Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কুশলের সাইকেল || Sanjib Chattopadhyay

কুশলের সাইকেল || Sanjib Chattopadhyay

কুশলের সাইকেল

অমরবাবু মানে অমর বসু আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন। ব্যাকরণ যতটা নীরস, অমরস্যার তার চেয়েও নীরস ছিলেন। চেহারাটা ছিল কোষো পেয়ারার মতো। আমরা নাম রেখেছিলুম সব্যসাচী স্যার। ডান হাত, বাঁ হাত দুটোই সমান চলত। বেত আর ডাস্টার দুটোই চালাতেন অক্লেশে। আর একটা কী? বাদ দিতেন না কাউকে। ফার্স্ট থেকে লাস্ট বেঞ্চ, সবাই গোল আলু, ঠিকরে আলু। আঁচড়, শুধু কামড়টাই বাদ যেত। আমরা বলাবলি করতুম, আর একটু বয়স বাড়লে ক্লাসে আমাদের কামড়েও দিতে পারেন। তবে একটাই কথা—সব্যসাচীস্যারের বয়স বাড়লে আমাদেরও বয়স বাড়বে। বছরের পর বছর ফেল না করলে আমরা পাসটাস করে বেরিয়ে যাব। তখন যাকে কামড়াবেন, তাকে কামড়াবেন, আমাদের দেখার দরকার নেই।

অমরস্যারের ছেলের নাম কুশল। কুশল আমাদের সঙ্গেই পড়ে। ফাস্ট বেঞ্চে বসে। ভালো ছেলে। ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। অঙ্কে আর ইংরেজিতে ভীষণ ভালো। কুশলের তেমন অহংকার নেই। আমাদের সঙ্গে মেশে। মুখ গোমড়া করে বসে থাকে না। কুশলের চোখ খুব খারাপ। পুরু লেন্সের চশমা চোখে। কাচের আড়ালে বড়-বড় চোখদুটো ঝকঝক করে। কুশল একটু তড়বড় তড়বড় করে কথা বলে। কথা বলার সময় হাত নাড়ে খুব। ছেলেটা খুব সরল। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব। স্কুল ছুটির পর ক্লাসরুমে বসে দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করি। তার কাছে আমি আবার অঙ্ক বুঝে নিই। যে-অঙ্ক আমি জীবনে কষতে পারব না, কুশল তা নিমেষে করে ফেলে।

যে-কুশল কখনওই স্কুল কামাই করে না, সে পরপর তিনদিন ক্লাসে আসছে না। ব্যাপারটা কী হল! অমরস্যারকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘স্যার, কুশল কেন আসছেনা?’

‘কুশল কেমন আছে কুশল জানে, আমাকে জিগ্যেস কোরো না।’ ভয়ে পালিয়ে এলুম। আমার আর-এক বন্ধু অপূর্বকে বললুম, ‘কুশলের কী হল বল তো?’

‘চল না ছুটির পর দেখে আসি।’

‘স্যার যদি মারেন!’

‘কারও বাড়ি গেলে মারে! মারামারি সব ক্লাসে।’

স্কুল থেকে প্রায় এক মাইল হবে কুশলদের বাড়ি। খেলার মাঠ, বোসদের ঝিল, বরফকল, হরেনবাবুর কাঠকল পেরিয়ে, শ্মশানের পাশ দিয়ে, নদীর ধারে বাড়িটা। বড়লোকদের বড়-বড় বাগানবাড়ি, সারাদিন ঝিম মেরে থাকে। সেইরকম দুটো বাগানবাড়ির মাঝখানে অমরস্যারের বাড়ি। বেশ বড় একটা উঠোন। উঠোনের মাঝখানে একটি কামিনী গাছ। লাল দালান। পেছনেই নদী। বাড়িটা বেশ শান্ত। আমরা ডাকছি, ‘কুশল, কুশল!’ কোনও সাড়া নেই। সময়টা বিকেল বিকেল। কৃষ্ণকলির ঝোপে সাদা, হলুদ, নীল ফুল ফুটেছে। কামিনীর ডালে চড়াই পাখির ঝাঁক গল্প করছে। আবার ডাকলুম—’কুশল’! আমরা এই প্রথম কুশলদের বাড়িতে আসছি।

অমরস্যারের ভয়ে আগে কখনও আসিনি। বেশ ভয়-ভয় করছে। এইবার একটু জোরে ডাকলুম, ‘কুশল’। মায়ের মতো দেখতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, ‘তোমরা কে বাবা?

‘আমরা কুশলের বন্ধু। কুশল কেন স্কুলে যাচ্ছে না মাসিমা?’

‘কুশল তো হাসপাতালে।’

‘হাসপাতালে! কেন কী হয়েছে?’

‘তোমরা জানো না!’

‘কোন হসপাতালে মাসিমা?’

‘জেলা হাসপাতালে।’

‘কী হয়েছে কুশলের?’

‘কুশলকে আর চেনা যাচ্ছে না। চুনের গামলায় পড়ে গেছে।’

আমি আর অপূর্ব দু’জনে বোকার মতো মুখের দিকে তাকালুম। কুশলের মা বললেন, ‘আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই বাবা, আমি এখন কুশলকে দেখতে যাচ্ছি। তোমরা আসবে তো এসো।’

হাসপাতালের বিছানায় কুশল শুয়ে আছে। গোটা শরীর সাদা ব্যান্ডেজে জড়ানো। মুখেও ব্যান্ডেজ। শুধু নাকের একটুখানি আর চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। কুশল চিত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটা বোয়াল মাছ। চোখ দুটো গুলির মতো জ্বলজ্বল করছে। নাকটা মাছ ধরার। ফাতনার মতো জেগে আছে। ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে কুশল একটা কিছু বলার চেষ্টা করল। কাচের জানালায় ডুমো মাছি আটকে গেলে যেমন বুজুর-বুজুর শব্দ হয়, সেইরকম একটা শব্দ ছাড়া কিছুই বোঝা গেল না।

আমি আর অপূর্ব দুজনে দুটো টুলে বসলুম। কুশলের বিছানা ঘেঁষে। কুশলের মা বসে আছেন মাথার কাছে। ছেলের চুলে হাত বুলোচ্ছেন। চুল ছাড়া শরীরে আর কোনও অংশই তো খোলা নেই। অপূর্ব বলল,—’তুই কী করে এমন হয়ে গেলি কুশল?’ কুশল কাচের গায়ে মাছির গলায় যা বলল, সেটা হল—কুশলের অনেকদিনের ইচ্ছে, সাইকেল চালানো শিখবে। অমরস্যার বারবার সাবধান করেছিলেন, ‘কুশল, টেস্ট পরীক্ষার আগে সাইকেল-মাইকেল নিয়ে মেতো না। পরীক্ষার পর তুমি নর্দমায় পড়ো; খানায় পড়ো আমার কিছু বলার নেই।’ কুশল বাবার কথা অমান্য করেছে।

‘তা লোকে তো সাইকেল নিয়ে খানায় পড়ে, তুই চুনের গামলায় পড়লি কী করে?’

বুজুর-বুজুর করে ব্যান্ডেজের তলা থেকে কুশল বলে গেল, ‘আমার ছোটমামার একটা সাইকেল আছে। যেমন বড়, তেমন ভারী।’

‘তাতে তোর কী?’

‘ছোটমামা অনেকদিন থেকে বলছিলেন, কুশল, সাইকেলটা শিখে রাখ, ব্যাটাছেলের সাইকেল শেখা খুব দরকার। অনেক উপকারে লাগবে।’ বললেন, ‘একমাস সাইকেলটা ধরে হাঁট। সাইকেলটা পাশে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁট। সাইকেলটা তোর পাশে থাকতে-থাকতে বেশ পোষ মেনে যাবে। তারপর হঠাৎ একদিন তার ওপর চেপে বসাব।’

‘তা তুই হাঁটলি?’

‘সেই হাঁটতে গিয়েই তো এই কাণ্ডটা হল। ঘোষালদের দোকান চুনকাম হবে, পয়লা বৈশাখ এসে। গেল। গরুর জাবর খাওয়ার বড় গামলায় চুন ভেজানো ছিল। গামলাটা ছিল পথের পাশে। সাইকেলটা মাঝে-মাঝে আমাকে হ্যাঁচকা টান মারছিল। আমিও টান মারছিলুম। টানাটানি চলছিলই। গামলাটার কাছে এসে সাইকেলটা লগবগিয়ে শুয়ে পড়তে চাইল। আমিও মারলুম টান। সাইকেলটা আমার ঘাড়ের ওপর শুয়ে পড়ল, আমিও শুয়ে পড়লুম চুনের গামলায়। সবাই এসে যখন উদ্ধার করল তখন আমি চুনে ভিজে সপসপে হয়ে গেছি।’

সাতদিন পরে কুশল স্কুলে এল। রংটা বেশ ফরসা দেখাচ্ছে। চোখ দুটো কোনওক্রমে বেঁচে গেছে। চুন ঢুকে গেলে আর কিছু করা যেত না। নাকে ঢুকে গেলেও সাঙ্তিক ব্যাপার হত। কুশল বলল, ‘সাইকেলটার ওপর ভয়ংকর প্রতিশোধ নোব।’

‘কীভাবে নিবি?’

‘হাফ প্যাডল, ফুল প্যাডলের মধ্যে যাব না। একেবারে সিটে চেপে বসব। প্যাডলে পা। ব্যাপারটার মধ্যে হাতি-ঘোড়া কিছু নেই। শুধু ভোলার ব্যাপার।’

‘ভোলার ব্যাপার মানে?’

‘মানে ভুলতে হবে যে, আমি সাইকেল চেপে আছি। ভুলতে হবে যে আমি সাইকেল চালাতে জানি না। পৃথিবীর বড়-বড় মানুষ বড় হয়েছে কীভাবে জানিস? ভয়কে জয় করে। দুটো কথা মনে রাখবি—পারিব না, এ-কথাটি বলিও না ভাই, এটা হল প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হল, আমি ভয় করব না ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’

‘এতেই হয়ে যাবে?’

‘হয় কি না দেখবি চল।’

কুশলের সঙ্গে কুশলের মামার বাড়িতে গেলুম। কুশল আমাদের ম্যাজিক দেখাবে। সাইকেল। চালানোনা শিখেই পাকা চালিয়ের মতো সাইকেল চালাবে। স্রেফ দুটো কথার ওপর নির্ভর করে, ‘পারিব না এ কথাটি’ আর ‘আমি ভয় করব না’। কুশল সাইকেলটা বাড়ি থেকে রাস্তায় বের করে। আনল। বেশ তাগড়া, শক্তপোক্ত একটা সাইকেল। কুশলের মেজোমামা লম্বা মানুষ, তাই সিটটা বেশ উঁচু করা। রাস্তাটা সোজা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। পশ্চিমে গঙ্গা। রাস্তাটা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেকালের জমিদারদের করা ঘাট। একটু ভেঙে এলেও বেশ সুন্দর। বিশাল চাতাল। ধাপে-ধাপে পইঠা নেমে গেছে জলে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন লোক চলাচল নেই। দু পাশে বাগানবাড়ি, প্রাচীন মন্দির। বড়-বড় গাছ। বেশ স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশ।

কুশল বলল, ‘আজ তোদের আমি দেখাতে চাই, কী দেখাতে চাই?’

‘সাইকেল চড়া।’

‘না সাইকেল চড়া নয়, আজ প্রমাণ করব, মানুষের মনই সব। মনই সব করে। যে জীবনে কখনও সাইকেল চড়েনি, সে সাইকেলে চড়ে চালাতে-চালাতে চলে যাবে।’

কুশল একটারকের কাছে সাইকেলটাকে নিয়ে এল। গম্ভীর মুখে বললে, ‘একটু বেআইনি হচ্ছে, মানে, রকে উঠে সিটে বসব। প্যাডেলে পা রেখে সাইকেলে চড়া, প্রথমেই পারব না। পড়ে মরব। অনেক পেকে গেলে তবেই ওভাবে চড়া যায়। আশা করি এতে তোমাদের আপত্তি হবে না।’

আমরা বললুম, ‘না, না, এতে আমাদের কোনও আপত্তি হবে না।’

কুশল রক থেকে বীরের মতো সাইকেলের সিটে উঠে বসল। বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইবার আমি আমার মনকে বলব, মন! তুমি কাঁচা নও, পাকা সাইকেল চালক। তুমি সাইকেলে ভূ-পর্যটন করে এসেছ। তুমি সাইকেল চড়ে পৃথিবীতে এসেছ, সাইকেল চড়েই স্বর্গে যাবে।’

কুশল প্যাডেলে পা রেখে চাপ দিল। ডান দিকে হাতল ঘুরিয়ে লগবগ করে রাস্তায় নেমে পড়ল। আমরা ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললুম। কুশল পড়বে, সাঙ্ঘাতিকভাবে পড়ে হাড়গোড় চুরমার করে ফেলবে। চোখ খুলে দেখি, কুশল অনেকটা দূরে চলে গেছে। সাঁই সাঁই করে গঙ্গার দিকে চলেছে। আমরা পেছন-পেছন দৌড়োচ্ছি। কুশল উল্কার মতো সামনে ছুটছে। রাস্তা শেষ। কুশল ঘাটের চাতালে। আমরা চিৎকার করছি, ‘নেমে পড় নেমে পড়।’ চাতাল শেষ করে কুশল। সাইকেলসুষ্ঠু লাফাতে-লাফাতে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে সোজা জলে নেমে গেল।

আমরা কোনওরকমে কুশলকে টেনেটুনে জল থেকে তুললুম। ডান পাটা ভেঙে গেছে। ডান হাত চুরমার। মনে আছে আমাদের, হাসপাতালে কুশলের জন্যে আলাদা একটা বেড রাখা হয়েছিল। কারণ, কুশল মনের জোরে সবকিছু করতে চাইত। তার ফলে দেহ কাবু হয়ে পড়ত। স্কুলে, কুশলের শেষ মনের জোর যা দেখেছিলুম, তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়া। কুশল দেখাতে চেয়েছিল, মনের জোরে মানুষ পাখির মতো উড়তেও পারে। সেবার তিন মাস শুয়ে ছিল। হাসপাতালে।

আজ, কুশল একজন বড় বিজ্ঞানী। আমেরিকায় থাকে। আমাকে আর অপূর্বকে হয়তো আর মনে নেই। এইটুকু জানি, কুশল মনের জোরেই বড় হয়েছে। অমরস্যার হঠাৎ মারা গেলেন। কুশল নিজেকেই নিজে বড় করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress