কালো ছড়ি
মুরারিবাবু প্রতিদিনের মতো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ, এ বয়সে রোজ ভোরবেলা অন্তত একঘণ্টা হাঁটাচলা করলে হার্টের অবস্থা ভালো থাকে। আঁকাবাঁকা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায়। তারপর কিছুদূর হাঁটলেই একটা পার্ক। বার দুই-তিন পার্কটা চক্কর দিয়ে মুরারিবাবু একটা বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নেন। তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি ফেরেন।
একদিন পার্কে চক্কর দিয়ে তিনি জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা বেঞ্চে বসলেন। সবদিন অবশ্য বেঞ্চ খালি পাওয়া যায় না। না পেলে মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান।
আজ পুরো একটা বেঞ্চ খালি। মুরারিবাবু ঘড়ি দেখলেন। ছটা বেজে গেছে। আজ একটু বেশি হাঁটা হয়ে গেছে হয়তো। তাই ক্লান্তিটা যাচ্ছে না যেন। আরও মিনিট দশেক বসা যাক।
একটু পরে এক ভদ্রলোক এসে বেঞ্চটার অন্যপ্রান্তে বসলেন। একমাথা সাদা চুল। পাকানো গোঁফ। পরনে গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধাক্কাপাড় ধুতি। পায়ে চকচকে পামশু। হাতে একটা কালো ছড়ি। বেশ শৌখিন মনে হচ্ছিল তাকে। তাছাড়া মিঠে একটা সুগন্ধও টের পাচ্ছিলেন মুরারিবাবু। এ বয়সে সেন্ট মেখে মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক।
মনে-মনে হাসি এল মুরারিবাবুর। আড়চোখে ভদ্রলোককে লক্ষ করতে থাকলেন। এবার ভদ্রলোক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন। তারপর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং পাকাতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সিগারেটটা জুতোর তলায় ঘষটে নিভিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন এবং হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন।
মুরারিবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক পার্কের গেট গলিয়ে বড়রাস্তার ফুটপাতে পৌঁছেছেন, সেই সময় মুরারিবাবুর চোখে পড়ল ওঁর কালো ছড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছড়িটা তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়িটা ফেলে গেলেন যে!
ভদ্রলোক যেন শুনতেই পেলেন না। ফুটপাতের ওখানেই বাসস্টপ। প্রায় খালি একটা বাস এসে গেল এবং উনি বাসে উঠে গেলেন। বাসটা তক্ষুনি গর্জন করতে করতে জোরে চলে গেল।মুরারিবাবু ছড়িটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কালো ছড়িটা ওই ভদ্রলোকের মতোই শৌখিন বলা যায়। হাতলওয়ালা ছড়ি। হাতলে রুপোলি নকশা আছে। বাকি অংশ মসৃণ। তলার দিকটা ইঞ্চিটাক রুপোলি খাপে মোড়া।
মুরারিবাবু অগত্যা ছড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কাল মর্নিংওয়াকে গিয়ে যদি ওঁর দেখা পান, ফেরত দেবেন। কাল যদি দেখা না পান, পরশুও ছড়িটা নিয়ে যাবেন। যতদিন না ওঁর দেখা পান, ততদিন এটা সঙ্গে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুবেন।…
সেদিন রাত্রে কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুরারিবাবুর।
তারপর ঝাঝালো মিঠে সুগন্ধ টের পেলেন তিনি। প্রথমে ভাবলেন মনের ভুল। পরে বুঝলেন, মনের ভুল নয়। ঘরে সত্যিই সুগন্ধ মউ-মউ করছে। আজ ভোরবেলা পার্কের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক এই গন্ধটাই তখন টের পেয়েছিলেন মুরারিবাবু।
কিন্তু সেই সুগন্ধ এই ঘরের ভেতর কেন?
চমকে উঠে মুরারিবাবু সুইচ টিপে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। তারপর মশারি থেকে বেরিয়ে সুইচ টিপে টিউবলাইটটাও জ্বাললেন।
ঘরে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই। থাকবেই বা কেমন করে? মশার জন্য মাথার দিকের দুটো জানালা সন্ধ্যার আগে বন্ধ করে দেন মুরারিবাবু। পায়ের দিকে অর্থাৎ বাড়ির ভেতর দিকের দুটো জানালার মধ্যে একটা বন্ধ করেন, অন্যটা শুধু খোলা থাকে। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা এবং বারান্দায় যাওয়ার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। তাহলে সুগন্ধটা কি ভেতরের বারান্দা থেকে আসছে!
সেই খোলা জানালার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, দেয়ালের ব্র্যাকেটে হাতল আটকে সেই কালো ছড়িটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটা নেই।
অমনি বুক ধড়াস করে উঠল মুরারিবাবুর। ছড়িটা গেল কোথায়?
অবশ্য তত ভিতু মানুষ তিনি নন। রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই পৈতৃক একতলা বাড়িতে বসবাস করছেন মুরারিবাবু। যখন তিনি চাকরি করতেন, তখন তাঁর বিধবা দিদি এই বাড়িতে একমাত্র ছেলে নকুলকে নিয়ে থাকতেন। মুরারিবাবু রিটায়ার করার আগেই নকুলকে রেলে একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন। এতদিনে নকুল কোয়ার্টার পেয়ে তার মাকে নিয়ে গেছে। কাজেই মুরারিবাবু এ বাড়িতে একা থাকেন। স্বপাক খান। বরাবর তিনি স্বাবলম্বী মানুষ। জীবনে কখনও ভূতপ্রেত দেখেননি। ভূতপ্রেত আছে না নেই, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। অবশেষে এই বয়সে যে এমন একটা ভুতুড়ে ঘটনার মধ্যে তাকে পড়তে হবে, কোনওদিন কল্পনাও করেননি।
মাথা ঠান্ডা রেখে মুরারিবাবু ঘটনাটা বুঝতে চাইলেন। এ তো একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ভোরবেলা পার্কে দেখা সেই ভদ্রলোক জলজ্যান্ত মানুষ। রহস্য যেটুকু ছিল, সেটুকু তার আকস্মিক চলে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু এখন রহস্যটা রীতিমতো ঘোরালো হয়ে উঠল যে!
একটু পরে মুরারিবাবু টের পেলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে মশা তার দুপায়ে যথেষ্ট হুল ফোঁটাচ্ছে। এই তল্লাটে মশার উৎপাত প্রচণ্ড। দেয়ালের সুইচ টিপে টিউবলাইট বন্ধ করে মুরারিবাবু মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। তিনি এখন মরিয়া। যা ঘটে ঘটুক, তিনি গ্রাহ্য করবেন না। কিছুক্ষণ পরে মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অফ করলেন মুরারিবাবু।
মাথার ওপর নতুন সিলিংফ্যান নিঃশব্দে ঘুরছিল। সুগন্ধটা তখনও মউমউ করছিল। সেই সুগন্ধে যেন কী মাদকতা আছে। মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় ঘুমে তলিয়ে গেলেন রেলের এক প্রাক্তন গার্ড মুরারিমোহন ধাড়া…
ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভোর পাঁচটায় সেই অ্যালার্ম বাজলে মুরারিবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। অভ্যাসমতো শশব্যস্তে উঠে পড়লেন তিনি। তারপরই মনে পড়ে গেল রাত্রের সেই অদ্ভুত ঘটনার কথা। কিন্তু নাহ! এখন ঘরে সেই সুগন্ধ নেই।
আর কী আশ্চর্য, সেই কালো ছড়িটা ব্র্যাকেটেই ঝুলছে। তাহলে কি তিনি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন?
কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না মুরারিবাবু। প্রতিদিনের মতো মশারি খুলে সিলিংফ্যানের সুইচ অফ করে কালো ছড়িটা হাতে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুলেন তিনি। যথারীতি দরজায় তালা এঁটেই বেরুলেন।
পার্কে পৌঁছে চারদিকে লক্ষ রেখেছিলেন মুরারিবাবু। কিন্তু কোথাও সেই ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন না।
আজ চারবার চক্কর দিয়ে সেই বেঞ্চটার কাছে এসে দেখলেন, গাদাগাদি তার বয়সি ছ-জন বৃদ্ধ বসে আছেন। মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আজ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
তার দৃষ্টি চঞ্চল। চারদিকে তাকিয়ে সেই ভদ্রলোককে খুঁজছিলেন তিনি। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না।
অগত্যা ছড়িটা নিয়ে আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা দেয়ালে আঁটা ব্র্যাকেটে আগের দিনের মতো ঝুলিয়ে রাখলেন।…
এদিন রাত্রে মুরারিবাবু সতর্কভাবে জেগে ছিলেন। ফ্যানের বাতাসে মশারি দুলছিল। তাই ব্র্যাকেটে ঝোলানো ছড়িটাকে দেখা যাচ্ছিল না। ফ্যান বন্ধ থাকলে
টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মশারির ভেতর থেকে ওটা চোখে পড়ার কথা।
টেবিল ল্যাম্পটা আজ ইচ্ছে করেই জ্বেলে রেখেছিলেন। ক্রমে পাড়া নিঝুম হয়ে এল। গলিতে রিকশা চলাচলও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়। মুরারিবাবুর চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। তবু তিনি কষ্ট করে জেগে থাকলেন। রেলের গার্ড ছিলেন তিনি। ঘুম এলে মনের জোরে তাকে তাড়াতে পারেন। কতক্ষণ পরে হঠাৎ একটা শব্দ হল। গতরাত্রে যেমন হয়েছিল।
আজ জেগে আছেন বলে বুঝতে পারলেন, উঁচু থেকে যেন কোনও হাল্কা জিনিস পড়ে যাওয়ার মতো শব্দটা। খট খট খটাস!
তারপরই আচম্বিতে নাকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মাদকতাময় আশ্চর্য সুগন্ধ!
কয়েক মুহূর্তের জন্য অজানা আতঙ্কে তার শরীর ভারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ তিনি আরও মরিয়া। মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে মুরারিবাবু চাপা গর্জন করলেন, তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে!
তারপর টিউবলাইট জ্বেলে ব্র্যাকেটের দিকে তাকালেন। অমনি ভীষণ চমকে উঠলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা ব্র্যাকেট থেকে নিচে পড়ে গেছে।
তাহলে এই শব্দটাই কাল রাতে তার ঘুম ভাঙিয়েছিল এবং আজ রাতেও একই শব্দ তিনি শুনেছেন।
ব্র্যাকেট থেকে ছড়ি পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফ্যানের বাতাসের ধাক্কায় হয়তো ছড়িটা দুলতে-দুলতে পিছলে পড়ে গেছে।
কিন্তু এই সুগন্ধটা?
মুরারিবাবু ছড়িটা তুলে আবার ব্র্যাকেটে রাখার জন্য পা বাড়িয়েছেন, সেই সময় অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে গেল।
ছড়িটা মেঝে থেকে সটান সোজা হল। তারপর শূন্যে ভেসে খোলা জানালার গরাদের ফাঁকা দিয়ে ভেতরের বারান্দায় চলে গেল। এবার বারান্দায় চাপা খুটখুট শব্দ হতে থাকল।
মুরারিবাবু স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। একটু পরে তার মনে হল, কে যেন বারান্দায় ছড়ি ঠুকঠুক করে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
সাহস করে জানালায় উঁকি দিলেন তিনি। বারান্দার ওপরে চল্লিশ ওয়াটের একটা বাধ সারা রাত জ্বলে। এলাকায় হিঁচকে চোরের উপদ্রব আছে।
হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। উঁকি মেরে মুরারিবাবু কাকেও দেখতে পেলেন না। তবে সেই সুগন্ধটা এখনও ঘরের ভিতর মউমউ করছে। ক্রমশ মাথাটাও যেন ঝিম ঝিম করছে। চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে ঘুমে।
টলতে টলতে মুরারিবাবু আলো নিভিয়ে গতরাতের মতো মশারিতে ঢুকে গেলেন এবং খুব শিগগির ঘুমিয়ে পড়লেন।
ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজল যথারীতি। মুরারিবাবুও মর্নিংওয়াকের জন্য তৈরি হালেন। আর কী আশ্চর্য! তিনি দেখলেন, কালো ছড়িটা কালকের মতোই ব্র্যাকেট থেকে ঝুলছে। ঘরে কোনও সুগন্ধও নেই।
হ্যাঁ, স্বপ্ন ছাড়া আর কী? মুরারিবাবুর মনে হল, পরপর দু-রাত্রি তিনি একই স্বপ্ন দেখেছেন। আসলে ছড়িটার রং কালো এবং সেই ভদ্রলোক ওইভাবে এটা ফেলে রেখে হন্তদন্ত এগিয়ে গিয়ে বাসে চেপে চলে গেলেন! তাই মনে একটা খটকা বেধেছিল এবং সেই খটকা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন।…..
এদিনও পার্কে সেই ভদ্রলোককে খুঁজে পাননি মুরারিবাবু। তবে সেই বেঞ্চে তার বসার মতো জায়গা ছিল। জনা চার তার বয়সি প্রবীণ ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে ছিলেন। কালো ছড়িটা একপাশে রেখে মুরারিবাবু ভাবছিলেন, পরপর দু-রাত্রি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। আজ রাত্রেও যদি ওই স্বপ্ন দেখেন?
অমন বিদঘুঁটে স্বপ্ন প্রতিরাত্রে দেখতে কি ভালো লাগে? তাছাড়া এভাবে কালো ছড়িটার রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সত্যিই যে পাগল হয়ে যাবেন!
তার চেয়ে ছড়িটা এখানে ফেলে রেখে সেই ভদ্রলোকের মতোই কেটে পড়া যাক।
এমন তো হতেই পারে, এই কালো ছড়িটা সেই ভদ্রলোকেরও নয় এবং তিনিও এর পাল্লায় পড়ে ভুতুড়ে স্বপ্নের চোটে নাকাল হয়ে এটা এখানে ফেলে কেটে পড়েছিলেন!
মুরারিবাবু ছড়িটা ফেলে রেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু বরাত অন্যরকম।
বেঞ্চের এক ভদ্রলোক ছড়িটা নিয়ে ছুটে এলেন।–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়ি! ছড়িটা ফেলে যাচ্ছেন যে!
বেগতিক দেখে মুরারিবাবু জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। ওটা আমার ছড়ি নয়।
ভদ্রলোক যেন তেড়ে এলেন–আমার নয় মানে? আপনিই এটা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসলেন। আবার বলছেন এটা আমার নয়!
মুরারিবাবু বললেন, আপনি ভুল দেখেছেন! আমি ছড়িহাতে বেঞ্চে বসিনি। ছড়িটা ওখানেই রাখা ছিল।
এবার তর্ক বেধে গেল। ভদ্রলোক চেঁচিয়ে ডাকলেন, অবিনাশদা! রঞ্জনবাবু! আপনারা শিগগির এখানে আসুন তো!
সেই বেঞ্চ থেকে চার প্রবীণ হন্তদন্ত এসে গেলেন। তারপর কথাটা শুনে সব্বাই একবাক্যে বললেন,–পরিতোষবাবু ঠিকই বলছেন। আমরাও দেখেছি আপনি এই কালো ছড়ি হাতে নিয়ে এসে বেঞ্চে বসলেন। এখন বলছেন, ওটা নাকি আপনার নয়। ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?
সবকথা খুলে বললে হয়তো এঁরা তাকে পাগল ভেবে ঠাট্টাতামাশা করবেন। এই ভেবে মুরারিবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে। ছড়িটা দিন।
বলে ছড়িটা নিয়েই তিনি হন্তদন্ত বেরিয়ে এলেন পার্ক থেকে। এঁরা চারজন ততক্ষণে হাসাহাসি করে সত্যিই বলছেন,–পাগল! পাগল! এক্কেবারে বদ্ধপাগল!
মুরারিবাবু মনে-মনে বললেন,–এখনও পাগল হইনি। তবে শিগগির যে পাগলা হয়ে যাব, তা ঠিক। ওঃ! হতচ্ছাড়া ছড়িটা!
গলিতে ঢুকে তিনি ঠিক করলেন, ছড়িটা বরং থানায় জমা দেবেন। শুধু বলবেন, এটা তিনি আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছেন।…..
বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট করে এবং তারিয়ে-তারিয়ে এক গেলাস চা খেয়ে মুরারিবাবু ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
কিন্তু থানায় গিয়ে আরেক কাণ্ড।
থানার বড়বাবু ছড়িটা দেখেই উত্তেজিতভাবে হাঁক দিলেন, সমাদ্দারবাবু! সমাদ্দারবাবু! শিগগির আসুন।
একজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত ঘরে ঢুকে বললেন, বলুন সার!
বড়বাবু বললেন, দেখুন তো এটা আঢ্যিবাবুর সেই ছড়িটা কিনা! ওঁর স্ত্রী বলেছিলেন, একটা কালো ছড়ি হাতানোর জন্যই ডাকাতরা আঢ্যিবাবুকে খুন করেছিল। ভদ্রমহিলা ছড়িটার যে ডেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এটা মিলে যাচ্ছে। তাই না?
সমাদ্দারবাবুও ছড়িটা দেখে চমকে উঠেছিলেন। ওটা হাতে নিয়ে হাতলের নিচে রুপোলি অংশটা খুঁটিয়ে দেখার পর তিনি বললেন, হ্যাঁ সার! এই তো এখানে খোদাই করা আছে এস, কে, আত্যি। তার মানে সুশীলকুমার আত্যি।
মুরারিবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বড়বাবু তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–দেখুন মশাই! এটা এক সাংঘাতিক মার্ডার কেস। ছেলেখেলা নয়। সত্যি করে বলুন তো আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?
সমাদ্দারবাবু বললেন,-সার! আগে দেখা যাক, এটার ভেতর হীরেগুলো আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে এই ভদ্রলোককে অ্যারেস্ট করতে হবে।
বলে তিনি ছড়ির হাতলটা ঘোরাতে শুরু করলেন। মুরারিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, পঁাচ খুলে হাতলটা আলাদা হয়ে গেল। তারপর সমাদ্দারবাবু ছড়ির মাথার দিকটা টেবিলে ঠুকতে থাকলেন। কয়েকবার ঠোকার পর খুদে তিন টুকরো উজ্জ্বল কী জিনিস বেরিয়ে এল। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছিল বড়বাবুর টেবিলে। সেই রোদে তিন টুকরো জিনিস থেকে চোখ ধাঁধানো দীপ্তি ঝলমলিয়ে উঠল। মুরারিবাবু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
এবার বড়বাবু সহাস্যে বললেন, আপনি এই ছড়িটা কোথায় পেলেন, বলুন তো মশাই?
মুরারিবাবু গুম হয়ে বললেন,–আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী সার?
বললুম না? মার্ডার কেস। বড়বাবু বললেন, কদিন আগে সুশীলকুমার আঢ্যি নামে এক ভদ্রলোক এই ছড়িহাতে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তারপর একটা গলির মোড়ে তাঁর ডেডবডি পাওয়া যায়।
সমাদ্দারবাবু বললেন, স্যার! আমার মনে হচ্ছে, যে কোনও কারণেই হোক, খুনিরা এই ছড়িটা হাতাতে পারেনি।
বড়বাবু বললেন, কারণটা এবার আসামীদুটোর মুখ থেকেই শোনা যাক। ওদের হাজত থেকে এখনই নিয়ে আসুন। ওরা এবার কী বলে শোনা যাক।
সমাদ্দারবাবুর নির্দেশে দুজন কনস্টেবল হাতকড়া এবং কোমরে দড়িবাঁধা দুটো লোককে টানতে-টানতে নিয়ে এল। একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা এবং অন্যজন রোগা। সমাদ্দারবাবু তাদের পেটে বারকতক বেটনের গুতো মেরে বললেন,–বল হতচ্ছাড়ারা! এই ছড়ির জন্যই তোরা সুশীলবাবুকে মার্ডার করেছিস। কিন্তু ছড়িটা হাতাতে পারিসনি কেন?
বেটনের গুতোর সঙ্গে চুল খামচে বেজায় টানাটানির চোটে অস্থির হয়ে বেঁটে লোকটা বলে উঠল, আমরা দুজনে সঙ্গে ছিলুম বটে, তবে খুনটা করেছিল বেচুলাল, সার! ছড়িটা সেই হাতিয়েছিল। পরদিন বেচুর কাছে গিয়ে শুনি, ছড়িটা নাকি তার ঘর থেকে নিপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। ওকে খুব শাসিয়েছিলুম। বেচু মা কালীর দিব্যি কেটে বলেছিল, রাতদুপুরে খুটখুট শব্দ শুনে সে আলো জ্বেলে দেখেছিল, ছড়িটা নাকি জানলা গলিয়ে পালিয়ে গেল। আর ঘরে নাকি ঝঝালো সেন্টের গন্ধ। আপনারা বেচুকে খুঁজে বের করুন সার!
এবার মুরারিবাবু চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, একটা কথা জিগ্যেস করি। সুশীলবাবুর মাথার চুল কি সাদা ছিল?
বেঁটে আসামী ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–ওঁর পরনে কি গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি ছিল?
–আজ্ঞে।
–পরনে ধাক্কাপাড়ের ধুতি আর পায়ে পামশু ছিল?
–আজ্ঞে।
মুরারিবাবু চুপ করে গেলেন। বড়বাবু বললেন, আপনি সুশীলবাবুকে চিনতেন নাকি মশাই?
আস্তে মাথা নেড়ে মুরারিবাবু বললেন,-এবার কি আমি যেতে পারি সার?
–হ্যাঁ। তবে নাম-ঠিকানা আর একটা স্টেটমেন্ট লিখে দিয়ে যান। সমাদ্দারবাবু! এঁর স্টেটমেন্ট নিন।
কাঁপা কাঁপা হাতে মুরারিবাবু স্টেটমেন্টের তলায় নাম-ঠিকানা লিখে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ একটু থেমে গিয়ে ভাবলেন বড়বাবুকে কি বলে আসবেন, খুনি বেচুলাল ঠিক কথাই বলেছিল তার দুই স্যাঙাতকে!
কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পুলিশের আইনে ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই। তাছাড়া আসল ঘটনা খুলে বলতে গিয়ে হয়তো নিজেও এই খুনের কেসে জড়িয়ে যাবেন। পুলিশ ভূতপ্রেতের চেয়ে সাংঘাতিক। তার চেয়ে চুপচাপ কেটে পড়াই নিরাপদ।
তবে হ্যাঁ। একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সুশীলবাবুর আত্মা যেন ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। মুরারিবাবুর মতো ভালোমানুষ শেষ অবধি তার ছড়িটা থানাতে জমা না দিয়ে পারবেন না। তাই ছড়িটা ওইভাবে বেঞ্চে তাঁর কাছে ফেলে রেখে সুশীলবাবুর আত্মা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।