Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিশু চমকে উঠল

বিশু! ওঠ, ওঠ। খাবি না? ভাত জুড়িয়ে যাচ্ছে যে বাবা! আয় আমি খাইয়ে দিই।

বিশু চমকে উঠল। তারপর ধীরে চোখ খুলল বিশ্বরূপ। মা নেই, বাবা নেই, দাদু নেই, কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই। মাঝে মাঝে এক অচেনা জগতের মধ্যে জেগে ওঠে বিশ্বরূপ। এরা কারা? এ কোথায় এল সে?

রাত বারোটার কাছাকাছি। ট্রেন এখনও বর্ধমানে পৌঁছোয়নি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ধৈর্যহারা যাত্রীরা গা ছেড়ে দিয়েছে। জল ফুরিয়েছে, খাবার নেই। শুধু ক্লান্তি আছে, আর বিরক্তি, আর রাগ। নিল রাগ। উলটোদিকের স্বামী আর স্ত্রীতে স্বাভাবিক বনিবনা নেই, ট্রেনের গর্দিশে মেজাজ আরও বিগড়ে গেছে। অন্তত চারবার চাপা ঝগড়া হয়েছে দু’জনের। এখন কথা বন্ধ। ভদ্রলোক বাঙ্কে শুয়ে ঘুমোচ্ছন। ভদ্রমহিলা নীচের সিটে মেয়ের পাশে শোওয়া, তবে ঘুমোচ্ছন কি না বলা শক্ত। একটু আগে বিশ্বরূপ দেখেছে, ভদ্রমহিলা তাকে চোরা চোখে লক্ষ করছেন। বেশ সুন্দরী, তবে বিলম্বিত ট্রেনের বিরক্তিকর এই যাত্রায় সৌন্দর্যটা ধরে রাখতে পারছেন না।

কামরায় এখন কোনও কথাবার্তা নেই। কথাও ফুরিয়েছে বোধহয়। ট্রেন আট ঘণ্টার ওপর লেট। স্টেশনে পৌঁছেও অনেকে বাড়ি যেতে পারবে না। খাবার পাবে না। লটবহর নিয়ে বসে থাকতে হবে প্ল্যাটফর্মে। বেশিরভাগ লোকেরই আর নতুন করে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। প্রতিবাদ নেই। প্রতিকার নেই। তারা অগত্যা ঢুলছে। তবু এরা ঘরে ফিরবে, যখনই হোক। ট্রেন লেট হওয়া ছাড়া আর তেমন কোনও বিপদ হবে না এদের।

বিশ্বরূপ বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটোল। এক ঝলক নিজের সিক্ত বিষণ্ণ মুখখানার দিকে তাকাল। লোকে বলে, এ মেলাঙ্কলিক ফেস। কেউ কেউ আড়ালে তাকে উইপিং অফিসার বলে উল্লেখ করে। নিজের মুখে কিছুই খুঁজে পায় না বিশ্বরূপ। তার কেবল একটা কথাই মনে হয়, সে এক সাজানো মানুষ। সে প্রতিপক্ষের উদ্যত অস্ত্রের সামনে এগিয়ে দেওয়া খড়ের পুতুল। সে এক অন্তহীন ক্যাসেট, যাতে অন্তহীন ক্রস-একজামিনেশন, অন্তহীন জেরা, অন্তহীন তথ্যাবলী রেকর্ড করা হয়। সে এক বিবেকহীন ভাড়াটে খুনি। মাস-মাইনের বিনিময়ে সে ফর ল অ্যান্ড অর্ডার অস্ত্র প্রয়োগ করে। তার নিশ্চিন্ত ঘুম বলে কিছু নেই, কানের কাছে ফোন রেখে পোশাক পরা অবস্থায় সে উৎকর্ণ হয়ে ঝিমোয় মাত্র। ফোন বাজলেই ছুটতে হয় এখানে সেখানে। রোবটের মতো দীর্ঘ রিপোর্ট টাইপ করে ফাইলবন্দি করতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে একত্র হলে তারা চারজন। ক্লান্ত অফিসার চুপচাপ বসে থাকে। কথা আসে না। ভাব আসে না। পারস্পরিক সিগারেট বিনিময় পর্যন্ত ভুলে যায় তারা।

অ্যাসাইনড টু কিল! না কি অ্যাসাইনড টু বি কিলড! কে জানে কী। তবে বিশ্বরূপ জানে সে গুপ্তঘাতকের প্রিয় টার্গেট। কে আগে কাকে দেখতে পাবে তা ঈশ্বর জানেন। ঈশ্বর জানেন কে আগে গুলিটা চালাবে। ঈশ্বর জানেন কার টিপ আসল মুহূর্তে থাকবে কতটা নির্ভুল।

গৃহস্থদের কি হিংসা করে বিশ্বরূপ? একটু করে। ওরা বেশ নিজেদের নিয়ে মেতে আছে। এই যে শ্যামল, তার সুন্দরী স্ত্রী বকুল, শিশু মেয়েটি ট্রেন লেট হওয়া ছাড়া, বাড়ি পৌঁছোনো ছাড়া এদের কোনও সমস্যাই নেই। এদের চলার পথে কেউ এদের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করছে না।

বিশ্বরূপ সিটে ফিরে এল। বকুল উঠে বসল উলটোদিকের সিটে। নিজের চুল ঠিক করতে করতে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, এত রাতে আপনি কোথায় গিয়ে উঠবেন?

বিশ্বরূপ সামান্য অবাক হয়ে বলে, আমি! ওঃ। আমার জন্য কোনও হোটেলে একটা রুম বুক করা আছে।

হোটেলে কেন? কলকাতায় আপনার কোনও আত্মীয় নেই?

না।

আত্মীয়রা সব কোথায়? দিল্লিতে বুঝি।

না। আমার তেমন আত্মীয় বলতে কেউ নেই।

শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় তো আছে!

বিশ্বরূপ সামান্য হাসল, আমার বউ বা শ্বশুরবাড়িও নেই।

আপনার তো সবই নেই দেখছি।–বলে বকুল একটু হাসল, তা হলে আছেটা কী?

স্মৃতি আছে। আর আছে কাজ।

ভাইবোন ছিল না আপনার?

না। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।

বকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, খুব আদরের ছিলেন বুঝি! এখন তো যত্ন করার কেউ নেই, কষ্ট হয় না?

না। কষ্ট কেন হবে?

আমি তো বারো বছর বয়স অবধি মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলাম। তখন আদরটাকে মাঝে মাঝে অত্যাচার বলে মনে হত। গুচ্ছের খাবার গিলতে হত জোর করে, গাদা গাদা জামাকাপড় খেলনায় আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসত, একটু অসুখ হলেই দু’জন-তিনজন ডাক্তার চলে আসত, ওষুধ খেয়ে খেয়ে ড্রাগ-অ্যাকশন হয়ে আমার নর্মাল স্বাস্থ্যই নষ্ট হতে বসেছিল। প্রাইভেট পড়ানোর জন্য তিনজন মাস্টারমশাই আর দু’জন দিদিমণি ছিলেন। গানের স্কুলে যেতে হত, ব্যায়ামের স্কুলে যেতে হত, আঁকা শিখতে যেতে হত। একা আমাকে যে কত কিছু করতে চেয়েছিল আমার মা আর বাবা। বারো বছর যখন আমার বয়স তখন হঠাৎ আমার দু’টি যমজ ভাইবোন হয়। ওরা হওয়ার পর আমার ওপর থেকে অ্যাটেনশন সরে গিয়ে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আপনারও কি সেরকম ছিল?

বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে স্মিতমুখে বলে, না। আমরা ছিলাম গরিব রিফিউজি। বনগাঁর কাছে একটা গাঁয়ে থাকতাম। আদরটা ঠিক আপনার মতো টের পাইনি। তবে

থেমে গেল বিশ্বরূপ। বললে এ মেয়েটা বুঝবে না। সে কী করে বলবে যে, তাকে আদর করত শরতের নীল আকাশ, দিগন্ত থেকে ছুটে আসা বাতাস, রাতের নক্ষত্র, মাঠের ঘাস, জ্যোৎস্নারাতের পরি। তাকে আদর করত জোনাকি পোকা, ঝিঁঝির ডাক, কালো পিঁপড়ে। তখন ভগবান ছিল। মা ছিল। দাদু ছিল। বাবা ছিল। রুকুদি ছিল।

সেই গাঁয়ে কেউ নেই এখন?

না। কেউ নেই।

বাড়িটা?

ঠোঁট উলটে বিশ্বরূপ বলে, সামান্য টিনের ঘর। হয়তো উড়ে-পুড়ে গেছে। আমি আর যাই না।

কেন যান না? শত হলেও দেশ তো! আমাদেরও যশোরের কোথায় যেন দেশ ছিল। মা-বাবা সারাক্ষণ দেশের কথাই বলে। আমি জন্মাই কলকাতায়। দেশ নেই বলে খুব খারাপ লাগে।

কেন, কলকাতাই তো আপনার দেশ!

মোটেই না। কলকাতাকে কক্ষনও দেশ বলে মনে হয় না।

কেন মনে হয় না? কলকাতার কী দোষ?

কী জানি কেন! থাকতেই ভাল লাগে না। এ যেন অন্যের শহর। আমরা কেমন যেন। ভাড়াটে-ভাড়াটে হয়ে আছি।

বিশ্বরূপ অর্থহীন ফ্যাকাসে হাসি হাসল।

মাটির গন্ধ না থাকলে কি কোনও জায়গা আপন হয়, বলুন? আমার খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে গাঁয়ে গিয়ে থাকতে। মাটির ঘর করব, বেশ বড় একটা বাগান থাকবে, তাতে অনেক গাছপালা। আমার গাছপালার ভীষণ শখ। আমার হাজব্যান্ডকে কত বলি, ও শুনে কেবল চটে যায়। বলে, দূর দুর, গাঁয়ে আজকাল ভীষণ পলিটিকস, থাকতে পারবে না। কত বুঝিয়ে বলি যে, আমরা তো সবসময় থাকতে যাচ্ছি না, মাঝে মাঝে গিয়ে থাকব। কতই বা খরচ হবে গাঁয়ে মেটে বাড়ি করতে? ও বলে, ও বাবা, না থাকলে সব বেদখল হয়ে যাবে। আচ্ছা, আপনাদের গ্রামটা কেমন ছিল?

বিশ্বরূপ ব্যথাতুর মুখে শূন্যের দিকে চেয়ে ছিল। অবশ্য সামনে শূন্য বলে কিছুই নেই। একটা আবদ্ধ কামরায় লটবহর, মানুষজন। তবু হঠাৎ কামরাটা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখ থেকে। সামনে জলভরা বর্ষার মাঠ। সেদিন বাড়িতে রান্নাই হয়নি। একপেট খিদে নিয়ে কাগজের নৌকো ভাসাচ্ছিল বিশু। তার তিনটে নৌকোর কোনওটাই শেষ অবধি সোজা হয়ে ভেসে রইল না। কেতরে পাশ ফিরে রইল। তারপর ঝমঝম বৃষ্টিতে ডুবেই গেল হয়তো। বর্ষার মাঠের ধারে একটু ভাঙা জমিতে কাকের মতো ভিজতে ভিজতে বসে রইল বিশু। পেটের খিদে থেকে রাগ উঠে আসছে মাথায়। এই বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো কি ভাসে? ভাসে না, বিশু জানে। কিন্তু কেন রাগ হচ্ছিল? রাগের চোটে সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল তিড়িং করে। তারপর আর কী করে? রেগে গিয়ে সে কী করে পৃথিবীকে জানান দেবে। তার রাগ? সে হঠাৎ দুই হাত ক্ষিপ্তের মতো ওপরে তুলে জলে নেমে শুধুই লাফাতে লাগল আর চেঁচাতে লাগল, কেন? কেন! কেন এরকম হবে? কেন সবসময়ে এরকম হবে? উদ্বাহু সেই নৃত্যের না ছিল মাথা, না ছিল মুন্ডু। লাফাতে লাফাতে নাচতে নাচতে কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল তার মাথা, চোখ আবছা হয়ে আসছিল বৃষ্টির জলে আর অশ্রুতে। রাতে স্বপ্নের ভিতরে তার তিনটে নৌকোই ফিরে এল সাজ বদল করে। পালতোলা মস্ত কাঠের নৌকো তরতর করে উজিয়ে আসছিল তার কাছে।

বিশুর ভগবান ছিল। বিশ্বরূপের নেই।

বিশ্বরূপ তার ঈষৎ ভাঙা ধীর কণ্ঠস্বরে বলে, কেমন আর ছিল। আর-পাঁচটা গাঁয়ের মতোই। খুব গরিব গাঁ। কিছুই তেমন ছিল না সেখানে। বন্যা হত, খরা হত, চাষে পোকা লাগত। বর্ষাকালটা ছিল আকালের ঋতু। কতদিন খাওয়া জোটেনি আমাদের।

আহা রে! পথের পাঁচালী পড়তে পড়তে আমি তো কত কাদি। কী সাংঘাতিক লেখা, না? কী ভীষণ গরিব ছিল ওরা।

মৃদু একটু হাসল বিশ্বরূপ। কিছু বলল না। এ মহিলা রোমান্টিক। এঁর এখনও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতাই হয়নি।

আপনি পুলিশ কেন হলেন বলুন তো? অন্য চাকরি জুটল না?

বিশ্বরূপ একটু হাসে, আপনার কি পুলিশের ওপর রাগ আছে?

না, তা নয়। পুলিশকে তো আমাদের ভীষণ দরকার হয়। তবে চাকরিটা কি ভাল? একটু কেমন যেন, না?

বোধহয়। তবে আমার এটাই জুটেছিল। চাকরি বাছাবাছি করার উপায় তো ছিল না। তখন বড্ড খিদে পেত।

আমার হাজব্যান্ড বলছিল আপনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন।

পুলিশের চাকরিতেও মেধার দরকার হয়।

যাঃ। পুলিশের চাকরি তো চোর-ডাকাত ধা। আর কী? আর ট্র্যাফিক কন্ট্রোল, আর বোধহয় মব ভায়োলেন্স আটকানো। এসবের জন্য মেধার আবার কী দরকার মশাই?”।

বেঁচে থাকতে গেলেও মেধার দরকার হয়। নইলে মরতে হয়। একটু শক্ত কাজ।

আপনাকে দেখে কিন্তু একটুও পুলিশ মনে হয় না। বরং ভাল লোক বলে মনে হয়। বিশ্বরূপ কখনও জোরে হাসে না। এখনও হাসল না। স্মিত মুখে বলল, পুলিশ তা হলে ভাল লোক নয়?

অপ্রতিভ বকুল বলে, ঠিক তা বলিনি। চাকরিটা একটু রাফ গোছের লতা। একটু র’। তাই? আপনাকে যেন মানায় না।

বিশ্বরূপ নিজের করতলের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বোধহয় ঠিকই বলেছেন আপনি।

রাগ করলেন না তো!

রাগ! না। রাগ আমার খুব কম হয়।

খুন-টুন করেননি তো? মানে, পুলিশকে তো অনেক সময় দুষ্টু লোককে গুলি-টুলি করতে হয়।

বিশ্বরূপ এ কথাটারও জবাব দেয় না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বকুল বলে, তার মানে করেছেন। উঃ, কী করে যে একজনকে আর-একজন খুন করে, তা সে হোক না চোর বা ডাকাত!

বিশ্বরূপ মৃদু-মৃদু হেসে বলে, আপনার মেয়েকে আপনি খুব ভালবাসেন তো?

ও বাবা, ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না আজকাল। আমার দিনরাত্তির তো ওই ভরে রাখে।

ধরুন আপনার মেয়েকে যদি কেউ কিডন্যাপ করে আর মেরে ফেলার ভয় দেখাতে থাকে?

বকুল স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বিশ্বরূপের দিকে। তারপর হঠাৎ বলে, বুঝেছি। পুলিশ কেন খুন করে কিংবা আপনি কেন খুন করেন সেটাই বোঝাচ্ছেন তো?

বোঝা মোটেই শক্ত নয়। তবে ওসব নিয়ে না ভাবাই ভাল। আপনাদের জীবন অন্যরকম।

আর আপনারটা?

বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বুঝতে পারি না। আমি হলাম খড়ের পুতুল। কে যেন চালায় আড়াল থেকে।

আপনি কীরকম পুলিশ? বাবু-পুলিশ না কেজো-পুলিশ?

দু’রকম আছে নাকি?

ওর এক বন্ধু আছে। লালবাজারে। সে কোনও অ্যাকশন-ট্যাকশন করেনি কখনও। ভাল তবলা বাজায় আর বই পড়ে। সে বলে সে নাকি বাবু-পুলিশ। আপনি?

আমি কেজো। বিশেষ ধরনের কেজো।

স্পেশাল ব্রাঞ্চ?

আপনি অনেক জানেন দেখছি। হ্যাঁ, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ।

আপনার কাজটা বোধহয় বিপজ্জনক, তাই না?

ইট ডিপেন্ডস। বর্ধমান এসে গেল কিন্তু। জল-টল লাগবে?

আপনি আজ তিনবার আমাদের ওয়াটার বটল ভরে দিয়েছেন। ছিঃ ছিঃ, যা লজ্জা করেছে আমার। আমার হাজব্যান্ডটি একদম স্মার্ট নয় যে! লেখাপড়া-জানা, মায়ের আদুরে ছেলে।

মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে, অনুমান করল বিশ্বরূপ। পঁচিশ-ছাব্বিশ। আদুরে এও কম নয়।

আপনার রান্না কে করে দেয়?

লোক আছে। মাইনে করা লোক।

বিশ্বাসী?

পুলিশকে সবাই একটু সমঝে চলে।

ওঃ, তাও তো বটে। ভুলেই গিয়েছিলাম। পুজোর মাসখানেক আগে আমাদের একটা কাজের মেয়ে সব চুরি করে পালিয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাটের ঝি এনে দিয়েছিল দেশ থেকে। খাওয়া-পরার লোক। বেশ কাজেরও ছিল। পালাল। পাশের বাড়ির ঝিটাও কাজ ছেড়ে দিয়েছে এ ঘটনার আগেই। ওদের গায়ের নামটা অবধি ভুলে গেছি। পাঁচ ভরি সোনা, ঘড়ি, জামা-কাপড়, অনেক বাসন আর আমার কিছু কসমেটিকস। পুলিশ কিছু করতে পারল না। বলল, অজ্ঞাতকুলশীলকে রাখা ঠিক হয়নি, তোক রাখতে হলে আগে থানায় এনে নাম-ধাম এন্ট্রি করে রাখতে হয়। তাই নাকি?

হবে হয়তো।

আপনার বাড়িতে তো চুরির বা ডাকাতির কোনও ভয় নেই, না?

বিশ্বরূপ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তার চেয়েও বেশি ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে। সত্যিই জল বা চা কিছু চাই না তো?

না। জল আছে। এখন শুধু চাই বাড়ি ফিরে নিজের ঘরদোর আর নরম বিছানা। ক’টায় পৌঁছোব বলুন তো?

রাত দেড়টা নাগাদ।

আপনার গাড়ি সত্যিই থাকবে তো! না কি রাত বেশি হলে ফিরে যাবে?

থাকবে। চিন্তা করবেন না।

আমাদের পৌঁছে দিয়ে আপনার তো হোটেলে ফিরতে আরও রাত হবে। আমাদের ফ্ল্যাটটা কিন্তু বেশ বড়, তিনটে বেডরুম। আপনি ইচ্ছে করলেই থাকতে পারেন।

বিশ্বরূপ মাথা নাড়ে, আপনি বাড়ি ফিরছেন, কিন্তু আমি বাড়ি ফিরছি না। গন্তব্যটাই জানি না এখনও। হোটেলের কথা বলেছিলাম বলে ভাববেন না সেখানেই যাব। হয়তো যাওয়া হবেই না।

আপনি কি কোনও মিশনে যাচ্ছেন? অন ডিউটি?

হ্যাঁ। অন ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট সারভিস।

আপনি যাকে বিয়ে করবেন সে বেচারার ভারী দুর্ভোগ আছে কপালে।

বিশ্বরূপ মাথাটা কোলে আর-একটু নামিয়ে নিল।

সরলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক পার্টিতে। অন্য মেয়েদের মত ঝলমলে নয়, বরং সিরিয়াস এবং চুপচাপ। কে যে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আজ আর তা কিছুতেই মনে পড়ে না। সব পার্টিতেই কিছু উটকো লোক আসে, স্মার্ট রসিক বাকচতুর এবং শিকড়হীন। ওরকমই কেউ হবে। আলাপ সামান্য, কিন্তু খুব গভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল সরলা।

ওই চোখদুটো তার পিছু নিয়েছিল সেদিন থেকে। তিনদিন বাদে ফোন এল মেয়েটির, তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

তখনই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল তার। কেননা সে মেয়েটিকে নিজের ফোন নম্বর দেয়নি। হয়তো সন্দেহ হয়েছিল, সেটা দাঁড়ায়নি, আবেগে ভেসে গিয়েছিল। লখিন্দরের লোহার বাসরেও তো ফুটো ছিল!

সরলা কুঁয়ারি নিজের পরিচয় দিয়েছিল দিল্লির মেয়ে বলে। মা বাবা নেই। এক পিসির কাছে মানুষ। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে বি এ পড়ছে দিল্লির কলেজে। দেখা হল প্রগতি ময়দানের এক একজিবিশনে। তারপর দেখা হতে লাগল। সরলা হাসে কম, কথা কম, শুধু গভীরভাবে তাকায়। সেটাই ওর কথা।

এক মাস মাত্র সময় নিল তারা। তারপর বিয়ে করে ফেলল।

বিশ্বরূপের জীবনে এই বিয়ের চেয়ে ভাল ঘটনা আর কিছুই ঘটেনি। সরলা বুদ্ধিমতী, কাজে চটপটে, সেবায় সিদ্ধহস্ত। যত রাতেই ফিরুক বিশ্বরূপ, গরম কফি পেয়েছে সঠিক মাপের চিনি ও দুধসহ। ঝরঝরে ভাত রাঁধতে পারত সরলা, জামা-কাপড় ইস্ত্রি করতে পারত। ঘর সাজাতে ভালবাসত। কখনও ঝগড়া বিবাদ করেনি।

মাত্র তিনমাস সেই অপরিমেয় গার্হস্থ্যের সুখ স্থায়ী ছিল। একদিন অফিসে কাজ করছে, হঠাৎ মালহোত্রা এসে বলল, বিশু, বাড়ি যাও। ব্যাড নিউজ।

বিশ্বরূপ চমকে উঠে বলে, ইজ শি ডেড?

না, তার চেয়ে খারাপ। শি ইজ আন্ডার অ্যারেস্ট।

বিশ্বরূপের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, অ্যারেস্ট! কী বলছ?

বাড়ি যাও। দে আর ওয়েটিং।

হু দি হেল?

পুলিশ।

বাড়ি ফিরে দেখে, সরলাকে তখনও নিয়ে যায়নি। থানার ওসি এবং কয়েকজন পুলিশ অফিসার গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করছেন। শোয়ার ঘরে কড়া পাহারায় নতমুখী সরলা।

কী হয়েছে?

শি ওয়াজ ইন আওয়ার লিস্ট।

হোয়াট লিস্ট।

স্যার, এ মেয়েটির সঙ্গে সুরিন্দরের গ্রুপের কানেকশন আছে। ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। আপনি ফাইল ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। ফরগেট দা ম্যারেজ স্যার। ইট ওয়াজ এ কনসপিরেসি টু পাম্প আউট ইনফরমেশনস ফ্রম ইউ।

বিশ্বরূপ চেঁচাতে গিয়েও হঠাৎ স্থিতধী হয়ে গেল। শান্ত হল। তার মস্তিষ্ক কাজ করতে লাগল হঠাৎ। বাধা দিল না। পুলিশ সরলাকে নিয়ে গেল।

পরদিন সুপিরিয়র ডেকে পাঠালেন বিশ্বরূপকে। গম্ভীর মুখ। প্রশ্ন করলেন, একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার কী করে এতটা ইডিয়ট হতে পারে বিশ?

সারা রাত ঘুমোয়নি বিশ্বরূপ। মুখ সাদা, শরীরে জ্বোরো ভাব। কথা বলতে পারল না।

শি ওয়াজ অন দি লিস্ট। মাত্র একমাসের পরিচয়ে মেয়েটাকে তুলে নিলে ঘরে? তোমার ম্যারেজ সার্টিফিকেটের কপি আনিয়েছি, দেখেছি চারজন সিভিলিয়ান তাতে সই করেছে সাক্ষী হিসেবে। যদি একজনও কলিগকে ডাকতে বিয়েতে তাহলেও হয়তো আটকানো যেত।

আমি বিয়ের পর একটা পার্টি দিয়েছিলাম। তাতে কলিগরা ছিল স্যার। তারা তখন সরলাকে দেখেছে।

সুপিরিয়র একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, কী দেখেছে বিশ? তোমার বউ সেদিন বিউটি পারলারে গিয়ে হেভি মেক-আপ নেয়, আইব্রো বদলায়, লিপ-লাইন বদলে ফেলে, টায়রা, নাকছাবি, নাকের গয়না, উইগ সবই সে ব্যবহার করেছিল। তুমি প্রেমে অন্ধ হয়ে লক্ষ করোনি।

বিশ্বরূপ মাথা নত করেছিল।

হেল অফ এ ম্যারেজ!

বিশ্বরূপের তখন নিজেকে পরাস্ত, বিধ্বস্ত, নিঃশেষ বলে মনে হয়েছিল।

তারপর চলল জেরা আর জেরা। পুলিশ হেফাজতে অন্তহীন জেরা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ আর ভয়। ওরা দু’দিনের মধ্যে সরলাকে ভেঙে ফেলল। গলগল করে বেরিয়ে এল তথ্য। তারপর আরও তথ্য। তারপর ধীরে ধীরে অসংলগ্ন কথাবার্তা। তারপর প্রলাপ।

বিশ্বরূপ তাকে জেরা করার অনুমতি চেয়েছিল। সুপিরিয়র বলেছেন, বেটার নট। ওর আর কিছু বলার নেই।

একবার যদি দেখা করি।

বেটার নট। ফরগেট ইট লাইক এ ব্যাড ড্রিম।

কতখানি ভালবাসা ছিল সরলার, আর কতটাই বা অভিনয় সেটা মেপে দেখা হল নাবিশ্বরূপের। সন্ত্রাসবাদীরা ওর কাছ থেকে কতটুকু জেনেছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। বিশ্বরূপের। ওদের অনেক চ্যানেল আছে। সব খবরই পৌঁছে যায়।

শুধু মালহোত্রা একদিন বলল, সুপিরিয়র একটা গাধা।

কেন বলো তো!

মেয়েটাকে অ্যারেস্ট করার মানেই হয় না।

বিশ্বরূপ চমকে উঠে বলে, তার মানে? ইজ শি ক্লিন?

আরে না ভাই, ক্লিন নয়। তবে আমরা ওকে তোমার বউ হিসেবে আরও এফিসিয়েন্টলি ব্যবহার করতে পারতাম। কাউন্টার-এসপিওনেজে। ও আমাদের ভাইটাল কানেকশন হয়ে উঠতে পারত। এরা যে কেন সবসময়ে হাল্লা মাচিয়ে কাজ বিলা করে দেয় কে জানে! তুমি কখনও ওর হ্যান্ডব্যাগ বা জিনিসপত্র দেখেছ খুঁজে?

না তো!

শি হ্যাড এ গান। সবুজ সুটকেসটার তলায় পাওয়া গেছে।

বিশ্বরূপ শিহরিত হল।

আশ্চর্যের বিষয় সরলা অ্যারেস্ট হওয়ার পর ওর আত্মীয়স্বজন কেউ এগিয়ে এল না। ওর যে পিসিকে আবছা চিনত বিশ্বরূপ সেও অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। বাস্তবিকই গোটা ঘটনাটা দুঃস্বপ্নের মতোই অলীক মনে হতে লাগল।

একটা মেন্টাল হোম-এ পুলিশ হেফাজতে এখনও বেঁচে আছে সরলা। তবে সম্পূর্ণ উন্মাদ। চেঁচায়, কাঁদে, হাসে। বিশ্বরূপ কখনও তার সঙ্গে আর দেখা করেনি। তিনমাসের একটা সুখকর স্মৃতিকে কি বিসর্জন দিতে পারে সে? তার সুপিরিয়র বলেছিলেন, ফরগেট ইট লাইক এ ব্যাড ড্রিম। কথাটার কোনও যুক্তি নেই। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সুখ-দুঃখের স্থিতি কী? ওই তিনমাস যদি অভিনয়ও করে থাকে সরলা তাতেই বা কী ক্ষতি? ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রী, বাপ-ছেলে, মা-মেয়ে কি এরকম অভিনয় মাঝে মাঝেই করে না? মানুষে মানুষে অবিরল অনাবিল ভালবাসা বলে কি কিছু আছে? কাজেই বিশ্বরূপ তার বিপজ্জনক, অস্থায়ী এই জীবনে পদ্মপত্রে জলের মতো ওই টলটল করা তিনটে মাসের সুখ তার ভিতরে বন্দী করে রেখেছে। ওপরওয়ালার আদেশ সত্ত্বেও ভোলেনি। উন্মাদিনী সরলার কাছেও যায়নি ওই একই কারণে, মহার্ঘ তিনমাসের সৌন্দর্য ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

বিশ্বরূপ বকুলের দিকে চেয়ে তার ধীর গম্ভীর গলায় বলে, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমাদের বউ হতে যদি কেউ রাজিও হয় তবে তার কপালে বিস্তর দুঃখ জমা আছে।

গাড়ি বর্ধমান ছাড়ল। বকুল তার গলার হারখানা ঠোঁটে নিয়ে একটু খেলা করে। মানুষ কখন যে কী করে তার ঠিক নেই। একটু চাপা হাসির ভাব আছে মুখে। বলল, তবু কেউ হয়তো সব জেনেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। তেমন মেয়েও কি আর নেই? আমার তো খুব ইচ্ছে ছিল একজন জঙ্গি পাইলট বা মিলিটারি অফিসারকে বিয়ে করি।

মানুষের প্রফেশনটা খুব বড় কথা নয়।

তবে কোনটা বড় কথা?মানুষটা? ওসব হল দার্শনিক কথা। আজকাল সবাই প্রফেশনটারই দাম দেয়। তবে আমি কিন্তু কখনও পুলিশ পছন্দ করিনি।

সেটা আগেই বলেছেন।

বকুল হাসছিল, জিরো জিরো সেভেন হলে অবশ্য আলাদা কথা। বা শার্লক হোমস।

ও দুটোই অলীক।

তা জানি মশাই। বাচ্চা ছেলেটাও জানে। ওরকম স্পাইও হয় না, ওরকম গোয়েন্দাও নেই। তবু কী থ্রিলিং ক্যারেকটার বলুন?

হ্যাঁ, সবসময়ে জয়ী, সবসময়েই সফল। ওরকম যদি বাস্তবেও হত।

হয় না, না?

বিশ্বরূপ হাসল, না। মাঝে মাঝে আমরা ভীষণ কাপুরুষের মতো আচরণ করি। পালাই। হারি। সাকসেস স্টোরির চেয়ে আমাদের আনসাকসেস স্টোরি অনেক বেশি লম্বা। তা যদি না হত তা হলে অপরাধীতে দেশটা এত ভরে যেত না।

আপনিও কি লাইসেন্সড টু কিল?

বিশ্বরূপ অসহায়ের মতো মুখ করে বলে, এ দেশে সবাই লাইসেন্সড টু কিল।

বর্ধমান ছেড়ে গাড়ি এখন চমৎকার দৌড়োচ্ছ। ঘুমন্ত মুখটা বাঙ্ক থেকে ঝুলিয়ে শ্যামল জিজ্ঞেস করে, ক’টা বাজে?

বকুল বলে, সাড়ে বারো।

আমরা কোথায়?

এই তো বর্ধমান পেরোলাম।

ওঃ, তা হলে দেরি আছে।

দেরি নেই। নামো৷ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে।

রাত দেড়টায় সত্যিই কলকাতা পৌঁছে গেল তারা। যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি ছিল, যদি ভাগ্যক্রমে দু-একটা ট্যাক্সি থাকে সেই আশায়। অব্যবস্থায় ভরা বিশৃঙ্খল উদ্ধৃঙ্খল এই দেশে কাউকে কারও দোষারোপ করার নেই।

উদ্বিগ্ন শ্যামল বলে, আপনার গাড়ি আছে তো বিশ্বরূপ?

বিশ্বরূপ তার জায়গা থেকে নড়েনি। নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ঢুকেছে। সামনেই কারপার্ক। জানালার সোজাসুজি পুলিশ-জিপটা দেখতে পাচ্ছিল বিশ্বরূপ। ঠিক এ রকম জায়গাতেই থাকার কথা। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা একজন সশস্ত্র লোক জিপের পাশে দাঁড়িয়ে। চোখ গাড়ির দিকে।

আছে। চলুন। গাড়িটা কিন্তু জিপ, আপনাদের একটু অসুবিধে হবে।

অসুবিধে! কী যে বলেন! এই মাঝরাতে কলকাতা শহরে জিপই আমাদের রোলসরয়েস।

বউ-বাচ্চা-মাল নিয়ে শ্যামল উঠল জিপের পিছনে। সামনে বিশ্বরূপ, ড্রাইভারের পাশে। বিশ্বরূপের ঘাড়ের কাছে সিটের কানায় একখানা নরম হাত। চুড়ির শব্দ। বকুল ঠিক তার পিছনেই বসেছে। ইচ্ছে করেই কি? জীবন ক্ষণস্থায়ী। সেইজন্যই এর প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সামান্য প্রাপ্তিকেও ফেলতে নেই। বিশ্বরূপ খুব গভীরভাবে শ্বাস নিল। কলকাতার বাতাস অপরিশুদ্ধ। বায়ুদূষণ সাংঘাতিক। প্রকৃতিহীন এই শহরকে সবাই ভয় পায়। কিন্তু এই গভীর রাতে, জিপটা যখন ভ্যাম্প ঘুরে হাওড়া ব্রিজে উঠে এল তখন গঙ্গার ঠান্ডা জল-ছোঁয়া বাসটি বড় শুদ্ধ বলে মনে হয়।

আপনার শীত করছে না?–মেয়েলি গলা।

বিশ্বরূপ মাথা নাড়ল, না। কলকাতায় শীত কোথায়?

শ্যামল হঠাৎ উদ্বেগের গলায় বলে, এই যাঃ, মাসিমার খবর নেওয়া হল না যে! তাড়াহুড়োয় ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।

মাসিমার তো গাড়ি আসবেই। যদু থাকবে। চিন্তা কীসের?

তবু কার্টসি বলে একটা জিনিস আছে তো!

নেই। উনি কার্টসি দেখিয়েছেন আমাদের? কই একবারও তো বলেননি, এত রাতে পৌঁছোবে, ঠিক আছে আমার গাড়ি বরং পৌঁছে দেবে তোমাদের। বলেছেন একবারও?

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোধহয় একটা মনোমালিন্য পাকিয়ে উঠছে। বাড়িতে গিয়ে হয়তো জনান্তিকে সেটা ফেটে পড়বে। বিশ্বরূপ তার ধীর ভাঙা গলায় বলে, শ্যামলবাবু, রাস্তাটা একটু খেয়াল রাখবেন। কাঁকুড়গাছি আর বেশি দূরে নয়। আমরা মানিকতলা পেরোচ্ছি।

মানিকতলা? এত তাড়াতাড়ি?

এরা বাড়ি ফিরছে। ভ্রমণের আনন্দের পর বাড়ি ফেরার নিশ্চিন্ত। বাড়ি ফিরে সংসারে মজে যাবে। ঝগড়া-বিবাদ-মান-অভিমান খুনসুটি-ভালবাসা সব মিলেমিশে একটা সম্পর্ক শেষ অবধি স্থায়ী হবে। যতদিন মৃত্যু এসে বিচ্ছেদ না ঘটায়। বিশ্বরূপের ঠিক এরকম জীবন বোধহয় হবে না আর কখনও।

খুব নরম করে বকুল বলল, এক কাপ কফি খেয়ে যাবেন কিন্তু! নইলে ছাড়ব না।

বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে বলে, না। এত রাতে নয়।

আপনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করলেন, আমাদের কিছু করতে দিচ্ছেন না কেন?

শোধবোধ করতে চান? পাওনা রইল।

এবার দিল্লি গেলে ঠিক আপনাকে খুঁজে বের করব। ঠিকানা টুকে রেখেছি।

ওয়েলকাম।

আপনি তো কাল বা পরশু, আপনার সুবিধেমতো আমাদের বাড়িতে লাঞ্চ বা ডিনারে আসতে পারেন?

আমি কলকাতায় থাকব না। কালই হয়তো যশিডির ট্রেন ধরতে হবে।

কী এত কাজ বলুন তো আপনার!

ক্রাইম। ক্রাইম আফটার ক্রাইম।

শ্যামল বলে উঠল, এই যে ডানদিকে।

গাড়ি ডাইনে চওড়া রাস্তায় ঢুকল।

এবার বাঁ দিকে।

কয়েকবার মোড় নিল গাড়ি। তারপর মস্ত একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে এসে দাঁড়াল।

মালপত্র নামল। ওরা নামল। ভদ্রতাসূচক কিছু কথাবার্তা ও আবার দেখা হওয়ার আশ্বাসের পর জিপ ঘুরিয়ে নিল মুখ। তারপর হু হু করে দূরত্ব বাড়িয়ে নিল চোখের পলকে। দূরত্বই ভাল। গার্হস্থ্য থেকে তার দূরে থাকাই উচিত।

অপারেশন সুরিন্দর। কলকাতার পুলিশ সন্দেহজনক দু’জনকে গ্রেফতার করে রেখেছে। দলে আরও একজন ছিল, সে পালিয়ে গেছে। বিশ্বরূপ জানে, ধৃত দুজনের কেউ বা পলাতক লোকটি সুরিন্দর নয়। সুরিন্দরকে গ্রেফতার করতে হলে পুরোদস্তুর যুদ্ধ হবে। কিছু লোকের মৃত্যু অবধারিত। সুরিন্দর মিলিটারি প্রশিক্ষণ পাওয়া লোক, পুরোদস্তুর কম্যান্ডো। নিজেকে সবসময়ে কন্ডিশনিং-এ রাখে। সারা ভারতবর্ষে তার সমব্যথী ও বন্ধু ছড়ানো। পীতাম্বর মিশ্রকে সপরিবারে খুন করে সে সোজা কলকাতায় চলে আসবে এটা নাও হতে পারে।

সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন গ্রেফতার না করে অনুসরণ করা ও গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখা। তাতে গোটা দলের হদিশ পাওয়ার আশা থাকে। কিন্তু এই সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কাজে পুলিশ কিছুটা ঢিলা।

স্যার, হোটেলে যাবেন?

লোকদুটোকে কোথায় রাখা হয়েছে?

হেয়ার স্ট্রিট লক-আপে।

সেখানেই চলুন।

জিপ তাকে হেয়ার স্ট্রিটে নিয়ে এল। কয়েকজন ক্লান্ত কনস্টেবল ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। তারাই খাতির করে লকআপে নিয়ে গেল তাকে। কম্বলের বিছানায় দু’জন চিতপাত হয়ে ঘুমোচ্ছ।

এরাই কি স্যার?

না। বড়বাবুকে বলবেন, অন্য কোনও অভিযোগ না থাকলে এদের কাল সকালে রিলিজ করে দিতে।

সুরিন্দরের ফোটোর সঙ্গে ডানদিকের লোকটার কিছু মিল আছে স্যার।

সুরিন্দর আর আমি দিল্লির একই ক্লাবে একসঙ্গে হকি খেলতাম। তাকে আধ মাইল দূর থেকেও চিনতে পারব।

তা হলে ঠিক আছে স্যার। বড়বাবুকে বলব।

ক্লান্ত বিশ্বরূপ এসপ্ল্যানেডের কাছে একটা হোটেলের বুক করা ঘরে ফিরল রাত আড়াইটেয়। ধৃত দু’জনকেই চেনে বিশ্বরূপ। পুরনো দিল্লির স্মাগলার। বাংলাদেশ, নেপাল, চিন সীমান্ত দিয়ে এদের কাজ-কারবার। সোনা, ইলেকট্রনিক জিনিস আর কসমেটিকস এর কারবার, দু’জনেই পুলিশের টাউট, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে পুলিশের ভাইট্যাল লিঙ্ক। অপরাধী বটে, কিন্তু উপকারী বন্ধুও।

বিশ্বরূপ বিছানায় শুয়েই ঘুমোল। কলকাতায় তার কোনও কাজ নেই। সকালে ট্রেন ধরতে হবে। গন্তব্য যশিডি, পাটনা। সামনে ঘুমহীন অনেক রাত অপেক্ষা করছে তার জন্য। অপেক্ষা করছে গুপ্তঘাতক ও আততায়ী। অপেক্ষা করছে পরাজয়, গ্লানি, রক্তপাত বা গৌরবহীন জয়। তার চেয়ে বেশি ক্লান্তি, বিষাদ, শূন্যতা।

লম্বা ঘাসের উঁটি বেয়ে একটা পিঁপড়ে খামোখাই ওপরে ওঠে। দোল খায়। তারপর ফের নামে। ঘাসের গভীর অরণ্যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়। পিঁপড়েরা কি পথ চিনে চিনে ঘরে ফিরে আসতে পারে? বটপাতায় একটা পিঁপড়েকে তুলে নিয়ে অনেক দূরে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল বিশ্বরূপ। কোনও চঞ্চলতা প্রকাশ করেনি পিঁপড়েটা। নিশ্চিন্তে বটপাতা থেকে নেমে অচেনা মুলুকে গটগট করে হেঁটে চলে গেল কোথায় যেন! পিঁপড়ের দেশ নেই। মানুষের আছে! দাদু তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বনগাঁ সীমান্তে যেত। চেকপোস্টের এপাশে দাঁড়িয়ে ওই পাশের দিকে মায়াভরা চোখে চেয়ে থাকত। ওই দিকে কোথাও তার দেশ। বিশ্বরূপ তার গভীর ঘুমের মধ্যেই পাশ ফেরে। হলধর ভূত আর জলধর ভূতের লড়াইতে কেউ হারে না, কেউ জেতে না। কিন্তু রোজ তারা লড়াই করে। শেষহীন লড়াই। অন্তহীন, জয়-পরাজয়হীন এই লড়াই আজও হয় ওইখানে, ওই মাঠের মধ্যে, যেখানে জ্যোৎস্নারাতে পরিরা নামে, যেখানে মাঝে মাঝে কাদুয়া চোরকে গোলপোস্টে বেঁধে পেটানো হয়, আর ঘাসের মধ্যে নির্বিকার ঘুরে বেড়ায় পিঁপড়ে। প্রতিদিন ওই মাঠ ক্লান্ত পায়ে পেরোয় দুঃখী দেবীলাল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *