কালো বেড়াল
এই নিয়ে পরপর তিন দিন। দিন না বলে সন্ধেবেলা বলাই উচিত। জগমোহন শবেড়াতে বেরিয়ে ঠিক একই জায়গায় একটা কালো বেড়াল দেখতে পেলেন।
কালো বেড়াল এমন কিছু বিদঘুঁটে প্রাণী নয়। কিন্তু একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আর জায়গাটাও তো সন্দেহজনক। গদাইবাবুর আমবাগানে। কিছুদিন আগে যেখানে মোনাই-ফকিরের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই।
মোনাই-ফকিরের আস্তানা একটু দূরে অবশ্য। সে নাকি লটারিতে অনেক টাকা পেয়েছিল। তারপর ডাকাত পড়েছিল রাত্রিবেলা। সকালে দেখা গেল ফকিরের লাশ পড়ে আছে গদাইবাবুর বাগানের ধারে। ধরো আর মুন্ডু আলাদা। সে এক বীভৎস দৃশ্য।
মোনাই-ফকির কালো আলখাল্লা পরে থাকত। মাথার টুপিও ছিল কালো। গাঁজার নেশায় সব সময় চোখদুটো রাঙা। আস্তানা বলতে একটা পুরানো বাদশাহি আমলের মুসলমান সাধুর কবরের ওপরের পাথরের একতলা ঘর। কবরের পাশেই মোনাই-ফকির খেত, ঘুমোত। ওখানেই তার সংসার আর সাধনভজন। হাটবারে লোকেরা এসে তার কাছে ওষুধ চাইত। ভূত-ভবিষ্যৎ জানতে চাইত। পয়সাকড়ি দিত।
এহেন ফকিরমানুষ লোভের বশে লটারির টিকিট কিনেছিল। একেবারে নাকি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। কমপক্ষে লাখ টাকা তো বটে। চারদিকে হইচই পড়ে গিয়েছিল এই খবরে।
কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ফকিরবেচারা প্রাণে মারা পড়ল।
জগমোহন রোজ নদীর ধার অবধি বেড়াতে যান বিকেলে। সন্ধেবেলা লাঠি ঠুকঠুক করে বাড়ি ফেরেন। ওই সব কথা ভাবতে-ভাবতেই হাঁটেন। আমবাগানের ধারে এসে একবার তাকান জায়গাটার দিকে এবং শিউরে ওঠেন। মনে হয়, আবছা আঁধারে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা রেখে ফকির শুয়ে আছে এবং মুন্ডুটা যেন মিটিমিটি হাসছে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
অমনি জগমোহন চলার গতি বাড়ান। গলার ভেতর রামনাম দু-চারবার হয় না, এমন নয়!
তারপর এক সন্ধেয় হঠাৎ এই কালো বেড়ালের আবির্ভাব। প্রথম দিন বিশেষ গা করেননি। দ্বিতীয় দিন একটু চমকে উঠেছিলেন। তৃতীয় দিন তো ভীষণ ভড়কে গেলেন ফকিরের কালো আলখাল্লার কথা মনে পড়েই।
জগমোহন এই মফস্বল শহরের একজন রিটায়ার্ড উকিল। বয়স হয়ে গেছে। মাথার চুল তুলোর মতো সাদা। বিকেলবেলা কিছুক্ষণ নদীর ধারে পার্কে গিয়ে না বসলে জীবন বড্ড একঘেঁয়ে লাগে। রাশভারী চেহারার মানুষটি যখন মোটাসোটা ছড়ি অর্থাৎ রীতিমতো লাঠিটি নিয়ে ঠুকঠাক করে হেঁটে যান, পথে সবাই খুব সম্ভ্রম রেখে কথা বলে।
সন্ধেবেলা গদাইবাবুর বাগানের ওদিকটায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে মিটমিটে আলো ছড়ায়। সেই আলোয় কালো বেড়ালের জ্বলজ্বলে হলুদ চোখজোড়া যেন জগমোহনের মনে গেঁথে গেল। সে-রাতে আর ঘুমোতেই পারলেন না। চোখ বুজলেই দেখতেন যেন কালো বেড়ালের হলুদ চোখজোড়া। আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায় বুঝি।
পরদিন বিকেলে আর একা বেড়াতে যেতে ভরসা পেলেন না। ব্যাপারটা কাকেও যে বলবেন, তাও খুব লজ্জা করে। একসময়কার বাঘা উকিল জগমোহন বেড়ালের ভয়ে কাবু–এ বড় খিটকেলের কথা নয়? সবাই হাসাহাসি করবে, আদালতের তাবড় তাবড় দুদে হাকিমকে যিনি ভয় পেতেন না, তিনি সামান্য বিড়াল দেখে ভয়ে পেয়েছেন?
নাতি দিবু খুব ডানপিটে ছেলে। সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছে। এরই মধ্যে সবরকম খেলাধুলায় নাম কুড়িয়েছে। জগমোহন দিবুকে আজ সঙ্গে নিলেন। দিবু কি খেলা ছেড়ে বিকেলবেলাটা বুড়ো দারুর সঙ্গে বেড়াতে বেরোবার ছেলে? অনেক বলেকয়ে লোভ দেখিয়ে তবে সে রাজি হল। ফেরার পথে মেধোর বেঁস্তোরায় কাটলেট কিংবা অম্বুর মিষ্টান্নভাণ্ডারে যথেচ্ছ রসমালাই খাওয়াবার কথা দিলেন জগমোহন। দিবু কাটলেট আর রসমালাইয়ের ভীষণ ভক্ত।
দিবু যখন সঙ্গে আছে, জগমোহনের তখন ভয় কীসের? এখন তিনি আলেকজান্ডার দি গ্রেট। কই এবার আয় দেখি ব্যাটা কালো বেড়াল অথবা মোনাই ফকির আমার সামনে। মাথা ছাতু করে ফেলব না?
আজ পার্ক থেকে একটু দেরি করেই ফিরছিলেন জগমোহন। দিবুর সঙ্গে আদালতের গল্প করতে করতে আসছিলেন। কোন হাকিম এজলাসে বসে ঢুলতেন, কোন হাকিম মামলার রায় পড়ার আগে জোর হেঁচে ফেলতেন, এইসব ক্যারিকেচার শুনে দিবু হেসে খুন হচ্ছিল। রাশভারী, গম্ভীর চেহারার দাদুকে এমন রসিকতা করতে শোনেনি সে।
কখন গদাইবাবুর আমবাগানের কাছে এসে পড়েছেন খেয়াল নেই। এসে যেই ডাইনে মুখ ঘুরিয়েছেন আর দেখতে পেয়েছেন সেই বিদঘুঁটে কালো বেড়ালটাকে। একই ভঙ্গিতে বসে আছে। তীব্র জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। তেমন চাউনি। আর আজ যেন গোঁফের তলায় কেমন একটা হাসিও রয়েছে।
জগমোহন অমনি লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার। মার। মার।
দিবু অবাক হয়ে বলল, কী হল দাদু? কী হল? কাকে মারতে যাচ্ছ?
জগমোহন হাঁপাত-হাঁপাতে লাঠি তুলে বললেন,–ওইগুই কালো বেড়ালটাকে।
বেড়াল! –দিবু আরও অবাক।–কই, কোথায় বেড়াল?
–ওই তো! দেখতে পাচ্ছিসনে? ওই যে!
দিবু হাসতে লাগল।–তোমার চোখ খারাপ দাদু। ওটা তো একটা কালো কাঠ পড়ে রয়েছে। সে দৌড়ে গিয়ে একটুকরো কাঠে লাথি মারল।
জগমোহন দেখলেন, বেড়ালটা সত্যি কাঠ হয়ে গেছে। তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে পা বাড়ালেন। মনটা ভালো হয়ে গেল। একেই বলে রজুতে সর্পভ্রম অর্থাৎ দড়িকে সাপ মনে করা। ছ্যা-ছ্যা কী লজ্জার কথা।
কিন্তু কিছুটা গিয়েই হঠাৎ মনে হল, যেন চাপাস্বরে বেড়ালটা ডাকল–মিউ! অমনি ঘুরলেন। ঘুরেই আঁতকে উঠলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
সেই কালো বেড়ালটা পেছন পেছন আসছে!
জগমোহন ফের লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার! মার! মার!
দিবু এবার রেগে গেল! বলল,–ও দাদু! আবার কী মারতে যাচ্ছ?
জগমোহন কাঁপতে কাঁপতে বললেন,-বেড়াল! সেই কালো বেড়াল।
–কই বেড়াল?
–এই তো!
দিবু আরও রাগ দেখিয়ে বলল, তোমার মুন্ডু। আমি চললুম।
কালো বেড়ালটা এখন একটু সরে গিয়ে রাস্তার পিচে বুক ঠেকিয়ে বসেছে। এ রাস্তাটা খাঁ-খাঁ নির্জন। জগমোহন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, দিবু! দিবু যাসনে। কাটলেট, রসমালাই!
তখন দিবু দাঁড়াল। তারপর হাসতে-হাসতে বলল,–বেড়ালকে এত ভয় কীসের বলো তো? বেড়াল ইজ বেড়াল।
জগমোহন হাঁটেন আর বারবার পিছু ফেরেন। আশ্চর্য! কালো বেড়ালটার সঙ্গে তার দূরত্ব সেই একই থেকে যাচ্ছে! ভিড়ে ভরা বড়রাস্তায় পৌঁছে অবশ্য আর তাকে দেখতে পেলেন না।
সেই রাতে জগমোহন অস্থির। চোখে ঘুম নেই।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কালো বেড়ালটাকে তিনি একা দেখতে পান, আর কেউ পায় না। দিবু দেখতে পায়নি তো!
আর তার চেয়েও বড় কথা, দিবুকেও বেড়ালটা গ্রাহ্য করল না। একবার বেমালুম কাঠে রূপান্তরিত হল।
দ্বিতীয়বার তার সামনে অদৃশ্য হয়ে রইল। শুই তাই নয়, জগমোহনকে অনুসরণ করল কতদূর।
অতএব বেড়ালটা সেই মোনাইফকিরের আত্মা, অর্থাৎ ভূত। হায়-হায়! এতকাল পরে এই বুড়োবয়সে জগমোহন একটা ভূতের পাল্লায় পড়লেন?
কথাটা যত ভাবছেন, আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ফকিরের ভূত তার গলা কামড়ে ধরবেই ধরবে।
বাড়িটা শহরের শেষপ্রান্তে। জগমোহনের ঘরের পেছনে জঙ্গুলে জায়গা খানিকটা। তার ওধারে সেই নদী! এমন জায়গায় বাড়ি করাই ভুল হয়েছিল।
তার ওপর মশারও খুব উপদ্রব বারোমাস।
তবে একটা সুবিধে হয়েছে দেখা যাচ্ছে। মশারির ভেতর শুয়ে থাকার ফলে রাতের বেলা নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন। বেড়াল তোক আর ভূতপ্রেতই হোক, মশারির ভেতর ঢুকতে পারবে কি? না পারাই উচিত। কোন বইয়ে যেন পড়েছিলেন, মশারির ভেতর মানুষ খুব নিরাপদ!
দেয়ালঘড়িতে টকটক শব্দ। তারপর ঢংঢং করে রাত বারোটা বাজল। আর তারপরই জগমোহন শুনলেন, মিড। অমনি চমকে মুখ তুললেন।
বাইরে অন্য পাশের রাস্তার আলো ত্যারচা হয়ে একটা জানালায় পড়েছে। আর সেখানে ফের আবির্ভূত হয়েছে সেই কালো বেড়াল। জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। মশারির ভেতর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোঁফের তলায় তেমনি একটা হাসিও। হাসিটা এখন কেমন ক্রুর। কালো বেড়ালটা ফের বলল–মিউ।
জগমোহন ততক্ষণে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাঁদরের বেলায় যেমন, তেমন ভূতের বেলাতেও এক কথা। বেশি পাত্তা দিতে নেই। পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে বসবে। ভূতকে ভয় করলেই ভূত আরও পেয়ে বসবে।
অতএব জগমোহন ভয় চেপেচুপে রেখে সোজা ভেংচি কাটলেন ভূত অর্থাৎ কালো বেড়ালকে, মিউ।
কালো বেড়ালও সঙ্গে সঙ্গে বলল,-মিউ! আর এতক্ষণে জগমোহন টের পেলেন, তিনি বেড়ালের ভাষা বুঝতে পেরেছেন। কী বলছে, ঠাহর হচ্ছে। কালো বেড়াল বলছে, টাকা।
অ্যাঁ টাকা! জগমোহনের টনক নড়ল। বেড়ালের ভাষায় বলে উঠলেন, মিয়াও! মিয়াও! টাকা? কীসের টাকা?
কালো বেড়াল বলল,–ম্যাঁও! ম্যাঁও! কেন? লটারির টাকা?
ওরে বাবা! বলে কী ব্যাটা! লটারির টাকা মানেটা কী?
জগমোহন হতভম্ব হয়ে বললেন,–মিঁই-ই! অ্যাঁ! বলল কী হে?
মিঁ-ও-ও! মিঁ-ও-ও! কেন উকিলবাবু, আমার লটারিতে পাওনা টাকার কথা ভুলে যাচ্ছেন!
মিঁউ, মিঁউ! কী মুশকিল! তোমার লটারির টাকা তো তোমায় খুন করে ডাকাতব্যাটারা নিয়ে পালিয়েছে–জগমোহন বললেন, ও বুঝেছি। তা তুমি কি আমাকে মামলা করতে বলছ তোমার হয়ে? মলো ছাই! ডাকাতব্যাটাদের কি আমি চিনি! তুমি বরং দারোগাবাবুর কাছে যাও। তিনি তোমার টাকা উদ্ধার করে দেবেন। ও ব্যাটাদের জেলে পুরবেন। যাও দিকি বাবু দারোগার কাছে।
–ম্যাঁও-ম্যাঁও! ওকথা বললে তো চলবে না উকিলবাবু।
ম্যাঁ-অ্যাঁ-ও–চলবে না মানে? আমি তো কবে ওকালতি ছেড়ে দিয়েছি হে!
–মিঁউ মিঁউ মিঁউ। টাকা টাকা টাকা! কোনও কথা শুনব না। টাকা চাই।
জগমোহন বিব্রত হয়ে মানুষের ভাষায় বললেন, কী আপদ! ভাগো, ভাগো বলছি। নইলে লাঠিপেটা করব।
কালো বেড়াল এবার নিজের ভাষায় তবে রে, বুড়ো! বলে এক লাফে তাঁর মশারির ছাদে এসে পড়ল। অমনি পটাপট দড়ি ছিঁড়ে মশারি আর বেড়াল পড়ল জগমোহনের ওপর। মুহূর্তে হুলুস্থুল ঘটে গেল। জগমোহন আর্তনাদ করতে লাগলেন, বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও। মশারির ভেতর জড়িয়ে-মুড়িয়ে খাটের নিচে পড়ে গেলেন। বাড়ির সবাই জেগে গেল। দরজায় ধাক্কা দিতে থাকল। কিন্তু দরজা খুলবে কে? শেষে প্রচণ্ড ধাক্কায় কপাট ভেঙে ফেলা হল। তারপর মশারি থেকে উদ্ধার করা হল জগমোহনকে।
দিবুর বাবা প্রণবেশ বললেন, কী কাণ্ড! মশারির দড়ি ছিঁড়ল কীভাবে?
দিবুর মা অরুণা বললেন, নিশ্চয় বেড়াল পড়েছিল। আমি তো জেগেই ছিলুম। কখন থেকে শুনছিলুম, এ ঘরে যেন বেড়াল ডাকছে। ভাবলুম, দুই বেড়ালে ঝগড়া বেধেছে।
জগমোহন অতি কষ্টে বললেন,–এক গ্লাস জল।
হ্যাঁ, কথাটা তো ঠিক। দুই বেড়ালের ঝগড়া বলা যায়। কিন্তু ঝগড়াটা টাকা নিয়ে। লটারির টাকা। ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়। মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছেন না জগমোহন।
জল খেয়ে সুস্থ হয়ে জগমোহন বললেন, কী বলছিলে বউমা, বেড়ালের ঝগড়া না কী?
অরুণা বললেন, হ্যাঁ। মনে হচ্ছে দুটো বেড়াল ঝগড়া করতে করতে আপনার মশারির ওপর পড়েছিল।
জগমোহন জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না। টাকা! লটারির টাকা।
তার মানে?–প্রণবেশ অবাক হয়ে বললেন,–বাবা, লটারির টাকা মানে কী?
জগমোহন ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাঁটু মুড়ে খাটের তলায় ঢুকলেন। বাড়ির লোকেরা হতবাক। দিবু ঘুমজড়ানো চোখে তাকিয়ে বলল,–ও দাদু! ওখানে ঢুকছ কেন? বেড়ালের ভয়ে? হি হি হি হি।
তাই শুনে রাঁধুনি হরুঠাকুর, কাজের লোক আন্নাকালী আর চাকর নবা পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। অরুণা ধমক দিয়ে বললেন, এতে হাসির কী আছে? যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো সব। সকাল সকাল উঠতে হবে। দেওঘরের ঠাকুরপো আসবেন না কাল? কত কাজ?
ওরা ব্যাজার মুখে যে-যার জায়গায় চলে গেল।
খাটের তলায় ঘষটানো শব্দ হচ্ছিল। জগমোহন কী একটা টেনে বের করছেন।
একটা পুরোনো সুটকেস। একদিকে ছোট্ট তালা আটকানো। সুটকেসটা টেবিলে রেখে জগমোহন বললেন, একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হায় ভুলো মন! মোনাই ফকির খুন হওয়ার কদিন আগে এটা আমায় রাখতে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে, ডাকাতব্যাটারা খামোকা বেচারাকে খুন করে গেল। খামোকাও হয়তো নয়, রাগে। টাকাগুলো পেলে খুন করত না। পায়নি বলেই রেগেমেগে মুণ্ডু কেটে ফেলেছিল। কিন্তু দেখো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এই সুটকেসের মধ্যে…কী ভুল! কী ভুল!
প্রণবেশ বললেন,–ও বাবা, ব্যাপারটা কি বলবেন খুলে?
জগমোহন দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,–বলব আবার কী? মোনাই-ফকিরের টাকা। শিগগির একটা জাবির গোছা আন। তালা না খুললে ভাঙতেই হবে শেষপর্যন্ত।
মোনাই-ফকিরের আস্তানা ঘিরে জগমোহন একটা অনাথ আশ্রম বানিয়ে দিয়েছেন। অনাথ ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া শিখছে। কারিগরি কাজ শিখে মানুষ হচ্ছে।
মোনাইয়ের লটারির টাকা। জগমোহনও কিছু দিয়েছেন নিজের পুঁজি থেকে। আজকাল সেই অনাথ আশ্রম নিয়েই থাকেন তিনি! বাকি জীবনের জন্য একটা ভালো কাজ পেয়ে গেছেন।
আর কালো বেড়ালটা?
শেষবার দেখেছিলেন অনাথ আশ্রম উদ্বোধনের দিন। কলকাতা থেকে এক মন্ত্রীমশাই গিয়েছিলেন উদ্বোধন করতে। জগমোহন দেখেছিলেন অত ভিড়ের মধ্যে কালো বেড়ালটা দিব্যি এসে তাঁর দু-পায়ের ফাঁকে কিছুক্ষণ বসে থাকল। পা শিরশির করছিল। তবু আর ভয় পাননি জগমোহন। এমন কী যাওয়ার সময় বেড়ালটা মিউ বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল।
মোনাই-ফকিরের আত্মার শান্তি হয়েছে! আর জগমোহনকে জ্বালাতে আসে না।
অবশ্য জগমোহন এখন কদাচিৎ কালো বেড়াল দেখলে চমকে ওঠেন। তবে আর মারমার বলে তাড়া করেন না। এরা তো ভূত নয়, নেহাত পাড়ার হুলো। একটু হেসে বেড়ালের ভাষায় ধমক দিয়ে শুধু বলেন, মিউ। অর্থাৎ তুই আবার কে রে? ভাগ-ভাগ!