কুহেলিকা (Kuhelika)
বর্ধমান স্টেশনে নামিয়া জাহাঙ্গীর মউলবি সাহেবকে লইয়া ‘রিফ্রেশমেন্ট রুমে’ ঢুকিয়া পড়িল।
সৌভাগ্যবশত তাহারা দুই জন ছাড়া আর কেহ সেখানে ছিল না।
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘মামারা এখনও মুসলমানকে সন্দেহের চক্ষে দেখে না, তাই আজও দিনের আলোকে কোনোরকমে মউলবি সাহেব সেজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সে কথা যাক, তোর ওপর আবার ভীষণ কাজের ভার পড়বে, পারবি?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘এর মধ্যে তো পারা-না-পারার কথা নেই। যা আদেশ করবেন, তা আমায় পালন করতেই হবে।’
মউলবি সাহেব খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘জিতা রহো লেড়কা! তোকে আবার মালপত্র সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তুই ছাড়া এ-কাজ আর কারুর দ্বারাই হবার নয়।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘সেবার কিন্তু মরতে মরতে বেঁচে গেছি দাদা! আবগারি সাব-ইন্স্পেকটার যখন গাড়িতে উঠে বাক্স-প্যাঁটরা খুলতে আরম্ভ করলে, তখন আমার আত্মারাম তো খাঁচা-ছাড়া হবার যো হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এক জনের প্যাঁটরা থেকে সের কতক আফিম বেরোতেই সে তাকে পাকড়াও করে নেমে গেল। একে একে সব বাক্স যদি খুঁজত, কী হত তাহলে ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে!’ বলিয়াই সামলাইয়া লইল, ‘ভাবনা আমার নিজের জন্য ছিল না – ভাবনা ছিল জিনিসপত্রগুলো নিয়ে। সে ব্যাটাও মরত – হয়তো বা আমিও মরতুম – মাঝে অত দামি জিনিসগুলো বেহাত হয়ে যেত!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, যাক এবার তোদের স্যালুনেই ওগুলো নিয়ে যেতে পারবি ফিরে যাবার সময়। কারুর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ অপ্রসন্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু এবার যে আমার বোধ হয় জোড়ে ফিরতে হবে দাদা!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘দেখ – নিয়তিকে এড়াতে পারবিনে। আমাদের বজ্রপাণিও তো বিবাহিত। শুধু বিবাহিতই নন, ছেলে-পিলে ঘর-সংসার আছে। আসল কথা, তোর যদি সত্যকার দেশপ্রেম থাকে – কোনো ব্যাটাই তোর সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িতেই, তাহারা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। উঠিতে দরজার সামনে এক চিরপরিচিত ব্যক্তিকে দেখিয়া জাহাঙ্গীর থতমত খাইয়া গেল। এ যে সেই ধাড়ি টিকটিকি অক্ষয়বাবু! জাহাঙ্গীরের অবস্থা বুঝিয়াই যেন মউলবি সাহেব কাংস্য কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘আরে বেহোঁশ! আভি টারিন ছোড় দেগা! দৌড়কে চল!’
অক্ষয়বাবু বাজপাখির মতো চোখে তাহাদের দিকে তাকাইয়া থাকিলেন।
জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া অক্ষয়বাবুও পাশের গাড়িতে উঠিয়া পড়িল।
জাহাঙ্গীর ইঙ্গিত করিতেই মউলবি সাহেব বলিয়া উঠিলেন, ‘কুছ ফিকির নেই বাচ্চা, উয়ো হজম হো যায়েগা।’
দেওয়ান সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘আর একটু দেরি হলেই স্টেশনে বসে বসে হজম করতে হত মউলবি সাহেব। আর আপনারা নামবেন না কোথাও! গাড়িতেই খাবার আনিয়ে নেবেন!’
অণ্ডাল স্টেশনে গাড়ি বদল করিবার সময় জাহাঙ্গীর দেখিল, অক্ষয়বাবু তাহাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। সেদিকে আর বেশি দৃষ্টিপাত না করিয়া একটা বই লইয়া পড়িতে লাগিল। তাহাদের গাড়ি হইতে নামিবার ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হইল না। তাহাদের স্যালুন ইঞ্জিন আসিয়া টানিয়া শিউড়ির গাড়ির ন্যাজে জুড়িয়া দিল।
মউলবি সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না, গানটা জান?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘গানটা জানি, কিন্তু গাইতে জানি না। আর জানলেও গাইতাম না।’
পাশের কামরা হইতে মা বলিয়া উঠিলেন, ‘খোকা বুঝি গান-টান একেবারে ভুলে গেছিস?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘হাঁ, মা, ওসব ভুলে যাওয়াই ভালো। অনর্থক কতকগুলো লোকের শান্তিভঙ্গ করে লাভ কী?’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘গানে বুঝি শান্তিভঙ্গ হয়? তুই একেবারে ভূত হয়ে গেছিস খোকা! দুনিয়ায় কি তোর সব আশা-আকাঙ্ক্ষা মিটে গেছে এরই মধ্যে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘বেটি ভয়ানক চালাক! পাশের জানলায় বসে শুনছেন আমরা কী কথা বলা-কওয়া করি!’
সন্ধ্যায় ট্রেন শিউড়ি আসিয়া পঁহুছিল।
হারুণ ছুটিয়া আসিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার ও দেওয়ান সাহেবের পায়ের ধুলা লইল। মাতা তাহাকে জাহাঙ্গীরের মতোই বুকে ধরিয়া শিরশ্চুম্বন করিলেন।
দেওয়ান সাহেব এক ডজন কুলি লইয়া জিনিসপত্র নামাইতে লাগিলেন।
হঠাৎ মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘খোকা, তোর মউলবি সাহেব কোথায় গেলেন?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘উনি এতক্ষণ বোধ হয় তাঁর বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন মা!’
মাতা বলিলেন, ‘সে কী! তুই ওঁর বোনের বাসা চিনিস? সেখান থেকে তাঁকে যে আনতেই হবে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘সে তো আমি চিনি না মা। তা ছাড়া ওঁর বোনের অসুখ, এখন তো যেতেও পারতেন না।‘
হারুণ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন মউলবি সাহেব?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘প্রফেসার আজেহার সাহেব।’
হারুণ বলিল, ‘কই তাঁকে তো দেখলুম না।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘তোমরা যতক্ষণ বোঁচকা-পুটুলি সামলাচ্ছিলে, ততক্ষণ উনি পগার পার হয়ে গেছেন।’
জাহাঙ্গীর দেখিল, অক্ষয়বাবু সারা প্ল্যাটফর্ম মন্থন করিয়া ফিরিতেছেন! সে অত্যন্ত কৌতুক অনুভব করিয়া মনে মনে বলিল, ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি।’
তবু তাহার মনে কেমন একটা অজানা ভয় উঁকি দিয়া ফিরিতে লাগিল।
গোটা চার পালকি ও দুইখানা গোরুর গাড়ি বোঝাই হইয়া জিনিসপত্র সমেত সদলবলে জাহাঙ্গীর হারুণের গ্রামে যাত্রা করিল।
টর্চলাইট ও বন্দুক সাথে ছিল। তাহা ছাড়াও চারি বেহারার পালকি, গাড়োয়ান, ভোজপুরি বরকন্দাজ প্রভৃতির জন্য কেহ আর রাত্রে যাইতে আপত্তি করিল না। আকাশও বেশ পরিষ্কার ছিল, ঝড়-বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। নিদাঘের সুনির্মল আকাশে শুক্লা নবমীর চাঁদ শুক্লা নবমীর চাঁদ ঝলমল করিতেছিল।
পালকিতে উঠিয়া জাহাঙ্গীরের মাতা বলিলেন, ‘বাবা! এ রকম বাক্সবন্দি হয়ে যাওয়ার তো অভ্যাস নেই। একে এই গরম, তার ওপর এইরকম ঘাড়মুড় ভেঙে বসে থাকা। আমি তাই বলছিলাম মোটরটা সাথে আনতে।’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘মোটর না এনে ভালোই করেছেন মা। এ দেশে মোটর যাবার রাস্তা নেই। তার ওপর মাঝে নদী।’
বিচিত্র শব্দ করিতে করিতে পালকি-বাহকগণ অগ্রে অগ্রে চলিল। পশ্চাতে গোরুর গাড়ি, সকলের শেষে বন্দুক স্কন্ধে বরকন্দাজ।
রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় সকলে হারুণদের গ্রামে গিয়া পঁহুছিলেন। পল্লিগ্রামে রাত্রি এগারোটার সময় কেহ সজাগ ছিল না। বেগম দেখিতে হয়তো গ্রামের লোক ভাঙিয়া পড়িত। হারুণ তাহার পিতা ও বোনদের ছাড়া কাহাকেও এ খবর বলে নাই, কাজেই গ্রামেও এ সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে পারে নাই। মোবারক তাহার এক বন্ধুকে এই খবর বলায় সে বিদ্রুপ করিয়া উড়াইয়া দিয়াছিল, উপরন্তু তাহার মাথায় জোর চাঁটি মারিয়া বলিয়াছিল যে, তাহারও পাগল হইবার আর দেরি নাই। ইহার পর সে আর কাহাকেও এ খোশখবর দিতে সাহস করে নাই।
এত পালকি এত লোকজন দেখিয়া মোবারক ভ্যাবাচাকা খাইয়া প্রস্তরবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। মনে হইল, তাহার আক্কেল গুড়ুম হইয়া গিয়াছে। তাহার অন্ধ পিতা ব্যস্ত সমস্ত হইয়া ছুটাছুটি করিতে গিয়া দুইবার আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেলেন। হারুণ তাহার পিতাকে স্থির হইতে বলিয়া জাহাঙ্গীরের মাতাকে সসম্মানে বাড়ির ভিতর লইয়া গেল। দেওয়ান সাহেব বাহির বাড়িতে গিয়া বসিলেন।
জাহাঙ্গীর সামনের খোলা মাঠে বসিয়া হাওয়া খাইয়া বাঁচিল।
তহমিনা ও মোমি আসিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার কদমবুসি করিল। মাতা দুই বোনকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ললাট-চুম্বন করিলেন।
বাঁদিদের হাতে টর্চ-লাইট ছিল, তাহারই আলোকে মাতা অনিমেষ নেত্রে তাঁহার ভাবী বধূর মুখ দেখিতে লাগিলেন। হ্যাঁ, তাঁহার পুত্রবধূ হবার মতো রূপসি বটে!
মাতা বারেবারে তহমিনার ললাট, চিবুক ও শিরশ্চুম্বন করিতে লাগিলেন। তাঁহার অত্যধিক আদরে, কিংবা কেন জানি না, তহমিনা তাঁহার বুকে মুখ রাখিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
মা আঙিনাতেই দাঁড়াইয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন, ‘কেঁদো না মা আমার, সোনা আমার! আর ভয় কী! ও পাগল তোমার অসম্মান করেছে – আমি তোমাকে বুকে তুলে নিতে এসেছি।’
অনেকক্ষণ কাঁদিয়া তহমিনা শান্ত হইল। ভাগ্যক্রমে তাহার উন্মাদিনী মাতা তখন অঘোরে ঘুমাইতেছিলেন, নইলে তিনি হয়তো তাঁহার মিনার জন্য কাঁদিয়া কাটিয়া একাকার করিতেন।
বাড়ির অবস্থা দেখিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার বুঝিতে বাকি রহিল না-দুরবস্থার শেষতম স্তরে ইহারা আসিয়া পড়িয়াছে। তাঁহার চক্ষে জল ভরিয়া আসিল। এমন সোনার চাঁদ মেয়েও এমন ঘরে থাকে!
তহমিনা সকলের জন্য রাঁধিয়া রাখিয়াছিল, সকলে তাহা খাইয়া তাহার রান্নার অশেষ তারিফ করিতে লাগিলেন।
হারুণের পিতা কেবলই বলিতে লাগিলেন, এ গরিবের বাড়ি হাতির পা পড়িবে – ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই। তাহাদিগকে বসিতে দিবার মতো তাঁহার স্থান তো নাই। তাঁহার বিনয় ও অসোয়াস্তি দেখিয়া দেওয়ান সাহেব এবং বেগম সাহেবা ঘনিষ্ঠ আলাপ আপ্যায়নে তাঁহাকে আপন করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। হারুণের পিতা আনন্দে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন।
জাহাঙ্গীরের মাতা নিজে তহমিনা, মোমি ও মোবারককে খাওয়াইলেন। অত্যাধিক গরম পড়ায় তাঁহার সাথে দুইখানা ক্যাম্পখাট খুলিয়া উঠানেই শুইয়া পড়িলেন। তহমিনাকে পাশের খাটে শোয়াইয়া আদর করিতে করিতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়া তাহার মনের কথা বাহির করার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
তহমিনা জীবনে এত স্নেহ পায় নাই। সে এই আদরে গলিয়া গিয়া ছোটো খুকিটির মতো তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া শুইয়া দুই একটি কথায় তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিল।
দেওয়ান সাহেব হারুণের পিতার মনোভাব বুঝিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সে রাত্রে আর বেশি কথা হল না। পথশ্রান্তিতে সকলেই শীঘ্র ঘুমাইয়া পড়িল।
তহমিনার চক্ষে ঘুম ছিল না। সে যখন দেখিল, সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, অথচ তাহার ঘুম আসিতেছে না, তখন সে উঠিয়া উন্মাদিনী মাতার খোঁজ লইতে গেল। উঠান হইতে অন্দরে যাইবার পথেই সদর দরজা। সে দেখিল, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে। দরজা বন্ধ করিতে গিয়া হঠাৎ তাহার সামনে মাঠের উপর দৃষ্টি পড়িল। দেখিল, অস্তমান চন্দ্রের ম্লান চন্দ্রালোকে বসিয়া জাহাঙ্গীর আকাশের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে। সে আর চোখ ফিরাইতে পারিল না, নির্নিমেষ নেত্রে তাহার পানে তাকাইয়া রহিল।
কেন সে অতন্দ্রনয়নে একা জাগিয়া শূন্য আকাশে চাহিয়া আছে? এই সুন্দর পৃথিবীতে কী তাহার চাহিবার কিছুই নাই। এত ঐশ্বর্য, এমন মা যাহার তাহার কেন এই দুঃখ-বিলাস?
তহমিনা বুঝিতে পারিয়াছিল, কেন হঠাৎ জাহাঙ্গীরের মাতা সদলবলে আসিয়া হাজির হইয়াছেন। তাহার আরও মনে হইতে লাগিল, হয়তো জাহাঙ্গীরই তাহার মাতাকে লইয়া আসিয়াছে। ভাবিতেই তাহার মন অভূতপূর্ব আনন্দে কানায় কানায় পুরিয়া উঠিল। তাহা হইলে, যতটা হৃদয়হীন সে জাহাঙ্গীরকে মনে করিয়াছিল, ততটা হৃদয়হীন সে নয়!
কিন্তু কী রকম বদরসিক লোকটা? একবারও কি ভুলিয়া খোলা দরজার দিকে তাকাইতে নাই?
সে যেন দরজা বন্ধ করিবার জন্যই দুই কবাটে আঘাত করিল এবং যুগল কবাটের স্বল্প অবকাশ দিয়া দেখিতে লাগিল, জাহাঙ্গীরের ধ্যান ভঙ্গ হইয়াছে কিনা।
জাহাঙ্গীর দরজার দিকে তাকাইল এবং একজন দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ইহাও বুঝিতে পারিল। সে মনে করিল, কোনো প্রয়োজনে হয়তো তাহার মাতা তাহাকে ডাকিতেছেন। সে দরজা ঠেলিতেই তহমিনাকে দেখিয়া চমকাইয়া প্রশ্ন করিল, ‘কে? ভূণী? আমায় ডাকছিলে?’
ভূণী ওরফে তহমিনা লজ্জায় মরিয়া গিয়া কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়াইয়া রহিল, ছি ছি, একী বেহায়াপনা সে করিল!
জাহাঙ্গীর আবার প্রশ্ন করিল, ‘আমাকে কি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবে?’
ভূণী হঠাৎ যেন কূল পাইল। সে অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে সহজ হইবার চেষ্টা করিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আবার এলেন কেন জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
জাহাঙ্গীর আহত হইয়া তাহার চোখে চোখ রাখিয়া বলিল, ‘আমি তো আসিনি, মা এসেছেন তোমায় নিয়ে যেতে!’
তহমিনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা তা হলে সব শুনেছেন?’
জাহাঙ্গীর ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘শুনেছেন নয় – জেনেছেন তোমার চিঠি পড়ে!’
তহমিনা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘মা গো কী হবে! ছি ছি! তুমি চিঠি দেখালে কেন?’
জাহাঙ্গীর এইবার একটু জোরেই হাসিয়া ফেলিল।
তহমিনা উত্তেজনায় জাহাঙ্গীরের মুখের কাছে হাত আনিয়া সহসা থামিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘দোহাই! অত জোরে হেসো না, কেউ জেগে উঠবে।’
জাহাঙ্গীরের মনে নেশা ধরিয়াছিল। সে আয়তচক্ষু মেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি যাবে তো?’
তহমিনা লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলিল, ‘সে তো আপনিই জানেন!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘বাঃ রে! বেশ তো! একবার “আপনি!” একবার “তুমি” একবার “হিঁয়া আও” –একবার “ভাগো”!’
জাহাঙ্গীরের মাতা পাশ ফিরিয়া শুইতেই তহমিনা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেই অসাবধানে তাহার হাতের একটা আঙুল দুই দরজার মাঝখানে পড়িয়া পিষ্ট হইয়া গেল। সে ক্ষীণ আর্তনাদ করিয়া বসিয়া পড়িল।
জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া প্রশ্ন করিল, ‘কী হল ভূণী? কিছুতে কামড়েছে?’
ভূণী সে স্পর্শে কন্টকিত হইয়া মনে মনে বলিল, ‘কামড়েছে বিষধর সাপে!’ বাহিরে বলিল, ‘আঙুলটা দরজায় বড্ড চিপে গেছে!
জাহাঙ্গীর ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও দেখিতে পাইল সত্যসত্যই আঙুলটা নীল হইয়া উঠিয়াছে। সে ভূণীর হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইল।
সে তাড়াতাড়ি আঙুলটা লইয়া চুষিতে চুষিতে বলিল, ইস! রক্ত জমে নীল হয়ে গেছে! একটু ভিজে ন্যাকড়া আনতে পার?’
তহমিনা তাহার অঙ্গুলিতে জাহাঙ্গীরের উত্তপ্ত মুখের শোষণ যতই অনুভব করিতেছিল, ততই পুলকে তাহার অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিতেছিল। সে আর থাকিতে পারিল না – মূর্চ্ছিতার মতো জাহাঙ্গীরের অঙ্গে হেলিয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর দিশা হারাইল। বক্ষে তহমিনার তপ্ত কোমল বক্ষের স্পর্শ পাইতেই তাহার রক্তে যেন তাহার পিতার লালসা বহ্নি জ্বলিয়া উঠিল।
সে জীবনে সংযম হারায়নি, আজ সে সংযম হারাইল। তহমিনাকে বিপুল আবেগে বক্ষে অজস্র পিষিতে পিষিতে জাহাঙ্গীর তাহার নিষ্কলঙ্ক গণ্ড অজস্র চুম্বন-কলঙ্কে ভরিয়া দিল।
তহমিনা সুখে, লজ্জায়, উত্তেজনায় শিথিল-তনু শিথিল-বসন হইয়া পড়িল। সে কিছুতেই যেন নিজেকে সংবরণ করিতে পারিতেছিল না। মনে হইল তাহার নড়িবার শক্তিটুকু পর্যন্ত কে হরণ করিয়া লইয়াছে! শুধু তাহার দুই বাহু দিয়া প্রাণপণ শক্তিতে জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ জড়াইয়া একবার অস্ফুট মিনতি করিল।
দেবকুমার এক মুহূর্তে রক্ত-লোলুপ পশু হইয়া উঠিল!
তহমিনা এইবার যেন কতকটা তাহার অবস্থা বুঝিতে পারিল। সে তাহার শিথিল বাহু দিয়া এক একবার বিবসন-অঙ্গ আবৃত করিতে ও এক একবার জাহাঙ্গীরকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু সেও আর পারিল না। অনাস্বাদিতপূর্ব উন্মাদনায় তাহারও দেহ যেন টনটন করিয়া উঠিল। সে আর বাধা দিতে পারিল না। জাহাঙ্গীরের বক্ষতলে বহুক্ষণ অজ্ঞানবৎ পড়িয়া থাকিয়া তহমিনা উঠিয়া দাঁড়াইল। বস্ত্র সংবরণ করিতে করিতে সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, এ কী সর্বনাশ করলে তুমি আমার? আমি কী করে মুখ দেখাব কাল?
জাহাঙ্গীর কোনো উত্তর না দিয়া মাতালের মতো টলিতে টলিতে চলিয়া গেল।
এ কী করিল সে? পঙ্কজ হইলেও নিজেকে পঙ্কের ঊর্ধ্বে শতদলের মতো তুলিয়া ধরিবার তপস্যা সে করিতেছিল। তাহার যে স্বদেশ-মন্ত্রের পবিত্র অগ্নিতে অগ্নিশুদ্ধি হইয়া গিয়াছে! স্বর্গে আরোহণ করিতে করিতে এ কোন রসাতলে সে পতিত হইল! অনুতাপে অনুশোচনায় তাহার আত্মহত্যা করিবার এচ্ছা করিতে লাগিল! কিন্তু এ কী! এক মুহূর্তে সে যেন অতি বড়ো কাপুরুষ হইয়া উঠিয়াছে। তাহার এখন মৃত্যুকে ভয় হইতেছে! আর সে অসংকোচে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইতে পারে না! সে তো তহমিনার সর্বনাশ করে নাই, সর্বনাশ করিয়াছে সে নিজের।
জাহাঙ্গীর মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া অসহায় শিশুর মতো রোদন করিতে লাগিল।
হঠাৎ কাহার শীতল স্পর্শে সে চমকিয়া চাহিয়া দেখিল – একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপ তাহার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে। সে শুনিয়াছিল, এ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সাপের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব।
সে মনে করিল, স্বয়ং বিধাতা বুঝি তাঁহার দণ্ড প্রেরণ করিয়াছেন। সে নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া রহিল। তাহার অঙ্গ বহিয়া সাপ চলিয়া গেল।
তবে কি মৃত্যুও তাহাকে ঘৃণা করে? ক্লান্ত হইয়া সে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িল।