কাঁসাই চরের গল্প কথা
সবুজ ফসলে ঢাকা দুকূলের উধাও ধূ ধূ মাঠ। মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জঙ্গলকন্যা কাঁসাইয়ের তন্বী শরীর। সাতবউনি থানের কাছে নদীর বুকে বিশাল চর। দু পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছতোয়া কিশোরী কাঁসাই। হাঁটু ডোবা বা কোথাও বা কোমর সমান জল। এই চর হলো খেজুর-গুড়-তৈরির আডত। শীতকালের শিউলি রা এখানে চালা বেঁধে খেজুর গুড় পাটালি (লবাত) বানায়! নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করতে থাকে চরের বাতাস। নদীর চরের দু’পাশেই নদীর ঘাট। জল ভেঙ্গে গ্রামের মানুষ চরে আসে হামেশাই। চরের কচি কচি সবুজ ঘাসে গরু-ছাগল মুখ ডুবিয়ে খায় !রাখাল আডবাঁশি বাজায়, গুড কারিগরদের সাথে গল্পগাছা করে।
এই গুড কারিগরদের ছেলে কানাই— রূপে গুণে সত্যিই কানাই তুল্য। কষ্টিপাথরে কোঁদা শ্যাম মূর্তি যেন। মা-মরা কানাই বাবার চোখের মনি। যত বড় হচ্ছে বাবা যেন আরো ওকে জড়িয়ে ধরছে। এবার গুড়ের মৌসুম শুরু হতেই সুফল কানাইয়ের বাবাও কে সাথে নিয়ে এসেছে চরে। ওরাসিমলাপাল এর বাসিন্দা ।ছোট্ট ভদ্রাসন আর কয়েক বিঘা জমি এই সম্বল। ওই জমিতে সম্বৎসর এর অন্ন জোটে না তাই এই গুড়ের কারিগরি। সুফলের নলেন গুড় ও লবাতের খুব নাম। ও চায় কানাই যেন এই কারিগরির উত্তরাধিকার বহন করে। কানাইয়ের মন নেই। বাঁশি বাজিয়ে পাখপাখালির ডাক অনুকরণ করে ওর দিন কাটে। এবার জোর করে নিয়ে এসেছে এখানে। চর পেরলে ছোট্ট ক ঘরের গ্রাম কাজলী। সব মিলিয়ে 10 ঘর হবে। সবই চাষী। কেবল একঘর মাত্র বামুন। এদেশে উৎকল বামুনদেরই আধিপত্য সম্পন্ন গৃহস্ত এই সন গিরি বামুনরা। ওদেরই আমন্ত্রণে এই চরের গুডের আডত। এই চরটা ওই ব্রাহ্মণদের। কানাই এই কাজলী গাঁয়ের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই ওর অবাধ যাতায়াত। মা মরা ছেলেটাকে গ্রামের সবাই আপন করে নিয়েছে। বেশিরভাগ দিনে ও গ্রামের কারুর না কারুর বাড়িতে খেয়ে নেয়। ওর বাবা অবাক হয়ে যান। কানাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় বাড়ির কাজলী গ্রামের মনসাথানের দেহুরীর বাড়ি। ওই বাড়ির মেয়ে ময়না ওর খুব প্রিয় বন্ধু। ময়নার মা কানাই কে খুব স্নেহ করেন। মা-মরা কানাই বেহুলার মাঝে নিজের মাকে খুঁজে পায়। দেখতে দেখতে দন্ডপলের হিসেবে কেটে গেছে পাঁচটি বছর সেদিনের কিশোর কানাই আজ সা জোয়ান। ময়নাও আর ছোট্টটি নেই। ওদের এই মেলামেশাটা আর সবার চোখে বেশ কাঁ’টা ফোটাতে লাগল। দশের কথায় ময়না কে কানাইয়ের সাথে মেলামেশায় বাধা দিল পরিবার, সমাজ। দেখতে দেখতে বর্ষায় মনসা পূজার দিন এসে গেল! এই গ্রামের মনসার ঝাঁপান খুব বিখ্যাত। সারা রাঢ় বাংলা থেকে বেদেরা আসে মা মনসার চ্যালা চামুন্ডারা দের নিয়ে। তুমডিবাঁশি,বিষম ঢাকির বোলে মা বিষহরির নাম গান এ চরাচর মেতে ওঠে। গ্রাম ছাড়িয়ে নদীর চরে বসে মেলার দোকান দানি। মেটেল বেদেদের সাথে সাথে বেদের নৌকা ও আসে চরে তবে সংখ্যায় কম। নানারকম পশুপাখি আর সাপ এদের সাথে। ছোট থেকে বিরাট বড় বড় সাপের ঝাঁপি। কাঁধের বাঁকে করে নিয়েই গৃহস্থের দুয়ারে দুয়ারে সাপ খেলা দেখিয়ে বেড়ায় এরা। কানাই একা একাই বেদেদের সাথে ঘুরে ঘুরে সাপ খেলা দেখে। এক বেদে বুড়োর সাথে ভালই সখ্যতা পাতিয়ে বুড়োর নাতি হয়ে ওঠে। বুড়োতাকে সাপ ধরা, সাপ চেনা সাপ খেলার ও শিক্ষা দেয়,। লোকমুখে শুনেছে ময়নার নাকি বিয়ে, মনসার ঝাঁপান এর পরপরই। কানাই কিছুতেই ময়নার সাথে দেখা করতে পারে না। যা থাকে কপালে বলে মা বিষহরির নাম নিয়ে তুমরি বাঁশি হাতে মনসাতলা এসে উপস্থিত হয়। পরনে বেদেদের মতোই লুঙ্গি ফতুয়া মাথায় ফেট্টি হাতে তুমডি বাঁশিও কাঁধে সাপের ঝাঁপি। ওকে দেখে অবাক হয়ে যায় সবাই —ময়নাও। ওরসাপ খেলানো দেখে সবাই অবাক। ও ময়না দের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়— বেহুলা ওকে সাদরে উঠোনে ডাকে! সিধা দেয়। তারপর বলে—” বাবা ময়নাকে তুমি ভুলে যাও! দেহুরী বংশের মেয়েকে বাইরের কারো সাথে বিয়ে দেবে না এই পরিবার।। আর তুমি কেন বেদেদের সাথে ঘুরছ? চাষির ছেলে তুমি কেন বাউন্ডুলে বিবাগী হবে?” কানাই নিরুত্তর! সাপের ঝাঁপি নিয়ে চরের অভিমুখে চলে সে। রাস্তায় মনসা থানের জঙ্গল আড়ালে ময়না দাঁড়িয়ে। ওকে দেখেই বলে— “তোমার জন্য অপেক্ষা করছি! তুমি আমাকে ভুলে যেও সংসারী হয়ো! ময়নাকে মনসার দেয়াসিনী হতে হবে এ কথাটা মনে রেখো!”
কানাই কে হতভম্ব করে সবুজ অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ময়না!—————–!
আস্তে আস্তে বিষম ঢাকির ধুমূলে বাস্তবে ফেরে প্রৌড বেদে সর্দার কানাই। বেদে সর্দার কানাইয়ের বেদেদল এসেছে কাজলী গাঁয়ের মনসার ঝাঁপানে কানাইয়ের মনে পড়ে ময়নার সাথে শেষ দেখার দিন টা। সচেতন হয়ে থানের মাটিতে ঝাঁপি সাজিয়ে বসে। তুমডি বাঁশির মায়াবী সুরেও বিষম ঢাকির বোলে মুখরিত মনসা আটন। মনসার দেয়াসিনী মা এসে বিষহরির ঘটে পূজা করেন। প্রৌডা ময়নাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে— এলোকেশী ময়নার কপাল জোড়া সিঁদুরের টিপ! অবিবাহিতা ময়না আজ– মা ময়না– মনসার দেয়াসিনী!
পূজা শেষে শুরু হয় ঝাঁপান খেলা। মা বিষহরির সন্তানদের নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা ক্ষন কানাই কে বারবার সেই ফেলে আসা সময় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
আস্তে আস্তে মনসাতলার পেছনের আঁকাবাঁকা পথে চলতে শুরু করে কানাই।পথ শেষ হয়েছে দেয়াসিনী মার বাসস্থানে। ওর ডাকে ঘর থেকে বেরোয় ময়না— মা মনসার দেয়াসিনী! চমকে ওঠে কানাই কে দেখে! কানাই বলে- চিনতে পারছ? দেখো আজ বেদে হয়েই এসেছি তোমার থানে। আমার দলকে আশীর্বাদ করো মা বিষহরি কৃপা যেন পায়। আমি যেন মনসার দেয়াসিনীর কৃপা পাই। ময়নার চোখ থেকে ঝরে পড়ে ভালবাসার অশ্রু যা এতদিন রুদ্ধদ্বার ছিল। ভালোবাসার রামধনুর রঙে শাওন আকাশে ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে পড়ে।তুমডি বাঁশির সুরে ভেসে যায় কাঁসাই চর। দিনমণি অস্তাচলে যান পশ্চিম দিগন্ত রাঙ্গা করে। মায়াবী আঁধারে ঢাকা পড়ে কাঁসাই চর এক অপার্থিব মায়ায়।