কামড়
‘কইরে,তোর হলো ?বাসন মাজতেই বেলা গড়িয়ে দিবি নাকি?বাসি কাপড়ের ডাই পড়ে,ওগুলো কাঁচতেই রোদ্দুর হেলে যাবে—এদিকে গরুদুটোকে এতবেলা অব্দি একমুঠো ঘাসও—বলি,এতোযে প্যাঁকপ্যাঁক করে যাচ্ছি,তা ,কানে সেঁধোচ্ছে,নাকি কালা হয়েছিসরে মুখপুড়ি’?
এওলাবিবির গলায় ভাঙ্গা কাঁসার শব্দ।যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা ,সে কিন্তু জবাব না দিয়ে দ্রুত হাত চালাতে যায় ।মাথাটা বোঁ–বোঁ ঘুরে উঠে।রাত থেকেই জ্বরে কুটছে।কপালের দু’পাশের রগদুটো দপদপ,মাথাটা যেন এক্ষুনি ছিঁড়ে পড়বে–অসহ্য ব্যথা।ওয়াক্!
একদলা বমি বেরোয় গলাজ্বালা করে ।
বাসনগুলো দু’হাতে জাপটে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই টলেপড়ে,কাল সামলাতে না পেরে পিছলে পড়ে যায়,–
বাসনগুলো ঝনঝন্ শব্দে ছত্রাকার —
শব্দ শুনে ছুটে এলো এওলাবিবি।বাসনগুলোর দুর্দশা দেখে মারমূর্তি একেবারে।এওলাবিবির ব্রহ্মতালুতে আগুন ধরে—-হায় আল্লা!কপালের নীচে ভুরুর তলে দু-দুটো চোখ থাকতেও —–মা–বাপ খেকো ডাইনি !
সর্বনাশী ,আমার হাড় মাস চিবিয়ে খেতে এসেছেগো , হায়রে ,আল্লা,এখন আমি কি করি গো ?আ্যাঁ !আমার সাধের কাঁচের বাটি দু’খানাও —দোজখেও জায়গা হবেনা তোর!—মর,মর,মরলে হাড় জুড়োবে আমার—
প্রচন্ড ব্যথায় নীল, তবুও বাসনগুলো কুড়িয়ে নিতে নিতেই ক্ষীণ কন্ঠে সর্বনাশী মেয়েটা বলে ওঠে,রাগ করো না খালাম্মা,একবারটি মাপ করে দাও ,রাত থেকে বেদম জ্বর ,গা কাঁপছে,তাই মাথাটা কেমন—–
চুপ!চুপ কর হারামজাদী।কাজের সময় সতেরো বাহানা,মিথ্যেবাদী হারামী,অসুখ না ঘোড়ার ডিম,কেবল ছল-চাতুরী।হুঁ,এওলা বিবিকে ফাঁকি দেওয়া কি এতোই সোজা ! আমার চোখ হল’গে শকুনের চোখ।সক্কাল বেলা পানি আনতে গিয়ে খানবাড়ির তেঁতুল গাছের তলে দাঁড়িয়ে রসুলের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি,হাসাহাসি—সেইসময় জ্বর ছিলোনা ?বল্ –মিথ্যে বলছি কিনা—–
ভয়ে শুকনো জিভ দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মেয়েটি করুণ আর্তনাদ করে—রসুল মিয়া যেচে কথা বল্লে,আমি–আমি চলে আসতে ছিলেম ,বিশ্বাস করো খালাম্মা–
মিয়াভাই নিজে —-
চুপ!হুঁঃ বিশ্বাস!তোকে? আর,ঈদ মোবারকের সময় ?গোয়ালের পেছনে —তোর আস্কারা না থাকলে সে হারামী কুত্তার বাচ্চা আসতে সাহস পায় ?সব টের পাই ।তোর বুঝি ছেনালি করতে মন গেছে এখন?—পিঠে ক’টা ঝাড়ুর ঘা পরলে বয়সের ভূত পালাতে পথ পাবেনা। দাঁড়া—
ভয়ে বিবর্ণ মেয়েটা কাঁপছে থরথর করে ,জবাইয়ের আগের নিরীহ পশুর মতো ।
উঠোনের কোনে পড়ে থাকা ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে যায় এওলাবিবি—-
আজ তিনদিন । বিছানায় জ্বরে বেহুঁশ মেয়েটা ।নিষ্ঠুর অত্যাচারে পিঠ ফালা- ফালা।রক্ত জমে কালচে কালশিটে পড়ে গেছে ।ক্ষুধা চেষ্টায় অবসন্ন দেহ। নাহ্ এওলা বিবির বুকের বিষ একটুও কমেনি ।ফিরেও দেখেনি একবারটি । একফোঁটা ওষুধ পাঠাবার মনুষ্যত্ববোধটুকুও নেই।দিব্যি নিজে কাঁড়ি-কাঁড়ি নির্বিকার গিলেছে। পান-দোক্তা চিবিয়েছে । অসহায় নির্যাতিতা মেয়েটার চোখের জলে বালিশ ভিজেছে শুধু ।আল্লাহ্ র প্রতি নিদারুণ অভিমানে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে আর ইন্তেকাল কামনা করেছে। সর্বাঙ্গে সাপের মতো বিষ ব্যথা নিয়ে আচ্ছন্নের মতো নেতিয়ে পড়েছিলো । ছ্যাচড়া বাঁশের দরজার আড়াল ঠেলে নওশাদ ঢুকলো ।
–কেমন আছিস ?জ্বর কমেছে ?
কাছে বসে নওশাদ ফিসফিস্ করে। জ্বরতপ্ত চোখ মেলে তাকায় মেয়েটা ।কেউ যেন মরিচ ডলে দিয়েছে,অব্যক্ত কষ্টের দলা কুন্ডলী পাকায় তার কন্ঠনালীতে।তীব্র বিতৃষ্ণায় মুখ ঘোরায় অন্যদিকে । নওশাদ লুঙ্গির কোঁচা থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করে–এ্যাই দ্যাখ,এটা পানিপড়া ।তোর জন্য এনেছি, ফকিরগ্রামের পীরবাবার কাছ থেকে ,এটা দু’বেলা খাবি,দাগ দেওয়া আছে,একদাগ করে,নে্ ভালো হয়ে যাবি,তোকে আমি খুব ভালোবাসি,তোর জন্যে রাতে আমার ঘুম আসেনা চোখে–কবে যে তোকে —– এওলাবিবির চিল-চীৎকার কানে আসে —-নওশাদ ! গরুগুলোকে মাঠ থেকে আনতে যাবিনে?
ত্রস্তে এদিক –ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পনে কেটে পড়ে নওশাদ ।মা এওলাবিবিকে যমের মতো ভয় তার।
দু’চক্ষে দেখতে পারেনা নওশাদকে। তবুও নিতান্তই নিরুপায় হয়ে পানিপড়াটা নিতে হয়েছে ওই দু’চক্ষের দুশমনটার হাত থেকে ,জীবনের তাগিদে । আত্মরক্ষার দূর্বার ইচ্ছায় ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ,তেমনিভাবে।
নওশাদের গায়ে পড়ে উপকার করতে আসার পিছনে লুকানো উদ্দেশ্যটা আঁচ করার চেষ্টায় আকাশ-পাতাল ভাবে,সাথে সাথেই এওলাবিবির রুদ্রমূর্তি ও নির্দয়তার কথা মনে পড়তে চোখ পানিতে ভরে ওঠে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে একসময় দুঃখিনী মেয়েটা পানকৌড়ির মতো ডুব দেয় ——-
মা–জানরে ,ও মাজান ,দ্যাখ কী সুন্দর জামা আনছি ।আয়,পরিয়ে দিই,এটা পরলে তোকে বেহেস্তের হুরীর মতো লাগবে , খুশিতো ?
—খু-উ-ব।কী সোন্দর জামা গো বাপজান !
মেয়ের মুখে আলো দেখে বাপ হাসে ,—আরও আছে, এই নে্–চুড়ি,ক্লিপ ,ফোঁটা ,প্লাস্টিকের রান্নাবাটি—–
—হায় আল্লা !,স-ব আ-মা–র !
—হ্যাঁরে,সব তোর । কিন্তু আমাকে কিছু দিবিনা ?দু’হাতে বাপের গলা জড়িয়ে গালে খুশির সোহাগ আঁকে বাপ–সোহাগী মেয়েটা ।
ফাতেমার টাকা-পয়সা নয়ছয় অপছন্দ ।তাই মুখখানায় বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আচ্ছা,তোমার কি আক্কেল -বুদ্ধি নেইগো?সেদিন না পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সিল্কের জামা আনলে,আজ আবার!হুঁঃ পয়সা থাকলে মানষে্ কুকুর–বেড়ালের জন্মদিন করে,শাদি দেয় ,শুনেছি বটে—-কিন্তু তোমার সেরকম জমিদারী আছে বলে তো শুনিনি।তাছাড়া, মেয়েমানুষের কপাল বলে কথা,কোন ঘরে যাবে,কার হাতে পড়বে,তাই একমাত্র আল্লাহই জানেন —- সচরাচর ,ফাতেমার ফরফরানি কানেই তোলে না করিম মিয়া । কিন্তু আজ মেয়েটার জন্মদিন।একটামাত্র মেয়ে তার!বাজার থেকে ফেরার পথে কুতুব উদ্দিনের দোকানের শো-কেসে ডল-পুতুলের গায়ে জামাটা দেখতেই মেয়ের মুখটা মনে পড়ে গেলো।আর তখনি— খিঁচিয়ে ওঠে করিম—-দ্যাখ্ ফাতেমা,বেশি বকর বকর করিস না,তোর বড্ড সাহস,আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস? তোমার আক্কেল থাকলে কি আর এমন করে—
চুপ !,আমাকে আক্কেল শেখাতে এলে তোর আক্কেল দাঁত আমি উপড়ে ফেলবো ।একটা মাত্র মেয়ে আমার —তোর কিরে?তোর বাপের পয়সায় এনেছি নাকি ? কী?আমার দাঁত —–হায় আল্লা, তুমি আমার বাপ তুলে গাল দিলে ? আমাকে ছোটলোকের মতন তুই–তোকারি——
গর্জে উঠে তেড়ে আসে করিম মিয়া—বেশ করেছি,সরে যা,আমার চোখের সামনে থেকে,নইলে——
ফাতেমাও ফোঁস তোলে,—নইলে কী করবে শুনি ?
কী করবো? তবে রে,লাথি,হ্যাঁ,লাথি মেরে কোমর ভেঙ্গে দেবো ।দৃপ্ত কন্ঠ করিমের।নাকের পাটা ফুলে ওঠে ।
ফতেমা সুন্দরী ।ভরা নিটোল যৌবন ।তবে,একটু মেজাজি ।বাপের বিষয়-আষয় আছে বলে একটু অহংকারীও।করিম মিয়ার নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার । তাই দেখতে শুনতে চোখে পড়ার মতো নাহলেও ফাতেমা সুখে থাকবে —এই ভেবেই ফাতেমার বাপজান এখানে মেয়ের শাদি ঠিক করে ।
করিমের ও কোন অভিভাবক ছিলো না,নিজেই পছন্দ করে নিকা করেছিলো ফাতেমাকে ।দু’হাজার টাকা দেনমোহরে।ফাতেমার সব ভালো, কিন্তু এতো হিসেবী হওয়ায় করিমের অসন্তোষ্টি। স্বামীর সোহাগে অভ্যস্ত ফতেমা।আজ এমন কটুক্তিতে অভিমানে বুক ভরে যায় ।চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে,–ওই একফোঁটা মেয়ের জন্য অকথা–কুকথা বলতে পারলে? জিভ খ’সে পড়লোনা ?কেন,মেয়ে কি একা তোমার মিয়া? আমি কি হিংসে করে বলেছি ?অকারণ অপচয়—ঠিক আছে ,আর কক্ষনো বলবো না ।থাকো মেয়ে নিয়ে–রাতে বেহায়ার মতো ডাকতে যেয়ো না-আমাকে যা নয় তাই–আল্লারে–
রাতের প্রসঙ্গ উঠতেই করিম কাৎ ।প্রলেপ দিতে চেষ্টা করে ,আহা!আমি কি তাই বলছি ,ও ফতুয়া,রাগ করিস কেন ?তোকে ভালোবেসে তুই করে বলিরে ,আল্লার কসম লাগে,বিশ্বাস কর।তবে, তুই তো জানিস,এই মেয়ে হল’গে আমার কলজে,একে কিছু বল্লে আমার মাথায় আগুন জ্বলে,দিশে থাকেনা ।কখন কি বলতে কি বলে ফেলি।কতো শখ করে জামাটা —ওরে মানাবে ভালো—-ওকি!চললি কোথায়?ও আমার জান, সোহাগের চাঁদবদনী,একটু এদিকে শোন না ,আর কক্ষনো তোকে—আয়—-
আঁচল ধরে টান দিতেই করিমের লোমশ বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফাতেমা।গ্রীবাতে অভিমান আঁকে—আহ্ ছাড়ো—-
তোরে ছাড়লে মরে যাবো রে ফতু,জংলি শাড়িখানায় তোকে যা দেখাচ্ছে না,বুকে আমার টগবগ করে পিরিতির আগুন ফুটছে,চল্ চল্,ঘরে চল—–
করিম পাঁজাকোলা করে ফাতেমাকে ঘরের দিকে নিয়ে যায়—-
সোহাগের ঠেলায় আচ্ছন্ন ফাতেমা শরমে লাল পলাশ —হায় আল্লা!ছাড়ো না,দিনদুপুরে এসব–ছিঃ রাতে-
না,,না,রাতে—রাতের জন্যে সবুর সইবে নাগো পরাণসখি—–
ফাতেমার আপত্তি করার আগেই করিমের তপ্ত ঠোঁট তার ওষ্ঠে চেপে বসে—-
গ্রামে মড়ক লেগেছে।সবাই আতঙ্কে তটস্থ। প্রতিদিনই দু-চারটে করে পটল তুলছে।গ্রামবাসীরা কলেরার আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার বাঁচার জন্যে অনেকে পালাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। শোনামাত্র সবার নিষেধ সত্বেও করিম ছুটে গেলো গর্দারাশি গ্রামে ।সম্পর্কীয় চাচাতো ভাই নঈমের সেবা করছিলো করিম মিয়া । নঈম তার আবাল্য সহচর।চাচার ইন্তেকাল হয়েছে কবেই ।চাচি গেছেন বাপের বাড়ি,ভাইঝির বাচ্চা হবে ।
নঈম অসুস্থ হতেই ও -বাড়ির ফজলুমালী ছুটে এসেছিলো ,–ভাইজানরে বাঁচান গো–খালি পায়খানা আর বমি–খালি আপনার নাম নিতাছে——-
শোনামাত্র—–ফাতেমা ,আমি চললাম,সাবধানে থাকিস তোরা —-
করিম একথা বলেই ফজলুর সাথে গাড়িতে ওঠে। নঈম সে–যাত্রা নতুন করে জীবন লাভ করলো বন্ধু ও ভাইজান করিম মিয়ার দৌলতে । পাঁচদিন লাগাতার রাত্রি জাগরণ ও কলেরা রোগীর মল-মূত্র-বমি ঘেঁটে ঘেঁটে করিম ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরেই কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে । রাতে বেদম জ্বর নামলো ।সারারাত ফাতেমা ও ঘুমায়নি । পরদিন সকাল হতে কলেরার লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতেই ভয়ে বুকটা শুকায় ফাতেমার ।চোখে আঁধার নামে । পাশের বাড়ির কেয়ামত চাচার ছেলে রহিমকে মনে পড়ে ।রহিম বাড়ি নেই ।ইলাফুফু বেড়িয়ে এলো
–ভাইজান তার খালার বাড়িতে গেছে,সালেহা খালার জ্বর
——-আমারে ঘর দেখাশোনা করতে বলেছেন। ফাতেমা পাগলের মতো ছোটে ।পীরের মাদুলি, পানিপড়া,দরগার ধূলোপড়া –কিছুই বাদ থাকলোনা । দু’বেলা কায়মনে নামাজ পড়ে,আযান শোনে,রোজা রাখে–আমার মিয়া সাহেবরে ভালো করে দাও আল্লাহ, আমি শিন্নি দেবো তোমারে—–
রান্নাঘরের বিছানায় তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলো করিম মিয়ার কলেজের টুকরো মেয়েটি।নাজু–নাজমা খাতুন।
করিমের স্তিমিত ডাক কানে আসে—ফতু,ফা–তে–মা-
ফাতেমা উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায়—কিছু বলবে আমায় ?কষ্ট হচ্ছে?পানি দেবো?হা–করো—–
করিমের জীবনদীপ নিভু নিভু।বহুকষ্টে যন্ত্রণা ভুলে উচ্চারণ করে–না—জু –কোথায় ?ওরে আন্—-
কাঁদতে কাঁদতে ফাতেমা নিয়ে আসে নাজু–নাজমাকে।
ছোট্ট নাজু বলে ওঠে ,বাপজান, তুমি ওষুধ খাও নাই ? পানি খাবে ?
রোগক্লিষ্ট করিমের দু’চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে,ওরে দেখিস,তোদের ভাসিয়ে গেলামরে ফতু —-
ফাতেমা আছড়ে পড়ে করিমের উপর দুঃসহ বেদনায়।
হায় আল্লা!হায়রে ,আমাদেরকে রেখে তুমি কোন বেহেস্তেও গেলে গো —-তোমার কলজে নাজুরে ছেড়ে কেমন করে থাকবে গো —একী সর্বনাশ হলোরে—-
ভাগ্যের মার আর কাকে বলে ! করিমকে কবর দেবার সাতদিনও কাটলোনা ,ফতেমা বিছানা নিলো ।স্বামীর কুলে কেউ নেই ,বাপের কুলেও।ফাতেমার মায়ের ইন্তেকাল হবার পর বাপজান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন।ফাতেমার সৎমা কিছুতেই সহ্য করতে পারতো না বলে পারতপক্ষে সেও বাপের বাড়ি যেতোনা ।সৎভাই ফয়সল ও মায়ের স্বভাব পেয়েছিলো ।বাপজান ইন্তেকাল করলে ফাতেমার বাপের বাড়ির পাটও চিরতরে ছুটে গেলো ।
অসুস্থ ফাতেমার মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ে ।সাতবছরের কচি মেয়েটার কথা ভেবে পাগলের মতো ছটফট করে,–হায় আল্লা!মেয়েটাকে কে দেখবে? তুমি উপায় করে দাও–
প্লাস্টিকের রান্নাবাটি নিয়ে আপনমনে খেলছিলো পাকা রাঁধুনির মতো নাজমা,মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,মা!খিদে পেয়েছে?আমার রান্না হয়ে এলো,একটু বসো ,কেমন?কাঁদবেনা কিন্তু—-
ফাতেমার চোখের কোণে অতি করুন বেদনার ধারা নামে,না ,মা,কাঁদবোনা । তুমি রান্না করে আমাকে খেতে দিও—-
ফাতেমার মুখের কথা শেষ হবার আগেই বাইরে কার গলার আওয়াজ শোনা গেলো–ভাবি!আমারে আপনি ডাকছিলেন?এখন কেমন আছেন আপনি ? পাশের বাড়ির কেয়ামত চাচার ছেলে রহিম,মাত্র কালই ফিরেছে ।সকালে জব্বার জেলে এসেছিলো মাছ নিয়ে ।তাকে দিয়েই রহিমকে খবর পাঠিয়েছিলো ফাতেমা। হ্যাঁ।আমার শরীরের চেয়ে এখন নাজুর চিন্তাই—রহিম,আমার একটা উপকার করে দেবে ? নিশ্চয়ই।কি করতে হবে বলুন ভাবিজান ?
খবর পেয়েই পাশের শহর থেকে ছুটে এসেছিল দূর–সম্পর্কের বোন এওলাবিবি।
—একি অবস্থা তোর ফাতেমা আপা ?হায় আল্লা!তোর এ অবস্থা ,তা কেন তুই আগে জানালিনে?করিম ভাইজানের ইন্তেকাল হলো –আমরা তো কিছুই জানিনা–যাকগে,ওমা!কী সুন্দর তোর মেয়ে আপা!আয় ,আমার কাছে,খালা হই তোর–আয়,কি নাম তোর?
–নাজু –নাজমা খাতুন।টেনে টেনেবলেছিলো মেয়েটা । এওলাবিবি দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো নাজমাকে । মৃত্যুপথযাত্রিনী ফাতেমাকে কথা দিয়েছিলো,দেখবে সে ,বোনটি হিসেবে নয় আত্মজার মতো । পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুঝেছিলো ফাতেমা।
তারপর ! দীর্ঘ দশ –দশটি বছর ।
কপাল দোষে নাজমা এওলা বিবির বিনি পয়সার বাঁদী।উদয়াস্ত খাটুনির বদলে চাট্টি পান্তাভাত ,কখনও– সখনও উচ্ছিষ্ট তরকারি জোটে ।রাতে ছেঁড়াকাঁথায় শুয়ে টালির ছ্যাঁদা দিয়ে অপলক চাহনি মেলে দেয়—দূর আসমান গাঙের বুকে।আসমানের হাজারো তারার ভিড়ে হাতড়ে বেড়ায়—
অস্পষ্ট হয়ে আসা দুটো অতিপ্রিয় মুখের ছবি ।
এওলা বিবির বখাটে ছেলে নওশাদ ।
বছর আঠারোতেই গাঁজা-ভাং-মদ রপ্ত করে ফেলেছে ।চরিত্র দোষও আছে ।পাড়ায় ওর নামে অনেক কেচ্ছা ।ওর চোখের সামনেই নাজমা লাউডগার মতো বেড়ে যৌবনবতী হয়েছে।এওলা বিবির চোখে চোখে রাখতে ।নাহলে, এতোদিনে ওই পুষ্ট দেহটা—-ফাঁক পেলেই শকুনের লোলুপ চোখে গিলে খেতে চায় সতেরো বছরের মেয়েটাকে ।
ঘৃণায় রি-রি করে নাজমার মন ।খালাকে বলতে গিয়েও সাহসে কুলোয়না ।নওশাদ ভাইজান কেবল ছোঁকছোঁক করে ,সুযোগ পেলেই হাত ধরে টান দেয়।নাজমা তাই সন্ত্রস্ত।
এ্যাই নাজু ,আমার হীরামন পাখি !আমারে দেখলে অমন সিঁটিয়ে থাকিস কেন? তোরে দেখলে আমার পরানে কুছ-কুছ করে, তুই বুঝিস না ?
ছিঃ ভাইজান ,এসব বলতে লাজ লাগেনা আপনার ?
নওশাদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় ।সে -দৃষ্টির ভাষা অতি জঘন্য ।
নাজমার মনে হয়,নওশাদ বুঝি কাপড়ের মধ্য দিয়েও ওর উদোম শরীরটা চাটছে ।মাগো ! ভয়ের হিমস্রোত নামে শরীর থেকে পা পর্যন্ত।সেই থেকে, পারতপক্ষে শয়তানটাকে এড়িয়েই চলতো নাজমা খাতুন ।
খালার নয়নের মণি ওই ছেলে ।এমনিতে বকাঝকা করলেও নাজমার নালিশ শুনে পেটের ছেলের বিচার করবে না কখনও-ই।উল্টে তাকেই শাপমন্যি করে মারধর করবে সাধ মিটিয়ে।তবে ,রসুলকে না বলে পারেনি ।
রসুল কোন এক মাড়োয়ারি দোকানে কর্মচারী ।ফর্সা,ছিপছিপে চেহেরা। খুব ফিটফাট।রসুলের বাপ তোতা মিয়া ও মা ফারহা দুজনেই নাজমাকে পছন্দ করেন ।এওলাবিবির মুখে লাগাম নেই ,নইলে প্রতিবাদ করতেন মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ।রসুল ও নাজমা ছোটবেলা থেকেই——-
নাজমার মুখের রং বদলে যায় রসুলকে দেখে ।বুকে একরাশ ভালোবাসার লাল গোলাপ কুঁড়ি মেলে সুবাস ছাড়ে।থরথর করে বুকটা কাঁপে,দু’চোখের পাতায় স্বপ্ন নামে।
ক্ষ্যাপা মোষের মতোই গর্জে ওঠে রসুল ।
–কী? এক্ষুনি ওর টুঁটি টিপে ধরবো ।এতো লোচ্চা হারামজাদা!,দোজখের কীট,চোখ গেলে দেবো না? এক্ষুনি যাচ্ছি—–
নাজমা ভয়ে কেঁদে ফেলে,নাহ্ তুমি যেতে পারবেনা ।খালাম্মার কানে গেলে আমাকে কেটে ফেলবে—
রসুল রেগে যায় ,তোমার খালাম্মাকে আমি ভয় পাইনা,
তুমিই বা ভয় পাবে কেন ? আর ক’দিন পরই তো বাপজান তোমাদের বাড়ি নিকার কথা বলতে যাবে।বলো তো আজই আমি নিকা করতে রাজি—বলো নাজু ,চুপ থেকো না ।
রসুলের বাপজান নিকার প্রস্তাব দিতে গেলে যে খালা খুশি হবেনা ,সেকথা নাজমা ভালো করেই জানে । তবুও খালাকে না বলে রসুলের সাথে নিকা বসবে!
না,না—-
কী ভাবছো বলো তো?এখন ভাবার সময় নেই ।শেষপর্যন্ত যদি ওই শয়তানটা তোমাকে—–নাহ আজ একটা হেস্তনেস্ত—–
শিউরে ওঠে রসুলের পথ আটকায় নাজমা খাতুন।
–না,না, আল্লার কসম লাগে,রসুল ভাই,তোমার কিছুই করতে হবেনা,শেষে কি আমার জন্যে হাজতবাস করবে?
ছিঃ তারচে’যা করার আ–আমিই করবো–আমি আজই খালাকে সব বলবো–তুমি ভেবোনা,বাড়ি যাও—-পানির কলসী কাঁখে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে নাজমা ।
ক’দিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি। শ্রাবণ মাসের আসমানটা মনের সুখে পানি ঢেলে চলেছে।এওলাবিবি আল্লার এই অন্যায় অবিচারে ক্ষুব্ধ।উঠোনে হাঁটুজল।বাগানের শিম-কুমড়োর গাছগুলি নির্ঘাৎ পচবে ।দুপুরে রোদ উঠতে উঠোনের জল নেমে গেলো।বিকেলের দিকে এওলাবিবি সেজেগুজে কুলখানির নেমন্তন্নে গেলো সরকার বাড়িতে।না গেলে মুখ থাকেনা। নওশাদ বাড়ি নেই।কোনো এক বন্ধুর শাদি বলে এওলাবিবির সঙ্গে না গিয়ে ঢের আগেই বাবু সেজে গা’য় আতর ছড়িয়ে বেড়িয়ে গেছে। নাজমা অনেক চেষ্টা করেও সেদিনের কথাটা খালাকে বলতে পারেনি।বাঘের মতো ভয় করে সে খালাকে।সামনে এলেই আলজিভ কাঠ।তবে,আজ নাহোক,
একদিন তো বলতেই হবে—-যদিও খালাম্মা সহজে বিনিপয়সার বাঁদী ছাড়তে রাজি হবেনা,তবু—–
খালাম্মা পইপই বলে গেছে,তার ঘরখানা আয়নার মতো সাফ হওয়া চাই,রাতের রান্নাটাও সারতে বলেছে।
ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে খুব যত্ন করে ঘর মুছছিলো।মুখে গানের কলি,’বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না,বন্ধু তিনদিন———-
ধূর্ত শেয়ালের মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল নওশাদ।আসলে,বিয়েবাড়ি আদৌ যায়নি সে,মাকে ফাঁকি দিতেই মিথ্যে কথাটা বলেছিলো।নইলে মা নাজমাকে ফেলে কিছুতেই যেতো কিনা সন্দেহ। তক্কেতক্কে ছিলো ,
এওলাবিবি বের হয়ে যেতেই খুরশিদের দোকান থেকে গাঁজা টেনে তবেই——
আচমকা ঘাড়ে গরম শ্বাসের ছ্যাঁকা,আতরের গন্ধ !
চমকে ঘুরে তাকাতেই নওশাদের বলিষ্ঠ দু’বাহু নাজমাকে জড়িয়ে ধরে।
হাত-পা ছুঁড়ছে নাজমা নিজেকে ছাড়াতে দস্যুটার হাত থেকে——আমাকে ছেড়ে দেন মিয়াভাই ,ও খালা গো—-
চুপ কর খানকি,জানে মেরে ফেলবো তোকে—-
নাজমা ভয়ে চেঁচাতে গেলো, কে আছেন গো বাঁচান–
নওশাদ তখন উন্মত্ত।অভাবিত সুযোগ পেয়েছে ।
উষ্ণ ঠোঁট দিয়ে নাজমার কথা বন্ধ করে দেয় সে।হাতের কাছে নরম–নধর নারী মাংস।বহুদিনের ইপ্সিত বুভুক্ষার পর আগ্রাসী ক্ষুধার আগুন লেলিহান—–
নওশাদের আক্রমণে ব্লাউজ ছিন্নভিন্ন, কাপড়টাও একটানে ফেলে দিতে সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা নাজমা দুর্বার লজ্জায় মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে ফুঁপিয়ে—হায় আল্লারে—
মাটিতে গড়াগড়ি ,ধস্তাধস্তির ফাঁকে সহসাই খালাম্মা এওলা বিবির খাটের নীচে ধারালো বটিখানার উপর চোখ পড়ে যায় নাজমার—–
নওশাদ কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই নাজমার হাতে ধরা বটিখানা ঝলসে ওঠে ক্ষিপ্ত আক্রোশে! মোক্ষম কামড় বসায় ———-