Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কৈশোরের হারানো খাতার পাতা থেকে || Nitish Burman

কৈশোরের হারানো খাতার পাতা থেকে || Nitish Burman

কৈশোরের হারানো খাতার পাতা থেকে

রাজপথে দেখা হলে কেহ যদি গুরু বলে
হাত তুলে করে নমস্কার,
বলি তারে হাসিমুখে বেঁচে বর্ত্তে থাক সুখে
স্পর্শ করি কেশগুলি তার।

ভাবিতে ভাবিতে যাই কি নাম? মনে ত নাই
ছাত্র ছিল কতদিন আগে ;
স্মৃতিসূত্র ধরি টানি, কৈশোরের মুখখানি
দেখি মনে জাগে কিনা জাগে।

— কবিশেখর কালিদাস রায়।

আমার বাল্যপাঠের স্মৃতি বড়ই মধুর ।স্মৃতি কখনো অপরিসীম সুখ এনে দেয় আবার কখনো দেয় দুঃখ ।ফেলে আসা শৈশবের শিশুপাঠ , স্কুলের দিনগুলো মনের মধ্যে মাঝে মাঝে খুব জেগে ওঠে ।ভেসে ওঠে গরীব স্কুলবাড়ি আর গরীব মাষ্টারমশায়দের মুখগুলো।এক দৈন্যতার স্পর্শে হয়েছিল শিক্ষার শুরু আর বেড়ে ওঠা। তবে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ছিল না কোনো দৈন্যতা, ছিল প্রশান্ত সাগরের সফেন তরঙ্গ লহরীর মত অনাবিল স্নেহ ভালবাসা আর শাসন ।সেই স্নেহের পরশেই আমাদের প্রতিটি ক্ষণ ,প্রতিটি মুহূর্ত ভরে থাকত প্রাচুর্যে। তখন তা বুঝতাম না কিন্তু এখন মনের অতলে গভীরতম মূল্যবোধের হিসেব যখন করি তখন খাতা মেলাতে গিয়ে দেখি অনেক কিছু জমা হয়ে আছে , যা কখনো হিসেব করিনি। আমার জন্ম গারোপাহাড়ের এক পাড়া গাঁয়ে । এই লেখায় গ্রামের স্কুল আর প্রাইমারী শিক্ষকদের কথাই উঠে এসেছে, ষাট-সত্তর দশকের কথা ।ভৌগলিক অবস্থান যাই হোক না কেন, তখন এক সময় ছিল ছাত্র শিক্ষকের সুমধুর সম্পর্ক তা দেশ কাল সব কিছুকে ছাপিয়ে হৃদয়ের কাছাকাছি চলে আসত । ভিতরে জাগত এক বিরল শ্রদ্ধা বোধ, ছিল বেতের শাসন তার সাথে ছিল বাৎসল্য, অগাধ স্নেহ আর ছিল এক বিশ্বাসের ভিত। কোনো দিন স্কুলে না গেলে ঘরে এসে শিক্ষকরা খোঁজ নিয়ে যেতেন শরীর খারাপ করল কিনা , প্রয়োজনে ওষুধ আনিয়ে দিতে কুন্ঠা বোধ করতেন না।আবার সকাল সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে পরিদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন বাড়িতে , ঠিক মত পড়া নিয়ে বসলাম কিনা তা দেখতে। মনে পড়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় কোনো স্যারকে দেখলেই ব্রেক কষে সাইকেল থেকে নেমে উনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটু দূরে গিয়ে আবার সাইকেলে চড়তাম।
আমার স্কুলের প্রাইমারী স্যারদের মধ্যে দুজন স্যার এখনো সশরীরে আছেন। এই ডিসেম্বরে অনেকদিন পর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম । প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণপদ শীল স্যারের সাথে দেখা করতে একদিন উনার বাড়ি যাই, প্রায় তিরিশ বছর পর হয়ত উনাকে দেখলাম। বয়স আশির কোঠায় । বড়ই মিষ্ট স্বভাবের স্যার তিনি। সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। তিনি সব সময় পরতেন ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি এবং সাদা পাজামা। প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে আসতেন এবং হেঁটে বাড়ি যেতেন । কোনদিন সাইকেল চড়তে দেখিনি, রিক্সায় চড়ার কথাও না, কারণ তখন সারা গ্রামে একটাই রিক্সা ছিল , তথাকথিত বড়লোকেরা তখন সেই রিক্সা চড়ত। প্রথম রিক্সার বাহক ছিলেন গোপাল হিস্ন্দুস্থানী , বিহার থেকে এসেছিল তাই সবাই হিন্দুস্থানী বলে ডাকত শেষে হিন্দুস্থানীই পদবী হয়ে যায় । বয়সের ভারে স্যারের শরীর কিছুটা ন্যুব্জ হয়েছে, রাস্তায় একা বেরতে সাহস পান না । দিনকাল বদলে গেছে । সেই গ্রামে এখন রাস্তা জুড়ে বাইক ,অটো , ছোট বড় গাড়ির দাপাদাপি । অথচ সে সময় সারাদিনে একটা বাস চলত , সেই বাসের আবার আপার লোয়ার থাকত, আপারের সিটগুলো আড়াআড়ি ভাবে এবং লোয়ারের সিটগুলো লম্বা ভাবে বসানো ।ভাড়াও আপারের বেশি আর লোয়ারের কম ।আপার আর লোয়ারের দরজা আলাদা ছিল ,আপার -লোয়ারের ভিতর সরাসরি যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সকালে একটা বাস যেত পঞ্চাশ কি.মি. দূরে সদর শহরে আবার বিকালে ফেরৎ আসত। এই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ছোটগাড়ি ,বাইক ,স্কুটার তখন কারো ছিল আমার স্মৃতিতে নেই। স্যার এখন তাই বাড়িতেই থাকেন, বাড়ি এবং বাগানে কাজ করে সময় কাটান।খুব সুশ্রী এবং মার্জিত চেহারার স্যার ছিলেন তিনি। আমাকে দেখে একবারেই চিনলেন এবং যারপরনাই আনন্দিত হলেন।পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম, বুক ভরে আশীর্বাদ করলেন । অনেক গল্প হল পুরনো স্কুল জীবনের । প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগের দিনগুলো যেন কিছু সময়ের জন্য ফিরে পেলাম।ফিরে পেলাম ফেলে আসা কিছু স্নেহ ভালবাসা । সে সময় স্কুলের পরিবেশ আর শিক্ষার মূল্যায়ন ঠিক বলে বোঝানো যাবে না, প্রাচীন ভারতে ‘গুরুকুলাশ্রম’ ই ছিল শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান।গীতায় আছে – ‘প্রণিপাতেন ,পরিপ্রশ্নেন সেবয়া’ । শ্রদ্ধার সাথে গুরুর চরণে প্রণাম জানিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে শিষ্য জ্ঞান লাভ করত।এইভাবে গুরুর আশীর্বাদে শিষ্য সমস্ত শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করে ফিরে আসত গার্হস্থ্য জীবনে।তাই প্রাচীন ভারতে এটাই ছিল শিক্ষার আদর্শ।শাস্ত্রে আছে -‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্’ ।গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাই ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনের একমাত্র পাথেয় । এই শ্রদ্ধার অভাব ঘটলেই ছাত্রদের জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতার গ্লানি ।শ্রদ্ধাবিহীন ছাত্র জীবনে খ্যাতি লাভ করতে পারে না, পারে না সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে।স্যারের স্মৃতি শক্তির প্রখরতা দেখে অবাক হয়ে যাই, প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর নাম উনার এখনো মনে আছে, স্কুলের অনেক ঘটনাই সাবলীল ভাবেই গল্পে উঠে এল ।একরাশ মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। মনে মনে ভাবি যদি স্যারের সাথে এই দেখা না হত তাহলে জীবনের অনেকটাই সোনালি মহূর্ত অধরা থেকে যেত ।প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বয়স বেশি হলে ৬ থেকে ১০ বছরের ভেতর ছিল অথচ সেই দিনগুলোর কথা এখনো মনে আছে বরং কলেজ জীবনের অনেক বেশি বয়সের অনেক মুহূর্তকাল ভুলে বসে আছি।কাঁচা মাটিতে হাতের যে দাগ পড়ে মাটি শক্ত হলে তা আর পড়ে না, এটাই বোধহয় এর প্রকৃত কারণ আর রয়েছে অবদান নিঃস্বার্থ শিক্ষাদানের ।আজ একটা কথাই বলব ,গুরু শিষ্যের যে পরাম্পরার শিক্ষার পাঠ পেয়েছি সেই গরীব স্কুল , গরীব মাষ্টারমশায়দের কাছ থেকে তা যদি এ প্রজন্মে আবার ফিরে আসে তাহলে হয়ত আবার গভীর মূল্যবোধের আদর্শ শিক্ষার পাঠ ফিরে আসবে। আর হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হবে শিশির স্নাত হাজার কমল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress