয় আমার ভাগ্নীর ওপর রেগে গেল, কিন্তু তাতেই যে তার নীপার ওপর রাগ কমে যাবে তার কি কোনো মানে আছে? সে আবার অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকতে পারে। কী, তাই না? সেইজন্য এবার প্ল্যান করেছি, বিষে বিষক্ষয়! নীপা আমার ভাগ্নীর ব্যাপারে জেলাস হয়েছিল, চন্দনকে সর্বক্ষণ কথা শোনাতো, নীপার সেই হিংসের জন্যই তো বলতে গেলে চন্দন এত রেগে গিয়ে…এবার চন্দনের মনেও হিংসে জাগাতে হবে। নীপা কারুর সঙ্গে প্রেম করছে শুনলে চন্দনের হিংসে হবে না? হিংসের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে হবে হিংসেকে। তারপর আসবে শান্তি। ভালো প্ল্যান না?
—নীপাবৌদি কারুর সঙ্গে প্রেম করছে নাকি?
–আসল প্রেম নয়, প্রেমের অভিনয়!
-কার সঙ্গে?
–তুমিও যেমন, বাইরের কোনো লোকের সঙ্গে কি আমরা নীপাকে প্ৰেম করতে দিতে পারি? তারপর যদি সত্যি সত্যি একটা কিছু ঘটে যায়! সেইজন্যই তো আমি নীপাকে সব সময় গার্ড দিয়ে রাখি। চন্দন যাতে পরে কিছু বলতে না পারে।
–তার মানে, আপনার সঙ্গে?
—আমি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি। তা প্রেমিক হিসেবে আমি কি খুব বেমানান? আমার এমন কিছু বয়েস হয়নি। চুলে কলপ দিই না।
—অর্থাৎ পরোপকার করবার জন্য আপনি নীপাবৌদির প্রেমিক হয়েছেন। আবার পরোপকার করবার জন্যই আপনি আপনার প্রেমিকার স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে চান। বাঃ চমৎকার ব্যাপার।
একগাল হেসে লালুদা বলল, এই তো তুমি ঠিক ধরেছ। সত্যি, মাধব, তোমার বুদ্ধি আছে।
আমিও সমানভাবে হেসে বললুম, মাধব? আগে তবু নীল পোরশানটা ঠিক বলছিলেন। এখন সেটুকুও ভুলে গেলেন।
একটু লজ্জা পেয়ে লালুদা বলল, ও, নীলু, তাই না? কী হয় জানো, এক-একজনের নাম কিছুতেই মনে থাকে না। অদ্ভুত ব্যাপার, একবার মাত্র আলাপ হলো এই রকম লোকের নাম সারাজীবন মনে থাকে, অথচ খুব চেনা এমন কারুর নামটা কিছুতেই মনে আসতে চায় না। আমার নাম লালু, তোমার নাম নীলু, বাঃ, মিল আছে, এবার থেকে আর ভুলব না। বুঝলে, ছন্দ মিলিয়ে মনে রাখলে কক্ষনো ভুল হয় না।
আমার প্লেট থেকে তৃতীয় টুকরো মাংস তুলে মুখে দিয়ে লালুদা বলল, এইবার আসল কথা।
ব্রীফকেস খুলে তিনি একটা ছবির খাম বার করে বললেন, এতে মোট আটখানা ছবি আছে, বিভিন্ন পোজে তোলা। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে তুলিয়েছি। দেখো তো, কেমন হয়েছে? তুমি অবশ্য চন্দনকে বলবে যে, এই ছবিগুলো তোমার তোলা!
মেট্রো সিনেমার সামনে নীপাবৌদি ও লালুদা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে মার্বেলের সিংহের সামনে ও ফোয়ারার পাশে নীপাবৌদি ও লালুদা, এক ডিভানে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে দু’জনে বসে থাকার দু’খানা ছবি, বোঝাই যাচ্ছে যে পাশে আরও অন্য লোক ছিল, তাদের কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, একখানা ছবিতে নীপাবৌদির পেটের কাছে লালুদার মুখ, খুব সম্ভবত লালুদা মাটি থেকে কোনো জিনিস তুলছিল, সেই মুহূর্তে ছবিটা নেওয়া, আর একটিতে নীপাবৌদির কাঁধে লালুদার হাত…
ছবিগুলোর কোয়ালিটি এতই ভালো যে মনে হয় কোনো সিনেমার স্টিল, কোনো পাকা ফটোগ্রাফারকে কাজে লাগিয়েছে লালুদা। আমি সাতজন্মে এরকম ছবি তুলতে পারব না।
আমি হাত বাড়িয়ে বললুম, আর ছবি কোথায়? সেগুলো দিন।
লালুদা বলল, আর তো নেই। এই ক’খানাই তোলা হয়েছে।
—এ তো সব নিরামিষ ছবি! এ দেখে চন্দনদার হিংসে হবে কেন? চন্দনদা তো আপনাকে চেনেই। চুমু-টুমর ছবি নেই?
—অ্যাই, তুমি বড্ড দুষ্টু তো! হ্যাঁ, মানে, আমার ঐ ইয়ে খেতে আপত্তি ছিল না, আমি নীপাকে বলেও ছিলুম, কিন্তু নীপার ঐসব খাওয়া ঠিক পছন্দ নয়। এতক্ষণে নীপাবৌদির ওপর আমার শ্রদ্ধা হলো। অভিনয় করেও নীপাবৌদি ঐ কাঁঠালি কলা টাইপের ঠোটে চুমু খেতে রাজি হননি।
লালুদা বলল, তুমি এই ছবিগুলোই দেখাবে, আর বাকিটা কানভাঙানি দেবে। আফটার অল, ঐ ইয়ে-টিয়ে খাওয়া, সে তো আর কেউ ক্যামেরাম্যানকে সাক্ষী রেখে খায় না! তুমি বানিয়ে বলবে যে তুমি লুকিয়ে ঐসব দেখে ফেলেছ! তোমার যেমন ইচ্ছে বানাতে পারো, সে তোমাকে আর কী শেখাব, বানাতে তুমি ওস্তাদ, মোটকথা আমাকে তুমি একেবারে ভিলেনই বানিয়ে দিও।
—ভিলেনের সঙ্গে প্রেম?
–না। মানে, সেই সেন্সে ভিলেন নয়। যাতে চন্দনের খুব রাগ আর হিংসে হয়, পরে কী হবে সেজন্য তুমি চিন্তা করো না, পরে আমি চন্দনের সঙ্গে ঠিক ম্যানেজ করে নেব। তাহলে কালকেই রওনা হয়ে যাও! তোমার কিছু খরচ-খচা লাগবে।
আবার ব্রীফকেস খুলে লালুদা একতাড়া একশো টাকার নোট বার করল। সেগুলো থেকে এক-দুই-তিন পর্যন্ত গুনে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এতে হয়ে যাবে না?
আমি বেমক্কা মাথা নেড়ে দিলুম। এই আমার এক দোষ, টাকাপয়সা সম্পর্কে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না। লালুদার কাছে অতগুলো একশো টাকার নোট, তিনের বদলে চারখানা খসে গেলেও লালুদার কিছু যায়-আসে না। আমি একদিকে মাথা হেলাবার বদলে দু’দিকে মাথা দোলালেও বোধহয় আর একটা নোট বাড়ত!
টাকা এবং ছবির খামটা আমার হাতে তুলে দিয়ে লালুদা বলল, তাহলে চলে যাও। তোমার ওপর ভরসা আছে, তুমি ঠিকই পারবে, লালু!
—লালু আমার নাম নয়, আপনার নাম।
—ওঃ হো, তাই তো, তাই তো! হে-হে-হে-হে!
আমার খাওয়া এবং লালুদারও খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। লালুদা এখানে আর একটু থামবে, আরও একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমার আর একটাই জিজ্ঞাস্য আছে। ঐ রোহিণী কি আপনার সত্যিই ভাগ্নী?
লালুদা চোখ বড় বড় করে বলল, হ্যাঁ, ভাগ্নী তো বটেই। ওর মা আমার দিদি হয়। অবশ্য দূর সম্পর্কের। কিন্তু খুব ক্লোজ।
—কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভাগ্নীর চেয়ে নীপাবৌদির দিকেই আপনার পাল্লাটা ভারি!—এদের সংসারটা ভেঙে যাবে, তা কখনো টলারেট করা যায়? তুমিই বলো। নীপা আমার বোনের মতন।
—কী উল্টোপাল্টা বলছেন, লালুদা! নীপা আপনার বোনের মতন, আবার তার সঙ্গে আপনি প্রেমের অভিনয় করছেন?
–না, মানে, আগে বোনের মতন ছিল, এখন অন্য চোখে দেখি। আবার কিছুদিন পরে চন্দন ফিরে এলেই নীপা আবার বোনের মতন হয়ে যাবে!
-বাঃ, চমৎকার! পারফেক্ট ব্যবস্থা! চলি, লালুদা।
-গুড লাক!
বাইরে এসে দেখি এর মধ্যে বেশ একপশলা জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তায় জল জমেনি বটে, কিন্তু পাশের নালায় কল কল শব্দ হচ্ছে। বাতাস ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।.. এখন আকাশটা চেটে দেখলে নির্ঘাত মিষ্টি লাগবে।
এই ছবিগুলো নিয়ে আমি ছোটপাহাড়ীতে যাব? পাগল নাকি? তা হলে আমার চরিত্রটা কী হবে, চুকলিখোর! আমি চন্দনদার কাছে তার বউয়ের নামে লাগাতে গেছি! ধুস!
ছবির খামটা ছুঁড়ে ফেলে দিলুম পাশের নালায়। খাম থেকে বেরিয়ে ছবিগুলো ভাসতে লাগল। বৃষ্টির জলে নীপাবৌদি আর লালুদা ভেসে যাচ্ছে।
তিনশো টাকা পেয়েও আমার তেমন আনন্দ হচ্ছে না। লালুদার ব্রীফকেসে নোটের তাড়াটা দেখে ফেলেছি বলেই মনে হচ্ছে, তিনশোর জায়গায় অনায়াসে চারশো হতে পারত, হলো না আমারই গাফিলতিতে। এ যেন তিনশো টাকা লাভ নয়, একশো টাকা ক্ষতি!
বাস ধরার জন্য এগোব, না ট্যাক্সি ধরব, এই নিয়ে দোনামনা করতে লাগলুম একটুক্ষণ। একা একা ট্যাক্সি চাপা একটা সত্যিকারের বিলাসিতা। টলি ক্লাবে লাঞ্চ খেয়ে বেরিয়ে কি কেউ বাসে ওঠে?
হঠাৎ লালুদার লাল গাড়িটা প্রায় ম্যাজিকের মতন এসে উপস্থিত হলো আমার সামনে। এই রে, আবার প্ল্যান পাল্টে গেছে, ছবিগুলো ফেরত চাইবে? এত তাড়াতাড়ি ফেলে দেওয়া আমার উচিত হয়নি। পেছন দিকে ঝট করে একবার তাকিয়ে দেখলুম, ছবিগুলো একটু দূরে কচুরিপানায় আটকে গিয়ে ঘুরছে, তার ওপর ওড়াউড়ি করছে দুটো ফড়িং!
লালুদা গাড়ি থেকে না নেমেই বলল, শোনো, একটা কথা মনে পড়ে গেল! তুমি চলে আসার পরেই আমার মনটা খচখচ করছিল। তোমাকে যে আমি ছোটপাহাড়ী পাঠাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আমার এই যে অ্যারেঞ্জমেন্ট হলো, সেটা কিন্তু স্ট্রিক্টলি বিটুইন ইউ অ্যাণ্ড মি। কারুকে বলবে না। এমনকি নীপাকেও না!
আমি ছবিগুলোর দিকটা যথাসম্ভব আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললুম, তা তো বটেই, এসব কথা আর কারুকে কি বলা যায়?
—আর একটা কথা। তোমাকে আমি যতখুশি বানাতে বলেছি, তাতে যদি তুমি তোমার কল্পনা লাগামছাড়া করে দাও, যাকে বলে আনব্রিড্ ইমাজিনেশান, তাতে বিপদ আছে। বানাতে বানাতে তুমি যেন বিছানা পর্যন্ত চলে যেও না।
-বিছানা বাদ?
-একদম বাদ। তুমি বিছানার ধারে-কাছেও যাবে না। চন্দন যদি ঐ ব্যাপারে আমাকে পরে অ্যাকিউজ করে, তাহলে নীপাও আমার ওপরে রেগে যাবে।
–ঠিক আছে, বিছানার নামগন্ধও করব না। ময়দানের ঘাস চলবে?
—ময়দানের ঘাস মানে? ঘাসের ওপর বসা বলছ? তা চলতে পারে। সবাই বসে। প্রেম করতে গেলে ঘাস বাদ দেওয়া যায় না কিছুতেই। এই বর্ষার সময় অবশ্য আমি ঘাসের ওপর বসতে পারব না।
—আপনার আর কিছু ইনস্ট্রাকশন আছে, লালুদা?
-আর হ্যাঁ, ছবিগুলো, তুমি যেন প্রথম গিয়েই ছবিগুলো দেখাতে শুরু করো না।
—মাথা খারাপ! ছবিগুলো দেখাবই না! মানে, দেখাব আস্তে আস্তে, একটা একটা করে, সইয়ে সইয়ে।
–বাঃ! প্রথম দুটো বলতেই এসেছিলুম। এটা টপ সিক্রেট আর নো বিছানা! মনে রেখো কিন্তু। তাহলে উইশ ইউ এভরি সাকসেস্, ঠিকঠাক সব ব্যবস্থা করে এসো, নীলু!
—থ্যাঙ্ক ইউ, লালুদা। থ্যাঙ্ক ইউ! কেন থ্যাঙ্ক ইউ দিচ্ছি বলুন তো? এতক্ষণে আপনি আমার নামটা ঠিক বললেন বলে!
লালুদা হেসে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার চলে গেল টলি ক্লাবে। ঘোরাবার সময় তার গাড়ির চাকা থেকে ছিটকে একটুখানি জল কাদার ছিটে লাগাল আমার প্যান্টে। ব্যাস, আমার বিবেক ফর্সা। ঐ জল কাদার ক্ষতিপূরণ তিনশো টাকা!
আমি ঐখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টানলুম। নীপাবৌদির সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। এর মধ্যে নীপাবৌদির সঙ্গে আমার একবারও ভালো করে কথা হয়নি। মাঝখানে কয়েক মাস আমি চন্দনদাদের বাড়িতে যাইনি, তার মধ্যেই এরকম গুরুতর ব্যাপার ঘটে গেল!
নীপাবৌদির ধারণা হয়েছে, আমি চন্দনদার পক্ষের লোক। আরে, তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, তার মধ্যে আমার সাইড নেবার কী আছে? এরকম ডিভোর্স তো কতই হচ্ছে আজকাল। মুমুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা না হয়ে গেলে এ ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। মুমুর মুখটা মনে পড়ে, হামাগুড়ি দেবার বয়েস থেকে ওকে দেখছি, এখনও মুখখানা কত সরল, টলটলে চোখ, মনটাও কচি। বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে ও আস্তে আস্তে নষ্ট হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। আর দু’চার বছর বাদেই পাড়ার কোনো বখা ছেলে যদি ওকেও সম্পূর্ণ বখিয়ে দেয়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এতদিন পর্যন্ত মুমুর বাবা আর মা ওকে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখত, ওকে বাইরে বেরুতে দিত না, অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও বিশেষ মিশত না। এখন বাবা আর মা কারুরই মনোযোগ নেই মেয়ের প্রতি। হঠাৎ যেন মেয়েটাকে রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে। এই জন্য বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা-মায়ের বেশি বেশি আদিখ্যেতা ভালো না। আরে বাবা, পরে যদি ডিভোর্স করবিই, তা হলে আগে ছেলেমেয়েদের অত আদর দিয়ে মাথায় তোলা কেন? মাথার থেকে হঠাৎ ধপাস্ করে মাটিতে ফেলে দিলে কি বাচ্চারা সইতে পারে? তার চেয়ে, গোড়া থেকেই ওদের মাটির ওপর ধুলোবালি মেখে খেলতে দেওয়া ভালো নয়?
লালুদা পরোপকারী লোক, তার উদ্দেশ্য মহৎ, এসব ঠিক আছে। কিন্তু নীপাবৌদি আগে তার ‘বোনের মতন’ ছিল, এখন আর সেরকম নেই, আবার পরে ‘বোনের মতন’ হয়ে যাবে, এই ব্যাপারটা কী? নীপাবৌদিই বা এতে রাজি হচ্ছে কেন?
বাড়িতে গেলে নীপাবৌদির সঙ্গে আলাদা কথা বলা যাবে না। লালুদা সেখানে থাকবেই। ব্যাঙ্কে যাওয়া যেতে পারে। মুস্কিল হচ্ছে দুটোর পর ব্যাঙ্কের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। এই সম্পর্কে আমার বরাবরই খুব কৌতূহল ছিল, দুটো বেজে গেলেই সাত তাড়াতাড়ি সামনের গেটে তালা দিয়ে ব্যাঙ্কের লোকেরা গোপনে গোপনে কী করে? একবার বিশেষ প্রয়োজনে দুপুরবেলা নীপাবৌদিকে ডাকতে যেতে হয়েছিল, চন্দনদা বলেছিলেন, সব ব্যাঙ্কেরই নাকি একটা পেছনের দরজা থাকে, চন্দনদার সঙ্গে গিয়ে আমি সেই দরজাটা দেখে নিয়েছিলুম।
একটা ট্যাক্সি আমাকে পেরিয়ে গিয়ে থেমে গেল একটু দূরে। তারপর একটু পিছিয়ে এলো, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রীতম বলল, কীরে নীলুচন্দ্ৰ, এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কোনো জানলা দেখছিস বুঝি?
অনেক জায়গায় চাকরির চেষ্টার পর প্রীতম এখন ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার হয়েছে। এদিকে যে তার এমন প্রতিভা ছিল, তা আগে বোঝা যায়নি, বেশ ভালোই ছবি তোলে। নামও হয়েছে খানিকটা, অনেক পত্রপত্রিকায় ছবির নীচে প্রীতম পাল নামটা দেখতে পাই। রোজগারও ভালো হচ্ছে মনে হয়, না হলে ট্যাক্সি চড়ছে কী করে?
অপরের ট্যাক্সিতে লিফট পাওয়ার আনন্দের কোনো তুলনাই হয় না। প্রাইভেট কারের চেয়েও বেশি, কারণ ট্যাক্সিতে যে লিফট দেয়, তার পকেট থেকে কড়কড়ে টাকা খসে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখার সুখটাও পাওয়া যায়। আরও একটা মজা আছে, নিজের পকেটে হাত দেবার ভান করে, জিজ্ঞেস করা যায়, আমি কিছু দেব? নেহাত চশমখোর না হলে কেউ বলে না, হ্যাঁ দাও!
আমি দরজা খুলে উঠে পড়লুম।
প্রীতম বলল, বেপাড়ায় এসে জানলা ওয়াচ করছিস? পাড়ার ছেলেদের কাছে প্যাঁদানি খাবি!
তারপরই সে একটা গান শুরু করে দিল, গো ফ্রম মাই উইণ্ডো, মাই লাভ, মাই লাভ—
আমি বললুম, কোথায় যাচ্ছিস, আমায় একটু পার্ক সার্কাসে নামিয়ে দে!
প্রীতম বলল, পার্ক সার্কাস? অত সুখ হবে না চাঁদু, আমি যাচ্ছি ঠাকুরপুকুর, আমার জরুরি কাজ আছে, একটা মিটিং কভার করতে হবে!
–এই রে, তাহলে তোর ট্যাক্সিতে চাপলুম কেন?
—আমি তো তোমায় ইনভাইট করিনি ভাই! তুমিই তো বড়ি থ্রো করলে। দীপ্তি সিনেমার কাছে নেমে যেতে পারিস, কিংবা নিউ আলিপুরে নেমে ট্রাম ধরতে পারিস, কিংবা ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত গেলেই বা ক্ষতি কী?
—হঠাৎ ঠাকুরপুকুর যেতে যাব কেন?
-সেটা তুই-ই বুঝবি! আমি কি যেতে বলছি! তবে তুই যদি যেতে চাস, আমি আপত্তি করব না। ট্যাক্সিতে একজন যাওয়া আর দু’জন যাওয়ায় তো আর ভাড়া কম বেশি হয় না!
প্রীতম আবার একটা ইংরিজি গান শুরু করতেই আমি বললুম, মেজাজটা খুব ভালো আছে দেখছি। হাতে বেশ পয়সা এসেছে বুঝি? এখন কোন মিটিং কভার করতে যাচ্ছিস?
প্রীতম বলল, একটা কোম্পানির বোর্ড মিটিং। সাতজন কর্মকর্তা তর্কাতর্কি চ্যাঁচামেচি করবে, আমাকে তার সাতখানা ছবি তুলতে হবে। এক-একটা ছবিতে এক-একজনের ওপর বেশি ফোকাস! হাজার টাকা দেবে!
আমি বললুম, বাঃ, এ তো চমৎকার লাইন ধরেছিস। এইসব কাজ জোগাড় হয় কী করে বল তো?
—কানেকশান! কানেকশান! এক জায়গায় ভালো ছবি তুললে তাদের সঙ্গে চেনাশুনো হয়ে যায়। তাদের কেউ আবার অন্য জায়গায় চান্স দেয়। অবশ্য আমার মতন এ ক্লাস ফটোগ্রাফাররাই চান্স পায়। তুই একখানা ক্যামেরা কিনলেই কি আর পাবি? কত রকম অদ্ভুত জায়গা থেকেই যে ডাক আসে, তুই কল্পনাও করতে পারবি না!
—তাহলে তোর সঙ্গে এখন আমি যেতে পারি? ঐ বোর্ড মিটিং-এ আমাকে থাকতে দেবে?
–তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেজে যাবি। আলো ধরবি। তা হলে আমার প্রেস্টিজ আর রেট দুটোই বেড়ে যাবে। যে ফটোগ্রাফার সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়ে আসে, তার রেট বেশি হবে না?
—তার বদলে তুই আমার জন্য বিনা পয়সায় কয়েকটা ছবি তুলে দিবি?—কার? তোর ছবি? তুই কি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করছিস নাকি, কন্যাপক্ষের কাছে ছবি পাঠাতে হবে?
—আমার তো বলিনি, আমার জন্য!
প্রীতমকে দেখে আমার মাথায় একটা অন্য প্ল্যান এসেছে। এখন প্রায় বিকেল। প্রীতমের সঙ্গে ঠাকুরপুকুরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর বেহালায় রোহিণীর বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে। সেদিন রোহিণীর ইন্টারভিউ নিয়ে এসেছি, কিন্তু তার একটা ছবি না নিলে ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কত বড় কাগজের আমি রিপোর্টার। লালুদার কাছে গুল মারলেও রোহিণীর ছবি তো তোলা হয়নি এখনও!
সেদিন রোহিণীদের বাড়িতে গিয়ে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। রোহিণীকে আর তার মাকেও। ঠোটে হাসি লেগে থাকা বয়স্কা মহিলাদেরও আমার ভালো লাগে, তাঁদের কথার মধ্যে একটা মিষ্টি সুর থাকে। রোহিণী বাড়ি ফিরতে দেরি করলেও ওর মায়ের সঙ্গে গল্প করা যাবে!
বিবেকে একটু পিন-ফোটার ব্যথাও অনুভব করলুম। নীপাবৌদির সঙ্গে দেখা করার কথা ভেবেও আমিও চলেছি বেহালার দিকে। সে কি শুধু বিনা পয়সায় ট্যাক্সি চড়ার লোভে? অথবা রোহিণীর আকর্ষণে?
ছবি তোলার নানান গল্প করতে করতে প্রীতম বলল, এই তো ক’দিন আগে কী একটা কনট্রাক্ট পেয়েছিলুম জানিস? একজন বিবাহিতা মহিলা, দেখতে বেশ সুন্দরী, খুব ডিগনিফায়েড চেহারা, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। তার সঙ্গে প্রেম করছে আমাদের লালুদা! লালুদাকে চিনিস তো? এক সময় আমার বৌদির সঙ্গে প্রেম করত, রোজ দুপুরবেলা এসে হানা দিত আমাদের বাড়িতে। সেই লালুদা এখন এই মহিলার সঙ্গে প্রেম করছেন, সেই ছবি আমায় তুলতে হলো লুকিয়ে লুকিয়ে। ফ্ল্যাশ ইউজ করা চলবে না। কী ঝামেলা বল তো! তার ওপর ভদ্রমহিলা খুবই আনউইলিং পার্টি মনে হলো!
হ্যাঁ, প্রীতম সত্যিই ভালো ছবি তোলে। তবে তার তোলা ছবিগুলো যে একটু আগে আমি নর্দমায় ফেলে দিয়েছি, সে কথা বলা যাবে না!