প্ৰথম খণ্ড – আদি পর্ব : ১.১২
ধন্যবাদ দিয়ে পত্র লিখলে সুলতাকে। লিখলে আপনাকে ধন্যবাদ, শত-সহস্র ধন্যবাদ না জানিয়ে মন তৃপ্তি পাচ্ছে না। আমার দৃষ্টিতে আপনি অস্ত্রোপচার করেছেন আজ। আমি দেখতে পাইনি—আপনি দেখতে পেয়েছিলেন, সকালের ওই মেয়ে দুটির মুখের মধ্যে বিব্রত বিপন্ন হওয়ার লক্ষণ। গাছের মাথায় ঝড়ের আগে ছায়া নামা আমি দেখেছি। ঝড় ওঠবার লক্ষণ দেখা দিলে আমি ছাদে উঠে দেখেছি পশ্চিমদিকে ময়দানের গাছগুলোর মাথায় ছায়া পড়ে। ছায়াই শুধু পড়ে না। গাছগুলোও নিঝুম হয়ে নেতিয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষের মুখে ওটা দেখতে পাইনি। আপনি পেয়েছিলেন, আমাকে বলেছিলেন, কিছু দিলে পারতেন। সারাটা দিন কথাটা আমার মনে ঘুরেছিল। সন্ধ্যার পর মনে হয়েছিল—ওরা বলেছিল, কাল সকালেই ওদের বিপদ ঘটবে। সব কেড়ে নিয়ে বের করে দেবে পথে। তাই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছিলাম। এবং সব সংকোচ জয় করে যখন ওদের আস্তানায় উপস্থিত হয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম, ঝড়ের ঝাপটা নেমেছে। সেই ঝাপটায় মেয়েটিকে দেখলাম, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে, মাথার চুল কপালে নেমে ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক ঝড়ে বিধ্বস্ত লতার পল্লবের মত। আমি টাকা দিয়ে ওদের বাঁচিয়ে এসেছি। এবং যে কৃতজ্ঞদৃষ্টির অভিষেক নিয়ে এসেছি, তা আমার জীবনের সব অপবাদের পঙ্কলেপনের মাঝখানে একটি চন্দনতিলক পরিয়ে দিয়েছে। আমি এই মুহূর্তেও অনুভব করছি—আমি দেবকুমার হয়ে গেছি।
মানুষের পাপপুণ্য, নিন্দা-প্রশংসার সব খোলস খসে পড়েছে। আপনার মন আশ্চর্য মন। পরশ-পাথরের মত। সে মনের স্পর্শ পেয়ে আমার মনে সোনা হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। ফিরে এসেই পত্র লিখছি আপনাকে। ইতি—সুরেশ্বর রায়।
.
এই খুশী-মনের জের তার আর ঘোচেনি বা মোছেনি। পরদিন সকালে উঠেও সে অনুভব করেছিল যে গ্লানি তার জীবনটাকে ভার করে রেখেছিল-তা যেন সব ঘুচে গেছে। সকালে উঠেই সে ছাদের উপর উঠেছিল অকারণেই। তখন জানুয়ারী মাসের শীত। তারই মধ্যেই সে ছাদে উঠে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নিচে নেমে এসে বাজনা নিয়ে বসেছিল।
রঘু চা-টোস্ট-ডিম নামিয়ে দিয়ে বলেছিল-আজও আবার সব লোকজন আসবে তো?
—নিশ্চয়ই! রঘুপতি রাঘব রাজারাম—তুমি ভাব কি? একজিবিশন এখন সাতদিন খোলা থাকবে। দশটা থেকে বারোটা। আবার চারটে থেকে সন্ধ্যে সাতটা।
—খাবার-দাবারও আনতে হবে তো?
—তাও আনতে হবে। তবে কালকের মত নয়। অল্প পরিমাণে। সিগারেট আনবে। আর একখানা চিঠি ফেলতে হবে। না-থাক। আমি নিজে ডাকে দিয়ে আসব। এক্ষুনি বেরুব।
চিঠিখানা আজই পৌঁছুনো চাই সুলতার কাছে। সকালে জি-পি-ও-তে ফেললে বিকেলে পাবেই। চিঠি পেয়ে সুলতা বিস্মিত হয়ে আসতেও পারে! বেরিয়ে গেল সে চা খেয়েই। হেঁটেই গেল। জানবাজার থেকে জি-পি-ও কাছেই।
বিকেলে কিন্তু সুলতা আসেনি। তবে সে-কথা নিয়ে ব্যস্ত হবার বা ভাববার সময় পায়নি। কারণ, একদল তরুণ শিল্পী এসেছিলেন—কেউ কিউবিস্ট কেউ ফিউচারিস্ট।—কেউ বা অন্য কিছু। তাঁরা খুশী হলেন। এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেশ হৃদ্যপরিচয়ে পরিচিত হয়ে গেলেন। তাঁদের দল আছে। বললেন-আমাদের দলে আসুন।
সে চৌবাচ্চায় বন্দী মাছের ওপরে জলস্রোতের শব্দ এবং ইসারায় আহ্বান পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরিচয় এমনই গাঢ় হল যে, সেইদিন সে তাদের বাজনাও শুনিয়ে দিলে-এস্রাজ—বেহালা।
এর মধ্যে সময় যে কেমন করে উড়ে গেল তা দলের কারুরই খেয়াল ছিল না। হঠাৎ একজন বললে—ওরে সর্বনাশ! আটটা যে বাজে বাজে! আমি উঠলাম। তখন নতুন করে কফি এবং খাবারের কথা বলেছে সুরেশ্বর। সে বললে—সে কি?
ভদ্রলোক বললেন-না! আটটার পর কফি-না স্যার! আবার আসব। নিয়ে যাব আপনাকে। আজ ছুটি!
অন্য একজন বললেন—উনি ড্রিংক করেন।
সুরেশ্বর বলে উঠল—বেশ তো। তাই আনাচ্ছি। বসুন।
—খুব ভালো হবে। আপনার স্বাস্থ্যপান করে উন্নতি কামনা করে ফাংশন হবে আমাদের।
তারপর উৎসাহ এবং উল্লাসের মধ্যে সে তাদের গেলাসের সঙ্গে গেলাস ঠেকিয়ে মদও খেলে!
আসর যখন ভাঙল, তখন ন’টা বেজে গেছে!
সকলে চলে গেলে সে আবার গিয়ে ছাদে উঠল। চৌরিঙ্গীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথার মধ্যে মদের প্রভাব চঞ্চল উত্তেজনা জাগিয়েছে—মনের মধ্যে প্রশংসা প্রতিষ্ঠার এবং শিল্পীদের প্রীতির স্মৃতি চৌরিঙ্গীর আলোর মতই ঝলমল করছে। পৃথিবী যেন তাকে ডাকছে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ মনে হল কালকের রাত্রের কথা। বের হবে আজকে আবার? এই শীতের রাত্রে যারা সুতি জামা আর রঙীন কাপড়ে ও রঙে পাউডারে সেজে সামান্য টাকার জন্যে হাসির মুখোশ পরে বসে আছে পথের দিকে তাকিয়ে, তাদের সকলের হাতে পাঁচটা করে টাকা দিয়ে বলে আসবে—যাও ঘরে যাও। এই তো কিছু পেলে—এ থেকেই চালিয়ে নিয়ো। দাঁড়িয়ে শীতে কষ্ট ক’রো না, যাও।
আবার আজ একবার সে দেবতা হয়ে পুজো প্রণাম কুড়িয়ে ফিরে আসবে। ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল তার। কিন্তু—। একটা নয় অনেক, কিন্তু! সব থেকে বড় হয়ে উঠল একটা কিন্তু। সে মদ খেয়েছে। কি ভাববে সেই রামদীন—তাকে তো সঙ্গে নিতেই হবে। কি ভাববে যাদের হাতে টাকা দেবে তারা? ভাববে না এটা মাতালের খেয়াল?
নিজেকে সংবরণ করলে সে। বাবার কথা মনে হল।
না! সে যাবে না! চন্দ্রিকাতে বাবা সহজ অবস্থায় মুগ্ধ হননি। তার প্রথম দিনের কথা বেশ মনে আছে। বাবা বেহালা বাজিয়েছিলেন—সে তবলা বাজিয়েছিল। সে গন্ধ পেয়েছিল বাবার কাছ থেকে।
না—সে যাবে না।
.
পরদিন সকালটা এর তৃপ্তিতে ভরপুর হয়ে ছিল। সে তৃপ্তি উপচে পড়েছিল একখানা চিঠি পেয়ে। সুলতার চিঠি; ছোট চিঠি।
ভারী ভালো লাগল চিঠিখানি। তবে একটা কথার প্রতিবাদ করছি। মনে হয় অতি বিনয়ে লিখেছেন বা আবেগের অতিশয্যে লিখেছেন। সংসারে পরশপাথর অলীক বস্তু। কিন্তু সোনা বাস্তব। আপনার মনই সোনা দিয়ে গড়া। কিছুর ছোঁয়াতে সোনা সে হয় নি। আমায় কাছ থেকে হয়তো খানিকটা উত্তাপ পেয়েছিলেন যাতে সোনার কাঠিন্য কিছু নরম হয়েছিল।
আপনি খাঁটি শিল্পী, বিচিত্র মানুষ—যাদের বিধাতা ছাঁচে তৈরী করেন না। নিজের হাতে তৈরী করেন পরমানন্দের মধ্যে। ইতি
—সুলতা ঘোষ।
সেদিন সন্ধ্যায় সে মদ খায়নি। সময় থাকতে ম্যানেজারের কাছে টাকা চেয়ে নিয়ে রেখেছিল। এবং সন্ধ্যার পর বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বিডন স্ট্রীট এবং সেন্ট্রাল এ্যাভেন্যু জংশনে নেমে রামদীনকে ডেকেছিল। রামদীন দাঁড়িয়েই ছিল। সে সসম্ভ্রমে সেলাম করে বলেছিল—হুজুর।
—আসবে একবার আমার সঙ্গে!
—শেফালি বিবিকে হুঁয়া?
—নেহি। এদের মধ্যে সব থেকে গরীব যারা, তাদের কিছু করে দিতে চাই।
রামদীন অবাক হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ তার মন আর একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছিল। বলেছিল—না। আমি ঘুরে আসছি। এগারোটা নাগাদ আসব। বুঝেছ! তুমি থেকো।
ট্যাক্সিটা তখনও যায়নি। মোড় নেবার উপক্রম করছিল মাত্র। সে ট্যাক্সিতে চড়ে বলেছিল- চল। এখন নটা বাজে। দুঘণ্টা ঘোরাও। তারপর ফের আসবে এখানে। এগারটায় এসে রামদীনকে সঙ্গে নিয়ে সেই গলিটা থেকেই শুরু করেছিল। যারা তখনও সেই শীতের মধ্যে ক্লিষ্ট মুখে, উৎকণ্ঠিত চোখে পথের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করে ছিল তাদের হাতে সে এক একখানা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বলেছিল-ঘরে যাও। রাত্রি অনেক হয়েছে। সে দাঁড়ায়নি কোথাও এক মুহূর্ত। এ-মোড়ে ঢুকে ও মোড়ে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে চেপে বলেছিল—চল।
ট্যাক্সিটা সে দাঁড় করিয়েই রেখেছিল।
রাত্রে গিয়ে সুলতাকে পত্র লিখেছিল। পরদিন সকালে জি-পি-ও-তে ফেলে এসেছিল নিজেই। সেদিন সন্ধ্যার সময় সুলতা নিজেই এসেছিল।
বলেছিল-আপনি কি পাগল নাকি?
—কেন?
—এসব কি আরম্ভ করেছেন?
—এদের দুঃখ জানেন?
—জানা সম্ভব নয়। তবে অনুমান করতে পারি। কিন্তু দুঃখ যতই থাক তার প্রতিকার কেউ কি এইভাবে করতে পারে?
—যতটুকু পারি।
—আপনি পৃথিবীর বুর্জোয়াদের একজন খাঁটি বুর্জোয়া।
হেসে উঠেছিল সে, বলেছিল—না—আমি—আর্টিস্ট!
—না বুর্জোয়া। ন্যাশনাল মুভমেন্ট নিয়ে সে চিঠি এই কারণেই আপনার পক্ষে দেখা সম্ভবপর হয়েছিল।
চুপ করে গিয়েছিল সুরেশ্বর। মনে আঘাত পেয়েছিল।
সুলতা বলেছিল—এ সব ছাড়ুন। মানী আর্টিস্টদের খেয়াল থাকে। তারা কিছুটা অদ্ভুত হয়ে থাকে। যে কাজ করেছেন তাতে তাদের এককণা উপকারও হয়েছে-একটা দিনের খোরাক হয়েও কিছু বেঁচেছে হয়তো! সব মেনেও বলব এটা পথ নয়! শুধু যারা বড়লোক তাদেরই এমন দয়ার অহঙ্কার থাকে। এটা ভাল নয়, ছাড়ুন!
বলে সে চলে গিয়েছিল।
বিচিত্র মানুষের মন। সেই বৈচিত্র্য বশেই বোধ করি এই মতের পার্থক্য সত্ত্বেও কিছুদিনের মধ্যেই সুলতা এবং সুরেশ্বর খুবই কাছাকাছি এসে পড়েছিল। দেখার চেয়ে বেশী চিঠি লেখার মধ্যেই হয়েছিল এটা। মাস কয়েকের মধ্যেই তারা চিঠি লিখতে শুরু করল “সু” বলে এবং শেষে সই করত “সু” ব’লে। সুলতাও তাই লিখত। আরম্ভে “সু”–শেষেও “সু”। ওরই মধ্যে বোধহয় জ্যামিতিক নিয়মে দুটি ত্রিভুজের মিলে যাওয়ার মত দুজনের চিঠিতেই সু শব্দের মিলের মধ্যে মনের মিল হওয়া বা মিলে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। দুজনের মধ্যে যে পার্থক্য—তা সামান্য ছিল না-ছিল অনেক। সেটা মতের এবং পথের। মতে ও পথে সুলতা ছিল ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুরেশ্বর সেদিক থেকে দাগী। কিন্তু ইদানীং তার এই বিচিত্র ছবির অঙ্কনপদ্ধতির জন্য বিপ্লবী দলের প্রশংসা পেয়েছিল। তাঁরা হয়তো তাকে এই জন্যেই মার্জনা করেছেন যে, যারা সংসারে শিল্পী হয় তারা এ ধরনের ভ্রম এবং ভুল ক’রে ফেলে আবেগ বশে। তাহলেও মতের কথায় তাদের মিলত না। তবুও কিছুদিনের মধ্যেই সুরেশ্বর লিখলে—দেখ পুরুষে নারীতে মিলন হয় বাহুবন্ধনের মধ্যে। এবং মনে মনে। যে মন মতের তোয়াক্কা করে না, তার রাজত্বের বাইরে তার বাস। সেখানে তোমার আমার মন —“সু” শব্দের মতই মিলে গেছে। এরপর রেশ্বর এবং লতার যদি নাই হয় মিল–সেক্ষেত্রে কি যায় আসে! আমার মত হল—মিলনটা বিবাহের চেয়েও বড়। সেটা আমি জানি তোমারও। কিন্তু বিবাহের চেয়ে বড় যে মিলন-তার দিন আসেনি। এবং অন্যদিকে মিলনটাই যখন হয়ে গেছে মনে মনে তখন ছোট ব্যাপার বিবাহটাই বা হবে না কেন?
সুলতা লিখেছিল—তুমি পাগল। এক কথায় বিয়ে!
সুরেশ্বর লিখেছিল—একশো বার। সুস্থ মানুষকে ঠেকানো যায়। পাগলকে ঠেকানো যায় না।
সুলতা লিখেছিল-যায়। রাঁচী পাঠালে।
সুরেশ্বর লিখলে তার থেকে তুমি শেকল দিয়ে বাঁধো না!
সুলতা লিখলে—অবুঝের সঙ্গে সংকেতে আলাপ চলে না। আগেরকালে যাঁরা বলেছেন—অরসিকের কাছে রসের নিবেদন করতে নেই তাঁদের কথাটা পাল্টে বলতে চাই বোকা বা পাগলকে বুদ্ধিমানের মত কথা বলো না এবং একেবারে রূঢ় যুক্তি ছাড়া বোঝাতে চেয়ো না। তোমার সঙ্গে এ মিলন হয় না। বাবা ব্যারিস্টার। তাঁর মেয়ে আমি কিন্তু আমি পাগল নই, আর্টিস্টও নই। তুমি জমিদারের ছেলে হয়ে খেয়াল নেই যে আমাকে বিয়ে করলে তোমার সমূহ ক্ষতি হবে। দেবোত্তরের সেবায়েত স্বত্ব চলে যাবে। ওসব ভুলে যাও। আমি তোমার সু হয়েই থাকব, কুয়ের কারণ হতে পারব না।
সুরেশ্বর এবার টেলিফোন ধরলে। কারণ চিঠি যাবে আসবে এ বিলম্ব তার সহ্য হল না। সে বললে—সু। আমি সু’ বলছি। তুমি যদি আমার কুয়ের কারণই হও, দেবোত্তরের সেবায়েত পথ যদি যায়ই তবে আমি তোমাকে পেয়ে ধন্য হব-মুক্তি পেয়ে যাব। আমি এ যুগের মানুষ। রায়বংশের গৌরবে কোন শ্রদ্ধা নেই আমার। যেটুকু শ্রদ্ধা আজ আমার জুটেছে সে আমার তুলির জোরে, আমার মনের জোরে। দেবতাতেও আমার বিশ্বাস নেই। তবে এইটুকু বলছি—রায়বংশের সেবায়েতরা দেবতাকে ফাঁকি দিয়ে সম্পত্তি পত্তনী দরপত্তনী দিয়েছেন, তার মোটা অংশ আমার ঠাকুরদা-তারপর আমার মা কিনে গেছেন। সুতরাং আর্থিক কষ্টে পড়ারও আশঙ্কা নেই। যদি তাও থাকত তবে আমি তাতেও পিছপাও হতাম না। এখন কি বলছ বল?
সুলতা চুপ করে ছিল।
সুরেশ্বর প্রশ্ন করেছিল—উত্তর দাও।
—উত্তর?
—হ্যাঁ।
এবারও নীরব থেকে ছিল সুলতা।
সুরেশ্বর বলেছিল—মৌন থাকলে সম্মতি আছে ধরে নিতে হয়। তা হলে কাল আমি তোমার বাবার কাছে যাব।
এবার সুলতা বলেছিল—এখনও ভাবছি।
—এর মধ্যে ভাবনার কি আছে?
—আছে?
—না নেই। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, মত নিয়ে কখনও কোনও ঝগড়া আমি করব না। তারপর হেসে বলেছিল-আমি ছবির একজিবিশন করব, তুমি বলো কিছু হয়নি, আমি রাগব না। তুমি ইলেকশনে দাঁড়িয়ো আমি কথা দিচ্ছি তোমার পোস্টার তৈরি করে দেব। আমার জমিদারীতে বলে দেব।
—কিন্তু তবুও যদি না বনে?
—তখন ডাইভোর্স করে নেব।
—হুঁ।
—তার মানে?
—তার মানে তা হলে আমাকে পরীক্ষাটা আগে পাশ করতে হবে। তারপর বিয়ে। তখন তুমি বাবাকে এসে বলবে।
—তা হ’লে আবার তখন কেন?
—তখন এই জন্যে যে, রেজেস্ট্রী করে বিয়ে করে যদি ডাইভোর্স করতে হয় তখন আমি কি করব? জীবিকা উপার্জনের ক্ষমতা না-থাকলে নতুন স্বামী খুঁজে বেড়াতে হবে। নয়তো কোন সাবান গন্ধতেল স্নোওয়ালাদের মাল নিয়ে বাড়ী-বাড়ী বেচে বেড়াতে হবে কমিশনের জন্য। নেহাত ভাগ্য হলে টেলিফোনে চাকরি পেতে পারি। তা হবে না।
—তুমি ঠাট্টা করছ?
—বুঝলে এতক্ষণে ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু তোমায় হাতজোড় করে মিনতি করছি, আমাকে পাসটা করতে দাও। বিয়ে হলে আর হবে না পাশ করা। তুমি যা মানুষ!
ওই পরীক্ষার জন্যেই বিয়েটা ঠেকে ছিল। এবং সেটা দুজনের প্রতিশ্রুতিক্রমে খুব গোপনেও ছিল। তার কারণ সুরেশ্বরেরই দেবোত্তর। এদিকে তার মামা এবং ম্যানেজার ওদিকে সুলতার বাবা দুপক্ষেই হয়তো আপত্তি তুলবেন।
সুলতার পরীক্ষা ছিল মাস দেড়েক পর। ছাত্রী হিসাবে ভালই ছিল। এবং রেজাল্ট ভাল করবার নেশাও ছিল। তবু মধ্যে মধ্যে আসত সে সুরেশ্বরের দাবী মত। দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে যেত—ইডেন গার্ডেন বা গঙ্গার ধার দিয়ে। সপ্তাহে একদিন হয়তো।
এরই মধ্যে হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল।
হঠাৎ কীর্তিহাটের দেবোত্তরের নায়েব সেটেলমেন্ট ক্যাম্প আদালতের এক সমন হাতে এসে হাজির হন। তার সঙ্গে মেজঠাকুমাও এসে হাজির হলেন কীর্তিহাট থেকে। সমনখানা তাঁরাই হাতে ক’রে এনেছেন। দেশে গভর্নমেন্ট সেটেলমেন্ট হচ্ছে। তার ব্যাপার অর্থাৎ আইন কানুন প্রায় সামরিক আইনের ধাঁচে তৈরী। মাঠের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে তাঁরা তেতে পুড়ে থাকেন—তাঁদের তাঁবুর দরজায় বিত্তবান মালিকদের হাতজোড় করে না দাঁড়ালে অঙ্গ শীতল হয় না—মেজাজ ঠান্ডা হয় না। কীর্তিহাটের কর্মচারীরা যা কাগজপত্র দেখিয়েছে তাতে তাদের সমস্যা মেটেনি। উল্টে মেজতরফ অর্থাৎ শিবেশ্বরের ছেলেরা নানান রকমে গোল বাধিয়েছে। যা কাগজ দেখিয়েছে তাতেই তারা আপত্তি দিয়েছে, বলেছে দেবোত্তর। আবার বহু দেবোত্তর সম্পত্তিও তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে রেকর্ড করিয়েছে। জাল-জালিয়াতি করতে তাদের দ্বিধা হয় নি। বরং তারা গৌরববোধ করেছে তাদের নিজেদের বিষয়বোধের জন্য। এতে মুখপাত্র হয়েছে সুখেশ্বরের ছেলে দুজন। দুজনেই চতুর এবং কিছু লেখাপড়াও শিখেছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ধনেশ্বর এবং জগদীশ্বর। জগদীশ্বর গাঁজা খায়, মদ খায়, ধনেশ্বর থেকেও উগ্র। সে বাঘ মেরে একটা বন্দুক পেয়েছে। সেই বন্দুক ঘাড়ে বেড়ায়। এবং কথায় কথায় মারপিট করে। সাধারণ গরীব প্রজারাও ভয় করে তার প্রহারকে এবং মধ্যবিত্ত গৃহস্থেরা ভয় করে তাকে কুকথার জন্য। সরকারী কর্মচারী বিশেষ করে হাকিমের কাছে তারা অত্যন্ত বিনীত এবং অনুগত। সুতরাং দেবোত্তরের কর্মচারীরা হয়ে পড়েছে অসহায়। হাকিম তাদের ঠিক বিশ্বাস করেন না। এবং তাদের ভরসায় সাধারণ প্রজা গরীব ও মধ্যবিত্ত কেউই সাক্ষী দিতে অগ্রসর হয় না। সুতরাং দেবোত্তরের নায়েবরাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে মিথ্যাবাদী জালিয়াত কুচক্রী। তাছাড়াও সেটেলমেন্ট হাকিম হয়েছেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ। কারণ আজও পর্যন্ত এই সম্পত্তির মোটা অংশের মালিক শ্রীসুরেশ্বর রায় তাঁদের ক্যাম্পে হাজিরা দেয়নি। সুতরাং তাঁরা হুকুম জারী করেছেন সুরেশ্বর রায়কে সশরীরে ক্যাম্প- আদালতে হাজির হতে হবে প্রয়োজনীয় দলিলপত্রসহ। অন্যথায় বডি ওয়ারেন্ট জারী করে তাকে গ্রেপ্তার করে হাজির করা হবে।
সমন নিয়ে ছুটে এসেছে দেবোত্তরের নায়েব। সঙ্গে এসেছেন মেজঠাকুমা। মেজঠাকুমা বললেন—ভাই, বলতে গেলে ওরা আমারই বংশ। কিন্তু কি ক’রে দেখব যে তারাই ভগবানের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে? আর তোমাকে ঠকাচ্ছে? মেজকর্তা গিয়ে অবধি ওরা তো আমার দিকে ফিরে তাকায় না। ভগবানের প্রসাদের বরাদ্দ করে গেছেন শ্বশুর। আজকাল প্রসাদ বলতে করকরে আতপের ভাত আর সামান্য ব্যঞ্জন, তা মুখে দেওয়া যায় না। তাই খেয়ে পেটটা ভরে। আর তোমার মা বরাদ্দ করে গেছেন পঞ্চাশ টাকা মাসিক। তাতেই বস্তু তাতেই তেল তাতেই ধর্ম ব্রত-পার্বণ সব। ভাই, ভগবানের বাল্যভোগ শুধু মণ্ডায় ঠেকিয়েছে। আমি একটু করে ছানা কিনে দি ওই টাকা থেকে। তোমাদের বলব কোন মুখে? কিন্তু আজ যখন তারা ঠাকুরকে তোমাকে সবাইকে ঠকাবে তখন আমিও ঠকব। লজ্জার দায়ে ছুটে এসেছি—পেটের দায়ে ছুটে এসেছি। শ্বশুরবংশের মান সম্ভ্রম কীর্তি সব ডুববে বলে ভয়ে ছুটে এসেছি। তুমি চলো ভাই। একবার গিয়ে দাঁড়াও!
এখানকার নায়েব ম্যানেজার হরচন্দ্র তখন কদিন থেকে অসুস্থ। তিনি ঘরে বিছানায় শুয়ে আছেন। না-হ’লে তাঁর নামে আম-মোক্তারনামা পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দেওয়া আছে, তাঁকে পাঠালে চলত। দিন পরশু।
পরের দিন সুলতার সঙ্গে সে একটা এনগেজমেন্ট করেছিল। ওই টেলিফোন কথাবার্তার পর তারা দু-তিন দিন দেখা করেছে, বেড়িয়েছে একসঙ্গে। কথা ছিল ইডেন গার্ডেনে দুপুরবেলা গিয়ে সে তার ছবি আঁকবে।
সে ফোন করলে সুলতাকে।-বিপদ ঘটেছে সু।
—কি বিপদ?
সে বললে বিপদের কথা। বললে—এ রাজত্ব ইংরেজের রাজত্ব, অভিসম্পাত করছি, এই পাপেই ধ্বংস হোক। এবং হবেও তুমি দেখো। আমি নায়েবকে বললাম- আমি যদি সম্পত্তি বললাম-আমি না চাই। হেসে ম্যানেজার বললেন—তাও গিয়ে হাজির হয়ে বলে আসতে হবে। এবং হাজির না হলে এরা কোমরে বেঁধে নিয়ে যাবে। এর আর জামিন নেই। আপীল নেই। কি করি বল তো!
হেসে সুলতা বলেছিল, আমার সামনে পরীক্ষা না থাকলে তুমি অ্যান্ড করতে, আমি তোমাকে শেল্টার দিতাম। তাতে আমার যা হবার হত। কিন্তু যাও না ঘুরেই এস না।
—যেতে বলছ?
—বলছি?
ছেড়ে দিয়েছিল ফোন সুরেশ্বর। কিছুক্ষণ পরে আবার সুলতা ফোন ক’রে বলেছিল-দেখ, বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম। বাবা বললেন—যেতেই হবে সুরেশ্বরকে। হি মাস্ট গো।
—মাস্ট গো!
—হ্যাঁ। বলছেন না-গেলে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাবে তিনি বুঝতে পারছেন।
বৃদ্ধ হরচন্দ্র বিকেলে সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই এসেছিলেন—যাওয়ার কি ব্যবস্থা হ’ল দেখতে! সঙ্গে এখানকার পুরনো আমলাকে দিলেন, যে দীর্ঘকাল প্রায় তিরিশ বছর—যোগেশ্বরের জমিদারী সেরেস্তায় আছে।
রওনা হতে হ’ল সেই রাত্রেই। না হলে সকালে পৌঁছনো যাবে না। সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে সময় দেওয়া আছে-বেলা দশটা।
সেই গেল সুরেশ্বর। ১৯৩৪ সাল শেষ হয়েছে, ১৯৩৫ সালের মার্চের ৩১শে রাত্রে। দিন ছিল ১লা এপ্রিল।
সেই গেল। তারপর বিচিত্রচরিত্র এই খেয়ালী বা অর্ধপাগল সুরেশ্বর কীর্তিহাটেই থেকে গিয়েছিল। কলকাতায় মধ্যে মাঝে দু-চার দিনের জন্য বা এক দুদিনের জন্য এসেছে, আবার ফিরে গিয়েছে কিন্তু সুলতার সঙ্গে আর দেখা করেনি। চিঠির মধ্যে দিয়ে যে ঘনিষ্ঠতার শুরু হয়েছিল, চিঠির মধ্যে দিয়েই তাতে ছেদ টেনে শেষ ক’রে দিয়েছে। শুধু সুলতার সঙ্গেই নয়, কলকাতার জীবনের সঙ্গে, শিল্পী-জীবন না হলেও শিল্পী-সমাজের সঙ্গে, সভ্য সমাজের সঙ্গে, সব কিছুর সঙ্গে। একবার নাকি বিলেত ঘুরে এসেছে—সেটা প্রথম দিকেই। তারপর সব শেষ। লোকে নানান কথা বলেছে। ক্রমে সে কথা চাপা পড়েছে। সুরেশ্বর সকলের মন থেকে মুছে গেছে।
সুলতা নীরবেই সব সহ্য করেছে। তার অন্তরের কথা সে-ই জানে। তবে সে বিয়ে করেনি। বি.এ. পাশ করে সে দ্বিগুণ উৎসাহে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল। এম.এ. পাশ করে কলেজে অধ্যাপিকার কাজ নিয়ে সেই রাজনীতি নিয়েই একরকম মেতে আছে। বামপন্থী রাজনীতি। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টি নয়! সোস্যালিস্ট সে। আজ ১৯৫৩ সালের ২৫শে নভেম্বর। এই আঠারো বছর পরে সেই সুরেশ্বর এবং সেই সুলতা জানবাজারের বাড়ীতে আকস্মিক ভাবে মিলিত হয়ে সামনাসামনি বসেছে। সামনের দেওয়ালে সুরেশ্বরের আঁকা সারি সারি ছবি। বিভিন্ন ভঙ্গী বিচিত্র বর্ণবিন্যাস। উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করছে। তার প্রথম ছবিখানার উপর ছড়ি ঠেকিয়ে সুরেশ্বর বললে—এই আমার প্রথম ছবি। পুণ্যবারিবিধৌত তট-বটচ্ছায়া-শীতল কীর্তিহাট গ্রাম। ১৮০১ সাল!
সুলতা ছবিখানার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ভারী ভাল হয়েছে ছবিখানা। রেখায় বর্ণে সুন্দর লাগছে।
না। শিল্পে সুরেশ্বর বেঁচে আছে!
সুরেশ্বর বললে–লেডীজ অ্যান্ড জেন্টলমেন!
চকিত হয়ে উঠল সুলতা। লেডীজ অ্যান্ড জেন্টলমেন!
সুরেশ্বর সংশোধন করে নিলে—না। এখানে তো তুমি একা সুলতা! হাসলে। তারপর বললে-দেখ, কিছুক্ষণ আগে বলছিলাম, তুমি নিজেও জান—একটা পাগলামি আমাদের বংশে আছে। খেয়াল ততক্ষণই খেয়াল, যতক্ষণ মাত্রা না ছাড়ায়। আমার মাত্রা অনেকদিন ছাড়িয়েছে। তারপর কীর্তিহাটে গিয়ে সেটা আমার মন আমার বুদ্ধি আমার বাসনা কামনাকে এমনভাবে অভিভূত করেছে সুলতা যে আমার ঠিক থাকে না। অবশ্য মদ্যপান আমি প্রচুর করতাম। ওটা তাকে বাড়িয়ে তুলত। আমি কল্পনায় নানান ছবি দেখি অন্ধকার রাত্রে। দেওয়ালের গায়ে, ছাদে চটে যাওয়া পলেস্তারার মধ্যে দেখতে পাই নানান ছবি। কখনও কখনও জীবন্ত হয়ে ওঠে তারা, কথা বলে। আজও আমার মনে হচ্ছিল, এই যে ছবিগুলোর মানুষ, হয় তারাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে, নয়তো অনেক অশরীরী আত্মা এখানে বসেছে। তারা দেখতে এসেছে ছবিতে কীর্তিহাটের কড়চা। শুনতে এসেছে সুরেশ্বরের জবানবন্দী।
চোখ দেখে সুলতার মনে হল, সুরেশ্বর কত দূরে -অনেক দুরের দিকে চেয়ে রয়েছে।