কল্যাণী (Kalyani) : 04
সেদিনই-বেলা নটার সময়।
কল্যাণী দোতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে কি যেন পড়ছিল।
গুণময়ী বললেন—কি পড়ছিস রে?
—একটা নভেল।
—তোর বাবা তোকে ডাকছেন—
—আমি পড়ছি
গুণময়ী একটু বিস্মিত হয়ে বললেন—পড়ার বই তো নয়—
—তা নাই বা হোক পড়ছি তো–
—বাঃ
আমি যাব না
—আঃ কি যে বলে কল্যাণী।
—বলো গিয়ে বাবাকে যে আমি যেতে পারব না
—দিক করিস নে—চল্–বাগানে অপেক্ষা করছেন
—কোথায় অপেক্ষা করছেন?
—বাগানে
—বাগান আবার কোথায়? বাগান! একটা কামিনী গাছ আর দু’টো বকুল গাছ নিয়ে বাগান! ক্যানার ঝাড় নিয়ে বাগান! বাগান!
কল্যাণী উঠে দাঁড়াল — বললে—কিসের জন্য ডেকেছেন?
— জানি না।
—চুরুট খাচ্ছেন তো?
— কি যে বলিস কল্যাণী
কল্যাণী বললে—নিজের বেলায় বাবার কিছুতেই কিছু না—আর একটু ঘুমুচ্ছিলাম বলে তিনি আমাকে বললেন কলকাতার থেকে এসেই অনাচার আরম্ভ করেছ—অনাচার শব্দের মানে কি তা তিনি জানেন যে বড় নিজের মেয়েকে অনাচারী বলছেন।
বাগানে ধীরে ধীরে গেল কল্যাণী—মার সঙ্গে। একটা বকুল গাছের নিচে বেতের চেয়ারে বসেছিলেন পঙ্কজবাবু।
গুণময়ী বললেন—তা যা; তা যা। জমিদার মানুষ—একটু চুরুট খান। কিন্তু এই ত্রিশ বছর ধ’রে তো আমি দেখে আসছি—এ ছাড়া আর কোনো বদ অভ্যাসই তাঁর নেই। এমন সৎ ধার্মিক লোক আমি আমার জীবনে দেখিনি —
গুণময়ীকে বললেন–আচ্ছা যাও তুমি।
গুণময়ী অন্দরের দিকে চলে গেলেন।
বেতের চেয়ার মোড়া ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল কয়েকটা; কল্যাণী একটাতে বসল। পঙ্কজবাবু বললেন—তুমি কলকাতায় যাবে কি আর?
—কেন যাব না?
—পরীক্ষা দেবে?
—নিশ্চয়ই দেব বাবা
—বলেছিলে যে তোমার চোখের অসুখ হয়েছে—
—তা হয়েছিল—
—কৈ, চশমা তো দেখছি না
—সে রকম অসুখ নয়—
পঙ্কজবাবু বুঝতে পারছিলেন না—
কল্যাণী বললে—সাধারণত স্মেলিং সল্ট শুঁকতাম; কপালে উইন্টো ঘষতাম; ক্যাফি অ্যাসপিরিন কয়েক ফাইল খেয়েছি; নিউরেলজিয়া হয়েছিল—
—নিউরেলজিয়া?
—হ্যাঁ বাবা।
—চোখ খারাপ হয়নি?
—না বাবা।
—চোখে স্পষ্ট দেখতে পাও?
—পাই তো
–পড়তে গিয়ে কোনো কষ্ট হয় না?
—না
—চশমা লাগবে না তা হ’লে?
—না
—চোখের অসুখ নয় বলছ?
—না, চোখের অসুখ নয়—
—ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
–না, কি দরকার?
—আচ্ছা চলো আজ এক ডাক্তারের কাছে—
—এখানে?
—হ্যাঁ, আই-স্পেশ্যালিস্ট তিনি
কল্যাণী বললে—আমি বললামই তো চোখের অসুখ নয়—
—দেখানো ভালো
—এই গেঁয়ো হাতুড়ের কাছে? তা হবে না।
কল্যাণী বললে—চোখ কি মানুষের এতই সস্তা?
পঙ্কজবাবু বললেন—অকুলিস্ট-বিলেত থেকে পাস করে এসেছেন—
কল্যাণীর একটু সম্ভ্রম হ’ল : বললে—তবুও—কলকাতায় গিয়ে দেখালে ভাল হত না?
পঙ্কজবাবু বললেন—আমার গাড়ি ঠিক রয়েছে—তুমি চল
—এখুনি?
—হ্যাঁ
দু’জনেই গেল।
এগারোটার সময় বাড়িতে ফিরে এসে কল্যাণী বললে—আমার এত যে চোখ খারাপ তা তো বুঝিনি বাবা—
গুণময়ী বললেন—খুব খারাপ?
পঙ্কজবাবু বললেন—চোখ দু’টো আধাআধি নষ্ট হয়ে গেছে—
গুণময়ী অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে বললেন—অন্ধ হবে না তো?
কল্যাণী হো হো করে হেসে উঠল।
বললে—কি বল যে তুমি মা! দেখ তো বাবা মা কি রকম ভয় পেয়ে গেছে—
পঙ্কজবাবু বললেন—তোমার মাইনাস সেভেন—ডাবল লেন্স লাগবে—অ্যাস্টিগ্মাটিজম রয়েছে—
কল্যাণী বললে—কিন্তু এত সব কি করে হ’ল—আমি কেন বুঝিনি বাবা?
পঙ্কজবাবু একটা ঢোঁক গিলে একটু পরে বললেন—সেই জন্যই তো তোমাকে আর ছেড়ে দেব না ভাবছি
—তার মানে?
—আর পড়াশুনা ক’রে কি করবে কল্যাণী?
—সে কি কথা বাবা!
গুণময়ী বললেন–ঠিকই তো বলেছেন উনি—এমন চোখ নিয়ে তুমি কি পড়বে আর —আমি পড়বই।
পঙ্কজবাবু বললেন—বাড়িতে বসে এক আধটু পড়তে পার–
আমি কলেজে পড়ব।
পঙ্কজবাবু হেসে বললেন—না তা পড়বে না; তার কোনো প্রয়োজন নেই।
বাবার মুখে কেমন একটা নিরেট নির্মম শাসন দেখা দিল—সেই সকাল বেলাকার মত, যখন বিছানার থেকে কল্যাণীকে উঠতেই হল-—
কল্যাণী বললে—না, না, আমি ছোড়দার সঙ্গে কলকাতায় যাবই
—তাই বল—কলকাতায় যাবে; (কলকাতায় যাবে—কোনো নিয়মের ভিতর থাকবে না—) ফূর্তি করবে, –কিন্তু পড়াশুনা তোমার আর হবে না।
কল্যাণী আঁচল কামড়ে ধরে বললে—আমি পাস করবই—
গুণময়ী শঙ্কিত হয়ে বললেন—পাস! সেই গুষ্টির বই গেলা বসে বসে আর চোখ খোয়ানো!
পঙ্কজবাবু বললেন—পাস না করলেও তোমার চলবে।
কেমন নির্মম হৃদয়হীনভাবে বললেন তিনি।
কল্যাণী কাঁদ কাঁদ বললে—এ কি কথা তোমরা সকলে মিলে বলছ আমাকে!
সে কেঁদে ফেলল—
গুণময়ী বললেন–থাক, যেও কলকাতায়– কিন্তু
পঙ্কজবাবু কল্যাণীর ঘাড়ে হাত রেখে তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন–না, মেয়ে আর কলকাতায় যাবে না; বাবার কাছে থাকবে—মায়ের কাছে থাকবে—চোখ ভালো হয়ে যাবে..
কল্যাণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললে—আমি যাবই—আমি কলেজে পড়বই—আমি পাস করবই—
শেষ পর্যন্ত সে কলকাতায় গেল বটে।