Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মস্ত নিমগাছের ছায়ায়

মস্ত নিমগাছের ছায়ায় এখনও খাঁটিয়া পাতা। খাঁটিয়ায় আধময়লা সবুজ সস্তা একখানা চাদর বিছানো, একখানা বালিশ। খাঁটিয়ার মাথার দিকে পায়ার কাছে ঝকমকে পেতলের ঘটি, তাতে ঢাকনা দেওয়া। পীতাম্বর মিশ্র সুতরাং বাড়িতেই আছেন। রিকশা থেকে নেমে কাঠের ফটক ঠেলে বাড়ির চত্বরে ঢুকেই অনুমানটা মজবুত হল অজিতের। পীতাম্বর মিশ্রের দৃঢ় বিশ্বাস নিমগাছের ছায়া এবং নিমের হাওয়ার জোরেই সত্তরেও তার স্বাস্থ্য এত ভাল।

স্বাস্থ্য কতটা ভাল এবং সক্ষম সেটা পরীক্ষা করতেই কি পীতাম্বর হঠাৎ মাত্র কয়েকমাস আগে ছাব্বিশ বছরের দুরন্ত এক দেহাতি যুবতীকে বিয়ে করে বসলেন? না কি বিয়েটা আসলে এতদিন বাদে তার “এক্স ওয়াইফ” ভজনাদেবীর ওপর প্রতিশোধ নিতেই?

বেলা সাড়ে দশটাও বাজেনি, গরমের রোদে চারদিক যেন চিতাবাঘের মতো ওত পেতে আছে। বিহারের গ্রীষ্ম মানেই বাঘের থাবা। পীতাম্বর মিশ্রর বাড়িটা তেমন কিছু দেখনসই না হলেও এলাকা বিশাল। চারদিক মাটি আর ইটে গাঁথা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ডানদিকে মস্ত ইদারা দেখা যাচ্ছে। ইদারার ওপর কপিকল লাগানো। সরু শেকলে বাঁধা বালতিতে মহেন্দ্র জল তুলছে।

অজিত একটু দুর থেকেই হাঁক দিল, মহিন্দর, মিশিরজি হ্যায়?

জি সাব। বৈঠ যাইয়ে। লালুয়া, আরে এ লালুয়া, চারপাই লাগা রে!

পীতাম্বর মিশ্রর পার্সোনালিটিকে কখনও সন্দেহ হয়নি অজিতের। তার ঘরদোর এবং তাকেও যারা সামলে রাখে তারা কেবলমাত্র বেতনভুক চাকরবাকর নয়। এরা মিশ্রজির ভক্ত এবং অনুগামীও বটে। মহেন্দ্ৰ বোধহয় ত্রিশ বছরের ওপর পীতাম্বরের কাছে আছে। লালুয়াও আছে শিশুকাল থেকে। পীতাম্বরের কাছ থেকে এরা অর্থকরী দিক দিয়ে তেমন কিছু পায় না, অজিত জানে।

অনাথ শিশু লালুয়া এখন কিশোরটি হয়েছে। থ্যাবড়া নাকের নীচে গোঁফের সুস্পষ্ট আভাস, পুরু ঠোঁটের ফাঁকে তৃপ্তি এবং আনন্দময় একটা হাসি। চারপাইটা ছায়ায় পেতে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলে, বৈঠ যাইয়ে। অউর বিড়ি মত পিজিয়ে।

এ বাড়ির চৌহদ্দিতে ধূমপান নিষেধ। খৈনিও নয়। এ বাড়িতে চা বা অন্য কোনও নেশার দ্রব্যের প্রচলন নেই। পীতাম্বর নেশার ঘোর বিরোধী। অজিত দড়ির চারপাইতে বসে বলল, পানি তো পিলা রে।

পানি এবং পীতাম্বর প্রায় একসঙ্গেই এলেন। পরনে ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া গোছের জিনিস, তাতে পকেট আছে। পায়ে খড়ম। গামছাও থাকে কাঁধে, তবে এখন সেটা বালিশের আড়ালে রাখা আছে, দেখতে পেল অজিত। গত বাইশ বছরে পীতাম্বর তেমন পালটায়নি। বাইশ বছর ধরে অজিত তাকে দেখে আসছে। তারও আগে থেকেই পীতাম্বর বোধহয় একইরকম থেকে গেছেন।

পীতাম্বর প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন, কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন করেছেন এবং কিছুদিন চাকরিও। জলের মতো বাংলা বলতে পারেন। অজিত যেমন পারে হিন্দি বলতে। কিন্তু পীতাম্বর বোধহয় অজিতের হিন্দিকে তেমন বিশ্বাস করেন না, বরাবর অজিতের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন। অজিত যখন জল খাচ্ছিল তখন পীতাম্বর খাঁটিয়ায় বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছিলেন।

আশাকরি তুমি ইন্টারভিউ নিতে আসোনি!

অজিত একটু অবাক হয়ে বলে, ইন্টারভিউ? না তো!

মজবুত দাত দেখিয়ে পীতাম্বর হাসলেন, আমি এখন নিঃশেষিত পানপাত্র। কেউ আর পোঁছে না। তবে বিয়ে করার পর কিছু কাগজ কেচ্ছা হিসেবে সেটা ছেপেছে। তোমার মতলব কী? ইজ ইট এ প্রফেশনাল ভিজিট?

অজিত পিতাম্বরকে ভালই চেনে। যখন রাজনীতি করতেন তখনও রাজ্যসভায় মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত মন্তব্য করতেন বা ছড়া কাটতেন যে লোকে বলত ছিটিয়াল।

তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়নি। তোমার চোখ দেখে মনে হয় লিভার ভাল কাজ করছে না। বোধহয় রাত জাগো। আজকাল কি ড্রিংকও ধরেছ নাকি?

না মিশিরজি। আপনি তো জানেন নিউ পাটনা টাইমস ছোট কাগজ। ভাল চলছে না। রিট্রেনচমেন্ট তো হবেই, কাগজও উঠে যেতে পারে। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি।

তোমার এডিটর রঙ্গনাথ হচ্ছে একটি আস্ত পাঠা, বিক্রি বাড়াতে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের নামে বদনাম ছড়াচ্ছে। ওতে কি কাগজ চলে? এ দেশে খবরের অভাব নেই, ঠিকমতো লিখতে পারলে কত খবর কুড়িয়ে আনা যায়। তোমরা শুধু বস্তাপচা রাজনীতি ছাপবে, তাতে হয়? এ দেশের রাজনীতি নিয়ে কারও কোনও মোহ আছে বলে মনে করো? আমি তো করি না। আমি কীসের ওপর রিসার্চ করছি এখন জানো?

কীসের ওপর?

এ কে ফর্টি সেভেন। কালাশনিকভ। উজি। অনেক বই আনিয়েছি।

অজিত একটু অবাক হয়ে বলে, রিসার্চ করছেন কেন? এসব তো টেরোরিস্টদের অস্ত্রশস্ত্র।

বটেই তো। উগ্রবাদীরাই তো ক্ষমতায় চলে আসছে। তোমার গভর্নমেন্টকে তো হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেছে উগ্রবাদীরা। এত কামান বন্দুক পুলিশ মিলিটারি লেলিয়ে কিছু করতে পারলে? আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি উগ্রবাদীরা আরও বহুত খেল দেখাবে।

অজিত অবাক হয়ে বলে, আপনি কি মনে করেন উগ্রবাদীরা পাওয়ারে আসবে?

উগ্রবাদীরা আর অলরেডি ইন পাওয়ার। এখন তো তারাই সরকারকে ইচ্ছেমতো চালাচ্ছে। পঞ্জাব, কাশ্মীর, অসম, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, খানিকটা বিহার, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ক’টা স্টেট হল অজিত? সব জায়গায় উগ্রবাদীরা তোয়াজ আর খাতির পাচ্ছে। কীসের জোরে জানো? এ কে ফর্টি সেভেন, কালাশনিকভ, উজি। এসব নিয়ে আমি পড়ছি এবং লিখছি। হাতেকলমেও দেখছি।

অজিত নড়েচড়ে বসে বলে, হাতেকলমে?

পীতাম্বর তার চিরকেলে চাপা হাসি হেসে বলেন, কাউকে যদি না বলো তো বলতে পারি।

আপনি কি কোনও অস্ত্র হাতে পেয়েছেন মিশিরজি?

আলবাত। এসব কি শুধু থিয়োরেটিক্যাল নলেজ থেকে হয় নাকি? দেখতে চাও?

চাই।

তা হলে এসো।

পীতাম্বরের পিছু পিছু তাঁর বাড়ির পিছন দিককার একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল অজিত। একটা সুটকেস খুলে পীতাম্বর দেখালেন ভাঁজ করা খুলে রাখা একটা রাইফেল! খুবই আধুনিক জিনিস।

পীতাম্বর বললেন, কয়েক সেকেন্ডে অ্যাসেম্বল করা যায়। আমি রোজ প্র্যাকটিস করি। তবে দুঃখের বিষয় গুলি নেই। কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। তখন চাঁদমারি করব পিছনের বাগানে।

পীতাম্বর কি পাগল হয়ে গেলেন? অজিত এত অবাক হয়ে গেল যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, আপনার কি এর লাইসেন্স আছে মিশিরজি?

পাগল! এর লাইসেন্স সরকার কাউকে দেয় নাকি? লাইসেন্সের প্রয়োজনই বা কী? হাতে হাতে ঘুরছে। অ্যাভেলেবল এভরিহোয়ার। তুমি যদি মিলিটান্ট হওয়ার ডিসিশন নাও তা হলে তোমার হাতেও এসে যাবে।

অজিত একটু শিহরিত হয়ে বলে, আপনার সঙ্গে কি উগ্রবাদীদের যোগাযোগ আছে? মিশিরজি তার কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে তাকে ঘরের বাইরে ঠেলে বের করে দরজায় তালা দিয়ে বললেন, আছে। তোমার নেই?

না। আমার কী করে থাকবে?

তা হলে তুমি কীসের রিপোর্টার? ঘোড়ার ঘাস-কাটা রিপোর্টিং করে বলেই তোমাদের কাগজগুলো এত স্টেল। আমি অ্যাকটিভ পলিটিক্স ছেড়ে দিয়েছি বলেই ধরে নিয়ে না যে আমি পলিটিক্যালি ডেড। আই অ্যাম ভেরি মাচ ইন পলিটিক্স। ভারতবর্ষের ভাবী পলিটিক্স যেখানে তৈরি হচ্ছে আমি সেই গর্ভগৃহ আন্ডারগ্রাউন্ডের পলিটিক্সকে এখন স্টাডি করছি। তুমি কি নার্ভাস হয়ে পড়লে অজিত?

হ্যাঁ মিশিরজি। খুবই নার্ভাস। আপনি এসব কেন করছেন?

সেটা আগেই বলেছি। তোমার মাথা ক্রিয়া করছে না বলে বুঝতে পারেনি। বাঙালি হয়ে উগ্রবাদের প্রসঙ্গে নার্ভাস হয়ে পড়া কি তোমাকে মানায়? উগ্রবাদের জন্ম দিয়েছিল কে অজিত? ব্রিটিশ আমলের কথা বাদ দাও, নকশাল মুভমেন্টও কি ভুলে গেছ? বাঙালি নকশালদের হাতে এইসব অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, তারা দিশি বোমা, ভোজালি, চপার, কয়েকখানা পিস্তল আর পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই করা পুরনো মডেলের কয়েকটা রাইফেল নিয়ে গোটা দেশ কাঁপিয়ে ছেড়েছিল, মনে নেই? ভাবতে পারো ওরা এইসব সফিস্টিকেটেড অস্ত্র পেলে কী কাণ্ড করতে পারত? পুরো পাওয়ার নিয়ে নিতে পারত হাতে! বাঙালি এখন নকশালি ছেড়েছে, কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে রেখে গেছে তার প্রভাব। নকশালরাই তো এই উগ্রবাদের গুরু এবং অগ্রপথিক। বাঙালি ছেড়েছে। ধরেছে বিহার, অন্ধ্র, কেরল। ধরেছে কাশ্মীর, পঞ্জাব, অসম, তামিলনাড়ু। আরও ছড়াবে। বহুত ছড়িয়ে যাবে। তোমাদের নপুংসক গদি আঁকড়ে থাকা আর কর্তাভজা রাজনীতির দিন শেষ হয়ে আসছে।

পীতাম্বরের বাড়িটি নেহাত ছোট নয়। অনেকগুলো ঘর। আসবাবের বাহুল্য নেই। আধুনিকতারও বালাই নেই। পীতাম্বর খুব সহজ সরল জীবনযাপন করতে ভালবাসেন। বাহুল্য পছন্দ করেন না। যে ক’টা কারণে পীতাম্বরকে এখনও গভীর শ্রদ্ধা করে অজিত তার একটা হল লোকটার এই সাদাসিধা জীবনযাপন।

আমার মনে হচ্ছে অজিত, বৃদ্ধের তরুণী ভার্যাটিকে দেখার একটা আগ্রহ তোমার আছে। দেখতে চাও?

অজিত অন্যমনস্ক ছিল। পীতাম্বর তাকে যথেষ্ট নার্ভাস করে দিয়েছেন। সে একটু চমকে উঠে বলল, না না, সেরকম কোনও–

আরে, লজ্জা পাচ্ছ কেন? বি ফ্র্যাঙ্ক। তুমি তো জানো আমি ফ্র্যাঙ্কনেস পছন্দ করি।

আমি অন্য একটি দরকারে এসেছিলাম মিশিরজি। আমি বলতে এসেছিলাম নিউ পাটনা টাইমসের কোনও স্থায়িত্ব নেই। আপনি আমাকে এই চাকরিটা দিয়ে একসময়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আমার ভয় হচ্ছে চাকরিটা থাকবে না। কাগজটা হয়তো উঠে যাবে।

মিশিরজি অতিশয় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ওসব বস্তাপচা কাগজ রেখেই বা লাভ কী অজিত? তুলে দাও, না হলে রঙ্গনাথের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেরা চালাও। আর ভজনার কোষ্ঠী ও জাতক বিচারটা সবার আগে বাদ দিয়ে দেবে। জ্যোতিষী একটা মস্ত ধাপ্পাবাজি।

অজিত একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আপনি হয়তো ওঁর ওপর রেগে আছেন। কিন্তু নিউ পাটনা টাইমসের সবচেয়ে বড় অ্যাট্রাকশন হল, ভজনা দেবীর ফোরকাস্ট এবং জাতক বিচার।

ভ্রু কুঁচকে পীতাম্বর বলে, জানি। ভজনার কাছে এখন বহু ভি আই পি তাদের ভাগ্য জানতে আসে। অনেকে নাকি তাকে আজকাল মাতাজি বলেও ডাকে। খুব শিগগিরই হয়তো সে একটা স্পিরিচুয়াল লিডার হয়ে উঠবে। এই পোড়া দেশে এরকম ঘটাই তো স্বাভাবিক। তুমি বোধহয় তার কাছে যাতায়াত করো!

মিশিরজি, উনি আমাকে স্নেহ করেন। আমাদের কাগজে ওঁকে লিখতে রাজি করিয়েছিলাম আমি। যতদিন উনি লিখবেন ততদিন আমি সেফ।

পীতাম্বর হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হাসলেন, তাই বলো! ভজনাকে তা হলে তুমিই ভিড়িয়েছ ওই কাগজে। এখন আমার কাছে আসার মতলবটা কী? ভজনা যখন তোমার ফেবারে আছে তখন চিন্তা কীসের?

কাগজটা রিভাইটালাইজ করতে হলে আপনাকেও আমাদের দরকার। আপনি একসময়ে দারুণ জার্নালিজম করেছেন।

লেখা-টেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি অজিত। লিখে কিছু লাভ নেই। যে দেশে নিরক্ষরের হার এত বেশি সে দেশে কাগজে লিখে কোনও ফল হয় না। আমি যা বলতে চাই তা ওই নিরক্ষরদের জন্যই। আমি অন্য মিডিয়ামের কথা ভাবছি যা কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছবে।

মিশিরজি, সমস্যাটা আমার একার নয়। গোটা কাগজ এবং তার চল্লিশ-পঞ্চাশজন কর্মচারীর। আপনি লিখতে শুরু করলে কাগজটা বোধহয় বেঁচে যাবে।

কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছ। একে যে তেল-দেওয়া বলে তা জানো?

জানি। আর এও জানি যে মানুষ সত্তর বছর বয়সে এ কে ফর্টি সেভেন নাড়াচাড়া করে সে তেলের তোয়াক্কা করে না।

পীতাম্বর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, আমি যা লিখব তা ছাপাতে পারবে?

অজিত একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, আপনি এখন উগ্রবাদ নিয়েই বোধহয় লিখবেন? তা-ই লিখবেন। ছাপব।

ইট মে বি ভেরি এক্সপ্লোসিভ অ্যান্ড ডেনজারাস অ্যান্ড সিডিশাস। রঙ্গনাথ অ্যারেস্টও হয়ে যেতে পারে।

রঙ্গনাথজির অনেক দোষ আছে, কিন্তু উনি এ ব্যাপারে খুব সাহসী। উনি আগেও দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন এবং আমাদের কাগজের বিরুদ্ধে অন্তত চারটে ডিফারমেশন কেস ঝুলছে।

লেখা কিন্তু এডিট করতে পারবে না।

পাগল! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

ঠিক আছে, তোমার মুখ চেয়ে লিখব। তুমি আমার ছেলের মতো। তোমার অনেক কিছুই আমার পছন্দ নয়, তবু স্নেহ জিনিসটা বোধহয় কোনও যুক্তিরই ধার ধারে না। আচ্ছা একটা কথা বলতে পারো, বাঙালিদের এরকম হাল হল কেন?

কীরকম হাল মিশিরজি?

কিছুদিন আগে পুরুলিয়ায় দুটো শিখ উগ্রবাদী ঢুকে পড়েছিল, মনে আছে?

আছে।

সংখ্যায় তারা মাত্রই দু’জন। দুটো নোক সারা জেলায় দাপাদাপি করে বেড়াল, মানুষ মারল, পুলিশ মারল। তাদের ভয়ে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে দেওয়ার মতো অবস্থা হল পুলিশের। ধেয়ে এল লালবাজার এবং বিরাট অপারেশনের আয়োজন হল। প্রায় বাঘ মারার মতো করে মারা হল তাদের। হোয়াট এ গ্রেট ফুলিশনেস। যেখানে দু’জন উগ্রপন্থীকে ধরলে অনেক ইনফর্মেশন আদায় করা যেত, পাওয়া যেত অনেক গুপ্ত খবর সেখানে তাদের ধরার চেষ্টাই হল না। মেরে ফেলা হল। অথচ সে দুটো মানুষ তখন অবসন্ন, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। লড়াই করার ক্ষমতাও তাদের আর ছিল না। আর কিছুক্ষণ ঘিরে রাখলেই অজ্ঞান অবস্থায় তাদের ধরা যেত। কিন্তু বাঙালি পুলিশ এত ভয় খেয়ে গিয়েছিল যে, তারা সেই চেষ্টাই করেনি। আমি শুধু ভাবছি মাত্র দুটো লোক আর দুটো এ কে ফর্টি সেভেন যদি তোমাদের এই অবস্থা করতে পারে তা হলে পঞ্চাশ বা পাঁচশো উগ্রবাদী ঢুকে পড়লে তো তোমাদের সরকার গদি ছেড়ে পালিয়ে যাবে! বাঙালিদের হল কী অজিত? উগ্রবাদের আগরওয়ালাদের এই হাল কেন?

মিশিরজি, আপনি বড় উগ্রবাদের ভক্ত হয়ে পড়েছেন।

না রে বাচ্চা, আমি আরও বেশি ভক্ত হয়ে পড়েছি এ কে ফর্টি সেভেনের। আমি রোজ অস্ত্রটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। চিনের সবচেয়ে সাকসেসফুল এক্সপোর্ট আইটেম। তার চেয়েও বড় কথা, এ কে ফটি সেভেনই এখন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় সম্মানিত জিনিস।

অস্ত্রটা আপনাকে কে দিল?

আছে আছে। তুমিও যদি চাও তো পাবে। কিছু টাকা খরচ করতে হবে, এই যা। নিমগাছের নীচে গিয়ে বসো, আমি মিঠিয়াকে ডাকছি। সে বোধহয় গোসলখানায় আছে।

আমার দ্বিতীয় পক্ষকে দেখে যাও, ভজনাকে গিয়ে বোলো কেমন দেখলে।

লজ্জা পেয়ে অজিত বলে, কী যে বলেন মিশিরজি!

নিমের ছায়ায় বসে লালুয়ার এনে-দেওয়া এক গেলাস ঘোল খেল অজিত। তারপর মিশিরজি এলেন, পিছনে সদ্যস্নাতা এক যুবতী। যুবতীই বটে। সারা অঙ্গে এমন উচ্চাবচ ব্যাপার যে তাকাতে লজ্জা করে।

আরে আরে, নববধুর মতো মুখ নামিয়ে নিলে যে! দেখো, ভাল করে দেখে নাও। ভজনাকে গিয়ে বোলো, আমার বয়স সত্তর আর আমার দ্বিতীয় পক্ষের বয়স তেইশ, তবু ওর কোনও অভিযোগ নেই। শি ইজ কনটেন্টেড। ইচ্ছে করলে তুমি ওকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। তবে খবরদার, পরকীয়া করার চেষ্টা কোরো না। জানোই তো, আমার এ কে ফর্টি সেভেন আছে।

এটা সেই গ্রীষ্মকালের কথা। অজিত পাটনায় ফিরে পরদিনই ভজনা দেবীর বাড়িতে গেল। ভজনাকে সে মা বলে ডাকে। শুধু জ্যোতিষী করে কেউ যে এই ভাল আর্থিক অবস্থায় পৌঁছতে পারে তার ধারণা ছিল না অজিতের। আগেও জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করতেন, ডিভোর্সের পর সেটা পেশা হিসেবে নিলেন। পাটনার এক গলিতে একখানা ঘর নিয়ে থাকতেন। এখন বাড়ি করেছেন দোতলা। গাড়িও কিনবেন। পীতাম্বর মিথ্যে বলেননি, অনেকেই আজকাল ভজনাকে মাতাজি বলে ডাকে। তার চেয়েও বড় কথা ভজনা দেবী এখন এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, নানা পর্যায়ে তার প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। বেশিরভাগ সময়েই লালপেড়ে গরদ পরে থাকেন, সিঁথিতে তেল সিঁদুর বহাল আছে। অজিতের কাছ থেকে বিবরণ শুনে বললেন, মিশিরজির কাছে তুই হঠাৎ যেতে গেলি কেন? লোকটা ভেবে নিল, আমিই তোকে পাঠিয়েছি ওর নতুন বউকে দেখে আসতে।

সেরকমই ভাবলেন। কিন্তু আমাকে পাঠিয়েছিলেন রঙ্গনাথজি। পীতাম্বরের লেখা তো খুব ঝাল মশলাদার হয়, ইংরিজিটা লেখেনও চোস্ত। কাগজটা একটু হয়তো চলবে।

বউটা কি ভাল? যত্নআত্তি করে?

সেটা কী করে বলব? তবে মিশিরজি ভালই আছেন।

লালুয়াটা কেমন আছে?

ভাল মা। সব ভাল।

ভাল হলেই ভাল। তবে একটা ফাঁড়া আছে মিশ্ৰজির।

এর বেশি কিছু আর ভজনা দেবী বলেননি। অজিতেরও আগ্রহ হয়নি জানবার।

পুজোর আগে রঙ্গনাথজি ডেকে বললেন, অজিত, পীতাম্বরের কোনও খবর নেই। লেখাটা কী হল? তুমি পাত্তা লাগাও।

ঠিক আছে, চিঠি দিচ্ছি।

আরে দূর। পীতাম্বর চিঠির জবাব দেওয়ার মতো ভদ্রলোক নাকি? নিজে চলে যাও। ক্যাশ থেকে যাওয়া-আসার ভাড়া তুলে নিয়ে যাও, আমি অ্যাকাউনট্যান্টকে স্লিপ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ফের পীতাম্বরকে ধরা-করা করতে এল অজিত। এসেই বুঝল, সব ঠিকঠাক নেই। কোথায় একটা ছন্দপতন ঘটেছে। সেটা এতই বেশি যে, ফটকে ঢোকবার আগেই বোঝ যায়। ফটকের কাছে লালুয়া দাঁড়িয়ে ছিল, অজিতকে দেখেই হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে গেল। অজিত কাছে এসে দেখল, ফটকে তালা আটকানো। দুটোই অস্বাভাবিক ঘটনা।

অজিত বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, লালুয়া! এ লালুয়া! মহেন্দর!

একটু বাদে লালুয়া বেরিয়ে এল। হাতে চাবি। মুখে হাসি নেই। ফটক খুলে অজিতকে ঢুকতে দিয়েই আবার তালা আটকাল।

অজিত অবাক হয়ে বলে, তালা দিচ্ছিস কেন?

ওইসাহি হুকুম হ্যায়।

বাইরে নিমগাছের ছায়ায় তাকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল লালুয়া। বাইরে যে খুব কিছু পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, কিন্তু অজিত কেমন অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করল, বাড়িটায় কোনও প্রাণ নেই। কেন যেন থমথম করছে।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে পীতাম্বর এলেন। অপেক্ষাকৃত ধীর চলন। মুখ একটু যেন বেশি গম্ভীর। কিংবা গাম্ভীর্যের চেয়ে বলা উচিত উদ্বিগ্ন। গ্রীষ্মকালে যা দেখে গিয়েছিল তার চেয়ে যেন এই কয়েক মাসে একটু বুড়িয়ে গেছেন।

মিশিরজি, কী হয়েছে?

কিছু হয়নি তো! কী হবে?–পালটা বিস্ময় প্রকাশ করেন পীতাম্বর। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য হল না। কৃত্রিম শোনাল।

আপনার শরীর খারাপ করেনি তো?

শরীর থাকলেই খারাপ-ভাল হয়।–শুকনো গলায় বললেন পীতাম্বর। আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে গলায়।

কে জানে বাবা কী। নতুন বউটা পালিয়ে-টালিয়ে যায়নি তো! বিয়েটাই বোধহয় ভুল হয়েছিল। অজিত বিনীতভাবে লেখাটার কথা তুলতেই পীতাম্বর যেন চমকে ওঠেন, লেখা! কীসের লেখা!

ভুলে গেছেন মিশিরজি? আমাদের কাগজে লিখবেন বলেছিলেন যে। রঙ্গনাথজির সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। লেখা না পেলে আমার চাকরি থাকবে না।

পীতাম্বরের মুখে বিরক্তি এবং হতাশা যুগপৎ ফুটে উঠল। তেতো গলায় বললেন, লেখা টেখা আমার আসছে না বাপু। আমি খুব পরেসান আছি।

কেন মিশিরজি?

এত প্রশ্ন করো কেন অজিত? আমি এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।

রাগলে পীতাম্বর একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু সহজে রাগবার পাত্রই উনি নন। সারাজীবন পলিটিক্স করে করে ঝানু হয়েছেন। গালমন্দ অপমান বিস্তর হজম করতে হয়েছে। রাগ উত্তেজনা ভাবাবেগ সবই অতিশয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তাই এই সামান্য কথায় পীতাম্বরকে রেগে যেতে দেখে অজিত খুবই অবাক হল। এরপর কী বললে পীতাম্বর রাগ করবেন না সেটা বুঝতে না পেরে অজিত চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। হতবুদ্ধি।

পীতাম্বর নিজে থেকেই বললেন, আজ বরং যাও অজিত। পরে যোগাযোগ কোরো। আমার এখন একটু–

বলেই থেমে গেলেন।

অজিত খুব গাড়ল নয়। সাংবাদিকতা করে করে তার চোখ কিছু পেকেছে। হঠাৎ তার মনে হল, মুখ নয়, কিন্তু পীতাম্বরের চোখ তাকে কিছু বলতে চাইছে। সে স্থির চোখে পীতাম্বরকে নজর করতে করতে বলল, মিশিরজি, আমি আপনার অতিথি। অন্তত একটু জলও তো পেতে পারি।

জল! ওঃ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। এ লালুয়া

লালুয়া নয়, খুব ধীর পায়ে পায়জামা আর গেঞ্জি পরা একটা বিশাল চেহারার যুবক সামনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পেয়ারা গাছটার নিচু ডালে হাতের ভর রেখে দাঁড়াল। ছোকরাকে জন্মে দেখেনি অজিত।

লোকটি কে মিশিরজি?

পীতাম্বর খুব দ্রুত বললেন, আত্মীয় হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের।

পীতাম্বর জীবনে মিথ্যে কথা বলেছেন খুবই কম। হয়তো-বা একটিও বলেননি। এই মিথ্যেটা বলতে তাই বোধহয় তার মুখ ব্যথাতুর হয়ে উঠল। আগন্তুকটি কদাচ মিঠিয়ার আত্মীয় হতে পারে না। মিঠিয়া দেহাতি পেঁয়ো যুবতী, এ ছোকরার চোখে মুখে শিক্ষা ও আভিজাত্যের ছাপ আছে।

হঠাৎ পীতাম্বর বলে উঠলেন, যা দেখতে পাচ্ছ না তা কল্পনা করে নিয়ো না অজিত। প্লিজ।

কথাটার মানে অজিত বুঝতে পারল না। আলটপকা এ কথাটা পীতাম্বর বলছেন কেন? তবে সে ফের স্পষ্টভাবে টের পেল, পীতাম্বরের মুখ এক কথা বলছে, কিন্তু চোখ অন্য কিছু বলতে চাইছে।

অজিত খুব ভিতু নয়। সে মাফিয়া লিডার থেকে শুরু করে খুনে লুচ্চা বদমাশ বিস্তর ঘেঁটেছে চাকরির সুবাদে। সে হঠাৎ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, ছোটে মাতাজির আত্মীয়ের সঙ্গে কি পরিচয় হতে পারে না মিশিরজি?

পীতাম্বর হঠাৎ সচকিত হলেন, পরিচয়! ওঃ হ্যাঁ, কেন নয়?

পীতাম্বরের অস্বস্তি লক্ষ করে হঠাৎ অজিত লোকটার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, নমস্তে জি, আইয়ে না, বৈঠিয়ে ইহা পর।

লোকটা খুব অবাক হল। তবে এল। বেশ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর পদক্ষেপ। বেশ অহংকারী উচ্চশির গেরামভারী হাবভাব। মুখে হাসি-টাসি নেই। চারপাইয়ের ওপর সাবধানে বসে পলকহীন চোখে অজিতের দিকে চেয়ে রইল। জরিপ করছে। হিসেব করছে।

অজিতের একটা ইনটুইশন আছে। খুনি দেখলেই সে চিনতে পারে। কখনও ভুল হয় না। খুনির চোখে একটা আলগা চকচকে ভাব থাকবেই। সবাই বুঝতে পারে না, অজিত পারে। সে স্পষ্টই বুঝে নিল, এ লোকটা খুনি। পীতাম্বরের বাড়িতে এর জায়গা হওয়ার কথাই নয়। পীতাম্বরের বাড়ির জীবনযাত্রার একটা প্যাটার্ন আছে, তাতে এ ভীষণ বেমানান।

তার চেয়েও বড় কথা, মুখটা অজিতের চেনা। আবছা হলেও চেনা। কোনও ফোটোগ্রাফে সে এই মুখটা দেখেছে।

পীতাম্বর গুম মেরে গেছেন।

অজিত তরল গলায় হিন্দিতে বলে, আপনি মিশিরজির শ্বশুরবাড়ির মেহেমান শুনলাম। আমি অজিত, সামান্য সাংবাদিক।

লোকটা বিবেকানন্দের মতো বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দুর্দান্ত গমগমে গলায় বলে, ইহা ক্যা কাম হ্যায়?

অজিত মৃদু হেসে বলে, মিশিরজিকা সাথ কুছ কাম হ্যায়।

লোকটা অপমানজনক গলায় প্রায় ধমকে উঠল, তো ওহি কর লিজিয়ে।

পীতাম্বরের অস্বস্তি এরপরে বেড়ে গেল। অজিত সংকেতটা বুঝতে পারছে। কিন্তু পীতাম্বরের চোখ কী বলছে বা বলতে চাইছে সেটা বুঝতে পারল না। শুধু আন্দাজ করল পীতাম্বর সুখে নেই, সোয়াস্তিতে নেই, পীতাম্বর ভয় পেয়েছেন, চাপের মধ্যে আছেন।

অজিত উঠল। স্বাভাবিক গলায় বলল, আজ চলি মিশিরজি। আমাদের লেখাটার কথা মনে রাখবেন। সপ্তাহে একটা। পার আর্টিকেল আমরা দুশো টাকা করে দেব।

ভেবে দেখব। এখন যাও। ঠিকমতো কাম কাজ করো। হুশিয়ারসে। রঙ্গনাথকে বোলো আমরা ভাল আছি। ভজনাকেও বোলো।

পীতাম্বরের পুরো কথাটাকেই কেন সংকেতবাক্য বলে মনে হল অজিতের? যখন চলে আসছিল তখন শুনতে পেল, লোকটা পীতাম্বরকে জিজ্ঞেস করছে, হু ইজ হি?

লাইক মাই সনা—পীতাম্বর বললেন।

পাটনায় ফিরে অজিত সোজা অফিসে চলে গেল। তখন অনেক রাত। নাইট শিফট চলছে। অজিত তার কাগজ এবং অন্যান্য কাগজের পুরনো ফাইল নিয়ে বসল। বেয়ারা হবিবুরকে বলল, টেররিস্টদের ফোটোর ফাইলটা বের করে আনো।

প্রায় সারা রাত ফাইল ঘাঁটল অজিত। ভোরের দিকে একটা ফোটোগ্রাফ খুঁজে বের করল। পিছনে একটা ট্যাগ লাগানো। বেশ বড় ট্যাগ। সুরেন্দ্র ওরফে হরমিক সিং ওরফে বুক্কা ওরফে নাম সিং… অনেক নাম। সাসপেকটেড কিলার অফ… খুনের তালিকাটাও বেশ বড়। বেসড ইন কানাডা। সঙ্গে সবসময়ে দু’জন বা তিনজন সঙ্গী থাকবেই। চার বছর আগে দিল্লিতে ছিল, একবার গ্রেফতার হয়, কিন্তু প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যায়। সবসময়ে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও থেমে থাকে না। প্রপার আইডেন্টিফিকেশনের জন্য দিল্লি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

সকাল আটটায় টেলেক্স করল অজিত। কী হবে কে জানে!

তারপর ফোন করল ভজনা দেবীকে, মাতাজি, পীতাম্বর সাহেবের সত্যিই ফাঁড়া।

ভজনা দেবী শান্ত গলাতেই বলেন, কী হয়েছে রে?

আপনি অনেক ভি আই পিকে চেনেন মাতাজি। আপনি বললে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। মিশিরজি বিপন্ন। নিজের বাড়িতেই উনি একজন উগ্রবাদীর প্রতিভূ হয়ে আছেন।

কী যা-তা বলছিস রে পাগলা?

ঠিকই বলছি।অজিত সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে গেল।

ভজনা দেবী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তোকে তো বলেইছি ওর ফাঁড়া আছে।

এখন জ্যোতিষ ছাড়ুন মাতাজি। মবিলাইজ অল রিসোর্সেস।

আমার কি সত্যিই কিছু করা উচিত?

সেটা আপনার ধর্মই আপনাকে বলে দেবে। তিনি তো আপনার হাজব্যান্ড। ডিভোর্স পীতাম্বর করলেও আপনি তো মানেননি মাতাজি। আপনি সিঁদুর পরেন।

তুই তো আমাকে মা ডাকিস। এখন মাতাজি ডাকছিস কেন?

উঃ মা, এখন এই বিপদের মধ্যে ওসব প্রশ্ন কেন?

ভজনা দেবী আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, কেন যে তুই আবার আমাকে ওর ব্যাপারে জড়াতে চাইছিস!হা রে, তোর কোনও ভুল হচ্ছে না তো! লোকটা হয়তো সত্যিই ওর শ্বশুরবাড়ির লোক।

না মা, আমি তোক চিনি৷ এ হচ্ছে, সুরেন্দ্র বা সুরিন্দর। ব্যাড নেম ইন পুলিশ রেকর্ড।

তুই একটা কাজ করবি অজিত?

কী কাজ?

আর-একবার ওখানে যা।

গিয়ে?

ভাল করে বুঝে আয়। নইলে একটা হাল্লা মাচিয়ে পরে লজ্জায় পড়ে যেতে হতে পারে।

ঠিক আছে মা, যাব। কিন্তু আপনি ইতিমধ্যে বসে থাকবেন না কিন্তু। কিছু হয়ে যেতে পারে।

তুই আগে যা তো! কিন্তু খুব সাবধান।

অজিত গিয়েছিল। আর গিয়েছিল বলেই স্কুপ খবরটা দিতে পেরেছিল একমাত্র নিউ পাটনা টাইমস। পীতাম্বর, তার যুবতী বউ, দু’জন কাজের লোক অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল বিশাল বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়। পীতাম্বরের লাশ পড়ে ছিল তার প্রিয় নিমগাছের ছায়ায়। তার সত্তর বছরের মজবুত শরীর— যা নিয়ে চাপা অহংকারও ছিল তার প্রায় দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল কোমরের কাছ বরাবর। নিউ পাটনা টাইমস-এর সব কপি বিক্রি হয়ে গেল চোখের পলকে। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারায় অজিত যখন পাটনায় ফিরে অফিসে এল তখন রঙ্গনাথ তার পিঠ চাপড়ে একশো টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিলেন।

অজিত ভ্রুক্ষেপও করল না। টেলেক্সে আর-একটা মেসেজ পাঠাল দিল্লিতে। তিনজন উগ্রবাদী পীতাম্বরকে সপরিবারে খতম করে রাত বারোটার ডাউন দানাপুর এক্সপ্রেস ধরেছে। লোকাল পুলিশ খবর নিয়েছে, তাদের কলকাতার টিকিট ছিল।

বিস্বাদ মুখে, খিদে-তেষ্টা-ঘুমহারা অজিত ভজনা দেবীকে ফোন করল, মা, সরি।

একটু চাপা ধরা গলায় ভজনা দেবী বললেন, আমি ভবিতব্য মানি।

আমারই ভুল, লোকাল পুলিশকে আমারই অ্যালার্ট করে আসা উচিত ছিল।

কিছু লাভ হত না। পুলিশও এদের ভয় পায়। হয়তো পুলিশের আরও কিছু লোক মারা যেত। লালুয়াটাকে আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলাম। আর মহেন্দ্র–সেও তো কত ছেলেবেলায় আমার কাছে এসেছিল।

আপনার ওকে ডিভোর্স দেওয়া উচিত হয়নি মা। আপনি থাকলে এটা হতে পারত না।

কে বলল? যা হওয়ার ঠিকই হত। আমরা কি সবকিছু খণ্ডন করতে পারি?

মা, আপনি বড় ভাগ্যবাদী।

আমার বিজ্ঞান তাই বলে। কী করব বল!

পীতাম্বরের জন্য শোক— সে ত আছেই অজিতের। কিন্তু এ ঘটনার পিছনে স্টোরিটা কী? পীতাম্বর তাকে চোখ দিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। ওই অসমসাহসী লোকটিও মুখ খুলতে সাহস পাননি। পীতাম্বরকে চেনে অজিত, তিনি মৃত্যুভীত ছিলেন না। কিন্তু ব্যক্তিগত মৃত্যুকে অনেক কাপুরুষও ভয় পায় না, ভয় পায় প্রিয় বা আশ্রিতজনের মৃত্যুকে। পীতাম্বরের ভয়ও কি তাই ছিল? মিঠিয়া, লালুয়া, মহেন্দ্র এদের বাঁচানোর জন্যই কি তিনি মুখ বন্ধ রেখেছিলেন? সেটাই সম্ভব। পীতাম্বর সবসময়েই বলতেন, আই লাভ মাই ফোকস। চেনাজানা মানুষ, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, দলের লোক বা অনুগামী সকলকেই তিনি সবসময়ে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।

স্থানীয় পুলিশ অজিতের কাছে মুখ খুলল অনায়াসেই। তার কারণ ঘটনাটা বেশ বড় ধরনের এবং তারা যথেষ্ট ভীত। এক ইন্সপেক্টর বললেন, ফোর মার্ডারস ইয়েস। বাট থ্যাংক গড দে আর আউট অফ আওয়ার হেয়ার।

এ কথা কেন বলছেন?

আরে ভাই, ওদের ট্যাকল করার মতো কী আছে আমাদের বলুন তো? ওই তো গাদা বন্দুকের মতো আদ্যিকালের সব ভারী বন্দুক, আর এরাটিক রিভলবার। আর ওদের কাছে সফিস্টিকেটেড এ কে ফর্টিসেভেন আর সাবমেশিনগান, যা দিয়ে আমাদের এখানকার পুরো পুলিশ ফোর্সটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়। এদের সঙ্গে লড়ার জন্য কী দিয়েছে আমাদের গভর্নমেন্ট! এনি ট্রেনিং? দু-চার দিন লেফট-রাইট করে ছেড়ে দিলেই হয়ে গেল? ওদের দেখুন, প্রত্যেকে কম্যান্ডো ট্রেনিং নিয়ে আসছে পাকিস্তান বা চিন থেকে। বিদেশেও ট্রেন আপ করা হচ্ছে। ফুল মিলিটারি ট্রেনিং। আমাদের এক্স-মিলিটারিমেনরাও ওদের ভিতরে রয়েছে। আমরা সিভিলিয়ানদের ট্যাকল করতে পারি, মব ভায়োলেন্সের মোকাবিলায় যেতে পারি, গুন্ডাবাজি সামলাতে পারি, বাট নট দিস টাইপ অফ অ্যাডভারসারিজ।

একটা কথা বলবেন?

কী কথা?

রিগার্ডিং পীতাম্বর মিশ্রজির ইয়ং ওয়াইফ। ওয়াজ শি রেপড?

মাই গড! নো স্যার। আমরা ও অ্যাঙ্গেলটা খুব ভাল করে দেখেছি। মিলিটান্টরা এ কাজ। বড় একটা করে না। মে বি দে হ্যাভ সাম আইডিয়ালস। তবে মার্ডারের তিন-চারদিন আগে আশেপাশের দুটো গ্রামীণ ব্যাংক লুটপাট এবং মার্ডার হয়েছে। লাখ খানেকের মতো টাকা গেছে। দুটো ব্যাংকেই আমরা এনকোয়ারি করেছি। কেউ মুখ খুলছে না। উলটোপালটা বলছে। অ্যাবসেলিউটলি টেরোরাইজড। এখন বুঝতে পারছি পীতাম্বর মিশ্রজির মার্ডারার আর ব্যাংক ডাকাত একই দল।

তারা ক’জন?

তিনজন?

টাকার অ্যাঙ্গলটার কথা মনে ছিল না অজিতের। সে এরপর পীতাম্বরের ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিল। গত সপ্তাহে পীতাম্বর তার চারটে মোটা টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচুরিটির অনেক আগেই ভাঙিয়ে নিয়েছেন এবং তুলে নিয়েছেন সেভিংস অ্যাকাউন্টের প্রায় সব টাকা। সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক তো হবেই।

মুংলি পীতাম্বরের তিনটে মোষের জন্য ঘাস কেটে এনে দিত। আর রতুয়া আসত খেউরি করতে। পীতাম্বরের খানাতল্লাসে তারা প্রথমটায় ভয় পেয়ে মুখ বুজে থাকলেও পরে যা জানাল তা হল, প্রায় এক মাস হল তিনটে গুন্ডা ধরনের লোক পীতাম্বরের বাসায় থানা গাড়ে। প্রথমটায় কিছু বোঝা যায়নি। পিছনের বাগানে পীতাম্বর ওদের সঙ্গে কয়েকদিন বন্দুক নিয়ে চাঁদমারি করেছিলেন। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন ফটকে তালা পড়ে গেল। বাড়ি থেকে কেউ বেরোত না। মুংলি ঘাসের বোঝা নিয়ে গেলে ফটকের ওপর দিয়ে ভিতরে ফেলতে হত, লালুয়া তুলে নিয়ে যেত। রতুয়া অবশ্য ভিতরে ঢুকে খেউরি করে আসত, তবে সবসময়ে লক্ষ করত আশেপাশে কেউ না কেউ মোতায়েন আছেই!

তবে বাজারহাট করত কে?

ওই তিনজনেরই একজন। আর কেউ বাড়ির বাইরে আসত না। পীতাম্বরজি অবশ্য কয়েকবার বেরিয়েছেন, কিন্তু সঙ্গে ওদের কেউ থাকত।

তোরা পুলিশে খবর দিসনি কেন? বা

প রে! জানে মেরে দিত বাবু! ওসব বহুত খতরনাক আদমি।

পুলিশের অনুমতি নিয়ে একদিন পীতাম্বরের বাড়িতে ঢুকল অজিত। দু’জন কনস্টেবল পাহারায় ছিল, তাদেরই একজন বাড়ির দরজার তালা খুলে দিয়ে সাবধান করে দিল, জিনিসপত্রে হাত দেবেন না।

পিছনের ঘরটায় সেই ছোট সুটকেসটা খুঁজে দেখল অজিত। পাবে বলে আশা করেনি। পেলও না। বিপ্লবীর অস্ত্র হাতে পেয়েও পীতাম্বর নিজেকে বাঁচাতে পারেননি, অস্ত্রটাও যোগ্য হাতে ফিরে গেছে। পীতাম্বরের লেখাপড়ার টেবিলটা খুঁজল অজিত। ফুলস্ক্যাপ কাগজের দেড়খানা লেখা পৃষ্ঠা পেল। মনে হল, তাদের কাগজের জন্যই লিখতে শুরু করেছিলেন পীতাম্বর। এগোতে পারেননি। অজিত দেড়খানা পৃষ্ঠা চুরি করল অম্লানবদনে।

পাটনায় এসে সে পীতাম্বর মার্ডার কেসের ওপর সংগৃহীত তথ্যাবলী সহ স্টোরি খাড়া করল। মুখপাত্র হিসেবে রইল পীতাম্বরের অসম্পূর্ণ লেখাটা। পরপর কয়েকদিন ধরে বেরোল রংদার কাহিনিটি।

নিউ পাটনা টাইমস ডুবতে ডুবতেও যেন প্রবল বিক্রমে ভেসে উঠতে লাগল। রাতারাতি সার্কুলেশন বেড়ে গেল দশ হাজার। রঙ্গনাথের মুখে হাসি। অথচ লোকটা একসময়ে পীতাম্বরের বন্ধু ছিল। এখন পীতাম্বর এঁর কাছে শুধু একটা গরম খবর মাত্র। আর কিছু নয়। পীতাম্বরের খুনের খবর স্কুপ করতে পারায় এ লোকটা দারুণ খুশি হয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন!

অজিত শিউরে উঠে ভাবে, আমিও কি ওরকম হয়ে যাব? ওরকম হৃদয়হীন, স্বার্থপর?

রঙ্গনাথ একদিন তাকে ডেকে বললেন, শোনো অজিত, নিউ পাটনা টাইমসের একটা হিন্দি এডিশন বের করার পারমিশন চেয়ে আমি অনেক আগেই একটা দরখাস্ত করেছিলাম। পারমিশনটা এসে গেছে। বাজার গরম থাকতে থাকতেই আমি হিন্দি এডিশনটা বের করতে চাই। গেট রেডি ফর মোর ওয়ার্ক।

উইথ মোর পে স্যার?

রঙ্গনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর হাসলেনও, অফকোর্স। তোমাকে ওভার অল ইনচার্জ করে দিচ্ছি। দুটো কাগজই দেখবে।

পীতাম্বর বরাবর তার উপকারই করে এসেছেন। পুত্রবৎ দেখতেন অজিতকে। মৃত্যুর ভিতর দিয়েও শেষ উপকারটাই করে গেলেন বোধহয়। অজিতের চোখ ঝাপসা হয়ে এল আবেগে।

পাটনার আই বি কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে অজিতের খাতির অনেকদিনের। আগাগোড়া যোগাযোগ। কালিকা একদিন বলল, তুই ভাবতে পারিস, সুরিন্দর— শুধু সুরিন্দরের জন্যই একটা আলাদা সেল আছে স্পেশাল ব্রাঞ্চে? চারটে মোস্ট এফিসিয়েন্ট অফিসার দিনরাত মনিটর করছে ওর অ্যাকটিভিটি। সারা ভারতবর্ষে যেখানে সুরিন্দরের গন্ধ পায় সেখানেই ছুটে যাচ্ছে ওরা। ওদের সন্দেহ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, পঞ্জাব থেকে অসম সারা দেশে একটা সন্ত্রাসের ঢেউ তুলে দিচ্ছে ওই একটা লোক। ওকে ধরতে পারলে অবশ্য ধরা কথাটা নিতান্তই কথার কথা আসলে মারতে পারলে সরকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *