কাঁকলাস
বিলিতি মদ দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে পায়ের শুকনো চামড়া নরম হয়ে যায়। তারপর একটু একটু করে উঠতে উঠতে সাফসুতরো–এই পরামর্শ দিয়েছিল গদাধর। টায়ারের জুতো পরে-পরে চামড়াটা মোষের ঘাড়ের মতো হয়ে গেছে। ব্যথা নেই, রস গড়ায় না কিন্তু চোখ পড়লেই বিশ্রী হয়ে যায় মনটা। তার এখন যে বয়স তাতে শরীরের খোলতাই কেউ আশা করে না। হাজামের কাছে উবু হয়ে বসতে কখনও-কখনও দিনদশেকও পার হয়ে যায়। খাঁকি শার্ট আর রঙিন পাজামার ঘাম জমে-জমে বিদঘুঁটে যে গন্ধটা তৈরি হয় তার সঙ্গে পাকা কাঁচা খোঁচা দাড়ি চমৎকার মানিয়ে যায়। এইজন্যে অবশ্য মালিকের কাছে কোনও কটু মন্তব্য শুনতে হয় না জীবনে। তবে গাড়িতে উঠলে নাক কুঁচকে যায় মেমসাহেবের। অবশ্য মেমসাহেব এ গাড়িতে উঠেছেন গোনাগুনতি তিনবার। এই পাগলা গাড়িতে কেউ উঠতে চায় না। যদি পেটে কিছু না পড়ে।
তিনবছর জিপটা চালাচ্ছে আকাশলাল। এর আগে সে ছিল শিলিগুঁড়িতে। বলরামবাবুর অ্যাম্বাসাডার চালাত। তার আগে কাটিহারে। জীবনভোর কত গাড়ি চালানো হল। সবকটা গাড়ির চরিত্র আলাদা। মর্জি না বুঝেছ তো ফাঁসলে। এই সব জেনেশুনে চালাত বলে আকাশলালের খ্যাতি হয়েছিল। বলরামবাবুর ওখান থেকে তাকে নিয়ে এল এই মালিক। লোকটাকে দেখে তার ভালো লেগেছিল। ঝকঝকে চেহারা, ফরসা, বছর তিরিশের মধ্যে বয়স। ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছে। দেখলে বেশ স্নেহ-স্নেহ বোধ জাগে। বলরামবাবু বলেছিল, চলে যাও ডুয়ার্সে। কাজের ঝামেলা কম। তোমারও তো বয়স হচ্ছে। তিরিশ টাকা বেশি মাইনে দেবে। ছোঁকরার এখন খুব ভালো সময় যাচ্ছে। কোনও নেশাভাঙ করে না, অনেক উঁচুতে উঠবে।
কি যেন মন বুঝল। বলরামবাবুর গ্যারাজ ছেড়ে চলে এল নতুন মালিকের সঙ্গে। তখন এই মালিকের দুটো গাড়ি ছিল। ফিয়াটটা চাপত মেমসাহেব। জিপে বড় হাওয়া ঢোকে, হুড খোলা থাকায় আব্রু থাকত না বলে ফিয়াটটাই পছন্দ করত মেমসাহেব। ফিয়াট চালাত একটা নেপালি ছোঁকরা। খুব সাজগোজ ছিল তার। তার পোশাক-আশাক এবং বয়স দেখে কথাই বলতে চাইত ছোকরাটা। সেই গাড়ি নেই, সেই ছোঁকরাও নেই। তখন মালিক আর মেমসাহেবকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন দেখতে ইচ্ছে করে না।
তিন বছর আগে হুইলে বসত আকাশলাল। সকাল সাতটায় মালিক নাস্তা খেয়ে চটপটে পায়ে এসে জিপে উঠত। সোজা সাইটে কিংবা সদরের ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে ছুটে যেতে হত তাকে। ভোর-ভোর স্নান সেরে পুজো করে নিয়ে পবিত্র মনে স্টিয়ারিং ধরে ভোরের হাওয়া রোদ মাখতে খুব আরাম লাগত আকাশলালের। ডুয়ার্সের ঝকঝকে রাস্তায় দুপাশে গাছের সারি রেখে ছুটে। যেতে কি যে আরাম লাগত! শিলিগুঁড়ি ছেড়ে চলে এসে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে বলে মনে হত। এইরকম হাওয়া শরীরে লাগলে বেঁচে থাকাটা বেশ আরামদায়ক হয়। যেতে-যেতে মালিক জিজ্ঞাসা করত, এই জিপটাকে চালাতে তোমার কেমন লাগছে আকাশলাল?
বহুৎ আচ্ছা মালিক, ঠিকই হ্যায়।
আমার বউ এই জিপটায় উঠতেই চায় না, বুঝলে? কেন উঠতে চায় না জানো?
নেহি মালিক।
ও বলে জিপ হচ্ছে কাটখোট্টা পুরুষের মতো, রসকস নেই! কথাটা বলে হো-হো করে হেসে। উঠত মালিক। কথাটা আকাশলালের মন খারাপ করে দিত। ড্রাইভার হিসেবে সে যে ওই নেপালি ছেলেটার চেয়ে ঢের ভালো এটা মেমসাহেবের জানা উচিত।
রবিবার মালিক বাড়ির বাইরে বের হত না। সেদিনটা চমৎকার কাটত আকাশলালের। ছিপ নিয়ে বেরিয়ে যেতঝিলে। বিশাল ঝিল। কালো জল সেখানে স্থির হয়ে থাকে অনেক রহস্য নিয়ে। পুঁটি, কাতলার বাচ্চা চটপট উঠে আসে। কিন্তু তাদের সাইজ এক বিঘতের মধ্যে। আকাশলাল মাছ মাংস মদ খায় না। শিকার করা মাছগুলো সে পৌঁছে দিত মালিকের বাড়িতে। প্রথম দিনই মালিক মাথা নেড়েছিল, এই মাছ কে খাবে আকাশ? ছোট মাছে বেজায় কাঁটা। আমার বউ কাঁটা বাছতে পারে না। তুমি খেয়ে নিও।
আমি তো মাছ খাই না মালিক।
আচ্ছা তাহলে ধরো কেন?
ধরতে ভালো লাগে।
তাহলে রেখে যাও। চাকরবাকর খাবে। তাই করত আকাশলাল। তিন রবিবার। শেষ পর্যন্ত ছিপ নিয়ে বের হওয়া বন্ধ করল। সারাদিন কাঠের ঘরের সিঁড়িতে বসে দেখত প্রচুর মানুষ দঙ্গল বেঁধে বসে গেছে ঝিল-এর চারপাশে। মানুষ যা পারে তা ঈশ্বরও পারেন না। দেখতে-দেখতে ঝিলটা ফাঁকা হয়ে গেল। বঁড়শি পড়লে ফাত্তা। নড়ে না। শুধু মাঝখানে জল তোলপাড় করে একটা বিশাল মাছ শরীর মোচড়াত। অনেকে অনেকরকম চেষ্টা করেছে, কোনও টোপই চেখে দ্যাখেনি মাছটা। হতাশ মানুষেরা রটিয়ে দিয়েছে মাছটার শরীর এত পেকে গিয়েছে যে তার শক্ত মাংস খাওয়া যাবে না। এখন দু-একজন ঝিলের পাশে বসে কি বসে না। এ দৃশ্য উদাস চোখে চেয়ে দ্যাখে আকাশলাল। দ্যাখে আর পায়ের শক্ত চামড়ায় হাত বোলায়। গদাধর বলেছিল বিলিতি মদে ভিজিয়ে রাখতে। বিলিতি মদের দাম। অনেক। যারা বিলিতি পেটে ঢালে তারা পায়ের চামড়ায় কি নষ্ট হতে দেবে! কয়েক মাস আগে হলে সে নিজেই একটা বিলিতি কিনে ফেলতে পারত। তারপর তুলোয় জড়িয়ে পায়ের চামড়া ভেজাত। কিন্তু তিন মাস আগে শেষ টাকা পেয়েছে মালিকের কাছ থেকে। বড় ভয় লাগে জমানো টাকা খরচ করতে। আগে এমন হলে চট করে সে অন্য একটা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার চাকরি নিয়ে চলে যেত। গেছেও তো কতবার। কিন্তু এবার পারছে না। বয়স হয়েছে তার? সে কথা ঠিক। এমনকী শরীরের চামড়াও কুঁচকেছে। কিন্তু তাই বলে খাটবার শক্তি তো যায়নি। তবু যেতে ইচ্ছে করছে না কোথাও। অস্বস্তি না ভয়, সেটা বুঝতে পারে না আকাশলাল। ডুয়ার্সের এই জায়গাটা। তার মন থেকে শেকড় নামিয়েছে হাজারটা। তাছাড়া গত কয়েকমাস সে কবার স্টিয়ারিং ধরেছে। গুনে বলতে পারে। গাড়ি না চালিয়ে না চালিয়ে চালাবার মনটায় কেমন জং ধরে গেছে। যা টাকা তার কাছে আছে তাতে আরও এক বছর এই ঘরে বসে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে মালিকের জন্যে। এইখানেই একটু গোলমাল হয়ে যায় আকাশলালের। ঈশ্বরকে মানুষ। খেলায় না মানুষকে ঈশ্বর? ছয়মাস আগে হলে সে প্রতিদিন রাত্রে বোতল-বোতল বিলিতি মদ পায়ে ঢালতে পারত। তখন তো পায়ের চামড়াটা শক্ত হয়নি। এখন চেষ্টা করলে মালিকের সঞ্চয় থেকে আধ বোতল দিশি সরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু দিশিতে এটা সারবে না বলে জানিয়েছে গদাধর।
বড় কন্ট্রাক্ট পাওয়ার কথা ছিল মালিকের। শিলিগুঁড়ির হরি সাহার কাছে গিয়েছিল খোশমেজাজে। যাওয়ার সময় মালিক জিপে বসে বলেছিল কাজটা এত বড় যে তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ ওটা করতে পারলে সারাজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা যাবে। শিলিগুঁড়ির হরি সাহাও কাজটা চায় কিন্তু তার একার দ্বারা হবে না। অতএব দুজনে মিলতে চায়। পার্টনারশিপে। ব্যবসাটা চালাবে শুধু এই কাজটার জন্যে। কখনও-কখনও মালিকের মন ভালো থাকলে এইসব কথা বলত। ব্যাপারটা ভালো লাগেনি আকাশলালের। অন্যের ওপর বিশ্বাস কতদিন টিকে থাকে? কিন্তু কিছুই বলেনি সে। তার সাজে না মতামত জানানো।
কিন্তু সেই রাত্রে, জলপাইগুঁড়ি শহরের বাইপাস দিয়ে হু-হুঁ করে গাড়ি চালিয়ে ফেরার সময় একদম বেহুশ হয়ে থাকা মালিকের শরীরটার দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করেছিল, এটা ঠিক না মালিক। নিজের শরীরটা অন্যের কাছে ছেড়ে দিলে কুকুরও লাথি মারে। নিজের ব্যবসা অন্যের সঙ্গে জুড়লে তার ইচ্ছেটাও রাখতে হয়। লোকটা আপনার বন্ধু নয় মালিক। প্রথম রাত্রে এত মদ খাওয়ায় যে, সে আপনার বন্ধু হতে পারে না। কিন্তু সেসব কথা শোনার ক্ষমতা ছিল না মালিকের। বাড়ির সামনে জিপ থামিয়ে আকাশলাল দেখেছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেটা ভালোই বলে মনে। হয়েছিল তার। মালিকের ওই অবস্থা অন্য চাকরবাকর দেখুক সে চাইছিল না। মালিকের শরীরটা কাঁধে তুলে নিয়ে গেট খুলে সোজা দোতলায় উঠে গিয়েছিল। কোন ঘরে মালিক ঘুমোয় তা সে জানত না। দরজা বন্ধ সবকটা ঘরের। তার মনে হয়েছিল যে বাড়ি মালিক যত্ন করে বানিয়েছে তার দরজা অন্য মানুষরা বন্ধ করে রাখে কেন? সে চাপা গলায় ডেকেছিল, মেমসাব, মেমসাব, মালিক আয়া হ্যায়।
দক্ষিণের ঘরের দরজা খুলে গেল। মেমসাহেব আলো জ্বেলে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?
আমি মেমসাব। মালিকের শরীর ঠিক নেই। তারপর মালিককে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চুপচাপ নেমে এসেছিল নিচে। সেই রাত্রে তার খুব খারাপ লেগেছিল। মালিকের মদ খাওয়ার জন্যে তো বটেই, আরও খারাপ লেগেছিল এই জন্যে মেমসাহেব কি করে ঘুমিয়ে ছিল? অতরাত্রে বিনা নোটিশে মালিক কখনও বাড়ি ফিরত না!
একবার আগল ভাঙলে জল ঢোকা বন্ধ করে কার সাধ্য। সন্ধেবেলায় মালিকের যাওয়ার জায়গা বেড়ে যেতে লাগল। আজ শিলিগুঁড়ি তো কাল হাসিমারা, সামচি থেকে মালবাজার ছুটোছুটি। করতে হত আকাশলালকে। আর গভীর রাত্রে বেশ একটা শরীর কাঁধে তুলে পৌঁছে দিয়ে আসত আকাশলাল। তখন ঘর অন্ধকার থাকত। তাকে ডাকতে হত না। মেমসাহেব কোনও কথা বলত না। কাজ শেষ করে সে চুপচাপ নেমে আসত। ক্রমশ মালিকের শরীরটা পালটে যেতে লাগল। একটা কালো ছায়া চেহারাটাকে মুড়ে ফেলল ধীরে-ধীরে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা ঘটল। হরি সাহার কাছে গিয়েছিল মালিক। বাড়ির বাইরে জিপ নিয়ে বসেছিল আকাশলাল রোজ যেমন বসে থাকে। রাত বাড়লে, রাস্তায় মানুষ-চলা শেষ হলে ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এল। তারপর মালিক বেরিয়ে এল টলতে-টলতে। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। হরি সাহা পেছন পেছন ছুটে এসে চিৎকার করল, প্রমাণ করো আমি তোমার টাকা মেরেছি। ফের যদি এই নিয়ে কথা বলো তাহলে লাশ নামিয়ে দেব। আজ রক্ত দেখিয়ে দিলাম মাত্র। আকাশলালের হাত নিসপিস করছিল। কিন্তু মালিক গাড়িতে উঠে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে কোনওমতে বলল, বাড়ি চলো, বাড়ি চলো।
আকাশলালের মনে হয়েছিল হাসপাতালে যাওয়া উচিত। মালিক বিড়বিড় করে নিজের মনে উচ্চারণ করেছিল, সব শেষ, ফতুর হয়ে গেলাম। তাপর খুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল আকাশলালের। তার বলতে ইচ্ছে করছিল, কিছুই শেষ হয় না মালিক। সব শেষ মানেই কিছুর শুরু। আপনি কাঁদবেন না। তার আগেই মালিক চিৎকার করে উঠেছিল, কোথায় যাচ্ছ এদিকে?
হসপিটাল মালিক।
কোন শুয়োরের বাচ্চা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে? ঘোরাও গাড়ি!
মালিক আপনার বহুৎ খুন–।
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মালিক তাকে বলেছিল গাড়ি থামাতে। হসপিটালের কাছাকাছি নির্জন রাস্তায় গাড়ি থামানো মাত্র মালিক তাকে বলল, স্টিয়ারিং থেকে সরে যেতে। ভয়ে-ভয়ে সে গাড়ি থেকে নেমে পেছনে উঠে বসল। তারপরেই শুরু হল ছুটে যাওয়া। ছুটে যাওয়া না বলে উড়ে যাওয়া বললেই ভালো হত। গাড়ি একবার রাস্তার এপাশে চলে যাচ্ছে আর একবার ওপাশে। ভয়ে চিষ্কার করে উঠল আকাশলাল। মালিককে তখন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। তার চিল্কারে কোনও কাজ হচ্ছিল না। প্রাণের ভয়ে সে সরে এল পেছনে। মাথার ওপরের রড দুহাতে ধরে পা ঝুলিয়ে রাখল বাইরে। যে মুহূর্তে অ্যাক্সিডেন্ট হবে সেই মুহূর্তেই যাতে লাফিয়ে পড়তে। পারে এমন ভঙ্গিতে তৈরি হয়ে থাকল সে। যে রাস্তা তার আসতে লাগত একঘণ্টা মালিক চলে এল প্রায় আধা সময়ে। বাড়ির সামনে জিপের ইঞ্জিন বন্ধ করে টলতে-টলতে ঢুকে গেল বাড়িতে। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছিল আকাশলালের। ওই জিপটাকেও তার মনে হচ্ছিল একটা পাগলা ঘোড়ার মতো। মালিক চলে যাওয়ার পরও সে ঝুম হয়ে বসে ছিল একই ভঙ্গিতে। চেতনা। সচকিত হল মেমসাহেবের গলায় নিজের নামটি শুনে। চমকে লাফিয়ে নেমেছিল জিপ থেকে। মেমসাহেব বলেছিলেন, অনেকক্ষণ তোমাকে ডেকেছি, ঘুমুচ্ছিলে নাকি? গাড়ি চালিয়ে এল কে?
মালিক। আকাশলাল এত রাত্রে মেমসাহেবকে এখানে দেখবে তা কল্পনাও করেনি। কিছু বোঝার আগেই মেমসাহেব ফিরে গেলেন বাড়িতে।
দুদিন গাড়ি বের হয়নি তারপর। বেহুঁশ ছিল মালিক জ্বরে। ডাক্তার যাওয়া-আসা করেছে। ডাক পড়েনি আকাশলালের। ঝিলের ধারে কাঠের বারান্দায় বসে সে ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করেছিল। খানা পাকাতে ইচ্ছে করেনি, ছাতু খয়েছে একদিন। তারপর ছিপ নিয়ে বসে থেকেছে জলের। ধারে। ফাৎনার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বেশ সময় কেটে যায়।
মালিকের বাড়িতে দুটো ঘটনা ঘটল। নেপালি ড্রাইভারটার চাকরি গেল। গাড়িটা বিক্রি করে দিল মালিক। কানে আসে, মেমসাহেব নাকি আপত্তি করেছিলেন। বিক্রি করতে হলে জিপটা ছেড়ে দেওয়াই উচিত। মালিক শোনেনি। সকাল বেলায় মাদারিহাটের কাছে একটা সাইটে তাকে নিয়ে যেত আকাশলাল। ওটাই মালিকের শেষ কাজ। রাস্তা তেরি হচ্ছে। কনস্ট্রকাশনের কাজও চলছে। স্নান করে ফিটফাট হয়ে যখন মালিক জিপে চাপত তখন স্টিয়ারিং হাতে খুশি হত আকাশলাল। কিন্তু সাইটে গিয়েই মদের বোতল খুলত মালিক। একটা কুয়ো খোঁড়া হয়েছিল কাজের জন্যে। জল তুলতে, সেটা ভরে উঠল মদের বোতলে। অর রাত বাড়লে যখন কোনও হুঁশ নেই তখন প্রাণ ধড়াস-ধড়াস করত আকাশলালের। চিৎকার করে তাকে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিতে বলত মালিক। টলতে-টলতে গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলেই ওটা একটা বন্য জন্তু হয়ে যেত। দুটো পা বাইরে ঝুলিয়ে মাথার ওপরের রড ধরে রামনাম জপ করতে শুরু করে দিত আকাশলাল। হেডলাইট। অন্ধকারকে ফালাফালা করে ছুটত দুপাশে জঙ্গল রেখে। কতটা জোরে ওই জিপ ছুটতে পারে তা বোধহয় ওর নির্মাতাও জানত না। মদ খেলে মানুষটা কেন এত গতি চায়? এবং এই করতে গিয়েই জিপটা একরাত্রে নেমে এল পাশের মাঠে। জঙ্গল কম, বুনো লতাপাতা ভেদ করে। লাফাতে-লাফাতে শেষ পর্যন্ত আটকে গেল উঁচু ঢিবিতে। রাস্তা ছাড়ার সময় লাফ দিয়ে নিচে পড়েছিল আকাশলাল। সেই অবস্থায় জিপটাকেও মাতাল বলে মনে হয়েছিল তার। ওপাশে কোনও শব্দ নেই। হেডলাইটের আলোটা শুধু ঢিবির গায়ে স্থির হয়ে আছে। গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে পিচের রাস্তা এবং মনুষ্যহীন জঙ্গলমহল। হুড়মুড়িয়ে ছুটেছিল সে জিপটার কাছে। তারপর উদ্বেগে চিৎকার করেছিল, মালিক, মালিক!
কোনও সাড়াশব্দ নেই। মালিক স্টিয়ারিং-এ মাথা হেলিয়ে পড়ে আছে। প্রথমে ধক করে উঠেছিল। বুক। তারপর ঠোঁট নড়তে দেখে সে চিৎকার করল, মালিক, আপনি ঠিক আছেন?
কয়েকবার ডাকাডাকির পর মালিক হাত বাড়াল, ড্রিঙ্ক! হুইস্কি!
গলায় এমন একটা সুর ছিল যে সন্মোহিত হয়ে গেল আকাশলাল। গাড়ির খোপ থেকে বোতল বের করে হাতে দিতে গিয়ে দেখল মালিকের হাত উঠেছে না। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর মতো সে মালিককে মদ খাওয়াল। সেটা পেটে যেতে মালিক বলল, সাবাস! তারপর বেহুশ হয়ে পড়ল। আকাশলাল যেটুকু বুঝল তাতে নিশ্চিন্ত হল মালিকের শরীর ঠিকই আছে, রক্ত বের হচ্ছেনা। জিপটারও কিছু হয়নি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল যার ডাকে তাকে এখানে আশা করেনি আকাশলাল। দরজায় দাঁড়িয়ে মেমসাহেব হুকুম করল। তাড়াতাড়ি করো, আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে। মেমসাহেব আর দাঁড়ায়নি। তৈরি হয়ে দুদ্দাড় করে ছুটল সে। মেমসাহেব ঝি-এর হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে এলেন। একটু বাদেই। সঙ্কুচিত হয়ে স্টিয়ারিং-এ বসতেই মেমসাহেব বললেন, তুমি স্নান করো না?কী বিচ্ছিরি গন্ধ!
জি মেমসাব, রোজ করি। শুধু এটাই হপ্তাতে একবার কাচতে হয়। কোন স্টেশন যাব?
কেন, ফালাকাটায় চলো। ওখান থেকে সকালে ট্রেন পাব।
আকাশলাল কোনও কথা বলল না। হাইওয়েতে পড়ে নিবিষ্টমনে গাড়ি চালাবার চেষ্টা করতে লাগল সে! পথে কোনও কথা বলেনি মেমসাহেব। আগবাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেনি সে। এক্তিয়ারের বাইরে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি সে কোনওদিন, আজ কেন করবে?
ফালাকাটায় নেমে মেমসাহেব একশটা টাকা দিল তাকে, কলকাতার টিকিট কিনে নিয়ে এসো। জিজ্ঞাসা করো ট্রেন কখন আসবে?
খবর নিয়ে ফিরে এল আকাশলাল, এখন কোনও ট্রেন নেই মেমসাহেব। দুপুরের আগে কলকাতার কোনও ট্রেন নেই। টিকিট কাটব?
অন্য কোনও স্টেশন থেকে কলকাতার ট্রেন পাওয়া যায় না?
জানি না মেমসাব, তবে গিয়ে দেখতে পারি।
তাই চলো।
এপাশে যদিব্রডগেজ ওপাশেন্যারোগেজ লাইন। দুটোর মধ্যে ব্যবধান তিরিশ কিলোমিটার। আধঘণ্টায় পৌঁছে গেল তারা। ন্যারো গেজের স্টেশনের অবস্থা খুব খারাপ। লোক খুঁজে পেতে সময় লাগল। আকাশলাল ফিরে এসে জানাল, প্যাসেঞ্জার ট্রেনের আসার কথা বেলা বারোটায়। সেটা রোজ ছয় ঘণ্টা লেট করে।
মেমসাহেব খবরটা শুনে খুব হতাশ হলেন। তারপর নিজের মনেই বোধহয় বললেন, কিন্তু আমাকে কলকাতায় ফিরে যেতেই হবে। এখানে কোনও ভদ্রমানুষ বাস করতে পারে না।
আকাশলাল বিনীত গলায় বলল, আগে থেকে সিট রিজার্ভ করে তৈরি হয়ে এলে মনে হয় ঠিক হবে মেমসাব। এইসব ট্রেনে খুব ভিড় হয়, আমি দেখেছি।
খুব ভিড় হয়?
হ্যাঁ মেমসাব। মেয়েছেলের ইজ্জত ঠিক থাকে না।
মেমসাহেব চোখ বন্ধ করলেন। তার মাথা ঈষৎ পেছনদিকে ঝুঁকল। এই ভঙ্গি দেখে আকাশলালের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, তাকে খুব দু:খী-দুখী লাগছে এখন। অত ফরসা মুখে কালো ছায়া দুলছে। মেমসাহেব বললেন, শিলিগুঁড়িতে গেলে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এই ভয়টাই করছিল আকাশলাল। ওখানে গিয়ে পয়সা ফেললে বাঘের দুধও মেলে। সে হাউমাউ করে বলে উঠল, আপনি চলে গেলে মালিক বাঁচবে না মেমসাব।
সে কি এখন বেঁচে আছে? এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে? না, আমি বাপেরবাড়িতেই ফিরে যাব। ওর সঙ্গে থাকার কোনও প্রবৃত্তি নেই আমার। মেমসাহেব মাথা নাড়লেন।
আকাশলাল বলল, ঠিক আছে মেমসাব।
কথাটা শোনামাত্র মেমসাহেব তার দিকে চমকে তাকালেন। তারপর দৃঢ়গলায় প্রশ্ন করলেন, তুমি কি বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলো!
আকাশলাল খুব সঙ্কুচিত হল, কিছু না মেমসাব। আমি কি বলতে পারি।
তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। চলো, ফিরে চলো। আমি ওকে বাঁচাবার জন্যে ফিরে যাচ্ছি না, আমি নিজে বাঁচতে যাচ্ছি। আর মাথা নিচু করে থাকব না। উঠে এসো।
ফেরার সময় মনটা প্রসন্ন হল আকাশলালের।
বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই মেমসাহেব নেমে গেলেন। ব্যাগটা কাঁধে করে পৌঁছে দিতে গেল সে। এবং গিয়ে জানল মালিক বাড়িতে নেই। মেমসাহেব বাড়ি ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর থাকার জায়গা আলাদা করতে হবে, মালিকের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। মালিক। থাকবে নিচের তলায়, ঢোকার মুখে। এবং তারপর মেমসাহেব তাঁর নির্দেশটি জানালেন, আকাশলাল যেন মেমসাহেবের অনুমতি না নিয়ে জিপ না বের করে। এই বাড়ি ও সম্পত্তি মেমসাহেবের নামে আইনত লেখা। অতএব এখন থেকে সব কাজ তাঁর হুকুমেই চলবে।
এত রাগ কেন বুঝতে পারে না আকাশলাল। স্বামী ব্যবসা করত, টাকা আসত। ব্যবসা চোট খেল, টাকা গেল। স্বামী মদ ধরল। এসব তো নিত্যদিন ঘটছে। তাই নিয়ে এরকম ব্যবহার করার কি। মানে আছে! জিপের চাবি চলে গেল মেমসাহেবের কাছে। আর মালিককে খুঁজতে বের হল আকাশলাল। এই গঞ্জ এলাকায় মালিক বড় একটা কারও সঙ্গে আড্ডা মারত না। গাড়ি ছাড়া রাস্তায় হাঁটতে দ্যাখেনি সে এই কবছরে। কিছুক্ষণ পথে-পথে ঘুরতেই এলাকাটা শেষ হয়ে গেল। মেমসাহেবের ঝি বলেছে মালিক নাকি পায়ে হেঁটে বেরিয়েছে। ঘণ্টাখানেক বাদে গদাধরের সঙ্গে দেখা হল তার, এই যে আকাশভাই, তোমার নাকি চাকরি চলে যাচ্ছে?
চমকে উঠল আকাশলাল, তুমি কি করে জানলে?
আমার মালিক বলছিল। তোমার মালিকের সব চিচিং ফাঁক হয়ে গেছে। জিপটাও বিক্রি করবে।
জিপের মালিক মেমসাব, মালিক নয়।
ও সবই সমান, হাতের এপিঠ ওপিঠ। পুরুষমানুষই হল মেয়েদের পরিচয়। যাচ্ছ কোথায়?
মালিককে খুঁজতে।
হ্যাকহ্যাক করে হাসল গদাধর, তোমার মালিক মাল খাচ্ছে।
কোথায়? অবাক হল আকাশলাল। এই গঞ্জে মালিককে সে কখনও মদ্যপান করতে দ্যাখেনি।
কিছুটা অবিশ্বাসের গলায় সে প্রশ্ন করল কার বাড়িতে?
বাড়ি কেন হবে! বলে আঙুল তুলে ইশারা করে দেখাল পাঁচু শা-এর ভাটিখানাটাকে। বিশ্বাস করতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না আকাশলালের। এই ভাটিখানায় দিশি মদ বিক্রি করে পাঁচু। তার খদ্দের হল যত কুলিকামিন আর ট্রাক ড্রাইভার। দু-টাকায় অনেকখানি গলায় ঢালা যায়। মালিক কেন যাবে ওখানে?গদধর বলল, যাও যাও, গেলেই দেখা পাবে। চৌমাথায় সবাই গিয়ে দেখে এসেছে। দেখার মতো দৃশ্য বটে! এরপর আর অবিশ্বাসের কিছু থাকে না। আকাশলাল একটু ইতস্তত করল। তারপর পা চালাল। বড় রাস্তা ছেড়ে সরু গলি নেমে গেছে নিচে। দুপাশে। পরিত্যক্ত ড্রাম আর ছেঁড়া টায়ারের স্তূপ। উকট গন্ধ ভেসে আসছে ভেতর থেকে। পাঁচুর দোকানের সামনে বিশাল চালার নিচে ছেঁড়া মাদুরে বসে কুলিকামিনরা মদ খায়। সেখানেই দেখতে পেল মালিককে সে। পাজামা পাঞ্জাবি পরে একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। মুখটা লাল, সামনে প্রায় শেষ হওয়া বোতল পড়ে আছে। তাকে দেখতে পেয়ে কাউন্টার থেকে একজন চিৎকার করে বলল, পুরো আউট! হাঁটতে পারবে না!
আকাশলাল উবু হয়ে বসল, মালিক, মালিক, আমি আকাশ।
মালিকের কাঁধ ঝাঁকাতে মাথা টলল। এই মানুষকে নিয়ে সে বাড়িতে ফিরবে কি করে। আকাশলাল ছেড়ে দিল। তারপর কিছুটা দূরে চুপচাপ বসে রইল। এই সকালে মাল খেতে মোটেই ভিড় হয়নি। দু-একজন যারা আসছে তার বোতল কিনে ফিরে যাচ্ছে। এখন কারও মদ খাওয়ার সময় নয়। তারা মালিককে দেখে হাসছে। কিন্তু কিছু করার নেই তার।
দুপুর যখন পার হব-হব তখন মালিক চোখ খুলল। ইংরেজি ভাষায় কি সব বলল বিড়বিড় করে। তারপর পড়ে থাকা বোতলটা টেনে নিয়ে গলায় ঢালতেই লাফিয়ে কাছে চলে এল আকাশলাল, মালিক, আর খাবেন না মালিক।
হু আর য়ু? কে বাবা?
মালিক আমি আকাশলাল।
আকাশলাল! আমার বউকে নিয়ে ভেগেছ?
নেহি মালিক, এরকম কথা উচ্চারণ করবেন না। শুনলেও পাপ।
নিঃশব্দে হাসতে লাগল মালিক, তারপর বলল, পাপ? পাপ মানে কী? আমার বউকে নিয়ে তুমি ভেগেছ আকাশলাল, তোমাকে আমি মাটিতে টেনে নামাব।
মালিক, মেমসাহেব বাড়িতেই আছেন।
বাড়িতেই আছেন মানে? সে ফিরে এসেছে? হায় কাঁপাল! মালিকের চোখেমুখে ভীতি ফুটে উঠল, ও কলকাতায় চলে যায়নি?
নেহি মালিক।
ভাগ হিঁয়াসে। যা শালা, তোর মেমসাহেবের পা চাট। কেউ আমাকে বিরক্ত করবি না। এখানে তোকে কে আসতে বলেছে? সেই ডাইনিটা?
নেহি মালিক, আমি নিজেই এসেছি। এবার আপনি ঘর চলুন।
পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে ছুঁড়ে দিল মালিক, ঠিক হ্যায়, খানা লিয়াও চিকেন আউর রোটি।
মালিক, বাড়িতে গিয়ে খাবেন, আমার সঙ্গে চলুন। টাকাগুলো কুড়িয়ে ফেরত দিল আকাশলাল। তারপর সাহস করে মালিকের হাত ধরল।
তোমার ধান্দাটা কি বলো তো? আমার আর পয়সাকড়ি নেই, তোমাকে মাইনে দিতে পারব না। এবার কেটে পড়ো এখান থেকে। জিপটাকে শালা বিক্রি করে দিলে কিছুদিন চিন্তা করতে হবে না আমাকে। মালিক এবার আকাশলালের সাহায্যে উঠল, জিপ কোথায়?
বাড়িতে। মেমসাব চাবি নিয়ে নিয়েছে।
শালা হারামি। এখানে কি মুখ দেখাতে এসেছ? তুমি বিয়ে করেছ?
না মালিক।
কোনও মেয়েছেলের সঙ্গে শুয়েছ?
না মালিক।
আরে ব্যাস! এ তো দেখছি বুড়ো বয়সে ভার্জিন। হু-হুঁ বাবা, তোমার তো কোনও জ্ঞানই হয়নি। জন্মটাই বৃথা গেল। আমাদের আগের নেপালি ড্রাইভারটা, আরে যেটা ফিয়াট চালাত, পদম না কি যেন নাম, মনে পড়ছে?
হ্যাঁ মালিক।
আমার বউ-এর সঙ্গে শুতো। মাইরি বলছি। ওকে ছাড়তে চায়নি বউ, তোমাকে তাড়াতে চেয়েছিল। তুমি বুড়ো বলে কোনও আগ্রহ নেই, তার ওপর তোমার গায়ে বোঁটকা গন্ধ। তবে তুমি ভার্জিন জানলে কি করবে জানি না! মালিকের এবার হেঁচকি উঠল।
এসব কথা বলবেন না মালিক।
কেন বলব না? আমি আমার বউকে সুখ দিতে পারি না, বাচ্চা দিতে পারিনি এটা তো সত্যি। কথা। কারও দোষ না। ভগবান দেয়নি তাই আমি পারি না। কিন্তু কেউ যদি পারে তাহলে দেখতে দোষ কি এটাই বউটা বোঝে না!
মালিক! শিউরে উঠল আকাশলাল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে।
হিহি করে হেসে উঠল মালিক, মালু, মাল্লু, মাল্লু যদ্দিন থাকবে তদ্দিন সব চাপা থাকবে, ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নেচে যাও কেউ রা কাড়বে না, কিন্তু সেই ফতেবাবু হয়ে গেলে অমনি ব্যাঙাচিও লাথি মারবে। ঘাগুলো দগদগিয়ে উঠবে চাঁদ।
মালিককে নিয়ে পথে নেমেছিল আকাশলাল। লোকজন তাকিয়ে আছে হাঁ করে। মালিকের তাতে গ্রাহ্য নেই। বাড়ির কাছাকাছি এসে মালিক মাথা নাড়ল, না না, ওই হারামির বাড়িতে আমি যাচ্ছি না, প্রাণ থাকতেও না।
হতভম্ব আকাশলাল জানিয়েছিল, ওটা মালিক আপনারই বাড়ি।
সেকথাই তো বলছি। ওখানে আমি যাচ্ছি না। তোমার ওখানে চলল!
আমার ওখানে? মালিক আপনি কী বলছেন?
ঠিক বলছি আকাশলাল। তুমি আকাশ, আমার বউকে নিয়ে ভেগেছ, তোমাকে ঠিক বলব না? আমার বউ হল পায়রা, বকবকম পায়রা, ওড়ে তো আকাশেই।
আকাশলাল ভেবেছিল মালিক নেশায় আছে। সে বাধ্য হয়েছিল ঝিল-এর ধারে তাকে নিয়ে আসতে। ঘরে ঢুকে মালিক সতরঞ্চির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে বলেছিল, আঃ কি আরাম! তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। আকাশলাল ছুটে গিয়েছিল মালিকের বাড়িতে। মাথা নিচু করে মেমসাহেবকে জানিয়েছিল মালিক এখন কোথায় আছেন। মেমসাহেব ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিলেন, এখন। ভাটিখানায় জুটেছে! ছি! ও মদ নিয়েই থাকুক আকাশলাল। এ বাড়িতে না ঢুকলেই আমি শান্তি পাব। ও হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম জিপটাকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু পরে মত বদলেছি। চলুক না চলুক একটা গাড়ি থাকা দরকার। তুমি ওই ঘরটাতেই থাকো। যখন দরকার হবে ডাকব। বাকি সময়টা ইচ্ছে করলে অন্য কাজ করতে পারো।
আকাশলাল কথাটার অর্থ বুঝতে পারেনি সঠিকভাবে। মেমসাহেব কি তাকে ঠিকে হিসেবে রাখতে চাইছেন? নিয়মিত মাইনেপত্র দেবেন না? তাহলে তার চলবে কি করে? সে অবশ্য গদাধরের সঙ্গে পরামর্শ করে ট্যাক্সি ড্রাইভারি করতে পারে। কিন্তু এখন আর ওসব ধান্দা করতে একটুও ইচ্ছে করে না। সে মেমসাহেবকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করবে। তার টাকা পয়সা বেশি চাইনা। খাওয়া পরা আর খইনির পয়সা হলেই চলে যাবে। আকাশলাল ফিরে এল ঝিলের ধারের ঘরে। খিদেতে পেট জ্বলছে। সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। ঘরে এসে সে দেখতে। পেল মালিক নেই। আশেপাশে কেউ নেই যাকে জিজ্ঞাসা করবে হদিশ। আবার খুঁজতে বের হওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না আকাশলালের। সে ছাতু মেখে মুখে তুলল। ব্যাপারটা নিয়ে সে খুব চিন্তিত ছিল। এক মালিক ছিল, তাকে নিয়ে নিল আর একজন। সে যেন একটা খেলনা, যে যার ইচ্ছেমতো খেলাচ্ছে। এই সময় ঝিলের জলে বেশ শব্দ করে খেলা করে গেল মাছটা। তারপর সব শান্ত।
আর তখনই আকাশলাল আবিষ্কার করল দাগটা। পায়ের অনেকটা জায়গায় কালচে ছায়া পড়ছে। আঙুল দিয়ে ঘষলেও উঠছে না। বরং মনে হচ্ছে সাড়টা কম। ভালো করে ঝিলের জলে পা ধুয়ে এল সে। দাগটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। আকাশলালের মন খারাপ হয়ে গেল। এটা আবার কি ধরনের অসুখ!
মালিকের বাড়ি থেকে কখনও-কখনও ডাক আসে। সেদিন মেমসাহেব সেজেগুঁজে বসে থাকেন আগেভাগে। এখন তার প্রতি কড়া নির্দেশ গন্ধওয়ালা জামা পরে গাড়ি চালানো চলবে না। প্রথমদিন বিকেলবেলায় মেমসাহেব পাশে বসে বলেছিলেন, শিলিগুঁড়ি! পথে কোনও কথা হয়নি, শহরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হরি সাহার কাছে চলো।
চমকে উঠেছিল আকাশলাল। যে লোকটা মালিককে মেরে শাসিয়েছিল, পথে বসিয়েছে, তার কাছেই যেতে চাইছে মেমসাহেব। কিন্তু নির্দেশ মান্য করাই তার কাজ। পরিচয় দেওয়ার পর হরি সাহার কর্মচারী তাঁকে ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক বাদে মেমসাহেবকে জিপে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল হরি সাহা। হাত কচলে বলেছিল, আজ আমি কৃতার্থ। মন চাইলেই চলে আসবেন, আমি সবসময় আপনার সেবায় তৈরি আছি।
গাড়ি চললে মেমসাহেব আনন্দিত গলায় বলেছিলেন, সব মানুষই খারাপ নয় আকাশ, ভালো ব্যবহার করলে শয়তানও ঈশ্বর হয়ে যায়।
না, বাড়িতে কেউ আসত না। কিন্তু মেমসাহেবের বাইরে যাওয়া বন্ধ হল না। আজ হরি সাহা, কাল প্রতীম সিং পরশু বদরিনারায়ণ। এরা সবাই মালিকের ব্যবসার বন্ধু। মেমসাহেব যখন ফেরেন তখন তাঁর পাশে জিপে বসে গন্ধ পায় আকাশলাল। গন্ধটাকে চেনে। সেই সঙ্গে তার মনে একটা ভয় পাক খেতে থাকে। কবে মেমসাহেব স্টিয়ারিং কেড়ে নেবেন আর তাকে বসতে হবে। পেছনে পা ঝুলিয়ে! সেই অবস্থায় মেমসাহেব একদিন জড়ানো গলায় বলেছিলেন, তুমি খুব। ভালো আকাশ, খুব ভালো। কিন্তু তুমি মদ খাও না!
জি নেহি মেমসাব।
কেন খাও না?
ইচ্ছে হয় না মেমসাব। তাছাড়া পয়সাও নেই।
ওই লোকটা তো ভিক্ষে করে মদ খায়। দিশি মাল শুনেছি। ভোরবেলায় তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায় ভাটিখানায়, তুমি ওকে পয়সা দাও আকাশলাল?
জি মেমসাব।
কেন দাও?
মালিক চাইলে না বলতে পারি না।
কে তোমার মালিক? আমি না সে? তুমি হাতবদল হয়ে গেছ আকাশ, মনে থাকে যেন। ওকে আর পয়সা দেবে না।
মালিকের বড় কষ্ট মেমসাব। ঠিকমতো খান না। আমি আর কি খাওয়াতে পারি, ঝিলে মাছও নেই।
ঝিলে একটা পাকা মাছ আছে শুনেছি, ওটা আমার চাই।
ঠিক আছে মেমসাব। কিন্তু মাছটা বঁড়শি খায় না।
নিশ্চয়ই খাবে। খাওয়াতে হবে। তোমার মালিক যদ্দিন আমাকে বাইরে যেতে দেয়নি তদ্দিন আমি তাই জানতাম। ও নিজে পারত না বলে অন্যকে লেলিয়ে মজা দেখত। কিন্তু এখন আমি জেনে গেছি যত বড় মাছ হোক ঠিক মতন বঁড়শি ফেললে খাবে।
দুইজন দু-প্রান্তের। দু-প্রান্তেরই বা কি করে বলা চলে। পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝখানে সে। আকাশলাল অসহায় হয়ে পড়ে। মালিকের প্রতি তার কোনও দায় নেই তবু তাকে ছাড়তে পারে না। মেমসাহেব অবশ্য তাকে মাইনে দিচ্ছে এখন, কিন্তু সেটা মানতে পারে না সে। এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার মনটা এখন অসাড় হয়ে গেছে। কী করবে সে? চব্বিশ ঘণ্টায় খুব কম সময় মালিক হুঁশে থাকে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সব সময় পয়সা চাইলে হ্যাঁ বলে না আকাশলাল। খারাপ। লাগে তবু বলে না। আজ বিকেলে মালিক ছিল আধা শে। আর সেই সময় মাছটা ঘাই মারল। সঙ্গে-সঙ্গে সোজা হয়ে বসল মালিক, আকাশলাল, মাছটার ওজন কত হবে মনে হয়?
জানি না মালিক।
বিশ কেজি তো বটেই। তার মানে পঁচিশ করে হলে পাঁচশো। মাছটাকে আমার চাই। ধরে দাও আকাশ। তোমাকে একশো দেব। চারশোতে আমার দু-মাস আরামসে চলে যাবে। চোখ বন্ধ। করল মালিক আবেশে।
ও মাছ টোপ খায় না মালিক।
কিসের টোপ?
ময়দা, ফড়িং, কাঁঠালের কোয়া–কোনওটাই না।
ব্যাঙ ফেল, জ্যান্ত ব্যাঙ, যে ব্যাঙের গা থেকে গন্ধ বের হয়।
ব্যাঙ খাবে মাছ?
হ্যাঁ বাবা, আমি বাপের কাছে শুনেছি। বঁড়শিতে গেঁথে ব্যাঙ ফেল জলে। নড়েচড়ে বেড়াবে, মাছ বুঝতে পারবে না, ওটা গিললে বঁড়শি আটকাবে। ও মাছ আমার চাই আকাশলাল। তোমার একশো, একদম পাকা কথা। ফুর্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল মালিক। যাওয়ার সময় বলে গেল ছিপ সুতোবঁড়শি আছে ও বাড়িতে। মাছের বাপের সাধ্যি নেই সেই সুতো হেঁড়ে।
একশো টাকা! রোমঞ্চিত হল আকাশলাল। চারশো হাতে পেলে মালিক নিশ্চয়ই আর তাকে বিরক্ত করবে না কিছুদিন। আর একশো পেলে সে কয়েকটা ছোট বিলিতি কিনে ফেলবে। মালিককে লুকিয়ে। পায়ে বড় শক্ত হয়ে গেছে চামড়াটা। গরুর ঘাড়ের মতো। পুরো বোতল দিয়ে চামড়া ভিজিয়ে রাখলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে। হাঁটতে আজকাল কষ্ট হচ্ছে বেশ।
আকাশলাল মালিকের বাড়িতে এসে ছিপ বঁড়শি সুতো প্রার্থনা করল। মেমসাহেব হাসলেন, মাছটাকে ধরতে পারবে তো আকাশলাল?ভালো ফ্রাই হবে। সামনের বুধবার পার্টি আছে, আমি ফ্রাই খাওয়াব সবাইকে।
মালিক মাছটাকে চায় মেমসাব।
কে চায়? ওর চাওয়ার কোনও অধিকার আছে? মাছ ধরবে তুমি–তুমি আমার লোক, ও চাইবে কেন?তুমি কাকে দেবে আকাশ? ওকে না আমাকে?মদির হাসলেন মেমসাহেব। বুকের ভেতর চিতা জ্বলল আকাশলালের।
জি মেমসাব।
কত বড় মাছ?
বিশ কেজি।
আঃ! ছেলে না মেয়ে?
জানি না মেমসাহেব।
কাছে এগিয়ে এল মেমসাহেব, ওর নাকের ডগা দিয়ে ঝুলিয়ে আনবে মাছটা। তারপর আমি তো আছি আকাশলাল।
ব্যাঙ কোথায় পাওয়া যায়, যার গায়ে গন্ধ আছে! সে গন্ধ মাছকে টানবে। হ্যারিকেন হাতে রাতদুপুর পর্যন্ত ব্যাঙ খুঁজে বেড়াল আকাশলাল। কত রকমের ব্যাঙ চোখে পড়ল কিন্তু তাদের গায়ে তো গন্ধ নেই। খুঁজতে-খুঁজতে চলে এল ভাটিখানার পেছনে ডোবার ধারে। সেখানে পড়ে থাকা মদ ফেলে দেয় চাকর-বাকর। বোতল ধোয় জলে। গোটাচারেক ব্যাঙ পেয়ে গেল
আকাশলাল। নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দেখল গন্ধ ছাড়ছে যেন। মদমদমিঠে গন্ধ। মদ ধোওয়া। জলে বাস করে শালারা মাতাল হয়ে বসে আছে। পা চালিয়ে ঝিলের ধারের ঘরে ফিরে এল সে। মালিক পড়ে আছে চিৎ হয়ে, জ্ঞান নেই।
সকাল-সকাল তোড়জোড় শুরু করল আকাশলাল। যেখানে জল গভীর তার কাছে পাড়ে সে। বঁড়শি ফেলল জলে। ব্যাঙের পেটের কাছে এমন ভাবে বঁড়শি ঢুকিয়েছে যাতে একটুও অস্বস্তি না হয় ওটার। বঁড়শির এক বিঘৎ ওপরে সিসে বেঁধেছে। বেশ কিছুটা দূরে ব্যাঙটা জলের তলায়। খেলা করছে। ফাৎনাটা তালে-তালে ঘুরছে। এক দৃষ্টিতে চেয়েছিল আকাশলাল। ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল, মাছটার কোনও চিহ্ন নেই, এর মধ্যে মালিক ঘুরে গেছে–খাচ্ছে? ঠোকরাচ্ছে?
না মালিক।
খাবে, ঠিক খাবে। আমি খদ্দের ধরতে যাচ্ছি। চারশো টাকা।
মালিক যাওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে মেমসাহেব এল। সে উঠে দাঁড়িয়েচ্ছিল। মেমসাহেব বলল, আহা বসো বসো। মাছটা ধারেকাছে আছে?
জানি না মেমসাব।
ধরতে পারলেই ডাকবে। আমি জ্যান্ত দেখতে চাই ওকে। খুব সুন্দর একটা জিনিস দেব তোমাকে। সে কোথায়, তোমার আগের মালিক?
খদ্দের দেখতে গেলেন মাছটার জন্যে মেমসাব।
দেখাচ্ছি খদ্দের। আমি তোমার মালিক মনে থাকে যেন।
তারপর আরও দুঘণ্টা কাটল। নির্জন ঝিলের ধারে হাওয়া বইছে। চোখ টনটন করছে ফাত্রার দিকে চেয়ে-চেয়ে। মাছটার কোনও পাত্তাই নেই। একবার বঁড়শি তুলে দেখেছে ব্যাঙটা দিব্যি আছে। ক্রমশ মনে হতে লাগল এই টোপ খাবে না মাছটা। কিন্তু কে অপেক্ষা করবে সন্ধে পর্যন্ত! দুটো মানুষকে দুঃখ দিতে পারবে না সে। দুটো লোকই চায় মাছটা উঠুক, সে চেষ্টা করে যাবে। কিন্তু খিদেতে এক সময় অবসন্ন বোধ করল সে। অথচ ছিপ ফেলে ওঠাও যাবে না। ঘুম পাচ্ছে। তার।
বুদ্ধি করে ছিপের ডগা থেকে সুতোটাকে খুলল আকাশলাল। তাতে ফাত্রাটা একটু কাঁপল মাত্র। তারপর সুতোর প্রান্তটা বাঁধল নিজের পায়ে। যেখানকার চামড়া শক্ত এবং কালো সেখানে। বাঁধনটা পড়তে তার ব্যথা লাগল না। নিশ্চিন্তি। এবার টানটান শুয়ে পড়া যাক। টোপ গিললেই সে জেগে যাবে।
চিৎ হয়ে শুয়ে সে আকাশটাকে দেখতে পেল। রোদ নেই। ঘোলা হয়ে আছে। হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হবে নাকি? আকাশলালের ক্লান্তি শিরায়-শিরায়। ঘুম এল লাফিয়ে। সমস্ত চরাচর তখন শব্দহীন। জলে ঢেউ কাঁপছে বাতাসের খেয়ালে।
হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান লাগল শরীরে। ঘুম-ভাঙা-হতভম্ব আকাশলাল বুঝতে না বুঝতে অনেকটা নেমে এল জলের ধারে। ঘোর কাটতে উবু হয়ে শক্ত কালো চামড়া থেকে টনসুতোর বাঁধন খুলতে গিয়ে আবার টান এল। সরসরিয়ে তার শরীরটা নেমে যাচ্ছিল নিচে। প্রাণপণে সে কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইল। কয়েক মুঠো ঘাস নিয়ে সে আছড়ে পড়ল জলে। ব্যাপারটা এমন। আকস্মিক যে একটা চিষ্কারও তার গলা থেকে বের হল না। একটানে অনেকটা জলের তলায় গিয়ে আলগা হল সুতোটা। বাতাসের জন্যে ছটফটিয়ে ভেসে উঠল আকাশলাল। চোখ মেলে। দেখল পাড় অনেক দূর। তখন হ্যাঁচকা টান। কাঠির মতো ডুবে গেল তার শরীর। জলের মধ্যে কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড শক্তিতে। চোখে ঘোলা জল। হাঁ করতে তাই ঢুকে গেল। পেটে। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আকাশলাল প্রাণপণে ওপরে উঠে এল। তার চোখে অন্ধকার।
বাতাস ঢুকল বুকে। ঝিলের মাঝখানে সে। আবার টান এল। শরীরটা পেছনে পা সামনে ছুটে যাচ্ছে। এইসময় চেতনার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে সে মাছটাকে দেখতে পেল। চোয়াল শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাণপণে সুতোটাকে ছাড়াতে চাইল সে মাছটার শরীর থেকে। মাছটা ভয় পেল। জলজ শ্যাওলার মধ্যে সে ঢুকে যেতেই আকাশলালের শরীরটা এলিয়ে পড়ল। ছেঁড়া কাগজের মতো ভাসতে-ভাসতে শ্যাওলার মধ্যে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।
সিসেটা আটকে গিয়েছিল দাঁতে। মাছটার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ ইতিমধ্যে তার মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল। একটা সুগন্ধী ব্যাঙকে কপাৎ করে গিলে ফেলতেই অতবড় একটা ওজন তাকে টানতে হবে সে ভাবেনি। মরিয়া হয়ে এতক্ষণ ঝিলময় ছুটে বেরিয়েছে সে। কিন্তু কিছুতেই ওজনটা তাকে ছেড়ে যায়নি। শেষপর্যন্ত সে কারণটা বুঝতে পারল। ওই নেতিয়ে পড়া মানুষটার সঙ্গে সে এক। সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে। বাঁচতে হলে সুতোটাকে খুলতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে বোঝা গেছে। সুতোটাকে ছিড়বার সাধ্য তার নেই। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি হচ্ছিল অন্য কারণে, তার গলার কাছে ব্যাঙটানড়ে বেড়াচ্ছে। ওটাকে বের করে দিতে পারলে খুশি হত সে। তার এমন যন্ত্রণার সময় ব্যাঙটা নড়ছে কেন? সে ওটাকে গিলতেও পারছে না শক্ত সিসের জন্যে। মাছটার হাঁফ ধরে গিয়েছিল। এই ঝিলের সম্রাট সে। চেহারায় অহঙ্কার আছে। সে মানুষটার শরীরের কাছে এসে লেজ দিয়ে একটা আঘাত করল। নরম কাদায় মানুষটার মুখ সামান্য নড়ল মাত্র। এবার মাছটা সুতোর অন্য প্রান্ত দেখতে পেল। মানুষের পায়ে বাঁধা আছে। টানাটানিতে আরও টাইট হয়ে গিয়েছে। কয়েকবার আঘাত করা সত্বেও সুতো ছিঁড়ল না। সে আবার সাঁতরাতে লাগল। শ্যাওলার বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের শরীরটাকে তার এবার বেশি ভারী লাগল। যতক্ষণ মানুষটার প্রাণ ছিল ততক্ষণ তাকে টেনে বেড়ানো সহজ ছিল। তবু বন্ধনমুক্তির আশায় মাছটা সমস্ত ঝিলময় ছোটাছুটি করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে বিশ্রামের জন্যে একসময় শান্ত হল। তবে এই ভেবে সে স্বস্তি পেল, আর যাই হোক মানুষটার ক্ষমতা নেই তাকে আক্রমণ করার। শুধু গলার কাছে ব্যাঙটা যদি না থাকত! কত সময় কেটেছে মাছটা জানে না। এরমধ্যে। প্রয়োজনে সে ওপরে উঠেছে, বাতাস নিয়েছে। মানুষটা শুয়ে আছে তেমনি, একাকী। মাছটা তার ঘ্রাণ নিয়েছে। সুতোটা খুলে গেলে সে একবার দেখবে মানুষটাকে খুবলে। ক্রমশ ওর গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। লোভনীয় খাবার বলে মনে হচ্ছে। অনেকদিন পেট ভরাবে মানুষটা। শুধু সুতো খুলতে যা দেরি, ক্লান্ত মাছ ঘোরের মধ্যে ছিল, হঠাৎ সে টান বোধ করল। কেউ তাকে। ওপরদিকে টানছে। চকিতে প্রতিরোধ করল সে। কিন্তু ওপাশের শক্তি বেশ বেশি। বিহুল হয়ে সে দেখল নিচে শ্যাওলার মধ্যে শরীরটা নেই। সে টান লক্ষ করে ওপরে উঠে দেখল মানুষটা আরও ফেঁপে ফুলে ওপরে ভাসছে। জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের শক্তি যে এত বেশি আবিষ্কার করে মাছটা আবার ছুটতে শুরু করল। তার খুব কষ্ট হচ্ছিল, কারণ ওই মানুষটা কিছুতেই জলের তলায় নামতে চাইছিল না। মাছটা আরও কাহিল হয়ে পড়ছিল। শরীরটা ডুবছে আর ভাসছে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল সে। তার বোধ হল মানুষটা তার শত্রু নয়, সে মানুষটার নয়, সর্বনাশ করেছে সুতোটা। এইটে থেকে মুক্তি পেলে ওরা দুজনেই বেঁচে যেত।
লগি দিয়ে টেনে-টেনে আকাশলালের বীভৎস শরীরটাকে তীরে নিয়ে আসা হল। যারা ভিড় করে কাণ্ডটা করছিল তারা আকাশলালের চেয়ে নিঃস্ব মানুষ। উৎসাহটা তাদেরই বেশি। মালিক। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। আকাশলালের বাক্সপ্যাঁটরা ঘেঁটে তিন হাজার টাকা পাওয়া গেছে। মাছ ধরতে গিয়ে লোকটা মরে গেল। চারশো টাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে লোকটা তিন হাজার দিয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল, সত্ত্বার খরচা আমার। পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তারপরেই হিসেব করে নিল দুহাজার নয়শো পঞ্চাশে তার কতদিন চলবে। ঠিক অত টাকা নেই। কাছে, কারণ মৃত্যুর খবর আর অর্থপ্রাপ্তির পর সে উদার হয়েছে। দিশির বদলে আশি টাকা দিয়ে বিলিতি কিনে এনেছে। সেইটে হাতে নিয়ে সে উৎসাহ দিচ্ছিল এবার দেহটাকে টেনে তুলতে।
এইসময় মেমসাহেব এলেন। তাকে দেখে পথ ছেড়ে দিল অধনগ্ন মানুষগুলো। মেমসাহেব আকাশলালের শরীরটার দিকে তাকিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললেন, আহা বেচারা! ওর সকারের টাকাটা আমি দেব।
না, আমি। চিৎকার করে উঠল মালিক।
মেমসাহেব ঠোঁট বেঁকালেন। দেহটাকে তোলা হল। ফুলে পচন শুরু হয়েছে। এবং তখনই একজন আবিষ্কার করল ওর পায়ে সুতো বাধা। কালো পুরু চামড়ায় সেটা বসে আছে। মেমসাহেব তিনহাত পিছিয়ে গেলেন, ইস, কি গন্ধ!
মালিক এগিয়ে এল, গন্ধ বন্ধ করে দিচ্ছি, কয়েক পেগ না হয় যাক। তারপর বোতলের মুখ খুলে কিছুটা মদ ছড়িয়ে দিল আকাশলালের শরীরে। এবং পুরু কালো চামড়ায় পড়ল কয়েক ফোঁটা।
মেমসাহেব বললেন, হঠাৎ দেখছি বিলিতি?
মালিক বলল, আরও অনেক কিছু দেখবে–যেমন দেখাচ্ছ!
দেখাবই তো! চাপা গলায় বলল মেমসাহেব, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
আড়চোখে মেমসাহেবের পেটের দিকে দেখে নিয়ে মালিক বলল, তাই? এইসময় হইচই উঠল। কয়েকটা হাতের টানে সুতো উঠে আসছে। এর শেষতক মাছটাকে দেখা গেল। কয়েকজন নেমে গেল জলে। মাছটা কোনও প্রতিবাদ করল না। হয়তো তার সেটা করার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। আকাশলালের মৃতদেহের পাশে সেই বিশাল মাছটাকে ফেলে দিতেই সে কয়েকবার শেষ চেষ্টা করল লাফাতে। ভিড়টা ভয় পেয়ে ছিটকে গেল দূরে। কয়েকবার আছাড় খেয়ে মাছটা। আকাশলালের শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ আকাশলালের পাশ থেকে সরিয়ে আনল তাকে দুজন।
মালিক নিজের মনে বলল, বড্ড পাকা মাছ, বিক্রি হবে না।
মেমসাহেব মাথা নাড়ল, ফ্রাই-এর মাংস হবে না।
মালিক বলল, তুমি পঁচিশদাও, আমি পঁচিশ দিচ্ছি।
মেমসাহেব ভুরু তুলল, কেন?
সৎকারের জন্যে। কপালে পুণ্যি হয় শুনেছি।
আধাআধি পুণ্যি!
মালিক চিৎকার করে বলল, কেটে ফেল মাছটাকে।
সঙ্গে-সঙ্গে ছুরি এসে গেল। ঝপাৎ করে কোপ পড়ল পেটে। গলগল করে রক্ত এসে পড়ল মৃত শরীরের পাশের মাটিতে। একজন সন্তর্পণে বঁড়শিটাকে বাঁচাতেই বোধহয় মাছের মুখ ফাঁক করে সিসে খুলে সুতোটাকে টেনে ছুরি চালিয়ে বঁড়শি আলগা করতেই ব্যাঙটাকে দেখা গেল। মানুষেরা হেসে উঠল, কারণ ব্যাঙটা বেঁচে আছে এখনও।
সন্তর্পণে তাকে মুক্ত করে মাটিতে ফেলে দিতেই সে কয়েক মুহূর্ত নিশ্ৰুপ পড়ে রইল। তারপর নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে লাফ দিতেই মৃত মাছটার শরীরে গিয়ে পড়ল, প্রবল উৎসাহে দ্বিতীয় লাফটা তাকে টেনে নিয়ে এল আকাশলালের গলায়। এবং অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর এখন ব্যাঙটা পরিচিত গন্ধ পেল। ভিজে-ভিজে মদের জল সে চুকচুক করে চেটে নিল জিভে। তৃতীয় লাফে সে নেমে গেল ঝিলের জলে। মেমসাহেব চাপা গলায় বললেন, তোমার নোংরা জামা থেকে আকাশলালের গন্ধ বের হচ্ছে।
মালিক হাসল, তোমার কথায় আঁশটে গন্ধ, মাছটার মতো।
মেমসাহেব চকিতে সেদিকে তাকালেন। তারপর অজান্তে একটা হাত উঠে গেল পেটে। সেখানে এক দুই এবং তৃতীয় লাফ দিয়ে কেউ শান্ত হল। আপাতত।