নন্দ কবিরাজ খুবই চিন্তিত
নন্দ কবিরাজ খুবই চিন্তিত, শশী গাঙ্গুলির অবস্থাটা তিনি ভাল বুঝতে পারছেন না। রোগলক্ষণ তেমন কিছু নেই। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতাতেই ঝিমিয়ে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে তাঁর। অনেকরকম পাঁচন করে খাইয়ে ফল পাচ্ছেন না তেমন। একটা পুরনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ে গতকালই একটা ভেষজ ওষুধের কথা পেয়েছেন। ত্রিশ রকমের গাছগাছড়া আর মূল লাগবে। সেইসব ভেষজ জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়! গাঁয়ে মাতব্বরদের বলেছেনও সে-কথা। তারা বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠাচ্ছেন সেইসব জিনিস সংগ্রহ করতে।
শশী গাঙ্গুলির নাড়ির গতি খুব ক্ষীণ। দুর্বলতা এতই বেশি যে, চোখের পাতা মেলতে পারেন না। ডাকলে সাড়া দেন না। সন্ধেবেলা শশী গাঙ্গুলিকে দেখে নন্দ কবিরাজ খুব অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরছিলেন। ভেষজগুলো যদি ঠিকমতো পাওয়া যায় তা হলে ওষুধটা তৈরি করতে দিন সাতেক সময় লাগবে। এই দিন সাতেক রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় চিন্তা করছিলেন তিনি। নানারকম নিদানের চিন্তা মাথায় ঘুরছে।
ডাইনি-পুকুরের কাছে বাবলাগাছের জঙ্গল। জায়গাটা ভারি নির্জন আর অন্ধকার। চারদিকে শুধু জোনাকি পোকা জ্বলছে। বহু পুরনো একটা জামগাছ ডালপালা মেলে আকাশটা একরকম ঢেকেই ফেলেছে। সন্ধের পর এ রাস্তায় লোক-চলাচল নেই। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বেশ অমায়িক গলায় বলে উঠল, “কবরেজমশাই নাকি?”
গলাটা অচেনা। নন্দ কবিরাজ ফিরে তাকিয়ে বেঁটেমতো একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়ে বললেন, “কে আপনি?”
“আমাকে চিনবেন না। অধমের নাম দিনু বিশ্বেস। শশীবাবুকে দেখে এলেন বুঝি? তা অবস্থা কেমন?”
শতবার এই প্রশ্নের জবাব দিতে-দিতে নন্দ কবিরাজ একটু বিরক্ত, বললেন, “ওই একই রকম। ভালও নয়, খারাপও নয়।”
“পাল্লাটা কোনদিকে ভারী? ভালর দিকে, না খারাপের দিকে?”
“বলা কঠিন।” বলে কবিরাজমশাই মুখ ফিরিয়ে হাঁটা ধরলেন।
লোকটি পিছু-পিছু আসতে-আসতে বলল, “কবরেজমশাইয়ের কি তাড়া আছে নাকি?”
নন্দ কবিরাজ এবার একটু চটে উঠে বললেন, “তা দিয়ে তোমার কী দরকার হে?”
খুবই অমায়িক গলায় লোকটা বলল, “শুনতে পাচ্ছি, আপনি নাকি নতুন একটা ওষুধের সন্ধান পেয়েছেন। সেটা নাকি মৃতসঞ্জীবনী। এক ঢোক খেলেই মরা মানুষও উঠে বসে! তাই বলছিলুম, কাজটা কি ঠিক হবে কবরেজমশাই? শশীবাবুর আয়ু প্রকৃতির নিয়মেই ফুরিয়েছে। তাকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখলে কি খোদার ওপর খোদকারি হবে না?”
নন্দ কবিরাজ খাপ্পা হয়ে বললেন, “আচ্ছা বেয়াদব লোক তো তুমি? আমাকে নীতিকথা শেখাচ্ছ?”
“আজ্ঞে না। নীতিকথা আপনারও কিছু কম জানা নেই। তবে হয়তো সবসময়ে খেয়াল রাখতে পারেন না। তাই একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া আর কি?”
“স্মরণ আর করাতে হবে না। আমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট আছে। এবার বাপু, তুমি নিজের কাজে যাও।”
লোকটা খ্যাক করে একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে, নিজের কাজেই আসা। আপনার হাতে যদি সময় থাকে, তবে দুটো কথা বলতুম।”
“না, আমার সময় নেই। তুমি এসো গিয়ে।”
“শুনতে না চাইলে শুনবেন না, কান দুটো তো আপনার। না শোনার হক তো আছেই। তবে কিনা কথাটা খুব মন্দ ছিল না।”
নন্দ কবিরাজ মনে-মনে চটে গেলেও নিজেকে সংযত করে বললেন, “সংক্ষেপে বলতে পারলে বলে ফেলো। হাঁটতে-হাঁটতেই বলো।”
“আজ্ঞে, তা হবে না। ডাইনি-পুকুরের ওধারে আমার পক্ষে যাওয়ার অসুবিধে আছে। দয়া করে এখানেই একটু দাঁড়িয়ে যান। নিরালা আছে, অন্ধকারও আছে। কথাটা পাঁচকানও হবে না, আর আমার পোড়া মুখখানাও আপনাকে দেখতে হবে না।”
লোকটার কথার ধরন-ধারণ মোটেই ভাল ঠেকল না নন্দ কবিরাজের কাছে। কিন্তু তিনি মাথা গরম করলেন না। বললেন, “এমন কী কথা বাপু যে, নির্জনে বলতে হবে? তুমি কোথা থেকে আসছ? মতলবটাই বা কী?”
“অত কথা খোলসা করে বলতে কিছু অসুবিধে আছে কবরেজমশাই। শনৈঃ শনৈঃ জানতে পারবেন অবশ্য।”
লোকটার মুখে ‘শনৈঃ শনৈঃ শুনে নন্দ কবিরাজ একটু ভ্রূকুটি করলেন। বললেন, “ঠিক আছে। যা বলার আছে, বলো।”
“বলছিলাম কি, শশীবাবুর আয়ু ফুরিয়েছে। শরীরটাও জরাজীর্ণ। আপনি আর দয়া করে তাঁর চিকিৎসা করবেন না। গাছগাছড়া আনতে চারদিকে লোক গেছে শুনলাম। তা সেগুলো তাঁরা আনুন। আপনার আর সেগুলো কাজে লাগিয়ে দরকার নেই।”
“তার মানে?”
“মানে খুব সোজা। শশীবাবুর গঙ্গাযাত্রায় আর বিলম্ব ঘটিয়ে পাপের বোঝা ভারী করবেন কেন?”
“তুমি কি শশীবাবুর মৃত্যু চাও?”
“ছি ছি। কী যে বলেন! গীতায় সেই যে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, মনে নেই? যা ঘটার তা ঘটেই আছে, তুমি নিমিত্ত মাত্র হও সব্যসাচী! এ হল প্রায় সেই বৃত্তান্ত। শরীরের খাঁচাটা পুরনো হলে তো বদলাতেই হয়, না কি? আপনি এত বড় কবরেজ, জীবন-মৃত্যু নিয়ে কারবার, এ কি আপনার জানা নেই?”
নন্দ কবিরাজ কুপিত এবং বিস্মিত হয়ে বললেন, “তোমার মতলব তো ভাল ঠেকছে না বাপু! তুমি তো দেখছি, মানুষ খুন করতে পারো।”
লোকটি খুবই শান্ত ও অমায়িক গলায় বলল, “তাই যদি হবে, তা হলে শশীবাবুকে তো কবেই খুন করে ফেলতে পারতাম। নির্জীব হয়ে পড়ে আছেন, ও-মানুষকে খুন করা শক্ত কী?”
“তা হলে চিকিৎসা বন্ধ করতে বলছ কেন?”
লোকটা যেন খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, “খুনের কথাটা তুলে আপনি বড় গণ্ডগোলে ফেলে দিলেন। ওসব কথা ভাবাও পাপ। খুনের কথা হচ্ছে না, বলছি, বয়সের নিয়মে উনি যদি মারাই যান, তা হলে তাতে বাধা হওয়া উচিত নয়। একশো সাত বছর বেঁচে আছেন, আর কিসের দরকার বলুন তো?”
“তোমাকে বাপু, পুলিশে দেওয়া উচিত। শশী গাঙ্গুলি মারা গেলে কী হবে জানো? তোমার মতো পাজি লোকেদের আস্তানা হবে এই কুঞ্জপুকুর।”
লোকটা খ্যাচ করে একটু হেসে বলল, “চোখ বটে আপনার! এই অন্ধকারেও আমাকে পাজি বলে ঠিক চিনেছেন কিন্তু।”
“তোমার মতো লোককে চিনতে দেরি হয় না। শোনো বাপু, শশী গাঙ্গুলির শত্ত্বরের অভাব নেই। একটা জীবন বিস্তর চোর-ডাকাত, গুণ্ডা বদমাশকে ঢিট করেছেন। তারা যে শশী গাঙ্গুলির মৃত্যু চায়, তাও আমরা জানি। আর তাই শশীখুড়োর বাড়ির চারধারে গাঁয়ের লোক শক্ত পাহারা বসিয়েছে। গাঁয়েও দল বেঁধে টহল দিচ্ছে। কাজেই তোমাকে বলি, সরে পড়ো। সুবিধে হবে না।”
লোকটা একটুও চটল না। পরম বিনয়ের সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে! আমি হেরেই গিয়েছি বলে ধরে নিন। তবে কিনা, আর একটা ছোট মাপের কথা ছিল। সেইটে বলেই আমি নাহয় সরে পড়ব। অভয় দেন তো বলি?”
“তোমার আম্পদ্দা দেখে অবাক হচ্ছি। তবু বলেই ফেলো।”
“আপনার একটা ফুটফুটে নাতি আছে। তার নাম বাবলু। বছর পাঁচেক বয়স হবে। ঠিক বলছি?”
নন্দ কবিরাজ একটু শক্ত হয়ে গেলেন। বললেন, “হাঁ, কিন্তু কী চাও?”
লোকটি খুবই দুঃখের গলায় বলল, “বেলতলার মাঠে আজ বিকেলেও খেলছিল অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে, কিন্তু সন্ধের পরও সে আজ বাড়ি ফেরেনি।”
“অ্যাাঁ!” বলে নন্দ কবিরাজ চমকে উঠলেন।
লোকটা শশব্যস্তে বলল, “আহা, ব্যস্ত হবেন না। তাকে খুঁজতে চারদিকে লোক গেছে। এই পথেই একটু আগে খুঁজে গেছে তারা। বাড়ির আর আশপাশের পুকরে জাল ফেলা হচ্ছে। একটু এগোলেই শোরগোল শুনতে পাবেন।”
“সর্বনাশ!” বলে নন্দ কবিরাজ ঘুরে দু পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
লোকটা পেছন থেকে বলল, “বলেছি তো ব্যস্ত হবেন না। ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। বাবলুকে পুকুরে বা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।”
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে হাতের মোটা বাঁশের লাঠিটা তুলতে যাচ্ছিলেন। লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, “কাজটা কাঁচা হয়ে যাচ্ছে না কবরেজমশাই?”
“তুই! তুই আমার নাতিকে চুরি করেছিস?”
“চুরি! চুরির কথা উঠছে কিসে? ধরে নিন না কেন, তাকে একরকম পুষ্যিই নিয়েছি। ঘাবড়াবেন না, সে এখন আমাদের ডেরায় দিব্যি ভাত খাচ্ছে। তারপর ঘুমোবে। খেলনা-টেলনাও দেওয়া হয়েছে। নাতি কিছু খারাপ নেই।”
“কী চাস?”
“এইবার বিবেচকের মতো কথা বলেছেন। পাকা মাথা দিব্যি কাজ করছে। খামোক লাঠি চালিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করতে যাচ্ছিলেন। বুদ্ধিমান মানুষ সব সময়েই পরিস্থিতি বুঝে সেইমতো চলে। লাঠিখানা দিয়ে আমার মাথা যদি ভাঙতেন, তা হলে আমার তুচ্ছ প্রাণটাই তো শুধু যেত না, আপনার আদরের নাতিটারও আর হদিস পেতেন না।”
নন্দ কবিরাজ বাঘা গলায় গর্জন করে বললেন, “বাজে কথা ছাড়ো। কাজের কথায় এসো।”
“তুই-তোকারি করছিলেন, তা, সেটাও চালিয়ে যেতে পারেন। বড়ই তুচ্ছ মানুষ আমরা। না, না, আর বেশি রেগে যাবেন না। আপনার বয়স পঁচাত্তর, এই বয়সে রাগটাগ ভাল নয়। অভয় দিলে এবার তা হলে কাজের কথায় আসি?”
নন্দ কবিরাজ রাগ-দুঃখ-ভয়ে কথা বলতে পারলেন না।
লোকটা খুবই বিনম্র গলায় বলল, “কাজের কথাটা খুবই সরল। যাকে বলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিংবা শঠে শাঠ্যং। কিংবা, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! না, না, এই শেষেরটা ঠিক লাগসই হল না।”
নন্দ কবিরাজ ফের গর্জন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কাহিল গলা দিয়ে একটা ফ্যাঁসফ্যাসে স্বর বেরোল, “কাজের কথাটা বলবে?”
“যে আজ্ঞে, কথাটা বলব বলেই তো ঘাপটি মেরে ছিলুম এতক্ষণ। সাপখোপের ভয়ে আধমরা হয়ে। তা ইদিকে কি শীতে সাপ বেরোয় কবরেজমশাই।”
“বেরোলে তো ভালই ছিল হে! কেন যে বেরোয় না, কে জানে!”
“যে আজ্ঞে। যথার্থই বলেছেন। প্রকৃতির নিয়ম বলে কথা! তারা বেরোলে পাপী-তাপীদের গতি কী হত বলুন! কবরেজমশাই, আপনার কি মনে হয় না, এ-জগতে পাপী-তাপীদের কিছু প্রয়োজন আছে? তাই যদি না থাকবে, তা হলে কি ভগবান পাপী-তাপী সৃষ্টি করতেন? বলুন না, আপনি বিজ্ঞ লোক। কদিন ধরে খুব ভাবছি, পাপী-তাপীদের বিনাশটা ভগবানও যেন ভাল চোখে দেখেন না, নইলে এতকাল ধরে তারা টিকে থাকত না। শশীবাবুর ওই বিটকেল হাতটার কথাই ধরুন! কত গুণ্ডা বদমাশকে মেরে পাট-পাট করল, কত পাপী-তাপীর বারোটা বাজাল, তবু নিকেশ করতে পারল কি? পাপী-তাপী তো নিকেশ হলই না, উপরন্তু নিজেই এখন নেতিয়ে পড়ে আছে।”
“অত ভরসা কোরো না হে। হাতটা আবার একদিন তেড়ে-ফুঁড়ে উঠবে।”
লোকটি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “উঠবে বলছেন? তা হলে তো ভয়ের কথাই হল মশাই। হেঃ হেঃ, তা যেমন বুনো ওল আছে, তেমনই বাঘা তেঁতুলও আছে। ভগবান সব বন্দোবস্তই করে রেখেছেন কি না। এক তরফা কিছু হতে দেন না। সবসময়ে হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরা আছে। পাপ বাড়লে পুণ্যিও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। পুণ্যি কমলে পাপও কমাচ্ছেন। কোনওদিকে পাল্লা বেশি ঝুঁকতে দেন না। ভ ভদ্রলোক আর যাই বলুন, একচোখো নন।”
“আর সময় নষ্ট কোরো না হে। যা বলার, বলে ফেলো।”
“যে আজ্ঞে! ঘুরেফিরে বলছি। আপনার মতো জ্ঞানী লোকের দেখা তো আমাদের বরাতে সহজে জোটে না। দু দণ্ড দাঁড়িয়ে এই যে কথা বলছি, এতেও আমার কত শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে।”
“তোমার হচ্ছে কিনা জানি না, তবে আমার হচ্ছে।”
লোকটি লজ্জার সঙ্গে বলল, “কী যে বলেন কবরেজমশাই! তবে কিনা হক কথাই বলেছেন। আমিও ভাবি, পাপী-তাপী বা পাজি-দুদের কাছে পণ্ডিতদেরও কি কিছু শেখার নেই? ঢের আছে মশাই, ঢের আছে।”
“দিন বিশ্বেস, কথাটা কী?”
“আজ্ঞে ছোট্ট কথা। বললেই ফুরিয়ে যাবে। শুনলে আপনি হয়তো ভাববেন, এই সামান্য কথাটা দিনু ফস করে বলে ফেলতে পারল না? তবে মশাই, সব কথা ফস করে বলাটা ভালও নয়। জমি তৈরি না হলে কি তাতে বীজ ফেলা ভাল? আপনার বয়স, ব্লাড প্রেশার, হার্টের অবস্থা সব খেয়াল রেখে হুঁশিয়ার হয়ে বলতে হবে তো? কথাটা শুনেই আপনি হয়তো ভিরমি খেলেন, তখন তো আমার একগাল মাছি।”
“তা বটে। তুমি সত্যিই বিবেচক লোক।”
“যে আজ্ঞে! মুখ বটি, তবে অবিবেচক নই। ধরুন, আমি একজন দোকানদার, আমার চাই পয়সা, আর আপনার চাই জিনিস। ঠিক তো?”
“ঠিক।”
“এও সেই বৃত্তান্ত। আপনার চাই নাতি, আর আমাদের চাই হাতি।”
“হাতি?”
“ওই হল। মিল দেওয়ার জন্য বলেছি। আপনার চাই নাতি আর আমাদের চাই হাতটি। বুঝলেন?”
“না।”
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলে, “এমন পাকা মাথায় কথাটা ঢেউ খেলছে না কেন, বলুন তো! এ তো জলবৎ তরলং ব্যাপার। শশীবাবুর ওই অলক্ষুনে হাতটি আমাদের হস্তগত করে দিলেই আমাদের হাত থেকে আপনার নাত ছাড়া পেয়ে যাবে।”
“নাত?”
“ওই হল। মিল দেওয়ার জন্য বলা। আপনার নাতি।”
নন্দ কবরেজ একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “এবার বুঝেছি।”
“হেঃ হেঃ। জলের মতো সোজা। তবু বলি, তাড়াহুড়ো করে বোঝবার দরকার নেই। বরং একটু তলিয়েই বুঝুন। অনেক সময়ে বুঝটা তেমন পাকা হয় না। তখনই নানা ফাঁকড়া বেরোয়। দরকার হলে আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
নন্দ কবরেজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বোঝও বাপু।”
“শশীবাবুর বাড়ি যেভাবে পাহারা দেওয়া হচ্ছে, তাতে ওই হাতের নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বলছিলুম, আপনি তাঁর চিকিৎসা করছেন, অবারিত দ্বার, এই ছোট কাজটা যদি নাতির স্বার্থে করে দেন, তা হলে বড় উপকার হয় আমাদের।”
“হাতটা চুরি করতে বলছ?”
“চুরি! ছি ছি, চুরির কথা ওঠে কেন? হস্তান্তর বলে একটা যেন ভাল কথা আছে। বেশ ভদ্র, সভ্য কথা। আপনি যদি হাতটাকে হস্তান্তর করে দেন, তা হলে সব দিক বজায় থাকে।”
লাঠিটা ফের শক্ত করে চেপে ধরলেন নন্দবাবু। ইচ্ছে হল, লোকটাকে আচ্ছাসে ঘাতক দেন। কিন্তু তাতে লাভ তো হবেই না, উপরন্তু বাবলুর ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি অসহায় গলায় বললেন, “এ কাজ আমার দ্বারা হওয়ার নয় বাপু! আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
“ওইসব শব্দ যে কোন আহাম্মক তৈরি করেছিল! বিশ্বাসঘাতকতা কথাটাকে ডিকশনারি থেকে লোপাট করে দেওয়া। উচিত। আমি বলি কি কবরেজমশাই, আজ রাতটা বেশ ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। আমাদের তাড়া নেই। বেশ ভাল করে ভাবুন, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। আর ওইসব ভাল-ভাল কথাগুলোকে মোটেই আমল দেবেন না মশাই। আপদ্ধর্ম বলে একটা কথা আছে। বিপদ-আপদ এলে তখন অনেক নীতিবাক্য লঙ্ঘন করাটাই ধর্ম। প্রাণ আগে, না নীতি আগে! যান, এখন বাড়ি যান। ওদিক থেকে লোকজনের সাড়া পাচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, এই যে আমার সঙ্গে আপনার দেখাঁটি হয়ে গেল, একথা দয়া করে ফাঁস করবেন না। তাতে আপনার নাতির ভাল হবে না। দেখাটা যে হয়েছিল, সেটা একদম বেমালুম ভুলে যান। আমি কাল আবার সন্ধের পর আসব।”
“কোথায় দেখা হবে?”
“সে নিয়ে আপনি ভাববেন না। সুবিধেমতো একটা জায়গায় ঠিক হাজির হয়ে যাব। যখন একাবোকা থাকবেন, তখন দেখবেন অধম আপনার শ্রীচরণ দর্শনে হাজির।”
বলেই লোকটা অন্ধকারে ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।
চিন্তিত কবিরাজমশাই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। মনটা বড়ই বিষণ্ণ। নানা আশঙ্কায় বুকটা দুরুদুরু করছে। বাবলুকে তিনি প্রাণাধিক ভালবাসেন। বাবলুও সারাদিন দাদুর ছায়া হয়ে ঘোরে। তাকে কোথায় নিয়ে গেল, কী অবস্থায় রেখেছে, মারধর করছে কিনা কে জানে! বেঁচে আছে তো! ভাবতে-ভাবতে নন্দ কবিরাজের দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল।
বাড়ির কাছাকাছি হতেই তিনি চারদিকে লোকের ছোটাছুটি আর ব্যস্ততা লক্ষ করলেন। পুকুরের পাড়ে মেলা লোক, হ্যাঁজাক জ্বলছে। পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। কে একজন দৌড়ে এসে বলল, “কবরেজমশাই, বাবলুকে পাওয়া যাচ্ছে না!”
নন্দ কবিরাজ বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। উত্তেজিত হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। রাত্রিবেলা বাড়ির লোক ডাকাডাকি করতে এলে তিনি বলে দিলেন যে, তাঁর শরীর-মন কোনওটাই ভাল নেই। কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে।
সারারাত কখনও বসে, কখনও পায়চারি করতে করতে অনেক ভাবলেন নন্দ কবিরাজ। দিনু বিশ্বেস তাঁকে খুবই ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। একটি নিষ্পাপ শিশুর প্রাণরক্ষার জন্য তাঁকে হয়তো নীতিবোধ বিসর্জন দিতেই হবে। সারারাত ধরে তিনি বাড়ির মেয়েদের কান্নাকাটি, চেঁচামেচি শুনতে পেলেন। গাঁয়ের লোকরাও অনেকেই ঘুমোয়নি। বাবলুকে চারদিকে খোঁজা হচ্ছে। থানাতেও খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে যে বিশেষ লাভ হবে না, তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কে জানে!
দারোগা সদাশিব রায় সকালেই এসে হাজির হলেন একটা জিপগাড়িতে চড়ে। মোটাসোটা আহ্লাদে মানুষ। পেটে তাঁর সাতরকমের ব্যায়ো। কবরেজমশাই বারোমাস তাঁকে ওষুধ গিলিয়ে কিছু করতে পারেননি। করা সম্ভবও নয়। কারণ সদাশিবকে খুশি রাখতে সকলেই তাঁকে প্রতিদিন নানারকম ভেট দিয়ে যায়। পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, খাসির ঠ্যাং, ডিম, ক্ষীর, পায়েস, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি থরেথরে তাঁর বাড়িতে মজুত। সদাশিব খেতে বড্ড ভালবাসেন। নন্দ কবিরাজ প্রায়ই বলেন, “খাওয়াটা একটু না কমালে যে পাকস্থলী বিশ্রাম পাচ্ছে না সদাশিববাবু। পেটের সহ্যশক্তির তো একটা সীমা আছে।”
সদাশিব অত্যন্ত করুণ মুখ করে বলেন, “তার চেয়ে আমাকে আত্মহত্যা করতে বলুন কবরেজমশাই। তাতে কষ্টটা কম হবে। না-ই যদি খাব, তা হলে বেঁচে থেকে হবেটা কী? আপনি এমন ওষুধ বের করুন, যাতে আমার খাওয়া আর হজম দুটোই বজায় থাকে।”
তা সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
সদাশিব মোটা মানুষ। শীতকালেও তাঁর ঘাম হয়। সর্বদাই একটা হাঁসফাঁস ভাব। দুঃখ করে বলেন, “কী বলব, এই কুঞ্জপুকুর এলাকায় এসে অবধি চোর-গুণ্ডা বদমাশদের টিকিও নাগাল পাচ্ছি না। শশীবাবুর হাতই এখানে হাকিম। বলতে লজ্জা করে, হাতে কাজ না থাকায় আমি থানায় বসে সেপাইদের সঙ্গে লুডো খেলি।”
ভালমন্দ খেয়ে, লুডো খেলে আর আলসেমি করে সদাশিবের এখন করুণ অবস্থা। নড়তে-চড়তে অবধি কষ্ট। বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারে বসে, রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “হাকিম সাহেব শয্যা নেওয়ার পর থেকে চারদিকে যেন বদমাইশির একেবারে হিড়িক পড়ে গিয়েছে।”
কবরেজমশাই অবাক হয়ে বললেন, “হাকিমসাহেব শয্যা নিয়েছেন নাকি? কই, আমি তো খবর পাইনি! এ তো অতি অন্যায় কথা, গত পাঁচ বছর যাবৎ আমি তাঁর চিকিৎসা করে আসছি, আর আমাকেই খবর দেওয়া হয়নি।”
সদাশিববাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে-হাকিম নয়। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় ভালই আছেন। আমি আসল হাকিমের কথা বলছি। শশীবাবুর হাত। তিনি সেই যে শয্যা নিলেন, নট নড়ন চড়ন, আর ইদিকে বদমাইশরা কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেখুন। যেন ডবল ডোজে ভিটামিন খেয়ে নেমে পড়েছে। চতুর্দিকে চূড়ান্ত অরাজকতা। আর বলবেন না মশাই, এমন তাদের আম্পদ্দা যে, কাল নিশুত রাতে আমার শোওয়ার ঘরের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে সে কী হিঃ হিঃ করে হাসি! শুধু হাসি? তারপর আবার গানও গাইল, মোটা দারোগা হবে রোগা।
চিন্তিত নন্দ কবিরাজ বললেন, “খুবই সাহস!”
“যা বলেছেন! ওই যে ভীম দাস বলে ডাকাতটা ছিল, সে তো ডাকাতি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে গিয়ে দিব্যি চাষবাস করে গেরস্ত হয়ে গিয়েছিল। শুনছি, হাকিমসাহেব শয্যা নেওয়ার খবর পেয়ে সেও নাকি চাষবাস ছেড়ে মোটা দাঁও মারতে এদিকে এসে পড়েছে। হস্তশিল্পী গৌরহরি চুরি ছেড়ে শহরে গিয়ে পানের দোকান দিয়েছিল। সে নাকি পানের দোকান বেচে চলে এসেছে। খুনি জটেশ্বর পয়সা নিয়ে মানুষ খুন করে বেড়াত। হাকিমসাহেবের জন্য দেশছাড়া হয়েছিল। সেও ফের চারপাশে ঘুরঘুর করছে শুনতে পাই। নীলমণি ঘোষের সঙ্গে রামকমল পালের মামলা চলছে। তা জটা নাকি নীলমণিকে বলেছে, মামলা মোকদ্দমা করে বুড়িয়ে যাবেন কেন, পাঁচটি হাজার টাকা ফেলুন, রামকমলের লাশ নামিয়ে দিচ্ছি।”
“ও বাবা!”
“চারদিকে একেবারে পাপের তুফান উঠেছে মশাই। এসব সামাল দেওয়া কি একজন মাত্র দারোগার কাজ! চার-পাঁচজন দারোগা দরকার। আমি দু’বেলা মা কালীকে ডাকছি, শশীবাবু ভাল হয়ে উঠুন, হাকিমসাহেব গা-ঝাড়া দিয়ে কাজে নেমে পড়ুন, আমি জোড়া পাঁঠা দেব।”
নন্দ কবিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ঠিকই বলেছেন। চিরকাল দেখে আসছি, কুঞ্জপুকুর আর আশপাশের এলাকা হল গুণ্ডা বদমাশ তৈরির বীজতলা। এখান থেকেই যত চোর, ডাকাত আর খুনে তৈরি হয়। এখানকার আবহাওয়ায় বোধ হয় কিছু একটা আছে। শশীবাবুর হাত এসে সেই ভিমরুলের চাকে নাড়া দিয়েছিল। গুণ্ডা বদমাশরা প্রথমটায় গা-ঢাকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন সব জো পেয়ে প্রতিহিংসা নিতে দ্বিগুণ উৎসাহে ফিরে আসছে।”
সদাশিববাবু একটু ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বললেন, “সেইজন্যই। তো আমি বদলি চেয়ে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছি। এ-তল্লাটে। আমার অনেকদিন হয়ে গেল। আর নয় মশাই। আর আপনারাও বাবলুর জন্য মা কালীকে ডাকুন। যারা বাবলুকে চুরি করেছে, তারা হয়তো মুক্তিপণ চাইবে। চাইলে সেটা দিয়ে দেওয়াই ভাল। বুঝলেন?”
আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দ কবিরাজ বললেন, “বুঝেছি।”
সদাশিববাবু একটু গলা নামিয়ে বললেন, “শশীবাবুর জন্য যে নতুন ওষুধটা তৈরি করছেন, তার কতদূর?”
নন্দ কবিরাজ একটু বিষয় গলায় বললেন, “গাছগাছড়া জোগাড় হচ্ছে।”
“তাড়াতাড়ি করে ফেলুন। গতিক মোটেই সুবিধের নয় কিন্তু।”
গতিক যে সুবিধের নয়, তা নন্দ কবিরাজের চেয়ে ভাল আর কে জানে! দারোগাবাবু বিদায় হলে নন্দ কবিরাজ শশীবাবুকে দেখতে গেলেন। আজ ঘরে ঢুকে তাঁর চোখ প্রথমেই গিয়ে পড়ল হাতটার ওপর। শশীবাবুর খাটের পাশেই টেবিলের ওপর হাতটা রাখা। শশীবাবুর মতোই নির্জীব। শশীবাবুকে পরীক্ষা করার পর নন্দবাবু আজ সাহস করে হাতটা তুলে একটু দেখলেন। একটু নাড়াচাড়া করলেন।
ক্ষান্তমণি বলল, “বাবার একটা মন্ত্র আছে। সেটা না বললে হাতটা কাজ করে না।”
নন্দ কবিরাজ কথাটা শুনতে পেলেন না। হাতটার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। এই হাতটার ওপর তাঁর নাতির প্রাণ নির্ভর করছে। কী করবেন তা বুঝতে পারলেন না। মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে। এই হাতটা তাঁকে চুরি করতে হবে। তারপর বদমাশদের হাতে তুলে দিতে হবে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে ঘেন্নায়। কিন্তু বাবলুর জন্য একাজ না করেই বা উপায় কী?