শশীবাবু মারা গেছেন
কবরেজমশাই সকালেই খবর পেলেন, শশীবাবু মারা গেছেন। প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে যখন শশীবাবুর বাড়িতে হাজির হলেন, তখন ভিড় জমে গেছে বাইরে। কান্নাকাটি পড়ে গেছে। নন্দ কবিরাজের বুকের ভেতরটা হাহাকারে ভরে যাচ্ছিল। নিমিত্তের ভাগী কি তিনিই হলেন?
ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখেন, গাঁয়ের মাতব্বররা সব শোকাতুর মুখে দাঁড়িয়ে। শুভ্র শয্যায় শশীবাবু শয়ান। মুখটা একটু কাত হয়ে আছে। একজন মস্ত চেহারার রক্তাম্বর পরা, জটাজুটধারী তান্ত্রিক মাথার কাছে বসা। তাঁর পায়ের কাছে পড়ে কাঁদছে ক্ষান্তমণি আর বলছে, “আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দিন … বাঁচিয়ে দিন।”
তান্ত্রিক দুঃখের গলায় বললেন, “তাই কি হয় মা, প্রাণপাখি একবার উড়ে গেলে আর কি খাঁচায় ফেরে। তবে বড় অকালেই চলে গেল শশী। এইটুকু দেখেছিলুম। কতই বা বয়স তখন, সাত-টাত হবে। ওর উপনয়নে আমিই তো ছিলাম আচার্যগুরু। সাবিত্রীমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলাম। এই একশো নব্বই বছর বয়সে আমি তো দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছি, পাহাড়ে উঠছি, কাঠ কাটছি, দিনে দশ বারো ক্রোশ হাঁটছি। আর দ্যাখো, কচি বয়সেই শশীটা চলে গেল। তাও স্বাভাবিক মৃত্যু হলে দুঃখের তেমন কিছু ছিল, কিন্তু মরলও তো অপঘাতে কিনা, গতি কী হবে কে জানে!”
নন্দ কবিরাজ অবাক হয়ে বললেন, “অপঘাতে?”
এবার তান্ত্রিক তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি কে গো খোকাটি?”
ক্ষান্তমণি বলল, “উনি কবরেজমশাই। বাবার চিকিৎসা উনিই করছিলেন।”
“বাঃ বাঃ। তা এসো, দেখে যাও শশীকে। তোমার চিকিৎসা তো কাজে লাগল না বাবা, শশীকে আজ ভোররাতে কে যেন গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। গলায় আঙুলের দাগ একেবারে স্পষ্ট।”
নন্দ কবিরাজ ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। গ্লানিতে তাঁর ভেতরটা ভরে যাচ্ছে। কোনওক্রমে গিয়ে শশীবাবুর নাড়িটা দেখলেন। নেই। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলেন। খাস চলছে না। গলাটা একটু ঝুঁকে দেখলেন। কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। গলায় মোটা-মোটা আঙুলের স্পষ্ট দাগ। ও হাত যে কোন হাত, তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কে জানে!
তান্ত্রিক বললেন, “তোমরা আর মরা মানুষের ঘরে ভিড় কোরো না। শশীর অপঘাতে মৃত্যু হওয়ায় আমি ওর মৃতদেহ কিছু সংস্কার করব, যাতে ওর আত্মার সদগতি হয়। অন্তিম সংস্কারও আমিই করব। আমার চারজন চেলা বাইরে অপেক্ষা করছে, তারাই আজ রাতে শ্মশানে নিয়ে যাবে।
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে এবং কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলেন। দুঃখের মধ্যে একটাই আশার আলো। এবার হয়তো বদমাশ দিনু বিশ্বাস তাঁর নাতি বালুকে ফেরত দেবে।
সকালবেলায় যখন একজন ঘোড়সওয়ার এসে গাঁয়ে দিনুর রাজা হওয়ার কথা ঘোষণা করতে লাগল, তখন কবরেজমশাই বুঝতে পারলেন, হাতটাকে দিনু সত্যিই কাজে লাগিয়ে ফেলতে পেরেছে। এর পরিণাম যে কী ভয়াবহ, তা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি। নিজের অবিমৃশ্যকারিতাকে ধিক্কার জানাতে লাগলেন বারবার।
লোকটা যখন কুঞ্জপুকুরে চক্কর দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তখন বাঁশবনের কাছে তাকে ধরলেন নন্দ কবিরাজ। পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন, “ওহে বাপু, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
ঝিকু ঘোড়া থামিয়ে বলল, “বলুন কবরেজমশাই।”
“দিনু আমার নাতিকে চুরি করেছিল। দুটো শর্তে ফেরত দেওয়ার কথা। শর্ত দুটোই পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমার নাতি কই?”
ঝিকু ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। তারপর কাছে এসে চাপা গলায় বলল, “এরকম আহাম্মক নোক আর দেখিনি, বুঝলেন। একেবারে আকাট।”
“কে? কার কথা বলছ?”
ঝিকু গলা আরও এক পরদা নামিয়ে বলল, “দিনুদাদার কথাই বলছি। রাজা-গজা মানুষ, প্রকাশ্যে তাঁর নিন্দে করলে গদান যাওয়ার ভয় আছে। তবু না বলেও পারছি না। অমন ফুটফুটে নাতি আপনার। ওর দাম কি মোটে দুশো টাকা?”
নন্দ কবিরাজ হাঁ হয়ে গিয়ে বললেন, “কী বলছ বাপু?”
“সেই কথাই তো বলছি। ওরকম ছেলের এ বাজারে হেসে-খেলে দু থেকে পাঁচ হাজার টাকা অবধি দর উঠবে। আর ৬৮
দিনুদাদা মাত্র দুশো টাকায় বেদেদের কাছে বাচ্চাটাকে বিক্রি করে দিল!”
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “বেদেদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে? বেদেদের কাছে…”
“বলে কিনা, উটকো ঝামেলা ঘাড়ে রাখতে চাই না, তাই শস্তায় বেচে দিলাম। সে না হয় হল। কিন্তু দরটা অমন কম করে বলার মানে হয়? আপনিই বিবেচনা করে দেখুন না, আপনারই তো নাতি, হেসে-খেলে দুটি হাজার টাকা আদায় হত না? এই বুদ্ধি নিয়ে উনি চালাবেন রাজত্ব! তবেই হয়েছে।”
কিন্তু নন্দ কবিরাজের কানে ঝিকুর আর কোনও কথাই ঢুকল না। তিনি মূৰ্ছিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
ঝিকু মাথা নেড়ে বলল, “দুঃখ হওয়ারই কথা। অমন নাতি এত শস্তায় বিক্রি হয়ে গেছে শুনলে কোন দাদুর না দুঃখ হয়?”
এই বলে ঝিকু ঘোড়ায় চেপে চলে গেল।
মূর্ছা ভেঙে নন্দ কবিরাজ উঠলেন আরও আধঘণ্টা পরে। শরীরটা কাঁপছে। মন ভারাক্রান্ত। বুকও ভার হয়ে গেছে। ভাবলেন, বাড়ি ফিরে গিয়ে বিষ খাবেন আজ। তারপর ভাবলেন, নিজের কর্মদোষে যখন এত ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছি, তখন মরার আগে এই জট না ছাড়িয়ে মরছি না।
দুর্বল শরীরটা টেনে তুললেন নন্দ কবিরাজ। তারপর বাড়ি ফিরে একটা বলকারক পাঁচন তৈরি করে খেয়ে নিলেন। পাঁচনের গুণেই হোক, বা তীব্র অনুতাপের দরুনই হোক তাঁর শরীর আর মনের দুর্বলতা কেটে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে। চোখ দুটো জ্বালা করছিল।
হুট করে আর কিছু করে বসবেন না বলে ঠিক করলেন তিনি। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। ভেবে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দিনকয়েক যেতে-না-যেতেই খবর পাওয়া গেল, রাজ্যের গুণ্ডা বদমাশ, চোর-ডাকাত সব গিয়ে দিনুরাজার আস্তানায় জুটেছে। মোটা নজরানা দিয়ে তারা বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। গাঁয়ের মেলা লোকও রোজ নজরানা নিয়ে দিনুরাজাকে সেলাম ঠুকে আসছে। তাদের নামধাম সব টুকে নেওয়া হয়েছে একটা জাবদা খাতায়। যাদের নাম উঠছে, দিনুরাজা তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে। রাজবাড়িও প্রায় শেষ হয়ে এল। হাতের কেরামতিতে ধাঁধাঁ করে বাড়ি উঠে গেছে। গম্বুজ বসালেই হয়। হস্তশিল্পী গৌরহরিকে মন্ত্রী করা হয়েছে। ভীম দাস হয়েছে সেনাপতি। জটেশ্বরকে দেওয়া হয়েছে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভার।
একদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে এসে সদাশিব দারোগা কবিরাজমশাইকে জিজ্ঞেস করল, “নন্দবাবু, ‘দৌবারিক’ কথাটার মানে কী বলুন তো?”
“দৌবারিক কথাটার মানে? কেন বলুন তো?”
“আজ্ঞে, বড্ড ঠেকায় পড়ে গেছি। দিনুরাজা আমাকে তাঁর প্রধান দৌবারিক করতে চেয়ে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমিও রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু মুশকিল হল, দৌবারিক কাকে বলে সেটাই জানি না।”
“আপনি কি দিনুর জাবদা খাতায় নাম লিখিয়ে এসেছেন নাকি?”
সদাশিব কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “কী করব কবরেজমশাই! বদলির দরখাস্ত করেছিলাম, তা সরকারবাহাদুর আমার দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দিয়েছেন। এ তল্লাটে যদি থাকতেই হয়, তা হলে দিনুরাজার কাছে মাথা না মুড়িয়ে থাকব, আমার ঘাড়ে কটা মাথা? জানেন তো, দিনুরাজা যে জায়গায় রাজবাড়ি করেছেন, তার দু’জন দাবিদার এসে হাজির হয়েছিল। দিনুরাজার পাইক বরকন্দাজরা তাদের গান নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে গিয়েছিল। তারা তখন চি-চি করতে করতে গোটা জমিটা দিনুরাজার নামে দানপত্র লিখে সই করে দিয়ে গেছে। নয়াগঞ্জের কুস্তিগির বীরবাহাদুর নজরানা না নিয়ে দিনুরাজার সামনে গিয়েছিল বলে তাকে কান ধরে পাবলিকের সামনে ওঠাবসা করানো হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, শশীবাবুর হাতটা নাকি এখন দিনুরাজার হাতে। তার জোরেই এতসব হচ্ছে। তা, নাম না লিখিয়ে কী করি বলুন!”
কবরেজমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে দৌবারিক কথাটার মানে না জানাই আপনার পক্ষে ভাল। গাঁয়ের লোকও বেশিরভাগই মানেটা জানে না। চাকরিটা বরং নিয়েই ফেলুন।”
“মানেটা কি খুব খারাপ কবরেজমশাই?”
“মাইনেটা যদি ভাল হয়, তা হলে মানেটা খারাপ হলেই বা কী যায়-আসে?”
সদাশিব একগাল হেসে বললেন, “আজ্ঞে, মাইনেটা খুবই ভাল। আপাতত দু হাজার টাকা। উপরি আছে। ক্ষমতাও মেলা।”
“তা হলে আর কী! লেগে যান কাজে।”
“আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে একটু যেন রেগে আছেন। তা আমি বলি কি কবরেজমশাই, রাগটাগ করে লাভ নেই। অবস্থা বুঝেই তো ব্যবস্থা করতে হয়। শশীবাবুর হাতটা কীভাবে দিনুরাজার হাতে চলে গেল, তা আমরা জানি না। কিন্তু যখন গেছে, তখন হাকিম সাহেবের হুকুম না মেনে কি উপায় আছে? বলুন আপনি।”
কবরেজমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শশীবাবুর হাত আজ খারাপ একটা লোকের হাতে গেছে বলেই কি আমাদেরও খারাপ হতে হবে সদাশিববাবু?”
সদাশিব একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন, “শুধু আমাকেই কেন দুষছেন কবরেজমশাই? আপনি কি জানেন, স্কুলের হেডস্যার হয়েছেন দিনুরাজার শিক্ষামন্ত্রী, হেডপণ্ডিতমশাই গতকালই দিনুরাজার সভাপণ্ডিতের চাকরিতে জয়েন করেছেন, বিজ্ঞানের মাস্টার রতন বোস হয়েছেন সভা-প্রযুক্তিবিদ। দিনুরাজা একটা উড়ন্ত চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝে গগনপথ থেকে তাঁর রাজ্যের এরিয়েল সার্ভে করবেন। রতন বোস তাঁর চেয়ারে সিটবেল্টের ব্যবস্থা করছেন। দশটা গাঁয়ের আরও কত মানুষ চাকরির আশায় দিনুরাজার দরবারে ঘুরঘুর করছে, তার হিসেব নেই।”
কবরেজমশাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “বটে!”
“শুনছি, আপনাকে রাজবৈদ্য করার প্রস্তাব নিয়ে লোক এল বলে!”
কবরেজমশাইয়ের মুখটা রক্তাভ হয়ে গেল রাগে। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, “পাষণ্ডটা আর কী করতে চায়?”
সদাশিব একটু হেসে বললেন, “দিনুরাজা মনে করেন, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি আনঅর্গানাইজড ক্রাইম। ওতে সমাজে বিশৃঙ্খলাই বাড়ে। তাই তিনি একটা সংগঠিত দল তৈরি করছেন। যারা নিয়মিত নজরানা এবং খাজনা দেবে, তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হবে না। কিন্তু যারা তা দেবে না, তাদের ঘটিবাটি চাঁটি করার সংগঠিত ব্যবস্থা হবে। যারা তবু বশ মানবে না, তাদের রাজদরবারে নিয়ে গিয়ে বিচার করা হবে। জেল, জরিমানা, বেত্রাঘাত, শূল, সব ব্যবস্থাই হচ্ছে।”
কবরেজমশাই এবার আরও একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা এতক্ষণ বলতে একটু বাধোবাধ ঠেকছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, বলে দেওয়াই ভাল। শুনতে যখন চাইছেন তখন বলি, “দৌবারিক’ কথাটার মানে হল দরোয়ান।”
“দরোয়ান?” বলে সদাশিব হাঁ হয়ে রইলেন। কবরেজমশাই উঠে গিয়ে বাংলা অভিধানটা নিয়ে এসে খুলে দেখিয়ে বললেন, “আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তো এই দেখুন। এখন ভেবে দেখুন, দারোগা থেকে দরোয়ান হতে আপনার কেমন লাগবে…?”
সদাশিব অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অভিধানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “কী! আমাকে এত বড় অপমান! এখনই আমি ব্যাটাকে ধরে থানায় এনে লক-আপে পুরে দিচ্ছি।”
কবরেজমশাই অনুত্তেজিত গলায় বললেন, “মাথা গরম করবেন। তাতে কাজ পণ্ড হবে। ঠাণ্ডা হয়ে বসুন।”
সদাশিব কুদ্ধ গলায় বললেন, “এর পরও ঠাণ্ডা হতে বলছেন? কী স্পর্ধা দেখছেন লোকটার?”
“দেখছি। তবু মাথা গরম করবেন না। মনে রাখবেন, লোকটার হাতে শশীবাবুর হাত আছে। আমাদের সাধ্য নেই তার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করার। কিন্তু কৌশলে সবই হয়।”
“আমাকে কী করতে বলেন আপনি?”
কবরেজমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “গায়ের জোর বাড়াতে বলি। আজ থেকেই খাওয়াদাওয়া ছাঁটকাট করতে হবে। রোজ ব্যায়াম করতে শুরু করুন। যখন প্রথম এ তল্লাটে এসেছিলেন, তখন আপনার বেশ মুগুরভাঁজা চেহারা ছিল। মুগুর আবার ধরুন। আর যারা এখনও দিনুর দলে নাম লেখায়নি তাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে থাকুন। আমাদেরও জোট বাঁধার সময় এসেছে।”
“যে আজ্ঞে!”
“চণ্ডীমণ্ডপে কালই আমরা মিটিং করব। একটু বেশি রাতের দিকে। বুঝলেন?”
সদাশিব এখনও রাগে গরগর করছেন, বললেন, “যে আজ্ঞে।”
রাগে ফুঁসতে ফুসতে সদাশিব বিদায় নিলেন।
পরদিন সকালবেলায় দশ গাঁয়ের লোক অবাক হয়ে দেখল শূন্যপথে খুব ধীরে ধীরে একটা সিংহাসনের মতো জিনিস ভেসে যাচ্ছে। তাতে বসে আছে দিনুরাজা। পরনে জরির পোশাক, মাথায় ঝলমলে মুকুট, হাতে একটা রাজদণ্ড আর মুখে একটু হাসি। ওপর থেকে সে মাঝে মাঝে বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলছিল।
এই দৃশ্য দেখে অনেকেই সোল্লাসে জয়ধ্বনি দিল, “জয় দিন মহারাজের জয়!”
আবার অনেকে মুখ কালো করে আড়ালে সরে পড়ল। দিনুরাজার উড়ন্ত সিংহাসন প্রথমেই এসে নামল কুঞ্জপুকুরের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, সিংহাসনটা ধরে রয়েছে শশীদাদুর সেই বিখ্যাত হাত।
দিনুরাজা সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে মিঠে মোলায়েম গলায় বলল, “ভাইসব, আপনারা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের পাঁচজনের আশীবাদ আর শুভেচ্ছায় চারদিকে আজ শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। চুরি, ছ্যাচড়ামি, ডাকাতি, রাহাজানি, গুণ্ডামি সব বন্ধ। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হতে আর দেরি নেই। এটা জনগণেরই জয়, আমি আপনাদের সামান্য সেবক হিসেবে আমার সামান্য সীমায়িত ক্ষমতায় যেটুকু করতে পেরেছি, তাও আপনাদেরই সহযোগিতায়। জনগণেরই বিশেষ অনুরোধে নিতান্তই অনিচ্ছায় আর ঠিক কুড়ি দিন বাদে মাঘী পূর্ণিমার দিন এই অধমকে জনগণ সিংহাসনে অভিষিক্ত করবেন বলে মনস্থ করেছেন। রাজার মুকুট মাথায় দেওয়া মানে আসলে কাঁটার মুকুট পরা। তবু আমি আপনাদের মুখ চেয়ে রাজি হয়েছি। ওইদিন আপনারা আপামর জনসাধারণ দয়া করে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, এই প্রার্থনা। কুঞ্জপুকুরে নেমন্তন্ন করতে আমি নিজেই এসেছি, কারণ এই গ্রামের সঙ্গে আমার অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”
সবাই জয়ধ্বনি করল, হাততালিও পড়ল। হাসি-হাসি মুখে দিনুরাজা ফের সিংহাসনে বসল। সিংহাসন শূন্যে উঠে ভেসে চলে গেল!
একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সদাশিব দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “দেখলেন কবরেজমশাই?”
কবরেজমশাই বললেন, “দেখলাম। আঙুল ফুলে কলাগাছ!”
“ইচ্ছে করছিল পিস্তলটা তুলে গুলি চালিয়ে দিই।”
“তাতে লাভ হত না, পিস্তল তুলবার আগেই হাত এসে পিস্তল কেড়ে নিত। গুলি চালাতে পারলেও দিনুর গায়ে লাগত না, সে বেঁটে মানুষ, লোকজন ঘিরে ছিল তাকে। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন সদাশিববাবু।”
“যে আজ্ঞে। আজ সকালে আমি মাইলটাক দৌড়েছি। খাওয়া অর্ধেক করে ফেলেছি, ডন-বৈঠক শুরু করে দিয়েছি।”
“খুব ভাল।”
“আর দিনু-বিরোধী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করে ফেলেছি। আজ রাত বারোটার পর চণ্ডীমণ্ডপে মিটিং। অন্ধকারেই মিটিং হবে।”
“বাঃ, আপনি তো আগের মতোই করিৎকর্মা হয়ে উঠেছেন।”
“যে আজ্ঞে।”
.
নিশুতরাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ল। কুয়াশায় চারদিক আবছা। তার মধ্যেই গুটিগুটি বারো-চোদ্দজন লোক এসে অন্ধকার চণ্ডীপণ্ডপে জড়ো হল। সকলেই কেমন মনমরা, হতাশ আর জবুথবু।
কবরেজমশাই উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললেন, “আপনাদের মনের অবস্থা আমি জানি। আমরা সবাই আজ এক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আগে আমার একটা অপরাধের কথা স্বীকার করে নিই।”
সবাই অন্ধকারেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কবরেজমশাই অকম্পিত কণ্ঠে তাঁর নাতির জন্য হাত চুরি করা এবং তা দিনুর হাতে তুলে দেওয়ার বৃত্তান্ত খোলসা করে বললেন। কিছুই লুকোলেন না, সবশেষে বললেন, “অপরাধ আমার। প্রায়শ্চিত্তও আমাকেই করতে হবে। দিনুর অভিষেকের দিনটাকেই আমার পছন্দ। আমার অনুরোধ, আপনারাও সকলে ওইদিন অভিষেকে উপস্থিত থাকবেন। যা হওয়ার ওইদিনই হবে।”
কে একজন মুখ ঢেকে বসে ছিল একটা থামের আড়ালে, সে হঠাৎ ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বলল, “আপনার নাতি কি ফেরত এসেছে?”
“না। তার আশা ছেড়ে দিয়েছি, দিনু তাকে দুশো টাকায় বেদেদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সেই বেদের দল এ তল্লাট ছেড়ে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না।”
সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। অনেকেই ক্রোধ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। কবরেজমশাই শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমারই পাপের শাস্তি। আপনারা উত্তেজিত হবেন না। তবে সকলেই প্রস্তুত থাকুন। যাঁরা এখনও দিনুর কাছে মাথা নোয়াননি, তাঁরা দয়া করে মাথা নোয়াবেন না। ভরসা রাখুন। ঠাকুর মঙ্গলময়।”
মিটিংয়ের পর কবরেজমশাই সদাশিবকে জিজ্ঞেস করলেন, “থামের আড়ালে মুখ ঢেকে একটা লোক বসে ছিল, আমাকে আমার নাতির কথা জিজ্ঞেস করল। কে বলুন তো?”
“আমিও ঠিক চিনতে পারলাম না। মিটিং শেষ হওয়ার আগেই সরে পড়ল।”
“দিনুর স্পাই নয় তো?”
সদাশিব দুশ্চিন্তায় পড়ে বললেন, “আশ্চর্যের কী? হতেই পারে।”
কবরেজমশাইয়ের কয়েকদিন নাওয়া-খাওয়া রইল না। নানারকম পাঁচন তৈরি করে দিনু-বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি পাঠাতে লাগলেন।
একদিন সকালবেলা ঝলমলে পোশাক-পরা ঝিকু ঘোড়ায় চেপে এসে হাজির হল।
“পেন্নাম হই কবরেজমশাই, দিনুমহারাজ পাঠালেন।”
কবরেজমশাই স্মিতহাস্যে বললেন, “কী খবর হে ঝিকু কোটাল?”
“আজ্ঞে, খবর সুবিধের নয়। যত রাজ্যের গুণ্ডা বদমাশ এসে রোজ ভিড় করছে। আমি তেমন পাত্তাই পাচ্ছি না। মহারাজের ফাঁইফরমাশ খেটে খেটে জান কয়লা হচ্ছে। এই কি কোটালের কাজ, কবরেজমশাই? ছ্যাঃ ছ্যাঃ।”
কবরেজমশাই আদর করে ঝিকুকে ঘরে এনে বসালেন। বললেন, “বোসো, বোসো, একটু জিরিয়ে নাও।”
তা ঝিকু বসল, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোটালের কাজ ঝিকু বিশেষ পছন্দ করছে না। কপালের ঘাম মুছে বলল, “কোটাল মানে কি ভৃত্য নাকি কবরেজমশাই? ওসব শক্ত-শক্ত কথা, মানেও জানি না!”
“না হে, কোটাল ভৃত্য হবে কেন? মস্ত সম্মানের কাজ। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে রাজার সমানই, সে হল আইনের রক্ষক। মানুষের ধনপ্রাণ তো সেই রক্ষা করে। বীরকে বীর, সাহসীকে সাহসী।”
“ধুর মশাই, কোথায় কী? আমাকে তো বীরের কাজ কিছু দেওয়াই হয় না। কেবল এটা আন, ওটা দিয়ে আয়, অমুককে একটা খবর দে, একটা পান সেজে আন, এইসব।”
“তা হলে তো খুবই দুঃখের কথা!”
“খুবই দুঃখের। একটু আদর-যত্নও তো পাওয়া যায় না। পান থেকে চুন খসলেই দাবড়ায়।”
“তা হলে তো আফসোসের কথাই ঝিকু। এভাবে তো চলবে না।”
“চলছে না মশাই, একদম চলছে না। আগেই ভাল ছিলুম।”
“আগে কী করতে বাপু?”
“বাপের জমি আছে। চাষবাস করতুম। বেশ ছিলুম তখন। দিনুদাদা গিয়ে কানমন্ত্র দিয়ে নিয়ে এল। রাজা হল বটে, কিন্তু সে তো নিজের এলেমে নয়, শশীবাবুর হাতের দৌলতে, রাজা হয়েই একেবারে ধরাকে সরা দেখতে লেগেছে, এখন কাদের খাতির জানেন? ওই ভীম সর্দার, গৌরহরি, জটেশ্বর, এরাই সব পেয়ারের লোক। আমি যেন ভেসে এসেছি।”
এই বলে ঝিকু একখানা চিঠি বের করে কবরেজমশাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, “আপনাকেও কোন ফেরেববাজিতে ফেলে দেখুন। রাজবৈদ্য হতে ডেকেছে। দু হাজার টাকা মাইনে আর উপরি। দু’ হাজার টাকা মাইনে আমারও, কিন্তু আজ অবধি দুশোটি টাকাও পাইনি। যা পাচ্ছে, সব রাজকোষে জমা করে নিচ্ছে। আপনার বেলাতেও তাই হবে দেখবেন।”
কবরেজমশাই চিঠি খুলে দেখলেন, দিনুরাজা পরম বিনয়ের সঙ্গে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে তাঁকে রাজবৈদ্য হিসেবে নিয়োগ করতে চেয়েছে। কবরেজমশাই চিঠিটা রেখে দিয়ে বললেন, “দিনুকে বোলো, অভিষেকটা ভালয় ভালয় হয়ে যাক, তারপর রাজবৈদ্যের চাকরি নেব। অভিষেকে তো যাচ্ছিই, তখন কথা হবে।”
“যে আজ্ঞে! আচ্ছা কবরেজমশাই, এটা কেমন নিয়ম বলুন তো! রাজামশাইয়ের সব কর্মচারীরই মাইনে দু হাজার টাকা করে? কেউ অবশ্য দু হাজার পায় না। কিন্তু বলা তো থাকছে।”
“খুব আশ্চর্য কথা! যেখানে মুড়ি-মিছরির এক দর, সেখানে খুব অরাজকতা বলেই ধরতে হবে। তা, রাজবাড়িতে খাওয়াদাওয়া কেমন?”
“সে আর বলবেন না। রাজা হওয়ার পর থেকেই দিনুদাদা এমন কেপ্লন হয়েছে যে, ডাল, ভাত আর ঘাট ছাড়া কর্মচারীদের আর কিছু জুটছে না। ওদিকে হাত বাবাজিকে রোজই এখান থেকে সেখান থেকে চুরি-জোচ্চুরি করে আনার কাজে লাগাচ্ছে। কয়েক দিনে লাখো লাখো টাকা করে ফেলল মশাই! যত দেখি। তো রক্ত গরম হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, দিই তলোয়ারের একটা কোপ বসিয়ে ঘাড়ে, তারপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু ভয় ওই হাত বাবাজিকে। গোবিন্দ কী একটু বেয়াদবি করেছিল, হাত বাবাজির কী উস্তম কুস্তম মার! যায়-যায় অবস্থা। ফটিককে এই শীতের রাতে পুকুরে চুবিয়ে আনল। অপরাধ কী, না সে খিদের মুখে, একটা কলা চুরি করে খেয়েছে। রাজামশাইয়ের খাওয়ার সময় কাজের লোক হাঁচি দিয়েছিল মশাই, তাকে চুল ধরে একটি ঘণ্টা শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিল। অত্যাচারের শেষ নেই। চাষিদের ঘরের ধান, চাল, সবজি, দুধ, মাছ, সব ওই হাত বাবাজিকে দিয়ে কেড়ে আনছে। তল্লাটের সব দোকানপাট লুট হয়ে গেছে। লোকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজছে।”
“তোমরা তবু চুপ করে আছ?”
“কী করব কবরেজমশাই! ওই হাত বাবাজির ভয়ে কিছু করার উপায় নেই কিনা!”
কবরেজমশাই যত শুনছেন, তো ভেতরে-ভেতরে খুশি হচ্ছেন। এই তো চাই। এ রকমই তো চাই। তিনি ভাল করে ঝিকুকে মণ্ডা-মিঠাই খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় কানে কানে বললেন, “প্রস্তুত থেকো, অভিষেকের দিন সুযোগ আসবে।”
“যে আজ্ঞে!”
অভিষেকের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। সদাশিববাবু তাঁর সেপাইদের নিয়ে রোজ লেফট রাইট করছেন। ডন-বৈঠক কসরত চলছে। ঘরে-ঘরে পাঁচন পৌঁছে যাচ্ছে। দিনু-বিরোধীরা গায়ে বেশ জোর এবং ফুর্তি পাচ্ছেন।
দেখতে না দেখতেই মাঘী পূর্ণিমা এসে পড়ল। দশটা গাঁয়ের লোক সেজেগুঁজে ভোর থাকতেই রওনা হয়ে পড়ল রাজবাড়ি।