কিছুই থাকে না শূন্য
সকালে কলেজে যাওয়ার পথে পিঙ্কি দেখল, রাস্তায় একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে। তোলাটা ঠিক হবে কিনা একবার ভাবল। তারপর ভাবল আমি না তুলে নিলেও কেউ তো তুলে নেবে? তাহলে আমার আর তুলতে দোষ কোথায়? এই ভেবে সে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিল, কেউ কোথায়ও আছে কিনা? কাছে পিঠে কেউ নেই। দূরে একটা বুড়ো মতন লোক ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে। পরনে তার খাঁটো ধুতি। ব্যাগটা লোকটার হবে না নিশ্চয়ই। ধুতি পরে কেউ মানিব্যাগ নিয়ে বের হয় না। নিজেই আবার ভাবল, বের হবে না কেন? কেউ তো ধুতি পরে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে বেরোতে পারে। পারে কিনা?
পারে, কিন্তু কয়জনে তা করে। ধুতি পরলে টাকা ট্যাকে গুঁজে রাখে। মানিব্যাগ নিয়ে কেউ বের হয় না বোধহয়।
এত ভাবার সময় নেই, বুড়ো লোকটা কাছে এগিয়ে আসছে, তাকে আড়াল করে পিঙ্কি মানি ব্যাগটা বাঁ হাত দিয়ে তুলে নিয়ে, চটপট বই-খাতার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটতে লাগল।
ব্যাগের মধ্যে কি আছে, দেখার জন্য পিঙ্কির মনটা ছটপট করে লাগল। কিন্তু কলেজে ব্যাগটা খুলে দেখা যাবে না। কেউ দেখলে বলবে, কিরে মানিব্যাগটা কার? তোর বয় ফ্রেন্ডের?
পিঙ্কি কি উত্তর দেবে এ কথার?
- হ্যাঁ। যদিও তার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। কলেজের অনেকেরই বয়ফ্রেন্ন্ড আছে। তার নেই। চিন্ময়ীর আছে। ও হয়তো ঠোঁট উল্টে বলবে, তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম কি।
- বাদল।
- তার ভাল নাম কিছু নেই?
- না।
- তুই কি ডাকিস, বাদু? বলেই সে হি হি করে হাঁসতে থাকবে।
- হাসছিন কেন?
- ভেবে হাসি পাচ্ছে, তুই তোর বয়ফ্রেন্ন্ড কে ডাকছিস, বাদু বাদু বলে।
- বাদু ডাকব কেন?
- তবে কি বলে ডাকিস?
- বাবু বলে
- কেন? বাবু ডাকিস কেন?
- ভালো লাগে ওই নামে ডাকতে।
- ও তোকে কি বলে ডাকে?
- সোনা।
- তুই কি বাবুর সোনা দাসী হতে চাস?
- ধূর।
পিঙ্কি মনে মনে ভাবে, তার একজন প্রেমিক থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু কিভাবে প্রেম করতে হয়ে সে জানে না।
একদিন শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা কি করে প্রেম করতে হয় রে?
শিপ্রা শুনে হেসে বলেছিল, কেন তোর কাউকে পছন্দ?
- না তো।
- তবে প্রেম করবি কার সাথে?
- ওহ্ প্রেম করতে হলে আগে ছেলে পছন্দ করতে হয় বুঝি?
- অবশ্যই
- কেন?
পছন্দ না হলে, তুই কার সাথে প্রেম করতে যাবি? - ওহ্ পছন্দ না এমনি কাউকে প্রেম করা যায় না?
- তুই একটা গাধা।
শ্রিপা তার সঙ্গেই সাহিত্যে অনার্স নিয়ে প্রথমবর্ষে পড়ে। সে দীপকের সঙ্গে প্রেম করে। দীপকের গড়িয়াহাটে একটা কসমেটিকস ছোট দোকান আছে। সেখানে টিপ কিনতে গিয়েই শিপ্রার সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়। শিপ্রা সেখানে মাঝেমাঝে এটা-সেটা কিনতে যেত। কখনও হেয়ার ক্লীপ, কখনও নেলপালিশ, কখনও অকারণ। দীপককে দেখতে দেখতে, তার সঙ্গে কথা বলে, শিপ্রার তাকে ভাল লেগে যায়। শিপ্রার মনের ভিতরে দীপক ঢুকে পড়ে কেমনভাবে যেন। শ্রিপাও তা জানে না। আজকাল দীপককে একদিন না দেখলে, তার সাথে কথা না বললে, শিপ্রার মনটা কেমন করে। ভাল লাগে না মোটেও। যদিও তার শরীর মন সুস্থ। কোন আধি-ব্যাধি নেই শরীরে। তবুও কেমন খারাপ লাগে তার। এর নাম বোধহয় প্রেমরোগ।
- আচ্ছা, শিপ্রা তুই বল তো, বাদল নামটা কেমন?
- কেন? বাদলকে কি তোর ভালো লাগে?
- বাদল কে? তাই তো জানি না, তাকে আবার ভাল লাগবে কি?
- এই যে বললি, বাদল?
- হ্যাঁ নামটা তোর কেমন জানতে চাইছি?
- কেন নাম দিয়ে কি করবি? নামটাকে ভালবাসবি নাকি?
- হ্যাঁ বাদল নামের কাউকে পেলে ভালবাসব।
- অন্ধ খোঁড়া যে কেউ হোক, ওই নামের?
- হ্যাঁ
- তুই একটা পাগল।
- নারে, শোন না, তাকে যদি আমি বাদু বাদু বলে ডাকি কেমন শোনাবে?
- বাদু, বলদ, বাঁদর যা খুশি ডাক। আমি এখন চলি। দীপু রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এখন তবে আসি।
- কংগ্রাচুলেশন। পিঙ্কি বলল তাকে।
শিপ্রা চলে গেল।
ক্লাস করে, অফ-পিরিয়ডে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে, চা খেয়ে, আড্ডা মেরে সারদিন কেটে গেল। মানিব্যাগটা বইখাতার ব্যাগের ভিতর এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। তার কথা পিঙ্কির মনে পড়েনি। বাড়ি ফেরার সময় মনে পড়ল। ভাবল বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা খুলে দেখবে।
ব্যাগের ভিতর টাকা-কড়ি কিছুই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল এক তরুণীর রঙিন একটি ছবি আর দুটি কাগজের টুকরো। তার একটি বারোশ’ টাকা দামের ট্রেডার্স এসেমব্লী থেকে কেনা শাড়ির রশিদ। অন্যটি একটি নাম গোত্রহীন চিঠি। আঁকাবাঁকা অক্ষরে দ্রত লেখা একটি চিঠি।
‘বাবা বোধহয় কিছু টের পেয়েছেন কিছু। তিনি আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। বাবার অফিসের এক বন্ধুর বোন-পো, আগামী রবিবার আমাকে দেখতে আসবেন কোন্নগড় থেকে গাড়ি করে। বোধহয় তাদের গাড়ি আছে সেটা আমাদের দেখাবার জন্য। ছেলে শুনেছি প্রোমোটার। তুমি যা ব্যবস্থা করার, তাড়াতাড়ি কোরো। বাবাকে বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ইতি –
(নাম নেই কোন)
চিঠিটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল পিঙ্কির। তরুণীর কী করুণ অসহায রআর্তি ফুটে উঠেছে, চিঠিটার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে।
তরুণীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে পিঙ্কি দেখেল, বেশ মিষ্টি দেখতে এক তরুণীর ছবি। পরনে রয়েছে তার একটা হলুদ ব্লাউজ আর তার সঙ্গে নীল ডুরে শাড়ি। পিঙ্কির দেখে মনেহল, মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী। টানা টানা চোখ দু’টি মায়াময়। মুখটা পান পাতার মতো ত্রিকোন ধরণে কিছুটা লম্বাটে। গায়ের রঙটাও ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে বোধহয় ফরসা। মুখটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেন। কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না।
ট্রেডার্স এসেমব্লী থেকে শাড়ি কেনার রশিদটা খুলে সেখানে নাম দেখল বাদল সোম।
বাদল নামটা দেখে সে আশ্চর্য হল। বাদল নামটা হঠাৎ কেন তার কলেজে মনে হয়েছিল? তার কি কোন কারণ আছে?
সোম পদবি হয় কারও আগে জানা ছিল না পিঙ্কির। তাহলে মঙ্গল বুধও পদবি থাকতে পারে। কত রকমের না পদবি আছে পৃথিবীতে। বর, ধর কর, সর এসব পদবি পিঙ্কি কখনও শোনেনি। মর পদবি আছে নাকি জানে না সে। বাঘ,সিংহ,হাতি এসব পদবি আছে জানে। তবে শিয়াল খাটাশ শুয়োর হায়না এসব পদবি আছে কিনা জানে না, শোনেনি কখনও। আছে বলে মনে হয় না।
বাদল সোমের ফোন নম্বরও লেখা আছে ক্যাশমেমোতে। ফোন নম্বর দেখে মনে মনে পিঙ্কি ভাবল, একবার ফোন করে তাকে জানাবে নাকি, তার মানিব্যাগটা সে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। তাতে অবশ্য কোনও টাকা ছিল না, একথা বললে বাদলবাবু কি বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মানিব্যাগ, মানি ছাড়া হয় না। বাদলবাবু সেদিন নিশ্চয়ই মানি ছাড়া মানিব্যাগ নিয়ে বেরোননি। কোন পকেটমার বোধহয় তার মানিব্যাগ পিক-পকেট করে পকেট থেকে তুলে নিয়েছে, তারপর ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে নিয়ে মানিব্যাগটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। এ অবস্থায় বাদলবাবুকে ফোন করে তার মানিব্যাগ রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়ার কথা বলে, চুরি না করেও শেষে চুরির দায়ে ধরা পড়বে নাকি? এই ভেবে পিঙ্কি ফোন করার চিন্তাটা মন থেকে দূর করে দিল। চট করে আর একটা চিন্তা পিঙ্কির মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে ভাবল, আচ্ছা সে কেন বাদল সোমের কথা ভাবতে গিয়ে আপনি-আজ্ঞে করে ভাবছে। বাদল না বলে বাদলবাবু বলে সম্মান জানাচ্ছে? তার কি কোন কারণ আছে? আশ্চর্য তো !
পিঙ্কি কলেজে যাবে, আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখল, আয়নার মুখটা ঠিক ডাইরীতে পাওয়া ছবিটার মতো যেন। পিঙ্কি আশ্চর্য হয়ে ভাবল, এটা কেমন করে হল? তখনই ডাইরী থেকে সে ছবিটা বের করে তার মুখের পাশপাশি দেখে নিশ্চিন্ত হল, তার মুখটা ঠিক ছবিটার মতোই তবে একটু গোল প্রকৃতির।
মনের ভিতরে বিস্ময় নিয়েই আচমকা তার ঘুমটা ভেঙে গেল। সে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত দুটো দশ। বেড সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে সে বাথরুমে গেল। বাথরুম সেরে, চোখে মুখে ভাল করে জল দিয়ে ফিরে এল। টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার চোখে ঘুম এল না আর। ভাবতে লাগল, এই স্বপ্নটা সে দেখল কেন? এর কি কোনও মানে আছে? নাকি নিছক স্বপ্ন মাত্র একটা।
পরদিন পিঙ্কি কলেজে গেল। ক্লাসের পর অফ পিরিয়ডে সে শিপ্রাকে বলল, চল ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাই।
- না, আমি এখন দীপকের দোকানে যাব।
- দীপকের সঙ্গে তোর দেখা হবে আজ?
- হ্যাঁ, কেন বল তো?
- চল তবে ওই বকুল গাছটার তলায় পাঁচ মিনিট বসি। বলছি তোকে
- পাঁচ মিনিটের বেশি আমি কিন্তু বসব না।
- বেশ, তবে চল এখন।
ওরা দু’জনে বকুল গাছটার তলায় এসে বসে। - বল।
- আচ্ছা ছেলেদের মানিব্যাগে কি থাকে বলত?
- টাকা থাকে।
- হ্যাঁ, টাকা তো থাকেই। টাকা ছাড়া আর কি থাকে?
- আর কি থাকে আমি জানি না
- ন্যাকা, আর কি থাকে আমি জানি না। কেন দীপকের মানিব্যাগে কি থাকে তুই জানিস না?
- সত্যি জানি না।
- কেন দীপকের মানিব্যাগ তুই দেখিস নি?
- মানিব্যাগ দেখেছি, কিন্তু ভিতরে কি থাকে খুলে দেখিনি।
- আজ খুলে দেখবি, সেখানে তোর একটা ছবি, তোকে লেখা এক টুকরো চিঠি আর তোকে দামি উপহার কিনে দেওয়ার ক্যাশমেমো। আর যাই থাক, সঙ্গে এগুলি নিশ্চয়ই থাকা উচিত। আর না থাকলে বুঝবি দীপক তোকে মন থেকে মোটেও ভালোবাসে না। তোর সঙ্গে টাইম পাশ করে, ব্যাপারটা পেকে উঠলেই গাছ থেকে পাকা ফলের মতো তোকে নীচে ঝেরে ফেলবে। তখন তুই কি করবি?
- পেকে উঠলে মাানে?
- আমি প্রেম করি না। প্রেম করিস তুই। আমার চেয়ে তুই ব্যাপারটা ভালো জানবি পেকে ওঠা মানে কি।
শুনে শিপ্রার বুকের ভিতরটা অকারণে কেঁপে উঠল। সে বলল, - তুই এসব কী বলিস?
- ঠিকই বলি।
- তুই জানলি কি করে এসব?
- প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা থেকে।
- তুইও কি প্রেম করসিস নাকি?
- না।
- তবে তুই জানলি কি করে?
- সে তোকে পরে বলব। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে, এখন তুই ওঠ, যা। দীপকের কাছে গিয়ে দেখ, তার মানিব্যাগে কি আছে?
দীপকের কাছ এসে শিপ্রা ইতস্ততঃ করতে লাগল, এইভেবে যে দীপকের কাছে সে মানিব্যাগ দেখতে চাইবে কিভাবে?
দীপক কাষ্টমারদের নিয়ে ব্যাস্ত ছিল। শিপ্রা এসে কখন তার দোকানের পাশে দাঁড়িয়েছে, দেখতে পায়নি। কাষ্টমারদের ভিড় একটু কমলে শিপ্রা দীপকের কাছে গিয়ে বলল, এই তোমার মানিব্যাগটা একবার দাও তো দেখি।
শুনে দীপক একটু অবাক হয়ে বলল,কেন, তোমার টাকা লাগবে? কতটাকা লাগবে বল?
- টাকা লাগবে না, তুমি একবার ব্যাগটা দাও না?
- টাকা লাগবে না তো মানিব্যাগ নিয়ে তুমি কি করবে?
- দেখব।
- কি দেখবে?
- যা দেখার তা আমি দেখব, তুমি দেবে কিনা, বলো?
দীপক অনিচ্ছা সত্বেও প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে বিরক্ত হয়ে মানিব্যাগটা বের করে শিপ্রার হাতে দিল।
শিপ্রা মানিব্যাগের সবক’টি খাপ খুলে ভাল করে খুঁজে দেখে, ব্যাগের ভিতর কোথায়ও তার ছবি নেই। আর তাকে লেখা টুকরো চিঠিরও কোনও হদিস পাওয়া পেল না। আর দামি উপহার দেওয়ার ক্যাশমেমো পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ দীপক তাকে কোন দামি উপহার দেয়নি কোন দিন। শিপ্রা হতাশ ভাবে মানিব্যাগটা ফেরৎ দিয়ে দিল দীপককে।
দীপক মানিব্যাগটা ফেরৎ নিয়ে শিপ্রাকে বলল, কি হল? - না, কিছু না।
- তবে?
- না, এমনি।
রাস্তার মোড়ে একটা এস টি ডি বুথ আছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার সময় পিঙ্কি এস টি ডি বুধে ঢুকে মানিব্যাগে পাওয়া ফোন নম্বরে ডায়েল করল। ফোন বেজেই যাচ্ছে কেউ ধরছে না। পিঙ্কি রিসিভার কানে ধরে রাখল। কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলা এসে ফোন ধরে বললেন, হ্যাঁলো কে বলছেন? কাকে চাই?
- বাদলবাবু আছেন।
- আপনি কে বলছেন?
- আপনি আমায় চিরবেন না, বাদলবাবু চিনবেন।
- আচ্ছা ধরুন, আমি ডেকে দিচ্ছি ওকে।
- আপনি কে হন ওর?
- মা।
একটু পরের ছেলেদের গম্ভীর একটি ভারী গলার আওয়াজ পেল পিঙ্কি। - হ্যালো কে বলছেন?
- আমি কে বলছি, সেটা জানা খুব জরুরী নয়। যা বলছি সেটা শুনুন।
- বলুন।
- আপনি কি বাদল সোম?
- কেন বলুন তো?
- এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না। কোনও প্রশ্ন না করে, যা জানতে চাইছি, তার উত্তর দিন।
- একেবারে পুলিশের মতো জেরা করছেন।
কি জানতে চান? - আপনি কি বাদল সোম?
- হুম্।
- আপনি যাকে ভালবাসেন তার মা কি তা জানেন?
- মানে আপনি কি বলতে চাইছেন? কার কথা বলছেন?
- আপনি কতজনকে ভালবাসেন? যার কথা বলছি তাকে আপনি ট্রেডার্স এসেমব্লী থেকে বারোশ’ টাকা দামের একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন, কত তারিখে বলব?
কথাটা শুনেই বাদল চুপসে গেল। - কি নাম মেয়েটার?
- পিঙ্কি সাহা।
শুনে পিঙ্কি ভীষণ অবাক হয়ে গেল। তার নামও তো পিঙ্কি। তবে পদবি সাহা নয় দাস। - কি করে সে?
- কলেজে পড়ে।
- কোন কলেজ?
- বাসন্তীদেবী কলেজ।
- গড়িয়াহাটে?
- হ্যাঁ।
পিঙ্কি কলেজটা চেনে। পিঙ্কি পড়ে গোলপার্কের কাছে সকালের শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজে। তারা পঞ্চানন তলায় ভাড়া থাকে। হেঁটেই কলেজে যাতায়াত করে পিঙ্কি। পিঙ্কির বাবা নেই। মা একটা প্রাথমিক স্কৃলে পড়ায়। - পিঙ্কির মা কি জানেন, আপনি তার সঙ্গে প্রেম করছেন?
- না।
- আপনার মা কি জানেন?
বাদল চুপ করে থাকে, কোন উত্তর দেয় না। - তার মানে আপনার মাও জানেন না। মানে আপনি অবৈধ্য প্রেম করছেন?
- অবৈধ কেন হবে?
- কাউকে না জানিয়ে করছেন বলে।
- সেটা গোপন প্রেম বলা যায়, অবৈধ বলা যায় না।
- বেশ তাই হল, গোপন প্রেম। আপনি কি কাজ করেন?
- ব্যাঙ্কে চাকরি করি। এসব দিয়ে আপনার কি দরকার?
- দরকার আছে বলেই তো জানতে চাইছি। না হলে আমার আর জানার প্রয়োজন কি?
- কোন ব্যাঙ্ক?
- স্টেট ব্যাঙ্ক।
- কোন শাখায়?
- বালিগঞ্জ শাখায়।
- বেশ আমি একবার আপনার সঙ্গে দেখা করব।
- কবে, কখন?
- আপনি কোনও টেনশন করবেন না। তা আমি আগে থেকেই জানিয়ে দেব। আপনি আমাকে পিঙ্কির বন্ধু ভাবতে পারেন।
- বেশ।
- আজ তবে রাখছি। আপনার ব্যাঙ্কে গেলে, আপনাকে ফোন করেই যাব।
বলেই পিঙ্কি তারপর ফোনের লাইনটা কেটে দিল। ফোনের সার্ভিস চার্জ পে করে, পিঙ্কি বুথ থেকে বেরিয়ে এল।
বাইরে বেরিয়ে এসে পিঙ্কির বেশ মজা লাগল। বাদলকে বেশ ঘাবড়ে দেওয়া গেছে।
পরদিন কলেজে গেল পিঙ্কি। এক অফ পিরিয়ডে, চিন্ময়ীর সঙ্গে পিঙ্কির দেখা হয়ে গেল ক্যান্টিনে। চিন্ময়ী তাকে কাছে ডাকল। পিঙ্কি উঠে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসল। চিন্ময়ীকে বলল, চা খাবি?
- আমি আগেই বলে এসেছি আমার জন্য, তোর জন্য অর্ডার দে।
- বেশ। বলে পিঙ্কি তার নিজের জন্য চায়ের অর্ডার দিতে গেল। ফিরে এসে চেয়ারে বসে বলল, তারপর তোর খবর কি?
- ভালোই। আর তোর বাদুর খবর কি?
- ভালো।
- কি করে সে?
- ব্যাঙ্কে চাকরি করে।
পিঙ্কির কথাটা বিশ্বাস হয় না চিন্ময়ীর। তাই জানতে চায়, - কোন ব্যাঙ্ক?
- বালিগঞ্জ স্টেট ব্যাঙ্ক।
- আমায় একদিন নিয়ে যাবি?
- কবে যাবি বল?
- আচ্ছা তোকে পরে জানাব।
- বেশ।
চিন্ময়ী ভাবে সমীর (তার প্রেমিক) বি এ পাশ করে, দু’বছর ধরে চেষ্টা করে, জুতোর সোল ক্ষয় করে ফেলেও কোন চাকরি পাচ্ছে না। দু’তিনটে টিউশন করে চালায় নিজেকে। তার বাড়ির অবস্থাও ভাল নয় খুব। তার বাবা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন শারীরীক অসুস্থতার কারণে। এর মধ্যে সমীরের কিছু-একটা কাজকর্ম না জুটলে খুবই জটিল পরিস্থিরর সৃষ্টি হবে তাদের সংসারে।
মেয়েটি ফোন কেটে দিতেই, বাদল ভাবে, মেয়েটি কে? নিজের পরিচয় দিল না। বলল, আমি কে বলছি, সেটা জানা খুব জরুরী নয়। কে হতে পারে? লিলির কোন বন্ধু? কি করে মেয়েটি আমার ফোন নাম্বার পেল? লিলি কি দিয়েছে তাকে? বাদল ট্রু-কলারে ফোন নাম্বারটা চেক করে দেখল। কোনও এস টি ডি বুথ থেকে মেয়েটি ফোন করেছে। সে একবার ভাবল লিলিকে সে ফোন করে জানবে কিনা, লিলি কাউকে তার ফোন নাম্বার দিয়েছে কিনা? পরক্ষণেই ভাবল, না থাক। লিলির কাছে এসব জানতে চাইলে হয়তো সে ভুল বুঝবে। উত্তেজনায় বশে অস্থির হয়ে পড়বে। খুব অস্থিরড় স্বভাবের মেয়ে সে।
মেয়েটি তো বলেছে, সে একদিন ফোন করে তার ব্যাঙ্কে আসবে। ব্যাঙ্কে গেলে তখনই মেয়েটি বোকা বনে যাবে। কারণ সেখানে সে বাদলকে পাবে না। বাদল তাকে একটাও সত্যি কথা বলেনি। সব মিথ্যে বলেছে। এমন কি লিলির নামটা পর্যন্ত, সে মিথ্যে করে পিঙ্কি বলেছে। লিলি কলেজে পড়ে না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর তাকে আর কলেজে ভর্তি করা হয়নি। তার জন্য সুযোগ্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বাদল একটা কাগজের অফিসে কাজ করে। ফ্রিল্যান্সিং করে। তাদের দেওয়া কোন বিশেষ বিষয়ের উপর প্রতিবেদন লিখে সম্পাদকের কাছে জমা দিতে হয়। তার লেখা প্রতিবেদনটি ছাপা হলে, তার জন্য কিছু টাকা পায়। না ছাপা হলে কোন প্রাপ্তি জোটে না। এই আয়ের ভরসায় কাউকে বিয়ে করা যায় না। বাদল একটা ভাল কিছু করবে ভাবে। খবরের কাগজের অফিসের কাজ সে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এই কাজটা ছেড়ে ভাল সে কী করবে সে বুঝে উঠতে পারে না। শুধুই ভাবে।
কিছুদিন পরে পিঙ্কির মনেহল, নিছক মজা করতে যাওয়ার উত্তেজনার আবেগের বশে বাদলবাবুকে ফোন করে কাজটা সে ঠিক করেনি। বাদলের ভাবনা এখন তার মন জুড়ে থাকে। সে কলেজের পড়ায় মন বসাতে পারে না। পড়তে বসলে বাদলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ফরসা রঙের ছিপছিপে এক যুবক। মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। গোঁফ আছে কিনা তার ঠিক মনে পড়ল না। বাদলকে সে কোনদিন দেখেনি। তবে তার এমন একটা ছবি বাদলের কথা ভেবে মনে পড়ল কেন? সে বুঝতে পারছে না। পড়ায় আর তার মন বসল না।
একটু পরেই তার মনে পড়ল, সে একদিন মাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গেছিল তার একটা সেভিসং একাউন্ট খুলতে। সেই একাউন্ট খুলতে গিয়ে, একজন ব্যাঙ্ক কর্মচারী খুব সাহায্য করেছিল তাদের। সে দেখতে ঠিক ওই রকম ছিল। তাই সেই ছবিটাই বাদলবাবু সম্পর্কে তার মনে ভেসে এসেছে। তা ছাড়া আর কিছু না। তখন সে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল।
পিঙ্কি মাঝে মাঝে কবিতা লেখে।
বাদলকে নিয়ে দু’টি পংক্তি হঠাৎ তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল।
“এমন দিনে বাদল বিনে দিন কাটে না আর
গ্রীষ্ম তাপে পুড়ছে এখন মনটা যে আমার।”
কেন পংক্তি দু’টি হঠাৎ তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল সে বুঝতে পারল না।
বাদলবাবুকে নিয়ে মজা করতে গিয়ে ব্যাপারটা আর মজার মধ্যে থাকল না।
মনের অস্থিরভাব কাটাবার জন্য ভাবল একদিন সে ব্যাঙ্কে বাদলবাবুর সঙ্গে দেখা করবে। তারপর ভাবল কেমন মানুষ জানার জন্য আগে পিঙ্কি সাহার সঙ্গে বাসন্তীদেবী কলেজে দেখা করে, তার সঙ্গে পরিচয় করলে মন্দ হয় না। তার থেকে বাদলবাবু সম্পর্কে জেনে নিয়ে, তারপর নয় অবস্থা বুঝে একদিন তার সঙ্গে ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করবে। তখন যদি বাদল জানতে চায় পিঙ্কির কথা আপনি জানলেন কি করে? সে আপনার কে হয়?
তখন সে অনায়াসেই বলতে পারবে পিঙ্কি সাহা আমার বন্ধু হয়।
পরদিন কলেজে শিপ্রার সঙ্গে তার কলেজ ক্যান্টিনে দেখা হল। শিপ্রা মনমরা হয়ে এককাপ চা সামনে নিয়ে বসে আছে। তার চোখ দু’দুটি ভাবলেসহীন। সে যেন কোনও গভীর চিন্তায় ডুবে আছে বলে মনেহল। পিঙ্কি তার উল্টোদিকের চেয়ার টেনে, বসে শিপ্রাকে বলল, কিরে, এত কী ভাবছিস? শিপ্রা চোখ তুলে তাকে দেখে বলল, তুই ঠিকই বলেছিস সে পিঙ্কি।
- কি?
- দীপক আমাকে ভালবাসে না।
- তুই কি করে বুঝলি?
- একদিন তার মানিব্যাগে চেয়ে নিয়ে দেখেছিলাম।
- তো?
- মানিব্যাগের কোন খাপে আমার ছবি বা চিঠি ছিল না।
- দীপকের কথা ছাড়। ও তো একটা ছাড়পোকা। তোর কি ছেলের অভাব আছে? যাবে চাইবি, তাকেই পাবি। এখন চল আমার সঙ্গে।
- কোথায়?
- গেলেই দেখতে পাবি।
- তবুও বল।
- বাসন্তীদেবী কলেজে।
- কেন, সেখানে কি?
- দরকার আছে।
গোলপার্ক থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওরা গড়িয়াহাট বাসন্তীদেবী কলেজের কাছে চলে এল। শিপ্রা বলল, এখানে এলি কেন, বল।
- একজন কে খুঁজতে।
- কি নাম?
- পিঙ্কি সাহা
- তোর নামেই নাম।
- হ্যাঁ, পদবিটা শুধু আলাদা।
- চল, কলেজের ভিতরে ঢুকে খোঁজ করি।
- হ্যাঁ, চল।
ওরা দু’জন ভিতরে ঢুকে এল।
ভিতরে ঢুকেই শিপ্রার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নাম মল্লিকা সেন।
মল্লিকা বলল, কিরে তোরা এখানে?
শিপ্রা পিঙ্কিকে দেখিয়ে বলল, আমার কলেজের বান্ধবী পিঙ্কি দাস, ও পিঙ্কি সাহা নামে একজনকে খুঁজতে এসেছে, যে এই কলেজে পড়ে বলেছে। - কোন ইয়ারে?
পিঙ্কি বলল, তা তো জানি না। - দাঁড়াও, আমি খোঁজ নিয়ে আসছি ইউনিয়ান অফিস থেকে।
মল্লিকা চলে গেল। ওরা দু’জনে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে মল্লিকা বলল, ওই নামে এই কলেজে কেউ পড়ে না।
পিঙ্কি অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? বলেছিল তো এই কলেজে পড়ে।
শিপ্রা বলল, হয় তো তুই ভুলে করোছিস। অন্য কোনও কলেজের নাম বলেছিল।
মুখে বলল, তা হতে পারে। বলেও মন থেকে তার বিভ্রান্তি দূর হল না।
আচ্ছা চল। শিপ্রাকে বলল সে।
ওরা মল্লিকাকে টা টা করে, নিজেদের কলেজে ফিরে এল।
পিঙ্কি শিপ্রাকে বলল, চল এককাপ করে চা খাই।
শিপ্রা বলল, চল।
ওরা এসে ক্যান্টিনে বসল।
খকখক করে কাশির শব্দে বাদলের ঘুম ভাঙল। পাশের ঘরে মা কাশছেন। একবার কাশিটা উঠলে থামতে চায় না। আগে ছিল না। ইদানিং শুরু হয়েছে। বাদল লক্ষ্য করে দেখেছে, সন্ধ্যা সকালের দিকে মার কাশিটা বেড়ে ওঠে। অন্য সময় তেমন থাকে না। আর একবার উঠলে থামতে চায় না। একবার মাকে ডাক্তার দেখানো উচিত। সে কি একবার বিছানা ছেড়ে উঠে মার কাছে গিয়ে বসবে? উঠব উঠব করেও, উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। কাল সারা রাত জেগে একটি লেখা লিখেছে সে। নববর্ষের সেকাল একাল নিয়ে একটি তথ্যনির্ভর লেখা চেয়েছেন সম্পাদক, নববর্ষ সংখ্যার ছাপার জন্য। নববর্ষ সংখ্যায় ছাপা হলে টাকাটা চারগুণ পাওয়া যায় দৈনিক প্রতিবেদনের চেয়ে। তাই সে লেখাটা অনেক খেটে লিখেছে। অনেক রেফারেন্স ঘেটে লিখতে হয়েছে। তিনি জানতেন না যে, সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক নববর্ষের প্রচলন করেছিলেন। লেখাটা লিখে সে খুব তৃপ্তি পেয়েছে মনে। সব লেখায় এমন তৃপ্তি পাওয়া না।
লেখা শেষ করতে করতে রাত প্রায় আড়াইটা বেজে গেছে। লেখাটা এত খেটে লেখার কারণ, সম্পাদক তার মতো আরও পাঁচজনকে লেখাটা লিখতে বলেছেন। সবার লেখা একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। সব লেখাগুলির মধ্য থেকে বাছাই করে মাত্র দু’টি লেখা পত্রিকার বিশেষ নববর্ষ সংখ্যায় ছাপা হবে। বাকিগুলি বাতিল হবে। তাই লেখাটা সে খুব যত্ন করে লিখেছে।
রাত তিনটার পর সে ঘুমিয়েছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লিলির স্বপ্ন দেখেছে। লিলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। লিলি খুব কাঁদছে আর ভাবছে বাদলের কথা। বাদলের বুকটা মুচড়ে উঠল। সে লিলিকে বলতে চাইল, কেঁদো না লিলি, তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। কথাগুলি তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। বাদল কোন কথা বলতে পারছে না। সে কি তবে বোবা হয়ে গেছে? যখন মুখ দিয়ে তার বোবার মতো গোঙানি বের হচ্ছিল,
এমন সময় মায়ের খকখক কাশিতে ভোরবেলা তার ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙলেও সারা শরীর জুড়ে এখন তার একরাশ অবসাদ আর ক্লান্তি। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। শুয়ে সে মনে মনে ভাবল, লেখাটা নববর্ষ সংখ্যায় বের হলে, যে টাকাটা সে পাবে, তাই দিয়ে সে লিলির জন্য একটা নীল রঙের বেনারসী শাড়ি কিনে দেবে।
কোন্নগর থেকে আসা প্রোমোটার পার্টি বিদায় হয়েছে। ছেলেটি লিলিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল এই শর্তে, বিনিময়ে তাকে প্রোমোটিং ব্যবসার জন্য নগদ দশ লাখ টাকা দিতে হবে। লিলির বাবা এত টাকা তাকে কোথা থেকে দেবেন। তিনি একটা পোষ্ট অফিসে পিওনের কাজ করেন। ফলে এই সম্বন্ধ বাতিল হয়ে যায়। লিলির বাবা তাতে মোটেও দমে যাননি। তারপরও এদিকে সেদিকে লিলির জন্য ছেলে খুঁজে বেড়াছে। খোঁজের কোনও বিরাম নেই তার। এই তো শোনা যাচ্ছে সামনের রবিবার সোনারপুর থেকে একজন আসবে। যে নাকি রাজপুর পুরসভায় কাজ করে।
চিন্ময়ী একদিন পিঙ্কিকে দেখে বলল, কিরে তোর বাদলের কাছে কবে আমায় নিয়ে যাবি?
- কেন, সমীরকে আর পছন্দ হচ্ছে নাতোর?
- কী যাতা কথা বলছিস? সমীরকে আমারপছন্দ হবে না কেন? তুই একদিন নিয়ে যাবি বলেছিলি, তাই বললাম।
- আমি ঠাট্টা করে বললাম। পিঙ্কি হেসে ফেলল।
- এ রকম ঠাট্টা আর কখনও করবি না। ঠিক তো?
- আচ্ছা, আর করব না।
- চল, চা খাবি?
- না।
- না কেন?
- ইচ্ছে করছে না।
- কেন, আমার উপর রাগ করেছিস?
- আমি কারও উপর রাগ করি না।
- বেশ, তবে চল।
পিঙ্কি উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গে চিন্ময়ীও উঠে দাঁড়াল। ওরা দু’জনে হাঁটতে হাটতে ক্যান্টিনে এসে বসল। দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল পিঙ্কি।
পিঙ্কি একদিন একা একাই বাদলের সঙ্গে দেখা করতে গেল বালিগঞ্জ ব্যাঙ্কে।
সেখানে গিয়ে শুনল, বাদল সোম নামে কেউ সেখানে কাজ করে না। পিঙ্কি আশ্চর্য হয়ে ভাবল, তবে কি লোকটা তাকে ধাপ্পা দিয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে একটি এস টি ডি বুথ থেকে পিঙ্কি ফোন করল। ফোনটা বেজে গেল। কেউ ধরল না। পিঙ্কি আবার ফোন করল। এবার কেউ রিসিভার তুলে নিল মনে হচ্ছে।
ওপার থেকে এক মহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো?
- হ্যালো, কে বলছেন? কা’কে চান?
- বাদলবাবু আছেন?
- না, ও তো বাড়ি নেই।
- ওহ্, আচ্ছা?
- কি নাম তোমার? তুমি বলছি, কিছু মনে কোরো না। আমি বাদলের মা হই। ওকে কিছু বলার থাকলে, আমায় বলতে পার। ও বাড়ি ফিরলে, আমি বলে দেব।
- আমার নাম পিঙ্কি। না, তেমন কিছু বলার নেই।
- এমনি তার খোঁজ করছিলে?
- হুম্, অনেকদিন কোন খবর পাইনি তাই।
- ওহ্ আচ্ছা।
- আমি তবে রাখছি।
- আচ্ছা।
পিঙ্কি ফোন রিসিভারটা ক্রেডেলে রেখে দিল। ভাবল, বাদল পিঙ্কি নামটা শুনে নিশ্চয়ই, তার সেই প্রেমিকার কথা ভাববে। তার কথা হয়তো তার মনে পড়বে না। মনে পড়ার কোন কারণও নেই। সে বাদলকে তার নাম জানায়নি।
ফোন নাম্বারটা ল্যান্ড লাইনের। নিশ্চয়ই বাদলদের বাড়ির ফোন। বাদলের কি কোনও মোবাইল নাম্বার নেই? থাকলে, সেটা কত নাম্বার পিঙ্কি ভাবল।
কলকাতা কর্পোরেশন ফুটপাথ সাফাই অভিযানে নেমে গড়িয়াহাটা ফুটপাথের সব দোকান কর্পোরেশন তুলে দিয়েছে। দীপকের কসমেটিক্সের দোকানও তার মধ্যে পড়েছে। দীপক আর আসছে না গড়িয়াহাটে। শিপ্রা তাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে, সে মনে মনে অস্থির হয়ে পড়েছে।
শিপ্রা একদিন পিঙ্কিকে কলেজে দেখতে পেয়ে বলল, জানিস দীপক আমাকে ভুলে গেছে। আর আসছে না গড়য়াহাটে।
- কেন?
- জানিস না দোকানটা কর্পোরেশন তুলে দিয়েছে।
- কেন?
- ফুটপাথের সব দোকান ওরা তুলে দিয়েছ।
- ওহ্, আচ্ছা।
- আমি এখন কি করি বলতো?
- কি করবি?
- দীপকের সাথে অনেকদিন দেখা হচ্ছে না।
- ওর বাড়ি চলে যা।
- বাড়ি কোথায় জানি না।
- যার সাথে প্রেম করিস, তার বাড়িটাও চিনিস না? ছেড়ে গেলে আর কি করবি তখন?
- চুপ করে বসে থাকব নাকি?
- তা ছাড়া আর উপায় কি তের?
পিঙ্কির সাথে কথা বলে, শিপ্রার অস্থিরভাবটা আরও বেড়ে গেল।
এপ্রিল মাস। গুমোট গরম। গরমে রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে। ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নামলে, গলা পীচে চটি আটকে যায়। মাথায় ছাতা নিয়ে গরমে ঘেমে চিন্ময়ী রাস্তা পেরিয়ে এপাড়ে আসছে খুব সাবধানে যাতে গলা পীচে পড়ে, চটি আটকে না যায়। চিন্ময়ীকে দেখে পিঙ্কি ডেকে বলে কী রে কি খবর তোর?
চিন্ময়ী কাছে এসে পিঙ্কিকে বলে,
- কীসের খবর?
- কেমন হচ্ছে পরীক্ষার প্রস্তুতি?
- ভাল না।
- কেন?
- মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। হয় তো বেশি দিন আর বাঁচবেন না। আমার পরীক্ষা দেওয়া হবে না রে।
- সে কী কথা?
- হ্যাঁ, সত্যি তাই।
শুনে পিঙ্কির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে চিন্ময়ীকে আর কিছু বলতে পারল না।
তারপর খুব মৃদু কন্ঠে বলে, তোর সমীরের খবর কি? কেমন আছে সে? - জানি না। অনেকদিন তার সাথেও দেখা হয় না আমার।
- সে কি রে?
- হুম্।
পিঙ্কি বলে, চল। ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাই।
- না রে। আমার এখন ব্যাঙ্কে যেতে হবে, মায়ের জন্য টাকা তুলতে।
- আচ্ছা, তবে যা, আর দেরী করিস না।
চিন্ময়ী চলে যেতে থাকে। কী বিষণ্ণ দেখায় তাকে, সেদিকে তাকিয়ে পিঙ্কির চোখ দু’টো ভিজে ওঠে।
পিঙ্কি ভাবে, কোন এক অদৃশ্য স্টাইকারের আঙুলের আঘাতে যেন সাজনো ক্যারম-বোর্ডের গুটির ছক কেমন বিচ্ছন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। স্টাইকারের সন্ধান কারও জানা নেই।
কয়েকদিন প্রাণ-কাড়া গুমোট গরম পড়ার পর, আচমকাই মাঝরাতে প্রচন্ড বৃষ্টি নামল। থামার কোন লক্ষণ নেই। বোধহয় শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পঞ্চনন তলার বড় রাস্তার মোড়ে এক কোমড় জল। গাড়িগুলি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছে। হৈ-হুল্লোর করে পাড়ার ছেলে-ছোকড়া, যোয়ান-মদ্দ সকলেই গাড়ি ঠেলে কিছু টাকা আয় করে ফেলছে, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। শুধু মেয়েরাই এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেখে, পিঙ্কির মনটা ভেঙে গেল। মন ভাঙাল, নারী জাতির প্রতি সমাজের অসম বঞ্চনা কারণ।
লিলির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেই রাজপুর পুরসভায় লোকটির সাথেই। নাম তার মাধব পাল। সোনারপুরে ভাড়া থাকে তারা। লোকটির বয়স নাকি একটু বেশি। বাতে পঙ্গু বাবা ছাড়া তার আর কেউ নেই। লোকটি মাধ্যমিক পাশ করে কয়েকবছর বেকার থাকার পর, কা’কে ধরে করে রাজপুর পুরসভায় একটা কেরানীর কাজ পেয়েছে।
লিলি বাদলের সঙ্গে দেখা করতে এসে সব জানালো তাকে। তার হাতটা ধরে খুব কাঁদল। বাদল তাকে কাঁদতে দিল। কেঁদে একটু হাল্কা হোক তার মনটা। লিলি চলে যাওয়ার সময় বাদল তার মাথায় হাত রেখে কপালে শেষ চুমু দিয়ে বলল, তুমি সুখি হবে, আমি আশীর্বাদ করছি। এবার লিলি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তাকে জড়িয়ে ধরল।
বাদল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। লিলিকে একবারও জড়িয়ে ধরল না। তাকে ছাড়িয়েও দিল না। যেন তার শরীরে প্রাণ নেই। প্রাণহীন একটা পাথর সে। পাথরের মূর্তি।
হঠাৎ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে যেন দেশে বিপর্যয় নেমে এল। দেশের ৭৫টি জেলায় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সন্ধান পাওয়া গেল। ফলে ২০২০ সালের ২২শে মার্চ থেকে কলকাতা শহর সহ অনেকগুলি শহরে ও জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। লকডাউনের সময়ে কোনও বাস-ট্রাম-রিকশা চলবে না। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরনো যাবে না। বের হলেও মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে চলতে হবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হাসপাতাল, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন বা বাস টার্মিনাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহনকারী গাড়ি চলাচলেও ছাড় থাকছে। সবজি, মাছ, মাংস, পাউরুটি, দুধ আর চাল-ডালের আর ওষুধের দোকানগুলি খোলা থাকবে। এই নির্দেশ অমান্য করলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে। নির্দেশ অমান্য না করেও মানুষগুলি ছটফট করে মরে যেতে লাগল। শহরে জেলায় মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। যেমন আগে কলেরা বা প্লেগ হলে দলে দলে লোক মারা যেত।
পিঙ্কির কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল মার স্কুল। পাড়ায় পাড়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মরতে লাগল অনেকে। পঞ্চানন তলার বস্তিও তার থেকে বাদ পড়ল না। সর্দি-জ্বর নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে পরীক্ষায় ধরা পড়ল, পিঙ্কির করোনা হয়েছে। তাকে একটা আলাদা ঘরে থাকতে হল। খাওয়ার থালা বাসন তার জন্য আলাদা করা হল। তার পোষাক প্রতিদিন আলাদা করে কাচতে দেওয়া হতো। মাসখানেক পর পিঙ্কি সুস্থ হয়ে উঠলে পরে, তার মা আক্রান্ত হল করোনায়। দু’তিন দিনের মধ্যেই মায়ের শরীরে শ্বাসকষ্টের বাড়াবাড়ি দেখা দিল। মা শ্বাস নিয়ে পারছেন না। তার দম আটকে আসছে তার। তাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হল। দু’দিন সেখানে থেকে, তিনি মারা গেলেন নিঃশব্দে। মায়ের এই অকম্মাৎ মৃত্যুতে পিঙ্কি ভীষণ ভেঙে পড়ল। কী করবে সে বুঝতে পারল না। করোনার থাবা একটু গুটিয়ে এলে পরে, পাড়ার এক কাকুর সহায়তায় সে ‘ডাই ইন হারনেশ’ গ্রাউন্ডে অনেক তদবির তদারকি করে, মায়ের চাকরিটা পেল। তার পড়া সেখানেই ইতি হল। সে বস্তির ভাড়া ঘর ছেড়ে দিয়ে পঞ্চানন তলা মোড়ের লেডিস হোস্টেলটায় এসে উঠল।
তার কলেজের বন্ধুদেের সঙ্গে এখন আর তার দেখা হয় না। কেমন আছে তারা, তার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু জানা হয় না। কারও সঙ্গেই পিঙ্কির যোগাযোগ নেই এখন আর।
হঠাৎ একদিন তার শিপ্রার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল গোলপার্কে। কী বিশ্রী কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে শিপ্রার। দেখে চেনা যায় না। শিপ্রা তাকে দেখে চিনতে পেরে বলেছে, পিঙ্কি না?
পিঙ্কি ঘুরে তাকিয়ে তাকে দেখে বলল, হ্যাঁ। তারপর চিনতে পেরে বলল, আরে শিপ্রা না?
কী চেহারা করেছিস? আমি তো দেখে প্রথমটায় চিনতে পারিনি।
- হ্যাঁ করোনায় অনেকদিন ভুগে যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি।
- দীপকের কি খবর?
- ওহ্, তুই জানিস না? দীপক তো আগেই করোনায় মারা গেছে। তারপর ওকে ছেড়ে আমায় ধরেছিল করোনা। আমিও প্রায় সহমরণে যচ্ছিলাম। কোন পুণ্যবলে যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তারপর তুই কেমন আসিস?
- আমার মা করোনায় মারা গেছে। আমারও করোনা হয়েছিল। সামলে উঠেছি।
- এখন কি করছিস?
- মায়ের স্কুলে মাষ্টারী করছি। তুই কি করিস?
- কিছু না।
- কেন?
- কিছু করতে আর ভাল লাগে না। মনেহয় কনোনায় মরে গেলেই ভাল হত।
- এসব কী বলছিস তুই? এসব ভাবনা মন থেকে তাড়া তোর। কিছু একটা কর।
- আচ্ছা দেখি। বলে শিপ্রা তার বিষণ্ণ চোখ দু’টি তুলে পিঙ্কির দিকে তাকাল।
- চিন্ময়ীর কোন খবর জানিশ?
- হ্যাঁ। চিন্ময়ীর সমীরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে।
- সমীর কি করে?
- সুইগি কোম্পানী থেকে হোম ফুড ডেলিভারি করে।
- ওহ্, আচ্ছা। ওর মা বেঁচে আছেন?
- না, ক্যানসারে মারা গেছেন।
- ওরা এখন কোথায় থাকে?
- শুনেছি, কসবা রথতলায়।
- আচ্ছা। তুই সাবধানে থাকিস।
শিপ্রা তার কোন উত্তর না দিয়ে, তার ক্লান্ত পা দু’টি সামনের দিকে ফেলে ধীর ধীরে এগিয়ে গেল। পিঙ্কি পিছন থেকে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়, তাকিয়ে রইল। শিপ্রা মিলিয়ে যেতেই পিঙ্কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, শিপ্রা কলেজে চমৎকার উজ্জ্বল প্রাণ খোলা প্রকৃতির একটা মেয়ে ছিল। এই মেয়ে যেন সে মেয়ে নয়, তার প্রাণহীন কঙ্কাল। পিঙ্কির বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল একটা দুর্বোধ্য ব্যথায়
আজকাল স্কুল থেকে হোস্টেলে ফিরে পিঙ্কির ভীষণ একা একা লাগে। একান্ত বিষণ্ণ মনেহয় নিজেকে। সন্ধ্যাটা যেন তার আর কাটতে চায় না। সেদিন সন্ধ্যায় মন আর ঘরে টিকল না। সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। একা একা আনমনাভাবে হাঁটতে লাগল গোলপার্কের ফুটপাথ ধরে। হঠাৎ তার বাদলের কথা মনে পড়ল। কেন মনে পড়ল? যাকে কোনদিন সে দেখনি। নামটাই শুধু শুনেছে। সে জানে না, কেন মনে পড়ল। গোলপার্ক থেকে ডানদিকে একটু মোড় নিতেই, তার চোখ পড়ল একটা এস টি ডি বুথ। সে অন্যমনস্কভাবে সেদিকে এগিয়ে গেল। বুথটার কাছে এসে তার মনেহল, একবার বাদলকে ফোন করলে কেমন হয়? অনেকদিন তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। সে বেঁচে আছে তো? করোনায় মরে যায়নি তো আবার?
পিঙ্কির বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। দুরুদুরু বুকে এস টি ডি বুথে ঢুকে বাদলের নাম্বারে ডায়েল করল।
ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল।
- কে?
- আপনি কেমন আছেন?
- কে বলছেন?
- আপনি আমায় চিনবেন না।
- তবে ফোন করেছেন কেন?
- আপনি কেমন আছেন জানবার জন্য।
- চেনেন না, তবে কেমন আছি জানতে চান কেন?
- আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমাাকে চেনেন না। আপনার মা কেমন আছেন?
- মাকে চেনেন?
- হ্যাঁ দু’এক দিন তার সাথে কথা হয়েছে।
- কি নাম আপনার?
- পিঙ্কি।
পিঙ্কি ভেবেছিল নামটা শুনে বাদল একটু চমকাবে। বাদল চমকাল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, মা অনেকদিন আগেই করোনায় মারা গেছেন। - আপনার করোনা হয়নি?
- হয়েছিল। তবে সেরে উঠেছি।
- আপনার প্রেমিকার খবর কি?
- কে, লিলি? তার তো বিয়ে হয়ে গেছে।
- তার নাম পিঙ্কি ছিল না?
- না তো।
- আপনি বলেছিলেন, পিঙ্কি।
- মিথ্যে বলেছিলাম।
- কেন?
- তা জানি না।
- সেকি কথা! আপনি মিথ্যে কথা বলেন?
- মিথ্যে কথা বলে না, এমন মানুষ আপনি কোথায় খুঁজে পাবেন?
- আমি মিথ্যে কথা বলি না।
- সত্যি?
- হুম।
পিঙ্কি আর কিছু না বলে রিসিভারটা ক্রেডেলে রেখে দিয়ে ফোনের চার্জ মিটিয়ে দিয়ে বুথের বাইরে বেরিয়ে এল। মনে মনে বলল, মিথ্যুক একটা।
বাদল তাকে চিনতে পেরেছে। এই মেয়েটাই এস টি ডি বুথ থেকে অনেকদিন আগে তাকে ফোন করেছিল? সে ভাবল, কেন মেয়েটি তাকে বারবার ফোন করেছে? কি বলতে চায় সে? আজও কিছু না বলে ফোন কেটে দিল কেন?। এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করছে বলে, বাদলের তাকে ফিরে ফোন করার কোনও সুযোগ নেই। যোগাযোগ এক তরফা। ওয়ান ওয়ে কম্যুনিকেশন।
এরপর পিঙ্কি ফোন করলে, তার ফোন নাম্বারটা জেনে নিতে হবে। বাদল ভাবল।
বাদল খবরের কাগজের ফ্রি-ল্যান্সিং করত। লকডাউনের সময় বাড়ি থেকে বের হতে না পারায়, সময় কাটাবার জন্য সে শখ করে গল্প লেখা শুরু করে। গল্পগুলি সবই তার অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। এইভাবে কয়েকটি গল্প লিখে ফেলে। দু’একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সেই গল্পগুলি ডাক-মারফৎ পাঠিয়ে দেয়। সেগুলির দু’একটি ছাপাও হয়ে যায় নামী সাপ্তাহিক পত্রিকায়। তার জন্য টাকা পাওয়া যায়। গল্পগুলি পাঠক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সেই কারণেই বোধহয় তার কাছে পুজো সংখ্যায় জন্য কয়েকটি পত্রিকা খেকে এবার গল্প চাওয়া হয়েছে। আজকাল গল্প লিখে কিছু টাকা পাওয়া যাচ্ছে দেখে, গল্প লেখার জন্য তার মনে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ঘুম থেকে ছটায় উঠে, বাথরুমের প্রাত্যহিক কাজ সেরে, সকাল সাতটার মধ্যে সে লিখতে বসে যায়। টানা দু’ঘন্টা নিরিবিলিতে বসে লেখে। তারপর ন’টার সময় কাজের মেয়েটা এসে দু’কাপ চা করে, এক কাপ চা বাদলকে ঘরে দিয়ে যায়। লেখার সময় কোনও কথা বলা বারণ দেখে সে কিছু না বলে, চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে চলে যায়। নিজে রান্না ঘরে বসে, চা শেষ করে ঘরের কাজে হাত দেয়। ঘর ঝাড় দেয়, বাসন মাজে, তারপর ভাত বসিয়ে দিয়ে, জামা-কাপড় কাচাকাচির কিছু থাকলে কাচাকাচি করে। এর মধ্যে ভাত হয়ে গেলে, ডাল বসিয়ে, তরকারি কাটতে বসে। ডাল সিদ্ধ হয়ে গেলে পরে, ডাল পাশে নামিয়ে রেখে,
উনোনে একটা কড়াই বসিয়ে দেয়। তারপর কড়াই গরম হয়ে উঠলে, তাতে তেল ঢেলে দেয়। তেল গরম হলে, তাতে ফোড়ন দিয়ে, পরে তাতে কাটা তরকারি ঢেলে দেয়। তাতে একটা ঢাকানা চাপা দিয়ে রেখে,উনোনের আঁচ একটু কমিয়ে দিয়ে, কাচা জামা-কাপড় বাইরের দড়িতে মেলে দিতে যায়। এর মধ্যে বাদল চা শেষ করে, বাথরুমে স্নানের জন্য ঢুকে পড়ে।
সে স্নান সেরে বেরিয়ে এলেই কাজের মেয়ে পূর্ণিমা বলে, দাদাবাবু ভাত বাড়ব?
- হ্যাঁ, বাড়ো।
বাদলের চুল আচড়াবার মধ্যেই পূর্ণিমা তার জন্য টেবিলে ভাত বেড়ে দেয়। সঙ্গে ডাল তরকারি। পূর্ণিমার রান্নার হাত ভাল। যা রাধে তাই সুস্বাদু হয়ে ওঠে। বাদল ডাল দিয়ে ভাত মেখে, তরকারি মুখে দিয়ে তৃপ্তি করে খেতে থাকে। দেখে পূর্ণিমার ভাল লাগে।
পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল করোনার কিছুদিন আগে। বিয়ের কয়েকদিন পর, করোনার আক্রমণের আগেই তার বর অমর দে কাজের জন্য বেঙ্গালুরু চলে যায়। সেখানে কাজে লাগার পরই করোনার জন্য সেখানকার কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি ফেরারও তখন কোনও উপায় থাকে না। ট্রেন বাস সব বন্ধ। তারপর তারা কয়েকজন ঠিক করে তারা রেল লাইন ধরে হেঁটে ফিরবে। তারপর হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে, আর ফিরতে পারেনি। রাস্তায়ই করোনা হয়ে মারা গেছে অমর, তার সঙ্গীরা তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। শুধুমাত্র একজন তার সঙ্গে ছিল। সে ফেরার সময় খবর দিয়ে গেছে।
তার পরদিনই বড় ভাসুর, পূর্ণিমাকে রাক্ষসী, অপয়া মেয়েছেলে বলে গালি দিতে শুরু করে। তাছাড়া আরও বলে, আমার ভাইটাকে খেয়েছিস তুই। এবার কি আমায় খাবি? তা হবে না। এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। না হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবো। শুনে পূর্ণিমার বুকের ভিতরটা মুচগে ওঠে, মনটা কুঁকড়ে যায়। বলে কী লোকটা !
আমি আমার স্বামীকে খেয়ছি? অপয়া আমি?
আমার কি দোষ? তার বুক ফেটে কান্না আসে। চোখের পাতা ভিজে ওঠে। সে না কেঁদে থাকতে পারে না।
- আর মায়া কান্না কাঁদতে হবে না। ওতে আমি ভুলি না। এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। তোর মুখ আমি দেখতে চাই না।
পূর্ণিমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলে, আমি যাব কোথায়? - যাহান্নামে যা। এ বাড়িতে আর তোর জায়গা নেই।
পূর্ণিমা আর কিছু বলতে পারে না, চাঁপা কষ্ট মনে নিয়ে, সেই অবস্থায় এক-কাপড়ে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। রাজপুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সন্তোষপুরে বাপের বাড়িতে চলে আসে। পূর্ণিমার বাবা নেই, কনোনায় মারা গেছে। মারও করোনা হয়েছিল, করোনার ইনজেকশন নিয়ে বেঁচে গেছে। মা পূর্ণিমার কাছে সব কথা শুনে, তাকে বুকে টেনে নেয়। দাদা বৌদি অবশ্য তাকে দেখে মোটেও খুশি হয় না। পূর্ণিমা ভাবল, তা’তে কি আসে যায়? সে তো আর দাদার আয়ে ভাগ বসাতে যাচ্ছে না।
কিছুদিনের মধ্যেই এক প্রতিবেশির কাছে জানতে পারল, ঢাকুরিয়ার একজন তার বাড়ির সব কাজ কর্মের জন্য লোক খুঁজছেন। সেই ঠিকানা নিয়ে পূর্ণিমা তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করল। পূর্ণিমাকে দেখে বাদলের পছন্দ হল। বাদলের বাড়িতে সে কাজে বহাল হল। এখানে আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত কাজ থাকে, তারপর এখান থেকে একটা প্রাইমারী স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের জন্য মিড-ডে মিলের খাবার রান্না করে। টিফিনের পর ছাত্রদের খাওয়া শেষ হতে দু’টো বেজে যায়, আর তার বাড়ি ফিরতে আড়াইটা বেজে যায়। তারপর সে বাড়িতে গিয়ে স্নান খাওয়া করে ঘুমায়।
বাদল সোমের বাড়িতে চার হাজার টাকা পায় আর বাচ্চাদের স্কুলে স্কুলে রান্না করার জন্য বারো শ’ টাকা পায় সে। মার হাতে সে চার হাজার টাকা তুলে দেয়। নিজের জন্য রাখে বারো শ’ টাকা। এই টাকা দিয়েই তার ভাল ভাবে মাস চলে যায়। মাও টাকা পেয়ে খুব খুশি। দাদা বৌদির কাছে তার আর কিছুর জন্য হাত পাততে হয় না। এইভাবে দিনগুলি ভালই কাটছিল তার।
লিলির বিয়ে হয়ে গেছে তিন বছরের বেশি। বিয়ের পর বাদলের সাথে আর লিলির দেখা হয়নি। লিলি কেমন আছে একবার সোনারপুরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যেতে পারে। তার কি কোন সন্তান হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?
কিন্তু বাদল সেই বাড়ির ঠিকানা জানে না। সোনারপুর তো খুব ছোট অঞ্চল না। ঠিকানা না জানা থাকলে সে কি করে সে লিলির খোঁজ করবে?
তারপর হঠাৎ তার মনে পড়ল, লিলির বরের নাম মাধব পাল। রাজপুর পুরসভায় কাজ করে। তার খোঁজ করে তাকে পেলেই, সব খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
কিন্ত মাধব পাল যদি তার কাছে জানতে চায়, আপনি কে হন লিলির? তখন সে যদি উত্তর দেয়, লিলি পুরনো প্রেমিকা আমার। শুনে মাধব পালের মুখের অবস্থা কেমন হবে ভেবে বাদলের খুব হাসি খুব পেল।
পূর্ণিমা মিড-ডে মিলের রান্না শেষ করে দেখল, স্কুলের অন্য ম্যাডামরা স্টাফ রুমে বসে থাকলেও, পিঙ্কি ম্যাডম একটা চেয়ার পেতে একা বসে আছেন বকুল তলায়। স্কুলে ঢুকতেই গেটের কাছে একটা বকুল গাছ আছে। ফুল ফোটার সময় সারা স্কুলটা বকুল গন্ধে মেতে থাকে। গাছের নীচটা তখন খুব শীতল মনেহয়।
পূর্ণিমা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে পিঙ্কি ম্যাডাম বললেন, কিছু বলবে পূর্ণিমা?
- না দিদি
- তবে?
- একটা কথা।
- বল।
- ম্যাডাম কিছু অপরাধ নেবেন না।
- আরে ভূমিকা ছেড়ে আসল কথাটা বল।
- ম্যাডাম আপনি যদি বিয়ে করতে রাজি থাকেন তো একজনের কথা আপনাকে বলতে পারি, খুবই ভাল মানুষ তিনি?
- আচ্ছা পূর্ণিমা তুমি আজকাল বিয়ের ঘটকালি করছো নাকি?
- না ম্যাডাম। লোকটার মা বাবা কেউ নেই। একদম একা। আপনার সাথে তার খুব মানাবে।
- কি করে বুঝলে?
- আপনারও বাবা মা কেউ নেই। দু’জনেরই সঙ্গী জুটবে। তাছাড়া, ওনাকে জানি বলেই একথা আপনাকে বলছি।
- ওনাকে কি করে জানো তুমি?
- উনি আমার দাদাবাবু হন। ওনার বাড়িতে আমি কাজ করি।
- তাই নাকি?
- হুম। ওনার বাড়ির কাজ শেষ করে, স্কুলে আসি আমি।
- আচ্ছা।
- আপনি ম্যাডাম রাজি থাকেন তো বলেন, আমি তাহলে ওনার সাথে কথা বলে দেখব।
- আচ্ছা ভেবে দেখি, পরে তোমাকে জানব।
- আচ্ছা ম্যাডাম।
বলে পূর্ণিমা স্টাফ-রুমের দিকে এগোয়।
দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাদল কাগজের অফিসে যায়। অফিসে তার পদোন্নতি হয়েছে। সাব এডিটরের পদ। তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে গাড়ি যায়। অফিসের কাজ সেরে বেরোতে পাঁচটা বেজে যায়। সঙ্গী কাউকে পেলে কোনদিন বারে যায়। বেশি নয়, মাত্র দু’তিন পেগ খায়। তারপর মনে রঙিন আবেশ সৃষ্টি হলে, সেই আবেশ নিয়েই বাড়ি ফিরে আসে। সেই রাতে ভাল ঘুম হয় তার। কোন দিন অফিসের পর গড়ের মাঠে কিংবা আউটট্রাম ঘাটে গিয়ে বসে থাকে। প্রেমিক-জুটি দেখলে, মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সাদৃশ্য খোঁজে লিলির মুখের সাথে। এই নিঃসঙ্গ জীবন বাদলের মন্দ লাগে না। তবে মাঝে মাঝে সঙ্গী খুঁজে নিয়ে সংসার পাতার সাধও জাগে মনে। তা কাউকে বলতে পারে না, মুখ ফুটে। অথচ কী করে যেন পূর্ণিমা তা টের পেয়ে যায়।
আজকাল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে, সন্ধ্যা বেলাটা পিঙ্কির একা একা হোষ্টেলে থাকতে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। মনেহয় এইভাবে আর কতদিন নিঃসঙ্গ জীবন কাটবে তার? পূর্ণিমার প্রস্তাবটা কিন্তু খারাপ না। মেয়েটি ভাল। খুব অল্প বয়সে তার স্বামী অকালে করোনায় মারা যাবার ফলে, নিঃসঙ্গ জীবনের কষ্ট সে বোঝে। সেই বেদনা বোধ থেকেই পূর্ণিমা হয়তো সেই প্রস্তাবটা, মনে মনে খুব সংকোচ নিয়ে, পিঙ্কির কাছে রেখে ছিল।
এইসব ভাবতে ভাবতে কাব্যিক আবেগ কয়েকটা লাইন চলে এল পিঙ্কির মাথার ভিতরে।
সে তার তার ডাইরীটা খুলে তার সাদা পাতায় লিখে ফেলল –
“কেমন একলা হয়ে যাচ্ছি দিন দুপুরে
যে রকম একা হয়ে গেলে,
নিজেকে ছাড়া আর সব কিছুকেই
মনে হয় একান্ত আপন,
চারপাশে মেঘলা দুপুর,
যতদূর চোখ যায়, সবখানে বন্ধু হাওয়া ঘোরে
তবুও কোথায়ও যাওয়ার
কোন তাড়া নেই আমার,
যেন সব কাজ সাঙ্গ করে আছি বারান্দায়
একটু পা ছড়িয়ে বসে প্রিয় সঙ্গীর আশায়। “
লেখার পর কবিতাটার ‘একাকীত্ব’ নাম দিয়ে, একটা কাগজে কপি করে পোষ্টাল খামে ভরে, দৈনিক বার্তার ঠিকানা লিখে রবিবাসরীয়তে পাঠাবার জন্য ডাকটিকিট লাগিয়ে তৈরি করে রাখল। পরদিন স্কুলে যাবার সময় পোষ্ট বক্সে ফেলে দিলেই হবে।
সারাদিন খাটা-খাটনির পর পূর্ণিমার আজকাল রাতে ভাল ঘুম হয়। অমর দে মারা গেছে খবর পাওযার পর থেকে বহুদিন তার বিনিদ্র কেটেছে। চোখে ঘুম আসত না। অমরের কথাই বারবার মনে পড়ত। বিয়ের পর, খুব বেশিদিন কাছে পায়নি পূর্ণিমা তাকে। কয়েকটা দিন কাছে মাত্র কাছে পেয়েছিল। তার আদরে সোহাগে কিভাবে দিনগুলি কেটে গেছে বুঝতে পারেনি। যখন পূর্ণিমা শুনল অমর কাজের জন্য বেঙ্গালুরু যাবে, তার মনটা খুব খারাপ হয়েগেছিল। অমরকে সে তাকে নিয়ে যেতে বলেছিল সেখানে। অমর বলেছিল, ওখানে গিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর তাকে নিয়ে যাবে। অমরের যাবার সময় মন খারাপ নিয়েও তাতে রাজি হয়েছিল সে। হাসি মুখেই তাকে বিদায় জানিয়েছিল। তখন কি আর ক্ষুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল পূর্ণিমা এটা তার শেষ বিদায় !
আজ হঠাৎ এইসব ভাবতে ভাবতে পূর্ণিমার চোখে আর ঘুম এল না। অনেকদিন পর সারারাত জেগে কাটল তার। ভোর বেলার দিকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল তার।
- ও পুণি, সাতটা বাজে যে, ঘুম থেকে উঠবি কখন?
সাতটা বাজে শুনে পূর্ণিমা চট করে বিছানায় উঠে বসল। তারপর বাথরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে বাদল সোমের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
বাদল সকাল সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত টানা দু’ঘন্টা করে লিখে দু’সপ্তাহের মধ্যে দু’টি গল্প শেষ করে ফেলল পুজো সংখ্যার জন্য। একটি প্রেমের বিরহের কাহিনি। লিলিকে নিয়ে তার প্রেমের ব্যর্থতার গল্প। অন্যটি এস টি ডি বুধ থেকে আসা এক রহস্যময়ী নারীর গল্প। এই লেখাটার ভিত্তি বাস্তবতা হলেও, বাস্তবতার সঙ্গে মিশেছে বাদলের অপার কল্পনা-বিলাস। নারী চরিত্রটিকে অলৌকিক এক রহস্যময় চরিত্র করে ফুটিয়ে তুলেছে সে, লেখার মধ্যে। পাঠকের আদি-ভৌতিক কোন চরিত্র বলেও মনে হতে পারে। লেখার মধ্যে সেই রহস্যটুকু বজায় রেখেছে বাদল। গল্প দু’টি লিখে সে নিজে খুব তৃপ্তি পেয়েছে। পাঠকরা কেমন ভাবে নেবে, তা সে জানে না। গল্পটি কাগজে বের হবার পরই তা বোঝা যাবে। আর একটি গল্প লিখতে হবে ‘নবপ্রভাত’ পত্রিকার পুজো সংখ্যার জন্য।
পূর্ণিমার আজ বাদলের বাড়িতে ঢুকতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। ভেবেছিল দেরি করার জন্য দাদাবাবু খুব রাগারাগি করবে। কিন্তু তিনি তা কিছুই করলেন না। তাকে দেখে কেমন উদাসীন মনেহল । অন্যদিন যখন পূর্ণিমা আসে দেখে দাদাবাবু লেখা নিয়ে ব্যস্ত। সে সময় তার সাথে কোনও কথা বলা বারণ। পূর্ণিমা বলেও না। সে এসে চা করে নিয়ে গিয়ে তার ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর রেখে চলে আসে। সে চলে গেলে বাদল তখন লেখা বন্ধ করে, চায়ের কাপ টেবিল থেকে তুলে নেয়।
দুটি গল্প লিখে শেষ করার পর বাদলের মনেহয় ‘নবপ্রভাত’-য়ে লেখার জন্য কোনও গল্প তার মাথায় আসছে না। আজ সকালে উঠে লিখতে বসে তার মনে হয়। তার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। লেখার মতো কোনও গল্প তার মাথায় আসছে না। এটাকে বলে রাইটার্স ব্লক। অনেক লেখকেরই নাকি এরকম হয় শুনেছে সে। তারা তখন নিজের লেখা বন্ধ রেখে, বিখ্যাত কোনও লেখকের লেখা অনুবাদে মন দেন। তাতে নাকি নতুন লেখার প্রেরণা আসে। কেউ কেউ আবার কোথাও ঘুরতে চলে যান কিছুদিনের জন্য। তারপর ফিরে এসে নতুন লেখায় আবার মন দেন। বাদলের এক বন্ধু আছে, বিপ্রদাস মজুমদার। নাটক করে বেড়ায়। নামী একটা গ্রুপে নিয়মিত নাটকের মহড়া দেয়। বাদল চা শেষ করে, বিপ্রদাসকে ফোন করল।
বিপ্রদাস ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে? - আমি বাদল।
- কোন বাদল?
- বাদল সোম।
- হ্যাঁ বল কি ব্যাপার?
- এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলি?
- হ্যাঁ, নাটক শেষ করে কাল রাত দু’টোর সময় বাড়ি ফিরেছি,খড়গপুর থেকে।
- ও, আচ্ছা তাহলে ঘুমা এখন।
- না, আর ঘুম হবে না। তুই বল কি জন্য ফোন করেছিস সকালে? কোথায়ও নাটক করতে হলে বলে দিলাম, করতে পারব না। সারা মাসের পরিকল্পনা আমাদের নির্ধারিত করা আছে। এছাড়া কিছু কথা থাকলে বল।
- না সেজন্য নয়।
- তবে বল।
- আজ সকাল উঠে দেখছি আমি আর কিছু লিখতে পারছি না। মাথাটার ভিতরটা একবারে ফাঁকা হয়ে আছে। কোন গল্প কাহিনি মাথায় আসছে না। এখন কি করি বলতো?
শুনে বিপ্রদাস বলল, ভীষণ সমস্যা একটা। দাঁড়া একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলছি। বিপ্রদাস ফস্ করে দিয়াশলাই জ্বালল, বাদল তা শুনতে পেল। তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল। তার আওয়াজও বাদল শুনতে পেল। তারপর ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে টেনে টেনে বিপ্রদাস বলতে লাগল, তু – – ই – – এ – – ক – – টা – – কা – – জ – – ক – – র , এ – – ক – – টা – – খু – ন – – ক – – রে – – ফে – – ল । - মানে?
- তুই আজ সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রীটের ট্রিংকাস বারে চলে আয়। তখন তোকে খুলে বলব সব ব্যাপারটা। বলেই বিপ্রদাস ফোন কেটে দিল।
পরদিন স্কুলে বের হবার সময় পিঙ্কি খামটা সঙ্গে নিয়ে নিল ব্যাগের ভিতর ভরে। স্কুলে যাবার পথে গোলপার্ক পোষ্ট অফিসের পোষ্ট বক্সে খামটা ফেলে দিল। তারপর ভিতরের রাস্তা দিয়ে সে কাঁকুলিয়া রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার স্কুলে চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, আজ পূর্ণিমার কাছে লোকটার খবর নেবে। কোথায় থাকে? কি করে? বাড়িতে কে কে আছে তার? এইসব আরকি।
পিঙ্কি স্কুলে ঢুকে দেখল বড়দি পূর্ণিমাকে বলছে, আজ বাচ্চাদের জন্য ডিমের ঝোল আর ভাত হবে। তুমি গিয়ে দেখ কতজন ছাত্র -ছাত্রী এসেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের পাঁচ জনের জন্যও ডিম নিয়ে আসবে। এই নাও টাকা, বলে বড়দি তার দিকে একটা পাঁচশ’ টাকার নোট এগিয়ে দিল। পূর্ণিমা টাকা নিয়ে দোকানে ডিম আর আলু কিনতে চলে গেল।
পিঙ্কি এটেনডেন্স রেজিস্টারে নিজের নাম সই করে টাইম বসিয়ে নিজের ক্লাসে চলে গেল। সে প্রথম পর্যায় চতুর্থ শ্রেণীতে বাংলা পড়ায়। চতুর্থ শ্রেণীতে ২৬ জন ছাত্র। আজ ক্লাসে ১৮ জন এসেছে। রোল কল শেষ করে সে তাদের বাংলা বই ‘পাতাবাহার’ খুলে ছন্দময়ভাবে পড়তে শুরু করল,
“আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে;
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন-মহান্,
খোলা মাঠের উপদেশে—
দিল্-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখালো হাসতে মেদুর,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর,—
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষাণ দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে
গান জাগালো আমার প্রাণে,
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্ব-জোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবের নতুন জিনিস,
শিখছি দিবারাত্র;
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
পাঠ্য যে-সব পাতায় পাতায়,
শিখছি সে-সব কৌতূহলে
সন্দেহ নাই মাত্র॥ “
কবিতাটা পড়া শেষ করে বলল, কবিতাটির নাম কি? কেউ বলতে পারবে? যারা পারবে হাত তোল।
১০ জন হাত তুলল। ৭ জন ঠিক বলতে পারল।
লেখকের নাম , কেউ জানো?
৭ জন হাত তুলল। ৪ জন ঠিক বলল।
পিঙ্কি তাদের বলল, কাল সকলে কবিতাটা মুখস্ত করে আসবে। আমি কাল তোমাদের কবিতাটার মানে বুঝিয়ে দেব।
সকলে সমস্বরে বলে উঠল, আচ্ছা ম্যাডাম।
প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ল। পরের পিরিয়ড়ে তৃতীয় শ্রেণির অঙ্কের ক্লাস।
চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস থেকে বেরিয়ে পিঙ্কি দেখল, পূর্ণিমা ডিমগুলি এনে একটা বড় সসপ্যানে সিদ্ধ বসিয়ে দিয়েছে।
পিঙ্কি তাকে ডেকে বলল, পূর্ণিমা কেমন আছো?
- ভালো আছি দিদি।
- তোমার মা কেমন আছেন?
- ভালোই আছে তবে বাতের ব্যথটায় রাতে খুব কষ্ট পায়।
- ডাক্তার দেখাওনি?
- না, মা ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। কার কাছে শুনেছে, তারপিন তেল গরম করে মালিশ করলে সেরে যাবে। তাই করে।
- ও আচ্ছা, আসি। বলে পিঙ্কি তৃতীয় শ্রেণীতে গিয়ে ঢুকল। ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে দেখে কলকল করে সমস্বরে চেচিয়ে উঠল। আজ আমরা নামতা শিখব ম্যাডাম।
- হ্যাঁ শিখবে। বসো সবাই। এই ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী বেশ। এই ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্য্ মোট ৩২ জন। আজ এসেছে ২৬ জন।
পিঙ্কি সুর করে তাদের দুই থেকে পাঁচ ঘর পর্যন্ত নামতা পড়ে শোনালো। তারপর তাদের সকলকে তার সঙ্গে বলতে বলল,
দুই দু’গুণে চার
তিন দু’গুণে ছয়
চার দু’গুণে আট
পাঁচ দু’গুণে দশ
ছয় দু’গুণে বারো
সাত দু’গুণে চোদ্দ
আট দু’গুণে ষোল
নয় দু’গুণে আঠারো
দশ দু’গুণে কুড়ি।
এই ভাবে সে সুর করে পাঁচ ঘর পর্যন্ত নামতা পড়ল। ছাত্র ছাত্রীরাও তার সঙ্গে সুর করে নামতা পড়তে লাগল। পিঙ্কি তাদের বলল, এই ভাবে সুর করে বাড়িতে পড়বে। দেখবে নামতা তোমাদের মুখস্ত হয়ে যাবে। কাল তোমাদের নামতা মুখস্ত ধরবো সকলকে।
- আচ্ছা ম্যাডাম। সমস্বরে চিৎকার করে উঠল।
ছাত্র-ছাত্রীদের মিড-ডে মিল খাওয়া শেষ হবার পর, রান্নাঘর গুছিয়ে রেখে পূর্ণিমা বাড়ি চলে যায়। আজও চলে যাবে বলে, সে রান্না ঘরে তালা লাগিয়ে, চাবিটা বড়দির কাছে দিয়ে চলে যাবে, এমন সময় পিঙ্কি এসে বলল, আচ্ছা পূর্ণিমা তুমি সেদিন তোমার দাদাবাবুর বিয়ের ব্যাপারে কি বলছিলে যেন?
পূর্ণিমা মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আপনি রাজি?
- কিসে?
- বিয়ের ব্যাপারে?
- না এখনও তেমনভাবে কিছু ভাবিনি। তবে তার সম্পর্কে সবকিছু জেনে শুনে, তারপর ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
- বলুন কি জানতে চান দাদাবাবুর সম্বন্ধে?
- কি নাম তোমার দাদাবাবুর?
- বাদল সোম।
নামটা শুনে পিঙ্কি চমকে ওঠল।
যেন কিছু শুনতে পায়নি সে, সেই ভাবে পিঙ্কি জানতে চাইল, কি নাম বললে? - বাদল সোম।
পিঙ্কি মনে মনে ভাবল, সেই মিথ্যুক লোকটা নাকি? পরক্ষণেই ভাবল একই নামের বহু মানুষ থাকতে পারে। থাকাটা বিচিত্র নয়। এই ভেবে পিঙ্কি আবার জানতে চাইল, কী করেন তিনি? - খবরের কাগজের অফিসে কাজ করেন।
- কোন কাগজের অফিস, নাম কি?
- জানি না।
- তিনি কি বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন?
- তার সাথে এ ব্যাপারে আমার কোন কথা হয়নি।
- তবে তার কথা ভেবে আমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে কেন, আমি বিয়ে করতে রাজি কিনা?
- আপনি রাজি থাকলে পরে, ভেবেছি বলে কয়ে দাদাবাবুকে রাজি করাব।
- বেশ আমি রাজি, এবার তোমার দাদবাবুকে রাজি করাও দেখি।
- আচ্ছা। বলে পূর্ণিমা সোদিন বাড়ি চলে গেল।
বাদল সন্ধ্যায় বিপ্রদাসের সঙ্গে দেখা করতে পার্কস্ট্রীটের ট্রিংকাস বারে গেল। সেখানে গিয়ে বিপ্রদাসের দেখা পেল না। নিজেের জন্য এক পেগ হুইস্কির অর্ডার দিল। সঙ্গে একপ্লেট ফ্রাই-প্রন দিতে বলল। পেগে একটা চুমুক দিয়েছে এমন সময় বিপ্রদাস এসে বারে ঢুকল। তাকে দেখে বাদল ডাকল। সে এসে বাদলের টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। বয়কে ডেকে তার জন্য বাদল একপেগ হুইস্কি দিয়ে যেতে বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আর এক পেগ হুইস্কির চলে এল তাদের টেবিলে। বাদল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরিয়ে বিপ্রদাসের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিল।
বিপ্রদাস হুইস্কিতে একটা চুমুক দিয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। বাদল সিগারেটের একমুখ ধোয়া ছেড়ে বিপ্রদাসকে বলল, বল সকালে ফোনে কি বলছিলি?
হ্যা, বলছি তোকে বুঝিয়ে বলে, বিপ্রদাস একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলতে শুরু করল।
- মনে কর তোর গল্পের নায়ক তুই নিজেই। তুই একটা খুন করবি, তারপর যে সব সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে ভেবে একটা গল্পের খসড়া পরিকল্পনা তোকে তৈরী করতে হবে। বুঝেছিস?
- আমি অযথা একটা খুন করতে যাব কেন?
- সে তোর ভাবনা। বলে বিপ্রদাস গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা ধর তোর নায়ক বিয়ের রাতেই, তার বউকে আদরের ছলে খুন করতে পারে। কি, পারে না?
- হ্যাঁ পারে। তবে তার জন্য তো একটা কারণ থাকা চাই।
- হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হবে। সেই কারণটা তুই খুঁজে বের করবি, লেখক হিসাবে সেটা তো তোর দায়িত্ব। দায়িত্ব কিনা বল?
- হ্যাঁ তা তো দায়িত্বই, অস্বীকার করি কি করে।
- তবে? এবার সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু কর। দেখবি ধীরে ধীরে গল্পটা তোর ভিতরে তৈরী হতে শুরু করছে।
বাদল গ্লাসটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
বিপ্রদাস বলল, এখনই উঠছিস কেন? আর এক পেগ খাবি না। - না। বলে বাদল আর কোন কথা না বলে কাউন্টারে হুইস্কির দাম মিটিয়ে দিয়ে, বার থেকে বেরিয়ে এল বাইরে।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল, আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে। হয়তো কোথায়ও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। না হলে ঠান্ডা হাওযা আসবে কোথা থেকে?
বাদল হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, এখনই বাড়ি ফিরে যাবে, নাকি কফিহাউজে গিয়ে একবার ঢুঁ মারবে। দেখবে,কে কে এসেছে। অনেকদিন তার কফিহাউজে যাওয়া হয় না।
কলেজস্ট্রীটে যাবে এমন একটা বাস দেখে সে উঠে পড়ল তাতে। বাস থেকে যখন সে কলেজস্ট্রীটে নামল, তখন প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাদল ভিজতে ভিজতে বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে কফিহাউজে গিয়ে পৌঁছাল। সেখানে চেনাশুনা দু’এক জনের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, এক কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়ল সে সেখান থেকে। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। বাদল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। তারপর কাক ভেজা হয়ে বাসে উঠল। বাড়ি ফিরে রাত হয়ে গেল। কিছু না খেয়ে, জামা-প্যান্ট ছেড়ে, ভাল করে গা মুছে, লুঙ্গি পরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাতে প্রবল জ্বর এল তার। রাতটা বেঘোরে জ্বরের ভিতর তার অচেতন ভাবে কেটে গেল।
বেলা আটটার সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে, বিছানা ছেড়ে উঠে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবির রিংট নিয়ে বাদল টলতে টলতে এসে গেটেরটা তালা খুলে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পূর্ণিমা ঘরে ঢুকে বাদলকে দেখে বলল, দাদাবাবু কি হয়েছে আপনার? - জ্বর হয়েছে বোধহয়, শরীরটা ভাল লাগছে না।
পূর্ণিমা তার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে তাকে রিক্সায় করে ঢাকুরিয়ার মোড়ে ডাঃ সঞ্জীব সেনের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। দর্শনী বাবদ বাদল মানিব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট তার হাতে তুলে দিয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর ওষুধগুলি কিনে নিয়ে পূর্ণিমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো রিক্সা করে। বাড়ি ফিরে পূর্ণিমা তাকে দুধ আর পাওরুটি গরম করে খেতে দিল। সেগুলি খাবার পর পূর্ণিমাকে তাকে বললেন, দাদাবাবু চা খাবেন? - না।
- আজ কি রান্না হবে দাদাবাবু?
- কিছু রান্না করতে হবে না। দুধ গরম করে রাখো। আমি খেয়ে নেবো খিদে পেলে।
পূর্ণিমা নিজের জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে এসে বাদলের ঘরে ঢুকল। জানলার কাছে একটা চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, দাদাবাবু কিছু মনে না করলে, একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন না তো? - কি কথা?
- ছোট মুখে বড় কথা ভাববেন না, আগে বলুন।
- না ভাবব না, তুমি বল।
- দাদাবাবু আপনি একটা বিয়ে করে ফেলুন।
- হা হা হা। কেন?
- আপনার অসুখ বিসুখ হলে, সে আপনার সেবা করতে পারবে। তাছাড়া আপনি একা মানুষ, কথা বলার মতো একজন পাশে থাকলে আপনার ভাল লাগবে। নিজেকে তখন আর একা নিঃসঙ্গ মনে হবে না।
- তা তুমি ঠিকই বলেছো পূর্ণিমা।
- আপনি বিয়ে করলে বলুন, আমাদের স্কৃলের এক দিদিমণি আছে। ম্যাডাম খুব ভাল মনের মানুষ। আমি তা হলে, তার সঙ্গে কথা বলে দেখব আপনার জন্য।
- বেশ, তবে কথা বলে দেখ।
- আচ্ছা।
পূর্ণিমা বাদলের ঘর থেকে এগারোটার পর বের হল। তারপর তার স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হল। কি কারণে, সেদিন আর পিঙ্কি স্কুলে আসেনি। তাই তাকে আর বলা হল না খবরটা যে, দাদাবাবু বিয়ে করতে রাজি। পূর্ণিমা ভাবল, পিঙ্কি ম্যাডাম যেদিন স্কুলে আসবেন, সেদিনই তাকে খবরটা দেবে সে।
তিনদিন পর জ্বর ছাড়ল বাদলের। তরে শরীর খুব দুর্বল। খাবারে কোন রুচি নেই।
কয়েকদিনের সেবা যত্নে পূর্ণিমা তাকে সুস্থ করে তুলল।
তার কিছুদিন পর পূর্ণিমার মধ্যস্থতায় বাদল আর পিঙ্কির মধ্যে বালিগঞ্জ মোড়ের কাছে ‘কোয়ালিটি’ রেস্টুরেন্টে এক সন্ধ্যায় তাদের একান্ত সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হল।
পিঙ্কি বুঝে পেল না যে, কি পরে আজ সে বাদলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে? সালোয়ার কামিজ, নাকি জীনসের প্যান্ট শার্ট। মানুষটার রুচি কেমন সে তা জানে না। জীনস পরলে যদি তাকে দেখে, বেশি মড মেয়ে ভাবে। মড মানে মডার্ন। মনে মনে নিজেই শেষে ভাবল, সবচেয়ে ভালো হবে, শাড়ি পরে যাওয়া। পুরনো কিংবা আধুনিক সব রুচির মানুষের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনেহয়। পিঙ্কির আকাশী নীল রঙের একটা ফিনফিনে সুন্দর শাড়ি আছে। সেটা পরেই সে যাবে ঠিক করল। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। কপালে টিপও পরবে আকাশী রঙের। ঠোঁটে লিপস্টিক দেবে আকাশী রঙের শেড। সঙ্গে ভ্যানিটি ব্যাগটাও নেবে সেই রঙের।
একদম আকাশী পরি সেজে যাবে সে। তাকে দেখে যেন মনেহয়, আকাশ থেকে উড়ে যাচ্ছিল, এখানে হঠাত এইমাত্র নেমে এসেছে পড়েছে সে।
ঠিক সন্ধ্যা ছ’টায় কোয়ালিটি’ রেস্টুরেন্টে ঢুকল পিঙ্কি। একটি টেবিলে বাদল বসেছিল। দু’জনের মধ্যে আলাপ পরিচয় হল। পিঙ্কি দেখল বাদল বেশ ধীর স্থির স্বভাবের বাদল। লম্বায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি হবে। তবে স্বাস্থ্য খুব ভাল নয়। রোগা প্রকৃতির। নাকটা টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো। চোখ দু’টি বড়, ভাসা ভাসা, কৌতূকপ্রিয় মায়াবী ধরণের। তবে দৃষ্টি তার উজ্জ্বল। তা দেখে পিঙ্কির বলতে ইচ্ছে হল –
“তোমার চোখের মায়াবী তারায়
হঠাৎ যদি আমার হৃদয় হারায়,
তুমি তখন উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে
নীল আকাশের তারায় তারায়।”
তবে তা আর তাকে বলে হল না।
লোকটা নীল রঙের জীনসের একটা প্যান্ট পরেছে। গায়েে হলদে-সবুজ রঙের জংলা চক্রাবক্রা ছাপের একটা সুতির টি-শার্ট। মাথায় কোকড়া চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। দাড়ি গোঁফ নিপুণভাবে কামানো। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কথা-বার্তায় কৌতূকের আভাস পাওয়া যায়। আকর্ষণ করার মতো তার চোখে একটা দুর্নিবার আভাস আছে। পিঙ্কির ভাল লাগল মানুষটাকে। মনে মনে তাকে পছন্দ করল।
বাদল পিঙ্কিকে বলল, কি খাবেন বলুন?
পিঙ্কি বলল, আপনি যা বলবেন তাই খাব।
বাদল শুনে নিঃশব্দে হাসল। তারপর বলল, কেন? আপনার নিজের কোন ইচ্ছে নেই?
- আছে। তবে আজ আপনার ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে।
বাদল হা হা করে হেসে উঠে বলল, বেশ। বাদল বেয়ারাকে ডেকে দু’টি মোগলাই পরোটার অর্ডার দিল।
মোগলাই আসতে খুব বেশি দেরি হল না। বাদল একটা প্লেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন খান।
লোকের সামনে খেতে পিঙ্কির খুব অস্বস্থি হয়। তবু প্লেটটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে, কাটা চামচ দিয়ে কেটে এক টুকরো মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, আপনি খুব মিথ্যুক।
বাদলও মোগলাই চিবোতে চিবোতে কৌতূকপ্রিয় চোখে তার দিকে তাকালো। জানতে চাইল, কেন?আমি আবার কি মিথ্যে বললাম? - আপনি বলেছিলেন, বালিগঞ্জ স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করেন। আপনার প্রেমিকার নাম পিঙ্কি।
বাদল এবার নিঃশব্দে হেসে বলল, অচেনা অজানা একটা মেয়েকে আমি কোন দুঃখে সত্যি কথা বলতে যাব? তাই মিথ্যে বলেছি। তারপর সে রসিকতার সুরে বলল, কেন আপনার নাম পিঙ্কি না? কি নাম তবে আপনার? - আমি আমার নামের কথা বলছি না।
- তবে?
- আমি বলছি আপনার প্রেমিকা পিঙ্কির কথা।
- তার নাম পিঙ্কি ছিল না। তার নাম ছিল লিলি।
- তার কি হল? বিয়ে হয়ে গেছে?
- হ্যাঁ।
- আপনাকেে ছেড়ে দিয়ে, সে কেন অন্যকে বিয়ে করল?
- তার বাড়ি থেকে যখন বিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিল, আমি তখন বেকার। একটা পত্রিকায় ফ্রি-ল্যান্সিং করে সামান্য আয় করি, নিজের চা সিগারেটের খরচও ওঠে না। সেই অবস্থায় তাকে বিয়ে করে কি খাওয়াব? তাই –
- তাই সে আপনাকে ছেড়ে গেল?
- না। বিয়ের আগে এসে সে আমার কাছে এসেছিল। এসে খুব কান্নাকাটি শুরু করল। আমি তখন তাকে আমার অসহায় অবস্থার কথা বুঝিয়ে বলে, তাকে ওই বিয়ে করতে রাজী করিয়েছি।
- ওহ্, আচ্ছা।
বাদল তারপর, মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, - আপনি তাহলে সেই নারী, যে আমাকে এস টি ডি ফোন থেকে ফোন করে মাঝে মাঝে বিরক্ত করতো?
- হ্যাঁ করতাম।
- কেন?
- বেশ করতাম।
- আপনি আমার বাড়ির ফোন নাম্বর পেয়েছিলেন কি করে?
- তা আপনাকে আমি বলব কেন? তা জেনে আপনার কী লাভ?
- না, কোনও লাভ নেই।
- তবে আর জানতে চাইছেন কেন?
- আর জানতে চাইব না।
- আপনি মানুষটা খুব সুবিধার নয়।
- কেন?
- আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে।
- তাই নাকি?
- হুম।
এই ভাবেই তাদের তাদের আলাপ কিংবা প্রলাপ চলতে থাকে মোগলাই খেতে খেতে। খাওয়া শেষ হলে, পিঙ্কি কফির অর্ডার দিল বেয়ারাকে ডেকে। কফি খেতে খেতেই তাদের এনগেজমেন্ট ডেট ঠিক হয়ে যায়। পিঙ্কি মনে মনে ভাবল, চাঁদু ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখনি। বিয়েটা আগে হয়ে যাক, তারপরে টের পাবে কার পাল্লায় পড়েছো তুমি?
যেহেতু তাদের দু’জনেরই মা বাবা কেউ নেই, তাদের মধ্যে নিভৃত আলোচনায়, এটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তাদের বিয়েটা হবে রেজিষ্ট্রি করে। রেজিষ্ট্রির হবার দিন থেকে, এক মাস আগে ম্যারেজ রেজিষ্টারের কাছে নোটিস দিতে হবে। তার একমাস পর তাদের রেজিষ্ট্রি হবে। দু’পক্ষেরই কমপক্ষে দু’জন করে সাক্ষী থাকতে হবে।
রেজিষ্ট্রির দিন ঠিক হল পঁচিশে বৈশাখ , রবি ঠাকুরের জন্মদিন। দিনটা কেন বাদল ঠিক করল, পিঙ্কি বুঝতে পারল না।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। আকাশে জায়গায় মেঘ ঝুলে আছে। ভ্যাপসা গরম। বাদলের কাগজের অফিস থেকে বেরোতে সন্ধ্যা ছ’টা বেজে যায়। অফিস থেকে বের হবার সময়ে শুরু হল টিপটিপ করে বৃষ্টি। বাদল অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলো সেই বৃষ্টিতে ভিজেই। তারপর গা মুছে, হাত পা ধুয়ে এসে, বাদল লুঙ্গি পরে গায়ে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এসে লেখার টেবিলে বসল। বাদল লেখালেখি করে সকালের দিকে। রাতেে দিকে লেখলেখি করে না। বই পড়ে। টেবিলে পড়ে আছে, এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য ব্লাক অবেলিক্স’ বইটা। অনেক দিন আগেই বইটা সে লাইব্রেরী থেকে নিয়ে এসেছিল। সময়ের অভাবে একপাতাও পড়া হয়ে ওঠেনি। কাজের চাপে পড়ার সুযোগ পায়নি। আজ বইটা পড়বে ভেবে বাদল বইটা কাছে টেনে নিল নিজের কাছে। কয়েকপাতা পড়ার পর, তার মনেহল, এক কাপ চা খেলে ভাল হত এই বর্ষায়। তাই সে বইটা টেবিলের উপর চাপা দিয়ে রেখে, রান্না ঘরে এক কাপ চা করে আনতে গেল। চা সে নিজে করতে পারে।
চায়ে চুমৃক দিতে দিতে বইটা সে পড়তে লাগল। বই পড়ায় তার মন বসাতে পারল না। মনে পড়তে লাগল পিঙ্কির কথা। পিঙ্কির কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল লিলির সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ এক দৃশ্যের কথা। সেদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিল। পার্কের নির্জন কোণে বসে বৃষ্টিতে ভিজে লিলির জামা-কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছিল। শরীর জামা-কাপড় ভেদ করে ফুটে বের হচ্ছিল তার যৌবন। লিলির বুকের দিকে চোখ পড়েছিল বাদলের। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েছিল সে।
- কি দেখছো?
- তোমাকে।
- আমাকে না আমার শরীরটাকে?
বাদল শুনে লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। - কি, লজ্জা পেলে নাকি?
- না তো।
- তবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
- কি করব?
- তোমার যা করতে ইচ্ছে করে করো।
- কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না।
- মিথ্যে কথা বলবে না। মিথ্যে কথা আমার একদম পছন্দ হয় না। আমি জানি তোমার কি ইচ্ছে করছে।
- কি?
- আমাকে চুমু খেতে।
- হুম
- খুব ইচ্ছে করলে খাও, আমি আপত্তি করব না।
- কেন?
- আমার ইচ্ছে।
- বেশ। বলে, আমি আর দেরি করিনি। পরপর সাতটা চুমু খেয়ে ছিলাম তাকে। লিলি কোন বাধা দেয়নি। বেশ উপভোগ করেছিল চুম্বনগুলি। আমার গুণে গুণে একুশটা চুমু খাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার। তা আর সম্ভব হয়নি, সে সময় কয়েকজন লোক এদিকে আসছিল দেখে, নিজেকে সংবরণ করে নিতে হয়েছিল।
‘দ্য ব্লাক অবেলিক্স’ বইটা আর পড়া হয়ে উঠল না। বাদল রুটি তরকারি খেয়ে বিছানায় এসে বসল। জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে টান দিয়ে ভাবতে লাগল, রাজপুর পুরসভার মাধব পালের সঙ্গে সেদিন বিয়ে না হলে, আজ তার সাথেই বিয়ে হত লিলির। সিগারেট শেষ করে, বাদল বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে কম স্পীডে। বাইরে বৃষ্টি হওয়ার জন্য হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা লাগছে।
গায়ে একটা চাদর টেনে নিয়ে সে চোখ বুঁজে কখন ঘুমিয়ে পড়ল, টের পেল না।
যখন ঘুম ভেঙে বাদল দেখল, আকাশ পরিস্কার। পূর্ণিমার বদলে বিপ্রদাস এসে হাজির সকালবেলা। এসে বলল, তোর জন্য একটা পিস্তল জোগাড় করেছি।
- কেন?
- তুই খুন করবি বলে।
- বলিস কি? আমি বিস্ময়ে বলি তাকে।
- চল আমার সঙ্গে গাড়ি নিয়ে এসেছি আমি। কা’কে খুন করবি ঠিক করেছিস, চল তাহলে বেরিয়ে পড়ি।
- কা’কে খুন করব?
- যাকে তোর শত্রু ভাবিস। আমাকে শত্রু ভাবলে, আমাকেও তুই খুন করতে পারিস। আমি বাধা দেব না।
- ধুস। বলেই বাদলের হঠাৎ মাধব পালের কথা মনে পড়ল। ওই লোকটাই তার শত্রু। সে লিলিকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
- কা’কে খুন করবি ঠিক করেছিস?
- হ্যাঁ।
- চল তবে। নীচে আমার গাড়ি আছে।
গাড়ি মানে মটর সাইকেল।
নীচে নেমে এলাম আমরা।
তারপর বিপ্রদাস মটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে বলল, উঠে বস এবার পিছনে।
বাদল তাই করল। - কোথায় যাবি?
- রাজপুর পুরসভা।
গাড়ি চলতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পর গাড়ি এসে থামল, রাজপুর পুরসভার কাছে। খুন করে দ্রুত ফেরা যায় য্কে তার জন্য গাড়ির মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, গাড়ি লক করে, আমরা পুরসভার ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকে আমি বললাম, মাধব পাল কি আছেন? - হ্যাঁ, আছেন। বলে একজন কর্মচারী ভিতরের ঘরে গেলেন তাকে ডেকে দেওয়ার জন্য।
- মোটাসোটা বেঁটে মতন একজন কালো লোক বেরিয়ে এসে বলল, কা’কে চান?
আমি বললাম- মাধব পাল। - আমিই মাধব পাল। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
- আমায় আপনি চিনবেন না। বলেই আমি, পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে, একটা গুলি করলাম তার কপালে। মাধব পাল ছিটকে নীচে পড়ে গেল। তাকে গুলি করে আমার মনে কোন অনুশোচণা হল না, তাকে খুন করার জন্য। গুলির শব্দ শুনে কর্মচারীরা বেরিয়ে আসার আগেই আমরা গাড়ি নিয়ে তীব্র গতিতে পালিয়ে চলে এলাম।
আমার বাড়ির সামনে বড় রাস্তার কাছে এসে, বিপ্রদাস আমায় নামিয়ে দিয়ে বলল, এবার বাড়িতে গিয়ে লিখতে বসে যা। খুনের এই ঘটনাটা দিয়ে ডিটেলসে লিখতে শুরু কর। দেখবি গল্পটা আপনা থেকে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।
তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে, আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। বাড়ির কাছে দেখলাম, একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম না কি করে পুলিশ এত তাড়াতাড়ি খবর পেল। আমি ভ্যান দেখে দৌড়াতে শুরু করলাম। একজন পুলিশ আমাকে বলল, স্টপ। তারপর আকাশের দিকে একটা গুলি ছুঁড়ে বলল, পালাতে চেষ্টা করলে কিন্তু গুলি করব আমি। আমি তার কথা না শুনে দৌড়াতে থাকলাম। আবার গুলির শব্দ শুনলাম। গুলিটা এসে আমার পায়ে লাগল৷ আমি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। কয়েকজন পুলিশ এসে আমাকে ধরে ফেলল। চ্যাং দোলা করে নিয়ে আমাকে ভ্যানের ভিতর কোনও মালের বস্তার মতো ছুঁড়ে ফেলল। তারপর ভ্যান চলতে শুরু করল। আমি ভ্যানের ভিতর পড়ে থেকে ভাবতে লাগলাম, বাইশে শ্রাবণ পিঙ্কির সাথে আমার ম্যারেজ রেজিষ্টি হওয়ার কথা। খুন করার জন্য আমার জেল হয়ে গেলে, তার কি হবে?
কাছে কোথায় বিকট শব্দে বাজ পড়ল। বিকট শব্দে বাদলের ঘুম ভেঙে গেল। এতক্ষণ তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল। বাদল সস্থি বোধ করল। শান্তি পেল মনে। এতক্ষণ বুকের ভিতরটা তার ভয়ে, হিম হয়েগেছিল। এখনও বুকটা কাঁপছে যেন।
এমন স্বপ্ন সে দেখল কেন? বাদল ভাবল। মনে সে কোন উত্তর খুঁজে পেল না। সে তো কখনও মাধব পালকে খুন করার কথা ভাবেনি। তাহলে? মনস্তত্ববিদরা শুনে হয়তো বলবেন, বাদলের অবচেতন মনে এই ভাবনা গোপনে বিলীন হয়ে ছিল। মনের চেতন ভাবনা, ভাবনার হিমশৈলের চূড়া মাত্র। অবচেতন মনের ভাবনার বিস্তার অনেক গভীরে।
আচ্ছা লিলি যদি জানতে পারে সে তার স্বামী মাধব পালকে খুন করতে চায়, তাহলে সে কি তাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে? বিয়ের আগে লিলি যেদিন শেষবার বাদলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সেদিন সে খুব কেঁদে ছিল। তা দেখে বাদল সেদিন তাকে আদর করে, কপালে শেষ চুম্বন দিয়ে বলেছিল, তুমি সুখি হবে, আমি আশীর্বাদ করছি। সেকথা তাহলে কথার কথা ছিল শুধুমাত্র। তাতে তার প্রাণ ছিল না কোনও? সে কি তবে মিথ্যে কথা বলেছিল লিলিকে? পিঙ্কি অবশ্য বাদলকে মিথ্যুকই বলেই ভাবে। সেদিন কোয়ালিটিতে মোগলাই খেতে তাকে বলেছিল, আপনি খুব মিথ্যুক।
ভোরে পিঙ্কির ঘুম ভাঙল। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। তারপর আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখল। মুখখানা তার খুব সুন্দর নয় অবশ্য। তবে তার মুখের লাব্যণে একটা আলগা আকর্ষণ আছে। চোখে ঝিলিক আছে। এটা তার মার কাছ থেকে পাওয়া। মাও হাসলে তার চোখ দু’টি ঝিলিক দিযে ওঠে। তারপর রাত পোষাকের উপরে একটা একটা গাউন গায়ে পরে এসে হোষ্টেলের পূব দিকের জানলা খুলে দিল। আকাশে হাল্কা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছুল। সূর্য তখনও ওঠেনি। কী সুন্দর লাগল দেখতে তার সকালের আকাশটা। তার মনে হল এমন সুন্দর সকাল সে প্রথমবার দেখল। আগে কখনও দেখেনি। সত্যিই কি তাই? হয়তো তার মনের মনোরম আবেশ এত সুন্দর করে তুলেছে তার মনের ভিতরে আকাশটাকে। হঠাৎ তার মনে হল চিন্ময়ী বা শিপ্রাকে খবরটা জানাতে পারলে বেশ ভাল হতো যে, বাদলের সঙ্গে পিঙ্কির বিয়ে হচ্ছে। সেটা জানাবার কোন উপায় নেই। তাদের কারও সঙ্গেই এখন আর পিঙ্কির কোনও যোগাযোগ নেই। তারা কোথায় থাকে, কি করে কিছুই জানা নেই। পুরানো মোবাইলে তাদের নাম্বারটা লেখা ছিল। মোবাইল খারাপ হয়ে যাওয়াও সেই নম্বরগুলিও হারিয়ে গেছে। স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পর সে একটা নতুন মোবাইল ফোন কিনেছে। কিন্তু সেখানে ওদের কারও মোবাইল নাম্বার টুকে রাখা হয়নি। হয়নি, তার কারণ হয়তো, পিঙ্কি স্কুলের চাকরি পাওয়ার পর, তার কাছে তাদের গুরুত্ব অনেকটা কমে গেছিল। কলেজে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, স্কুলের মতো এত প্রগাঢ় হয না সাধারণত।
পিঙ্কি ভাবল ম্যারেজ রেজিষ্টির দিন, সে তার সঙ্গে স্কুলের বড়দি আর রমাদিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, তার পক্ষের সাক্ষী হিসাবে। তাদের বলে রাখতে হবে আগে থেকে, ওই বাইশে শ্রাবণ দিনটির কথা।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাদল ফোন করে বিপ্রদাসকে বলল, বন্ধু খুন নয়, আমি একটা বিয়ে করতে চলেছি। বাদল শুনে বলল, আশ্চর্য !
- আশ্চর্য কেন?
- আরে আমিও কাল দেখেছি তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস, আর আমি তোর সঙ্গে যাচ্ছি।
- মানে?
- কাল রাতে আমি এমনই একটা স্বপ্ন দেখেছি, তা যে সত্যি হয়ে উঠবে মোটেই ভাবতে পারিনি, তাই আশ্চর্য হয়েছি।
- তাই নাকি গুল দিচ্ছিস আমাকে?
- হানড্রেড পারসেন্ট ট্রু। তা মেয়েটির নাম কি? কি করে সে?
- মেয়েটির নাম পিঙ্কি, স্কুলে পড়ায়।
- মাষ্টারনী?
- হুম।
- তা কবে বিয়ে?
- পঁচিশে বৈশাখ রেজিষ্টি হবে, তুই আমার পক্ষের সাক্ষী থাকবি।
- নিশ্চয়ই থাকব। কখন রেজিষ্টি হবে?
- সন্ধ্য ছ’টায়।
- বেশ আমি চলে যাব। জায়গাটা বল।
- তুই আমার বাড়ি আসবি পাঁচটার মধ্যে। আমরা একসঙ্গে যাব।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তুই সেই দিন সকালের দিকে আমাকে একটা ফোন করে, একবার মনে করিয়ে দিস।
- আচ্ছা, তোকে সকালে ফোন করব আমি।
- ঠিক আছে, রাখছি তবে। বলে ফোন কেটে দিল বিপ্রদাস।
পূর্ণিমার দাদা গড়িয়াহাটের একটা জামা-কাপড়ের দোকানে কাজ করে। মাসে ছয়- সাত হাজার টাকা পায়। এখনও তাদের কোন বাচ্চা হয়নি। পূর্ণিমারা সন্তোষপুর বস্তির বাড়িতে দু’টি ঘর নিয়ে ভাড়া থাকে। একটিতে দাদা বৌদি থাকে। অন্যটাতে মা থাকে পূর্ণিমাকে নিয়ে। পূর্ণিমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, যখন সে স্বামীর ঘরে চলে গেছিল, তখন দাদা বৌদির কাছেই মা থাকত। তারা মাকে খাবার দিত। পূর্ণিমা এখানে ফিরে আসায় তারা কেউই খুশি হয়নি। বরং তাকে বলেছে, নিজের অধিকার কোন আক্কেলে ছেড়ে চলে এলি। পূর্ণিমা তার কোন জবাব দেয়নি। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। মা যখন তাকে বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছে, তখন এসব অবান্তর কথার উত্তর দেওয়ার কোন মানে হয় না।
তারপর এখানে এসে পূর্ণিমা কাজে যোগ দেওয়ার পর, দাদা বৌদি মাকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পূর্ণিমার আয়েই এখন তাদের চলে, তার আর মায়ের। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার মা মন খারাপ করে ভাবেন, আমি মারা গেলে পরে পূর্ণিমাকে কে দেখবে? পূর্ণিমার বাকী জীবনটা কি তাহলে বৈধব্যের কষ্ট নিয়ে কাটবে? এসব ভেবে ভেবে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। কিন্তু কোন কূল কিনারা পান না তার।
এর মধ্যে স্কুলে গিয়ে পিঙ্কির বিয়ে নিয়ে, দিদিমণিদের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। পিঙ্কির বিয়ের কথা শুনে তারা সকলে খুব খুশি। স্কুলের এক দিদিমণির বিয়ে হবে। রেজষ্ট্রির দিন বড়দি আর রমাদি তার সঙ্গে যাবেন জানলেন উৎসাহের সঙ্গে।
- কোথায় দাঁড়াতে হবে বল? সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে তো?
পিঙ্কি বলল, হ্যাঁ। পঞ্চানন তলা থেকে উবে-ট্যাক্সি নিয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। সাড়ে পাঁচটায় আমরা পঞ্চানন তলা বাস স্টপে সকলে মিট করব। ওরা রাজী। তাই ঠিক হল।
এর মধ্যে পিঙ্কির সঙ্গে বাদলের দু’বার কথা হয়েছে। দু’বারই কাজের কথা।
পঁচিশে বৈশাখ বাদল তার দু’জন সাক্ষী নিয়ে বিজয়গড়ে রেজিষ্টারের অফিসে চলে যাবে ছ’টার মধ্যে। পিঙ্কিও যেন তার দু’জন সাক্ষী নিয়ে চলে যায় সেখানে ছ’টার মধ্যে। রেজিষ্টারের অফিসের ঠিকানা ও ফোন নম্বর সে পিঙ্কির হোয়াটস অ্যাপে লিখে পাঠিয়েছে। আর জানতে চেয়েছে, রেজিষ্ট্রির পরই সে বাদলের বাড়ি চলে আসবে কিনা হোষ্টেল ছেড়ে?
পিঙ্কি তার উত্তরে বাদলকে জানিয়েছে, রেজিষ্ট্রির দিনটা পঁচিশে বৈশাখ যেহেতু মে মাসের নয় তারিখ হবে, তাই সে মে মাসটা হোষ্টেলে কাটিয়ে দেবে, তারপর পয়লা জুন সেখানকার সব পাট চুকিয়ে তার বাড়িতে চলে আসবে। সেই সময়ের মধ্যে বাদল যতটা পারে ঘরটা গুছিয়ে নিতে পারবে। তারপর পিঙ্কি সেখানে গিয়ে সে তার নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবে। বাদল তার কথায় এক গাল হেসে বলল, তথাস্তু দেবী।
বাদলের বলার ধরণ দেখে পিঙ্কিও হেসে ফেলল।
আজ পঁচিশে বৈশাখ। সকাল থেকেই প্রচন্ড গরম ছিল। দুপুরের দিকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। প্রথমদিকে বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ছিল। বেলার দিকে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। কখনও বেগ আবার কিছুটা কমে আসছিল। কী হবে ভেবে পিঙ্কির বুকের ভিতরটা ভয়ে দুরদুর করছিল। আবার তার মনের ভিতরটা আনন্দেও নেচে উঠছিল, এই কথা ভেবে যে, আজ তার বিয়ের রেজিষ্ট্রির দিন। রেজিষ্ট্রির কাজ সব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে তো? মাঝে কোন ঝামেলা ঘটবে না তো? এইসব কথা ভেবে পিঙ্কির মনের ভিতরে কিছুটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। এমন সময় বাদলের ফোন এল। পিঙ্কি মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে বলল – হ্যালো।
- আমি বাদল বলছি, ছ’টার মধ্যে সাক্ষীদের নিয়ে রেজিষ্ট্রি অফিসে চলে আসবেন।
- আচ্ছা।
পিঙ্কির হাসি পেল। বাদল এখনও তাকে আপনি করে কথা বলছে। তুমি করে কখন থেকে বলতে শুরু করবে? রেজিষ্ট্রি হওয়ার পর থেকেই কি? নাকি যেদিন থেকে সে বাদলের কাছে গিয়ে তার ঘরে থাকতে শুরু করবে, সেদিন থেকে? - কি করছেন এখন? বাদল জানতে চাইল।
- ভাবছি।
- কি, আমার কথা?
পিঙ্কির বলতে ইচ্ছে হল, আপনার কথা ভাবতে আমার বয়েই গেছে। আপনার কথা ভাবতে যাব কোন দুঃখে? বলতে ইচ্ছে হলেও সে বলতে পারল না।
হয়তো পিঙ্কি বললে, বাদল কথাটা শুনে বলে উঠবে- দুঃখে নয়, ভাবছেন সুখে।
সে সব কিছুই ঘটল না।
পিঙ্কি বলল – হুম। - কি ভাবছেন আমার কথা?
- আপনি, আমাকে বিয়ে করে, ভুল করবেন না তো?
- কেন, এ কথা বলছেন?
- আমি একটু বেয়াড়া প্রকৃতির ও বেয়াদপ ধরণের।
- মানে?
- নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিছু করতে পারি না। সেটা মেনে নিতে পরে আপনার অহংয়ে লাগবে না তো?
শুনে বাদল, হো হো করে হেসে উঠল। - হাসছেন কেন?
- যার কোনও অহংই নেই, তার আবার লাগবে কিসে?
বাদলের এই কথা শুনে পিঙ্কি বিমূঢ় হয়ে পড়ল। তার আর কথা বলার রইল না। তাই সে বলল, - ঠিক আছে, ছটার মধ্যে আমরা রেজিষ্ট্রি অফিসে পৌঁছে যাব।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু ধরে এল। পিঙ্কিরা যখন বেরোল তখন বৃষ্টি ছিল না। তারা উবে-ট্যাক্সি করে ছ’টার মধ্যেই এসে রেজিষ্ট্রি অফিসে এসে পৌঁছাল।
একটু পরেই এল বাদলরা। বাদলের সঙ্গে এসেছে বিপ্রদাস আর পূর্ণিমা। মেয়েরা সকলেই খুব সেজেগুজে এসেছে। পূর্ণিমা পরেছে একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি। তার সঙ্গে মানান সই রঙের হাল্কা সবুজ রঙের ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। পিঙ্কি পরেছে, আকাশী নীল রঙের ফিনফিনে শাড়ি। সেই রঙের ব্লাউজ ও টিপ। দেখতে আকাশের পরি পরি লাগছে তাকে। বাদল তাকে দেখে বিহ্বল হল। ভাবল এত সুন্দর পিঙ্কি। বড়দি পরেছে দামী একটা ঝামদাণী শাড়ি। হাতে সোনার চুড়ি বালা। গলায় ভাড়ি সোনার হার। রমাদি অবশ্য ওদের মতো অতটা জমকাল সাজ-পোষাক পরেননি। সে পরেছে সাদা জমিনের উপর লাল পাড়ের শাড়ি। রোগা পাতলা শরীরে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বাদল পরেছে বিস্কুট রঙের সিল্কের পাঞ্জাবী ও পাজামা। পাঞ্জাবীর গলার কাছে আবার নীল সূতোর কারুকাজ করা। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। তাকেও বেশ সম্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। বিপ্রদাস নাটকের রিয়ের্সাল থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছ। তার পরনে জীন্সের প্যান্ট আর গায়ে জংলি চক্রাবক্রা কাটা একটা সূতির শার্ট। দলের মধ্য তার পোষাকটাই একটু বিসদৃশ প্রকৃতির।
রেজিষ্ট্রি অফিসে তখন আর এক যুগলের রেজিষ্ট্রি চলছিল। এরপর ওদের রেজিষ্ট্রি হবে। ওরা সকলে অফিস সংলগ্ন একচিলতে বারান্দায় পাশাপাশি দুটো বেঞ্চে বসেছিল। বারান্দাটা অপ্রশস্ত। তারা বসার পর আর নড়াচড়ার কোনও জায়গা ছিল না। কিছুক্ষণ বসার পর বাদল বিপ্রদাসকে বলল, চল বাইরে গিয়ে একটা সিগ্রেট টেনে আসি।
- চল।
বিপ্রদাস আর বাদল বাকীদের সকলকে বলে, বারান্দার বাইরে চলে এল। বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় পড়তেই অদূরে একটা পান সিগ্রেটের দোকান দেখা গেল। বাদল সেখান থেকে দু’টি সিগ্রেট কিনে বিপ্রদাসের দিকে একটা এগিয়ে দিল। বিপ্রদাস সিগ্রেট নিয়ে দোকানের জলন্ত দড়ি থেকে সিগ্রেটটা ধরিয়ে নিল। সিগ্রেটে দু’টান দিয়ে বিপ্রদাস বলল, ওদের জন্য চারটে মাজা কিনে নিয়ে গেলে হত না? - হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।
ওই দোকানে মাজা আছে দেখে, বাদল ওদের জন্য চারটে মাজা কিনল ওই দোকান থেকেই।
কাঁধের শান্তিনিকেতনী ব্যাগ থেকে মানিব্যাগ বের করে দোকানীকে, সিগ্রেট আর মাজার দাম পরিশোধ করে দিল। তারপর মানিব্যাগ আবার কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগে ভরে রাখল।
বাদল আবার বলল, রেজিষ্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর তো রেজিষ্ট্রারের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিতে হয়। - তাই নাকি? তুই জানলি কি করে?
- আমাদের নাটকের দলের একজনের সঙ্গে রেজিষ্ট্রি অফিসে সাক্ষী দিতে গিয়ে দেখেছি।
- চল তবে কিনে নিই মিষ্টি।
বিপ্রদাস পান সিগ্রেটের দোকানদারের কাছে জানতে চাইল, কাছাকাছি কোথায় মিষ্টির দোকান আছে কিনা? - ওই তো। সামনের মোড়টা ঘুরলেই ডানদিকে দেখতে পাবেন।
ওরা সেদিকে হাঁটতে লাগল সিগ্রেট টানতে টানতে।
সামনের মোড় ঘুরেই দোকানটা দেখতে পাওয়া গেল। ‘ইন্ডিয়ান সুইটস’ দোকানের নাম। সেখান থেকে দশটাকা দামের পাঁচটা কড়াপাকের সন্দেশ কিনে নিল বাদল। আবার কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে মানিব্যাগ বের হল। মিষ্টির দাম মিটিয়ে দিয়ে, মানিব্যাগ আবার ঝোলায় মধ্যে ঢুকে গেল।
ওরা রেজিষ্ট্রি অফিসে ফিরে এসে দেখল, আগের যুগলের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। ওরা চলে যাবার পর, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাদলদের রেজিষ্ট্রির কাজ শুরু হবে। বাদল মেয়েদের দিকে মাজার বোতলগুলি এগিয়ে দিল। মাজা হাতে পেয়ে ওরা সকলে বেশ খুশি হল মনে মনে। সকলেই স্ট্র দিয়ে চুকচুক করে খুব তৃপ্তির সঙ্গে মাজা খেতে লাগল।
এর মধ্যেই আগের যুগল অফিস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। একটু পরেই অফিস ঘরে তাদের ডাক পড়ল। ততক্ষণে মেয়েদের মাজা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ওরা বোতলগুলি বাইরের ওয়েষ্ট বক্সে ফেলে দিয়ে, সকলে একসঙ্গে ওই ঘরে ঢুকল।
রেজিষ্ট্রির বয়ান লেখা আগে থেকেই রেজিষ্ট্রি পেপারে ছিল। তা পড়ে শোনানো হল সকলকে। সকলে শুনল। তারপর এক এক করে স্বাক্ষর করার পালা শুরু হল দু’কপি পেপারে। একটা রেজিষ্ট্রিঅফিসের ওদের রেজিষ্ট্রি ফাইলে জমা থাকবে। আর অন্য কপিটা পাবে বাদলরা।
প্রথমে স্বাক্ষর করল, বাদল। তারপর পিঙ্কি। এরপর দু’তরফের সাক্ষীদের, সকলে একে একে স্বাক্ষর করতে হল। সকলে স্বাক্ষর করার পর, রেজিষ্টার নিজে স্বাক্ষর করে রেজিষ্ট্রি অফিসের স্ট্যাম্প দিয়ে সীল মেরে এক কপি রেজিষ্ট্রি পেপার বাদলের হাতে তুলে দিল।
বাদল কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে মানিব্যাগ বের করল। মানিব্যাগ খুলে রেজিষ্ট্রারের প্রাপ্য মিটিয়ে দিল। মানিব্যাগ আবার ঝোলার ভিতর ঢুকে পড়ল। রেজিষ্টার বয়স্ক মানুষ। পিঙ্কি আর বাদলের মাথায় হাত রেখে আন্তরিকভাবে আশীর্বাদ করে বললেন, তোমরা সুখি হও। বাদল তার হাতে মিষ্টির প্যাকটটা তুলে দিল। তারপর ওরা সকলে রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে এলো।
বেরিয়ে এসে,পিঙ্কি মনে মনে একটা কবিতা ভাবল।
“সময়ের হাতে
ছেলেটি মেয়েটির ডান হাতে হাত রেখে বলল
তুমি আমার আইনত স্ত্রী
মেয়েটি ছেলেটির ডান হাতে হাত রেখে বলল
তুমি আমার আইনত স্বামী
তারপর কয়েকটি সই সাবুদ
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের টিপছাপ,
এক প্যাকেট মিষ্টি
ব্যাস হয়ে গেল বিবাহ নিবন্ধন
তারপর বাকিটা সময়ের হাতে।”
রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে এসে, রাস্তার মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে গড়িয়াহাটে ‘সোনালী রেস্টুরেন্ট’-য়ে চলে এল। সকলের জন্য বিরিয়ানি আর চিলি চিকেনের অর্ডার দেওয়া হল। মেয়েরা সকলে নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কী সব কথা বলছিল আর খুব হাসাহাসি করছিল, হেসে হেসে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আর তৃপ্তি করে বিরিয়ানি চিলি চিকেন খাচ্ছিল। পিঙ্কিও তাদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিয়েছিল। বাদল ওদের হাসি দেখে মজা উপভোগ করছিল বিরিয়ানি আর চিলি চিকেন খেতে খেতে। বিপ্রদাস খেতে খেতে দেখছিল, পূর্ণিমাকে। যেন এক সবুজ পরি বন থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে যোগ দিয়েছে। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, সে আবার বনের ভিতর চলে যাবে।
হাসি গল্প আর খাওয়ার আনন্দে ওরা অনেকটা সময় ব্যয় করল ‘সোনালী রেস্টুরেন্টে’।
পিঙ্কি ‘সোনালী রেস্টুরেন্টের’ বিল মেটাল। বিয়ের খরচ বাদব সে এটা খরচ করল। ওরা সোনালী রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হল, দেখল বাইরে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি কখন এক প্রবল হয়েছে, ওরা কেউ টের পায়নি। ওরা তখন রেস্টুরেন্টের ভিতরে ছিল। এবার বাড়ি ফিরবে কিভাবে ভেবে, সকলেই চিন্তায় পড়ল। এখন বাজে সাড়ে ন’টা। বৃষ্টি কখন থামবে তার কোনও ঠিক নেই। পিঙ্কি বাদলকে বলে সে তার স্কুলের দিদিমণিদের (যারা তার হয়ে সাক্ষী দিতে গেছিলেন) নিয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে, তাতে চড়ে পঞ্চানন তলায় এসে নামল।
নামতে গিয়ে ওরা বৃষ্টিতে অনেকটা ভিজে গেল। দিদিমণিরা রিক্সা নিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল। পিঙ্কি পাশেই তার হোস্টেলে ঢুকে পড়ল।
বাদল আর পূর্ণিমা আর একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরল। বাদল পূর্ণিমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল।
বিপ্রদাস থাকে ভবানীপুরে বকুলতলা রোড। সে হাজরাগামী একটা বাস পেয়ে, তাতে লাফিয়ে উঠে পড়ল।
পরদিন সকালে পিঙ্কি বাদলের ফোন পেল। সে মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে খুব মোলায়েম গলায় বলল, হ্যালো।
- কাল সকলে ঠিক মতো বাড়ি পৌঁছে ছিলেন তো?
- এখনও আপনি?
বাদল হাসল। বলল, আপনি বললে তুমি বলব। - আমি বলার কে? এটা এখন তোমার অধিকার।
অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। যেমন আমার অধিকারে আমি তোমাকে তুমি বলছি। - তাই নাকি?
- হ্যাঁ, মশাই।
- সকলে কি আর তোমার মতো এত অধিকার সচেতন হয়?
- যারা হয় না, তারা অভাগা।
- আমি তাহলে, অভাগা বলতে পার। আমি তেমন অধিকার সচেতন নই।
- সচেতন হা হলে, কি করে নিজের অধিকার আদায় করবে?
- অধিকার বুঝি আদায় করে নিতে হয়?
- নিশ্চয়ই। অধিকার কেউ কাউকে দিতে পারে না। আদায় করে নিতে হয়।
বাদল কথা ঘুরালো। - বেশ বুঝলাম। এখন কি করছো তুমি?
- এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম, এবার বাথরুমে যাব।
- বেশ, তবে যাও। পরে কথা হবে। বলে বাদল ফোনটা কেটে, টেবিলে রেখে দিল।
সেদিন কাগজের অফিসে গিয়ে বাদল এটেনডেন্স রেজিষ্টারে স্বাক্ষর করার পর, ম্যানেজার তথা মালিক সন্তোষ লাহিড়ির চেম্বারের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সন্তোষ লাহিড়ির বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ গম্ভীর প্রকৃতির রাশভারী মানুষ তিনি। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাদল বলল, একবার আসব স্যার? খুব ব্যস্ত আছেন নাকি?
- কে?
- আমি বাদল সোম।
- এসো।
বাদল চেম্বারে ঢুকেই সন্তোষ বাবুর পায়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে, তিনি পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, করেন কি?
বাদল বলল, স্যার একবার প্রণাম করতে দিন, তারপর বলছি। বলে বাদল তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাসি মুখে বলল, স্যার আমি কাল বিয়ে করেছি রেজিষ্ট্রি করে। - বল কি? এ তো দারুণ সুখবর। তোমাদের তো তবে একটা উপহার দিতে হয় আমাকে।
- আপনার আশীর্বাদই আমাদের কাছে বড় উপহার।
- তা বললে কি আর হয়? আশীর্বাদ তো অবশ্যই করি, তার সঙ্গে উপহারও চাই।
বাদল তাকে আবার প্রণাম করে, আসি স্যার বলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসল। তার কাছে পাঠানো সব খবরগুলি দেখে, ভাবছিল কোন খবরগুলি কাগজের প্রথম পাতায় লীড করা যাবে। এরই মধ্যে সে বিয়ে করেছে খবরটা কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা এসে বলল, একটা সুখবর শুনলাম আপনার। বাদলদা মিষ্টি খাওয়ান। মালিককে ছাড়া মোট পনেরো জন কর্মচারী এই কাগজে কাজ করে। আজ এসেছে নয়জন। বাদল দশজনের জন্য দুটো করে রাজভোগ আনার জন্য পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা দু’শ টাকার নোট বের করল। তারপর নোটটা আর্দালি দশরথের হাতে দিয়ে বলল, কুড়িটা রাজভোগ কিনে নিয়ে এসো।
মিষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই দশরথ ফিরে এল।
বাদল তখন দশরথকে দুটো করে মিষ্টি সকলকে বেঁটে দিতে বলল। আর একটা প্লেটে দুটো মিষ্টি নিয়ে সে নিজেই গেল সন্তোষবাবুর ঘরে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার একবার আসব, আমি বাদল সোম। - আসুন।
বাদল চেম্বারে ঢুকে টেবিলের উপর টেবিলের উপর মিষ্টির প্লেটটা রেখে বলল, স্যার একটু মিষ্টিমুখ করুন।
তার কথা শুনে সন্তোষবাবু অমায়িক হাসলেন।
তারপর বললেন, আমার সুগার আছে, মিষ্টি খাওয়া বারণ, তবুও আপনার বিয়ে উপলক্ষে একটা মিষ্টি আমি খাব। বলেই একটা মিষ্টি তুলে নিলেন। তারপর প্লেটটা বাদলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা আপনি খান। বলেই হাতে তুলে নেওয়া মিষ্টিটা মাথাটা একটু পিছন দিকে কাত করে, মুখটা তুলে ধরে বিশাল একটা হাঁ করে মিষ্টিটা মুখের ভিতর আলগোছে ছেড়ে দিলেন। বাদল দেখল সন্তোষবাবু উপরের মাড়ির একটা দাঁত নেই। এই কথাটা তার জানা ছিল না।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে বিপ্রদাসের মনে পড়ে গেল বাদলের ম্যারেজ রেজিষ্ট্রির কথা।
সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল তার চোখের সামনে পূর্ণিমার মিষ্টি মুখখানা। কী সুন্দর মুখখানি। সহজ সরল মেয়ে। কথা বা ভঙ্গীর মধ্যে কোন জড়তা বা সংকোচভাব নেই। সহজ সাবলীল কথাবার্তা। খুব বেশি কথাবার্তা অবশ্য হযনি পূর্ণিমার সঙ্গে। ওরা যখন বাদলের বাড়ি থেকে একসঙ্গে ট্যাক্সি করে রেজিষ্ট্রি অফিসে আসছিল।
তখন বাদল বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। পিছনে ছিটে বসে ছিল পূর্ণিমা আর বিপ্রদাস। গাড়ি চলতে শুরু করলে বিপ্রদাস তাকে বলল, একটা সিগ্রেট ধরালে আপনার অসুবিধা হবে না তো?
- না না, আপনি ধরান।
বিপ্রদাস তার দিকের ট্যাক্সির জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে, একটা সিগ্রেট ধরাল। তারপর সিগ্রেটে একটা টান দিয়ে বলল, কি নাম আপনার? আমার নাম বিপ্রদাস। - আমার নাম পূর্ণিমা বসু।
- থাকেন কোথায়?
- সন্তোষপুরে।
- বাড়িতে কে কে আছেন?
- দাদা বৌদি, মা আর আমি।
- আপনি কি অবিবাহিত?
- না তো।
- তবে?
- বিয়ে হয়েছিল।
- বর সঙ্গে থাকে না।
- থাকবে কি করে?
- মানে?
- সে তো মরে ভূত হয়ে গেছে।
- কিভাবে?
- বিয়ের কয়েকদিন পরই ব্যাঙ্গালরে ঠিকা-শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে যায়। তারপরই শুরু হল করোনা মারণ ব্যধি। কাজ-কাম সব বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার ট্রেন ও বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ওরা তখন কয়েকজন মিলে ঠিক করল, হেঁটে ফিরবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ফিরতেও শুরু করেছিল ওরা। করোনা ওকে ছাড়ল না। ধরল। সঙ্গীরা ওকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে হাঁটা শুরু করল। ওর একজন বন্ধু অবশ্য ওর সঙ্গে থেকে গেছিল। সেখানেই আমার বর করোনায় মারা গেল। ওর বন্ধু কয়েকদিন পর এসে বাড়িতে সেই খবর দিল।
- তবে আপনি শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে মার কাছে চলে এসেছিলেন কেন?
- ভাসুর আমাকে স্বামী-খাকি বলে বদনাম দিয়ে, বাড়ি থেকে আমাকে তাড়িযে দিয়েছেন।
- আপনি কোন প্রতিবাদ করোনি?
- প্রতিবাদ করে আর কি লাভ হতো বলুন? জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কি বাঁচা যেতো? হয়তো ওরা আমাকে বিষ খায়িয়ে মেরে ফেলতো।
- সরি। আপনাকে না বুঝে ব্যথা দেবার জন্য।
- আপনার দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমি এতে ব্যথা পাইনি মোটেও।
বিপ্রদাস ভাবছিল, কী সুন্দর সাবলীলভাবে নিসংকোচে কথাগুলি বলেছিল পূর্ণিমা। বলার মধ্য কোন জড়তা নেই। দীর্ঘদিন নাটকে নিয়ে কাজ করতে করতে, যেন নাটকীয় হয়ে গেছে বিপ্রদাসের ব্যবহারিক জীবন। তার মধ্যে এমন সহজ সুন্দর আচরণ করা সহজ নয়। তাই পূর্ণিমার আচরণ তাকে মুগ্ধ করেছে। তাকে ভাবিয়েছে। এমন মেয়েও আছে আজকাল এই পৃথিবীতে !
ঘরের কাজ করতে করতেই কয়েকদিনের ভিতর বাদলের ঘরখানা সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার হাতের নিপুন স্পর্শে ঘরখানা যেন ইন্দ্রপুরী হয়ে উঠল। যা দেখে বাদল নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেল। আর কয়েকদিনের মধ্যেই পিঙ্কি এসে এই ঘরে উঠবে। শুরু হবে তাদের দাম্পত্য জীবন। যেদিন পিঙ্কি এই বাড়িতে আসবে, সেদিন বাদল একটা পার্টি দেবে ঠিক করেছে। সেখানে থাকবে রেজিষ্ট্রি অফিসে যারা গেছিল তারা সকলে। আর থাকবে তার কাগজের অফিসের সব কর্মচারীরা। আর পিঙ্কি যদি তার কোন বন্ধুকে আসতে বলে, তারা থাকবে। মোট কুড়ি-পঁচিশ জনের মতো হবে। দশ-বারো হাজার টাকা খরচ হবে তাতে। তা হোক। বাদল খরচ করতে কোন কার্পণ্য করবে না এই ব্যাপারে।
পিঙ্কির মনটা খুব অস্থির লাগছিল। মায়া হচ্ছিল হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে। মায়ের মৃত্যুর পর, ভাড়া ঘর ছেড়ে সে উঠে এসে উঠেছিল এই হোস্টেলে। অনেকদিন কেটেছে এখানে তার। তাই তার এই হোস্টেল ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও তাকে এই হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হবে কাল সকালে। সুপারকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল এ’কথা। তার পাওনাগন্ডা সব মিটিয়ে দিয়েছে কাল। তার ঘরের জিনিষপত্র দু’টো বড় হোল্ডঅন ব্যাগে ভরে সে গুছিয়ে নিয়েছে। শুধু ক্যালেন্ডারটা তার এখানে থাকার স্মৃতি হিসাবে এখানে ফেলে রেখে যাবে। এখানে যে নতুন আসবে, সে জানবে পিঙ্কি নামে একজন তার আগে এখানে থেকে গেছে। ক্যালেন্ডারের উপর পিঙ্কি নিজের নামটা লিখে রাখল বড় বড় করে ‘পিঙ্কি দাস’। লিখেই ভাবল, এখন থেকে তো সে আর দাস নেই। রেজিষ্ট্রির পরেই সোম হয়ে গেছে।
তবে কি পদবি দাস কেটে সোম লিখবে। পরক্ষণেই ভাবল, না থাক। সে তো দাস পদবি নিয়েই এখানে কাটিয়েছে তার সময়টা। মাত্র কিছুদিন আগে সোম পদবি জুটেছে তার।
হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ায়, তার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কেঁদে উঠল মন। আজ মা বেঁচে থাকলে কত সুখিই না হতেন। ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এমন সময় ডোর বেলটা বেজে উঠল। পিঙ্কি চট করে আঁচল দিয়ে ভাল করে চোখ দু’টি মুছে নিয়ে দরজা খুলল।
দেখে সুপার সামনে দাঁড়িয়ে।
- কি ম্যাডাম?
- কাল কখন যাবে?
- সকালে।
- এই নাও তোমার রিলিজ সার্টিফিকেট।
সুপার একটা কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিল। - থ্যাং ইউ ম্যাডাম।
- বী হ্যাপি। বলে তিনি হেসে চলে গেলেন।
সুপারকে পিঙ্কির কখনোই পছন্দ করত না। আজ যেন তার জন্যও মায়া হল তার। আর দেখা হবে না তার সঙ্গে ভেবে।
বাদল বিপ্রদাসকে ফোন করে জানালো, পয়লা জুন পিঙ্কি বাড়িতে আসবে বলে, সে একটা বৌভাতের অনুষ্ঠান করতে চায়।
বিপ্রদাস জানতে চাইল, কতজন লোক আসবে?
- কুড়ি-পঁচিশ জনের মতো হবে।
- মেনু কি হবে?
- সরুচালের ভাত,সুক্ত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল, ঝিরিঝিরি আলু ভাজা, চিংড়ি মাছ দিয়ে আলু-পটলের তরকারি, মাছের কালিয়া, খেঁজুর আমসত্ত্বের চাটনি, দই, মিষ্টি, সন্দেশ, পান।
- ঠিক আছে, আমার জানা একজন ক্যাটারার আছে, তার সাথে কথা বলে, পরে তোকে জানাচ্ছি, প্রতি থালির কত করে খরচ পড়বে।
- আচ্ছা।
- খাওয়া হবে কোথায়?
- তুই বল, কোথায় করা যায়?
- হল ভাড়া করলে তো পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা পড়ে যাবে।
- তাই নাকি? এত টাকা ! এ তো দেখছি, ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির অবস্থা।
- হুম। এক কাজ কর। তোদের বাড়ির ছাদে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কর। ক্যাটারারকে দু’টো বড় বড় রঙিন ছাতা আর চারটে টেবিল সঙ্গে পনেরো-কুড়িটা চেয়ার দিয়ে দিতে বলব। তার জন্য তোকে আলাদা খরচ দিতে হবে।
- আচ্ছা কথা বলে দেখ, তার জন্য কতটা বাড়তি খরচ দিতে হবে।
- আচ্ছা। আমি ক্যাটারারের সঙ্গে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।
- ঠিক আছে।
আধ ঘন্টা পর বিপ্রদাস ফোন করে জানালো, ক্যাটারারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। শোন বলি, প্রতি প্লেট খাবার ৪৫০ টাকা করে নেয়, আমার চেনা জানা বলে নেবে ৪২০ টাকা করে নেবে। ২৫ প্লেট খাবারের দাম – ১০,৫০০ টাকা।
দু’টি রঙিন বড় ছাতার ভাড়া – ২০০ টাকা।
চারটে টেবিল ৫০ টাকা করে ভাড়া-২০০ টাকা।
চেয়ার ৩০ টার ভাড়া ১৫ টাকা করে ৪৫০ টাকা।
খাবার পরিবেশন করার জন্য দু’জন লোক যাবে, তাদের দু’জনকে ৫০০ টাকা করে – ১,০০০ টাকা।
আর জিনিষ পত্র নিয়ে য়াওয়া আর আসার জন্য
ভ্যান ভাড়া – ৩০০ টাকা দিতে হবে।
তাহলে তোর মোট খরচ হল –
খাবার – ১০,৫০০ টাকা।
ছাতা – ২০০ টাকা।
টেবিল – ২০০ টাকা।
চেয়ার – ৪৫০ টাকা।
পরিবেশন – ১,০০০ টাকা।
ভ্যান ভাড়া – ৩০০ টাকা।
মোট খরচ – ১২,৬৫০ টাকা।
তোকে দিতে হবে আরও ১৫০ টাকা বাদ দিয়ে মোট ১২,৫০০ টাকা।
রাজি থাকলে বল, তোর কাছে ক্যাটারারকে পাঠিয়ে দেব। ওকে ৫,০০০ টাকা অ্যাডভান্স করে দিয়ে, রিসিটে তারিখ লিখিয়ে ওকে দিয়ে সই করে নিস।
- ঠিক আছে, ক্যাটারার কে পাঠিয়ে দে আমার বাড়ি। বলল বাদল।
পূর্ণিমার খুব আনন্দ হচ্ছে আজ দাদাবাবুর ঘরে পিঙ্কি ম্যাডাম আসবে বলে। সে খুব সুন্দর করে ঘরটাকে সাজাবার চেষ্টা করছে।
বাদলও তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পূর্ণিমা বলল, দাদাবাবু, বাজার থেকে কিছু রজনীগন্ধা স্টিক কিনে আনুন। বাদল উৎসাহিত হয়ে বাজার থেকে রজনীগন্ধার দু’ডজন স্টিক কিনে এনে পূর্ণিমার হাতে দিল। পূর্ণিমা খাটের মাথার দিকের টেবিলটার উপর দু’টো ফ্লাওয়ার ভাসে কিছুটা জল ভরে ছ’টি করে রজনীগন্ধা স্টিক দু’টোতে ভরে রাখল।
ঘর সাজাবার পর, পূর্ণিমা বলল, দাদাবাবু চা করব, চা খাবেন?
- কর।
পূর্ণিমা রান্না ঘরে চলে গেল। রান্না ঘর ছাড়া বাদলদের দু’টি পাকা ঘর। উপরে কংক্রিট ঢালাই ছাদ আছে। একটিতে মা থাকতেন। একটিতে বাদল থাকত। মা করোনায় মারা যাবার পর, মার ঘরটি বাদলের স্টাডি রুম হয়েছে।
বাদল স্টাডি রুমে এসে চেয়ারে বসল। তার মনটা হঠাত কেমন করে উঠল মার কথা ভেবে। মা আজ বেঁচে থাকলে কী খুশিই না হতেন। লিলির সঙ্গে তার বিচ্ছেদের ঘটনাটা জানত। তিনি বাদলের বিয়ে দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদলের আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে তা মে সময় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আজ মা বেঁচে থাকলে বোধহয় তার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হত না। ভাবতে ভাবতে বাদলের চোখ ভিজে উঠছিল। এমন সময় পূর্ণিমা চা নিয়ে এসে ঢুকল। বাদল পূর্ণিমাকে বলল, চা-টা টেবিলে রাখ, আমি বাথরুম থেকে আসছি। বলে সে চোখের জল লুকোতে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
চোখ-মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসতেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে, মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল, পিঙ্কি ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে বাদল মোলায়েম সুরে বলল, সুপ্রভাত। - সুপ্রভাত। কি করছো?
- চা খাচ্ছি। তুমি কখন আসবে?
- দশটার মধ্যে চলে আসব।
- তুমি কি করছো, সাজু-গুজু?
- হুম।
- তোমার স্কুলের সকলকে বলছো আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে আসতে?
- হুম।
- মোট কতজন আসবে?
- বলেছি তো সবাইকে।
- কতজন?
- চারজন।
- বেশ।
- মোট কতজনের খাবার ব্যবস্থা করেছো?
- পঁচিশজন।
- তোমার কতজন আসবে?
- পনেরো-ষোল জন।
- আচ্ছা।
- দশটায় দেখা হচ্ছে।
- ওকে, মাই ডারলিং।
এরমধ্যে ক্যাটারারের লোকজন নিয়ে বিপ্রদাস এসে হাজির। তাদের নিয়ে সে ছাদে চলে গেল।
পূর্ণিমাকে ডেকে বাদল ওদের জন্য চা করতে বলল।
পূর্ণিমা চা করে নিয়ে গিয়ে ছাদে ওদের দিতে গেল।
পূর্ণিমাকে চা নিয়ে ছাদে আসতে দেখে, বিপ্রদাস মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাল।
পূর্ণিমা তাকে দেখে একগাল হেসে বলল, কেমন আছেন বিপ্রদাসবাবু?
বিপ্রদাসের বলতে ইচ্ছে করছিল, ভাল নেই। তোমাকে দেখার পর থেকে মোটেও ভাল নেই।
সে কথা বলা যায় না। তাই বিপ্রদাস বিগলিত হয়ে হেসে বলল, ভালো। আপনি কেমন আছেন পূর্ণিমাদেবী?
শুনে পূর্ণিমা খিল খিল করে হেসে উঠল।
- হাসছেন কেন?
- হি হি হি হি। আমাকে দেবী বলতে শুনে।
- এতে হাসির কি আছে?
- আমি দেবী-টেবী নই। বিধবা নারী একজন।
বলে পূর্ণিমা নীচে নেমে গেল।
বিপ্রদাস আর কিছু বলতে পারল না। চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিল। কর্মচারীরা চা শেষ করে, কাপ নীচে নামিয়ে নেখে, একঘন্টার মধ্যে টেবিল চেয়ার পাতা ও রঙিন বড় ছাতা লাগানোর কাজ শেষ করে দিল। তারপর ক্যাটারারের কর্মচারীরা এই বলে চলে গেল, যে সন্ধ্যা ছ’টার মধ্য পরিবেশন করার দু’জন লোক সহ খাবার চলে আসবে গাড়ি করে এখানে। চিন্তা করার কোন কারণ নেই।
বাদল তাদের কথা শুনে স্বস্থি পেয়ে বলল, আচ্ছা।
পূর্ণিমা ছাদ থেকে খালি কাপগুলি আনতে গেল।
পূর্ণিমাকে শুনিয়ে বিপ্রদাস বাদলকে বলল, আমি এখন চলি তাহলে। সন্ধ্যায় আসব। - সময় মতো চলে আসিস কিন্তু, না হলে আমি সামলাতে পারব না।
বিপ্রদাস আর কিছু না বলে, রহস্যময়ভাবে হেসে চলে গেল।
পূর্ণিমা খালি কাপ হাতে নিয়ে ফিরে এসে দেখল বিপ্রদাস চলে গেছে।
তার একটু পরে, দু’টো ভারী ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল পিঙ্কি। তাকে দেখে পূর্ণিমা ছুটে গেল তার কাছে। পূর্ণিমাকে জড়িয়ে ধরল পিঙ্কি।
বাদল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভারী ব্যাগ দু’টো ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল। পিঙ্কি ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পূর্ণিমার হাত ধরে ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল।
ঘরটা দেখেই পিঙ্কির মনটা ভরে গেল। কী সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। মুগ্ধ হয়ে, ঘরের চারিদিক দেখতে লাগল। তারপর বলল, কে ঘর সাজিয়েছে?
বাদল বলল, কে আর পূর্ণিমা। সুন্দর হয়নি?
- খুব সুন্দর হয়েছে। পূর্ণিমা কই গেল?
- বোধহয় চা করতে।
কিছুক্ষণ পর পূর্ণিমা ট্রেতে কয়েকটা গরম চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। চা থেকে ধোঁয়া উঠছে।
পূর্ণিমা ট্রে থেকে একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে পিঙ্কির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন ম্যাডাম।
শুনে পিঙ্কি, দিদিমণি সুলভ ধমকে উঠল, মারব থাপ্পর।
শুনে পূর্ণিমা একটু থমকে গেল। থমকালো বাদলও।
পিঙ্কি হেসে বলল, আমাকে এখানে ম্যাডাম বলে ডাকবে না। ডাকবে, দিদি বলে। না হলে মারব থাপ্পর, মনে থাকে যেন।
- আচ্ছা ম্যাডাম।
- আবার ম্যাডাম? পিঙ্কি চোখ বড় বড় করল।
শুনে বাদল হেসে ফেলল। পূর্ণিমাও হাসল নিঃশব্দে।
সন্ধ্যার আগেই বিপ্রদাস খুব সেজেগুজে তার বাইকে চড়ে চলে এল। তার কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে ঢুকল ক্যাটারারের লোকজন।
যাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে তারা একে একে আসতে শুরু করেছে। পূর্ণিমা আর পিঙ্কি তাদের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন করে ছাদে নিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণিমা পরেছে নীল শাড়ি ব্লাউজ টিপ। আর পিঙ্কি পরেছে লাল শাড়ি ব্লাউজ টিপ। ওদের দু’জনকে দেখাচ্ছে যেন নীল পরি আর লাল পরি। বাদল পরেছে সবুজ পাঞ্জাবী আর সাদা ট্রাউজার। বিপ্রদাস আর বাদল ছাদের লোকজনদের নিয়ে গিয়ে খাবার জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে।
সবার খাওয়া শেষ হতে রাত ন’টা বাজল। মোট বাইশ জন এসেছে। তিনজনের খাবার উদ্বৃত্ত হয়েছে। ক্যাটারার সেই খাবারগুলি প্যাকেট করে রেখে তাদের বালতি গামলা সব পাত্র গুছিয়ে নিয়ে তাদের ভ্যানে তুলল। রঙিন বড় ছাতা চেয়ার টেবিল সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে ভ্যানে রাখল। তারপর বাকি পাওনা সাড়ে সাত হাজার টাকা বাদলের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে চলে গেল।
পিঙ্কি পাওয়া উপহারগুলি গুছিয়ে নিয়ে বাদলের স্টাডিরুমে রাখল।
বাদল তাদের জন্য এক প্যাকেট খাবার রেখে, বাকি দু’প্যাকেট খাবার বিপ্রদাস আর পূর্ণিমাকে নিয়ে যেতে বলল। কিন্তু পূর্ণিমা একা বড়ি ফিরবে কিভাবে বাদল চিন্তায় পড়ল। শুনে পিঙ্কি বলল, কেন? বিপ্রদাসবাবু তো বাইক নিয়ে এসেছেন, তিনি একটু পূর্ণিমাকে বাইকে করে পৌঁছে দিতে পারবেন না?
বাদল বলল, দেখি বিপ্রদাসকে বলে। বিপ্রদাসকে বলতেই বিপ্রদাস রাজি হয়ে গেল। পিঙ্কি দু’প্যাকেট খারার একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে বাদলের হাতে দিয়ে ওদের কে দিয়ে দিতে বলল। বিপ্রদাস প্লাস্টিকের প্যাকেটটা বাদলের হাত থেকে নিয়ে পূর্ণিমাকে ধরতে বলল।
আগে নিজে বাইকে উঠে বসে, তারপর সেই প্যাকেট তার হাতে নিয়ে পূর্ণিমাকে পিছনের সীটে উঠে বসতে বলল। পূর্ণিমা বাইকের বঁদিকের পা-দানীতে পা দিয়ে উঠে পিছনের সীটে বসল। পূর্ণিমা উঠে বসার পর বিপ্রদাস বাইকে স্টার্ট দিল। পূর্ণিমাকে বলল, আমাকে শক্ত করে ধরে থাকবেন, নাহলে বাইক থেকে ছিটকে নীচে পড়ে যাবেন।
- আচ্ছা। বলে,পূর্ণিমা জড়তাহীনভাবে বিপ্রদাসের কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে রইল।
বাইক চলতে শুরু করল। মাঝে মাঝে রাস্তার বাম্পে চাকা পড়তেই বাইক লাফিয়ে উঠতে লাগল, তা’তে পূর্নিমা বিপ্রদাসের পিঠের উপর ঝুঁকে পড়ছিল। বিপ্রদাসের পিঠে পূর্ণিমার সুডৌল স্তনের স্পর্শ পাচ্ছিল সে। তাতে পূর্ণিমার মনে কোন সংকোচ ছিল না। বিপ্রদাসের শরীর শিহরিত হয়ে উঠছিল। রোমাঞ্চিত হচ্ছিল মন।
এইভাবে কিছুক্ষণ বাইক চলার পর, পূর্ণিমা বিপ্রদাসকে এক জায়গায় এসে বাইক থামাতে বলল। - এখানেই নামব। কাছেই বাড়ি। আমি এই পথটুকু হেঁটেই যেতে পাবর।
বিপ্রদাস বুঝল, পূর্ণিমা একজন যুবকের সঙ্গে বাইকে চড়ে এসে বাড়ির সামনে নামছে দেখলে, পাড়ার লোক নানা কু-কথা বলতে পারে। তাই সে
পাড়ার মোড়ে এসে বাইক থামাতে বলেছে বিপ্রদাসকে।
বিপ্রদাস বাইক থামাল। পূর্ণিমা নেমে দাঁড়াল। তারপর বলল, পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। - ধন্যবাদের কিছু নেই। এ আমার কর্তব্য। আচ্ছা একটা কথা বলব আপনাকে, কিছু মনে করবেন না তো?
- মনে করব কেন? বলুন।
- আপনি আবার বিয়ে করছেন না কেন?
পূর্ণিমা হি হি করে হেসে বলল, - কে আমাকে বিয়ে করবে? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে, যে আমার মতো একজন বিধবাকে বিয়ে করবে কেউ?
- আপনি রাজি থাকলে, আমি বিয়ে করব।
- এ আপনার কোন দুর্বল মুহূর্তের মোহ। মোহ কেটে গেলেই বুঝবেন, আপনি কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিলেন।
- আপনার ফোন নম্বরটা দিতে কোন আপত্তি নেই তো?
- কোনও আপত্তি নেই। আপনার এই অলীক মোহ কেটে গেলেই দেবো। তারপর নিঃশব্দে হেসে বিপ্রদাসকে বলল, আজ তবে আসি। বলে আর সে মুহূর্তের জন্য আর দাঁড়াল না। হাঁটতে শুরু করলো।
যতক্ষণ তাকে দেখা যায়, বিপ্রদাস ততক্ষণ সেখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। পূর্ণিমার হেঁটে যাওয়া সে পলকহীন চোখে দেখলো। তারপর পূর্ণিমা দৃষ্টির অগোচর হয়ে গেলে, সে তার বাইকে স্টার্ট দিল।
বাদল আশুতোষ কলেজে পড়ত।সেখানেই বিপ্রদাসের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। কলেজের পাঠ শেষ হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব থেকে যায় শুধু নয় আরও গাঢ় হয়। খুব ছোট থাকতেই বিপ্রদাসের বাবা মা মারা গেছেন। পিসিমা নিঃসন্তান হওয়ায়, তিনি বিপ্রদাসকে তার কাছে এনে বড় করেন। স্কুলে কলেজে পড়ান। পিসিমা বেঁচে থাকলেও পিসেমশাই করোনার প্রকোপে পড়ে দু’বছর আগে মারা গেছেন। তারপর থেকেই পিসিমা তাকে বিয়ে করার জন্য পীড়াপিড়ি শুরু করেছেন। এতদিন বিপ্রদাস তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। আর এড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না।
এবার পিসিমাকে পূ্র্ণিমার কথা বলবে, ভাবল সে। সব কথাই খুলে বলবে তাকে পূর্ণিমা সম্পর্কে। কোনও কথা গোপন করবে না।
বাদলদের দাম্পত্য জীবনের দশ দিন পার হযেছে। দৈনন্দিন সব কাজের মধ্যেও দু’জনেরই যেন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কাটছে। পূর্ণিমা আগের মতোই সকাল আটটার মধ্যে এসে যায়। তিন কাপ চা করে, দু’কাপ বাদলদের ঘরে দিয়ে আসে। তারপর রান্নাঘরে বসে নিজের চা শেষ করে, আগের মতোই ঘরের কাজে হাত দেয়।
চা শেষ করে পিঙ্কি, বাসী ড্রেসিং গাউন খুলে রেখে, নতুন জামা কাপড় পরে রান্নাঘরে এসে পূর্ণিমার সঙ্গে কাজে হাত লাগায়।
পূর্ণিমা কত বারণ করে তাকে, পিঙ্কি তা শোনে না। বিয়ের পর পিঙ্কির সঙ্গে পূর্ণিমার সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়েছে। দু’জনের আগের সম্পর্কের ভিতরের দূরত্বটা যেন একেবারে ঘুচে গেছে । দু’জনে পরস্পর পরস্পরের সখী হয়ে উঠেছে। এই কয়দিনে পূর্ণিমার সঙ্গে রান্নাঘরে থেকে সে অনেক নতুন রান্না শিখে ফেলেছে। বাড়িতে থাকতে মা তাকে রান্নার কাজ করতে দিত না। কারণ, তা’তে পিঙ্কি পড়াশুনার ক্ষতি হবে। তারপর হোস্টেলে এসে হোষ্টেলের খাবার খেয়েই তার কেটেছে। কখনও হোষ্টেলের খাবার ছাড়া অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে হলে জোমাটো, সুইগি থেকে খাবার আনিয়ে খেত।
কাল হোস্টেল থেকে সুপারের ফোন এসেছিল। অবাক হয়ে ফোন ধরে পিঙ্কি বলল, বলুন ম্যাডাম।
- কংগ্রাচুলেশন। কেমন আছো তোমরা?
- ভালো আছি ম্যাডাম। আপনি আশীর্বাদ করবেন।
- সর্বান্তকরণে তোমাদের আশীর্বাদ করি। যার জন্য ফোন করা, তোমার নামে একটা পত্রিকা এসেছে। একদিন এসে নিয়ে যেয়ো।
- আচ্ছা ম্যাডাম।
- রাখছি তবে।
- হ্যাঁ, ম্যাডাম।
পূর্ণিমা বলেছিল, মুহূর্তের মোহ অচিরেই কেটে যাবে বিপ্রদাসের। কিন্তু তার কথা সত্যি হয়নি। দিন দিন যেন পূর্ণিমার দুর্নিবার আকর্ষণ বিপ্রদাসকে আকুল করে তুলেছে। পিসিমার কাছে বলব বলব করেও এখনও তার বলা হয়ে ওঠেনি পূর্ণিমার কথা। আজ সে কথা পিসিমাকে বলবে বলে, ঠিক করল বিপ্রদাস। তারপরেই ভাবল, আগে পূর্ণিমাকে রাজি করানো দরকার। পূর্ণিমা রাজি হলে, তারপর পিসিমাকে বলা যাবে। তার আগে বললে, পিসিমা রাজি হলেও, পরে যদি পূর্ণিমা তাকে বিয়ে করতে রাজি না হয়, সেটা বড় খেলো ব্যাপার হয়ে যাবে। তাই আগে বিয়ের ব্যাপারে পূর্ণুমার সম্মতি প্রয়োজন। সে রাজি হলেে পরে, পিসিমাকে বলে রাজি করাতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকবে না।
সে ভাবল, এই ব্যাপারে বাদল তাকে সাহায্য করতে পারবে। সন্ধ্যার সময় সে বাদলকে ফোর করল।
পিঙ্কি তখন বাদলকে নিয়ে তার পুরনো হোস্টেলে যাচ্ছে। তার নামে একটা পত্রিকা এসেছে, সেটা সংগ্রহ করতে, আর বাদলের সঙ্গে সুপার ম্যাডামের পরিচয় করিয়ে দিতে।
বাদল তখন তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল, বিপ্রদাস ফোন করেছে। সে ফোনটা রিসি়ভ করে বলল,
- বল।
- তুই কি বাড়ি আছিস?
- কেন?
- আছিস কিনা বল।
- না।
- কোথায় আছিস?
- পিঙ্কির সঙ্গে একটু বেরিয়েছি।
- তোদের ফিরতে কি দেরী হবে?
- তা হতে পারে। কেন?
- তোর সাথে একটা জরুরী কথা ছিল।
- ঠিক আছে, তবে কাল সকালে আমাদের বাড়িতে চলে আয়।
- আচ্ছা।
- কখন আসবি?
- সকাল মধ্যে চলে যাব।
- ঠিক আছে।
পিঙ্কি হোস্টেলে ঢুকে বাদলকে গেষ্টদের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে, সুপারের ঘরে গেল।
শাখা সিঁদুর পরা পিঙ্কিকে দেখে খুব খুশি হলেন সুপার। একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বলে, পাশের ঘর থেকে পিঙ্কির নামে আসা পত্রিকাটা নিয়ে এসে পিঙ্কির হাতে দিয়ে বলল, এটা তোম্র নামে এসেছে। পিঙ্কি কাগজের মোড়ক খুলে পত্রিকাটা বের করে দেখল ‘দৈনিক বার্তা’ পত্রিকা।
সুপার বললেন, চা খাবে?
- না ম্যাডাম, আমার বর নীচে গেষ্টরুমে একা একা বসে আছেন
- আগে সে কথা বলবে তো। চলো, নীচে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসি। সুপার নিজের ঘর ছেড়ে নীচে নেমে এলেন। গেষ্ট রুমে ঢুকে বাদলকে দেখে বললেন, কংগ্রাচুলেশন।
বাদল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হাতজোড় করে তাকে নমস্কার জানল।
পিঙ্কি সুপারের সঙ্গে বাদলের পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা হল। তারপর ওরা বেরিয়ে এলো। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ওরা হেঁটে গল্প করতে করতে পঞ্চানন তলা থেকে গোলপার্ক পেরিযে গড়িযাহাটে চলে এলো। সেখানে এসে ওরা ‘দাস কেবিনে’ ঢুকল মোগলাই পরোটা খাবে বলে। এখানে মোগলাই পরোটা বেশ ভাল বানায়। মোগলাই পরোটা খেয়ে ওরা যখন ‘দাশ কেবিন’ থেকে বেরোল, তখন ন’টার মতোন বাজে। ওরা সেখান থেকে একটা অটো ধরে বাড়ি ফিরল।
বাড়ি ফিরে পিঙ্কি বাইরের পোষাক ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে নিয়ে রাত পোষাক পরে নিল। তারপর বিছানায় বসে ‘দৈনিক বার্তা’ পত্রিকাটা খুলে বসল। সূচিপত্রে তার নাম দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। দেখল তার লেখা ‘একাকীত্ব’ কবিতাটা ছাপা হয়েছে। সম্পূর্ণ লেখা লেখাটা পড়ে দেখল, ছাপার কোন ভুল নেই। নিজে কবিতাটা লিখছে যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বাদল তাকে ‘দৈনিক বার্তা’ পড়তে দেখে বলল, কি পড়ছো?
পিঙ্কি তার লেখা কবিতাটা যে পাতায় বেরিয়েছে, সেই পাতাটা খুলে বাদলের দিকে এগিয়ে দিল।
বাদল কবিতাটা পড়ে, বিস্ময়ে অবাক হয়ে বলল, এই কবিতাটা তুমি লিখেছো?
পিঙ্কি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
বাদল বলল, দারুণ হয়েছে। তুমি কবিতা লেখ, আমি ভাবতে পারিনি।
শুনে পিঙ্কি মিঠিমিঠি হাসছিল। - তুমি আমার রত্নহার। বলে বাদল আবেগ মথিত হয়ে পিঙ্কিকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ আদর করল। পিঙ্কি তাতে কোন আপত্তি করল না। সুখের আবেশে তার চোখ বুঁজে আসছিল। সে মনে মনে ভাবছিল, এত সুখও তার জন্য তোলা ছিল? চোখ বুজে সে বাদলের আদর উপভোগ করে গভীর আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ছিল।
পরদিন পূর্ণিমা সকাল আটটায় বাদলদের বাড়ি কাজে এল। যথারীতি প্রতিদিনের মতো সে তার কাজ করল। পিঙ্কির সাথে কত গল্প করল। তারপর সে তার কাজ শেষ করে বাদলকে, ‘দাদাবাবু আসি বলে’ বেরিয়ে পড়ল।
আটটা ন’টার মধ্যে বিপ্রদাস আসবে বলে, দশটা বেজে গেল, তবুও বিপ্রদাস আসছে নাা দেখে বাদল ভাবল, বিপ্রদাস তো এমন করে না। কথা দিয়ে কথা রাখে। তবে আজ কি হল তার? একটা ফোন করে দেখা যাক বিপ্রদাসকে।
এই কথা ভেবে বাদল ফোন করল বিপ্রদাসকে।ফোনটা বেজে যাচ্ছে, বিপ্রদাস ধরছে না কেন?
ওপাস থেকে যান্ত্রিক কথা ভেসে এল, আপনি যাকে ফোন করছেন, তিনি এখন ব্যস্ত আছেন। আপনার ফোন ধরতে পারছেন না। আপনি কিছুক্ষণ পরে ফোন করে দেখুন।
বাদল আবার দশ মিনিট পরে ফোন করল। বিপ্রদাস এবার ফোনটা ধরল।
বাদল বলল, কিরে তুই আসবি বললি, এখনও এলি না যে? তুই এখন কোথায় আছিস?
- বাঙুর হসপিটালে।
- কেন? কি হয়েছে?
- ভোর বেলা পিসিমার সেলিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিযেছে, তাকে এনে এখানে ভর্তি করেছি।
- এখন কেমন আছেন?
- ভাল না।
- বিকেলে কখন ভিজিটারদের ঢুকতে দেয়?
- পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত।
- ঠিক আছে, আমরা বিকেলে যাব দেখা করতে।
- আচ্ছা, আয়।
পাঁচটার সময় বাদল আর পিঙ্কি গিয়ে বাঙুর হসপিটালে হাজির হল। বিপ্রদাসকে ফোর করল। বিপ্রদাস নীচে নেমে এসে বাদলকে নিয়ে কার্ড দেখিয়ে ভিতরে ঢুকল। পিঙ্কি নীচে অপেক্ষা করতে লাগল। বাদল দেখে নেমে আসার পর, বিপ্রদাস গেটে কার্ড দেখিয়ে পিঙ্কিকে নিয়ে ভিতরে গেল। পিঙ্কি দেখল, বিপ্রদাসের পিসিমার শরীরে নানা রকম নল ঢুকানো রয়েছে। সেলাইন অক্সিজেন চলছে। তিনি চোখ বুঁজে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। দৃশ্যটা দেখতে পিঙ্কির ভাল লাগছিল না। তার মনে পড়ছিল তার মায়ের কথা। তার মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন হসপিটালে। মাকেও সেখানে এমন করে রাখা হয়েছিল। দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। সে বাইরে বেরিয়ে এল,সেখান থেকে। দেখল, বিপ্রদাস ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাদল। পিঙ্কিও সেখানে গিয়ে দাঁড়াল।
বাদল, জানতে চাইল, ডাক্তারবাবু পেশেন্টের অবস্থা কেমন?
- এখনও ক্রিটিকাল পজিশনে আছেন। বাহাত্তর ঘন্টা পার না হলে কিছু বলা যাবে না। তবুও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি তাকে বাঁচিয়ে তুলবার জন্য। তারপর ঈশ্বরের হাত।
পিঙ্কি তার কথাটা শুনে, ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে ভাবল, এনারাও ভগবানে বিশ্বাস করেন। তাহলে, অশিক্ষিত মূর্খ অজ্ঞ সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে আর কি লাভ?
ডাক্তার বিপ্রদাসকে বলল, আপনি প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধগুলি তাড়াতাড়ি কিনে এনে দিন। সেলাইনের সঙ্গে ইনজেক্ট করে চালাতে হবে। - আচ্ছা। বলে বিপ্রদাস ডাক্তারবাবুকে হাতজোড় করে নমস্কার করল।
ডাক্তারবাবুও প্রতি নমস্কার করে, পাশেই তার অফিসঘরে ঢুকে পড়লেন। বিপ্রদাস বাদলের সঙ্গে কড়িডোর ধরে হাঁটতে লাগল। পিঙ্কি ওদের পিছনে হাঁটছে। বিপ্রদাস হাঁটতে হাঁটতে বাদলকে সংকেচের সঙ্গে বলল, তোর কাছে কিছু টাকা হবে? - কত চাই?
- যা আছে দে।
বাদল তার মানিব্যাগ খুলে দেখল, তিন হাজার দু’শো টাকা আছে। সে তিন হাজার টাকা ব্যাগ থেকে বের করল বাদলকে দেবার জন্য। পিঙ্কি পিছন থেকে সামনে এসে বলল, আমার কাছে দু’হাজার টাকা আছে। বলে সে তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করে বাদলের হাতে দিল। বাদল সেটা নিয়ে বিপ্রদাসকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলল, এটা রাখ।
বিপ্রদাস টাকাটা নিয়ে তার হাত ব্যাগে রেখে বলল, আমি ওষুধগুলি কিনে এখানে দিয়ে বাড়ি ফিরব। তোরা আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে করবি কী? তোরাও বাড়ি চলে যা।
বাদল বলল, আচ্ছা। কোনও দরকার হলে ফোর করিস। - নিশ্চয়। বলে আর বাদল দাঁড়াল না। ওষুধগুলি কিনে তাড়াতাড়ি হসপিটালে পৌঁছে দিতে বলেছেন, ডাত্তারবাবু।
বাদলরাও মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
পরদিন পূর্ণিমা ট্রে-তে করে দাদাবাবু আর পিঙ্কি দিদির জন্য চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে শুনল, বাদল ফোনে বলছে, পিসিমা কেমন আছে বিপ্রদাস?
- একই রকম কন্ডিশন, ভাল নেই।
- তুই চিন্তা করিস না এত, ঠিক ভাল হয়ে যাবে? দরকার হলে আমাকে ফোন করিস।
- আচ্ছা।
বাদল ফোনটা কেটে দিয়ে পিঙ্কিকে বলল, বিপ্রদাসের পিমিমার অবস্থা আগের মতোই। ভাল নেই মোটেও।
পিঙ্কি শুনে বলল, কি হবে তবে বিপ্রদাসবাবুর, যদি তার পিসিমা মারা যান? - একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে হবে ওর, বিপ্রদাসকে বাঁচাবার জন্য। পিসিমা তো অনেকদিন আগে থেকেই ওকে বিয়ে করার কথা বলছিল। মেয়ে পছন্দ হচ্ছিল না বলে, ও নাকি বিয়ে করেনি। এবার তা করতে হবে। না হলে বিপ্রদাস বাঁচবে কি নিয়ে?
- তাই তো। পিঙ্কি বলল।
সব শুনে পিঙ্কি দিদিকে পূর্ণিমা প্রশ্ন করল , বিপ্রদাসবাবুর পিসিমার কি হয়েছে? - সেলিব্রাল অ্যাটাক।
পিঙ্কি দিদির কথাটা শুনেই পূর্ণিমার বুকের ভিতরটা কেমন ধকধক করে অব্যক্ত ব্যাথায় মুচড়ে উঠল। মনটা আঁতকে উঠল আতঙ্কে।
বিপ্রদাসবাবু সেদিন কথায় কথায় পূর্ণিমাকে অবশ্য বলেছিল, সংসারে তার পিসিমা ছাড়া আর কেউ নেই। পিসিমা তাকে খুব ভালবাসেন। কি হবে পিসিমা না থাকলে বিপ্রদাসবাবুর? পূর্ণিমার মনের ভিতরটা বিপ্রদাসবাবুর জন্য অপার্থিব এক মায়ায় ভরে উঠল।
পূর্ণিমা আবার পিঙ্কি দিদিকে জিজ্ঞাসা করল, কোন হসপিটালে ভর্তি আছেন? - বাঙুর হসপিটালে। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে? আমরা তাকে দেখতে যাব আজ।
- ক’টার সময়?
- বিকেল পাঁচটার মধ্যে ওখানে পৌঁছাব। তুমি গেলে সাড়ে চারটার মধ্যে আমাদের বাড়ি চলে এসো।
- আচ্ছা, আমি আসব।
সাড়ে চারটার আগেই পূর্ণিমা পৌঁছে গেল দাদাবাবুর বাড়ি। সেখান থেকে ওরা একটা ট্যাক্সি করে পাঁচটার মধ্যেই বাঙুর হসপিটালে পৌঁছে গেল। পৌঁছে বাদল বিপ্রদাসকে ফোন করল, তুই কোথায়?
- হসপিটালে।
- আমরা হসপিটালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে।
- আচ্ছা। আমি আসছি।
স্বল্পক্ষণ পরেই বিপ্রদাস হসপিটালের গেটের সামনে এসে, পূর্ণিমাকে অবাক হয়ে গেল। পূর্ণিমা পিসিমাকে দেখতে আসবে বিপ্রদাস কল্পনাও করতে পারেনি। কল্পনাতীত। তাই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগল। তাই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বিপ্রদাস তার বুক পকেট থেকে হসপিটালের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে বাদলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোরা দু’জনে আগে গিয়ে দেখে আয়। তোরা ফিরে এলে আমরা দু’জন যাব। বাদল কার্ডটা বিপ্রদাসের হাত থেকে নিয়ে, পিঙ্কিকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে গেল।
ভিজিটিং কার্ডে লেখা এডমিট টু। মানে দু’জনের ভিতরে ঢোকার অনুমতি আছে। গেটের প্রহরী তার বেশি লোক ভিতরে ঢুকতে দেয় না। দু”জনের বেশি লোক ঢুকতে গেলে বাধা দেয়। তাই দু’জন করে ঢুকতে হয় হসপিটালের ভিতরে। বাদলরা চলে যেতেই বিপ্রদাস বলল, আপনি এসেছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনি যে আসবেন আমি ভাবতে পারিনি। - পিসিমার কবে সেলিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে?
- কাল।
- কেমন আছেন এখন?
- ভাল না।
- আপনি ভাববেন না, ঠাকুরের কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে।
- তাই যেন হয়। তারপর হঠাৎ বিপ্রদাস বলল, পিসিমা মরে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বলুন?
- বিয়ে করে নিজের সংসার গড়বেন।
কথাটা শুনেই বিপ্রদাস পূর্ণিমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে কাতর ভাবে অনুনয়ের সুরে বলল, আপনি আমার পাশে থাকলে, বাঁচার মানে খুঁজে পাব আমি।
পূর্ণিমা তখন বিপ্রদাসের থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল না। পিঙ্কিদের আসতে বিপ্রদাসের মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা মৃদু স্বরে বলল,ওই যে পিঙ্কিদিদিরা ফিরে আসছেন। পূর্ণিমার কথা শুনে বিপ্রদাস পূর্ণিমার হাতটা ছেড়ে দিল।
পিঙ্কি আর বাদল ফিরে এসে ভিজিটিং কার্ডটা বিপ্রদাসের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, যা এবার তোরা দেখে আয় গিয়ে।
বিপ্রদাস কার্ড হাতে পূর্ণিমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। পূর্ণিমা ভিতরে ঢুকে দেখল, বিপ্রদাসবাবুর পিসিমা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন বেডে। সংঙ্গা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শরীরে নল দিয়ে ওষুধ আর সেলাইন যাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে পূর্ণিমার মাথাটা কেমন করে উঠল। সে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। একটু পরে বিপ্রদাসবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, আপনি একটু বসুন, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আসছি। পূর্ণিমা তাকে মুখে কিছু না বলে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
তারপর পূর্ণিমা হসপিটালের গ্রীলের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। দেখল গেটের সামনে কত লোক। কারও চোখে মুখে করুণ আর্তি। কারও চোখ দু’টি ব্যথাতুর। সকলেই তাদের প্রিয়জনদের সুস্থ করে ফিরিয়ে নেবার জন্য এখানে এসেছেন তাদের প্রিয়জনদের নিয়ে। কেউ কেউ সফল হয়ে আনন্দে ঘরে ফিরে যাবেন। আর যারা অসফল হবেন, তারা শোক বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ফিরতে বিপ্রদাসবাবুর দশ মিনিটের বেশি সময় লাগল। বিপ্রদাসবাবু ফিরে বললেন, চলুন। পূর্ণিমা তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল।
হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে এলে, বাদল বিপ্রদাসবাবুকে বললেন, ডাক কি বলল?
- ডাক্তার তো ভরসা দিচ্ছেন। চিন্তা করতে বারণ করছেন। কিন্তু আমার তা’তে মানছে না।
- তবে তুই কি করতে চাস?
- তাই ভাবছি।
- কি, অন্য হসপিটালে দেওয়ার কথা?
- হ্যাঁ।
- কোথায়?
- আম্রি বা অ্যাপোলেতে।
- সেখানে তো অনেক খরছ।
- তাই তো ভাবছি।
- পিসিমার কোন মেডি-ক্লেম আছে?
- না।
- তবে খরচ চালাবি কি করে?
- আমাদের নাটকের গ্রুপের দেড় লাখ টাকা আমার কাছে আছে। ভাবছি সেটাই এখন খরচ করব।
- নাটকের গ্রুপ যখন টাকা ফেরত চাইবে, তখন কি বলবি?
- যা সত্যি তাই বলব।
- সেখানে গিয়েও যে পিসিমা বাঁচবেন, তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া সরকারি হসপিটালে ভাল চিকিৎসা হয় না, এ ধারণা সব সময় ঠিক নয়।
- তাহলে, তুই কি বলিস?
- আমি বলি, যা করবি সব দিক ভাল করে ভেবে করবি। আবেগের বসে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিবি না, যাতে তোকে পরে পস্তাতে হয়।
পিঙ্কি বলল, আচ্ছা আজ তবে আসি আমরা বিপ্রদাসবাবু।
- আচ্ছা।
ওরা একটা ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরল। তারপর পূর্ণিমা দাদাবাবুর বাড়ি থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরল।
ভিজিটিং কার্ডে লেখা এডমিট টু। মানে দু’জনের ভিতরে ঢোকার অনুমতি আছে। গেটের প্রহরী তার বেশি লোক ভিতরে ঢুকতে দেয় না। দু”জনের বেশি লোক ঢুকতে গেলে বাধা দেয়। তাই দু’জন করে ঢুকতে হয় হসপিটালের ভিতরে। বাদলরা চলে যেতেই বিপ্রদাস বলল, আপনি এসেছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনি যে আসবেন আমি ভাবতে পারিনি। - পিসিমার কবে সেলিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে?
- কাল।
- কেমন আছেন এখন?
- ভাল না।
- আপনি ভাববেন না, ঠাকুরের কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে।
- তাই যেন হয়। তারপর হঠাৎ বিপ্রদাস বলল, পিসিমা মরে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বলুন?
- বিয়ে করে নিজের সংসার গড়বেন।
কথাটা শুনেই বিপ্রদাস পূর্ণিমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে কাতর ভাবে অনুনয়ের সুরে বলল, আপনি আমার পাশে থাকলে, বাঁচার মানে খুঁজে পাব আমি।
পূর্ণিমা তখন বিপ্রদাসের থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল না। পিঙ্কিদের আসতে বিপ্রদাসের মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা মৃদু স্বরে বলল,ওই যে পিঙ্কিদিদিরা ফিরে আসছেন। পূর্ণিমার কথা শুনে বিপ্রদাস পূর্ণিমার হাতটা ছেড়ে দিল।
পিঙ্কি আর বাদল ফিরে এসে ভিজিটিং কার্ডটা বিপ্রদাসের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, যা এবার তোরা দেখে আয় গিয়ে।
বিপ্রদাস কার্ড হাতে পূর্ণিমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। পূর্ণিমা ভিতরে ঢুকে দেখল, বিপ্রদাসবাবুর পিসিমা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন বেডে। সংঙ্গা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শরীরে নল দিয়ে ওষুধ আর সেলাইন যাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে পূর্ণিমার মাথাটা কেমন করে উঠল। সে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। একটু পরে বিপ্রদাসবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, আপনি একটু বসুন, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আসছি। পূর্ণিমা তাকে মুখে কিছু না বলে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
তারপর পূর্ণিমা হসপিটালের গ্রীলের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। দেখল গেটের সামনে কত লোক। কারও চোখে মুখে করুণ আর্তি। কারও চোখ দু’টি ব্যথাতুর। সকলেই তাদের প্রিয়জনদের সুস্থ করে ফিরিয়ে নেবার জন্য এখানে এসেছেন তাদের প্রিয়জনদের নিয়ে। কেউ কেউ সফল হয়ে আনন্দে ঘরে ফিরে যাবেন। আর যারা অসফল হবেন, তারা শোক বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ফিরতে বিপ্রদাসবাবুর দশ মিনিটের বেশি সময় লাগল। বিপ্রদাসবাবু ফিরে বললেন, চলুন। পূর্ণিমা তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল।
হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে এলে, বাদল বিপ্রদাসবাবুকে বললেন, ডাক্তার কি বলল?
- ডাক্তার তো ভরসা দিচ্ছেন। চিন্তা করতে বারণ করছেন। কিন্তু আমার তা’তে মানছে না।
- তবে তুই কি করতে চাস?
- তাই ভাবছি।
- কি, অন্য হসপিটালে দেওয়ার কথা?
- হ্যাঁ।
- কোথায়?
- আম্রি বা অ্যাপোলেতে।
- সেখানে তো অনেক খরছ।
- তাই তো ভাবছি।
- পিসিমার কোন মেডি-ক্লেম আছে?
- না।
- তবে খরচ চালাবি কি করে?
- আমাদের নাটকের গ্রুপের দেড় লাখ টাকা আমার কাছে আছে। ভাবছি সেটাই এখন খরচ করব।
- নাটকের গ্রুপ যখন টাকা ফেরত চাইবে, তখন কি বলবি?
- যা সত্যি তাই বলব।
- সেখানে গিয়েও যে পিসিমা বাঁচবেন, তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া সরকারি হসপিটালে ভাল চিকিৎসা হয় না, এ ধারণা সব সময় ঠিক নয়।
- তাহলে, তুই কি বলিস?
- আমি বলি, যা করবি সব দিক ভাল করে ভেবে করবি। আবেগের বসে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিবি না, যাতে তোকে পরে পস্তাতে হয়।
পিঙ্কি বলল, আচ্ছা আজ তবে আসি আমরা বিপ্রদাসবাবু।
- আচ্ছা।
ওরা একটা ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরল। তারপর পূর্ণিমা দাদাবাবুর বাড়ি থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরল।
পূর্ণিমা কখন বাড়ি ফিরবে তার জন্য মা অপেক্ষা করে বারান্দায় বসে ছিলেন। পূর্ণিমা গেট খুলে ভিতরে ঢুকতেই, তিনি তাকে দেখে বললেন, কিরে মহিলা কেমন আছেন?
- ভাল না তেমন।
- ডাক্তার কি বললেন?
- কি আর বলবেন? বললেন আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, ভগবানের উপর ভরসা রাখুন।
মা আর কিছু বললেন না। ঘরে ঢুকে গেলেন। পূর্ণিমা পোষাক ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। নতুন পোষাক পরে কিছুক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে।
মা তাকে দেখে বললেন, খাবি কখন? - যখন বলবে।
- তবে চল, খাবার বাড়ি।
পূর্ণিমা তার সঙ্গে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। একচিলতে রান্নাঘর, তাদের ঘরটাকেই ভাগাভাগি করে রান্নাঘর করা হয়েছে। মা সেখানেই রান্না করেন। মেঝেতে চাটাই পেতে খেতে হয়। খাওয়ার পর আবার সে’গুলি গুছিয়ে তুলে রাখতে হয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর খাটে মায়ের পাশে শুয়ে পূর্ণিমা একমনে বিপ্রদাসের কথা ভাবছিল। তার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, টের পায়নি। সে দেখল বিপ্রদাস পিসিমাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছেন। পিসিমা এসে মায়ের সাথে বসে গল্প করছে। দেখে মনে হ্চ্ছে যেন কতকালের চেনা জানা পরস্পরের মধ্যে। মা হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন পিসিমার কথা শুনে। এদিকে বিপ্রদাস এসে ঢুকেছে তার ঘরে। পূর্ণিমা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। ঘরে ঢুকে বিপ্রদাস দেখল পূর্ণিমা জড়োসড়ো হয়ে একটা পুটলির মতো হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তা দেখে বিপ্রদাসের হাসি পেল। সে শব্দ করে হাসল। তা শুনে পূর্ণিমার খুব রাগ হল। সে ছদ্মঘুম ত্যাগ করে, চোখ খুলে তাকে বলল, আপনি হাসলেন কেন আমাকে দেখে।
- আপনি তাহলে ঘুমোননি? আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে ছিলেন?
- হ্যাঁ ছিলাম। তা’তে হাসির কি হল?
- আপনাকে দেখতে একটা কাপড়ের পুটলির মতো লাগছিল, তাই দেখে হাসি পেয়ে গেল।
- আমার ঘরে এসেছেন কি মনে করে?
- তোমাকে দেখতে।
- বেশ দেখুন। দেখে চলে যান। আমি এখন ঘুমাব।
- তবে আমিও ঘুমাব আপনার এখানে।
- কোথায়?
- আপনার সঙ্গে।
- সে গুড়ে বালি।
- আমি বালি-গুড়ই পছন্দ করি। বলে, বিপ্রদাস হাসল।
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গিয়ে, পূর্ণিমার স্বপ্নটা হঠাৎ ভেঙে গেল। সে বিছানায় উঠে বসে ভাবল, তার অবচেতন মনে তাহলে বিপ্রদাসের সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার বীজটা অঙ্কুরিত হয়ে, অনেকখানি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে। সে উঠে বাথরুমে চলে গেল। ফিরে এসে দেয়াল ঘড়িতে দেখল, ভোর চারটা কুড়ি বাজে। আবার সে মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার চোখে ঘুম এল না। স্বপ্নের কথাটাই সে মনে মনে ভাবছিল। এমন সময় মা পাশ ফিরে তার দিকে মুখ করে শুলো।
পূর্ণিমা অন্ধকারে মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল ঠিক নেই।মায়ের মুখটা দেখতে দেখতেই সে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়ল, টের পেল না। তার ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। মা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।
দশদিন যমে আর ডাক্তারে লড়াই চলার পর, শেষপর্যন্ত হার স্বীকার করে যম ফিরে যেতে বাধ্য হল। ডাক্তারদের জয় হল। বিপ্রদাসের মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বিপ্রদাসের বুকে প্রাণ ফিরে এলো। সে ডাক্তারদের কৃতজ্ঞতা জানাল। কৃতজ্ঞতা জানাল বাদলকেও। তার পরামর্শ শুনে, তারই পরোক্ষ আশ্বাসে সরকারি হসপিটালে আস্থা রেখতে পেরেছিল সে। না হলে হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি হঠাৎ আম্রি বা অ্যাপোলোতে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করত, তাহলে তার কাছে জমা রাখা গ্রুপের টাকা তাকে খরচ করতে হত। আর তা করলে, সে গ্রুপের টাকা তছরূপের দায়ে বেইজ্জতি হয়ে দলের কাছে মুখ দেখাতে পারত না। হয়তো তাকে দল ছাড়তে হত বদনামীর ভাগীদার হয়ে। সে বড় লজ্জার ব্যাপার হত। সে অঘটন ঘটেনি বাদলের পরামর্শ শুনেই।
বিপ্রদাসের কাছে পিসিমা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার কথা শুনে, বাদল আর পিঙ্কি পরদিন সন্ধ্যার সময়, ভবানীপুরের বকুলতলা রোডে বিপ্রদাসের বাড়িতে গেল। কোনও খবর না দিয়ে যাওয়ায়, তাদের দেখে বিপ্রদাস একটু অবাক হল। সেই ভাবন থেকে সরিয়ে,পিসিমার ঘরে সে তাদের নিয়ে গেল। পিসিমা বিছানায় শুয়ে ছিলেন।
বিপ্রদাস বলল, দেখো পিসি কা’রা তোমায় দেখতে এসেছে?
পিসিমা বিছানায় উঠে বসতে গেলেন।
পিঙ্কি বলল, আপনাকে উঠে বসতে হবে না। শুয়ে থাকুন। শুয়েই কথা বলুন। তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। খুব দুর্বল দেখাচ্ছিল তাকে।
পিঙ্কি বলল, কেমন আছেন?
- ভাল আছি মা।
বাদল বলল, ভাল তো আপনাকে থাকতেই হবে।বিপ্রদাসের বিয়ে না দিয়ে গেলে, আপনি মরেও শান্তি পাবেন না। - একদম ঠিক বলেছো বাবা। এ’যাত্রায় বোধহয় সে’কারণেই যমের হাত থেকে ফিরে এসেছি। তোমরা বিপুর (বিপ্রদাস) জন্য একটা ঘরোয়া মেয়ে দেখো না। ওদের বিয়েটা দিয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই।
বাদল বিপ্রদাসকে বলল, কিরে শুনছিস পিসিমার কথা? এবার একটা মেয়ে পছন্দ করে বিয়েটা করে ফেল। - হ্যাঁ, করব।
পিঙ্কি বলল, মেয়ে ঠিক করা আছে? - আছে।
বাদল বলল, কে সে?
বিপ্রদাস বলল, পূর্ণিমা।
বাদল বিস্মিত হয়ে বলল, কোন পূর্ণিমা? আমাদের পূর্ণিমা?
বিপ্রদাস বলল, হ্যাঁ।
বাদল বিচলিত হয়ে বলল, বলিস কি? ও তো উইডো।
এবার পিঙ্কি প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল, উইডো তো কি হয়েছে? বর মরেছে বলে, তার সঙ্গে মেয়েটার সব স্বাদ আহ্লাদ মরে গেছে বুঝি? তার কোনও মনের আবেগ ইচ্ছে থাকতে নেই? থাকতে পারে না বরের মৃত্যুর পর? সে কি তাহলে রোবট হয়ে বেঁচে থাকবে বাকিটা জীবন। আপনি কি বলেন পিমিমা? পিঙ্কি যেন পিসিমাকেই বিচারকের ভূমিকায় দাঁড় করাল।
পিসিমা পিঙ্কিের কথা শুনে বলেন, তাই তো বটেই। তুমি ঠিকই বলেছো মা।
বিপ্রদাস এবার পিসিমাকে জিজ্ঞাসা করল, তা’হলে পূর্ণিমাকে বিয়ে করলে তুমি কোনও আপত্তি করবে না? - আমি আপত্তি করব কেন? তোর পছন্দ হলে তুই বিয়ে করবি। এতে আমার আপত্তি করার কি আছে?
- পূর্ণিমা বিধবা বলে?
- বিধবা বিয়ে তো বেআইনি নয়। কতদিন আগে বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা বিবাহ আইনি করে রেখে গেছেন। তারপর মলিন হেসে রসিকতা করে পিসিমা বললেন, অল্প বয়সে আমিও বিধবা হলে, আমিও হয়তো তাই করতাম। তোর পিসেমশাই যখন মারা গেল, সে বয়সে তো আর কেউ আমাকে বিয়ে করে ঘরে নিতে চাইবে না। তার কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
পরদিন পূর্ণিমা ট্রে-তে করে দু’কাপ নিয়ে প্রতিদিনের মতো দাদাবাবুর ঢুকতেই, পিঙ্কি তাকে রহস্যের সুরে বলল, পূর্ণিমা তোমার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।
পূর্ণিমা শুনে তটস্ত হয়ে বলল, কি কথা দিদি?
তোমার চায়ের কাপটা নিয়ে এ ঘরে এসে বসো, বলছি। পূর্ণিমা রান্নাঘর থেকে তার চায়ের কাপটা নিয়ে এসে, খাটের নীচ থেকে বেতের মোড়াটা টেনে নিয়ে বসল। তারপর ভয়ে দুরু-দুরু বুকে বলল, বলুন দিদি।
- তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে আমার বিয়েটা তুমি দিয়েছিলে মনে আছে?
- হ্যাঁ দিদি মনে আছে।
- আমি তোমার কাছে সে ঋণ রাখতে চাই না, শোধ করতে চাই।
- কি যে বলেল দিদি।
- হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি।
- কিভাবে শোধ করবেন?
- যেভাবে তুমি আমায় ঋণী করেছিলে, সেভাবেই।
- মানে?
- আমিও তোমার বিয়ে দিতে চাই, তোমার দাদাবাবুর এক বন্ধুর সঙ্গে।
- সে কী?
- হ্যাঁ, তুমি তাকে চেনো, দেখেছো। বিপ্রদাসবাবু।
আমি ভেবে দেখলাম, তুমিও একা, নিঃসঙ্গ। সেও একা, নিঃসঙ্গ। আমি তোমাদের দু’জনের নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে দিয়ে, তোমাদের বিয়ে দিতে চাই। তোমার কোন আপত্তি আমি শুনবো না। তুমি তোমার মাকে বললে, আমি আর তোমার দাদাবাবু, কাল সন্ধ্যাবেলা আমরা তোমার মার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে যাব।
পূর্ণিমার বিয়ের প্রস্তাব শুনে তো তার মা খুব খুশি। এমনই একটা ব্যবস্থপনার কথা মনে মনে তিনি চাইছিলেন পূর্ণিমার জন্য। পূর্ণিমাকে বৈধব্য জীবনে ফেলে রেখে মরে যেতে, একেবারে তার মনে সায় ছিল না। তার খুব ইচ্ছে ছিল, পূর্ণিমা আবার বিয়ে করে তার নতুন সংসার গড়ে তুলুক।
মাসখানের মধ্যেই ছোটখাটো একটা অনুষ্টানের মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিপ্রদাসের পিসিমা আর পূর্ণিমার মা, দু’জনেই খুব খুশি হলেন এই বিয়েতে। তাদের দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাদের কত দিনের চেনা-জানা পরিচয়। বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশির হাসির ঝিলিক সেই দুই বুড়ির চোখে-মুখেই লেগেছিল।
দুই বন্ধুর মধ্যে আলোচনা করে ঠিক হল, দুর্গা পূজার পর, সতেরোই অক্টোবর থেকে বাইশে অক্টোবর পর্যন্ত তারা দু’জনেই হানিমুন করতে যাবে, দার্জিলিং শহর আর দার্জিলিংয়ের একটা অফবিট স্পট ‘তিনচুলে হাম তুকদহ খাসমহাল’-য়ে।
এবার বাদল সোমের ডাইরী থেকে তাদের ঘুরে বেড়াবার বিবরণ তুলে দিচ্ছি।
সোমবার (১৭/১০/২০২২) যাচ্ছি দার্জিলিং। রাত্রি এগারোটা কুড়িকে মিনিটে পদাতিক এক্সপ্রেস শিয়ালদহ থেকে। বাড়ি থেকে বেরোলাম রাত ন’টায় উবে ক্যাব ভাড়া করে। আমি আর পিঙ্কি ঢাকুরিয়া থেকে উঠে ভবানীপুর থেকে বিপ্রদাস আর পূর্ণিমাকে তুলে নিলাম গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করল। পোঁনে-দশটার মধ্যে শিয়ালদা পৌঁছে গেলাম আমরা। বারো নম্বর প্যাটফর্মে দার্জিলিং মেল দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা তার টিকিট পাইনি। আমরা কেটেছি পদাতিক এক্সপ্রেসের টিকিট। সেটা এই প্লাটফর্ম থেকেই ছাড়বে দার্জিলিং মেল ছাড়ার পর। তাই প্রতীক্ষায় থাকতে হলো। উপায় নেই। আমরা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে গল্প করলাম। তারপর
লোকজনের ব্যাস্ত চলাচল দেখে সময় কিছুটা পার করে দিলাম। তারপর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আমি আর বিপ্রদাস চা- সিগ্রেট খেলাম। তারপর আবার ফিরে এলাম।
দার্জিলিং মেল ছাড়ল দশটা পঁনেরো মিনিটে। সাড়ে দশটায় ওই প্লাটফর্মে পদাতিক এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াল। তাতে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ির ভিড় লেগে গেল। আমরা বসে বসে দেখলাম। তারপর ভিড়টা একটু হাল্কা হতেই ট্রেনে উঠে আমারা ট্রেনে উঠে সীট নম্বর মিলিয়ে দেখে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। ট্রেন ছাড়ল নির্ধারিত সময়ই।
বাইরে তখন অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
তাই দক্ষিনেশ্বর স্টেশন পেরোবার পর,রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে কানে আসছিল। বোলপুর, রামপুর হাট। রাত তখন তিনটা। তারপর আমি কখন ঘুমিয়ে পড়লাম। ফারাক্কা আসতে ঘুমটা ভেঙে গেল লোকের চিৎকার চেচামেচিতে । সকাল তখন পাঁচটা বাজে প্রায়। তারপর আবার কখন তন্দ্রার মতোন মতোন এসে লেগেছিল আমার চোখে।
এইভাবে ঘুম ও জগরণের মধ্যে কাটলো আরও কিছুক্ষণ।
মালদায় ট্রেন আসতে চায়ে গরম ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ওরা সকলেই জেগে গেছো। আমরা এককাপ করে কফি খেলাম। প্রতি কাপ কুড়ি টাকা করে নিল। দামটা বিপ্রদাস মিটিয়ে দিল। আমি কপি পান করার পর বাথরুমের কাজ সেড়ে ফ্রেস হয়ে নিলাম।
মঙ্গলবার (১৮ /১০/ ২০২২) এন জি পি – তে এসে আমরা নামলাম সকাল সোয়া-ন’টায়। সেখানে গাড়ি বলা ছিল। আমাদের আগেই সে সেখানে উপস্থিত ছিল। তাকে ফোন করায়, সে এসে আমাদের স্টেশন থেকে গাড়িতে তুলে নিল। নাম তার সুদেন তামাং। সুদেন তামাংয়ের লম্বা লম্বা চুলগুলি মাথার উপরে ঝুঁটি বাঁধা ছিল। তা’কে দেখে কাকাতুয়া পাখির মতো লাগছিল।
তা দেখে পিঙ্কি আর পূর্ণিমা নিজেদের মধ্যে চোখা-চুখি করে নীরবে মিঠিমিঠি হাসছিল।
সুদেন তামাংয়ের বয়ম ছেচল্লিশ বছর,পঁচিশ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। পাকা হাতের গাড়ি চালক সে। সুদেন শিলিগুড়ি বাইপাশ হয়ে সেবক রোড ধরলো, তারপর পাহাড়ের পাক খাওয়া চড়াই উৎড়াই পথ ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে লাগল। আকাশ তখন ঝকঝকে নীল। মোঘের চিহ্ন মাত্র কোথাও নেই। ড্রাইভার সুদেনের কাছে শুনলাম দু’দিন আগেও নাকি এখানে খুব বৃষ্টি হয়েছে। সেবক রোড পেরিয়ে যত উপরে উঠতে লাগলাম তত হিমল বাতাসের ধার বাড়তে লাগল।
গাড়ি এসে পৌঁছালো ‘বেঙ্গল সাফারি’- তে। সাফারিতে টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ডুকলাম। ঢুকে, খোলা জায়গায় অনেক রকমের জন্তু-জানোয়ার দেখে বিমুগ্ধ হলাম। কিছুক্ষণ সাফারি দেখে তারপর সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা।
এরপর এখান থেকে আমরা যাব তিস্তা-ভ্যালি টি এস্টেট, আর তাকদা অর্কিড গার্ডেন দেখতে।
পাহাড়ের ধার ঘেষে নেমে যাওয়া সারি সারি পাইন বনের অপূর্ব দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে ছবি তুলতে তুলতে আমরা এগোতে লাগলাম।
তিস্তা-ভ্যালি টি এস্টেট দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল আমাদের সকলের।
তারপর দেখলাম, তাকদা অর্কিড গার্ডেন। কত রকমের যে অর্কিড এখানে সংগৃহীত আছে, না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। আর দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মাটির টবে রাখা নানা রকমের অর্কিড এখান থেকে বিক্রি করাও হয়।
ষাট টাকা থেকে তিনশো টাকার মধ্যে দাম। পিঙ্কি আর পূর্ণিমা কিনলো দেখলাম। সেখানে আমাদের কিছু ছবি তুললাম। তারপর সেখান থেকে আমরা সকলে বেরিয়ে এলাম।
এরপর তাগদা ছাড়িয়ে আরও উপরে প্রায় সাড়ে আট হাজার ফিটের মতো উঁচুতে উঠে তিনচুলে হাম তুকদহ খাসমহালে এসে পৌঁছালাম আমাদের নির্ধারিত বুক করা ‘কৃপা-কুটি’ স্টে-হোমে (হাম তুকদহ খাসমহাল) বিকেল সাড়ে তিনটার সময়। সেখানকার মালিক রাজা রাই অমায়িক মানুষ। আমাদের সকলকে সাদর আমন্ত্রণ জানল পরম আত্মীয়ের মতো। জিজ্ঞাসা করলেন, চা খাবেন তো? বললাম, দিন। তারপর সেখানে সকলে এক কাপ চা খেয়ে, গীজারের গরম জলে বাথরুমের কাজ ও স্নান সেরে, খেতে বসলাম চারটায়। খেলাম ভাত ডাল আলুভাজা পটলের তরকাড়ি আর ডিমেরকারি। খেয়ে দেয়ে টানা একঘুম দিলাম আমরা। বিপ্রদাস আর পূর্ণিমা ছিল পাশের রুমে। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল ছ’টায়। দরজা খুলে দেখি চা আর গরম গরম মো মো নিয়ে হাজির হয়েছে দরজায়। সেগুলি টেবিলে রাখতে বললাম।
তারপর হাত মুখ ধুয়ে, আমি পিঙ্কি সেগুলি তৃপ্তি করে খেয়ে চায়ে চুমুক দিলাম। আমাদের ঘুমের জড়তা কাটল যেন অনেকটা। তারপর পাশের ঘরে গিয়ে বিপ্রদাসদের খবর নিলাম। আমরা
ভেবে ছিলাম এরপর বাইরে থেকে একবার ঘুরে আসব। কিন্তু বাইরে এতো ঠান্ডা, বেরোবার উপায় নেই, ভীষণ ঠান্ডা, হাড়ে কাঁপুনি ধরে যায় প্রায় । আর কলকাতায় এখন ২৮/৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা। লোকেরা গরমে ঘেমে উঠছে একজন বন্ধু ফোন করে জানালো। আর এখানে এখন ১০/১২ ডিগ্রি তাপমাত্রা। হিমশীতল পরিবেশ।
তাছাড়া রাস্তা ঘাট বিপদসংকুল হওয়ায় সন্ধ্যার পর সাধারনতঃ এখানে কেউ আর তেমন শহরের মতো ঘুরতে বের হয় না।
সব থাকার হোম-স্টেতেই গরম জলের জন্য গীজার আছে আবশ্যিক ভাবে। কিন্তু এখানে কোথাও কোন ফ্যান ব্যবহার হয় না। এতো ঠান্ডা থাকে সারাবছর। কোনও রুমে ফ্যান চোখে পড়ল না।
বাইরে বেরোনো যাবে না, তাই ঘরে বসে আমারা গল্প জুড়ে দিলাম। গল্প শেষ হলে মোবালই খুলে বসি। দেখি নেট কাজ করছে না, বড় স্লো। চাকা ঘুরে যাচ্ছে তো ঘুরেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে তোলা ছবিগুলি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ লোড শেডিং হয়ে গেল। এখানেও লোডশেডিং হয় তা’হলে। ধারণা ছিল না। কিছুক্ষণর মধ্যেই অবশ্য বিদ্যুৎ ফিরে এলো রুমে।
রাত ন’টা নাগাদ খাবার দিয়ে গেল রুমে। রুটি আর চিকেনকষা সঙ্গে স্যালাড। খুব তৃপ্তি করে খেলাম আমরা। চমৎকার রান্না করা হয়েছে কষা-মাংসটা।
রাতে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ব্র্যাঙ্কেট গায়ে তুলে নিতেই উষ্ণতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই গা গরম হয়ে গেল। পিঙ্কির শরীরী চাহিদা পূরণ হলে পরে, আরামে আর ক্লান্তিতে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম আমি। আমার ঘুম ভাঙল মাঝরাতে একবার। দেখলাম দু’হাত এক জায়গায় জড়ো করে -পা মুড়ে পিঙ্কি বালিকার মতো শুয়ে আছে। বাথরুম সেরে ফিরে এসে আবার আমি পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল এরপর সকাল সাড়ে ছ’টায়।
দরজা খুলতেই ধারালো শীতল বাতাসে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। এখন এখানে দশ ডিগ্রি টেম্পারেচার। ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। পিঙ্কি তখনও অসার হয়ে গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে পড়ে আছে। সকাল সাতটার সময় রুমের দরজায় খটখট আওয়জ করল। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খোলার আগে পিঙ্কিকে জাগিয়ে দিয়ে বললাম ওরা রুমে সকালের জল-খাবার দিতে আসছে বোধহয়। তুমি উঠে পর।
ঘরে এসে ওরা চা আর গরম গরম লুচি দিয়ে গেল। চা লুচি খেয়ে প্রাত্যহিক কর্ম সেরে নিলাম। তারপর আটটায় টিফিন এলো পুরি আর আলু মটরের তরকারী। খুবই সুস্বাদু রান্না। খেয়ে নিয়ে তৈরী হয়ে নিলাম আমরা চারজন। সাড়ে আটটায় গাড়ি নিয়ে আসবে সুদেন তামাং। আজ দেখতে নিয়ে যাবে – গুম্বা ডেরা, লাভার মিট পয়েন্ট আর পেশক টী-এস্টেট। সুদেন তামাং সময়মতো এসে হাজির হলো।
বুধবার (১৯/১০/২০২২) সকাল নটার সময় আর এককাপ ধূমায়িত চা খেয়ে, গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা চারজন। চড়াই উৎড়াই রাস্তা দিয়ে পাহাড়কে প্রদক্ষিণ করে গাড়ি নীচে নামতে লাগল। দু’পাশে সারি সারি পাইনের বন, সেদিকটা খাদের দিক উল্টো দিকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। মাঝখান থেকে পাহাড় কেটে সরু রাস্তা করা হয়েছে। এতোটা সরু যে একটা গাড়ি চলার মতো। উপর থেকে যদি কোন গাড়ি নীচে নেমে আসে ,তখন উপরে ওঠা কোন গাড়ি সেই গাড়িটাকে দেখে খাদের গা ঘেষে একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, সেই গাড়িটাকে নামার রাস্তা করে দেওয়ার জন্য। এই ভাবে অনেক সময় পাঁচ- সাতটা গাড়ির লাইনও পড়ে যায় নীচে নামার। উপরের গাড়িগুলি নীচে নেমে যাওয়ার পর নীচের গাড়িগুলি উপরে ওঠা শুরু করে সারি সারি ভাবে। আগে নীচের গাড়িগুলিকে নামার সুযোগ করে দেয়। কারণ সেই গাড়িগুলিকে নামার রাস্তা করে না দিলে, নীচের গাড়িগুলি উপরে ওঠার সুযোগ পায় না।
পাহাড়ের গায়ে গায়ে সুন্দর করে সাজান সব চা বাগান। ব্যাক-গ্রাউন্ডে সেই চা-বাগনকে রেখে আমাদের চারজনের কয়েকটা ছবি তোলা হল। তারপর বিপ্রদাস পূর্ণিমাকে নিয়ে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কতগুলি ছবি তুলল। ছবিগুলি তুলল, পিঙ্কি। আমাদেরও (আমার আর পিঙ্কির) ওই রকম কয়েকটি অন্তরঙ্গ ভঙ্গির ছবি তুলল,পূর্ণিমা।
পূর্ণিমার মুখখনা এখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে।
চা বাগানের মনোরম দৃশ্য একবার দেখে আশ মেটে না। বারবার দেখার জন্য অজান্তেই চোখ চলে যায় সেদিকে। আর দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় আপনা থেকেই। এইসব মনোহর দৃশ্য দেখা শেষ করে, প্রায় চল্লিশ মিনিট পর এসে পৌঁছালাম গুম্বা ডেরা। দেখান থেকে তাকিয়ে দেখলাম সুদূরে সিকিম পাহাড়ের সারি।
তারপর ওপাশ থেকে পাহাড়ের ধাপ নীচে নামতে নামতে এসেছে ,আর এপাশ থেকে নেমে যাওয়া ধাপ গিয়ে মিশেছে সেখানে। সারি সারি পাইন ফার গাছ ধাপে ধাপে নেমে গেছে। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। দেখে মন ভরে যায়। এই দৃশ্য থেকে অন্যদিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় যে, অন্যদিকে ধাপে ধাপে চা-বাগানের সাজানো সারি যেন ধাপে ধাপে ওপাশের উপর দিকে উঠে গেছে। সকলেই আমরা মুগ্ধ হয়ে এইসব দুশ্য দেখছি। আর আবেগ উদ্বেল হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। বিপ্রদাস মুগ্ধ হয়ে বলল, আমার তো এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে বাকি জীবনটা।
এই স্পট দেখার জন্য প্রতিদিনই অনেক ট্যুরিষ্ট এখানে আসে। ফলে গড়ে উঠেছে অনেকগুলি চা-সিগ্রেট ও মনোহারী দোকান।
একটা চায়ের দোকানে বসে আমরা চা নিলাম এককাপ করে।
অপূর্ব চায়ের স্বাদ, জিবে লেগে থাকার মতো।
চা শেষ করে সিগ্রেট ধরালাম একটা। সিগ্রেট টানতে টানতে প্রকৃতির শোভা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আরও কিছুক্ষণ। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছিল না এই সব অপূর্ব দৃশ্যাবলী থেকে।
সকলেই নিজের মোবাইলে কিছু কিছু ছবি তুলে নিয়ে, সেখান থেকে গিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল, কখনও ডাইনে বেঁকে কখনও বাঁয়ে বেঁকে চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ‘লাভার্স মিট পয়েন্ট’-য়ের দিকে। ‘লাভার্স মিট পয়েন্ট’-য়ে ঘটেছে তিস্তা নদীর সঙ্গে রঙ্গীত নদের মিলন, তাই এখানকার নাম হয়েছে ‘লাভার্স মিট পয়েন্ট’।
সেখানে পৌঁছাতে আধ-ঘন্টার মতো সময় লাগল আমাদের। এসে নামলাম সেখানে।
আমরা এখন পাহাড়ের নীচের দিকে আছি। নীচের দিকে পাইন ফারের বন। তারও নীচে দেখা দেখলাম, রঙ্গীত নদ এসে তিস্তা নদীর সঙ্গে মিলেছে। দু’টি জলধারা দু’রঙের। একটি গভীর নীল অন্যটা হাল্কা ফিকে নীল। অপূর্ব দৃশ্য। অনকেক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম আমরা। চোখ ফেরাতে পারলাম না অন্যদিকে। দুটির রসধারা নিবিড় ভাবে মিশে গিয়ে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে সেটা আকাশী নীল রঙের।
সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম সেই সব দৃশ্যের। বিপ্রদাস পূর্ণিমা জুটির নানা ভঙ্গীর অনেকগুলি ছবি তুললাম আমি আমার মোবাইলে। বিপ্রদাসও আমার আর পিঙ্কির কতগুলি ছবি তুলল, আমাদের নানা ভঙ্গির তার মোবাইল ফোনে।
তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে সেখানকারই একটি চায়ের দোকানে বসে আমরা সকলে এক কাপ চা খেলাম দশটাকা করে প্রতিকাপ। দোকানী মহিলা। তার ব্যবহার আপনজনের মতো, যেন কত কালের চেনা পড়শী আমি তার। আমি চায়ের দাম মিটিয়ে দিলাম।
সেখান থেকে বেরিয়ে এবার গন্তব্যস্থল ‘পেশক টী-এস্টেট’। সেখানে পৌঁছাতেও আধঘন্টার মতো সময় লাগলো আরও। যখন পৌঁছালাম, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। সারি সারি চা বাগান। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু চা বাগান পাহাড়ের ধাপে ধাপে নেমে গেছে অনেক নীচে দিকে অনেক দূর পর্যন্ত। দু’পাশের চা বাগান দেখতে দেখতে ধাপে ধাপে অনেকটা নীচে নেমে গেলাম। চারপাশে ও উপরে নীচে চা বাগান দিয়ে ঘেরা আমার কিছু ছবি তুললাম আমাদের সকলের মনের সুখে। তারপর আবার ধাপে ধাপে আবার উপরে উঠে এলাম। এসে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে দেখলাম, কাছেই একটা চা বাগানে একদল মেয়েরা পিঠের ঝুড়িতে নিপুণ হাতে চা পাতা তুলে বোঝাই করছে । মনের ভিতরে অদ্ভুত এক খুশির আবেগ ছড়িয়ে পড়ছিল । দু-চোখ যেন সবুজের সজীবতায় ডুবে গেছে নিবিড় সুখে। চা শেষ করে একটা সিগ্রেট ধরালাম। সিগ্রেট টানতে টানতে নিবিড় সুখে চা বাগানের মনোরম দৃশ্য, মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। সিগ্রেট টানা শেষ হলে, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও কিছু ছবি তুললাম। তারপর গাড়িতে এসে উঠে বসলাম আমরা।গাড়ি চলতে শুরু করলো। এবার ফেরার পালা।
ফেরার সময় পাহাড়ের গায়ে দু-একট কবর দেখতে পেলাম। তা দেখে ড্রাইভার সুদেনের কাছে জানতে চাইলাম, মারা যাবার পর তোমাদের কি কবর দেওয়া হয়?
শুনে সুদেন বলল, না আমাদের দাহ করা হয়। তবে আমাদের মধ্যে অন্য সম্প্রদাযের লোকদের কবর দেওয়া হয়। যেমন আপনারা যেখানে উঠেছেন ‘কৃপা-কুটি’ হোম স্টে-র মালিক রাজা রাইদের কবর দেওয়া হয়। শুনে কিছুটা আশ্চর্য ও অবাক হলাম বইকি ! যাক্ সে সব কথা।
গাড়ি পাহাড়ের চড়াইয়ের আঁকা বাঁকা পথ ধরে উপরে উঠতে লাগল। চলার পথ এতটাই সংকীর্ণ যে উপর থেকে কোন গাড়ি এলে আমাদের গাড়িটাকে পাহাড়ের খাত ঘেষে দাঁড় করাতে হচ্ছে , না হলে উপরের গাড়িটা নামতে পারছে না। আর উপরের গাড়িটা না নামলে আমাদের গাড়িও উপরে ওঠার কোন পথ পাচ্ছে না, এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে বহুবার ফেরার সময়ে। ঘরে এসে পৌছাঁলাম বিকেল চারটার সময়।
পরদিন বৃহস্পতিবার (২০/১০/২০২২) সকালে আলুর পরোটা, গাজর আর বাঁধা কপির মিক্সড সুপ খেয়ে জলখাবার সারলাম। তারপর চা খেয়ে ঘুরতে বের হলাম সকাল নটার পরে।
আজকে দেখবো, ঘুম মসেস্ট্রি, ঘুম টয় ট্রেন স্টেশন, বাতসিয়া লুপ প্রভৃতি জায়গাগুলি।
গাড়িতে যেতে যেতেই চোখে পড়ল টয়-ট্রেন স্টেশন, সেখান থেকে টয়-ট্রেন চলতে আরম্ভ করে সারা শহর পাঁক খেতে দার্জিলিং পৌঁছাতে সময় লাগে আট ঘন্টার মতোন। তবে ভাড়াটা ভীষণ বেশী। জন প্রতি আড়াই হাজার টাকা প্রায়। অনেকের পক্ষেই ইচ্ছে থাকলেও তাতে চড়া সম্ভব হয় না।
গাড়ি এসে ঘুম মনেস্টিতে পৌঁছাল। গাড়ি থামিয়ে পার্কিং স্টেশনে রেখে, মনেস্ট্রির ভিতরে ঢুকে দেখলাম আমরা। দেখে মন ভরে গেল। তবে হেঁটে অনেকটা উঁচুতে উঠতে হলো কষ্ট স্বীকার করে।
সেখানে আমরা সকলেই চারপাশটা ঘুরে ঘুরে মোবাইলে ছবি তুললাম অনেকগুলি।
সেখানে আমরা আধঘন্টার মতো কাটিয়ে নীচে নেমে এসে (মনেস্ট্রি থেকে বেরিয়ে এসে) ড্রাইভারকে ফোন করলাম, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য। সেখান থেকে গাড়িটা অনেকটা দূরে পার্কিং স্টেশন রাখা ছিল।
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলে তাতে উঠে বসলাম আমরা। এবার আমাদের গন্তব্য বাতাসিয়া লুপ। গাড়ি চলতে শুরু করল। চলতে চলতে গাড়ি লবচু মার্কেট পেরিয়ে গেল, তার কিছুক্ষণ পরে এলো সিক্থ ম্যাল মার্কেট। সেখানে লোকজনের বেশ ভিড় চোখে পড়ল মার্কেটগুলিতে। সকলেই তাদের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কেনা-কাটায় ব্যস্ত। তার পাশ দিয়েই চলে গেছে টয়-ট্রেনের সরু লাইন। সেই লাইন দিয়ে গাড়িও যেতে দেখলাম। কু ঝিক ঝিক আওয়াজ তুলে কয়লা ইঞ্জিনের গাড়িটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। গাড়ির দুটো মাত্র বগি। কলকাতায় চলা ট্রামের মতো দেখতে লাগে একদম। বোধহয় একশো লোকের বেশী ধরে না দু’টি বগিতে।
কয়লা ছাড়াও ডিজেল ইঞ্জিনের টয়-ট্রেনও আছে কিছু। তবে তার সংখ্যা খুব বেশী নয়। কয়লার ট্রেনে ভাড়া ১৫০০ টাকা,আর ডিজেল ট্রেনের ভাড়া ১২০০ টাকা। আধঘন্টায় দার্জিলিং শহরের বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলি ঘুরিয়ে দেখায়। যেমন, ঘুম মনেষ্ট্রি,বাতাসিয়া লুপ প্রভৃতি।
এসব দেখতে দেখতে এসে পৌঁছালাম বাতাসিয়া লুপে। অপূর্ব দৃশ্য। বাতাসিয়া লুপ দেখে হৃদয়ে এক অপার্থিব অনুভূতির সঞ্চার হলো। কী আশ্চর্য সুন্দর ভাবে প্রকৃতি তার পৃথিবীকে সাজিয়ে রেখেছে। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে অনেকগুলি ছবি তুললাম আমরা। পূর্ণিমা বলল, আমি কখনও ভাবিনি যে এমন দৃশ্য কখনও দেখতে পাব জীবনে। মনে হচ্ছে জীবন আমার সার্থক আজ। তারপর আমরা ফিরে এসে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।
এবার এখান থেকে যাব দার্জিলিংয়ের মোহিত হোটেলে। যেখানে আমার ঘর বুক করা আছে দু’দিনের জন্য। সেখানে দুদিন থাকবো। এখানে দু’দিন থেকে দার্জিলিং ঘুরে দেখে তারপর ঘরে ফেরার পালা। মোহিত হোটেলে এসে পৌঁছালাম বিকেল চারটায়।
শুক্রবার (২১/১০/২০২২) ভোর তিনটার সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হল সকলকে, গাড়ি আসবে সাড়ে তিনটার সময়। টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখাতে নিয়ে যাবে। তার আগে সকালের প্রাত্যহিক কাজ আমাদের বাথরুমে সেরে নিতে হল একে একে। গাড়ি এলো ঠিক সাড়ে তিনটায়। কী ঠান্ডা রে বাবা! যত গরম পোষাক ছিল সব গায়ে জড়িয়ে নিলাম। তার উপরে একটা সবুজ শাল জড়ালাম গায়ে। চড়ে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করলো পাহাড়ের গা ঘেঁষে ডাইনে বাঁয়ে আঁকা বাঁকে পথের চড়াই উৎড়াইয়ের বাঁক পেরিয়ে উপরের দিকে। গাড়ি যতো উপরে উঠছে ঠান্ডা ততো বাড়ছে। পিঙ্কি তো কাঁপতে শুরু করেছে ঠকঠক করে। টাইগার হিলে যখন এসে পৌঁছালাম, তখন তাপমাত্রা সাত ডিগ্রি। কনকনে ঠান্ডা হাড়ে বিঁধে যাচ্ছে যেন। হাতের আঙুলগুলি ঠান্ডায় অবশ অসার হয়ে গেছে। নাড়াতে পারছি না। হাতে মোবাইল ধরে রাখতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে মোবাইলটা নীচে পড়ে যাবে, এমন অসার আঙুলগুলি। এত কষ্ট করে সূর্যোদয় দেখতে আসা। বিপ্রদাস ও পূর্ণিমারও আমাদের মতো অবস্থা। বিপ্রদাস বলল, এত ঠান্ডা আগে জানলে
আসতাম না। পূর্ণিমা, তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
- হুম হচ্ছে।
আকাশটা সচ্ছ নীল। মনোরম আবওহাওয়া। আধ-ঘন্টার মধ্যে এসে পৌঁছালাম টাইগার হিলে। একটু পরেই সূ্র্যোদয় ঘটল। যা দৃশ্য দেখলাম, তা বর্ণনার অতীত। ধীরে ধীরে সূর্যের আগমন ঘটছে। পাহাড়ের রঙ ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করলো। প্রথমে কালো থেকে হাল্কা নীল। তারপর ধীরে ধীরে সবজে নীল। তারপর রূপালী রঙ ধরলো। তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম চূড়া দেখা গেল। সেখানে সূর্যের আলো পড়ে চূড়াটা সোনালী হয়ে উঠল। তারপর দ্বিতীয় চূড়াটির মাথায় সোনালী রঙ ধরলো। এরপর তৃতীয় চূড়া দেখা গেল একই রঙে রঙিন হয়ে উঠল। সব চূড়াগুলিই এখন দেখে মনে হচ্ছে সোনার চূড়া। যেন সোনার মুকুট মাথায় পরে আমাদের দেখা দিলেন কাঞ্চনঘঙ্ঘা। অপূর্ব সে দৃশ্য। বর্ণনাতীত। অসাধারণ এক অনুভূতির আবেশ সকলের মনের ভিতর ছড়িয়ে পড়ল সূর্যোদয়ের মতোই। মনের আশ মিটিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে বিহ্বল হয়ে পড়লাম সকলেই। মোবাইলে প্রচুর ছবি তুললাম মন ভরে। তারপর রোদ এসে টাইগারে হিলে পড়তে শুরু করল। তা দেখে সেখানে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে নীচে নেমে এলাম আমরা।
যা দেখলাম এতক্ষণ ধরে , তা দেখে মনে হল ভোর থেকে এতক্ষণ ধরে যত সব কষ্ট সহ্য করেছি, তা যেন সার্থক হয়ে উঠেছে। এমন মনোহর রূপ এত কষ্ট সহ্য করে এখানে না এলে বোধহয় জীবনে আর কখনও দেখা হতো না।
আকাশ মেঘলা থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার এই মোহময় রূপ দেখা যায় না মোটেও । সবই প্রকৃতির সদয় অনুকম্পা বটে আমাদের প্রতি।
নীচে নেমে এসে সেখানে একটা দোকানে ঢুকে গরম গরম আলুর পরটা আর কফি দিয়ে টিফিন সারলাম। তারপর এক কাপ করে গরম গরম চা খেয়ে, একটা সিগ্রেট ধরালাম, আয়েস করে সিগ্রেট টানতে লাগলাম । চোখ এখনও কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ মোহে বিভোর হয়ে আছে। সিগ্রেট শেষ করে খাবারের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে সূর্য অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। আমরা গাড়ি করে আবার নীচে নামতে শুরু করলাম ‘মোহিত হোটেল’-য়ে ফেরার জন্য। সাড়ে আটটায় হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে ফিরে এসে পিঙ্কি আর আমি, দু’জনে তৃপ্তি করে সঙ্গম করে গা গরম করে নিলাম। তারপর গীজার ছেড়ে গরম জলে স্নান সারলাম। হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার দেখতে বেরোতে হবে – জাপানিস টেম্পেল (পীস প্যাগোডা), দার্জিলিং জু, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনসটিটিউট, দার্জিলিং জু মিউজিয়াম, HMI মিউজিয়াম, তেনজিং রক আর চিত্রা টি এস্টেট।
এগারোটা খাওয়া- দাওয়া সেরে আবার গাড়ি নিয়ে বের হলাম আমরা। প্রথমে গেলাম জাপানিস টেম্পেল (পীস প্যাগোডা) দেখতে। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হলো বটে । সেখানে দেখে কয়েকটা ছবি তুলে আবার নীচে নেমে এলাম সিঁড়ি ভেঙে।
এরপর যাব দার্জিলিং জু। জু-তে এসে পৌঁছালাম আধ-ঘন্টার মধ্যেই। সেখানেও সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা উপরে উঠতে হল। এন্ট্রি ফি ষাট টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম আমি আর পিঙ্কি। বিপ্রদাস আর পূর্ণিমা জু দেখতে গেল না। ওরা নীচে অপেক্ষা করতে লাগল। আমি আর পিঙ্কি জু-তে এসে দেখলাম লেপার্ড (চিতা-বাঘ), বিয়ার (ভালুক), ব্ল্যাক প্যান্থার ( কালো চিতা-বাঘ) ছাড়াও রয়েছে অনেক রকমের পাখি। সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর সেখান থেকে দেখতে গেলাম – ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনসটিটিউট’ যেখানে পাহাড়ে ওঠার নানা রকম সামগ্রী। নানারকম পোষাক আর মুখে পরার নানা রকমের মাক্স থেকে নানা ধরনের জুতো, লোহার কুঠার যা, দিয়ে বরফে গেঁথে সেটা চেপে ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে একধাপ ওঠে, আবার অন্য হাতের কুঠার বরফে গেঁথে দ্বিতীয় ধাপ ওঠে। এই ভাবে বরফের পাহাড়ে ওঠে আরোহীরা। কুঠারটির নাম নাম ‘স্নো এক্স’।
সেখান থেকে বেরিয়ে দেখলাম H M I মিউজিয়াম। এইসব দেখে সেখানে প্রায় দেড় ঘন্টা কেটে গেলে আমাদের। এরপর আবার সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এসে, বিপ্রদাসকে ফোন করে জানলাম, পূর্ণিমা আর বিপ্রদাস গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ড্রাইভার সেখানে নেই, কোথায় গেছে ওদের বলে যায়নি। আমি ড্রাইভারকে ফোন করলাম , কারণ এখানে সব জায়গায়ই গাড়ি স্ট্যান্ডে রাখতে হয়, তার জন্য ভাড়া দিতে হয় ১০০/১৫০ টাকা পর্যন্ত।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার এলো,দেখলাম ভিতরে বিপ্রদাস আর পূর্ণিমা বসে আছে।
এবার আমরা দেখতে যাব তেনজিং রক। যেখানে প্রথম তেনজিং নোরকে পা রেখেছিল এভারেষ্ট জয় করার পূর্বে। সেখানে দড়ি ঝোলানো আছে। কেউ আগ্রহী হতে চাইলে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে সেই রকের চূড়ায় উঠতে পারে। অবশ্য তার জন্য প্রত্যেককে একশো টাকার টিকিট কাটতে হবে। আমরা যখন গেলাম, তখন অবশ্য কাউকে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে উপরে উঠতে দেখিনি। আমি বিপ্রদাসকে বললাম, কিরে রক ক্লামবিং করবি নাকি?
- ধুর, এসব করতে আমর মোটেও ভাল লাগে না।
সেখানকার কিছু ছবি আমরা মোবাইলে তুলে রাখলাম। আধ ঘন্টার মতো সেখানে আমাদের কাটলো। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল ‘চিত্রা টি এস্টেট’। দেখতে যাব চা বাগান। আমরা সেখানে রওনা দিলাম। রাস্তা জ্যাম থাকায় আধ ঘন্টার বেশি লাগল সেখানে পৌঁছাতে। সেখানে পৌঁছে চোখ জুড়িয়ে গেল। নীচের দিকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে সারি সারি চা বাগান। ধার দিয়ে আঁকা বাঁকা সর্পিল গতিতে পথ নেমে গেছে, নীচে নেমে যাবার জন্য । নেমে যেতে যেতে চা বাগানগুলি সাজানো একখানা ছবির মতো লাগছিল দেখতে। অনেক দর্শনার্থীরাই নীচে নেমে যাচ্ছে সেই দুশ্য দেখতে দেখতে। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে যাচ্ছে বাগানগুলি ভাল করে দেখবার জন্য। আমি ও বিপ্রদাস ওদের দেখা-দেখি খানিকটা নীচে নেমে গেলাম। আহা কী অপূর্ব লাগছে দেখতে ! আমি দাঁড়িয়ে আছি নীচে , আমার চারপাশ ঘিরে ধাপে ধাপে চা বাগানগুলি উঠে গেছে উপরের দিকে।
আমাদের সেখানে পৌঁছাতে দেখে, পিঙ্কি ও পূর্ণিমাও নীচে নেমে আমাদের কাছে চলে এলো। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকগুলি ছবি তুললাম যে যার মোবাইলে। কিছুক্ষণ ঘুরে কাটালাম সেখানে। তারপর ধীরে ধীরে আবার উপরে উঠে এলাম আমরা সকলে।
উপরে উঠে এসে, পূর্ণিমা বলল পিঙ্কিকে, কী অপূর্ব লাগছিল দেখতে, তাই না দিদি?
পিঙ্কি তার কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, অপূর্ব, অপূর্ব। অতুলনীয় দৃশ্য।
রাস্তার উপরে এসে আমরা দেখলাম চা বাগানের দিকে সারি সারি চায়ের গুমটি-দোকান কুড়ি-পঁচিশটি। এইসব বাগানের চাএখানে বিক্রি হয়। এখানে ওদের বানানো চা পান করে তার স্বাদ গ্রহণ করে, পরে ইচ্ছে হলে ওদের থেকে চা-পাতা কিনতে পারা যায। কেজি ৬০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত দাম।
১২০০ টাকা কেজি দরের, ওদের বানানো চা পান করে, তার স্বাদ আমাদের ভাল লাগায়, ৫০০ গ্রাম করে চা ওদের থেকে বিপ্রদাস আর আমি কিনে নিলাম ৬০০ টাকা করে দু”জনে দিয়ে। তারপর সেই গুমটি-দোকান থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আরও একবার মন ভরে চা বাগানগুলি দেখে, গাড়িতে এসে উঠে বসলাম, এবার আমরা যাব রোপ-ওয়ে চড়তে।
আজকের মতো আমার শেষ গন্তব্যস্থল।
চাপপাশের পাহাড়ী মনোরম দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর এসে পৌঁছালাম রোপ-ওয়ে সেন্টারের কাছে। রোপ-ওয়েতে চড়ার জন্য বহুলোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও দাঁড়ালাম লাইনে এসে। বেশ কিছুক্ষণ পর টিকিট কাউন্টারের কাছে এসে পৌঁছালাম। এপার ওপার যাতায়াতের জন্য আমাদের টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দাম বারশো টাকা করে শুনে, বিপ্রদাস রোপ-ওয়েতে চড়তে আপত্তি করছিল। আমি ওকে বললাম, হানিমুন করতে এসে এই টাকাটা অনায়াসেই খরচ করা যায়। বারবার তো আমরা এখানে হানিমুন করতে আসব না। আমার য়ুক্তি শুনে, বিপ্রদাস হেসে ফেলল। তারপর রোপ-ওয়ে চড়তে রাজি হল।
বারশো টাকা করে দুটো টিকিট কাটতে, চব্বিশ’শ টাকা টিকিট কাউন্টারে জমা দিয়ে দু’খানা টিকিট নিল। আমিও তাই করলাম। পিঙ্কি আর মার জন্য দু’খানা টিকিট কেটে নিলাম কাউন্টারে চব্বিশ’শ টাকা জমা দিয়ে।
তারপর টিকিট দেখিয়ে আমরা গিয়ে চড়ে বসলাম রোপ-ওয়েতে। পাহাড়ের একটা টিলা থেকে আর একটা টিলায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয়। নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় ভয়াল আতঙ্ক সৃষ্টিকারী পাহাড়ী খাত আর চোখ জুড়ানো পাইন গাছের সারি। তা দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেলাম ওপারের টিলার উপরে। রোপ-ওয়েতে একবারে চারজন করে বসা যায়। একটা রোপ-ওয়ে যখন ওপারে যায়, তখন আর একটা রোপ-ওয়ে এপারে আসে।
চড়ে বসলে রোমহর্ষক এক অনুভূতি তৈরী হয় মনের ভিতরে।
অসাধারণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, মনে এক মুগ্ধকর আবেশ নিয়ে ওই ভাবেই আমরা আবার রোপ-ওয়ে চড়ে আগের জায়গায় ফিরে এলাম। এই ভাবে আমরা আমাদের রোপ-ওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতা সারলাম।
সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। এবার হোটেলে ফেরার পালা। রওনা দিলাম মোহিত হোটেলে ফেরার জন্য। বিকেল পাঁচটা নাগাদ এসে হোটেলে পৌঁছালাম আমরা। পিঙ্কি আর পূর্ণিমাকে রুমে রেখে আমি আর বিপ্রদাস নীচে নেমে এলাম। নীচে নেমে এসে দেখি হোটেলের নীচে ওদের বার-কাউন্টার আছে। আমি আর বিপ্রদাস সেখানে ঢুকে দু’পেগ হুস্কির অর্ডার দিলাম। সেই সময় পিঙ্কি আমাকে ফোন করে জানতে চাইল, তোমরা এখন কোথায়?
পিঙ্কিকে কি বলব ভাবছি। এমন সময় বিপ্রদাস
আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিল, আমরা এখন ড্রিংসের দোকানে, আপনার খাবেন? নিয়ে আসব?
- ও কোথায়?
- ড্রিংস কিনছে। আপনাদের জন্য আনব? পূর্ণিমাকে ফোন করে বলুন, আমাদের রুম লক করে, ওকে আপনাদের রুমে এসে বসতে, আমরা আপনাদের জন্য ড্রিংকস্ কিনে নিয়ে আসছি।
- আচ্ছা।
বাদল বিপ্রদাসের কান্ডটা দেখে থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ না করে, ধীরে সুস্থে পেগটা শেষ করল।
বিপ্রদাসেরও পেগ তখন শেষ, সে আর এক পেগ করে হুইস্কি আনতে বলল বয়কে ডেকে। বাদল বলল, আমি আর খাব না। তুই খা।
- কেন, পিঙ্কিকে ভয় পাচ্ছিস?
- হ্যাঁ, ও তো জানে না আমি মদ খাই।
- এখনও ওকে বলিসনি, যে ড্রিংস করিস তুই?
- না।
- বেশ তবে চল, আমিও আর খাব না। বয়কে আর হুইস্কি আনতে বারণ করে দিল বিপ্রদাস। তারপর কাউন্টারে গিয়ে হুইস্কির দাম মিটিয়ে দিল সে।
পূর্ণিমা আর পিঙ্কি ওদের দু’জনের জন্য দু’টো থামস্ আপের বোতল কিনে নিলাম আমি। তারপর আমাদের রুমে এসে ঢুকলাম আমরা দুজনে। দেখলাম, পিঙ্কি আর পূর্ণিমা ওরা দু’জনে মিলে জমিয়ে গল্প শুরু করছে।
থামস্ আপের বোতল দু’টি আমার হাত থেকে নিয়ে বিপ্রদাস ওদের দিকে এগিয়ে দিল। পিঙ্কি বোতলটা হাতে নিয়ে বিপ্রদাসের দিকে তাকিয়ে বলল, স্ট্র আনেননি? - না, মনে ছিল না।
পিঙ্কি আর কিছু না বলে, থামস্ আপের বোতল খুলে নিয়ে ছোট ছোট করে চুমুক দিতে লাগল।
পূর্ণিমাও তার দেখাদেখি সে ভাবেই চুমুক দিয়ে থামস্ আপ পান করতে লাগল।
ন’টার সময় আমাদের রুমে রাতের খাবার দিতে এলে, বিপ্রদাশদের খাবারটা আমি আমাদের ঘরে দিয়ে যেতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ঘরে চার প্লেট কষা মাংস আর চারপিস করে হাত-রুটি চলে এল। আমরা সকলে একসঙ্গে বসে খেতে খেতে অনেক গল্প আর মজা করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা গল্প করে কাটালাম। রাত বারোটার পর বিপ্রদাস আর পূর্ণিমারা তাদের রুমে চলে গেল। তারপর আমি আর পিঙ্কি, বড় লাইট নিভিয়ে দিয়ে, নাটট-ল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
শনিবার (২২/১০/২০২২) আমাদের ঘুম ভাঙল সকাল আটটার সময়। ফোন করে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। দশ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল রুমে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি আর পিঙ্কি চা খেতে খেতে দূরের পাহাড় দেখছিলাম। দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেলে, এই ভেবে যে আজ আমাদের এই মনকেড়ে নেওয়া মনমোহিনী পাহাড়কে বিদায় জানাতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফেরার জন্য ‘উত্তরবঙ্গএক্সপ্রেস’ – ট্রেনে আমার টিকিট কাটা আছে। সন্ধ্যা ৫-৪৫ মিনিটে ‘উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস’ ট্রেন ছাড়বে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে। সেখানে তার আগে আমাদের পৌঁছাতে হবে। বিদায় জানাতে হবে এই পাহাড়-সুন্দরী দার্জিলিং শহরকে। টাইগার হিলকে। মনে শুধু তার সৌন্দর্যের মুগ্ধ স্মৃতির রেশ নিয়ে আমাদের ফিরতে হবে স্বার্থপরের মতো।
সকালের প্রাত্যহিক কাজ কর্ম সেরে আমরা দ্রুত লাগেজ গুছিয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। বেলা এগারোটার মধ্যে হোটেলের সমস্ত হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে দিয়ে, ফর্মালিটির ফর্মে সই সাবুদ করে, দুপরের খাবার খেয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। আমরা হোটেল ছেড়ে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে বের হলাম বেলা এগারোটায়।
ফেরার পথে কার্শিয়াং হয়ে শিলিগুড়ি নামবে আমাদের গাড়ি। তার মধ্যে রাস্তায় ধারে যা যা দেখবার আছে সব দেখে নেবো ভাবলাম আমরা মনে মনে।
গাড়ি নীচে নামতে শুরু করল দার্জিলিং হয়ে, ঘুম টয়-ট্রেন স্টেশন ছুঁয়ে, জল বাংলা রোড হয়ে (তার উপরে মিলিটারী ক্যাম্প), সেখানে দেখলাম হিন্দি সিনেমার অভিনেতা গোবিন্দার বাড়ি। তার বাড়ির বিপরীত দিকেই বাতসিয়া লুপ। তার বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায়।
জল বাংলা রোড শেষ করে ‘সোনাদা’ হয়ে, হিলকার্ট রোড় ধরলো গাড়ি। হিলকার্ট রোড ধরে এসে গাড়ি পৌঁছালো কার্সিয়াং বাজারে। সেখানে নেমে পছন্দসই কিছু গরম পোষাক কেনা-কাটা করলাম আমরা। তারপর কার্শিয়াং টয়ট্রেন স্টেশন, কার্শিয়াং রেডিও স্টেশন দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে খানিকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে। একটা দোকানে বসে চা খেলাম এক কাপ করে সকলে।
চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে ছবি তুললাম কিছু আশে পাশের দৃশ্যাবলীর। তারপর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম আমরা।
এরপর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। খনিকটা পথ পেরিয়ে এসে বালাসোম নদী পেলাম। বালাসোম নদীর উপরে ব্রীজ পেরিয়ে, তিনবাতি মোড় হয়ে নীচে নামতে শুরু করলো গাড়ি । তারপর এন জি পি রোড হয়ে গাড়ি শিলিগুড়ির সমতল ভূমিতে নামতে লাগল। সেখান থেকে অল্প কিছুক্ষণ পরেই বেলা পৌঁনে চারটার সময় এসে পৌঁছালাম নিউ জলপাইগুড়ি ষ্ট্যেশনে। আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে,দেওয়ালীর শুভেচ্ছা জানিয়ে ড্রাইভার বিদায় নিল। আলবিদা।
তারপর আমরা একটা হোটেলে ঢুকে, লাগেজ রেখে, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিয়ে চা টোষ্ট খেলাম। তার দাম মিটিয়ে দিয়ে, হোটেলের বাইরে এসে একটা সিগ্রেট ধরালাম আমি আর বিপ্রদাস। ঘড়িতে দেখলাম ৪-৪৫ মিনিট। তার মানে ট্রেন ছাড়তে আরও একঘন্টা বাকি।
ধীরে সুস্থে এক্সেলেটারে উঠে, হেঁটে ওভার ব্রীজ পেরোতে আরও পাঁচ- ছয় মিনিট সময় লাগল আমাদের। ওভার ব্রীজ থেকে নীচে নেমে খবর নিয়ে জানলাম, ‘উত্তরবঙ্গএক্সপ্রেস’ দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। লাগেজ সামনে রেখে সেখানে একটা বসার সীট পেয়ে তাতে গিয়ে বসলাম আমরা।
৫-২০ মিনিটে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে ‘উত্তরবঙ্গএক্সপ্রেস’ ট্রেন দিল। হুড়োহুড়ি করে কিছু লোক উঠে যাবার পর, একটু ফাঁকা হলে আমরা ধীরে সুস্থে গিয়ে আমি ট্রেনে উঠলাম। আমাদের সীট নম্বর খুঁজে নিয়ে, সেখানে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর ঠিক ৫-৪৫ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি বাড়তে লাগল। আমাদের পিছনে পড়ে রইলো শৈল্য শহর দার্জিলিং।
রাত সাড়ে আটটার সময় ট্রেনে ভেন্ডার এসে খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। রাত ন’টার মধ্যে খাবার দিয়ে গেল। আমরা খাবার খেয়ে সীটে চাদর পেতে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ও জাগড়ণের মধ্যে সারারাত কেটে গেল আমার। ভোর ৪-৪৫ মিনিটে আমরা এসে পৌঁছালাম জনাকাীর্ণ শিয়ালদা স্টেশনে। সেখান থেকে গাড়ি বুক করে ছ’টার মধ্যে ঢাকুরিয়ায় এসে আমাদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বিপ্রদাসও আর একটা গাড়ি বুক করে পূর্ণিমাকে নিয়ে চলে গেল তাদের ভবানীপুরের বাড়ি। পিঙ্কি বাড়ি ফিরে আমাকে বলল, এই কয়টা দিন যেন আমাদের স্বপ্নের মতো কেটে গেল। আবার জীবনের কর্ম-ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়তে হবে আমাদের কাল থেকে।
আমি তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, হুম।